প্রপোজ ডে

 
আজ ঐতিহাসিক ৮ ফেব্রুয়ারি৷ মহান প্রপোজ ডে৷ এই দিনটি আমার জীবনে একটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ দিন৷ আজ থেকে ঠিক এগারো বছর আগে আজকের এই দিনে আমার শ্রদ্ধেয় প্রজেক্ট সুপারভাইজার জায়ান আরিজ স্যারকে আমি এক বুক আশা নিয়ে প্রপোজ করেছিলাম; আই মিন, থিসিসের প্রপোজাল পেপার সাবমিট্ করেছিলাম৷ জানতাম, স্যারের কঠিন পুরুষহৃদয়ে অতো দয়ামায়ার জায়গা হওয়ার কথা নয়। জায়গা হয়ওনি। আমার দেখা সবচাইতে পাষাণহৃদয়ের ৩জন পুরুষমানুষের মধ্যে স্যার একজন। যা-ই হোক, স্যার আমাকে নিরাশ করেননি, যথারীতি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। জীবনে প্রথমবারের মতো কাউকে প্রপোজ করে ‘না’ শুনলাম। তাও পুরুষমানুষকে! সেই থেকে শুরু৷ এখনও রিফিউজড্ হয়েই চলেছি হয়েই চলেছি৷ রিফিউজড্ হতে-হতে এখন আমি ক্লান্ত। আর পারছি না, গুরু ……….. এইবার অন্তত কেউ ‘হ্যাঁ’ বলুক, সত্যি-সত্যি না হোক, মিথ্যে-মিথ্যে হলেও বলুক, ‘সত্যিই ভালোবাসি.........’
জানি, সবই পাপের ফল। ‘না’ বলাও যে পাপ, সেকথা কেউ কোনওদিনও আমাকে বলে দেয়নি। কেউ-কেউ শুধু অভিসম্পাত দিয়েছিল, আমি ভুল করে ভেবেছিলাম, ওসব মেয়েমানুষি অভিমান। সেইসব সময় ছিল ‘না’ বলার সময়, অহংকারি ইগো দেখানোর সময়। এখন সময় বড় দুঃসময়, না শোনার সময়! যে ‘না’ বলে, সে ‘না’ শোনে। কম্পিউটার প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজের নিয়মে বলতে গেলে, দশজন স্মার্ট অসুন্দরীকে বাঁকামুখে ‘না’ বলা সমানসমান (==) একজন খ্যাত্ সুন্দরীর কাছ থেকে থ্যাবড়ামুখে ‘হ্যাঁ’ শোনা। বেশিদিন আগের কথা নয়, এই ৫ বছর আগেও মেয়েদের সাথে কথাও বলতে পারতাম না। আমারই স্টুডেন্ট, অথচ রাস্তায় দেখা হলে কথা বলতে গিয়ে লজ্জায় মরে যেতাম! মেয়েদেরকে মনে হতো মেয়ে, মানুষ ভেবেও যে সহজভাবে কথা বলা যায়, এটা মাথায় আসত না। কত জনের কাছ থেকে কাউন্সেলিং নিয়েছি, কীভাবে মেয়েদের সাথে সাবলীলভাবে মেশা যায়! হাউ টু টক টু গার্লস্‌ লিখে নেটে সার্চ করেছি দিনের পর দিন। রাস্তার একদিকে হাঁটছি, দূর থেকে চোখে পড়ল সুন্দরীদের কোনও এক দল আসছে, আর আমি অমনিই পালালাম রাস্তার ওপারে! মেয়েরা অসহায় বলদ লাজুক টাইপের ছেলেদের উপর যে কতটা চড়াও হতে পারে, সেটা ভুক্তভোগীমাত্রই জানেন। আমার ক্ষেত্রে এরকম বহুদিনই হয়েছে! অ্যাডাম-চেজিং (ইভ-টিজিংয়ের বিপরীতটি) কী জিনিস, সেটা আমাকে কোনও বই পড়ে শিখতে হয়নি। সেসময় আমাকে কেউ কোনওদিন কোনও মেয়ের সাথে হাঁটতে দেখেনি। স্বাভাবিকভাবেই সেই গাধা আমাকে কেউ প্রপোজ করলে ‘প্রেম করলে মা বকবে’ কিংবা, ‘মাফ করে দাও, বোন’ কিংবা, ‘ছিঃ! ভালো ছেলেরা কি প্রেম করে?’ বলা ছাড়া আর কী-ই বা করতে পেরেছিলাম! হ্যাঁ, সেসময় মেয়েদেরকে হয় ভয় পেতাম, অথবা (লজ্জায়) পাত্তাই দিতাম না। এমনও হতে পারে, বরং মেয়েদের কাছ থেকেই পাত্তা পেতাম না, কিংবা যে দুএকটি মেয়ে আমাকে পাত্তা দিত, তাদেরকে ‘পাত্তা দেয়ার মতো’ ভাবতাম না। যে ছেলে সুন্দরীর মাথায় পদার্থের খোঁজ করে মরে, সে ছেলের মাথায় কোনও পদার্থ আদৌ কি আছে? হ্যাঁ, আমি বিশ্রী রকমের পদার্থশূন্য চিড়িয়া ছিলাম। জীবনকে যে জীবনের গতিতে চলতে দেয় না, সে একটা সময়ে নিজেই গতিছন্দহীন জীবনে টুক করে ঢুকে পড়ে! আমার ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে।
সুন্দরীকে প্রপোজ করলে হয় ওর সৌন্দর্য আরও বেড়ে যায়, অথবা হঠাৎই আমি নিজেই অসুন্দর হয়ে যাই। তা যদি না-ই হবে, তবে সুন্দরীরা ওরকম হুট করে ‘না’ বলে দেয়ার আশ্চর্য প্রতিভা পেয়ে যায় কোত্থেকে? ওদেরকে প্রপোজ করাটা একদমই ঠিক নয়। ওরা মিষ্টি হেসে বলবে, “ভাইয়াআআআ....! আইসক্রিম খাবো!” সব সুন্দরীই একটা করে খ্যাত্‌ বয়ফ্রেন্ড থাকে। আমার কোনওকালেই কোন সুন্দরীর প্রিয়তমকে স্মার্ট মনে হয়নি। সুন্দরীর সাথে কাউকে দেখলেই আমার মনে হতে থাকে, ও দুনিয়ার সবচাইতে কুদর্শন মানব, ওর চাইতে আমার দাঁত সাদা, ওর চাইতে আমার মাথায় চুল বেশি, ওর চাইতে আমার হাসি সুন্দর, ওর চাইতে আমার মাথায় বুদ্ধি বেশি.....আরও কী কী সব যেন! কিউট-কিউট বেড়ালছানাগুলি কী বিশ্রী-বিশ্রী খাটাশের সাথে ঘুরে বেড়ায়! আবার যেসব সুন্দরীর বয়ফ্রেন্ড নেই, তাদের বিকটদর্শন পতিঅসুর আছে। মহাযন্ত্রণা!
সুন্দরী---কখনওই একেবারে খালিহাতে ফেরায় না; হয় যন্ত্রণা দেয়, নতুবা বিরহ! ছ্যাঁকা দেয়ই--- প্রেমময় কিংবা প্রেমহীন! আমার দিন কাটে সুন্দরীদের প্রোফাইল পিকচারের উপরে ক্রাশ খেয়ে-খেয়ে। লুকিয়ে-লুকিয়ে ওদের প্রোফাইলে ঢুঁ মারি আর প্রেমহীন ছ্যাঁকা খাই। আহা! সুন্দরী জানলোই না, আর আমি ছ্যাঁকা পর্যন্ত খেয়ে ফেললাম! এইডা কিসু হইলো? প্রেম করে ছ্যাঁকা খাওয়ার যন্ত্রণার চাইতে প্রেম না করে ছ্যাঁকা খাওয়ার যন্ত্রণা বহুগুণে বেশি! কে বোঝাবে সুন্দরীকে এই কথা? ওরা তো সেই সৃষ্টির আদিকাল থেকেই পৃথিবীর তাবৎ শিম্পাঞ্জির গলায় মুক্তোর মালা দিয়েই চলছে! হায় বিধি! আমি কেন শিম্পাঞ্জি নই? মানুষ হয়ে কী-ই বা হবে যদি বানরদের সুখে নাচতে দেখে দেখেই জীবনটা কাটিয়ে দিতে হয়? পরস্ত্রীইমাত্রকেই কেন সুন্দরী হতেই হবে? যাকে প্রপোজ করবো বলে ভাবি, সে কেন আমাকে আপন মায়ের পেটের ভাই বলে ডাকে? আমাকেই কেন দাদা/ ভাইয়া/ দাদাভাই টাইপের চেহারা নিয়ে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে? কেন, কেন, কেন?? সবাই যদি বোন হয়, তবে আমি কাকে প্রপোজ করবো? কেন হায় এই ‘প্রপোজ ডে’ প্রহসনের অনর্থক সৃষ্টি? আমি সুন্দর, তাই বলিয়া আমার প্রিয়তমা সুন্দরী হইবে না কেন? শুধু অসুন্দরীগণই কেন সুন্দরগণকে পতিদেবতা বানাইবার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হইয়াছে? আমার কেন শুধু এটাই ভাবতে ভাল লাগে, আমিই সবচাইতে সুন্দর? আমার চাইতে সুন্দর কেউ পৃথিবীতে কখনওই আসেনি, আসেবেও না? তাই, সুন্দরীদের পবিত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য, টুপ করে শুধু আমারই প্রেমে পড়া?
ঈশ্বর পৃথিবীতে ৩টি জাতি প্রেরণ করেছেন। মানুষ জাতি, জ্বিন জাতি আর সুন্দরী জাতি। ৩য় জাতিভুক্তগণ ১ম দুই জাতির মাথার উপরে কাঁঠাল ভাঙিয়া মুড়ি মাখাইয়া খায়। সে খাদ্য বড়ই উপাদেয়। তাই, যদি কোনও সুন্দরী ভুলেও বলে ‘ভালোবাসি’, আমি ভাবতে বসি, ‘ওর পেটখারাপ হলো নাতো আবার?’ কিংবা ‘সুন্দরীর ভালোবাসা কি গাছে ধরে?’ কিংবা ‘আমি এমন কী অন্যায় করলাম যে আমাকেও ‘ভালোবাসি’ বলতে হবে?’ কিংবা ‘ভালোবাসি---এর মানে কি ও আমার প্রেমে পড়ে গেছে? নাকি, ও আমাকে প্রেমে ফেলার চেষ্টা করছে?’ ........ আহা! এ জন্মে আর ভালোবাসাকে ভালভাবে নেয়াটা শেখা হলো না।
কেউ বোধহয় চেয়েছিল, আমি ওকে প্রপোজ করি৷ গল্পসিনেমার মতো করে৷ একেবারে হাঁটুগেড়ে বসেটসে হাতের গোলাপটা এগিয়ে দিয়ে। আজকের এই দিন আসার বহু আগেই সে চলে গেলো৷ আর কেউ প্রপোজড্ হতে এল না। আহা! জায়ান স্যার কা আফটার-ইফেক্ট! নয় বছর পরেও!! আআআম্মুউউউউউউ........!!! আচ্ছা, প্রজেক্ট/ থিসিস সুপারভাইজার স্যাররাও কি আরেকটা জাতি? মানে, স্যার জাতি? এখনও মনে আছে, স্যারের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হতে-হতে বাটা-অ্যাপেক্স সুয়ের তলা ক্ষয় করে করে অবশেষে লোহার জুতো পরে প্রজেক্ট কমপ্লিট করি৷ হায়! এখন আমার আর লোহার জুতো নেই, হারিয়ে গেছে৷ একজোড়া জুতো হবে, জুতো? আমি প্রেমে পড়লেই আবার ফেরত দিয়ে দেবো। সত্যি-সত্যি! একজোড়া জুতো হবে, জুতো? লোহার? ........ এখন আর লোহার জুতোয়ও হবে না হয়তো। ইস্পাতের জুতো খোঁজার সময় ঘনিয়ে আসছে ক্রমশই! লোকে নাকি কবিতা লেখে প্রেমে পড়লে, আমি কবিতা লেখা শুরু করেছিলাম প্রেমে পড়তে। হায়! এখন আমার সব কবিতা ছন্দ-সুর-লয়-মাত্রা হারিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে!
যে সুন্দরীরা আমার নয়, তাদেরকে খুউব জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয় ………. সুখে তো আছ, না? কিন্তু, কেন আছ? একটু জানলে কী এমন ক্ষতি হয়ে যেত, এই আমিও পৃথিবীতে জন্মে তোমাকে না পাওয়ার জন্যই এখনও বেঁচে আছি?
বহুদিন আগের কথা। আমি তখন থার্ড ইয়ারে পড়ি। ব্যবহার করি ওই সময়ের সবচাইতে জনপ্রিয় এন-ইলেভেন-জিরো-জিরো মডেলের সেট (মানে, নকিয়া ১১০০)। অবিশ্বাস্য রকমের লাজুক, সহজসরল, বোকাসোকা একটা ছেলে ছিলাম সে সময়। এক মেয়ের সাথে ওরই খুব জোরাজুরিতে বহু কষ্টে মাসে চারপাঁচবার ফোনে কথা বলতাম। তাও খুব বেশি হলে ৭-৮ মিনিটের জন্য। এবং, আমরা কখনওই রাত ১২টার পর কথা বলিনি। ওই সময়ে একটা মেয়ের সাথে অতো রাতে কথা বলব, এটা আমার জন্য একটা অকল্পনীয় ব্যাপার ছিল। আমি প্রায় সারারাতই বিভিন্ন বইপত্র পড়তাম, কম্পিউটারে বসে স্টুডেন্টদের জন্য লেকচার শিট বানাতাম, কিন্তু কখনওই ফোনে কারও সাথে কথা বলিনি। সে মেয়ের সাথে ওইভাবে ৬ মাস কথা চলল। কখনওই দেখা হয়নি, তবে আমরা পরস্পরের প্রতি এক ধরনের টান অনুভব করতাম। আমি তখন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিয়মিত আবৃত্তি করি। কোনও এক পহেলা বৈশাখে আবৃত্তির অনুষ্ঠানে মেয়েটা আমার আবৃত্তি দেখেছিল। সেই থেকে ও আমার প্রেমে পড়ে যায়। আমি কিন্তু ওকে কখনওই দেখিনি। সময়টা ২০০৪ কি ২০০৫, তখন ফেসবুক অতো ছিল না, তবে জীবন ছিল। মেয়েটা আমার সম্পর্কে অনেক কিছুই জানত, তবে কীভাবে জানত, তা কখনও বলত না, আমিও জিজ্ঞেস করিনি। আমি শুধু জানতাম, মেয়েটা ডিএমসি’তে পড়ে, ফার্স্ট ইয়ারে, ভাল গান গায়। খুবই শান্ত আর ভদ্র স্বভাবের একটি মেয়ে। এর বাইরে ওর সম্পর্কে তেমন কিছুই জানতাম না। মাত্রাতিরিক্ত লাজুক স্বভাবের ছিলাম বলে ফোনে কথা বলার সময় প্রায় ৯০% কথাই ও বলত, আমি বেশিরভাগ সময়ই শুধু হ্যাঁ হুম হুঁ করে যেতাম। ওর ছিল অসীম ধৈর্য। আমার অমন ভাসুরমার্কা কথাবার্তায়ও একটুও বিরক্ত না হয়ে আমাকে দিয়ে বিভিন্নভাবে কথা বলানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেই যেত সে, এবং ব্যর্থ হতো সবসময়ই।
একদিন আমি কী একটা কাজে ঢাকায় যাই। শহীদুল্লাহ হলে আমার বন্ধু মুফিদ থাকত। ও আমার চিটাগাং কলেজের ফ্রেন্ড, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মৃত্তিকাবিজ্ঞানে পড়ত। ঢাকায় গিয়ে ওর সাথেই উঠি। মেয়েটা আমাকে বারবার ফোন করে দেখা করার জন্য অনুরোধ করছিল আর আমি ফিরিয়ে দিচ্ছিলাম। বাধ্য হয়ে মুফিদকে বলতে হল মেয়েটার কথা। ও তো বিশ্বাসই করতে পারছিল না যে আমার পক্ষেও একটা মেয়ের সাথে ফোনে কথা বলা সম্ভব। চিটাগাং কলেজে পড়ার সময় মেয়েদের সামনে অস্বাভাবিক লাজুক আচরণের কারণে আমি সবার কাছে ‘রোবট’ নামে পরিচিত ছিলাম। সেই রোবট এখন ফোনে একটা মেয়ের সাথে কথা বলে! ক্যামনে কী! যা-ই হোক, মুফিদের অসীম পীড়াপীড়িতে ঝিলমের সাথে দেখা করতে রাজি হই। তবে ঝিলমকে দুটো শর্ত দিয়ে দিই। এক। শহীদুল্লাহ হলের পুকুরপাড়ে দেখা করতে হবে, আমি মরে গেলেও কোনও নিরিবিলি জায়গায় একটা মেয়ের সাথে দেখা করতে পারবো না। দুই। আমার সাথে মুফিদ থাকবে, চাইলে ঝিলমও সাথে করে ওর কোনও বান্ধবীকে নিয়ে আসতে পারে। বেচারি অন্য কোনও উপায় না দেখে রাজি হয়ে গেলো।
জীবনে প্রথম কোনও মেয়ের সাথে দেখা করতে গিয়েছি। সেদিন বিকেলের কথা আজও স্পষ্ট মনে আছে। মেয়েটি পুকুরপাড়ে এল। এসে আমাকে টানা ফোন করতে লাগল, কারণ আমি ফোন ধরছিলাম না। বাধ্য হয়ে অনেক ভয়ে-ভয়ে ফোনটা ধরে বললাম, “ঝিলম, একটু অপেক্ষা করো, আমরা আআআআআ---আসছি।” এইটুকু বলতেই আমি ঘেমেটেমে একাকার, গলা কাঁপছিল প্রচণ্ডভাবে, তোতলাচ্ছিলাম আর হাঁপাচ্ছিলাম। ননস্টপ বুক ধড়ফড় করছিল। আমার কাণ্ড দেখে মুফিদ আমার বাম বাহুতে জোরে ঘুসি মেরে বলল, “শালা, গর্দভ! চল্‌!” নিচে নামলাম আরও মিনিট বিশেক পর। মুফিদই নামিয়েছিল অনেকটা টেনেহিঁচড়ে। যেন জীবনে প্রথম কোনও বাঘের খাঁচার সামনে আমাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে যে খাঁচাটা খোলা, এতটা ভয় আর নার্ভাস লাগছিল যে মনে হচ্ছিল, মরেই যাবো। ওরা দুই বান্ধবী প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করতে-করতে ক্লান্ত হয়ে ঘাসের উপর বসে পড়েছিল। একটু দূর থেকে ওরা আমাদের চোখে পড়ল। ঝিলমের হাতে এক গুচ্ছ লাল গোলাপ, একটা নীল খাম, আর সাথে ওর এক বান্ধবী। আকাশি রঙের ড্রেসে ওকে ভারি সুন্দর দেখাচ্ছিল। “দোস্তো, ও ফুল আনসে কেন? আমার তো ভয় লাগতেসে। আজকে বাদ দে, চল্‌, চলে যাই।” তখন আমাকে জাপটে ধরে প্রায় চিৎকার করে মুফিদ ঝিলমকে ডাকল। ঝিলম উঠে দাঁড়িয়ে আমাদের কাছাকাছি আসার উপক্রম করতেই আমি বলে উঠলাম, “এই, এই শোনো, ওইখানেই দাঁড়াও। ওইখানে দাঁড়িয়ে কথা বলো। নাহলে আমি চলে যাবো।” ও কথা না বাড়িয়ে খাম আর গোলাপ হাতে ওখানেই দাঁড়িয়ে রইল। আমি দাঁড়িয়ে কাঁপছি, মুফিদ আমাকে শক্ত করে ধরে আছে, যাতে পালিয়ে যেতে না পারি। সত্যিই দেখার মতন এক দৃশ্য। এখন তা মনে পড়লে আপনমনে হাসতে থাকি। কী একটা জিনিস ছিলাম তখন! আমার গলা দিয়ে কোনও শব্দই বেরোচ্ছে না। পৃথিবীর সব কথা আমার গলার কোথায় যেন দলা পাকিয়ে আটকে গেছে, অতি কষ্টে দুএকটা স্বর বের হচ্ছে। আমাদের সে মুখোমুখি আলাপ ছিল অনেকটা ইন্টারভিউ স্টাইলে। ঝিলমের সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলাম মাথা নিচু করে মাটির দিকে তাকিয়ে, যেন ওই মাটির নিচে গুপ্তধন আছে যেটাকে আমি সবসময়ই চোখেচোখে রাখছি। খেয়ালই করিনি, মুফিদ একসময় কোথায় যেন সটকে পড়ল, আবিষ্কার করলাম, ঝিলমের বান্ধবীও ওর পাশে নেই। অতি নার্ভাসনেসের ফলে আমি দরদর করে ঘামছিলাম, মনে হচ্ছিল, এখুনিই মাথা ঘুরে পড়ে যাবো। যে ছেলে মঞ্চ কাঁপিয়ে আবৃত্তি করে, সে ছেলেটাই শরীর কাঁপিয়ে থ’ মেরে দাঁড়িয়ে আছে! ক্রমাগত ঢোঁক গিলতে-গিলতে মুখের সমস্ত থুতু খেয়ে ফেলেছিলাম। হল থেকে বের হওয়ার সময় সেই যে প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে রেখেছিলাম, সে দুই হাত আর বের করিনি। যে কেউই দেখলে ভাববে, নিশ্চয়ই আমার বিশেষ জায়গায় চুলকানি হয়েছে!
আমরা দাঁড়িয়েছিলাম পরস্পরের অন্তত সাত-আট হাত দূরত্বে। এরপর হঠাৎ দেখি, ঝিলম একটু-একটু করে আমার দিকে এগোচ্ছে। আমিও দেরি না করে পেছোতে শুরু করলাম। ও দুই পা এগোয়, আমি চার পা পিছোই। “আপনি এমন করছেন কেন? একটু দাঁড়ান না ওখানে! এই ফুলগুলো আপনার জন্য এনেছি। নেবেন না?” “তুমি প্লিজ প্লিজ প্লিজ ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকো। কাছে এসো না। নাহলে কিন্তু আমি চলে যাবো।” “ওকে ওকে ঠিক আছে। আর পেছন দিকে হাঁটবেন না। পড়ে যাবেন তো! আমি আসব না কাছে। ওখানেই দাঁড়িয়ে কথা বলুন!” “ওরা কোথায়? ওরা আমাদের ফেলে কোথায় চলে গেছে?” “ওরা আছে আশেপাশেই। আসুন না, আমরা ওদিকটায় একটু বসি, গল্প করি.........” এটা বলেই ও আচমকা আমার দিকে এগিয়ে এল। আমি ভয়ে দিলাম দৌড়! সে কী দৌড়! দৌড়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় খেয়াল করেছিলাম ও ঘাসে উপর ধপাস করে পড়ে অঝোরে কাঁদছে আর গোলাপগুলি ছড়িয়েছিটিয়ে পড়েছে ওর চারিদিকে। পরে মুফিদ আর ওর বান্ধবী মিলে অনেক কষ্টে ওকে শান্ত করেছে। মুফিদ রুমে আসার পর ওর কাছ থেকে জানতে পেরেছি, ঝিলম ওর সাথের খামটা চিঠিসহ কুচিকুচি করে ছিঁড়ে পুকুরের পানিতে ফেলে দিয়েছিল। এতকিছুর পরও ও আমার সম্পর্কে একটাও বাজে কথা বলেনি। ওর বান্ধবী আমাকে ‘গবেট’ বলার পর ও চিৎকার করে বলেছিল, “খবর্দার, বাজে কথা বলবি না!” মুফিদ ওকে বলেছিল, “আমার বন্ধুটা একটু লাজুক, আপনি কিছু মনে করবেন না, প্লিজ। আসলে ও ছেলে হিসেবে.........” ওকে কথা শেষ করতে না দিয়েই ঝিলম বলেছিল, “আমাকে চেনাতে হবে না। আমি জানি, আপনার বন্ধু কেমন।”
আমি রুমে ফিরে এসেই কাঁপা-কাঁপা হাতে ওকে লিখে পাঠাই---আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো, বোন! (ওইটুকু লিখতেও আমাকে কয়েকবার ব্যাকস্পেস চেপে ঠিক করে লিখতে হয়েছিল।) এর রিপ্লাইয়ে ও পাঠিয়েছিল---খুব ভাল থাকবেন। শেষে একটা স্মাইল ইমো। আর কিছুই না! এরপর আমাদের আর কখনওই কোনও কথা কিংবা মেসেজ আদানপ্রদান হয়নি। সকারণ অভিমান আর অকারণ সংকোচে একটা সম্পর্কের জন্মই হল না আর।
গতকাল ছিল গোলাপ দিবস৷ সে উপলক্ষে গত পরশুই এক সুন্দরী আমাকে ফ্রেন্ডলিস্ট থেকে রিমুভ করে দেয়৷ সে হয়তো বুঝে গিয়েছিল, গোলাপ-রজনীগন্ধার যত্ন নিলেও আমি মূলত মালী, প্রেমিক নই৷ হায়! গোলাপ দিবসে শুধুই ফুলের ব্যাপারী হতে ইচ্ছে করে; হৃদয় না মিলুক, কিছু পয়সা তো অন্তত মিলতো৷............. কত-কত গোলাপ দিবস চলে যায়, কেউ একটা কাগুজে গোলাপও দেয় না! একটা গোলাপ দেবে কেউ? হোক সস্তা, ফিকে---বাসি হয়ে-ওঠা। তবুও? দামটা নাহয় আমিই দেবো!
আজ ভাবি, কেন হায় সারাটি জীবন নীরব নিভৃত গোপন হৃদয়ে ভালোবাসা বুনে-বুনে শুধু রেখেই গেলাম? কেউ কেউ ভালো না বেসেও অনেক আবেগ দিয়ে মুহূর্তেই ‘ভালোবাসি’ বলে ফেলতে পারে। কেউ কেউ ভালোবেসেও অনেক ঝাঁঝালো খাঁটি সরিষার তেল দিয়ে দিনের পর দিন মুড়ি খেয়ে কাটিয়ে দিতে পারে। ভালোবাসার কত রঙ, কত রূপ! বাদামখাওয়া ভালোবাসা, মুড়িখাওয়া ভালোবাসা! ‘মনে মনে ভালোবাসা’র কোনও দামই নেই। আমি বলি, সত্যিই ভালোবেসে ফেললে প্রয়োজনে ‘ভালোবাসি’ বলেটলে লজ্জায় জিভ কেটে রক্তাক্ত করে ফেল, তবুও হৃদয়ে রক্তক্ষরণ কোরো না। যে রক্ত দেখা যায় না, সেটাই যে বেশি লাল!
হে ঈশ্বর! আমাকে পৃথিবীতে পাঠালেই যদি, ভালোবাসার মতো একটু স্মার্ট আর ভালোবাসানোর মতো আরেকটু হ্যান্ডসাম করে কেনো পাঠালে না? সুন্দরীকে এতো মেধা দিলেই যদি, আমাকে ভালোবাসার একটু সুবুদ্ধি কেনো দিলে না? কেনো কেনো কেনো???
এই মেয়ে, শোনো! ভালোবাসো না কেন গো, একটু শুনি? আমায় ভালোবাসলে বুঝি চুলে ভীষণ উকুন হবে, হুঁ? যত্তোসব ঢং......!!!