পান্থগৃহের উঠোনে/দুই

 বহুদিন হয়, মন্দিরে বাঁচি। কোন ভুলে তবে বেঁধে দরোজা মুক্তি তারই সাধ করে যাচি?
সে মন্দিরে বেঁধে ঘর ইষ্টদেবতা আড়াল করি কোন শপথে? খুঁজতে নিজেকে
লুণ্ঠিত ধন করি যে আপন, চারদেয়ালে হই বন্দি, মুক্ত হওয়ার স্বপন দেখি!
এসব নেশা আর বুঝি না। বন্ধু, এবার এসো পানশালায়, খুন হয়ে যাই বাঁচার নেশায়!


বেদনা যখন ভারটা বাড়ায়, অশ্রু ঝেরো না, ভারটা কেবলই বাড়বে ওতে।
কুয়াশা-উঠোনে, রৌদ্র যেখানে ঘুমিয়ে থাকে, সেখানে এসো, এসে হাত ধরো,
রাজ্য যেটা হারিয়ে গেছে রাজা নেই বলে, সে রাজ্যটাকে ফিরিয়ে আনো,
এই শুভক্ষণে পান করে সুরা জাগিয়ে রাখো ওই হৃদয়টাকে।


আছেন ঈশ্বর সুরার সুরে, নেশার পেয়ালায়---খুঁজে পায় তাঁকে বিশ্বাসী কেবল।
সুরার কত রকমফেরে রুচির প্রভেদ ঘোরে ফেরে, পান করে যে, সে-ই শুধু জানে, কোনটা দারুণ কেমন করে।
কেউ মধু টানে, কেউবা সুরা; কেউ সুরে ভাসে, কেউবা বেসুরে,
সুরে বেসুরে, ভাসুক যেখানেই, যে যতটুক, জীবন মেপেই মৃত্যু সরে ঠিক ততটুক!


খুললে সরাই, ভুলটা কী, বলো? পান না কর, পানটা দেখো, চোখ ভরিয়ে স্বপন মাখো,
সুরার শেকলে বাঁধলে হৃদয়, মনটা কেবল সুরাই যাচে, সুরায় নাচে,
হলে ক্রীতদাস জয় এসে যায় সুরা-কটোরায়! সাকি এসে বলে,
“বন্ধু, এখন এই পৃথিবী তোমার হল! দৃষ্টি ফেরাও, ভাগ বুঝে নাও, নিমিষে হারাও!”


এক সবুজ ঘরে মদের ঘোরে পড়ল বাঁধা আলোর পথিক,
কষ্টদীপের সোনালি আলোয় আনল শেকলে সুখের রেখা।
স্বর্গ আসে রাস্তা থেকেই, দেবতার ঘরে ফাঁকিই কেবল!
হৃদয় ধরো, হৃদয় পড়ো, হৃদয় বোঝো---স্বর্গ পাবে!


সুখের যে রথ, পথভুলে আসে বছর ঘুরে কানাগলি ধরে,
যে মালা পোড়ে চোখের জলে, সে মালা গাঁথি সুখের ফুলে।
হাঁটো পৃথিবী, চেয়ে দেখো দূরে, কাছের যা কিছু কেমন ফাঁকি!
ক্লান্তি জুড়োতে, শ্রান্তি ফুরোতে, কষ্ট বুড়োতে ক্ষণিক সুখের মত্ত ফোয়ারা রেখো অলখেই!


সেই মাতাল প্রহর ভাঙার ক্ষণে কে যেন এসে শরাব দিল.........
সাকি নয় সে, অন্য মানুষ; তাইতো বুঝি সুরার স্বাদটা ঘোলেই মাটি!
কিছু লোক দেখি, বেঁচেই সুখী! কিছু লোক দেখি, না মরে দুঃখী!
পান্থগৃহের মাড়ালে উঠোন যা মেলে হেসে, তার নেশাতেই অচিন দেশে জীবনখেয়া সুরেই মেশে!


সুরার যে ঘর, রেখে দিয়ো তাকে হৃদয়মাঝে, করো উষ্ণ ওই নিজেকে যখন দিব্য ভাঙে শীতল রাতে।
কাদার শরীর আলোয় ভরো, মনের বঁধু মধুয় মেখো, দৃষ্টিটুকু ছড়িয়ে দেখো, পথের রত্ন যত্নে রেখো।
মন্দিরে আজ লোকারণ্য, হায়, কেউ নেই তবু! তাই প্রার্থনা নেই, নেই নিবেদনও।
গুঁড়িয়ে প্রাসাদ প্রসাদ ছড়াও, ভাঙো নিদ্রা, আসুক আলো, জাগুক আত্মা, মাতুক গৃহতল।


আমায় ভাবো---দেখছ যেমন, নয়কো তেমন; যেমন দারুণ হতে পারতেম, তেমন করে!
মানুষ বোঝো হৃদয় বুঝে, সুখকে খোঁজো দুঃখ খুঁজে, আলোয় মাতো আঁধার যুঝে।
বন্ধু, আমায় আর ডেকো না পানশালাতে, এখন কেমন জীবন দেখে ক্লান্ত লাগে!
যে দেবতা বাইরে বাঁচেন, রেখো না তাঁকে আর বাঁচিয়ে মনের মাঝে।


সূর্য যখন মধু ঝরায়, সিন্ধু তখন অল্প ছড়ায়---জল কমে যায়, স্থল বেড়ে যায়,
শরাব হাতে মেঘকে দেখি, আমায় দেখে সুযোগ বুঝে হয় সে সাকি, মধুর স্রোতেই মধুর আবাদ---বুঝল কে তা!
বর্ষাশেষে শরাব নিয়ো, শুকনো হৃদয় সুরায় ভরো, খেয়ালে সাকির ছন্দে নেচো---জীবন এটাই!
জেনো বন্ধু, ক্ষুধার আগুন নেভে নাতো ফুলে! বর্ষা এলে ধানের গোলায় আগুন মেখো---আরাম পাবে।


যে প্রার্থনায় তারারা কাঁদে, যে পেয়ালায় মধুই বাঁধে---
সে প্রার্থনায় সাগর নাচাও, সে পেয়ালায় অমৃত ঢালো সাগর সেচে।
জেগে ওঠো সাকি, ঘুমিয়ো না আর, চেয়ে দেখো, কত তৃষ্ণা জমেছে তোমার দুয়ারে!
এই সাগরতটেই স্বর্গ নামে, পৃথিবী থামে কী ইশারায় বালুকা ঘেঁষে---বুঝতে এসো!


কারও ঠোঁটে দেখি, বিষ-পেয়ালা ঝরে পীযূষে, কারও-কারও ঠোঁটে পীযূষ ঢেলে বিষই মেলে।
শরাবের কী দোষ যদি দেহের পরশে মনের তৃষ্ণা বিষেই মেটে?
আর কেউ নয়, সাকিই পারে ঢালতে শরাব সুধার মতন,
চোখের ঠিকানা দৃষ্টিতে নয়---সাকির যাদুতে, মদের মধুতে।


আজ যে চারা করেছ রোপণ, কাল তা ছড়াবে মধুর ছায়া।
পেয়ালাটা আজ সাজিয়েই রেখো---কাল সে পেয়ালা সাজবে শরাবে ছায়ার গুলাবে,
চাওয়ার কত প্রভেদ ভাসে, সেই প্রভেদে মধু কিবা শরাব আসে---
দুইই তো একই---নেশা যার যাতে, যে যাতে হাসে!


পূর্ণতা এক পেয়ালাভরা চায়ের মতন---প্রতি পেয়ালাই সমান যাদুয় ঠোঁটকে টানে.........
এমন পানে হঠাৎ করেই মাতাল লাগে, সন্দেহ হয়---এ ভুল নাতো?
যাদের আছে সুধার খনি, চূড়ায় তাদের বিদূরমণি---তাদের কাছেই সবাই ছোটে। তাদের দেখি,
সকাল হতেই সাকির ডাকে ঘুমের ফাঁকে দিনের প্রথম কিরণ মেখে মাতাল হওয়ার পথে নামে প্রতিদিনই।


পুরনো নেশা ভেঙে যায় যদি নতুন এসে রাজ্য গড়ে,
জীবনের ক্রোধ, বাঁচার যে শোধ---ফুরোয় সবই।
বিলাপ কি জহর, একএক করে সবই আসে কী অবরোহে---নেশার নাকি?
সূর্যটাও ঘুমোয় যখন, তখনই জাগে পান্থগৃহের উঠোনখানি!


যে সুরা নেয়, সে-ই তো বোঝে, কী দাম আলোর!
আঁধার এলেই মধুর প্লাবন, সুরের শ্রাবণ, সুরার স্খালন,
আলো না আসুক, কোনও ক্ষতি নেই, এ ঘর জুড়ে নামুক আঁধার।
কিছু না এলে এরপরে যে আসে না কিছুই! আঁধার আসুক---আঁধার এলেই আসবে আলো।


চেয়ে দেখি ফিরে, কোত্থেকে এলো কী এক আলো আমায় ঘিরে!
ফিরে চাইলাম, অজানা আলোর কোন যাদুতে চোখ ধাঁধালো,
পথ নেই তাই পথ দেখে যাই, সুখ নেই তাই কষ্ট মাতাই,
কেউ যেন আসে পথ ধরে এক, চোখের সামনে দিবারাত্রি সে পথই হাসে।


কী হল আজ! পানের পেয়ালা উপচে নাচে জীবন-আঁচে!
জীবনের দায়ে মৃত্যুপ্রসব, বাঁচার তাগিদে মরণযাপন---সুর ও সুরার সেতুর কাঁপন---জীবন এমন!
আজ পেয়ালাটাকে সামলে নিয়ো সাকির আমন্ত্রণে, জীবনটাকে বাজিয়ে বেঁচো রাতের নিমন্ত্রণে।
স্বপ্নমিছিল! পুরোভাগে তার পসারী-বীণার ধ্রুব সংকেত! তা দেখে তুমি অন্ধ হয়ো না, বুঝেই ছোটো!


কষ্ট দিলে দিয়ো নিজেকেই---ওর চেয়ে কেউ হয় না আপন, দেয় নাতো কেউ অতো অধিকার,
পুড়িয়ে নিয়ো জ্বলার আগেই, অসময়েই মাতাল হয়ো আনতে সময়,
মনের যত খোয়াবছবি, যত্নে রেখো খুব গোপনে, রঙ মাখাতেই ধূসর রেখো পুণ্য হৃদয়।
দূর নগরীর সুরস্বপ্ন মাতায় যখন, কে থাকে ঘরে চুপটি মরে ঘুমের ঘোরে সরিয়ে আলো?


মিঠে যে আঙুর সুরা হয়ে জ্বলে, সে আঙুর জেনো, পুড়ে তেমনিই, যেমনি বরফ পোড়ায় আগুন!
অচল নদীর কষ্ট কে বোঝে? যে হৃদয় দেখে ঢেউ তোলে সে, নদীর শোকে সে হৃদয় ধোঁকে, নদীর প্রাণেই স্বপ্ন বাঁধে।
আগুনে-কণার দাপট দেখি সাকির চোখে, সুরার ঠোঁটে---এমন কণাই বরফ ভেজায়!
ওই চন্দ্রাতপে কীসের মায়া? ওই সুর-আসরে কীসের ছায়া? দেরি হয়ে যায়........তবুও জানি, জীবন কাটেই!


হৃদয়েরও এক হৃদয় আছে---রক্তে গড়া।
বীরের হৃদয় ফোয়ারা সুরের---বয়েই চলে খুব অলখেই।
সাকির হৃদয় শরাব বোঝে---তৃষ্ণা খোঁজে সেই গূঢ় বোধে।
কি ভালোবাসা, কিংবা ঘৃণা পোড়ায় যাকে---সেজন, জানি, খুব খেয়ালে মুক্ত হতেই শেকল পরে!


বাসলে ভালো শরম পালায়, সাহস আগায়; ভাঙা স্বপ্নও স্বপ্নে বাঁচায়।
প্রার্থনা হোক, হোক অভিশাপ---দুইই বাঁচে হৃদয়পীঠে!
এই দুনিয়ার কোন প্রান্তে স্থান করে নেয় আকুতি মনের? এক সাকিই জানে কোন সুরাতে কী সুর মানে!
শুদ্ধ প্রেমের নিভৃত আবাস রাখে আত্মা বিগত পুণ্যে---বাঁচে সে আত্মা উমেদশূন্যে!