পৌলোমীর চিঠি

প্রিয় কৌস্তুভ,


কেমন আছো? বহুদিন পর তোমায় লিখছি। অথচ লিখতে বসেই কেমন একটা নিরর্থক প্রশ্ন করে বসলাম, তাই না! তুমি একবার বলেছিলে, কেমন যে আছো, তা যেন কখনও জানতে না চাই। তুমি কেমন থাকতে, তা খুব করে বুঝতে না চেয়েও কেমন করে যেন ঠিকই বুঝে যেতাম। আহা, সেইসব দিনগুলি! যতটা চেয়েছিলাম, তার চেয়েও বড্ড বেশিই দিয়ে দিয়েছিলে তুমি…তোমারও অজান্তে। তাই বুঝি ইচ্ছেরা আমার মাঝেমধ্যেই অমন বেয়াড়া হতে চাইত! কী যে পাগল ছিলাম আমরা…মনে পড়ে?


সেসময় দুমদাম ‘ভালোবাসি’ বলে ফেলতে পারতাম আমরা। আমাদের দুজনের কারুরই লজ্জা বা সংকোচ খুব একটা ছিল না বলেই একে অপরকে অতটা দুর্বার হয়ে প্রকাশ করতে পেরেছিলাম দুজনই। আমায় ভালোবাসতে না চেয়েও যে ভালোবেসে ফেলছিলে ধীরে ধীরে, ওটা ভীষণ টের পেতাম। আমার কাছে এসেও আমায় ভালো না বেসে থেকে যাওয়া…সহজ নয়! আজ বলেই ফেলি, সেই প্রথম দিনটাতে তোমার চোখে একধরনের অবিশ্বাস দেখেছিলাম, আমায় যে বিশ্বাস করতে পারছিলে না, সেটা ঠিক বুঝেছিলাম। সেদিনের পর থেকেই, কী এক নিবিড় বিশ্বাসে ডুবে গেলে তুমি আমার মধ্যে! কখনও সে বিশ্বাস ভাঙার দুঃসাহসও আমি করিনি। তবু যখন তোমার চিঠিতে একরাশ অভিমান পেলাম, তখন আর কিছুই বলার ছিল না আমার।


জানো, প্রথমবার কীসের টানে, কীসের জেদে তোমার কাছে গিয়েছিলাম, তা আজও জানি না। এরপর যে-বার গেলাম, আমায় দেখে হাসিমুখে কয়েকটা কথা বলে তুমি যখন তোমার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লে পাশের ঘরে, তখন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে খুব কাঁদছিলাম আমি। শুধু ভাবছিলাম, কেন কেবলই ভালোবেসে তোমার কাছে চলে গেলাম! কেন পাবো না জেনেও এপথে পা বাড়ালাম! হিসেবে আমি বরাবরই কাঁচা! তবে ক্রমেই সময়ের আবর্তনে তোমার কাছেই শিখেছি, বিনিময়ে কিছুই না পাওয়ার প্রেমও অনেক অনেক কিছু দেয়! তোমার একলা সময়টাকে রাঙাতে আমার এই একলা ‘আমি’টার কত আপ্রাণ চেষ্টা ছিল, সে কি কখনওই চোখে পড়েনি তোমার! জানি, পড়েছে। তুমি অনেক কিছুই বুঝতে দাও না। তবু বুঝে যে ফেলি, আর তোমাকে এটা বুঝতে যে দিই না, সম্ভবত এই দুটো ব্যাপার তুমি বোঝো না।


কাল চিঠির খাম খুলে যখন দেখলাম, আমায় তুমি ‘পলাতকা’ বলেছ, চোখ গড়িয়ে নামা হাসিটুকুর ঠোঁটের কোণে এসে থেমে-যাওয়াটা ঠিকই টের পেয়েছিলাম। এই যে আমি আজ এত দূরে, এখানে বসেও তোমার অভিমান- অনুযোগ- ভালোবাসামাখা চিঠিটা দেখে নিজের কাছেই নিজেকে অপরাধী ঠেকছিল। ইচ্ছে করছিল, ইস্‌, পাশে বসে যদি বলতে পারতাম…এই তো আমি! তুমি বলেছ, আমাকে নাকি পকেটে পুরে সবখানে নিয়ে নিয়ে বেড়াও! আসলে ঠিকই বলেছ! তাই বুঝি এই এতটা দূরে থেকেও তোমার ঘ্রাণটা দিব্যি টের পাই আমি। তোমার স্পর্শ, তোমার নিঃশ্বাস…সবই লেগে আছে এই শরীরে!


মাঝে মাঝে আমার ইচ্ছে করে, যে বাড়িটায় তুমি আমি থাকতাম, ওটার মতন একটা ছোট্ট বাড়ি বানাই। পরমুহূর্তেই ভাবি, আচ্ছা, বাড়িটা বানিয়েই-বা কী হবে? বাড়ি বানালেই কি আর তোমায় ওখানটায় পাবো, বলো! তোমার অমন ঝকঝকে স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি…পাবো? তুমিহীন বাড়িকে তো তখন শ্মশান মনে হবে! তার চেয়ে বরং এই যে হৃদয়ের কোটরে লেপটে আছো, এটাই-বা কম কীসে!


তোমায় বড্ড জ্বালাই মাঝেমধ্যে। আমি বুঝতে পারি। আচ্ছা, আর কাকে জ্বালাব তবে, বলো? দূরে গেলেই কি আর অধিকার হারায়! অমন করে তোমায় ভালোবাসবে কেউ আর? একেবারেই তোমার মনের মতো করে, সবকিছু মেনে নিয়ে…বাসতে পারবে, বলো? তুমিও তো বুঝতে ঠিকই, এই টিংটিঙে খুব সাদামাটা চেহারার মেয়ের ভেতরটায় তোমার জন্য কতটা শুভ্র একটা আসন পাতা ছিল! তোমার কাছে কণামাত্রও অনুযোগটুকু করিনি কোনও কালেই। চেয়েছি শুধুই, আমার ভালোবাসা বেঁচে থাকুক নিঃস্বার্থ ভালোবাসাতেই!


কেমন আছি? এর উত্তর: নিজেকে ভালো রেখো, তবেই আমি ভালো থাকব। ‘তোমার তুমি’টা তো আর তুমি একা নও!


তোমারই পৌলোমী