প্রথম প্রেমস্মৃতি

অরুণদা, সেবার তোমাদের বাড়ির পুজো দেখতে গিয়েছিলাম, সন্ধে নামার কিছুক্ষণ আগে পুজোমণ্ডপে হঠাৎ সে কী আগুন! মনে আছে, ছোটাছুটি-করা মানুষের ভিড়ে দাউদাউ করে জ্বলা আগুনের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছি। তুমি কোত্থেকে যেন দৌড়ে এসে অস্থিরহাতে আমার হাতটাকে সজোরে চেপে ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেলে একটু দূরে নিরাপদ জায়গায়।
  
 অরুণদা, জানো, সে রাতে আমি একফোঁটাও ঘুমাতে পারিনি। ষোড়শীর পূর্ণচাঁদে সদ্য পা-রাখা আমার সারা ঘর-মন সবটা জুড়ে বার বার ভেসে উঠছিল কোনও পুরুষের প্রথম ছোঁয়ার আগুন। সারাশরীর জুড়ে সে কী এক অদ্ভুত শিহরন! অরুণদা, তোমার বয়েস তখন ঠিক সাতাশ।
  
সেদিন জানালার গ্রিল ধরে আমি তোমার কথাই ভাবছিলাম। তোমাকে নিয়ে কত কী যে একা একা কল্পনা করছি আর লজ্জায় হাসছি, নিজের কাছেই মুখ লুকোচ্ছি যেন! ইসসসস্...!
  
তুমি কোত্থেকে যেন ঘরে ঢুকেই মাথায় টুক করে আলতো চড় দিয়ে বলেছিলে, কী রে ছোটি, তোর ভাই কই রে?
  
আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই তুমি গড়গড় করে উঠে চলে গেলে দাদার ঘরে।

 তুমি যেখানে চড় দিয়েছিলে, সেখানটায় হাত দিয়ে ধরে রেখে তাকিয়ে আছি তোমার বেখেয়ালি চলে যাবার দিকে।
  
 জানো অরুণদা, সেদিন তোমার দ্বিতীয় স্পর্শের সুখে সে রাতেও ঘুমোতে পারিনি। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তোমার ছুঁয়ে-দেওয়া অঙ্গে বার বার ছুঁয়ে ছুঁয়ে চোখ বন্ধ করে অনুভব করছিলাম তোমাকে, আর নিজেকে বলছিলাম, এইখানটায়, হ্যাঁ, এইখানটায় অরুণদা ছুঁয়েছে আমায়! আহা, সে কী অপূর্ব অনুভূতির অনুরণন গো!
  
 অরুণদা, তুমি আমার জীবনের প্রথম একতরফা প্রেম ছিলে। তুমি কখনও জানতেও পারোনি যে লুকিয়ে লুকিয়ে তোমার নামে সিঁদুর পরতাম মায়ের কৌটো থেকে চুরি করে।
  
 মাঝে মাঝে মায়ের আলমারি থেকে লালশাড়িটা গায়ে জড়িয়ে দেখতাম তোমার বউ হলে আমায় দেখতে কেমন লাগবে। তুমি ফিরনি ভালোবাসতে বলে পাক্কা রাঁধুনির মতো শিখে নিয়েছিলাম ফিরনি-রান্নাও। তোমার নীলরং প্রিয় বলে পৃথিবীর সব নীলকেই আমার কাছে বড়ো আদরের রংধনু মনে হতো। দাদার বেড়াল মিনিকে তুমি পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করে দিতে। তুমি তো জানো না, তুমি চলে যাবার পর মিনিকে আমার রুমে নিয়ে এসে ওর পিঠে কতশত বার যে চুমু খেতাম!
  
সেবার যে কলমটা ফেলে গিয়েছিলে, আমি লুকিয়ে ওটা বুকে জড়িয়ে কত যে আদর মাখতাম কলমের সারাগায়ে!

 আহা, তোমাকে নিয়ে কতশত আয়োজনে যে ব্যস্ত থাকত আমার ব্যক্তিগত শহরটা! সে শহরে কখনও রাত নামত না। পৃথিবীতে পুরুষ বলতে এক তোমাকেই বুঝেছিলাম। সবার অগোচরে শরীরমন সবটা জুড়ে তোমাকেই খুব করে চাইতাম।

 তোমার মনে আছে, অরুণদা, এক ঝুমবৃষ্টির সন্ধ্যায় তুমি পুরোদমে ভিজেটিজে একাকার হয়ে আমাদের ঘরে এসেছিলে। দাদা আর মা কই জিজ্ঞেস করেই গা থেকে জল ঝাড়তে ঝাড়তে ঘরে ঢুকে দরজায় খিল লাগিয়ে দিলে। আমি বলেছিলাম, ঘরে তো কেউ নেই। তুমি একটুও ইতস্তত হওনি, বরং নিজের ঘরের মতো খুব অধিকার খাটিয়ে বলেছিলে, যা তো যা, এককাপ রংচা নিয়ে আয়, আর তোয়ালেটা দিয়ে যা।
  
 তুমি তোয়ালে দিয়ে সারা গা মুছতে মুছতে দাদার টেবিলের ল্যাপটপ থেকে গান ছেড়ে দিলে... যখন থামবে কোলাহল, ঘুমে নিঝুম চারিদিক...। তোমার আমার প্রতি কোন‌ও ভ্রূক্ষেপই ছিল না। আমি দেখছি, নিজের ঘরের মতোই এ কাজ ও কাজ করে যাচ্ছ। গুনগুন করে গানের সুরে গলা মিলিয়ে আমার হাত থেকে চায়ের কাপটা নিলে। জানো অরুণদা, তৃতীয় বার তোমার হাতের আঙুল আমার আঙুলে লেগেছিল সেদিন।
  
আমি একদৌড়ে নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে হাঁপাতে হাঁপাতে ওই আঙুলটাকে বুকের ভেতর চেপে ধরে রেখে দিয়েছিলাম প্রায় ঘন্টাখানেক।
  
 সে রাতে তুমি আমাদের ঘরেই ছিলে। দাদার রুমে তুমি আর তার এক রুম পরেই আমার রুম। আমি মনে মনে খুব করে চাইছিলাম যেন তুমি টকটক করে দরজায় কড়া নেড়ে বলো, বৈশাখী, তোকে খুব ভালোবাসি! কিংবা ওটাকে সুযোগ ভেবেই জোর করে আমার রুমে ঢুকে ঠোঁটে ঠোঁট বসিয়ে দিয়ে খুব করে চুমু খেয়ে দাও!
  
না, হয়নি তেমন কিছুই। সারারাত অপেক্ষায় ছিলাম, তুমি আসোনি। মধ্যরাত সাড়ে তিনটায় ধীরে ধীরে তোমার রুমে উঁকি মেরে দেখছিলাম, কী করছো তুমি। দেখি, তুমি আরাম করে নাক ডেকে ঘুমোচ্ছো। আমি কাঁথাটা গায়ে জড়িয়ে দিয়ে লাইটটা বন্ধ করে নিজের রুমে এসে শুয়ে ছিলাম।
  
'পাশের রুমে, মাত্র কয়েক গজ পরেই তুমি আছ!' এই ভাবনাটা আমাকে সে রাতে ঘুমুতে দেয়নি একফোঁটাও! তুমি ঘুম থেকে ওঠার আগেই চা বানিয়ে ফ্লাস্কে ভরে তোমার রুমে দিয়ে এসেছিলাম। তুমি চা খেয়ে চলে যেতে যেতে বলেছিলে, কী রে ছোটি, তুই তো খুব ভালো চা বানাস! শুনে আমি লজ্জায় মাথা নিচু করে রেখেছিলাম। মনে মনে খুব করে চাইছিলাম, তোমাকে সজোরে টেনে ধরে বলি, অরুণদা, আজকেও থেকে যাও না! চলে যেয়ো না, প্লিজ!
  
 তুমি একপেশে হয়ে চলেই যাচ্ছ, আর আমার বুকের ভেতর কী যেন ভেঙেচুরে তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। তুমি যত দ্রুত গতিতে দূরে চলে যাচ্ছ, তার দ্বিগুণ গতিতে ভেতর থেকে কে যেন অগনিতবার চিৎকার করে বলেই চলেছে, অরুণদা, যেয়ো না, প্লিজ! থেকে যাও, অরুণদা।
  
চৈত্রের কোনও এক বৃহস্পতিবারের শুভক্ষণে তুমি সিঁদুর পরালে চৈতালির সিঁথিতে।
  
 যখন তোমার ঘরে চলছে ঘরভর্তি মানুষের হ‌ইচ‌ই আর বিয়ের উৎসব, তখন আমার নিজেকে লাগছিল কৃষ্ণগহ্বরের অসীমে তলিয়ে যাওয়া কোনও এক তুচ্ছ কণার মতো। দরজা বন্ধ করে হাউমাউ করে পাগলের মতো কেঁদেছিলাম সে রাতে, তুমি জানতেও পারোনি গো, অরুণদা!
  
বিয়ের পর বউ নিয়ে সংসার পেতেছিলে শহরের কোনও এক গলিতে। তারপর আমাদের আর দেখাসাক্ষাৎ হয়নি। কেউ কারও খোঁজখবর রাখিনি। তবুও আমি অপেক্ষায় আছি। সে অপেক্ষাটা যে ঠিক কীসের জন্য, তা আমি নিজেও জানি না।
  
অরুণদা, তোমার সবকিছুই আমি অদ্ভুত রকমের ভালোবাসতাম। তোমার হেলেদুলে চলা, ফিক করে হেসে ওঠা। তোমার চোখ, নাক-কান-গলা, তোমার কেমন করে জানি কথা বলা, সবই ভালোবাসতাম, অরুণদা! সত্যি বলছি, সবকিছুই ভালোবাসতাম আমি। তোমায় না পেয়েও পেয়েছি যতটা, তোমায় পেয়েও তার কানাকড়িও কি পেয়েছে সে, জানতে বড্ড ইচ্ছে করে!