পুরনো দোকানের খণ্ডপসরা/ এক

 
(গতকাল একটা মধুর ধাক্কা খেলাম, রাতে। রাত দেড়টায়।


সাল দুটো ১৯৯৭ ও ১৯৯৮। আমার ক্লাস সেভেনে ও এইটে পড়ার সময়। মনে আছে, তখন প্রচুর বই পড়তাম। আমাদের সময়ে খুব বইপড়ার চল ছিল। স্কুলের বই নয়, বাইরের। লিখতামও। কবিতাই লিখতাম বেশি। লেখালেখির হাতেখড়ি হয় তখনই।


খুব সস্তা কাগজে কলমে লিখতে হতো। (বলতে ইচ্ছে হলো বলেই বলি: যুবক জয় গোস্বামী তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘হৃদি ভেসে যায় অলকানন্দা জলে’ লিখেছিলেন সিগারেটের প্যাকেটের কাগজটার গায়ে।) তো 'পড়া ফাঁকি দিয়ে' লুকিয়ে লুকিয়ে কবিতা লিখছি, এটা তো মেনে নেওয়ার মতো কোনও জিনিস নয় গার্ডিয়ানদের কাছে। লেখার খাতা চাইব কীভাবে! তাই হাতের কাছে যা পেতাম, তাতেই লিখে রাখতাম মনে যা আসে। লিখেছি যা…আসলে আমি নই, আজ থেকে ২৩-২৪ বছর আগের ছেলেটি লিখেছিল যা, তা আর নেই।


সেসময় লুকিয়ে লুকিয়ে কয়েকটা খাতা বাঁধাই করেছিলাম কবিতা আর গদ্য লেখার জন্য। লিখতাম। মাথায় যা আসে, লিখতাম। মাথায় না এলে জোর করে টেনে এনে হলেও লিখতাম। মাথায় এসেছিল, লিখতেই হবে, অনেক কিছু লিখে ফেলতে হবে। হয়তো সেগুলোর একটাও লেখা-পদবাচ্য নয়, তাও লিখতে হবে! কেন ওরকম ভাবনা এসেছিল, মনে নেই। ১৩-১৪ বছরের একটা ছেলের মাথায় কী আসে কী আসে না, তার কোনও ঠিকঠিকানা নেই।


একদিন। সন্ধ্যায়। কারেন্ট নেই। হারিকেনের আলোয় পড়ছি। মা রান্নাঘরে। হঠাৎ আবিষ্কার করলাম, পেছনে মা। কখন জানি এসে দাঁড়িয়েছে চুপিচুপি। এসে দেখে, তার আদরের বাঁদরটি অঙ্ক প্র্যাকটিস না করে মহানন্দে কবিতা লিখছে অঙ্কের খাতায়। মাথায় বুদ্ধিসুদ্ধি অল্প ছিল, তাই ধরা পড়ে গেলাম। আমরা পুরনো মানুষ, কেরোসিনের ঘ্রাণ শুঁকে শুঁকে বড় হয়েছি। কুপিবাতি আর হারিকেনের আঁচে যারা বড় হয়, তারা একটু বোকাসোকাই হয়। আমরা তো আর ‘ফেসবুক’ দেখিনি, আমরা ‘বুক’ দেখে দেখে বড় হয়েছি। এখন ফেসবুকেই তো নিজের চেহারাটা নিজের পছন্দমতোই দেখে নেওয়া যায়, আবার বুকে যাবার কী দরকার? আমাদের সে সুযোগ ছিল না, নিজের চেহারাটা আমাদের দেখতে হতো বুকেই! আমাদের ব্যস্ততা কম ছিল, আমাদের হাতে বইপড়ার সময় ছিল। যে ছেলেটি বইয়ের ঘ্রাণ নিতেই শিখল না, সে আবার মানুষ হয় কী করে!


আমাদের মায়েরা 'হাত থাকতে মুখে কী!' নীতিতে বিশ্বাসী ছিল। আমরা তাই মার খেতে খেতে বড় হয়েছি। মায়ের হাতের মার না খেলে আবার বুদ্ধি খোলে নাকি? তখন ইন্টারনেট ছিল না, ছিল কেবল বেতের বাড়ি আর বই। একদিন পর থেকে যে ছেলের স্কুল-টার্ম শুরু হবে, সে ছেলে বসে বসে পড়াশোনা না করে কবিতা লিখছে, এটা মেনে নেওয়ার মতো ভালোমানুষ আমার মা ছিল না। অগত্যা...আবার কী! মার খেলাম! সে কী প্রচণ্ড মার! তখন মার খেলে হাতে পায়ে ফুলে উঠত, নীল নীল দাগ বসে যেত! মা হাতের কাছে যা পেত, তা-ই দিয়ে পিটাত। বেত লাগবেই তা নয়---হাতপাখা, পর্দার লাঠি, খাটের স্ট্যান্ড, শলার ঝাড়ু, খন্তির বাট, আঙুলের ফাঁকে কলম রেখে চাপ দেওয়া, নিলডাউন করিয়ে রাখা, কানে ধরে অসংখ্যবার উঠবস করানো…আর মায়ের হাতের চড়ঘুসি, চুলটানা---ওসব তো ছিলই! সে কী অমৃত…খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে ভয়ে কুঁকড়ে অস্থির হয়ে যেতাম! আমার অপরাধ ছিল, আপনাদের অনেকের মতোই, আমিও স্কুলে ফার্স্ট সেকেন্ড হতাম। তখন তো ছিল ফার্স্ট সেকেন্ড হওয়ারই বয়স! আর যারা ফার্স্ট সেকেন্ড হয়, ওদের কবিতালেখা বারণ, কেননা ওদের ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হতে হয়। হতে হয় মানে কিন্তু হতেই হয়! ফার্স্টবয়রা ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হতে না পারলে না খেতে পেয়ে পেয়ে একদম মরেটরে যায়। আমাদের সময়ে ওটাই ছিল নিয়ম। (ইদানীং যেমন একটা নতুন নিয়ম হয়েছে…যারা বিসিএস ক্যাডার হতে পারে না, তারা অনাহারে ধুঁকে ধুঁকে মরে যায়, ওরকম আরকি! ভেবে দেখুন, আজকের দিনে যেখানে উচ্চশিক্ষিত লোকজনও ভাবেন, বিসিএস ক্যাডার হতে না পারলে বুঝি জীবনটাই শেষ, সেখানে আমাদের মায়েরা তো ছিল সেকেলে অল্পশিক্ষিত মানুষ, তারা তাদের সন্তানের জন্য অমন করে ভাববে, এটাই তো স্বাভাবিক।)


তো আমাকে মারতে মারতে আমার সবকটা গল্প-কবিতার খাতা মা নিয়ে নিল। আমাকে দিয়ে শপথ করাল যে আমি আর কক্ষনো গল্প-কবিতা লিখব না। মায়ের মারের সামনে করা যায় না, এমন একটা শপথও পৃথিবীতে নেই। তবে মায়ের কাছে করা শপথটা ভেঙে আমি এখন ভালো আছি। আনন্দের কথা, এই অবাধ্য ছেলেকে নিয়ে আমার মা-ও ভালো আছে।


মা রাগ করে সেই সম্মানিত বাচ্চা-লেখকের খাতাগুলো সেরদরে বেচে দিয়েছিল। (সে টাকা দিয়ে মা কয়েকটা বিল্ডিং তুলেছিল আর গাড়ি কিনেছিল!) তাই সেগুলো আর নেই। টুকরো টুকরো কাগজে যা লিখেছি, সেগুলো থাকার কথা নয়, তাই সেগুলোও নেই। সেই মার খাওয়ার দিন একটা খাতার খোঁজ মাকে দিতে ভুলে গিয়েছিলাম। সেটি ছিল অন্য এক জায়গায়, আমার বন্ধুর ব্যাগে। পরে সেটিকে যত্নে রেখেছি বহু দিন। আবার হারিয়ে গিয়েছিল। গতকাল রাতে পুরনো কিছু কাগজ ঘাঁটতে গিয়ে ওটা পেলাম। হাতের নেবার পর মনে হলো, যেন হৃদয়ের কম্পনগুলো গোনা যাচ্ছে! ওতে প্রথম প্রেমের তাজা আবেগ জড়িয়ে আছে যে!


খাতার অর্ধেক পৃষ্ঠাই নেই। ছিঁড়ে গেছে, পড়ে গেছে কোথাও। যা আছে, ছবি তুলে দিয়ে দিলাম। দিয়ে দিতে ইচ্ছে হলো, তাই দিলাম। জানি, লেখাগুলো ভুলে ভরা। বানানে ভুল, ছন্দে ভুল, গঠনে ভুল। ভুল আর ভুল পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায়। তবু ভুলগুলো তো আমারই, তাই প্রিয়। পুরনো ভুল সব সময়ই আনন্দ দেয় যদি সে ভুল থেকে বেরিয়ে আসা যায়। ভুল করতে করতেই তো বেঁচে ছিলাম, এখনও তা-ই আছি। তখন প্যাঁচানো প্যাঁচানো বা টানা টানা, যা-ই বলুন কেন, তেমন ফন্টে লিখতাম। আমাদের স্কুলের প্রধান শিক্ষকের মার খেয়ে ওরকম রাবীন্দ্রিক স্টাইলে লেখা শিখতে বাধ্য হয়েছিলাম। ভালো কথা, একটা লেখায় তারিখ লেখা ২০০০ সালের।


কিছু কবিতার নিচে কৌতুক লিখে রেখেছিলাম। কেন, মনে নেই। কোথাও কোথাও নিজে নিজে বানানো 'বাণী' লিখে রেখেছি। সেসময় আমি উঠতে বসতে প্রচুর প্রচুর বাণী প্রসব করতাম! বাণী বানালে নিজেকে জ্ঞানী জ্ঞানী মনে হতো। সেগুলো, যেখানে মন চাইত, সেখানেই লিখে রাখতাম। হয়তো খাতায় কবিতা লেখার পর যখন দেখলাম, কিছু জায়গা খালি পড়ে আছে, সেই জায়গাটার সদ্ব্যবহার করেছিলাম কৌতুক আর বাণী লিখে রেখে। কয়েকশ কবিতার কয়েকটি মাত্র আমার হাতে, এতেই অনেক আনন্দ হচ্ছে।


মনে রাখতে হবে, আমাদের সময়ে আমরা মোবাইল চোখে দেখেছি ক্লাস টেনের শেষের দিকে, তাও ছুঁয়ে দেখতে পারিনি, কেবলই দূর থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল সমীরণ স্যারের হাতে। স্যারের কাছে আমরা বাংলা-ইংরেজি-সামাজিক বিজ্ঞান পড়তাম। উনি দূর থেকে আমাদের সামনে সিটিসেল সিমের মোবাইলটা হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে দেখাচ্ছিলেন আর বলছিলেন, "আমি চাইলেই এখন এটা দিয়ে আমেরিকায়ও কথা বলতে পারি! কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আমেরিকার লোকটা আমার সব কথা হুবহু শুনতে পারবে! এই যেমন তোমাদের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছি, ওরকম করে কথা বলা যাবে!" আমরা সবাই সেই বিচিত্র জাদুর দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে ছিলাম। আমি বোকার মতো জিজ্ঞেস করেছিলাম, "স্যার, এটা দিয়ে আপনি ঢাকায় আমার মাসির বাসায় কথা বলতে পারবেন? ওদের তো টেলিফোন আছে!" উত্তর পেয়েছিলাম, "গাধার মতো প্রশ্ন করবে না। টেলিফোন তো ফকিরা জিনিস! এটার দাম জানো তুমি? এক লাখ টাকা!" কী প্রশ্ন করলাম আর কী উত্তর পেলাম! ওই বয়সে কি আর এক লাখ টাকার অর্থ জানতাম! সালটা ২০০০, তখন এক লাখ টাকা সত্যিই অনেক টাকা! ওই টাকা দিয়ে সিটিসেল সিম কিনলে সিমের সাথে সেট ফ্রি পাওয়া যেত!


----------------------------------------------------
৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০)


(খাতার পৃষ্ঠা ছিঁড়ে গেছে, তাই কবিতার বাকি অংশ ও নাম-তারিখ পাইনি।)


দেশটাকে যেন খাচ্ছে গিলে
সন্ত্রাসীরা যত,
পুলিশেরাও ওদের ভয়ে
করে মাথা নত।
সন্ত্রাসীরা জনগণের
করছে পকেট ফাঁকা,
পুলিশেরা হচ্ছে মোটা
খেয়ে ওদের টাকা।
একাত্তরে উড়িয়েছিলাম আমরা
বিজয়ের নিশানা,
তবুও কেন শোনা যায় আজ
মা-বোনদের বুকফাটা কান্না?
আমরা কেন ভীত থাকি
সন্ত্রাসীদের জন্য?
আমরা বাঙালি, স্বাধীন জাতি,
এ কি আমাদের কাম্য?


হে মহান জাতির পিতা
---------------------------


হে মহান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান,
তুমি মোদের দিয়েছ এনে বাঙালি জাতির সম্মান।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনিকে না করে তুমি ভয়,
বজ্রকণ্ঠে দিয়েছিলে ঘোষণা---“জয় বাংলার জয়”।
স্বৈরাচার আইয়ুব খান তোমায় ভয় দেখিয়েছিল কত,
বলেছিলে তুমি, জেল খাটব, তবু করব না মাথা নত!
৭ই মার্চে দিয়েছিলে তুমি বাংলার মুক্তির ডাক,
তখন বাংলামায়ের দামাল ছেলেরা হয়ে উঠেছিল বাঘ।
নয় মাস লড়াই করে মোরা হানাদারের সাথে,
ছিনিয়ে এনেছিলাম স্বাধীনতার লাল সূর্যটাকে।
তুমি চেয়েছিলে দেখতে বাংলাকে সবুজে শ্যামলে ভরা,
তোমার স্বপ্ন হতে দেয়নি পূর্ণ বাংলার দুশমনেরা।
চলে গেছ তুমি, তবু বলি আজ, তোমার মৃত্যু নাই,
বাংলার মাঠ-ঘাটে তাকালে আজও যেন তোমায় দেখতে পাই।


……………………………
১২ আগস্ট ১৯৯৭


লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু
----------------------


মশার বড় দুঃখ
সে গান করিতে না পারে,
মানবের গান শুনে সে
রাগে-হিংসায় মরে।
বিধাতারে জিজ্ঞাসে সে
কী ছিল মোর পাপ,
যার ফলে তুমি মোরে
দিলে হেন শাপ?
দিয়েছ উড়ার শক্তি মোরে
তবুও অখুশি হই,
মানব প্রিয় তার সমুধুর গানে
তবে আমি কেন নই?
বিধাতা হাসিয়া কহে,
দুঃখ করিস না বাছা,
এই নে দিলাম তোরে
যেমনি তোর ইচ্ছা!
মশা পাইল তেমন
যেমন ছিল তার পণ,
কণ্ঠ পাইয়া সে আনন্দে
করে ভনভন।
তাতে বেচারা মশার
বাঁচা হইল দায়,
রক্ত খাইতে গেলে মানব
আগেভাগে টের পায়।
অতি লোভ করিয়া মশা
হারায় এখন তার প্রাণ,
অতি লোভে তাঁতি নষ্ট (লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু)
এই হইল তাহার প্রমাণ!


(প্রকৃতপক্ষে কেউ কাউকে কোনও কিছু শেখাতে পারে না, শুধুমাত্র সত্যটাকে তার সম্মুখে তুলে ধরতে পারে।)
………………………………………………………
১৮ আগস্ট ১৯৯৭


একটি প্যারোডি কবিতা
------------------------------


আনন্দ রে আনন্দ, তোকে
কোথায় পাওয়া যায়?
তুই কি থাকিস তাদের কাছে
যারা ঘুষ খায়?
তুই কি থাকিস তাদের কাছে
যারা পরিশ্রম করে?
না কি থাকিস তাদের কাছে
যাদের কারণে লোক মরে?
তুই কি বন্ধু মেধাবী ছাত্রদের
যারা দিন রাত খাটে?
না কি তুই বন্ধু ক্যাডার ছাত্রদের
যারা অস্ত্র নিয়ে হাঁটে?
তুই কি থাকিস ধনীদের কাছে
যারা অত্যাচার করে?
না কি থাকিস গরীবদের কাছে
যারা দিনরাত খেটে মরে?
আনন্দ রে আনন্দ, বল
তুই যে থাকিস কোথা?
তুই কি থাকিস সেখানটাতে
খুনাখুনি হয় যেথা?
ছাত্রদের হাতে তুই কি বোমা
না কি মাদকদ্রব্যের খেলা?
তুই কি অস্ত্রের ঝনঝনানি
না কি শান্তি-সুখের মেলা?
তুই আমার মা-বোনদের
অশ্রুসিক্ত চোখ?
না কি ওসব পশুতুল্য
রক্তচোষা জোঁক?


(আহসান হাবীবের ‘আনন্দ’ কবিতা অবলম্বনে)


(আমি তো অনেকের কথাই ভাবি, কিন্তু আমার কথা ক’জনে ভাবে?)
…………………………………………………………
২৩ আগস্ট ১৯৯৭


ষড়ঋতুর বৈচিত্র্যে ভরা বাংলাদেশ
---------------------------------


সবুজে-শ্যামলে শস্যে ভরা আমাদের এই বাংলাদেশ,
ষড়ঋতুর বৈচিত্র্যে তার রূপের যেন নেইকো শেষ।
প্রথমে আসে গ্রীষ্ম, বর্ষা আসে তার পরে,
শরৎ হলো তৃতীয় ঋতু, তার পরেই হেমন্ত আসে।
হিমের পরশ নিয়ে তার পর শীতের বুড়ি আসে,
ফুলের ফলের মেলা নিয়ে বসন্ত যেন হাসে।
গ্রীষ্মকালের খাঁ খাঁ রোদে আম-কাঁঠালের মজা,
বর্ষাকালে খুবই মজা ঝমঝম বৃষ্টিতে ভিজা।
শিউলিফুলের মেলা নিয়ে শরৎ যে তার পর আসে,
ধান্যে ভরা হেমন্ত যেন নবান্নরূপে হাসে।
শীতের বুড়ি হিমেল পরশ নিয়ে আসে শীতকালে,
বসন্তে প্রকৃতি যেন ধরা পড়ে ফুলের জালে।
ছয় ঋতুতে ও বার মাসে ভরা মোর এই জন্মভূমি,
ফুলে-ফলে সাজিয়েছে তারে, সত্যিই উদার প্রকৃতি তুমি।


……………………………………………………
২৪ আগস্ট ১৯৯৭


স্বার্থ
----------------


এ পৃথিবীতে সবাই স্বার্থের জন্য করছে মারামারি,
ক্ষুদ্রাতি-ক্ষুদ্র, তুচ্ছাতি-তুচ্ছ জিনিস নিয়ে করছে কাড়াকাড়ি।
এ পৃথিবীতে সবাই শুধু স্বার্থের কথাই ভাবছে,
এর জন্য হানাহানি করে কত লোকই না মরছে।
এ পৃথিবীটা যেন হয়ে গেছে রণক্ষেত্র,
হিংসা-ক্রোধ-ঘৃণার বাণে বিদ্ধ হচ্ছে সবাই,
সবাই ভুলে যাচ্ছে সব মানুষ আমার আপনজন,
আমরা সবাই ভাই ভাই।
অনিষ্টচিন্তা, স্বার্থচিন্তা প্রভৃতিতে ভরে গেছে সবার মন,
পাবে না এমন লোক এ পৃথিবীতে,
সুন্দর মনের অধিকারী যে জন।
যে জন করবে প্রতিজ্ঞা, ‘সুন্দর হব আমি’,
চেষ্টায় কি না হয়,
বলবে লোকে তারে পাগল, বোকা,
মূর্খ ছাড়া আর কিছু নয়।
আমরা কি পারি না সবার কল্যাণচিন্তা করতে,
পারি না কি আমরা এ পৃথিবীকে সুন্দর কিছু উপহার দিতে?


…………………………………………………
২৪ আগস্ট ১৯৯৭


বৃক্ষ
------------------


বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে চাই আমি,
চারিদিকে আমার শুধু দূষিত পরিবেশ।
আমি যেতে চাই সেখানে, যেখানে আছে সবুজের ছড়াছড়ি,
আমি যেতে চাই সেখানে, যেখানে নেই কোলাহল,
যেখানে আছে পাখির কিচির-মিচির, সবুজের বাগান,
যেখানে নেই মানুষের হুড়োহুড়ি।
যেখানে কোনও নেই অশান্তি, নেই খুনাখুনি, নেই বিদ্বেষ,
যেখানে গেলে মনে হবে যেন স্বর্গরাজ্য,
যেখানে বন-বনানীর ছায়া আছে, আছে অনাবিল শান্তি,
যেখানে গেলে মনে হবে যেন এই বৈজ্ঞানিক সুখ পরিত্যাজ্য।
জানি, সে জায়গা পাওয়া বড় কঠিন,
কারণ মানুষ বৃক্ষনিধন যেভাবে করছে দিনদিন!
‘ইটের পাঁজরে, লোহার খাঁচায়’ নিজেদের আবদ্ধ রাখতে,
কেটে উজাড় করছে বনভূমি সবখানেতে।
বৃক্ষ আমাদের অক্সিজেন দেয়, আর দেয় আমাদের যা প্রয়োজন,
আর আমরা নিষ্ঠুর কুঠারাঘাতে সে বৃক্ষ করছি কর্তন।
বৃক্ষ তো বলতে পারে না, “ব্যথা পাচ্ছি আমি, মেরো না আমায়।
তোমরা মানুষেরা যেমন ব্যথা পাও, তেমনি আমরাও পাই।”
আমরা কি পারি না চারিদিকে সবুজ বেষ্টনী গড়ে তুলতে?
পারি না কি আমরা আমাদের বন্ধু, প্রকৃতির সম্পদ বৃক্ষকে বাঁচিয়ে রাখতে?


(জনৈক ব্যক্তি: কী ভাই, এখানকার গাছগুলো সব কেটে ফেলছেন কেন?
শ্রমিক: কারণ আজকে এখানে বন ও পরিবেশমন্ত্রী ভাষণ দিবেন।)


………………………………………………
২৪ আগস্ট ১৯৯৭


My Cat
--------------------


I have a cat,
She is very fat.
She has soft far,
I love her.
She has a round head,
She sleeps on my bed.
She has two eyes,
She catches mice.
She is afraid of the dog,
She doesn’t eat the frog.
She steals milk from the jar,
But I love her.


মোরা সবাই ভাই ভাই
---------------------------------------


হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান,
মোরা সবাই ভাই ভাই
একই মায়ের সন্তান।
হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান,
মোরা এক ভাষাতেই কথা বলি,
করি এক ভাষাতেই গান।
মোরা বাঁচার জন্য সংগ্রাম করি,
ছাড়ি না বাঁচার হাল,
মোদের গঠন একই, উদ্দেশ্য একই,
ভিতরের রক্ত লাল।
মোরা একই গাছ হতে ছায়া গ্রহণ করি,
একই গাছের ফল খাই,
মোরা একই বাতাস করি উপভোগ,
একই দিকে এগিয়ে যাই।
সুখেতে মোরা হাসি সবাই,
দুঃখে ঝরাই চোখের জল,
মোরা একই মাটিতে ফলাই শস্য,
একই মাটিতে ফল।
তিনি এক, তিনি অদ্বিতীয়
যাঁকে মোরা করছি উপাসনা,
কেউ-বা ডাকছি বুদ্ধ, আর কেউ-বা গড,
কেউ-বা ডাকছি ভগবান, কেউ-বা আল্লাহ।
মোরা মানবধর্ম পালন করি,
মোরা মানবজাতি,
কোরান-গীতা-বাইবেল-ত্রিপিটক
একই কালি দিয়ে লিখি।
নির্দিষ্ট সময়ে আসি মোরা,
নির্দিষ্ট সময়ে যাই,
মোরা একে অন্যের একান্তই আপন,
মোরা ভাই ভাই।


(আমি ভেবেই পাই না যে তাজমহল প্রেমের নিদর্শন হতে পারে কীভাবে, তা তো স্বার্থপরতার এক জীবন্ত নিদর্শন!)


………………………………………………………
২৬ আগস্ট ১৯৯৭


পারতাম যদি
----------------------


পাখির মত হতাম যদি,
যদি হতাম গাছের মতো!
পারতাম যদি ধুয়ে-মুছে দিতে
এ পৃথিবীর কালিমা যত!
প্রজাপতির হতাম যদি,
ফুলে ফুলে উড়ে বেড়াতাম!
মোর গায়ের সোনালী রঙ যদি
পৃথিবীর মাঝে ছড়াতে পারতাম!
হতাম যদি চন্দ্র-সূর্য,
তবে ছড়াতাম কত আলো,
মোর আলো দিয়ে ফেলতাম মুছে
পৃথিবীর যত কালো!
হতাম যদি গাছের মতো,
কী আনন্দই হতো না বল,
গাছের মতো দিতে পারতাম যদি
অন্ন-জল, ফুল ও ফল!
হতাম যদি মাটির মতো,
তবে গর্বিত হতাম শহীদের রক্তে,
ফলাতাম মোর বুকে শস্য আমি,
তবে পারতাম কল্যাণকর কিছু করতে!
চাই না আমি সুখ-সমৃদ্ধি,
সম্পদের পাহাড় গড়তে,
আমি চাই জনহিতকর কাজ করে
মানবের তরে মরতে।


(দাদু: আচ্ছা দাদুভাই, তুমি কি ব্যবসা করে বড় হবে, না কি লেখা-পড়া শিখে বড় হবে?
নাতি: দাদু, আমি এত কষ্ট করে বড় হব কেন? আমি টুলের উপর টুল দিয়ে বড় হব।)


…………………………………………………
২৭ আগস্ট ১৯৯৭


হিন্দু-মুসলমান
-----------------------------


গাহি আজ মোরা আনন্দের গান,
আজ একত্রিত হয়েছি মোরা
ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে, হিন্দু-মুসলমান।
আজ মসজিদে দিচ্ছে মোল্লা আজান,
মন্দিরে বাজছে ঘণ্টা,
আজ মোরা হয়েছি ঐক্যবদ্ধ,
নেই হাঙ্গামার শঙ্কা।
আজ হিন্দু বলছে, “মুসলিম আমার ভাই,
একান্তই আপনজন।”
আজ মুসলমানেরা হয়েছে হিন্দুদের ভাই,
কেউ কারও নয় দুশমন।
আজ মোরা হিন্দু-মুসলিম হয়েছি একজোট,
মোদের মধ্যে হবে না কখনও ছাড়াছাড়ি,
মোদের মধ্যে রইবে একতা,
হবে না মারামারি।
মোরা আজ গাহিব ঐক্যের গান,
মোরা আজ ধরিব একতান।
মোদের এ শ্রম কভু না হবে পণ্ড,
মোদের দেখিয়া আজ কেহ বলিতে পারিবে না,
“বাধিয়া গিয়াছে হিন্দু-মুসলমান কাণ্ড!”
আজো মুসলিম পরছে ফতুয়া,
আর হিন্দুরা পরছে ধুতি,
পৃথিবী ভেঙে দুভাগ হবে,
তবু ভাঙবে না মোদের সম্প্রীতি।
মোরা সহোদর,
ছিন্ন হবে না কভু মোদের এই ভ্রাতৃত্বের বন্ধন।
দুর্গম গিরি পার হব মোরা,
প্রয়োজনে মৃত্যুকে করব আলিঙ্গন।
হিন্দু করিছে দেবতার পূজা,
মুসলমান করিছে আল্লাহর সেবা।
আজ কেউ কারও উপাসনায়
দিবে না কোনও বাধা।
সৃষ্টিকর্তা এক, তিনি অদ্বিতীয়,
তাঁকে পাবার জন্য মোরা করছি কতই না কাজ!
হিন্দু ঘরে পূজা-পার্বণ, আর
মুসলিমে নামাজ।
পৃথিবীকে আলোকিত করব মোরা
দুই ভাই একত্রে হাত ধরে,
একসাথে থাকব মোরা,
যাব না কেউ কারও হতে সরে।
শত বাধাবিঘ্ন, শত বিপর্যয়,
কোনও কিছুকে মোরা করব না ভয়,
বুকে বল নিয়ে মোরা যাব এগিয়ে,
পৃথিবীকে মোরা করবই জয়।


(জীবনে যতটা জন্মদিন আসবে, আমরা ততটা মৃত্যুর দিকে এক বছর করে এগিয়ে যাব। তাই জন্মদিনে আনন্দ করার সাথে সাথে আমাদের এই ভেবে শংকিত হওয়া উচিত যে আমরা মৃত্যুর দিকে ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছি, বছরগুলো জীবনের ডায়রি হতে হারিয়ে যাচ্ছে।)


…………………………………………………………
২৭ আগস্ট ১৯৯৭