পালানোর শব্দ

 
আমি ছলে, চাতুরিতে আর কৌতুকে ভরা দূরের এক জীবনের সংকেত দেখতে পাচ্ছি
ভয়ঙ্কর শান্তিতে, সেই মুহূর্তে আমার হৃদয়ের জমাটবরফে কে যেন হাতুড়ি পিটিয়ে যাচ্ছে অবিরত।
আমার সারা শরীরে ব্যান্ডেজ, এ শরীরেই আমি একটি অন্ধকার স্বপ্ন দেখতে পাবো। ভাবছি,
নদীর উপর অবস্থানরত একটি ধোঁয়াটে পুরানো চুক্তিকে আমি আবারও জ্যান্ত করে দেবো।


রাতের বেলা আমি হাসি আর তারার দিকে তাকিয়ে থাকি, সেই
চিরন্তন লড়াইটি শুরু হয়ে যায়, যা নদীর ধার বেয়ে উপরে ওঠে,
সাপের উন্মত্তায় ফুঁসে ওঠে, কাঁপিয়ে দেয়,
তখন বিশ্বস্ত বন্ধুর মতন ধীরেধীরে মগ্নতা এসে ভর করে।


আমার তিক্ত, কোমল ঠোঁটের কোণে, একটি
দীর্ঘ সময়ের চুম্বন আসবে চাঁদ থেকে,
রাত জাগবে, সান্ত্বনা দেবে। সন্দিগ্ধ দৃষ্টি যখন
বিশ্বাসের সন্ধান করে যায়, তখন
নদীতে জঞ্জাল এসে গণ্ডগোল পাকিয়ে দেয়।
রাতের কোলে শুয়ে এইসব ভাবি।


আমার কথা কিংবা কবিতার রং ও শরীর কালো,
সাদা কথা কিংবা কবিতা আজকাল আর গলায় কিংবা কলমে আসে না।
যখন মানুষ পাগল হয়,
তখন সে অকারণেই আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকে।
হতে পারে সে আয়নাটি স্রেফ আয়নাই,
এবং আমিও হয়তো ওটিকে একটি খোলা, মসৃণ তল হিসেবেই দেখি,
এমন-কী, আগামীকাল হয়তো নতুন কারো আত্মা ভেঙে গেলে
সে আর আয়নার দিকে তাকাবেই না,
কিন্তু আজ, এখনও, পাগল যারা হয়েই যায়,
ওরা আয়নার দিকেই ছুটে যায় সহজ অভ্যস্ততায়।


বিস্মৃত পুরানো ট্রেনে মুগ্ধতার সন্ধানে চলেছি।
সূর্যমুখীর মতো
তার মুখটি কুঁচকানো, তামাটে ছিল।
ওকে বলেছিলাম, তবে এসো। তার দুই চোখের দিকে তাকিয়ে দেখেছিলাম,
একটি রক্ত-ঝরঝরে, অন্যটি অশ্রুসিক্ত।
রাস্তায় আলো জ্বালানো হয়েছিল, ফুটপাথটি দুলছিল,
আর প্রেম আমাদের উপর
অভিশাপের মতো পড়েছে,
এবং শোক তাড়াতে ব্যর্থ হয়ে আফসোস করেছে;
দেখলাম, তার ঠোঁট দুটো কাঁদছে আর কাঁদছে।


আমরা বারবার বলছিলাম, আগুন কোথায়? আগুন কোথায়?
আমরা পুড়তে চেয়েছি, বস্তুত, একটি কয়লাও মানুষের চেয়ে ঢের বেশি মুক্ত। এর বদলে
পেয়েছি একটি খালি তৈরি কারাগার।
সেখানে বসবাস করেছি আর উঁচু গলায় চেঁচিয়ে বলেছি,
যে নরক পোড়াচ্ছে, তাকে আমাদের সামনে ডেকে আনো,
তার বুনো চোখের আর্তি দেখে ভুল কোরো না,
সে মাতাল ছদ্মবেশী! শুনে ওরা জিজ্ঞেস করলো,
এইবার বলো, কে তোমাদের সেখান থেকে বের করে দিয়েছে?


আশীর্বাদের দিনটি আমাদের কাছ থেকে গোপন করা হয়েছে, অথচ
আমরা ইতোমধ্যে দায়িত্ব মনে করে ধর্মগ্রন্থ পড়ে নিয়েছি,
এবং একই সাথে হেঁটে বেরিয়েছি সঙ্গত ও অসঙ্গত উপায়ে সুখলাভের অলিতেগলিতে।
আমরা ভাল মানুষ হওয়ার সব রাস্তা ঘুরে ক্লান্ত হয়ে
ভাল মানুষ হওয়ার সময় আর করে উঠতে পারিনি।


আমরা যে ঘরে আছি, সেটিকে উষ্ণ করতে গিয়ে আরও শীতল করে ফেলি,
আমরা ট্রেন-স্টেশনে বসে ট্রেনের অপেক্ষায় বুদ্ধিমানের কড়া হাসি দেখাতে থাকি,
যদিও ইতোমধ্যে অনেকেই জেনে গেছে যে কিছুই আজকে আর আসছে না,
আমরা তবু ওদের দিকে অবিশ্বাসের চোখে তাকাই।


কারাগারে বিলাপ করে কিচ্ছু হয় না,
সেখান থেকে পালাতে না পারলে হাসিমুখে থাকাই শ্রেয়।
যা হয়---বোকা লোকদের বাড়িতে ধূর্তদের ভিড় হয়,
সদ্যই বিরক্ত হয়েওঠা কিছু লোক শহরের মূল স্কোয়ারের মাঝখানে মোমবাতি জ্বালিয়ে বসে থাকে।
অন্যরা বাচ্চাদের শেখায় কীকরে নিজের হাতে স্নান করতে হয়।


একজন রোগাপাতলা পুরোহিত আজও কম কথা বলেন।
তিনি বলেন, আমাদের প্রচুর কান্নাকাটি করা উচিত,
আমরা খুব খারাপ।
উনার কথা শুনে একবার আমরা নতজানু হয়ে কোরাসে কেঁদেছিলাম, মনে পড়ে।
আমরা আজও কাঁদছি, আমরা আজও খারাপই আছি।