পারসোনা (১৯৬৬)

আমার পারসোনা। এর অর্থ, লোকে আমাকে যেমন ভাবে, কিংবা আমার বাহ্যিক দিকগুলি আমার সম্পর্কে লোককে যা ভাবায়। হ্যাঁ, আদতে আমি আমার পারসোনার মতো নাও হতে পারি।

দুইজন মানুষ। একজন বলে যাচ্ছে, আরেকজন শুনে যাচ্ছে। মনের ভেতরের সব দ্বিধা, আফসোস, সংঘাত একএক করে কথায় উঠে আসছে। মানুষ পুরনো পাপ আর ভুল নিয়ে তার সাথেই আলাপ করে, যাকে সে কাছের কেউ ভাবে। এখানে তা-ই হচ্ছে। একজন বলছে সে এমন, সে তেমন; আরেকজন ভাবছে সে তেমন, সে এমন। এরকমই তো হয়।

আমি কেবলই বদলে যাই, তুমি তো কখনো বদলাও না!……….হৃদয়ের চিৎকার মুখে এসে পড়ে!

আরেকজন শুনছে আর ভাবছে, আমি বদলাই না, আমার পারসোনা বদলায়। তুমি তার কী বুঝবে?

বক্তা হঠাৎই আলাপ থেকে বিদেয় হয়। আলাপ থেমে যায়? নাকি এখুনিই অন্য কেউ এসে আবারো এমন সব কথা বলা শুরু করে দেবে, যা প্রকৃতপক্ষে শ্রোতারই মনের কথা? তবে কি বক্তা যা বলে যাচ্ছিল, তা শ্রোতার জীবনের আংশিক দর্পণ মাত্র……..যাকে আমরা নাম দিচ্ছি……পারসোনা?

আমরা সবাইই অভিনয় করে চলেছি। একটা রোল যেমন, ঠিক তেমন করে নিজেকে কাস্টমাইজ করে নিচ্ছি। এতটাই যে, আমাদের সত্যিকারের চেহারাটা কেমন, তা কেউ কল্পনায়ও আনতে পারছে না! আমাদের রোল বদলে যায়, আমাদের কাজকর্মও বদলে যায়, আমাদের বাহ্যিক অবয়বও বদলে যায়, আমাদের পারসোনাও বদলে যায়। আমাদের পারসোনা আমাদের সাথে বদলায়।

বক্তা যতক্ষণ বলে চলছিল, ততক্ষণ শ্রোতা বক্তার কথার মধ্যে নিজেরই কোনো না কোনো দিক খুঁজে নিচ্ছিল, যা তার অস্তিত্বেরই অংশ, সেই পারসোনাকে শ্রোতা নিজের চোখের সামনে খুব স্পষ্ট হয়ে উঠতে দেখছিল। বক্তার মধ্যে সে নিজেকে খুঁজে পাচ্ছিল, সাথে নিজের বোন কিংবা প্রিয় কাউকেও, যার মতো সে নিজেকে প্রকাশ করতে চায়………..যে তার পারসোনা। আলাপ আর সহাবস্থানের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বক্তা শ্রোতার প্রতিটি কথা আর আচরণ, সাথে আবেগের জায়গাগুলি অনুভব করতে থাকে। সেইসব দিক কোনো বাহ্যিক চেষ্টা কিংবা সচেতন মননে কেউই ধরতে পারবে না। মানুষ তার পারসোনা আবিষ্কার করতে ভালোবাসে, বিশেষত সে পারসোনাটি, যেটি সে অন্যের, এমন-কী নিজের কাছ থেকেও লুকিয়ে রাখে। আমরা যে গল্পের কথা বলছি, সে গল্পে বক্তা শ্রোতার কাছে তেমনই এক স্বস্তিকর পারসোনা।

গোলমেলে লাগছে, না? আসল গণ্ডগোলটা বাধে যখন বক্তা শ্রোতার স্বামীকে নিজের প্রাক্তন প্রেমিক হিসেবেই ধরে নেয়, আর স্বামীটিও বক্তাকে নিজের স্ত্রী ভেবে ভুল করে বসে! বস্তুত, বক্তা যেমন, তা শ্রোতারই একটা পারসোনা, আবার স্বামীটি যেমন, তা বক্তার পুরনো প্রেমিকেরই একটা পারসোনা। তবে কি আমরা সময়েসময়ে একে অন্যের পারসোনা? যা-ই হোক, বিপত্তি আরো বাধে যখন শ্রোতার ছেলের ছবি দেখে বক্তার শরীরেমনে বিস্ময় আর ভয় ভর করে আর তার বিবেক তাকে প্রশ্ন করে বসে, তবে কি সেই ছেলেটি এখনো বেঁচে আছে যার ভ্রূণ তুমি অ্যাবরশনের মাধ্যমে নষ্ট করে ফেলেছিলে সেই কত আগে? জীবিত কেউ মৃত কারো পারসোনা হতেই পারে! স্পষ্ট হল।

এমন কিছু মনস্তাত্ত্বিক অবস্থান এবং বিরুদ্ধ-অবস্থানের রূপকআলেখ্য ইংমার বার্গম্যানের ‘পারসোনা (১৯৬৬)’। এ ফিল্মের গতিপথ রৈখিক নয়, অবশ্য রৈখিক হতে হবেই-বা কেন? সময়, কল্পনা কি বাস্তবতা, স্বপ্ন, ধারণা, দৃশ্যপট—সবকিছুই অর্থবহ হয়ে ওঠে যদি আমরা এটাকে কোনো ছকে ফেলার চেষ্টা না করি, স্রেফ ফিল্ম হিসেবে নিই কিংবা কিছু অভিজ্ঞতার স্বচ্ছন্দ ভ্রমণ হিসেবে বিবেচনা করি।