পৃথিবীর পথে

আপনি ততক্ষণ পর্যন্ত এ দুনিয়ার আসল চেহারা সম্পর্কে শতভাগ জানতে পারবেন না, যতক্ষণ আপনার বাবা-মা বেঁচে আছেন। আপনি যদি মনে করেন, আপনার আশেপাশের ফেরেশতাতুল্য লোকজন আপনার বাবা-মায়ের মৃত্যুর পরে একজন ফেরেশতার মতনই আপনার পাশে এসে দাঁড়াবে, মাথায় হাত রেখে সান্ত্বনা দেবে, তবে আমি বলব, ভাই, জীবন নামের সিনেমার আপনি শুধু ট্রেইলারই দেখেছেন, পুরো সিনেমা এখনও বাকিই আছে।


হ্যাঁ, মানছি, দু-একজন মানুষ, যাঁরা আগেও ভালো ছিলেন, তাঁরা তখনও ভালোই থাকবেন। তবে সেটা ওই দু-একজনই। দুই যোগ এক সমান তিনজনই হবে বড়োজোর, এর বেশি কিছুতেই না। জীবন নামের ওই সিনেমার কে যে ভিলেন, আর কে যে সাইডরোলটা প্লে করে যাচ্ছিল এতদিন, আপনি এটা বাবা-মায়ের মৃত্যুর পরেই বুঝবেন। হ্যাঁ, তবে মূলচরিত্রে, আগের মতোই, আপনিই থাকবেন, এটা ঠিক।


ও আচ্ছা, ভালো কথা, ওই সময়ে আপনার প্রেমিক/প্রেমিকা অথবা স্বামী/স্ত্রীরও সেই রূপটা দেখতে পাবেন, যেটা হয়তো আগে কখনও দেখেননি। পার্টনারকে সেই সময়ে খুব ভালো আচরণ করতে দেখা যায় সাধারণত, আবার এর উলটোটাও ঘটতে দেখতে পাবেন হয়তো। সে এমন আচরণ করবে যেন কিছুই হয়নি, তার আচরণ এরকম হবে যে…মানুষ তো মারা যাবেই, এতে এত আবেগপ্রবণ হবার কী আছে?!


এবার আসি আত্মীয়স্বজনের কাছে। আপনি বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর থেকে মাত্র তিন দিনের মধ্যে সেইসব আত্মীয়স্বজনকে দেখতে পাবেন, যাদের হয়তো আগে কখনওই দেখেননি। এদের অধিকাংশই আসে কোনও-না-কোনও ধান্দা হাসিলের জন্য। এদের কেউ কেউ আপনার মৃত বাবা অথবা মায়ের নাম ধরে এতই মায়াকান্না জুড়ে দেবে যে আপনার মনে হবে, এতিম আপনি না, তিনিই হয়েছেন। তাদের কেউ কাঁদবে তো কাঁদবেই, আবার কেউবা কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞানই হয়ে যাবে! তখন আপনাকে আর কে সান্ত্বনা দেবে? উলটো আপনাকেই গিয়ে তাকে সান্ত্বনা দিতে হবে। অথচ এইসব আত্মীয়স্বজনদের কেউ কেউ, বেঁচে থাকাকালীন আপনার বাবা-মায়ের খোঁজটাও কখনও নিয়ে দেখেননি, বরং নানান সময়ে অসময়ে আপনার বাবা-মায়ের সাথে দুর্ব্যবহার করেছে। তাদের মায়াকান্নার কিছু আলাদা অর্থ আছে। দিন যেতে থাকবে, আর আপনি ক্রমেই বুঝতে পারবেন, এসব আত্মীয়স্বজন দেশের নানান প্রান্ত থেকে আলোর বেগের চেয়েও দ্রুতগতিতে কেন এসেছেন আজ এতদিন পর!


এবার আসি বাবা-মায়ের কাছে।


আপনার বাবা জীবিত থাকা অবস্থায় মা মারা গেলে নিচের ঘটনাগুলির যে-কোনও একটি ঘটতে পারে বলে আমার মনে হয়। হ্যাঁ, ব্যতিক্রমী কিছুও হতে পারে, তবে ব্যতিক্রম তো ব্যতিক্রমই।


১. মায়ের পাওনা জমিজমা নিয়ে ভেজাল লাগতে পারে। তাঁকে সেসব সামলাতে হবে।


২. তাঁকে নানান মানুষ সঙ্গিনীর মৃত্যুর পর থেকেই দ্বিতীয় বিয়ে করার কথা বলতে থাকবে, অথচ বেচারা নিজে হয়তো কোনও দিনই এরকম কিছু ভেবেই দেখেননি। স্ত্রীর মৃত্যুর বিয়ে-করা খারাপ, না ভালো, সেই বিচারে যাচ্ছি না, আমি শুধু আশেপাশের লোকজনের আচরণের কথা বলছি।


৩. স্ত্রীর আকস্মিক মৃত্যুতে তিনি হয়তো চট করে বুঝে উঠতে পারেন না যে তিনি কী করবেন, ফলে তিনি নির্বিকার হয়ে যান।


৪. আপনার এবং আপনার ভাই-বোনদের দিকে তাকিয়ে তিনি দুনিয়ার আর সব ভুলে যান। তিনি আপনাদের নিয়েই পড়ে থাকেন সারাক্ষণই।


৫. যাঁরা সাধারণত প্রথম স্ত্রীকে অনেক ভালোবাসতেন, তাঁদের অনেকে একা একা স্মৃতির বোঝা টানার ভয়ে দ্বিতীয় বার বিয়ে করেন, যেটাকে সমাজ অন্য চোখে দেখে। কেউ কেউ আবার সন্তানদের মা পাইয়ে দেবার জন্যই আরেকটা বিয়ে করেন। আবার কেউ কেউ শেষবয়সের বার্ধক্য আর একাকী জীবনযাপনের ভয়ে বিয়ে করেন, কেউ কেউ আর বিয়ে করেনই না---ওরকম কিছুর কথা ওঁরা ভাবতেও পারেন না।


আর বাবা মারা যাওয়ার পরে মা জীবিত থাকা অবস্থায় সাধারণত যা যা হয়:


১. মায়ের বয়স কম থাকলে অথবা পরিবারের চাপে উনি আরেকটা বিয়ে করেন। যদিও, এখনও, স্বামীহারা কোনও মহিলার একাকিত্ব কিংবা মন আর শরীরের চাহিদা বলে যে কিছু আছে, এটা বোঝার বেলায় আমাদের এ সমাজ একেবারেই কোলের বাচ্চাশিশুর মতন আচরণ করে!


যা-ই হোক, বিয়ে করলে তিনি হয় সন্তানকে সাথে নিয়েই বিয়ে করেন, নয়তো সন্তানের একটা নিশ্চিত ব্যবস্থা করে তবেই বিয়েটা করেন। অবশ্য, অধিকাংশ ক্ষেত্রে, মায়েরা বিয়েই করেন না।


২. বাবার মৃত্যুর পরে জমিজমা নিয়ে যে বিরাট অশান্তি হয়, সেগুলো মা-ই সামাল দেন। অনেক পুরুষের কাজই হচ্ছে জীবিতাবস্থায় জমিজমা নিয়ে দুনিয়ার ঝামেলা তৈরি করতেই থাকা। এটা যত না প্রয়োজন, ততোধিক...নেশা।


৩. উনিও স্বামীর মৃত্যুতে দিশেহারা হয়ে পড়েন, তবে নির্বিকার হয়ে যান না। মায়ের হাতে তিন দিনও শোকপালন করার সময় থাকে না। দেখা যাবে, বাবা মারা যাবার পরের বেলাতেই আপনার মা আপনাকে জিজ্ঞেস করবেন, তুই খেয়েছিস তো বাবা?


৪. উনি সব ভুলে গিয়ে আপনার দিকে তাকিয়ে এক নতুন জীবন শুরু করেন। এটা ভেবে না যে আপনি ভবিষ্যতে তাঁকে দেখে-টেখে রাখবেন; বরং এজন্য যে, মা হলে তাকিয়ে থাকতে হয়---মা হবার পর থেকেই। মায়েরা ঘুমের মধ্যেও চোখ আর মন খোলা রাখেন সন্তানের জন্য, মায়েরা একেবারে চোখ বন্ধ করেন মৃত্যুর সময়ই।


এখানে আমি বাবা-মা, এই দুজনের ভালোবাসা কিংবা অন্য কোনও আবেগের তুলনা করিনি; বাবা কিংবা মা, কেউই সন্তানকে কম ভালোবাসেন না। তাই কে বেশি ভালোবাসেন, এই তুলনায় যাওয়াটা একধরনের বোকামো আর অন্যায় মনে হয় আমার কাছে। আমাদের মাথায় রাখতে হবে, নারী আর পুরুষের আবেগ এবং আবেগ প্রকাশের ধরন কখনওই একরকম হয় না। এখানে শুধুই বাস্তব চিত্রটি তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।