পেঙ্গুইনটা উড়ছে!

প্রত্যেক মানুষই বিশ্বাস করতে ভালোবাসে, সে বিশেষভাবে আশীর্বাদপ্রাপ্ত, ফলে অন্যদের তুলনায় তার জীবনে খারাপ কিছু ঘটার আশংকা কম এবং অন্য যে কারো চাইতে তার জীবনে ভাল কিছু ঘটার সম্ভাবনা বেশি। “কোনো ঘটনা যতো বেশি নেতিবাচক, আমার জীবনে তা ঘটার আশংকা অন্যদের তুলনায় ততো কম। কোনো ঘটনা যতো বেশি ইতিবাচক, আমার জীবনে তা ঘটার সম্ভাবনা অন্যদের তুলনায় ততো বেশি।”—লোকে এরকম করেই ভাবে। আমরা সবাইই অনেক ধরনের আশায় বাঁচি। কীরকম আশা? এই যেমন, আমরা ধরেই নিই, আমাদের জীবনে যাকিছু ঘটতে যাচ্ছে, তার বেশিরভাগই ভালকিছু। খারাপ কোনোকিছু আমাদের জীবনে অতোটা ঘটবে না। আমরা যে রিলেশনে আছি, কখনোই সেটার বিচ্ছেদ ঘটবে না। আমাদের ক্যান্সার হবে না, রাস্তায় বের হলে আমরা কোনো দুর্ঘটনার মুখোমুখি হবো না। আমরা অনেকদিন বাঁচবো, আমাদের ক্যারিয়ারটা দারুণ কিছু একটা হবে। এক কথায়, আমার জীবনে যা ঘটবে, সেটার সবচাইতে সুন্দর রূপটা কল্পনা করতে এবং সেটাকেই আঁকড়ে ধরে বাঁচতে আমরা অভ্যস্ত। এরকম প্রত্যাশা কে কতটা বেশি বা কম করে, তা নির্ভর করে ব্যক্তির অবস্থান, পারিপার্শ্বিকতা এবং পছন্দের উপর। বিশ্বাস, আকাঙ্ক্ষা এবং আশা মানুষের সিদ্ধান্ত এবং কাজের প্রকৃতি নির্ধারণ করে দেয়। কীরকম? একটা উদাহরণ দিই। বশিরের ফ্যামিলি হিস্ট্রি বলে, তার হার্ট অ্যাটাক হওয়ার আশংকা ৩০%, যেখানে তার বয়সি একই শারীরিক অবস্থার একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের হার্ট অ্যাটাক হওয়ার আশংকা ২৫%। আমরা ধরেই নিই, বশির খুব সংকটজনক অবস্থার মধ্যে আছে। আবার সেই একই বশিরের ফ্যামিলি হিস্ট্রি যদি এমন হতো যে তার হার্ট অ্যাটাক হওয়ার আশংকা বেড়ে দাঁড়াত ৩৫%-এ, যেখানে তার বয়সি একই শারীরিক অবস্থার একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের হার্ট অ্যাটাক হওয়ার আশংকা ৪০%, তাহলে আমরা ধরে নিতাম, বশির অপেক্ষাকৃত কম সংকটজনক অবস্থার মধ্যে আছে। আর যদি বশিরের ফ্যামিলিতে হার্ট অ্যাটাকের কোনো পাস্ট হিস্ট্রিই না থাকত, তখন তার বয়সি একই শারীরিক অবস্থার একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের হার্ট অ্যাটাক হওয়ার আশংকা ৬৫% হলেও বশির কিংবা আমরা কেউই ভাবতে চাইতাম না যে, বশিরের শারীরিক অবস্থা বাকি ৩৫% সম্ভাবনার মধ্যে অবস্থান করছে না। এক গবেষণায় দেখা গেছে, যদি কারো হার্ট অ্যাটাক করার প্রকৃত আশংকা হয় ৬০%, কিন্তু সে নিজে বিশ্বাস করে, কিংবা তাকে বিশ্বাস করানো হয় যে, ওই আশংকাটি ৩০%, তবে তার স্ট্রেস-লেভেল কমে যাওয়ার কারণে এবং ইতিবাচক মানসিক গঠনের ফলে প্রকৃত আশংকাটি কমপক্ষে ১০% কমে যায়। ভাল চিকিৎসকরা রোগীকে তার সুস্থতা সম্পর্কে আশাবাদী করে তোলেন, এবং এই টেকনিকে সত্যি সত্যিই রোগীর রোগের প্রকোপ অনেকটাই কমে যায়।

কোনো একটা বিশ্বাসের পেছনে বিভিন্ন ধরনের কারণ থাকতে পারে। বিয়ের কথাই ধরি। তরী বিশ্বাস করে, তার ডিভোর্স হবে না। কেন বিশ্বাস করে? হতে পারে, ওরকম বিশ্বাস করার পেছনে অনেকগুলি যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে। সে কারণগুলি এতোটাই শক্ত যে, কোনোমতেই ডিভোর্সের প্রশ্নই ওঠে না। এমনও হতে পারে, তরী চাইছে না, তার জীবনে এমনকিছু ঘটুক, যেটার কারণে তার ডিভোর্স হয়ে যেতে পারে। ডিভোর্স হবে কী হবে না, সেটা নির্ধারণ করে যে বিষয়গুলি, সেগুলি সম্পর্কে তরী তেমন কিছু জানে না, বা সেগুলির উপর তার কোনো হাতও নেই, ব্যাপারটা হচ্ছে স্রেফ এই যে, সে চাইছে না, তার ডিভোর্স হোক। যা-ই ঘটুক না কেন, সে নিজ থেকে কখনোই ডিভোর্সে আগ্রহী হবে না। আবার তরীর মনে এও থাকতে পারে যে, সে এমনকিছু করবে না যেটার কারণে ডিভোর্স হয়ে যেতে পারে, সে একজন (তার নিজের বিচারে) আদর্শ স্ত্রী হয়েই থাকবে, তবে তার জীবনে যদি এমনকিছু ঘটে, যেটার কারণে কোনোভাবেই সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখা যাচ্ছে না, তবে সে ডিভোর্সের দিকেই যাবে। পশ্চিমা বিশ্বে ডিভোর্সের হার প্রায় ৪০ শতাংশ। মানে, প্রতি ৫টার মধ্যে ২টা বিবাহিত জীবনযাপনের ইতি ঘটে। অথচ, সদ্য বিয়ে করেছে, এমন কোনো যুগলের সাথে আলাপ করে দেখুন; দেখবেন, ওরা বিশ্বাস করে, কখনোই ওদের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটবে না। প্রেম করছে, এমন দুজন মানুষকে জিজ্ঞেস করলেও আপনি একই ধরনের উত্তর পাবেন। ওরা বিশ্বাস করে, ওদের প্রেম অনন্ত। সে গভীর বিশ্বাস থেকেই ওরা মেলামেশা করে। অথচ, খোঁজ নিলে জানতে পারবেন, শতকরা ৮৫ ভাগ প্রেমেই বিচ্ছেদ বা ব্রেকাপ হয়ে যায়।

প্রত্যেকটা মানুষই এটা বিশ্বাস করে যে, তার নিজের সন্তানটি ভীষণ মেধাবী। অন্য যেকোনো কারো সন্তানের চাইতে তার নিজের সন্তানটি প্রায় সব দিক দিয়েই অনন্য। তার রেজাল্ট যদি ভাল না হয়, তবে তার কারণ একটাই: সে চেষ্টা কম করে, বয়স কম বলে না বুঝে একটু ফাঁকিবাজি করে; কিন্তু একটু চেষ্টা করলেই সে সবাইকে ছাড়িয়ে যেতে পারবে। ও আসলে স্টুডেন্ট হিসেবে ভাল, অথচ দুষ্টুমি করে পড়াশোনা করে না বলেই আজ ওর এই অবস্থা। এমনকি, যখন তার বড় ভাইয়ের ছেলেটি পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়, নিজের অসীম প্রতিভাসম্পন্ন ছেলেটি একই পরীক্ষায় ফেল মারে, তখনো তার দৃঢ় বিশ্বাস, তার নিজের ছেলেটি আসলে কম পড়াশোনা করে ওর কাজিনকে ওর চাইতে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে! ক্যাসিনোতে যারা খেলে, তাদের প্রত্যেকেই বিশ্বাস করে, অন্য যে কারোর তুলনায় তার জেতার সম্ভাবনা বেশি। কলেজের অধ্যাপকরা প্রত্যেকেই ভাবেন, তিনি অন্য সবার চাইতে ভাল পড়ান, স্টুডেন্টদের জন্য বেশি পরিশ্রম করেন। স্তন ক্যান্সারের কিছু লক্ষ্মণ বা সন্দেহ মনের মধ্যে উঁকি দিলেও বেশিরভাগ মহিলাই স্তন পরীক্ষা করাতে চাইবেন না, কেননা উনি ধরেই নেন, “কোন দুঃখে আমার স্তন ক্যান্সার হতে যাবে?” প্রত্যেক প্রেমিকই মনে করে, সে অন্য সবার চাইতে আলাদা। সে দেখতে অন্যদের চাইতে ভাল, স্মার্ট; তার কণ্ঠস্বর সবচাইতে রোমান্টিক। আর যা-ই হোক, সে অ্যাভারেজ গোছের প্রেমিক নয়। তার প্রেমিকার পাশে সে বাদে পৃথিবীর অন্য যেকোনো ছেলেই বেমানান। সে তার প্রেমের রাজ্যে সবচাইতে সুদর্শন যোগ্য নায়ক!

এমনই হয়। আমরা আমাদের নিজেদের সম্পর্কে, নিজেদের পরিবার সম্পর্কে, নিজেদের সন্তানদের সম্পর্কে ভীষণ আশাবাদী। কিন্তু, নিজেরা বাদে অন্য কারো সম্পর্কেই আমাদের তেমন কোনো আশাবাদ নেই। যার ভাগ্যে যেমন অঘটনই ঘটে ঘটুক, আমাদের খারাপ কিছুই হবে না। সবাই মরে যাবে, আমরাই কেবল অমর হয়ে থেকে যাবো। আমাদের আগামীটা সবচাইতে সুন্দর হবে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সবাইই নিজেকে দেখে আর ভাবে, সে এই পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর মানুষ। আপনি কতটা মজার? আপনি কতটা আকর্ষণীয়? আপনি কতটা মেধাবী? আপনি কতটা সৎ? আপনি কতটা বিনয়ী? আপনি কতটা যৌক্তিক? এরকম কিছু প্রশ্ন আমাদের করা হলে আমরা প্রায় সবাইই নিজেদেরকে অন্যদের তুলনায় সেরা ভাববো। সবাইই সেরা হবে, এটা কি আদৌ সম্ভব? সবাইই উত্তম হলে মধ্যম বা অধম কে হবে? অথচ, আমরা সত্যিই ওরকম করে ভাবতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। সবাই ভাবছে, সে-ই ঠিক, বাকিরা সবাই ভুল। সবচাইতে সুন্দর দিনগুলি তার হবে, বাকিরা সব বসে-বসে আঙুল চুষবে। এখন কথা হল, এমন ভাবনা আমাদের জন্য কতটুকু ভাল? কেউ-কেউ বলবে, না, এটা ভালকিছু নয়। কেউ-কেউ বলবে, প্রত্যাশাটা কমিয়ে বাঁচলে জীবনে সুখী হওয়া যায়। যদি আমরা জীবনে মহৎ কিছু না চাই, যদি আমরা ভালোবাসা, সুস্বাস্থ্য, সাফল্য আশা না করি, তবে আমরা কখনোই আশাহত হবো না। যদি ভালকিছুর প্রতীক্ষায় না বাঁচি, তবে সেরকম কিছু হঠাৎ ঘটে গেলে সেটাই হবে আমাদের জন্য দারুণ একটা সারপ্রাইজ। না চাইতেই ভালকিছু পেয়ে গেলে আমরা ভীষণ খুশি হবো।

এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, স্টুডেন্টদের মধ্যে যাদের প্রত্যাশা বেশি, তাদের আত্মবিশ্বাসও বেশি, এবং তাদের সাফল্যের হারও বেশি। কীরকম? যখন তারা পরীক্ষায় এপ্লাস পায়, তখন তারা ভাবে, আমি জিনিয়াস, তাই আমি এপ্লাস পেয়েছি, এবং সামনেও আমি এপ্লাস পাবো। এমনকি যদি তারা পরীক্ষায় ফেলও করে, তাও তারা ভাবে, তারা তাদের নিজেদের দোষে ফেল করেনি, বরং পরীক্ষাটা স্বচ্ছ না হওয়ার কারণেই তারা রেজাল্ট খারাপ করেছে। সামনের বার রেজাল্ট নিশ্চয়ই ভাল হবে। এই আত্মবিশ্বাস থেকে তারা আরো ভাল করে পড়াশোনা করে, এবং ভাল রেজাল্ট করে। আবার স্টুডেন্টদের মধ্যে যাদের প্রত্যাশা কম, তারা যদি পরীক্ষায় খুব ভাল করে, তবে তারা ভাবে, পরীক্ষার প্রশ্ন সহজ হওয়ার কারণে কিংবা পরীক্ষার খাতা সহজ করে কাটায় তারা পরীক্ষায় বেশি মার্কস পেয়েছে। পরেরবার তারা নিশ্চয়ই যথারীতি ধরা খাবে। পরীক্ষায় ফেল করলে তারা ধরেই নেয়, যা হওয়ার কথা, তা-ই তো হয়েছে! আত্মবিশ্বাসের এরকম ঘাটতি তাদেরকে মানসিকভাবে আরো দুর্বল করে দেয় এবং তারা সামনের দিকে অতোটা এগিয়ে যেতে পারে না। এখানে মূল ব্যাপারটি হচ্ছে, ভিন্ন মানসিক গঠনের কারণে একদল স্টুডেন্ট নিম্ন আত্মবিশ্বাসী হয়ে কম পড়াশোনা করে পরীক্ষায় কম মার্কস পায়, অপরদিকে আরেকদল স্টুডেন্ট উচ্চ আত্মবিশ্বাসী হয়ে বেশি পড়াশোনা করে পরীক্ষায় বেশি মার্কস পায়। এ কারণেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, ভাল স্টুডেন্টরা সবসময়ই ভাল করে এবং খারাপ স্টুডেন্টরা সবসময়ই খারাপ করে। পরীক্ষায় যে সবসময়ই ফার্স্ট হয়, সে ফার্স্ট হলে কেউ কিছু মনে করে না, অথচ, যে কখনোই ফার্স্ট হয়নি, সে একবার কোনোভাবে ফার্স্ট হয়ে গেলে সে নিজেই অপরাধবোধে ভুগতে থাকে! একজন স্টুডেন্টকে ছোটবেলা থেকেই আত্মবিশ্বাসী, দায়িত্বশীল এবং পরিশ্রমী করে গড়ে তুলতে পারলে পরবর্তীতে তাকে আর কখনোই পিছিয়ে পড়তে হয় না।

ভবিষ্যৎ ফলাফল যা-ই ঘটুক না কেন, ভালকিছুর জন্য প্রতীক্ষা মানুষকে ভাল রাখে, আনন্দে রাখে। একটা মজার সমীক্ষার কথা বলছি। একবার আমেরিকান অর্থনীতিবিদ জর্জ লোয়েন্সটাইন তাঁর ক্লাসের স্টুডেন্টদের জিজ্ঞেস করলেন, “ধর, তুমি তোমার সবচাইতে প্রিয় সেলিব্রিটিকে চুমু খাওয়ার সুযোগ পেলে। তবে এর জন্য তোমাকে দাম দিতে হবে। কোন ক্ষেত্রে তুমি কতটা খরচ করতে রাজি আছ, আলাদা-আলাদা করে লিখ: চুমুটা এখুনিই খেতে পারলে? আগামী ৩ ঘণ্টার মধ্যে চুমু খেতে পারলে? আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে? আগামী ৩ দিনের মধ্যে? আগামী ১ বছরের মধ্যে? আগামী ১০ বছর পর? ভাল করে ভেবে তোমার উত্তরটা কাগজে লিখে জমা দাও।” দেখা গেল, স্টুডেন্টরা সবচাইতে বেশি খরচ করতে রাজি হয়েছিল ঠিক ওই মুহূর্তেই চুমু খাওয়ার জন্য নয়, বরং পরবর্তী ৩ দিন চুমু খাওয়ার জন্য প্রতীক্ষা করার জন্যই ওরা বেশি খরচ করতে আগ্রহ দেখিয়েছিল। প্রতীক্ষার জন্য বাড়তি খরচ করতে ওদের কোনো আপত্তি ছিল না। তবে হ্যাঁ, তাদের মধ্যে কেউই চুমু খাওয়ার জন্য ১ বছর অপেক্ষা করতে বেশি খরচ করতে চায়নি, কারণ ১ বছরে এমন অনেককিছুই ঘটে যেতে পারে, যেটার কারণে ওরা হয়তো চুমু খাওয়ার সুযোগটাই হারাবে। ১০ বছর অপেক্ষা করার জন্য তেমন কেউই কোনো পয়সা খরচ করতে রাজি হয়নি, এর কারণ হিসেবে ওরা জানিয়েছিল, আগামী ১০ বছরে ওই সেলিব্রিটি বুড়ো হয়ে যাবে, আর অতো বুড়ো একটা মানুষকে চুমু খেয়ে কী লাভ? তার চাইতে ৩ দিন ঠিক আছে। এর জন্যই বেশি খরচ করাই যায়! (তবে ৩ দিন ধরে ওরা কি সাজুগুজু করবে, নাকি, ক্রমাগত চুমু খাওয়ার প্র্যাকটিস করে নিজেদের চুমু খাওয়ার ব্যাপারে সুদক্ষ করে গড়ে তুলবে, সে তথ্যটি অবশ্য সমীক্ষায় উঠে আসেনি!) এখুনিই চুমু খেয়ে ফেললে তো মজাটা এখুনিই শেষ হয়ে গেলো! তার চাইতে ৩ দিন পর কী এক দারুণ মুহূর্ত আসতে যাচ্ছে তাদের জীবনে, সে মাহেন্দ্রক্ষণটির জন্য অধীর আগ্রহ আর টানটান উত্তেজনা নিয়ে যে প্রতীক্ষা, ওতে সুখ অনেক অনেকবেশি। চুম্বনের চাইতে চুম্বনের জন্য প্রতীক্ষা অধিক সুখের। তাই বেশিরভাগ স্টুডেন্টই ওই অপশনটির জন্য বেশি খরচ করতে রাজি হয়েছিল।

যাদের সাপ্তাহিক ছুটি ১দিন—শুক্রবার, তারা বৃহস্পতিবারকে যতোটা পছন্দ করে, শুক্রবারকে ততোটা করে না। এমনকি, পছন্দের দিক দিয়ে বুধবারকেও শুক্রবারের চাইতে এগিয়ে রাখে। অথচ, বৃহস্পতিবার বুধবার—দুটোই কাজের দিন, আর শুক্রবার হল বিশ্রাম নেয়ার দিন। তাও, তাদের পছন্দের তালিকায় প্রথমেই আছে বৃহস্পতিবার—সেদিন একটা ক্লান্ত কর্মসপ্তাহ শেষ হয়, এরপর বুধবার—সেদিনের পরেই তো আসে বৃহস্পতিবার, সবার শেষে শুক্রবার! লোকে বৃহস্পতিবারকে বেশি পছন্দ করার আরেকটা কারণ—বৃহস্পতিবার মানেই দারুণ একটা উইকএন্ডের জন্য প্রতীক্ষা। আর শুক্রবার মানেই তো আরেকটা ব্যস্ত সপ্তাহের জন্য ক্লান্তিকর বিরক্তিকর অসহায় অপেক্ষা! সুখের চাইতে সুখের জন্য প্রতীক্ষা যে বেশি সুখ দেয়!

আশাবাদীরা ভবিষ্যতে বেশি-বেশি চুমুর জন্য প্রতীক্ষা করতে পছন্দ করে, কোনো ধরনের টেনশন ছাড়াই পার্কে নিজের ইচ্ছেমত ঘুরে বেড়াতে পারবে—এমন কোনো দিনের জন্য প্রতীক্ষা করতে পছন্দ করে। এমন আশ্চর্য সুন্দর প্রতীক্ষা তাদের মানসিক ও শারীরিকভাবে সুস্থ রাখে। তারা বাস্তববাদীদের তুলনায় বেশি সুখী হয়। তারা যতদিন বাঁচে, সুন্দর মন ও সুস্থ শরীর নিয়ে বাঁচে। এর মানেটা কী দাঁড়াল? আশাবাদ কঠিন বাস্তবতাকে সহজ করে উপস্থাপন করে। আমরা যেরকম পৃথিবীর স্বপ্ন দেখি, কখনো-কখনো পৃথিবীটা সেরকম করে আমাদের চোখের সামনে ধরা দেয়। ধরুন, আপনার মেক্সিকান খাবার খেতে ইচ্ছে করছে। তখন আপনি রাস্তা দিয়ে হাঁটবার সময় এমন কিছু মেক্সিকান রেস্তোরাঁ আবিষ্কার করে ফেলবেন, যেগুলি আগে কখনো আপনার চোখেই পড়েনি। আশাবাদ পড়াশোনায় ভাল করতে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে, খেলাধুলায় জিততে উৎসাহ যোগায়, রাজনীতিতে সফল হতে সাহায্য করে, ব্যবসার উন্নতিতে ভূমিকা রাখে। অসীম আশাবাদের জোরেই সবচাইতে অখ্যাত টিমটাও বিশ্বসেরা টিমটার সাথে খেলায় জিতে যায়। ভবিষ্যতটা সুন্দর হবে, এটা যে যতো বিশ্বাস করে, তার দুশ্চিন্তা ততো কম, উদ্বিগ্নতা কম, ফলে সে ততো সুস্বাস্থ্য নিয়ে বাঁচে। ক্যান্সারে আক্রান্ত দুজন মানুষ, যাদের আয়ু আছে আর বড়োজোর ৩ মাস। একজনকে এই ভয়াবহ তথ্যটি জানালো হল, অন্যজনকে এই ব্যাপারে কিছুই বলা হল না। দেখা যাবে, দ্বিতীয় ব্যক্তিটি প্রথম ব্যক্তির তুলনায় বেশিদিন বেঁচেছেন। আশাবাদের এরকম অনেক উপকার আছে।

তবে হ্যাঁ, অতি আশাবাদ প্রকৃত বাস্তবতাকে কখনো-কখনো খর্ব করে দেয়। আমরা যদি বাস্তবতা বুঝে কাজ না করি, তবে স্রেফ আশাবাদের উপর ভর করে অনেকদূর যাওয়া সম্ভব নয়। যদি তা-ই হয়, তবে আসলেই কি আমরা আশা নিয়ে বাঁচতে পারি? সে বাঁচা সাধ ও সাধ্যের দুরূহতম সেতুটিকে কতটা ছোঁয়? আমাদের কোনো একটা প্রত্যাশা যখন পূরণ হয় না, আমরা তখন সাধ আর সাধ্যের সাথে মিল রেখে সেটা বদলে ফেলি। ছেলেকে মেডিক্যালে পড়ানোর শখ ছিল, কিন্তু ছেলে মেডিক্যালের ভর্তি পরীক্ষায় সফল হতে পারল না। তখন বাবা-মা কী করেন? ছেলেকে ডাক্তার বানানোর সাধ ও সাধ্য উভয়ই থাকলে ছেলেকে প্রাইভেটে পড়ান। এক্ষেত্রে ছেলেকে সরকারি মেডিক্যালে পড়ানোর প্রত্যাশা থেকে বাবা-মা’কে সরে আসতে হয়। আর শুধুই সাধ থাকলে, সাধ্যের অভাবে সে সাধ বিসর্জন দেয়া ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। এক্ষেত্রে আর্থিক অসঙ্গতির কারণে বাবা-মা’কে ছেলের কাছ থেকে ক্যারিয়ার-প্রত্যাশা বদলাতে হয়। একজন ব্যর্থ সন্তান নিজের পিতা-মাতা’কে ব্যর্থ করে দেয়। অতীতে এমনকিছু জনগোষ্ঠী ছিল, যারা বিশ্বাস করতো, খোলা আকাশের নিচে দলবদ্ধভাবে নাচার মাধ্যমে বৃষ্টি নামানো সম্ভব। যখনই ওরা দেখত আকাশ মেঘাচ্ছন্ন, তখনই সবাই একসাথে নাচতে আরম্ভ করত। যদি কখনো এমন হতো, ওরা সবাই মিলে নাচল, অথচ বৃষ্টি নামল না, তখন ওরা ধরেই নিত, নিশ্চয়ই তাদের নাচে কোথাও কোনো ভুল হয়েছে। ঠিকমতো নাচলে তো বৃষ্টি নামতই! অতি আশাবাদ মাঝে-মাঝে কুসংস্কারেরও জন্ম দেয়।

আমাদের মস্তিষ্কের একটা মজার রহস্য বলি। একবার কিছু মধ্যবয়স্ক মানুষকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো, “আপনার ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার আশংকা কতটুকু বলে আপনি মনে করেন?” একদল উত্তর দিলেন, “৫০ শতাংশ।” তাদেরকে বলা হল, “আপনার জন্য একটা সুসংবাদ আছে। একজন মধ্যবয়স্ক মানুষের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার আশংকা সাধারণত ৩০ শতাংশ।” এটা শুনে তাদের বেশিরভাগই বললেন, “তাহলে আমার ক্ষেত্রে আশংকাটি হয়তো ৩৫ শতাংশ বা কিছু বেশি হতে পারে।” অতি আশাবাদী কিছু মানুষ ছিলেন, যারা বলেছিলেন, তাদের ক্ষেত্রে ওই আশংকা ১০ শতাংশ। “আপনার জন্য দুঃসংবাদ! সাধারণত এটা ৩০ শতাংশ হয়ে থাকে।” “আরে নাহ্‌! আমার ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার আশংকা বড়োজোর ১১ শতাংশ হতে পারে। এর বেশি কিছুতেই না! আমি নিজে তো জানি, আমি কেমন আছি!”

কেন এমন হয়? কাউকে যখন বলি, ডিভোর্সের হার ৪০ শতাংশ, তখন সে ধরেই নেয়, ওই ৪০ শতাংশ যুগলের মধ্যে সে কোনোভাবেই নেই। সে অনন্য, তার জীবনটা অনন্য; অতএব, তার ভাগ্যটাও অনন্য। পৃথিবীর কেবল ভাল জিনিসগুলিই তার জন্য বরাদ্দ। কেউ যখন জানতে পারে, ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার আশংকা ৩০ শতাংশ, তখন যদি ওই ৩০ শতাংশ তার নিজের অনুমানের চাইতে বেশি হয়, তবে সে আরো বেশি আশাবাদী হয়ে ওঠে। আর যখন ওই ৩০ শতাংশ তার অনুমানের চাইতে কম হয়, তখন সে ততোটা আশাবাদী হতে পারে না। এর মানে কী দাঁড়াল? মানুষকে তার প্রত্যাশার চাইতে বেশি আশা দিলে সে চট্‌ করে ততোটা আশান্বিত হয়ে উঠতে পারে না। আবার মানুষকে তার প্রত্যাশার চাইতে কম আশা দিলে সে চট্‌ করে ততোটা নিরাশ হয়ে যেতে পারে না। ধূমপায়ী জানে, ধূমপান মৃত্যু ঘটায়। ধূমপায়ী বিশ্বাস করে, ধূমপান সে বাদে অন্য সবার মৃত্যু ঘটাবে। এটাই আশাবাদ! কিন্তু কেন মানুষ যেকোনো ভয়াবহ কিছু ঘটার আশংকাকে নিজের ক্ষেত্রে ফুঁ মেরে উড়িয়ে দেয়? কাউকে যখন বলবেন, “ফ্ল্যাটের দাম বাড়ছে” তখন সে ধরেই নেবে, তার ফ্ল্যাটটির দাম দ্বিগুণ হয়ে যাবে! অথচ, সে একই মানুষটিকে বলে দেখুন, “শেয়ারবাজারে ধ্বস নামতে পারে” সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাইবে না, তার কেনা শেয়ারগুলির দাম যেকোনো মুহূর্তে পড়ে যেতে পারে!

এসবকিছুর আসল রহস্যের মূল ব্যাপারটি ঘটে আমাদের ব্রেইনের ভেতরে। এর বাম অংশটি সক্রিয় হয়ে ওঠে, যখন আমরা কোনো নেতিবাচক মানসিকতা নিয়ে বসে থাকি, আর তখনই কোনো একটি ইতিবাচক খবর আমাদের ব্রেইন রিসিভ করে। সেসময় এর কাজ হল, ওই ইতিবাচক খবরটিকে ততোটা ইতিবাচকভাবে রিসিভ না করা। সে কারণে ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার আশংকা ৩০ শতাংশ শোনার পরও ব্রেইন যেহেতু আগেই নেতিবাচক একটা তথ্য (৫০ শতাংশ) ধারণ করে বসেছিল, সেহেতু অপেক্ষাকৃত কম আশংকাজনক নতুন তথ্যটিকে কিছুটা হলেও বর্ধিত আকারে (৩৫ শতাংশ) ব্রেইন রিসিভ করেছে। অপরদিকে ব্রেইনের ডানদিকের অংশটি সক্রিয় হয়ে ওঠে, যখন আমরা কোনো ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে বসে থাকি, আর তখনই কোনো একটি নেতিবাচক খবর আমাদের ব্রেইন রিসিভ করে। সেসময় এর কাজ হল, ওই নেতিবাচক খবরটিকে ততোটা নেতিবাচকভাবে রিসিভ না করা। সে কারণে ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার আশংকা ৩০ শতাংশ শোনার পরও ব্রেইন যেহেতু আগেই ইতিবাচক একটা তথ্য (১০ শতাংশ) ধারণ করে বসেছিল, সেহেতু অপেক্ষাকৃত বেশি আশংকাজনক নতুন তথ্যটিকে অতি সামান্য বর্ধিত আকারে (১১ শতাংশ) ব্রেইন রিসিভ করেছে। ব্রেইনের এই রহস্যময় খেলার উপরেই মানুষের কর্মস্পৃহা বা কর্মঅনীহা নির্ভর করে। মানুষের প্রচেষ্টা এবং অর্জন এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আশাবাদ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হয়। ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে যে মহিলাদের আটকে রাখা হয়েছিলো, একসময় তাদের প্রাকৃতিক রজঃক্রিয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। সেসময়ের বৈরি পরিবেশে সন্তান জন্মদান আর লালনপালন রীতিমতো অসাধ্য—-এই সংকেতটি ব্রেইনে প্রচণ্ডভাবে গেঁথে যায়, এবং সে অনুযায়ী ক্যাম্পের মহিলাদের শরীরবৃত্তীয় স্বাভাবিক চক্রটিও সাময়িকভাবে বদলে যায়। আমাদের ব্রেইন কীভাবে কোনো একটি ঘটনা বা প্রবৃত্তিকে গ্রহণ করছে, তার উপর আমাদের সকল অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক কর্মকাণ্ড নির্ভর করে।

এখন কথা হচ্ছে, ব্রেইনের এই খেলাকে কি আমরা কোনো উপায়ে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি? এমনকিছু কি করা যায় না, যাতে ব্রেইন সবসময়ই ইতিবাচকভাবে সাড়া দেয়? এই সমস্যাটির সুরাহা করতে একজন নিওরোসায়েন্টিস্ট একজন নেতিবাচক চিন্তাভাবনার মানুষের ব্রেইনের বামদিকের অংশটিতে বিশেষ ধরনের চৌম্বকীয় সংকেত পাঠানোর মাধ্যমে সেটার স্বাভাবিক কাজকর্ম প্রায় আধা ঘণ্টার জন্য বন্ধ করে দিয়েছিলেন, এবং সেই মানুষটি ওই সময়টাতে ইতিবাচক সিদ্ধান্তগ্রহণ করতে শুরুও করেছিল। কিন্তু সে প্রভাব কতক্ষণ ছিল? বেশিক্ষণ নয়। কৃত্রিম সংকেত পাঠানো বন্ধ করার কিছুক্ষণের মধ্যেই নেতিবাচক চিন্তাভাবনার মানুষটি স্বমূর্তিতে স্বমহিমায় আবির্ভূত হয়েছিলেন! কেন এমন হয়? ইতিবাচক চিন্তাভাবনার মানুষ যেকোনো তথ্য থেকে (হোক ইতিবাচক, হোক নেতিবাচক) ইতিবাচক দিকগুলিই গ্রহণ করে এবং সেগুলিকে কাজে লাগায়। একইভাবে, নেতিবাচক চিন্তাভাবনার মানুষ যেকোনো তথ্য থেকে (হোক ইতিবাচক, হোক নেতিবাচক) নেতিবাচক দিকগুলিই গ্রহণ করে এবং সেগুলিকে কাজে লাগায়।

ভাবুনতো, হীরক খণ্ডটি সবচাইতে অনমনীয় আর দৃঢ় কেন? কারণ, সেটি জন্মের সময়ই অসম্ভব চাপ সহ্য করেছে। জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে দারুণ রকমের সফল যারা, তারাও জীবনে অনেকবেশি ঘাতপ্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে আজকের অবস্থানে এসেছেন। তাই হীরক খণ্ডের মতোই তারা কখনো শত আঘাতেও ভেঙে পড়েন না। নেতিবাচক নিষ্ঠুর পৃথিবীতে মাথা উঁচু করে সম্মানের সাথে চলার সকল প্রস্তুতিই তাদের থাকে। শুধু কি ইতিবাচক মনোভাবই আমাদের কোনো কাজ সুন্দরভাবে ঠিকমতো করতে সাহায্য করে? নেতিবাচক সবকিছুকেই কি আমরা এড়িয়ে চলতে পারি সবসময়ই? অগ্নিনির্বাপক কর্মী এবং বিভিন্ন দুর্ঘটনার উদ্ধারকর্মীদের প্রশিক্ষণের সময় শেখানো হয়, যাতে ওরা কোনো অভিযানে নামার আগেই দুর্ঘটনাটি চরম খারাপ অবস্থায় বা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে, এটা মাথায় রেখেই বিপদমুক্ত হওয়ার সবচাইতে নিরাপদ পরিকল্পনাটি করে ফেলে। সেনাবাহিনী এবং অন্যান্য প্রতিরক্ষা বাহিনীতেও একই ধরনের মাইন্ড সেটআপ শেখানো হয়। বিভিন্ন প্রকল্পের নকশা করার সময় প্রকল্পের খরচ এবং সময়কাল নির্ধারণ করার সময় নেতিবাচক সকল দিককেই মাথায় রাখা হয়। লোকে বিয়ে করার সময় ডিভোর্সের আশংকাটা একটু হলেও মাথায় রাখলে বিয়ের খরচটা অনেক কমে যেত!

আশা এবং প্রত্যাশার মধ্যে কোনটা আমাদের জন্য ভাল? তার আগে দেখা যাক, আশা কী, প্রত্যাশা কী। আশা হচ্ছে, আমরা চাইছি কোনো একটা ব্যাপার ঘটুক। যদি সেটা ঘটে, আমরা খুব খুশি হবো। সেটা ঘটার কথা ছিল না, তাই সেটা ঘটা বা তার ফলে কিছু একটা পাওয়াটা একটা উপহারের মতোই। যদি সেটা নাও ঘটে, তাতেও কিছু এসে যায় না, কারণ আমরা তো জানতামই, সেটা ঘটার কথা নয়, আমরা শুধু আশা করেছিলাম যে সেটা ঘটুক। আশা এমনকিছু, যার অপ্রাপ্তিতে দুঃখ হয় না, কিন্তু যার প্রাপ্তিতে সুখের পরিমাণ শতভাগ। অন্যদিকে, প্রত্যাশা হচ্ছে, আমরা ধরেই নিয়েছি, অমুক ব্যাপারটা ঘটবে, বা আমাদের অমুক জিনিসটা পাওয়ার কথা। যদি সেটা ঘটে, তবে তা আমাদের মনে আলাদা কোনো আনন্দের সৃষ্টি করে না, কারণ, আমরা ভাবি, যা হওয়ার, তা-ই তো হয়েছে, এতে এতো উল্লসিত হওয়ার কী আছে? আর যদি সেটা না ঘটে, তবে তা আমাদের মনে অসীম দুঃখ এনে দেয়, কারণ আমরা ভাবি, যা হওয়ার কথা ছিল, তা হলো না। প্রত্যাশা এমনকিছু, যার অপ্রাপ্তিতে দুঃখের পরিমাণ শতভাগ, অথচ যার প্রাপ্তিতে বাড়তি কোনো সুখ অনুভূত হয় না।

সুখী হওয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে, উচ্চাশা আর নিম্ন প্রত্যাশা নিয়ে বাঁচা। উচ্চাশা ভাল, কিন্তু অন্ধ আশাবাদ মানুষের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। উচ্চাশা কী? উদাহরণ দিয়ে বলি। আমি জানি, আমি চাঁদকে ছুঁতে পারবো না, তবে আমি চাঁদকে ছোঁয়ার শপথ নিয়ে ঠিকভাবে প্রচণ্ড চেষ্টা করে গেলে চাঁদ ছুঁতে পারি না পারি, আকাশের তারা অন্তত ছুঁতে পারবো। আর যদি চাঁদকে কোনোভাবে ছুঁয়ে ফেলতে পারি, তাহলে তো পুরো প্রাপ্তিটাই বোনাস! ক্যারিয়ার গোল ঠিক করার সময় এই থিওরিটা খাটে। সাহস করে বড় কিছু চাইতে না পারলে নিজের মধ্যে বড় কিছু পাওয়ার ইচ্ছেটা জাগে না, ফলে সেটার পাওয়ার জন্য পরিকল্পনা আর পরিশ্রম কখনোই আর করা হয় না। মানুষ নিজের শক্তির জায়গাগুলিকে চিনতে পারে বড় কিছুর জন্য নিজেকে প্রস্তুত করার সময়। অন্ধ আশাবাদ কী? আপনি আপনার স্বপ্ন পূরণের জন্য অনেক চেষ্টা করছেন। কিন্তু প্রতিবারই আপনার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হচ্ছে। এর মানে কী? আপনার প্রচেষ্টার ধরনটা বদলাতে হবে, কিংবা প্রচেষ্টার পরিমাণ আরো বাড়াতে হবে। যদি তা না করে আপনি এটা ধরে বসে থাকেন যে, যা-ই কিছু ঘটুক না কেন, আপনি আপনার স্বপ্ন পূরণ করতে পারবেনই, কারণ আপনার নিজেকে নিয়ে আপনি আশাবাদী, তবে আপনি বোকার স্বর্গে বাস করছেন। প্রকৃতপক্ষে, ভুল কৌশলে চেষ্টার মাধ্যমে কোনোকিছুই অর্জন করা সম্ভব নয়, কিছু সময় আর শ্রম অনর্থকই বৃথা যায়। এরকম অন্ধ আশাবাদ স্রেফ ক্ষণিকের আত্মতুষ্টি ছাড়া আর কিছুই দিতে পারে না।

এতো কথার মানে দাঁড়াচ্ছে এই, আমরা বেশি আশাবাদী, কিংবা বেশি নিরাশাবাদী, এর কোনটাই হতে পারবো না। তবে উপায়? একটা গল্পের মাধ্যমে উপায়টা বলছি। একদিন একদল পেঙ্গুইন ঠিক করলো, তারা উড়বে। কিন্তু পেঙ্গুইন তো উড়তে পারে না। ওই পেঙ্গুইনরাও এটা জানতো যে তাদের পক্ষে ওড়া সম্ভব নয়। যে বিশ্বাসই করতে পারে না যে সে উড়তে পারবে, সে কখনোই উড়তে পারে না। তাই ওরা নিজেরা অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে ফেলল যে ওরা উড়বেই! ওরা ভাবল, চেষ্টা করলে তো পৃথিবীতে কোনোকিছুই অসম্ভব নয়। ওরা ঠিক করলো, ওদের এখন এমন কিছু একটা করতে হবে, যা ওরা আগে কখনোই করেনি, এমনকি সেটা করার কথাটা পর্যন্ত ওদের মাথায় কখনোই আসেনি। কারণ, ওরা এমন একটা ক্ষমতা পেতে চাইছে, যা আগে কখনোই ওদের ছিল না। অভিনব কিছু পেতে চাইলে তো অভিনব কিছু করতেই হবে! ওরা সবাই মিলে দলবেঁধে একটা উঁচু টিলার ওপরে উঠল। ঠিক হল, সবাই একসাথে ওখান থেকে লাফিয়ে পড়বে এবং মাটিতে পড়ার আগেই ওরা উড়তে শুরু করবে। ওড়ার ব্যাপারে ওদের আশা, আত্মবিশ্বাস আর সংকল্পের কোনো কমতিই ছিল না। ওদের চেষ্টা দেখে অন্য পেঙ্গুইনরা হাসাহাসি করতে লাগল। ওদের মধ্যে একটা পেঙ্গুইন ছিল যে কিনা টিলায় ওঠার আগেই নিজের পিঠে একটা প্যারাসুট বেঁধে নিয়েছিল। প্যারাসুটটা সাথে নেয়ার সময় ওর মাথায় ছিল, টিলা থেকে লাফিয়ে নিজের চেষ্টায় উড়তে পারলে তো খুবই ভাল, কিন্তু যদি কোনো কারণে সেটা না হয়, সেক্ষেত্রে যেন প্যারাসুট দিয়ে উড়ে হলেও সে তার স্বপ্নটা পূরণ করতে পারে। পিঠে প্যারাসুট বাঁধায় বেচারাকে দেখাচ্ছিল কিম্ভূতকিমাকার। ওর সহযাত্রী পেঙ্গুইনরা আর অন্য পেঙ্গুইনরা সবাইই ওকে দেখে ভীষণ বিদ্রূপ করল। টিলার চূড়ায় উঠে পেঙ্গুইনরা সবাই একসাথে লাফিয়ে পড়ল। এরপর যা হবার তা-ই হল। সেই একটা পেঙ্গুইন বাদে অন্য সবাই মাটিতে উল্টে পড়ে ব্যথা পেলো, অন্য পেঙ্গুইনরা আবারো আগের মতো তাদের নিয়ে খুব হাসাহাসি করলো। আর ওই কিম্ভূতকিমাকার পেঙ্গুইনটা প্যারাসুটে ভর করে উড়ে চলল। তার সহযাত্রী পেঙ্গুইনরা এবং অন্য পেঙ্গুইনরা তাকে দেখে হাততালি দিয়ে অভিনন্দন জানালো, স্যালুট দিল। ভিন্ন কিছু করার জন্য তার ভিন্ন প্রস্তুতি ছিল। এক্সট্রা কিছু করে দেখাতে হলে তো এক্সট্রা প্রিপারেশন রাখতেই হবে। সঠিক পরিকল্পনা আর প্রস্তুতিবিহীন অহেতুক আশাবাদ কিংবা বিশ্বাস কোনো কাজেই লাগে না। কে কী বলল, সেটাকে পাত্তা না দিয়ে নিজের স্বপ্ন পূরণের জন্য শুধু কাজ করে যাওয়াটাই যথেষ্ট নয়, এর সাথে, কাজটা ঠিক কৌশলে করা হচ্ছে কিনা, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হয়। ভুল পদ্ধতিতে পরিশ্রম করার চাইতে পরিশ্রম না করে ঘুমানোও অনেক ভাল। “আমি আশা করছি, আমি যেভাবে চাইছি, সেভাবেই সবকিছু হবে।”—খুবই ভাল কথা। তবে, যদি কোনো কারণে সেভাবে না হয়, তখন সে পরিস্থিতিটা সামলানোর মতো পূর্বপ্রস্তুতিও আমার রাখতে হবে।