পুনশ্চ পাঠেও ভুল, অতঃপর…

 
আমার ভাবতেও খুব অবাক লাগে, ওর সাথে যখন রিলেশনে ছিলাম, তখন কত কত যে পাগলামি করেছি! মাত্র ছয় মাস, হ্যাঁ, ওইটুকুই, এর পর সব শেষ! আমাদের সম্পর্কটা কেন শেষ হয়ে গেল, আমি তা আজও জানি না। চেষ্টা করেছি অনেক ওকে ফিরিয়ে আনতে। পারিনি। ও আমাকে সব জায়গা থেকেই ব্লক করে রেখেছিল। আমি আর যোগাযোগই করতে পারিনি তার সাথে। কেন সে এমন করল, আমি সত্যিই জানি না। আমার পৃথিবীর কিছু অমীমাংসিত রহস্যের মধ্যে এটি একটি। আমরা কাছাকাছি থাকতাম না, ভিন্ন দুই জেলায় ছিলাম বলে ওর কাছে গিয়ে জানতে পারিনি কেন সে এমন করল। অবশ্য আমি তার ঠিকানাও জানতাম না। সে সময়টার কথা আমার মনে পড়ে। ওকে ভালোবাসতাম, এখনও বাসি। ভালোবাসার কোনও পাস্ট-টেন্স হয় না, ভালোবাসা সব সময়ই প্রেজেন্ট-টেন্স। কাউকে একবার ভালোবাসলে, তাকে ভালো না বেসে পারা যায় না আর। যে ভালোবাসা হারিয়ে যায় সময়ের সাথে, সম্ভবত তা ভালোবাসা নয়, স্রেফ সম্পর্ক। ভালোবাসার তুলনায় সম্পর্কের ব্যাপ্তি খুব ছোট। সম্পর্ক যে কারও সাথেই হতে পারে, ভালোবাসা যে কারও সাথে হয় না। তো যা-ই হোক, ওর চলে যাওয়ার পর আমি মানসিকভাবে অস্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিলাম। আমার ফ্যামিলিতেও কিছু ঝামেলা চলছিল তখন। সব মিলিয়ে কী যে এক ভয়ংকর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে আমাকে, বলে বোঝাতে পারব না।


আমি একসময় অনেক নরম স্বভাবের ছিলাম, এখনও আছি, তবে ওই সময়ের ধাক্কাগুলি আমাকে অনেকটাই শক্ত করেছে। জীবনে কিছু ধাক্কার দরকার আছে, নইলে মানুষ ঠিক মানুষ হয়ে ওঠে না। সবাই জানে, আমি ওকে ভুলে গেছি। এক আমিই জানি, ওকে ভুলে যেতে হয় কীভাবে, তা আমার জানা নেই। সত্যিটা হল এই, আমি ওকে একটাসেকেন্ডও ভুলতে পারি না। তাকে আমি ভালোও বাসতে পারি না, ঘৃণাও করতে পারি না। সে এক কঠিন ব্যাপার! সবার সামনে বেশ হাসিখুশি থাকি। সে এক দারুণ অভিনয়! তবে আমার জীবনে আরও অনেক ঘটনা আছে, যেগুলির সবটা আগে সামলাতে পারতাম না, আর এখন কষ্ট হলেও পারি শুধুই সেই ধাক্কাটা খেয়েছিলাম বলেই। আমি চাই অনেক বড় হতে। তবে আমি একটা মেয়ে, আমার চলার পথে অনেক অনেক বাধা, সাথে আছে কিছু পারিবারিক সমস্যাও। আমার জীবনটা খুব মসৃণ নয়। জানি না জীবনে আদৌ কিছু করতে পারব কি না সব সামলে নিয়ে। তবে আমি চেষ্টা করে যাব শেষপর্যন্ত।


আমার গল্পটা আমার পরিবার থেকেই শুরু করা যাক। আমি, আমার বাবা-মা আর আমার তিন ভাইকে নিয়েই আমাদের সংসার। আমি সেজো, আমার আগে দুই ভাই, পরে এক ভাই। আমি এখন থার্ডইয়ারে, বড় দুই ভাইয়ার একজন ডাক্তার, আর একজন গ্রাজুয়েশন শেষ করে চাকরি খুঁজছে, আর ছোট ভাই ইন্টার সেকেন্ডইয়ারে। আমার বাবা আয়কর বিভাগে অফিস সহকারীর চাকরি করেন, মা আগে একটা কিন্ডারগার্টেন স্কুলে পড়াতেন, এখন গৃহিণী। এই তো আমাদের সংসার। ছোটবেলা থেকে শুরু করে আজও দেখছি, একদম মধ্যবিত্ত ফ্যামিলি বলতে যা বোঝায়, তা-ই আমরা। আমি শুনেছি, আমার বাবাও খুব কষ্ট করে পড়াশোনা করেছেন। সেই ছোট থেকেই আমি কারও কষ্ট সহ্য করতে পারতাম না। কেউ যদি একটু ‘আহা রে!’-ও বলত, তাতেও আমার মনে হতো যেন কলিজাটা ছিড়ে যাচ্ছে! আর সিনেমায় কোনও ইমোশনাল-সিন দেখলে তো কথাই নাই। কাঁদতে কাঁদতে নাকের পানি, চোখের পানি এক করে ফেলতাম। মানে এতটাই ইমোশনাল ফুল ছিলাম আমি!


আমি বাড়ির একমাত্র মেয়ে হওয়ার কারণে ছোটকাল থেকেই অনেক আদরে বড় হয়েছি। কখনও কিছু চেয়েছি কিন্তু পাইনি, এমন হয়নি। আমি যা পেতাম, তা-ই দিয়েই যতটা পারতাম, ততটা মানুষকে সাহায্য করতাম সেই ছোটবেলা থেকেই। আমি যা চাইতাম, তা-ই পেতাম ঠিকই, কেবল একটা অভাব আমার জীবনে ছিল আর তা হলো, আমি কথাবলার মতো কোনও লোক পেতাম না। আমার বাবা-মা সোশাল মিডিয়া বা টেলিভিশন নিয়ে বসে থাকতেন না, এটা ঠিক, তবে আমার সাথে কথাবলার মতো সময়টা তাঁদের হতো না। আবার আমাকেও কারও সাথে মিশতে দিতেন না তাঁরা। ছেলে কি মেয়ে, কারও সাথেই মিশতে পারতাম না আমি। আর এদিকে আমি কারও সাথে কথাবলার জন্য কাঙালের মতো হয়ে থাকতাম। তাই আমাদের বাসায় কেউ বেড়াতে এলেই আমি খুব খুশি হয়ে যেতাম। আবার মেহমান চলে গেলে খুব কাঁদতাম। তবে আমি সেই ছোটবেলা থেকেই কাউকে দেখিয়ে কখনও কাঁদতাম না। সব সময়ই লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদতাম। কাউকে দেখিয়ে কাঁদাটা এখনও আমার কাছে পৃথিবীর সবচাইতে নিরর্থক ব্যাপার মনে হয়। আমি খুবই লাজুক স্বভাবের ছিলাম। কাঁদতেও লজ্জা পেতাম। এভাবেই আমার দিন কাটছিল।


আমি ছোটবেলা থেকে অনেক নাদুসনুদুস আর কালো ছিলাম। বড় হওয়ার সাথে সাথে আমার গায়ের রং প্রাকৃতিকভাবেই কিছুটা খুলে গেলেও ওজন ততটা কমেনি। অবশ্য এর দুইটা কারণ আমি নিজে খুঁজে পেয়েছি:
এক, আমার নানাবাড়ির বংশের লোকজন বেশ স্বাস্থ্যবান। দুই, আমার কিছু হরমোনাল সমস্যার কারণে ওজন কমেনি। তবে ছোটবেলায় এই সমস্যার কথা আমি জানতাম না, জেনেছি অনেক পরে। এর জন্য সঠিক বয়সে আমার সঠিক চিকিৎসা হয়নি বলে আমি সুন্দর কোনও ফিগার কখনও পাইনি। আমার উচ্চতাও বেশি নয়। কেন বলছি এসব, গল্প এগোলে ধীরে ধীরে বোঝা যাবে।


যা-ই হোক, আমার আবার ২টা অন্য সমস্যাও ছিল:
এক, আমার পরিপাকযন্ত্রে সমস্যা ছিল অনেক। আমি কিছু খেয়েই হজম করতে পারতাম না সেই ছোটবেলা থেকেই। আমি অনার্স ফার্স্টইয়ার পর্যন্ত সকালে উঠে বমি করিনি, এমন একটা দিনও নেই। ঈদের দিনও কিছু খেতে পারতাম না, বমি হয়ে যেত। কী যে যন্ত্রণার ছিল সেই দিনগুলি! অনেক কাঁদতাম এটা নিয়ে। হ্যাঁ, তা-ও লুকিয়ে লুকিয়েই। দুই, আমার স্কিনে অনেক অ্যালার্জির সমস্যা ছিল। তা ছিল একদম ভয়াবহ পর্যায়ের। চুলকাতে চুলকাতে চামড়া থেকে রক্ত বের হয়ে যেত। কত যে ডাক্তার, কবিরাজ দেখিয়েছি, তবু সারেনি। আমি তো রংপুরে থাকি। এখানে এমন কোনও ডাক্তার নেই, যাকে আমি দেখাইনি। ঢাকা, খুলনা, বরিশাল, বগুড়া, রাজশাহী যে যেখানেই যেতে বলেছে, সেখানে গিয়েই ডাক্তার দেখিয়েছি, কিন্তু ফলাফল প্রতিবারই শূন্য। পৃথিবীতে কিছু মানুষ আছে, যাদের জন্মই হয়েছে সারাজীবনই সব জায়গায় শূন্য পাবার জন্য। আমি ওদেরই একজন।


সম্প্রতি কীভাবে কিছুটা ভালো হয়েছি, বলছি। হ্যাঁ, আমার বাবা-মা খুব ভালো, তাঁরা আমায় এত এত জায়গায় ডাক্তার দেখিয়েছেন, আমার পেছনে অর্থ, শ্রম, সময় দিয়েছেন। আমি অনেক সৌভাগ্যবান যে তাঁদের মতন বাবা-মা আমি পেয়েছি। কিন্তু এখানে একটা ব্যাপার আছে। আমি না সত্যিই তাঁদের মাঝে মাঝে বুঝতে পারি না! প্রতিমাসে আজ অবধি আমি যখনই ডাক্তার দেখিয়ে ঘরে পা রাখি, তখন আমাকে শুনতে হয়, আজ যদি আমাকে এক পাল্লায় আর আমার পেছনে খরচ-হওয়া অত টাকাকে আর এক পাল্লায় রাখা হয়, তা হলে টাকার ওজনই বেশি হবে। তখন আমার গলা দিয়ে ওষুধ আর নামতেই চায় না, গায়ে কিছু লাগাতে আর ইচ্ছেই করে না। আর একটা কথা। ছোটবেলা থেকে আমি আমার পরিবার থেকে একটা জিনিসই শুনে এসেছি---আমি মোটা, খাটো, কালো। অমুক তমুক তো স্লিম, লম্বা, ফরসা। আমি কেন ওদের মতো নই?


ওই যে বললাম, আমি ছিলাম একটা ইমোশনাল ফুল। তাই সব সময় ভাবতাম, এইগুলি আমার অপরাধের মাঝেই পড়ে! আর নিজের অক্ষমতার জন্য লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদতাম। আমি এমন একটাও দিনের কথা মনে করতে পারি না, যেদিন আমি কাঁদিনি। এভাবে আমি নিজেকে ছোটবেলা থেকেই আরও গুটিয়ে ফেলতে লাগলাম। কারও সামনে যেতাম না, কারও সাথেই মিশতাম না। কেউ এলে আমি সামনে যেতে চাইতাম না। বাসায় আমায় নিয়ে উপহাস করত বলে বাইরের লোকও উপহাস করার সাহসটা পেত। মেহমান চলে গেলে আমি আরও কটুকথা শুনতাম। এমনও শুনেছি যে আমি মরলে বাসার সবার শান্তি হয়। আবার যখন আমি লোকের সামনে যেতাম না, তখন শুনতাম, এমন খারাপ শারীরিক গঠন নিয়ে আমি আসলে মিশতে চাই না কারও সাথে। আমি যখন লোকজনকে দেখতাম, তাদের ভাইরা তাদের অনেক আদর করে, তখন আমি ভাবতাম, আহা, তাদের কত ভাগ্য! কেননা আমি কখনও আমার ভাইদের কাছ থেকে সেই ভালোবাসাটা পাইনি। এটা নিয়ে কিছু ঝামেলাও হয়। সে কথায় আমি পরে আসছি।


আমি স্টুডেন্ট হিসেবে ভালো কি খারাপ, তা আমি নিজেই জানি না। আর জানবই-বা কীভাবে, আমি তো পড়তেই পারি না ঠিকমতো! প্রায় সারাক্ষণই অসুস্থ থাকি। যা-ই পড়ি, পরীক্ষার কিছু দিন আগেই পড়ি। মরে হোক বেঁচে হোক, ওইটুকু সময়ে যা পড়া যায় আরকি! আমি সরকারি একটা স্কুলে পড়তাম। তার পর সরকারি কলেজে চান্স পেলাম। কিন্তু খুবই জেদি ছিলাম আমি। কলেজের দুই বছরে অনেক জেদি হয়ে গিয়েছিলাম। বাসার কারও কথা শুনতামই না। ঠিক করলাম, একটা বেসরকারি কলেজে পড়ব আর বাবার টাকা উড়াব। কোনও দিন কিছু না করেও তো কত কথাই শুনেছি। এইবার নাহয় একটু করেই কথা শুনি! একটু বোঝাই সবাইকে আমার কেমন যে লাগে! বয়স ছিল কম, আর জেদি হয়ে গিয়েছিলাম, অগত্যা যে ভাবা সে কাজ!


সেই প্রাইভেট কলেজে ভর্তি-হওয়াই আজ আমার জন্য কাল হয়ে দাঁড়াল!


আমি জেদি হয়ে গেলেও ওই মানবদরদি স্বভাবটা কিন্তু চলে যায়নি। আমাকে যে টিফিনখরচ দিত বাসা থেকে, আর কলেজে ভালো রেজাল্ট করার জন্য আমি যে একটা বৃত্তি পেতাম প্রতিমাসে, এই দুই টাকা থেকে আমি, আমার পরিবারের কেউ হোক, আর বাইরের কেউ হোক, কেউ সমস্যায় থাকলে তাকে টাকা দিয়ে দিতাম। আমার মনে আছে, কলেজে থাকতে এই দুইটা উৎস থেকে পাওয়া টাকায় আমি কখনও নিজের জন্য একটি চকলেটও কিনে খাইনি। ভাবতাম, আজ টাকাটা থাকলে কাল হয়তো অন্য কারও কাজে লাগবে।


এভাবে ভালোই কাটছিল দিনগুলি। আমার প্রতিবছরই একটা করে মোবাইল লাগত। কেন জানি না আমার মোবাইল হারিয়ে যেত বারবার। তবে সেকেন্ডইয়ারে ওঠার পর থেকে আমি আর কোনও ফোন কিনিনি। ভেবেছি, যদি কখনও চাকরি পাই, তবেই কিনব, এর আগে না। এই ভাবনার কারণটা বলছি।


এদিকে আমার বন্ধু, বান্ধবী বাড়তে লাগল। আমি হয়ে উঠলাম সবার জন্যই নির্ভরতার একটা নাম। কারও হেল্প লাগলেই চারু হাজির! এর মাঝে আমার এক বন্ধু ছিল, যার পরিবার ছিল অনেক গরীব। খুব অভাব ওদের। আমি তাকে বইকেনা, স্যারদের প্রাইভেটের বেতন-দেওয়া থেকে শুরু করে আর্থিকভাবে যত ধরনের হেল্প একজন স্টুডেন্টের পক্ষে করা সম্ভব, তার সবই করেছি। সে ভালোই পড়াশোনা করত, এদিকে আমি অসুস্থতার কারণে পড়ার সুযোগ পেতাম না, তাই কোন প্রশ্ন যে সহজ আর কোন প্রশ্ন যে কঠিন, সেটাই বুঝতাম না। পড়াশোনা থেকে দূরেই থেকেছি বা থাকতে হয়েছে প্রায়ই। পরীক্ষার আগে আগে পড়ে সব সময় পরীক্ষা দিয়েছি। যারা সারাবছর পড়ে পরীক্ষায় ভালো নম্বর পেত, ওদের দেখলে আমার মনে হতো, ওরা এলিয়েন বা ওরকম কিছু, কিন্তু আসল ব্যাপার হলো, ওরা পড়ত বলেই পরীক্ষায় ভালো করত। আমি অসম্ভব শ্রদ্ধা করতাম তাদেরকে, যারা এইরকম মেধাবী ছিল, আর তাদের নানানভাবে হেল্প করে আমি নিজে অনেক তৃপ্তি পেতাম। এভাবেই দিন কাটছিল। এইচএসসি পাস করলাম। ভর্তি কোচিং-এ ভর্তি হলাম। এদিকে দিন দিন আমার শরীর আরও খারাপ হতে লাগল। প্রতিদিনই জ্বর আসে। আমি পড়তে আর পারি না। এর মধ্যে একদিন সেই বন্ধুটি, যাকে আমি নানানভাবে সহায়তা করতাম, সে আমায় প্রপোজ করে বসে। আমি সময় নিয়ে অনেক ভেবেচিন্তে রাজি হই। তবে ওই ফোনেই যা কথা, ওর সাথে দেখা আর হয় না। ওদিকে আবার সামনে ভর্তি পরীক্ষা।


আমি কিছুই পড়িনি। পরীক্ষার কিছু দিন আগে জানতে পারি, আমার কিডনিতে ইনফেকশন হয়েছে। খুব কড়া ওষুধ চলে। ওটা খাওয়ার ফলে আমার অবস্থা এমন হয় যে আমার পড়াশোনা আমাকে ফেলে রেখে বহু দূরে চলে যায়। আমি পড়তে পারি না, সে কিন্তু পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে ঠিকমতোই। আমি ওকে আগের মতোই সব ধরনের আর্থিক সাহায্য করে যাচ্ছি। ওর ফরম কিনে-দেওয়া, বিভিন্ন ভার্সিটিতে যাওয়াআসার সব খরচ আমিই দিয়েছি। সে পরীক্ষা দিল, কিন্তু কোথাও চান্স পেল না। সে মানসিকভাবে অনেক ভেঙে পড়ল। শেষ এক জায়গায় পরীক্ষা বাকি, কিন্তু পরীক্ষা দিতে যাবে, সে টাকা নেই। ওই টাকাটাও আমি দিই। সে পরীক্ষা দেয় আর চান্স পায়। তখন আমি বেডরেস্টে থাকায় কোথাও পরীক্ষা দিতে পারিনি। শেষে ন্যাশনাল ভার্সিটিতে ভর্তি হই। পরের বছর আর পারিনি কোথাও পরীক্ষা দিতে। কেননা তার পরের বছর ভর্তি পরীক্ষার সময় আমার প্রথম বর্ষের পরীক্ষা শুরু হয়, আর ঠিক পরীক্ষার সময় আমার বাবার বাইপাস সার্জারি হয়। এসবের কারণে আর হয়নি।


যা-ই হোক, সে পাবলিক ভার্সিটিতে চান্স পেল, তার পর থেকে তার আর কোনও খোঁজ নেই। কল দিলে ধরে না, এসএমএস দিলে রিপ্লাই দেয় না। এমন অবস্থা। হঠাৎ সে একদিন জানায় যে আমার সাথে সম্পর্করাখা তার পক্ষে আর সম্ভব না, কেননা আমি মোটা আর কালো, ন্যাশনালে পড়ি, তা ছাড়া তার ফ্যামিলি সমবয়সি কারও সাথে বিয়ে মেনে নিবে না, এইসব কথাবার্তা বলে। আমি যা বোঝার বুঝে নিই।


তার পর থেকে আমি দিন দিন ডিপ্রেশনে চলে যাই। তখন আমার এক ছোট বোন, যাকে আমি হেল্প করেছিলাম একসময়, সে ব্যাপারটা জানতে পারে, আর চায় আমাকে হেল্প করতে। সে সৈকতকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করে, সৈকতের ফ্রেন্ডসার্কেলকে ধরে ওকে বুঝাতে। তখনই ওর ভার্সিটির এক ছেলে এগিয়ে আসে। সে ছেলে আবার সৈকতের ফ্রেন্ডের ফ্রেন্ড। সে বলে, সৈকতকে বোঝানোর চেষ্টা করবে, আর আমাকেও মেন্টাল সাপোর্ট দিবে। আমি তখন সবে ফেসবুক চালাই। আমার এক বান্ধবী আমাকে ফেসবুক আইডি খুলে দেয়, আর বলে দেয়, কেউ যদি আমাকে রিকোয়েস্ট দেয়, তাকে অ্যাকসেপ্ট না করলে তাকে অপমান করা হবে। আমি এমনই হাঁদারাম ছিলাম যে তখন যে-ই রিকোয়েস্ট দিত, আমি তাকেই সাথে সাথে অ্যাকসেপ্ট করে ফেলতাম। সেভাবে ওর সেই বন্ধুকেও অ্যাকসেপ্ট করি। ওর নাম আওরঙ্গজেব। নামটা একটু বড়, তাই গল্পের প্রয়োজনে ধরে নিই, ওর নাম রনি।


তো রনি আমাকে রিকোয়েস্ট দেয়। আমিও বান্ধবীর ফর্মুলা মেনে ওকে অ্যাকসেপ্ট করি। তার পর সে আমাকে বুঝায়, দেখো, সৈকত একটু কেমন জানি। তুমি তো জানো না, সে ভার্সিটিতে এসে অনেক বদলে গেছে। তুমি ওকে ভুলে যাও। তার পর সে অনেক মনীষীর উক্তিটুক্তি নিজের নামে চালায় আমাকে মোটিভেট করতে। আমি তো গাধা টাইপের ছিলাম, ওর সব কথাই বিশ্বাস করতাম। আমি ভাবতাম, আরে বাবা, এই ছেলে কত জ্ঞানী! আমি ভার্সিটিতে পড়তে পারিনি বলে যারা ভার্সিটিতে পড়ে, তাদের অনেক সম্মান করতাম। ধীরে ধীরে সে আমার বিষয়ে জানতে থাকে এবং আমাকে নানাভাবে অনুপ্রাণিত করতে থাকে। আমি ক্রমেই আগের সব কিছু ভুলতে লাগলাম। আর স্বাভাবিক হতে শুরু করলাম। এভাবে একসময় তার উপর আমার অনেক মায়া জন্মে যায়। মায়া বড় ভয়াবহ জিনিস, মানুষকে একেবারে শেষ করে দেয়!


এমন সময় আমার বিয়ের প্রপোজাল আসতে থাকে। একবার এক বিসিএস ক্যাডার বাসায় প্রস্তাব পাঠায়। ছেলে বিসিএস ক্যাডার বিধায় আমার বাবা আমাকে বোঝাতে থাকে আমি যেন রাজি হয়ে যাই। ওদিকে এটা রনিকে জানালে সে আমাকে অনেক আবেগ দিয়ে নানা কথা বলতে থাকে, অবশেষে বলে, আমি বিয়ে করে ফেললে সে থাকবে কী করে, সে তো আমাকে ছাড়া বাঁচবেই না, আরও হেনতেন বলে, সবাই যা বলে আরকি। সে আমাকে বোঝাতে থাকে, আমিও বুঝতে থাকি…অবশেষে আমি তখন তার কথায় গলে যাই আর বাসায় অনেক ঝামেলা করে সেই বিসিএস ক্যাডারকে বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিই। এর পর বাসায় কেউ আর আমার সাথে কথা বলে না, সারাদিন শুধু রাগারাগি হয়। আমি আবারও পুরোপুরি ডিপ্রেশনে চলে যাই। রনি আমাকে আবারও বোঝায়, অনুপ্রেরণা দেওয়ার চেষ্টা করে।


এর পর একদিন হঠাৎ সেও আমাকে প্রপোজ করে বসে। আমি তাকে বলি, তুমি তো সবই জানো। তোমার সাথেই পড়ে আমার এক্স-বয়ফেন্ড। ও বলে, এইগুলি কোনও ব্যাপারই না। ও সব জেনেবুঝেই এগুচ্ছে। ও আমার পাশে সারাজীবন থাকতে চায়। আরও ব্লা ব্লা অনেক কিছুই বলে। আমি ভাববার জন্য তিন মাস সময় নিলাম। ওই তিন মাসে সে আমাকে অনেকভাবেই ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করত, আর আমিও ইমোশনাল ফুল ছিলাম বলে ওর সবই বিশ্বাস করতাম। আমি ভুল করে বসলাম আবারও। অবশ্য তখন দেখেছিলাম, রনি সৈকতের মতো না, অনেক আলাদা সে।


শুরু হলো নতুন সম্পর্ক। রনি সত্যিই আলাদা ছিল। ও আমার অনেক কেয়ার নিত। আমাকে অনুপ্রাণিত করত নানান কথা বলে বলে যদিও সেগুলি একটাও তার নিজের কথা ছিল না, ও বিভিন্ন মানুষের কথা নিজের কথা বলে চালাত। ওতে অবশ্য আমার কিছু এসে যায় না, আমি অনুপ্রাণিত হতাম, এটা সত্যি। রনি আমাকে প্রতিদিনই বিয়ের কথা বলত। আমি বলতাম, দেখো, আগে আমাদের দুইজনেরই একটা শক্ত অবস্থান হোক, তার পর আমরা বিয়ে করব। আমার চোখে-মুখে তখন জীবনের রং লেগেছে পাকাপাকিভাবেই। আমি খুবই খুশি! মজার বিষয়, আমরা মাত্র একবারই দেখা করেছিলাম। এর পর থেকে ফোনেই কথা হতো। একেবারে সারাদিন। রাতে হতো সারদিনে কী কী করেছি, কী কী ভাবছি, কী কী হলো…এইসব হাজারো কথা।


তার পর হঠাৎ ৬ মাস পর দেখলাম, সে আর আগের মতো নেই। কেমন জানি বদলে গেছে। কেন গেছে, আমি জানতাম না। জিজ্ঞেস করলে বলে, ওর পারিবারিক সমস্যা। কী সমস্যা, তা আমি অনেকবারই জানতে চেয়েছি, কিন্তু সে কখনওই বলেনি। হ্যাঁ, রনির আর্থিক অবস্থা অনেক খারাপ ছিল। আমি হেল্প করতে চাইতাম। কিন্তু সে ইগোর কারণে নিত না। হঠাৎ একদিন আমি জানতে পারি, আমি ওর ব্লকলিস্টে! আমি অনেকভাবেই ট্রাই করি ওর সাথে যোগাযোগ করার, কিন্তু কিছুতেই ওর নাগাল আর পাই না। ফ্রেন্ডের ফোন থেকে, এর ওর ফোন থেকে ওকে ফোন দিই, কিন্তু ও আমার গলা শুনলেই ওই নাম্বারটাকেও ব্লক করে দিত। এভাবে একদিন আমি আমার মাকে বলেই ফেলি যে আমি একজনকে ভালোবাসি, তার সাথে এমন এমন রিলেশন, ইত্যাদি। আমার সব কথা শুনে মা কিছুই বলেন না। শুধু বলেন, ওই ছেলের সাথে তিনি কথা বলবেন। আমি কাউকে কিছু বলতে পারছিলাম না। আমার কথা শোনার মতো তেমন কেউ ছিল না। আর কষ্টের কথা তো কাউকে বলতে নেই, লোকে তা শুনলে বরং উপহাস করে। আর তার জন্য বেঁচেথাকাটাই আরও কষ্টকর হয়ে যায়।


আমি রনির সাথে কথা বলতে চাইতাম, কিন্তু কথা বলব কীভাবে, আমি তো তার সব জায়গা থেকে ব্লকড হয়ে আছি! তার পর থেকে প্রতিটা দিন প্রতিটা সেকেন্ড আমি অপেক্ষা করতাম তার একটা ফোনকলের জন্য। যদি ফোন বাজত বা মেসেজ আসার টোন বাজত, আমি লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে ফোনের কাছে যেতাম, ভাবতাম, বুঝি রনি। কিন্তু সে আর কল দিত না। প্রতিটা সেকেন্ড যে কী কষ্ট নিয়ে কাটত, বলে বুঝাতে পারব না। আমি আমাদের সেই আগের স্মৃতিগুলি মনে করতাম আর ভাবতাম, আচ্ছা সে কি আমার মতোই কষ্ট পাচ্ছে? আচ্ছা, সে কী করছে এখন? আচ্ছা, সে কি খেয়েছে? সবচেয়ে বেশি ভাবতাম…কেন সে এমন করল? কারণটা কী? আমি ভেবেই পেতাম না কোনও কারণ। ধীরে ধীরে আমি ডিপ্রেশনে চলে যাই। আমার মা তখন আমাকে অনেক সাপোর্ট দিয়েছিলেন। আমাকে ভালো রাখার জন্য তিনি সব কিছুই করার চেষ্টা করেছেন। জীবনে এই প্রথম, আমি ছোটবেলায় মাকে যেভাবে চেয়েছিলাম, ঠিক সেভাবেই পেয়েছি। তিনি সব কিছু ভুলে আমার পিছনেই পড়ে থাকতেন। আমি কোনও কথাবার্তা না বলে চুপ করে থাকতাম আর সারাদিনই কাঁদতাম।


তখন আমার পরীক্ষার ডেট দেয়। আমি ভাবি, আমি তো কিছুই পড়িনি। যার কাছেই শুনি, সে-ই বলে, পড়াশুনা করে উল্টিয়ে ফেলেছে, আর সেখানে আমি বইয়ের মুখও এই জীবনে দেখিনি। ভাবলাম, আমি পরীক্ষা দিব না। কিন্তু মা খুব কাঁদলেন, বললেন, তোর একটা বছর চলে যাবে, তুই আরও ডিপ্রেশনে ডুবে যাবি, তুই পরীক্ষাটা দে, দরকার হলে কয়েকটাতে ফেইল কর, তাও দে! যেদিন পরীক্ষার ফি জমা দেওয়ার লাস্ট-ডেট ছিল, ওইদিন মা জোর করে আমাকে টাকা দিয়ে পাঠালেন ফরম ফিলআপ করতে। আমি করলাম। কিন্তু আমি অনড় যে আমি পরীক্ষা দিব না। একদিন মা খুব কাঁদলেন। মায়ের কান্না দেখে খুব খারাপ লাগছিল, তাই আমি পরীক্ষায় বসার সিদ্ধান্ত নিলাম। বই খুললাম। দেখি, এসব কী লেখা এখানে? কিছুই তো মাথায় যায় না! তার উপর আমার যখন হরমোনের সমস্যা বাড়ে, তখন আমি কিছুই মনে রাখতে পারি না। ভাবলাম, আমি থিওরি দিয়ে নয়, ম্যাথস দিয়ে এগোব। তখন আমাদের ৫টা ম্যাথসের সাবজেক্ট ছিল। দেখলাম, ম্যাথসে যদি নম্বর তুলতে পারি তো আমার মোটামুটি একটা রেজাল্ট আসবে।


আমি পরীক্ষা দেওয়া শুরু করলাম। আমি তখনও কিন্তু ভুলিনি তাকে। রোজ আমি নিয়ম করে কাঁদি, আর আমি যে কাঁদি, তা বাসার সবাই জানে। ওই মুহূর্তে আমার সাথে বাবা আর ভাইয়ারা কথা বলতেন না। কী যে কষ্ট হতো তখন! মনে হতো, আমি যেন এই ঘরে আছিই কেবল দুইবেলা দুইমুঠো ভাত খেয়ে বেঁচে থাকতে। আমি শুধু আমার রুমেই থাকতাম। ৩টা পরীক্ষা দেওয়ার পর আমরা দীর্ঘ ১৭ দিনের ছুটি পাই। আবার জানুয়ারি থেকে বাকি পরীক্ষাগুলি শুরু হবে। ওই সময় আমার সমবয়সি এক প্রতিবেশী মেয়ের বিয়ে হয়। ওর বিয়ের কথা শুনে আমি আবারও ডিপ্রেশনে চলে যাই। ভাবি, আজ তো আমিও বিয়ে করতে পারতাম, কিন্তু আমার তো কিছুই হলো না! আজ আমার কই থাকার কথা, আর আমি আছি কই! তার পর আবার রনির কথা ভাবি। রনি তো আমাকে একবারও কল দেয় না। কেন দেয় না? তার কি সত্যিই আমার কথা আর মনে পড়ে না? কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব?


আজ আমার জীবনে রনি থাকলে বলতাম, এই জানো, আমাদের পাশের বাসায় বিয়ে হচ্ছে! তার পর হয়তো নিজেদের বিয়ে নিয়ে ভাবতাম। আমি খুবই স্বপ্নবিলাসী মানুষ ছিলাম। ভাবতাম, নাটক-সিনেমায় যেমন হয়, ঠিক তেমনই একটা বিয়ে হবে আমার। নানান কথা ভাবতে ভাবতে আমি আবারও ডিপ্রেশনে চলে যাই। আমার অবস্থা দেখে বাবা একদিন বলে বসলেন, বোরকা পরে পরে বাইরে গিয়ে এইসব কাজ করেছে সে! আর এখন ঘরে ভং ধরে আছে! বড় ভাইয়া বললেন, ওকে তো ঘর থেকেই বের করে দেওয়া উচিত। মেজো ভাইয়া বললেন, চারু তো এইজন্যই ওই বিয়েতে রাজি ছিল না তখন। মা-ও একসময় বিরক্ত হয়ে বললেন, এর চেয়ে তোর মরে যাওয়াই ভালো ছিল! আমি এসব শুনে তখন ভাবি, আজ রনি থাকলে হয়তো এই কথাগুলি শুনে কষ্ট পেত, কিন্তু সে তো আমার খবরই নেয় না। আমি ওকে কিছুতেই ভুলতে পারতাম না। সত্যি তখন গাধাই ছিলাম!


ডিসিশন নিলাম, সবারই যখন এতটা ঝামেলা আমকে নিয়ে, আমি তখন মরেই যাব। আমি সুইসাইড করব। যে-ই ভাবা সে-ই কাজ। একগাদা ঘুমের ওষুধ হাতে নিলাম, রিভোট্রিল টু এমজি। যখনই খেতে যাব, তখনই একটা কান্নার আওয়াজ কানে ভেসে এল। কানপেতে শুনি, আমার মা নামাজের পাটিতে বসে বলছেন, আল্লাহ, আমার মেয়ের মনে তুমি শান্তি দাও, ওকে সহ্যক্ষমতা দাও, ওর মনের কষ্ট দূর করে দাও।


আমার চোখবেয়ে পানি নেমে এল। আমি ওষুধগুলি ফেলে দিলাম। আর ঠিক তখনই প্রতিজ্ঞা করলাম যে আজ থেকে আমি ভালো করে পড়ব, এবং আমার মনে যতই কষ্ট থাক না কেন, আমি প্রয়োজনে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদব, কিন্তু সব সময়ই হাসিখুশি থাকব। এর পর থেকে আমি আর কোনও দিনই বাসার লোকের সামনে কাঁদিনি। আমি আমার পরের পরীক্ষাগুলি দিলাম। মাত্র ওই কয়দিন পড়ে পাস করারই তো কথা না, কিন্তু আমি সবাইকে অবাক করে দিয়ে বাংলা সিনেমার কাহিনির মতো ফার্স্ট-ক্লাস পেয়ে পাস করলাম। এটা সম্ভব হলো শুধু ম্যাথসের সাবজেক্টগুলির জন্য। আমি তার পর হঠাৎ একদিন রনিদের ভার্সিটি নিয়ে ইউটিউবে সার্চ দিই। কেন দিই, মনে নেই, তবে কোনও কারণে দিয়েছি বলে মনে হয় না। আমি অকারণেই যেসব কাজ করতাম, ওটা ছিল সেগুলিরই একটা। রনি ওখানে পড়ে, অতএব ওটা খোঁজো! এরকমই কিছু একটা হবে!


আমি তখন ফেসবুক-চালানো একেবারে বাদ দিয়ে দিয়েছিলাম। কারণ ফেসবুক চালালে আমি ভালোথাকার অভিনয়গুলি করতে পারতাম না। হ্যাঁ, আমি আজকের দিন পর্যন্ত ওর কথা একসেকেন্ডের জন্যও ভুলতে পারিনি। একসময় আমি প্রতিরাতেই কাঁদতাম। এই তো কিছু মাস আগে থেকে কাঁদা বাদ দিয়েছি। আসলে বাদ হয়ে গেছে। কতদিন আর কাঁদা যায়! কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি ফুরিয়ে গেছে। এখন আমার অনেক কষ্ট পেলেও আর কান্না পায় না। কিন্তু আমি খুব চাই কাঁদতে। কিন্তু চোখে পানি আসে না। সে অবশ্য আর এক কষ্ট! তখন কেমন জানি অস্থির অস্থির লাগে। কাঁদতে না পারার কষ্ট অনেক! সবাই জানে, আমি সব কিছু ভুলে গিয়েছি; কিন্তু কেউ এটা জানে না, আমি আসলে খুব ভালো অভিনয়-করা শিখে গিয়েছি। না জানলে না জানুক, সবাই ভালো থাকুক।


আর হ্যাঁ, ইউটিউবে খুঁজে দেখলাম, ওদের ভার্সিটির জন্য তৈরি-করা একটা রোড-শোতে সৈকত একটা মেয়ের সাথে ড্যান্স করছে, রনিও আর একটা মেয়ের সাথে ড্যান্স করছে। এটা দেখে কেন জানি না আমার দুঃখ অনেক কমে গেল, যদিও ওটা ছিল জাস্ট একটা শুটিং, তবুও কমে গেল। মনে হচ্ছিল, ওরা আরও নাচুক, পৃথিবীর সব মেয়ের হাতধরেই নাচুক! একধরনের শান্তি পেলাম মনে।


আর হ্যাঁ, আমি শুরুতে বলেছিলাম, আমার পেটের খুব সমস্যা ছিল। আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, নিজেকে আরও ইমপ্রুভ করব। আমার চিন্তাভাবনা, আমার আবেগ, আমার শারীরিক সমস্যা…সব কিছু। টানা তিন মাস এটা নিয়ে উঠেপড়ে লাগলাম। তিন মাস পর যখন একদিন খেয়াল করলাম, আমার আর বমি হচ্ছে না, সেই দিনটা যে আমার জন্য কী ছিল, বলে বোঝাতে পারব না! দীর্ঘ এগারো বছর পর এর যন্ত্রণা থেকে আমি অবশেষে মুক্তি পেলাম। আনন্দে আমি কেঁদেই ফেলেছিলাম। এই কান্নাটা ছিল খুশির। আমি যেহেতু তখনও ফেসবুক চালাই না বলে হাতে অনেক সময় আছে, সেহেতু এর পর ভাবলাম, এবার অ্যালার্জি নিয়ে কিছু ভাবা যাক। কত রকম ওষুধ, প্রাকৃতিক জিনিস তো খাওয়া হলো, লাগানো হলো শরীরে, কিন্তু কিছুতেই তো কিছু হয় না। আমার অ্যালার্জির লেভেল ছিল অনেক হাই। ডাক্তার বলেছিলেন, এইগুলি সারতে আমার ২০/২৫ বছর বা তার চেয়েও বেশি সময় যাবে। কী হাই-পাওয়ারের ওষুধ খেতাম তখন! খেতাম আর ঘুমাতাম। আর খেলেই কেমন জানি শরীরের ভিতর অবশ অবশ লাগত। এভাবেই যাচ্ছিল আমার দিন।


হঠাৎ মনে এলো, নিজের খরচটা নিজের উপার্জনে চালানো উচিত। কিন্তু আমাদের এখানে টিউশনি অনেক রেয়ার। আর যা পাই, তা-ও অনেক দূরে দূরে। বেতনটাই শেষ হয়ে যাবে যাওয়াআসার ভাড়ার পেছনে। তাই ভাবলাম, ইন্টারের কোটায় যে চাকরিগুলি হয়, সেগুলিতে অ্যাপ্লাই করা যাক। চাকরির পরীক্ষা দেওয়ার এক্সপেরিয়েন্স তো হবে অন্তত, আর চাকরি হয়ে গেলে তো ভালোই! এটা ধরে রেখে পরে আমি আরও ভালো কিছু করতে পারব। এই চিন্তা থেকে আমি অ্যাপ্লাই করতে থাকি। এরই মাঝে আমার প্রতিরাতে কাঁদা আর সারাদিন ভালোথাকার অভিনয়-করা চলতেই থাকে। আমি ২টা পরীক্ষায় পাসও করে ফেলি। একটা ছিল সাঁটমুদ্রাক্ষরিক পদে। কিন্তু ভাইভাবোর্ডে আমাকে সরাসরি টাকার কথা বলা হলো। আমি বুঝতে পারছিলাম না, আমি যদি পরীক্ষায় নম্বর কম পাই, তা হলে ওরা আমায় কেন ডাকল? আর ভালো নম্বর পেলে টাকা কীসের? যা-ই হোক, চাকরিটা আমার আর হয়নি। আমি বাসায় বলিইনি ওই টাকার কথা। আরও একটা পরীক্ষা দিয়েছিলাম তৃতীয় শ্রেণীর পদে, ওখানেও টাকা চেয়েছিল। এর পর কিছু পরীক্ষার ডেট আমার অ্যাকাডেমিক পরীক্ষার মধ্যে পড়ে যায়, তাই আর দেওয়া হয়নি।


আমার বাবা-মা কিন্তু এমনিতে অনেক ভালো, তবে তাঁরা তুলনা করেন বেশি। আমার সাথে দুনিয়ার সব মেয়ের তুলনা। ওদের এটা আছে ওটা আছে, আমার কিছুই নেই, এরকম তুলনা। এই যেমন, অমুক তো চাকরিটা পেয়েই গেল, তুই কেন পেলি না? বা অমুক মেয়ে তো লম্বা, ফরসা, স্লিম হেনতেন, তুই এরকম কেন? তাঁরা আমাকে নিয়ে অনেক আপসেট থাকেন সারাদিন। মাঝে মাঝে আমার নিজেরও খুব খারাপ লাগে। আমি চাই, তাঁদের সুখী রাখতে, কিন্তু কিছুই করতে পারি না তাঁদের জন্য। প্রায়ই মনে হয়, আমি তাঁদের সারাজীবনই কষ্ট দিয়ে গেলাম, কিন্তু তাঁদের কষ্টটা কমাতে কিছুই করতে পারলাম না।


বাবা-মাকে সুখী করতে আমি আরও পরীক্ষায় বসতে চেয়েছি, কিন্তু একটার একটা বাধা এসেছে শুধু। গতবছর আর একটা পরীক্ষা দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমার মায়ের গলব্লাডারের অপারেশনের জন্য দিতে পারিনি। তার পর প্রাইমারিতে টিকেছিলাম, কিন্তু ভাইভার সময় আমার দাদাজান মারা যাওয়ায় আর ভাইভা দিতেই যাওয়া হয়নি। তার কিছুদিন আগে আমি অ্যাক্সিডেন্ট করেছিলাম, এর ফলে আমার বাঁ-পায়ের হাড় সরে গেছে। ডাক্তার আমাকে বলেছিলেন ফুল-রেস্টে থাকতে, কিন্তু পরীক্ষার জন্য আর রেস্ট নেওয়া হয়নি। যেদিন আমার পরীক্ষা থাকে, সেদিন পরীক্ষা দিয়ে এলে আমার পা ফুলে যায়, খুব যন্ত্রণা করে, সারারাত ঘুমাতে পারি না। আমি ভাবি, হ্যাঁ, এসবই তো হবে চারুর সাথে, কেননা চারু যে চারুই!


আর হ্যাঁ, রনিকে আমি এখনও ভুলি যাইনি। এই তো কিছুদিন আগে আমি ফেসবুকে ব্যাক করি। আমি এতদিন ভাবতাম, সে হয়তো বিরহে আছে। কারণ আমি রিলেশনের সময় তাকে যা জেনেছিলাম, তাতে আমার ওরকমই মনে হয়েছে। কিন্তু ফেসবুকে ব্যাক করে দেখি, আমি যা জেনেছিলাম, তার পুরোটাই ভুল! সে বেশ ভালোই আছে। অথচ আমি যখন ফেসবুক চালাতাম না, তখন কত কী ভাবতাম। আমি প্রতিদিন তার আইডিটা লুকিয়ে লুকিয়ে দেখি, আর খুব কষ্ট হয়। কিন্তু আসলে সে ভালোই আছে। এখন ভাবি, আমাকেও ভালো থাকতে হবে। তাই আমি ঠিক করেছি, আমি আর ততদিন ওর আইডি ঘাঁটব না, যতদিন না আমি একটা চাকরি পাব। হয়তো এমনও হতে পারে, আর কখনওই আমার ওকে নিয়ে জানাই হবে না। কিন্তু আমাদের কিছু কমন-ফ্রেন্ড থাকার কারণে মাঝে মাঝেই ওর সম্পর্কে জানা হয়ে যায়। আমি জানতে চাই না চাই, ওরা আমার সামনে এসে রনির কথা বলে, আমিও না শোনার ভান করেও উৎকর্ণ হয়ে শুনতে থাকি, শুনতেই থাকি…


আমি আমার জীবন থেকে অনেক কিছু শিখেছি, নিজেকে কিছুটা পরিবর্তন করেছি। জীবন আমাকে শিখিয়েছে, ক্লাসমেট আর ফ্রেন্ড কখনওই এক না। যাদের আমরা চিন্তা না করেই ফ্রেন্ড বলে দিই, ওদের বেশিরভাগই আসলে আমাদের ক্লাসমেট। এই লজিকে দাঁড়ালে আমার সত্যিই কোনও ফ্রেন্ড নেই, সবই ক্লাসমেট। এর কারণ, আমি এখনকার যুগের মতো করে চলি না। আমি ছবি তুলি না, ফেসবুকে বা মাই-ডে’তে কোনও ছবি দিই না। আমি নামাজ পড়ি, কোরান পড়ি, আমল করি সারাদিনই। তাই আমি সবার ভাষায়, পুরাই খ্যাতমার্কা একজন মানুষ! আর এজন্যই সবাই আমার ক্লাসমেট, আমার কোনও ফ্রেন্ড নেই। এটা নিয়ে অবশ্য আমার তেমন কোনও দুঃখও নেই।


তবে আমার জীবনের এই ধাক্কাগুলির জন্য আমি মানুষ চিনেছি। খুবই দরকার ছিল এরকম একটা বড়সড় ধাক্কার! আমি আগে সত্যিই কত বোকা ছিলাম, কত সরল ছিলাম! কথা বলতে খুব পছন্দ করতাম, কিন্তু এখন আর ভালো লাগে না। আমি দেখেছি, কথা বেশি বললে বিপদও হয় বেশি।


আমি ভাবি, রনির একদিন বিয়ে হবে, ওর একটা সুখী সংসার হবে, কিন্তু আমার আর কিছুই হবে না। আমি ছেলেদের আর বিশ্বাস করতে পারি না। আজ হয়তো আমার বাবা-মা আমার পাশে ছিলেন বলে আমি বেঁচে আছি, কিন্তু আমি যদি চাকরি না করেই বিয়েটা করি, তা হলে তখন যদি এমন হয় যে বিয়ের পর আমার বর আমাকে ভুলে যায়, বেরই করে দেয় বাড়ি থেকে, তখন কী হবে? পেট যখন আল্লাহ দিয়েছেন, তখন তা চালাতে তো হবে! কিন্তু আমি বাবা-মা’কে এই কথাটা বুঝাতেই পারি না। তাঁরা চান আমাকে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দিতে। ছেলেদের কিন্তু অনেক টাইপের ডিমান্ড থাকে। আবার বিয়ে করব কি করব না, তাও বুঝি না, এদিকে বয়সও বাড়ছে। দেখা যাবে, একসময় চাকরি ঠিকই হবে, কিন্তু বিয়েটা আর হবে না। মাঝে মাঝে মনে হয়, ছেলে হলে হয়তো ভালো হতো, তখন বয়স নিয়ে আর টেনশন করতে হতো না। মেয়েদের অনেক টেনশন থাকে। মেয়ে হয়ে জন্মালে কেবল দুঃখই পেতে হয়।


আমার বাবা-মা যদি আমাকে আর একটু বুঝতেন, এত তুলনা না করতেন, তা হলে তো আমি আর একটু ভালো করে পড়তে পারতাম। আমি এইগুলি নিয়ে ভাবি না। কিন্তু একটা মানুষ, যার কথাবলারও কেউ নেই, যে সারাদিনই ঘরে আটকে থাকে, যার প্রতিটা সেকেন্ডেই নানান ধরনের কথা শুনতে হয়, সে দিনশেষে শত অনিচ্ছাতেও আপসেট হয়ে যায়ই। তবে আমি এতটা শক্ত হতে পারব, তা কখনওই ভাবিনি। এইগুলি হয়তো অনেকের কাছে কিছুই না, কিন্তু আমার জন্য অনেক বড় ব্যাপার। আমি তো আর সবার মতো না, আমি আমার মতো। আমি এইগুলি অনেক ধাক্কা খেয়ে খেয়ে শিখেছি।


আমি কেমন ছিলা্‌ম, একটু বলি। আমি তেমন ছিলাম, যখন ক্লাসে স্যার কিছু জিজ্ঞেস করতেন, আমি সেটার উত্তর জানলেও বলতে লজ্জা পেতাম, ভাবতাম, আমি বলব আর লোকে শুনবে, এ আবার হয় নাকি! আর এখন? সেই ক্লাসেই সব থেকে লাউড ভয়েসটা আমারই! বাসা থেকে আমাকে কখনও একা কোথাও যেতে দেয়নি, আর একা যেতেও আমি ভয় পেতাম। অথচ সেই আমি আমি এখন চাকরির পরীক্ষা দিতে একা একাই ঢাকা চলে যাই। রাতে ভয় পেতাম বলে আমি রুমে লাইট জ্বালিয়ে ঘুমাতাম, আর এখন আমি লাইট অফ করে জানালা খুলে ঘুমাতে পারি একা একাই! এইগুলি সবই ধাক্কা খাওয়ার কারণেই শিখেছি। নাহয় এ জীবনে এসব কখনওই শেখা হতো না। এইসব আমার জন্য অনেক বড় অর্জন!


এখন আমি চাই আমার বাবা-মায়ের জন্য কিছু করতে। তার জন্য আমার একটা চাকরি দরকার। আমার সব সমস্যা যেমনি চলে গেছে, তেমনি একদিন সব ঝামেলাও মিটে যাবে। আমি আগে ভাবতাম, জীবনটা নাটক-সিনেমার মতো…ভাবতাম আমি প্রতিক্লাসে ফার্স্ট হবো, আমার জীবনে কোনও একদিন এক ছেলের সাথে ধাক্কা লেগে প্রেম হবে, তার সাথে খুব লুতুপুতু একটা প্রেম করব, তাকে বিয়ে করব, তাকে নিয়ে সিনেমা দেখব, ঘুরব, খাব, ঘুমাব…তার পর একদিন টুক্‌ করে মারা যাব। আমার ছেলেমেয়েরা খুব কাঁদবে সেদিন।


…কী হাস্যকর সব চিন্তাভাবনা! প্রকৃত জীবনটা অনেক কঠিন। এখানে লড়াই করে বাঁচতে হয়। আর সে লড়াইয়ের পর যদি কখনও কোনও প্রাপ্তি আসে তো সেটার মতো সুখ আর কিছু নাই!


রনির ভার্সিটির সবাই জানে, রনি অনেক স্ট্রং পারসোনালিটির একজন মানুষ। শুনে আমার হাসি পায়। সত্যিই কি ওর মধ্যে ওটা আছে? আচ্ছা, রনি কি কখনও আয়নায় নিজের মুখটা না দেখে নিজের মনটা দেখার চেষ্টা করেছে? মনে করিয়ে দিই, রনির নামটা কিন্তু রনি না, আওরঙ্গজেব।


আর হ্যাঁ, আর একটা জিনিস শিখেছি জীবন থেকে। চার ফুট এগারো ইঞ্চির উনষাট কেজির মতো একটা হেঁড়েহোঁতকা মেয়েমানুষের নাটকের মতো স্বপ্ন দেখতে নেই, কাউকে ভালোবাসতে নেই, বড় কিছু আশাও করতে নেই। এইসব তার জন্য নিছকই বিলাসিতা! যদি সে এটা না বুঝে, তবে সে একটা গাধা!