প্রসঙ্গ: র‍্যাগিং (শেষ অংশ)

কেস স্টাডি-৩৭।
একটা আপু কোনো কারণ ছাড়াই আমাকে বারবার র‍্যাগ দিত, অন্যদের কাছে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, ওই আপুটা নাকি পাগল, আমি যাতে তার কথা পাত্তা না দিই। একটা জিনিস দেখে অবাক হয়েছিলাম। র‍্যাগ দেয়ার জন্য কিছু স্পেশালিষ্ট বড়ো ভাইয়া কিংবা আপু ছিলো। আর যারা র‍্যাগ দিতে পারতো, তারা ভার্সিটিতে খুবই পপুলার ছিলো। ওরা অনেক সম্মানও পেতো ব্রাদারহুডের নামে। যারা র‍্যাগিং-এর সাথে অভ্যস্ত না, তারা অনেক ক্ষেত্রেই সাফার করতো।
ভার্সিটিতে ৪ বছর পার করে ফেললাম, অনেক বোঝার চেষ্টা করলাম ওদের পয়েন্ট অব ভিউ কী, এমনকি আমার এক্স-বিএফ’ও ছিলো একজন র‍্যাগিং এক্সপার্ট! দিনের শেষে যা বুঝতে পারলাম, তা হলো আসলে যারা র‍্যাগ দেয়, তারা বেশিরভাগই খুব হতাশাগ্রস্ত আর কাপুরুষ টাইপের ছেলেমেয়ে। প্রকটর অফিস থেকে কোনো কাজে ডাকলে তারা বেড়ালের মতো গুটিয়ে থাকতো, তখন তাদের দাদাগিরি কোথায় যেন পালাতো!
আসল কথা হল, তারা নিজেদের ব্যক্তিত্ব আর যোগ্যতা দিয়ে সবার সাথে প্রতিযোগিতা করে সম্মান অর্জন করতে পারার মতো মানুষই না, এ কারণে তারা ঘোরানো পথ অনুসরণ করে পপুলারিটি অর্জন করার চেষ্টা করতো। তাদের সাথে চলাফেরা করেও দেখেছি, তাদের বেশিরভাগই খুবই শ্যালো-হেডেড আর স্থূল চিন্তাভাবনার মানুষ। তারা উদার মনের মানুষ না, তারা একটা মানুষকে দেখে নিজেদের জায়গা থেকে, সে মানুষটার জায়গা থেকে দেখে না কিংবা দেখতে অক্ষম।
মজার ব্যাপার হল, এইসব র‍্যাগিং বজায় রাখতে হেল্প করতো কিছু শিক্ষক। তারা কোনো না কোনো কারণে ভার্সিটি প্রশাসনকে পছন্দ করতেন না, এবং এই র‍্যাগদাতা স্টুডেন্টদের ইমোশনকে ইউজ করে ভার্সিটির পরিবেশ নষ্ট করে দিতে চাইতেন। সেইসব টিচার ক্লাসে পড়াতে এসেও বলতেন, ভার্সিটিতে চেইন অব কমান্ড বজায় থাকতে হবে, এবং সেই তথাকথিত চেইন অব কমান্ডটা উনারাই কিছু নির্বোধ অভদ্র ছেলেদের হাতে তুলে দিতেন, যাদের ব্রাদাহুডের নামে ব্রেইন ওয়াশ করা খুবই সহজ।
যারা র‍্যাগ দিত, তারা শুধু জুনিয়রদের সামনে আসলেই ঘেউঘেউ করতো, তাদের প্রকৃত চেহারা তারা সবসময়ই লুকিয়ে রাখতো। ব্রাদারহুডের নামে চড়থাপ্পড়, ব্রাদারহুডের নামে এক জনের পেছনে আরেক জনকে লেলিয়ে দেয়া, ব্রাদারহুডের নামে নির্দিষ্ট কারুর প্রতি শত্রুতাকে রাজনীতিতে রূপান্তর করা, এইসব ফালতু কাজই ছিলো তাদের একমাত্র কাজ। তাদের হাতে ছিলো অফুরন্ত সময়, এবং সে সময়টাকে তারা ওরকম আজেবাজে কাজে ব্যবহার করতো। যারা বোকা, তারা এইসব বুজরুকি বিশ্বাস করে অনেক দিন খুইয়ে শেষ পর্যন্ত ড্রপ খেতো, আর যারা চালাক, তারা অন্যদের ওই পথে নিয়ে গিয়ে নিজেরা ঠিকই ক্যারিয়ারকে গুছিয়ে ফেলতো।
যারা র‍্যাগিং-এর বিরুদ্ধে কথা বলতো, তাদেরকে সবার সামনে বলা হতো চিকেন-হার্টেড পাবলিক। চিকেন পাবলিকরাই নাকি লুকিয়ে থাকে, জনপ্রিয়তা আর পরিচিতি ভয় পায়, তাই র‍্যাগিং-এর বিরুদ্ধে কথা বলে।
আসল কথা হল, বেশিরভাগ সাধারণ মানুষই রাজনীতি বোঝে না, যেদিকে মেজরিটি, সেদিকেই দৌড়ায়। বাঙালির মতো হুজুগে জাত পৃথিবীতে আর কয়টাই বা আছে? তাদের কাছে প্রকৃত ঘটনা খুব ভাল করে ব্যাখ্যা করলেও সেটা মেনে নেবে না, কিংবা বুঝতেই পারবে না, সে ক্ষমতা আর যোগ্যতাই তাদের নেই। ডিপ্লোম্যাটিক সেন্সও তেমন কোনো স্টুডেন্টদের মধ্যে নেই।
কেস স্টাডি-৩৮।
আমি আমার এক কাজিনের সাথে একবার দেওয়ান বাজার থেকে জিইসির মোড়ের ওইদিকে যাচ্ছিলাম। দিদার মার্কেট এর ওখানে গাড়ির জন্য দাঁড়িয়ে ছিলাম কিছুক্ষণ। আমার কাজিনের পরনে ছিলো টপস। সে পোশাককে উছিলা বানিয়ে আমাদের কী পরিমাণ যে হেনস্থা আর অপমানিত হতে হয়েছে সেদিন, বলার মতো না! কোনো ভদ্র মানুষের ছেলেমেয়ে এরকম গালি কখনোই সহ্য করতে পারবে না। আমার কথা হলো, আমার কাজিনের অপরাধটা কোথায়? ও টপস পরেছে, তাই বলে কি ওকে উদ্দেশ্য করে গালাগালি করতে হবে? সেদিনের কথা মনে পড়লে এখনো কান্না আসে।
পরে জেনেছি, যারা গালাগালি করেছিলো, ওদের মধ্যে দুইটা ছেলে ছিলো আমার কাজিনের ভার্সিটির সিনিয়র ভাইয়া।
কেস স্টাডি-৩৯।
এমনিই ইচ্ছার বিরুদ্ধে গুরজী তোড়ি কলেজে অনার্স করছি, তার উপর সেখানে খেতে হল র‍্যাগিং!
১ম বর্ষের ছেলেমেয়েদের বরণ করছে ৩য় ও ৪র্থ বর্ষের ছেলেমেয়েরা। আচ্ছা ভাল....বরণটরণ শেষ। মেয়েদের আর ছেলেদের আলাদা আলাদাভাবে রুমে নিয়ে যাওয়া হল বিশেষ অনুষ্ঠান পালনের জন্য.......রুমে গিয়ে বললো, হিজাবীরা কেউ যেন না বসে, ওদের অন্য রুমে যেতে হবে। হিজাবীদের পরে ননহিজাবীদের পালা......আমি তো দাদা হিজাবী.....পুরাই নার্ভাস। হিজাবীদের কাজ হলো---হিজাব ফেলে চুল খুলে ঠোঁটকে বাঁকিয়ে কোমর বাঁকা করে সেলফি পোজে আধা ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। কিছু বেহায়া মেয়েরা আবার মহাখুশি! চুলের আর ঠোঁটের বাহার দেখাবে......হিজাব খোলা হচ্ছে, এটা তাদের সেল্ফরেসপেক্টে একটুও বাধছে না। আমার সিরিয়াল ১২। না বলাতে আমার জন্য ১০ মিনিট আরও বাড়লো। সবচেয়ে মজার ব্যাপারটা ঘটল তখন, যখন যে মেয়েটা লিডার, ওর লুচ্চা টাইপ বয়ফ্রেন্ড চলে আসলো, আর ও বলছে, থাক, আমার আর করার দরকার নাই! ওর বান্ধবীকে ও বলছিলো, আমি এই পোজ দিলে ওর বয়ফ্রেন্ডের কুনজরে পড়বো এবং তার প্রাণপাখি তাকে ফেলে চলে যাবে!
বেঁচে গেলাম আমি......ওইদিনটা এখনো মনে পড়লে ওই মেয়েটাকে চিবিয়ে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে!
কেস স্টাডি-৪০।
অভিজ্ঞতাটি আমার নয়। আমাদের তৃতীয় তলার এক আপুর। উনাকে উনার মেডিকেল কলেজের কিছু সিনিয়র ভাইয়া র‍্যাগিং-এর নামে গ্যাং রেইপ করে। সে ঘটনার পর উনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। উনার বাড়ির কেউই উনাকে মেডিকেল কলেজে ভর্তি করানোর পক্ষে ছিলেন না। উনি বুয়েটেও চান্স পেয়েছিলেন কিন্তু বাড়ির সবার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে মেডিকেলে ভর্তি হয়েছিলেন। উনি কলেজের হস্টেলে থেকে পড়াশোনা করতেন, যেটাও উনার বাড়ির সবার অপছন্দ ছিলো। ঘটনার পর উল্টো উনাকেই বাড়ির সবাই দোষারোপ করেন এই বলে যে মেডিকেলের পরিবেশ তো ভাল না, এটা উনাদের আগেই জানা ছিল, মেয়েটা কেন বাড়ির অবাধ্য হল! উনার এই ব্যাপারটা থানায় জানানো দূরের কথা, উনার বাসা থেকে বের হওয়াই বন্ধ করে দেয়া হয়। উনাকে সবসময়ই একটা রুমে তালাবন্ধ করে আটকে রাখা হতো। এতে উনি মানসিকভাবে আরো ভেঙে পড়েন এবং একটাসময় উনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। এরপর উনাকে প্রায় ২ বছর দেশে এবং দেশের বাইরে সাইক্রিয়াটিক ট্রিটমেন্ট দেয়া হয়। তারপর উনি মোটামুটি স্বাভাবিক হলেন।
র‍্যাগিং-এর জন্য কানাড়ার সব ভার্সিটিই কুখ্যাত। আভেগী বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কিটেকচার ডিপার্টমেন্টে ৫ মাস পড়ার পর আমার কাজিন অ্যাডমিশন ক্যানসেল করে আশাবরী ভার্সিটিতে ভর্তি হয় আর্কিটেকচারেই। ওর স্বপ্ন, ও আর্কিটেক্ট হবে। তবে যেখানে পড়ার স্বপ্ন ছিলো, সেখানে পড়তে পারল না। ওরা ওকে পড়তে দিলো না। আগের ভার্সিটির বড়ো ভাইয়া আর আপুরা জোর করতো ক্লাসমেটদের কিস করতে। র‍্যাগিং এর নামে সেক্সুয়াল অ্যাবিউজ আভেগী বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক বেশি। কেউ মুখ খুলতে সাহস পায় না, কারণ মুখ খুললে নির্যাতনের পরিমাণ আরো বেড়ে যায়।
ধর্ষিতা হবার যে আপুটার ক্যারিয়ার আর জীবন প্রায় পুরোপুরি শেষ হয়ে গিয়েছিলো, উনার ধর্ষকদের কয়েকজনকে আমি চিনি। বিভিন্নভাবে ওদের খোঁজখবর রাখি, রাখতে ইচ্ছে করে।
ওরা কেউই ওদের অ্যাকাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড অনুযায়ী তেমন কিছু করতে পারেনি। আমি বিশ্বাস করি, করতে পারবেও না।
................প্রকৃতি প্রতিশোধ নেয়। অবশ্যই নেয়।
কেস স্টাডি-৪১।
পৃথিবীতে সবচেয়ে অসহায় সে-ই, যে নিজের মনের কথা তার প্রিয় মানুষগুলোর কাছে বলতে গিয়েও বলতে পারে না………নিজের ভাললাগা, মন্দলাগা, কষ্টের অনুভূতিগুলি কাউকে দেখাতে পারে না…………একটু চিৎকার করে কাঁদতে পারে না, শুধু মৃদু হাসির আড়ালে চোখের কোণে জল লুকিয়ে রাখে।
ভাইয়া, এই প্রথমবার আপনাকে লিখছি। তাও আবার আমার জীবনে র‍্যাগিং এর মতো বাজে এবং নোংরা অভিজ্ঞতা নিয়ে। ঘটনাটি চারুকলার। ২০১০-১১ সেশনে শুদ্ধকল্যাণ বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা অনুষদে আমার মোটামুটি ভালো স্কোর পেয়ে চান্স হয়। আমাকে র‍্যাগিং করার ব্যাপারটা ভাইবা দিতে গিয়ে ঘটে। আমাকে চারুকলার কিছু (৩/৪ জন) সিনিয়র আপু ডাকেন। আমি চারুকলা সম্পর্কে কিছু জানতাম। বুঝতে পারলাম, কিছু একটা হতে যাচ্ছে। সালাম দিয়ে বললাম, জ্বি আপু, আমাকে ডেকেছেন? আপুরা হাসতে শুরু করলেন এবং বললেন, হ্যাঁ, তোমাকে। জ্বি, বলেন। তখন আপুরা আরো অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন এবং বললেন, তোমাকে এখন র‍্যাগ দিব। আমি বললাম, আপু আমি তো এখনো এখানে ভর্তি হইনি, ভাইবা দিতে এসেছি। উনারা আবারও হাসিতে ফেটে পড়লেন (সম্ভবত ওনারা একটু বেশিই বিকারগ্রস্ত ছিলেন) এবং বলতে লাগলেন, এসেছ যখন খেয়ে যাও! উনারা চারুকলার সামনে পিকাসো গ্যালারির অপর পাশে পাথরের কিছু নারী ন্যুড ভাস্কর্যের পাশে বসা ছিলেন।
আমার পর্ব শুরু হলো, যা ছিলো আমার কাছে চরম অস্বস্তিকর এবং নোংরামিতে ভরা। ব্যাপারগুলো আপনাকে বলতেও নোংরামি মনে হচ্ছে। বলে রাখছি, আমি এমনিতে এখনো কোনো মেয়ের সামনে কথা বলা তো দূরের কথা, দাঁড়াতেও চরম নার্ভাস ফিল করি। সেইদিন, এককথায়, পুরাই বোকা হয়ে যাই। যা-ই হোক, এবার আমার পালা শুরু। প্রথমে আমাকে বলা হলো ন্যুড ভাস্কর্যটার স্তন দুই হাত দিয়ে ধরতে। কিছুই করার নেই। লজ্জায় লাল হয়ে গেলাম এবং স্তন দুই হাত দিয়ে ধরলাম। বললেন, জিএফ-এর যেমনি করে ** টিপে, তেমনি করে টিপে দেখা। চিন্তা করেন, উনারাও নাকি মেয়ে! উনাদের আমার এখনো আপু বলতেও ঘেন্না করে! তারপর কাঁচুমাচু করে কিছুটা দেখালাম। এরপর পর্যায়ক্রমে উনারা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে বলতে লাগলেন লিপকিস কর, আদর কর, সন্ধিতে হাত দিয়ে এই কর, সেই কর। শেষে বললেন, এক্স-এ যেমন করে **য় থাপ্পড় দিয়ে সেক্স ওঠায়, ওইসব কর.........হাবিজাবি ইত্যাদি। উনাদের কথা বলার ধরন আর অঙ্গভঙ্গি ছিল নোংরামি আর অশ্লীলতায় ভরপুর।
কী না বলতে পারে উনারা মেয়ে হয়ে, সেই দিন দেখেছিলাম, আর আল্লাহ্‌র কাছে তওবা করেছিলাম যেন আমাকে চারুকলায় না পড়তে হয়। তখন ওইখানে আমার সাথে সিলভিয়া এবং নাফিসা নামে আমার দুই ফ্রেন্ড ছিলো। সিলভিয়া আপুদেরকে আমাকে র‍্যাগ না দেওয়ার জন্য অনেক অনুরোধ করে এবং পরে লজ্জায় সেখান থেকে চলে যায়। নিজের ইচ্ছায় চারুকলায় পরীক্ষা দিই, যদিও পরে পারিবারিক কারণে পড়া হলো না, কিন্তু সেইদিনের ভয়ংকর লজ্জাটা মনের ভিতরে রয়ে গেছে। দুঃখিত ভাইয়া, লজ্জাজনক কথাগুলো আপনার কাছে বলার জন্য, কিন্তু সত্যি বলছি, এগুলোই ঘটেছিলো আমার জীবনে। ধিক্কার করি ওইসব অসভ্যদের। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া না-বলা কথাগুলো প্রাণখুলে বলার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য।
ভাল কথা, আমার একটা জেদ আমি রেখেছি। আমার চাইতে পেন্সিল স্কেচিং পারে, চারুকলার এমন কাউকে আমি চিনি না।
কেস স্টাডি-৪২।
আমার অভিজ্ঞতাটা মনে হয় সবচাইতে বাজে। এসএসসি শেষ করে এইচএসসি’তে কলেজে ভর্তি হলাম, বয়সে আর বুদ্ধিতে অনেক ছোট। অনেক ব্যাপারই বুঝতাম না। কলেজের বড়ো আপুরা ডেকে র‍্যাগিং দিয়েছিলো। আমাকে ডেকে কয়েকটা ব্র্যান্ডের কনডমের নাম বলতে বলেছিলো। আমি বললাম, আপু, আমি এগুলি জানি না, বুঝি না। ওরা বলেছিলো, সায়েন্সে পড়িস, এইগুলি বুঝিস না? বলেই হাহাহা করে হেসে আরো অনেক কিছু বলে অপমান করেছিলো।
কেস স্টাডি-৪৩।
আমি একটা প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়ি। আমি মেডিকেলে চান্স পাইনি, প্রাইভেট মেডিকেলেও পড়বো না, তাই বাবা অনেক অভিমান করে পেছনের সারির একটা প্রাইভেট ভার্সিটিতে ভর্তি করিয়ে দেন। প্রথম দিনে বাবার সাথে ভার্সিটিতে যাই। সেইদিন কেউ কিছু বলেনি। আমি তখনও পর্যন্ত জানতামই না যে র‍্যাগিং বস্তুটা কী। দ্বিতীয় দিনে আমি একাই যাই। ক্যাফেটেরিয়াতে বিবিএ-র এক বড়ো ভাই আমাকে ডেকে বললেন, তোমার ড্রেসটা তো অনেক সুন্দর! তোমার ব্যাগে কত টাকা আছে? বিলটা দিয়ে দাও তো! আমি কিছু না বলে ওয়েটারকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম, মামা, বিল কত? উনি বললেন, ১০০০ টাকা। আমি শুনে তো পুরোই অবাক! এদিকে আমার ব্যাগে ছিলো ৪০০ টাকা। বললাম, ভাইয়া, এত টাকা তো হবে না। তখন উনি বললেন, তাহলে ড্রেসটা খুলে রেখে যাও। সাথে আরো অনেক বাজে কথাও বললেন। আমি কিছু না বলে সেখান থেকে চলে আসি। পরদিন সে ভাইয়া আমাকে প্রপোজ করলেন। বললেন, রাজি হয়ে যাও, রাজি হলে সব সুবিধা পাবে। হস্টেলে উঠতে পারবে, থাকা-খাওয়ার সব দায়িত্ব আমার, তুমি আমার গার্লফ্রেন্ড হলে হলে তোমাকে পরীক্ষার সময় প্রশ্নও যোগাড় করে দেবো। আমি সেদিনও কিছু না বলে অনেকটা জোরে হেঁটে সেখান থেকে চলে আসি। এরপর থেকে ক্রমাগত বিরক্ত করতে থাকে। একদিন আমাদের ক্লাস ব্রেকের সময় আমাদের রুমে এসে সবাইকে চলে যেতে বললো, শুধু আমাকে যেতে দিলো না। সে আমাকে খুবই বাজেভাবে স্পর্শ করতে চাইলো, আমি সেদিনও অনেক কষ্টে রুম থেকে পালিয়ে চলে আসি। পরে আমি ভার্সিটির একজন স্যার আর আমার বাবাকে বললাম যে আমি আর ওখানে পড়বো না। আমি অন্য ভার্সিটিতে শিফট হতে চাইলাম। কিন্তু একটা সমস্যার কারণে তা আর হলো না। সে ঘটনার পর আমি ক্লাসের সবাইকে বলে দিলাম, আমি বিবাহিতা, স্বামী দুবাইয়ে থাকেন, ইত্যাদি ইত্যাদি। তখন আর তেমন প্রবলেম ফেস করতে হয়নি।
কেস স্টাডি-৪৪।
দাদা আপনি র‍্যাগিং-এর অভিজ্ঞতার কথা শুনতে চাইছেন, তাই টেক্সট করলাম। দেশাখ বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি যখন ভর্তি পরীক্ষা দিতে গিয়েছিলাম, তখন কিছু বড় ভাই/আপু আমাকে র‍্যাগিং করেছিলো এইভাবে........এক বড় ভাই বললো, তোমার নাম কী? বললাম, সৈকত। মোবাইল ইউজ কর? “হুমম্‌”। এক আপু বললো, “আচ্ছা, তোমার ফোনে কী কী আছে?” আমি বললাম, “আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না।” তখন আপুটা বললো, “তোমার ফোনে ‘এক্স’ আছে?” আমি বললাম, “সরি।” “তুমি এক্স দেখ না?” “জ্বি না।” “আচ্ছা, তুমি এক্স বলতে কী বোঝো, বলোতো?” “সরি, আমি তা এখন বলতে পারব না।” এরপর ওই আপু রেগে গিয়ে বললেন, “বেয়াদব ছেলে! সবসময় মাথায় নেগেটিভ চিন্তাভাবনা, তাই না?” আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বললেন, “তোমার ফোন চেক করে দেখোতো, মোবাইল কিবোর্ড-এ ‘এক্স’ আছে কি না?” আমি অবাক হয়ে শুধু তাকিয়ে রইলাম। তার পরবর্তী ঘটনাটা অবশ্য অনেক মজার ছিলো।
কেস স্টাডি-৪৫।
দাদা, আমার ছোট্ট একটা অভিজ্ঞতা শেয়ার করব। ২০১৪’তে দেবক্রী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে যাই। অসম্ভব বাজে পরীক্ষা দিয়ে মনখারাপ অবস্থায় হল থেকে বের হয়ে সামোয়া গেটের দিকে হেঁটে আসছি।
তো কিছুদূর যাওয়ার পর দেখি ৩টা সিনিয়র আপু বসে আছে, আর আড্ডা দিচ্ছে। আমার হাতে একজামের জিনিসপত্র দেখে বুঝে গেলো যে......পাইলাম, বলির পাঁঠাকে পাইলাম! আমিও বুঝলাম। কিন্তু মনমেজাজ খারাপ থাকায় ওদিকে ভ্রূক্ষেপ করলাম না। একজন ডাক দিল, “এইইইইই, এদিকে আয়!” গেলাম। বললো, “একজাম কেমন দিলি? চান্স হবে তো?” বললাম, “নাহ, চান্স হবে না।” বললো, “ধুউর......বাদ দে.......তোর জিএফ কই?”.......বললাম, “রাস্তায় আছে, বাসায় যাচ্ছে।” একজন অন্যজনের দিকে তাকিয়ে চোখাচোখি করে কী যেন বললো। তখন একজন বললো, “একটা কাগজ দে তো কেউ আর একটা পেন দে।” আমার দিকে পেন আর কাগজ এগিয়ে দিয়ে বললো, “তোর ইয়ের ছবি আঁক তো দেখি।” শুনে আমি খেলাম ধাক্কা! র‍্যাগ দিচ্ছে বুঝতে পারছিলাম, কিন্তু তাই বলে এ-ই! নিলাম পেন আর কাগজ। আঁকলাম ইয়ায়ায়ায়ায়া বড় করে একটা। বললো, “এত বড়?” “হ্যাঁ।” “প্রমাণ কী?” বললাম, “এখানে খুলব, নাকি কোণায় কোথাও যাবেন?” দিল এক থাপ্পড়। দিয়ে বিদায় দিল।
কেস স্টাডি-৪৬।
র‍্যাগ নিয়ে আমার অভিমত হল, র‍্যাগিং ব্যাপারটা তখনই খারাপ, যখন এটা মাত্রা ছাড়ায়। প্রশ্ন হল, মাত্রা কতটুকু? আমি মনে করি, এটার কোনো একেবারে ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। যারা র‍্যাগ দেয়, তারা বেশিভাগ ক্ষেত্রেই অপরিপক্ব মানসিকতার বলে এটা প্রায়ই মাত্রা ছাড়ায়। তখন ব্যাপারটা খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু পরিমিত মাত্রার র‍্যাগের প্রয়োজন আছে। আমি ভর্তি পরীক্ষা দিতে গিয়ে যাদের কাছে র‍্যাগ খেয়েছিলাম, সে সময় মনে হয়েছিলো, চান্স পেলে মেরেই ফেলবো! কিন্তু দেখা গেছে, উনারাই আমার সবচাইতে কাছের সিনিয়র হয়েছিলেন, এবং এখনো আছেন। আসলে কী জানেন, সবাই র‍্যাগ দিতে পারে না। অনেকেই র‍্যাগের নামে যেটা করেন, সেটা বিকৃত রুচির পরিচায়ক। স্মার্টলি র‍্যাগ দিতে জানলে সে র‍্যাগের ফলে জুনিয়রদের অনেক উপকার হয়, গা-ছাড়া ভাব চলে যায়, কিছুটা নমনীয় হতে শেখা যায়, আচার-আচরণে সংযত ভাব আসে, পড়ার বাইরে অনেক ভাল কিছুতেও যুক্ত হওয়া যায়। বলা নাই, কওয়া নাই, কোনো কারণ ছাড়াই র‍্যাগের নামে কাউকে গালিগালাজ করা, মারধর করা কিংবা মানসিক নির্যাতন করার নাম র‍্যাগিং নয়। যে র‍্যাগ দেয়, তার মাত্রাজ্ঞান আর কাণ্ডজ্ঞান না থাকলে র‍্যাগিং-এর মতো কাজ এক ধরনের সন্ত্রাস ছাড়া আর কিছুই নয়।
কেস স্টাডি-৪৭।
র‍্যাগের নামে যা হয়---বড় আপুরা রুমে থেকে ডেকে নিয়ে যায়......তারপর গান গাইতে বলে.......হিন্দি গানের সাথে নাচতে দেয়.......না পারলে আরো অপমান করে........গালিগালাজ শুনতে হয়........রাত নয়টা থেকে একটা পর্যন্ত রুমে আটকে রাখে.......মেন্টালি টর্চার করে.......একে তো আমরা ফ্যামিলি ছেড়ে একা একটা নতুন পরিবেশে এসেছি, তার উপর এরকম আচরণ........মেনে নিতে খুব কান্না পায়।
কেস স্টাডি-৪৮।
ভাইয়া, আমি মুলতানী কলেজে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। আমাদের কলেজের কাছেই ‘পটদীপ’ নামে একটা হস্টেল আছে। ফার্স্ট ইয়ারে পড়ার সময় ওখানে থাকতাম। আমাদের কলেজ শুক্রবার আর শনিবার বন্ধ থাকে। ঘটনাটি ঘটে কোনো এক শুক্রবার রাতে। মাত্র তিন দিন হলো হস্টেলে উঠেছি, ১দিন ক্লাস করেছি। আমি ও আমার নতুন রুমমেট নিজেদের সম্পর্কে জানছিলাম, ভূত এফএম শুনছিলাম। তারপর আমরা ঘুমিয়ে যাই। আনুমানিক আড়াইটা নাগাদ দরজায় প্রচণ্ড জোরে নক। দরজা খুললাম। দেখি, দুইজন যুবক টাইপের ছেলে এসেছে। তারা বললো, জলিল মামা (উনি আমাদের হস্টেলের কেয়ারটেকার) বলেছেন নিচে যেতে। আমার রুমমেট আবার মনে করছিলো ডাকাত এসেছে। তো ও বিভিন্ন প্রশ্ন করছিলো। বড় ভাইরা ওর উপর ক্ষেপে যায়। তখন সে পাশের রুমের এক ভাইকে জাগানোর চেষ্টা করে। পরে ওই ভাইকে, যারা আমাদের ডাকতে এসেছিলো, তারা কানেকানে কী যেন বলে। পরে ওই ভাইয়াও আমাদের নিচে যেতে বলে। ওই ভাইয়া আবার আমাদের দুই ব্যাচ সিনিয়র ছিলো, যারা ডাকতে এসেছিলো, তাদের চেয়ে এক ইয়ার সিনিয়র। বিষয়টা হচ্ছে, যারা নতুন আসে, তাদেরকে এক ইয়ার সিনিয়র ভাইয়েরা র‍্যাগ দেয়, যেটা পরে জানতে পেরেছি। আমরা পাঁচ তলায় ছিলাম, আমাদেরকে দুই তলায় চারজনের একটা রুমে নেওয়া হল। ঢুকে দেখি, অনেক যুবক একসাথে বসে আছে। আমি সবাইকে সালাম দিয়ে ঢুকি, আমার রুমমেট দেয় না। ওরা ওই রুমের এক বারান্দায় আমাকে পাঠিয়ে দেয়। গিয়ে দেখি, সেখানে আমার এক ফ্রেণ্ড বসা। (ওই দিনই কলেজে ওর সাথে পরিচয় হয়েছিলো।) পরে এক ভাইয়া আসলো, আমাদের সাথে গল্প করলো। ওই সময়ে আমার রুমমেটকে ওরা র‍্যাগ দেয়। আমরা বারান্দায় বসে অনেক কিছুই শুনেছি। একবার হঠাৎ করে দরজা খুলে গেলো, তখনই দেখি, আমার রুমমেট সে রুমে ঝুলন্ত অবস্থায়! (ভেতরের সমস্ত সাহস তখনই উবে গিয়েছিলো!) একটু পরে আমাকে আর আমার যে নতুন ফ্রেন্ড, তাকে রুমে নেয়া হল। আমার রুমমেট রুমে বসেছিলো, সে ভয়ে কাঁপছিলো, তার চোখমুখ ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিলো। আমাদের সাথে তেমন কিছুই করা হয়নি, উল্টো কোক আর বিস্কিট খেতে দেয়া হলো। পরবর্তীতে আমার রুমমেটকে হাজারবার জিজ্ঞেস করেও সেদিন কী হয়েছিলো, জানতে পারিনি।
কেস স্টাডি-৪৯।
আমার ছোটবোন এবার দেব গান্ধার বিশ্ববিদ্যালয়ে পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে ভর্তি হয়েছে। ও খুবই চুপচাপ স্বভাবের একটা মেয়ে। ভর্তি হওয়ার পর থেকেই র‍্যাগিং নিয়ে খুব ভয়ে ছিলো। এদিকে ওর ডিপার্টমেন্টের অনেকেই অলরেডি র‍্যাগ খেয়ে ফেলেছে। এক মেয়েকে ১৬-১৭ জন সিনিয়র ভাইয়া ডেকে নিয়ে র‍্যাগ দিয়েছিলো। মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো যে ওর রিলেশন আছে কি না। মেয়েটা রিলেশন নেই বলাতে ওদের মধ্যে একজন বললো, তাহলে আমাদের সবাইকে প্রপোজ করো। এরপর ওই মেয়ে সবাইকে প্রপোজ করার পর ছাড়া পেয়েছে।
আমাকে এইসব গল্প আমার বোন ফোনে বলতো আর খুব ভয় পেতো। এরপর একদিন আসলো আমার বোনের পালা। ওকে ক্লাস থেকে ডেকে নিয়ে বললো, শুন্য’র নামতা বলতে। এরপর এক-এর নামতা, এগারো’র নামতা। ও ভয়ে ঠিকমতো বলতেই পারেনি, এরপর ওরা সবাই মিলে ওকে ইচ্ছেমত অপমান করল। এরপর জিজ্ঞেস করল রিলেশন আছে কি না। ও প্রপোজ করার ভয়ে বলে দিলো, আছে। এরপর বয়ফ্রেন্ড নিয়ে হাবিজাবি অনেক প্রশ্ন করল আর বোনও সব বানিয়ে বানিয়ে উত্তর দিয়ে গেলো। তারপর ওকে ওরা ছেড়ে দিলো। আমার বোন এইসব কথা আমাকে ফোনে বলে আর অনেক কান্নাকাটি করে।
আমার প্রশ্ন হলো, এইসব ছোট ছোট বাচ্চাগুলিকে এভাবে হ্যারাস করার মানে কী? এমনিতেই নতুন ক্যাম্পাস, পরিবারের বাইরে গিয়ে থাকা, নতুন পরিবেশ, সম্পূর্ণ নতুন একটা জগতে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়ার চেষ্টা, তার উপর আবার র‍্যাগিং? র‍্যাগ না দিলে ওরা নাকি স্মার্ট হবে না, কিন্তু এমন ধরনের হ্যারাসমেন্টের মধ্য দিয়ে ছেলেমেয়েদের স্মার্ট বানানোর দায়িত্ব ওদের কে দিয়েছে?
কেস স্টাডি-৫০।
আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে র‍্যাগিং নিয়ে কিছু বলছি........
এক। র‍্যাগ বলতে আমি যা বুঝি, তা হলো, কাউকে অকারণে মারধর করা কিংবা শুনিয়ে শুনিয়ে টিটকারি মারা বা আজেবাজে কমেন্ট পাস করা।
দুই। কলেজে উঠে দেখেছি আমাদের ক্লাসের এক মেয়েকে কেন্দ্র করে এক গ্রুপের ছেলে আরেক গ্রুপের ছেলের মাথা ফাটিয়ে দেয়। পরবর্তীতে সে মেয়েকে অন্য একটা গ্রুপের কিছু মেয়ে একটা বন্ধ ক্লাসরুমে ডেকে নিয়ে চড়থাপ্পড় মারে, আজেবাজে কথা বলে, যদিও সেই ঘটনায় মেয়েটার কোনো হাত ছিলো না। মেয়েটা ওই দুই ছেলের কাউকেই পছন্দ করতো না। ওরা নিজেরাই মেয়েটাকে নিয়ে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে মারামারি করে এবং একজন আরেকজনের মাথা ফাটিয়ে দেয়। আমি সে সময় বুঝেছিলাম, বাংলাদেশে অনেক পাগল-ছাগল টাইপের ছেলেমেয়ে কলেজ-ভার্সিটিতে পড়তে যায়।
তিন। কলেজের শেষ দিনে আমরা যখন র‍্যাগ ডে উদযাপন করছিলাম, তখন মাশুক নামের আমার এক ফ্রেন্ড আমার কপালে রঙ লাগিয়ে দিয়েছিলো। এটা দেখে কলেজের অনার্সের কিছু বড়ো ভাইয়া ওকে মাঠে ডেকে নিয়ে লাঠি দিয়ে ইচ্ছামত পিটায় এবং ওকে পরে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দেয়। আমি পুরো ঘটনায় খুবই বোকা হয়ে যাই! আমার জন্য এতকিছু হয়ে গেলো, অথচ সেখানে আমারই কোনো হাত ছিল না! আম্মু স্কুল থেকে ফিরলে আমাকে এটা নিয়ে অনেক বকাঝকা করেন। আমি আম্মুকে বললাম, আমাদের কলেজে তো মারামারি সবসময়ই হয়, নতুন কিছু না, আজকের মারামারির ঘটনায় আমার কিছুই করার ছিলো না। আম্মু আমার কথা তো বিশ্বাস করলেনই না, উল্টো আমাকে আরো কিছুক্ষণ বকলেন। মাশুককে কেন ওরা র‍্যাগ দিলো, ওটা কি আদৌ র‍্যাগ ছিলো কি না, আমারই-বা সেখানে দোষ কোথায়, আমি তার কিছুই বুঝতে পারলাম না।
কেস স্টাডি-৫১।
আমাদেরকে প্রথমেই সবার মধ্যে বসালো। তারপর বললো, বসলি কেন? আমরা তো হতবাক। বললো, বসতে বললে তবেই বসবি। পরে বললো, আমরা নাকি বেয়াদব। নিলডাউন করাল এবং তারা ওই এলাকার নেতা, এই কথা জাহির করল। নাচালো, গান গাওয়ালো, বললো **তে পারি কি না, *র্ন দেখি কি না। এইসব মানসিক টর্চার করার পর বললো, পেক-এর নামতা বল। আমি বললাম, পেক-এর নামতা কী? ওদের মধ্যে একজন আমার মাথায় জোরে একটা থাপ্পড় দিয়ে বললো, গাধার বাচ্চা! এটা জানিস না তো কী জানিস? আমি ভয়ে কেঁদে ফেললাম, এরপর আমাকে আর কিছু না করে ছেড়ে দিলো। আমার সামনে অনেককেই ওরা মারলো। পরে আমাদের বুঝালো, আমাদের ভালর জন্য ওরা র‍্যাগ দিয়েছে, একসাথে বসে গল্প করে পরিচিত হলো আরকি! সে ঘটনার পর আমাদের অনেকেই অনেকদিন পর্যন্ত মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থায় ছিলাম।
কেস স্টাডি-৫২।
দাদা, আপনি কিছুদিন আগেই আমাদের ভার্সিটিতে একটা সেমিনার করে গেলেন.......সেদিন কিছু প্রশ্ন ছিলো মনে আপনাকে করার জন্য, কিন্তু অবান্তর মনে হওয়ায় আর করিনি প্রশ্নগুলো। তবে আজকে র‍্যাগিং সম্বন্ধে আপনার বিরূপ মনোভাব দেখে একটা কথা না বলে পারলাম না, সেটা হচ্ছে, ইঞ্জিনিয়ারিং ও বিভিন্ন পাবলিক ভার্সিটিতে চান্স পাওয়া এদেশের অধিকাংশ ছেলেমেয়েই থাকে অতি পড়ুয়া আঁতেল টাইপের.......তারা শুধু পড়াশোনা বাদে জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ জিনিস সম্পর্কেই অনবগত থাকে, যেমন, অন্যান্যদের কীভাবে মিশতে হয়, নানান ধরনের কো-কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিস.......তো তারা ভার্সিটিতে উঠেও র‍্যাগিং-এর শিকার না হওয়া পর্যন্ত যেই লাউ সেই কদুই থেকেই যায়..........আর আমি এই পর্যন্ত যতোটুকু বুঝেছি, তা হলো, ভার্সিটি আসলে একজন যুবককে পরিণত পুরুষে রূপান্তরিত করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে, স্বাবলম্বী হতে শেখায়, সামনে অপেক্ষমান জীবনকে মোকাবিলা করতে শেখায়........অন্ততপক্ষে আমার মতো ঘরে বসেথাকা পোল্ট্রি মুরগিকে তা-ই শেখাচ্ছে। আর এসব যেভাবে শেখায়, সেটা হচ্ছে সিনিয়র+জুনিয়র ব্রাদারহুড (নোংরা নয়, সত্যিকার অর্থেই) এবং ইন্টারকানেকশনের মাধ্যমে.......কিছুকিছু অ্যাডভান্সড ছেলেমেয়ে থাকে, যারা নিজ থেকেই বড়ো ভাইদের সাথে মেশে এবং সব শিখে নেয়, কিন্তু অধিকাংশই, আমার মতে, এটা করে না, বলতে গেলে, করতে পারে না, যদি না তাদেরকে র‍্যাগিং দিয়ে ভাইদের সাথে ফ্রি করে নেয়া হয় এবং ভেতরের জড়তাটাকে কাটিয়ে দেয়া হয়........আর র‍্যাগিং বলতে অবশ্যই হালকা-পাতলা ঝাড়ি, হাসিঠাট্টা করা, জড়তা কাটে এমন কাজ করানোকেই বুঝি আমি। সবার সামনে একটা গান করলে কিংবা কৌতুক বললে কারো মানসম্মান চলে যায় না, বরং জড়তা কাটে। তবে হ্যাঁ, যারা ফার্দার স্ট্রিক্ট পানিশমেন্ট বা অকথ্য গালাগালি, ক্ষেত্রবিশেষে সেক্সুয়াল হ্যারেসমেন্ট করে মজা পায়, তাদের সে কাজকে আমি একদমই সাপোর্ট করি না। সত্যি বলতে কী, ওইসব ফাত্রামি র‍্যাগিং-এর পর্যায়েই পড়ে না। তবে এসবও অহরহ হয়ে আসছে অনেক জায়গায়। তো দেখতে গেলে র‍্যাগিংটা আল্টিমেটলি সাময়িক হ্যারাসমেন্ট হলেও এর ফলাফলটা সবসময়ই যে খুব মন্দ, তা নয়। আপনিও এসব সিচ্যুয়েশন ফেস করে এসেছেন অনেক আগেই, তাই আমার থেকে অনেক ভাল জানেন........তাও নিজের মতামতগুলো আপনার সামনে তুলে ধরতে চেষ্টা করলাম।
কেস স্টাডি-৫৩।
দাদা, আমি কখনো আপনাকে টেক্সট পাঠানোর সাহস করিনি। কিন্তু আজ যখন দেখলাম আপনি র‍্যাগিং নিয়ে জানতে চাইলেন, তখন আপনার সাথে কিছু কথা শেয়ার করতে ইচ্ছে করল।
এটা নিয়ে আমার এক কাজিনের সাথে অনেক তর্ক হয়েছিলো। ও বলছিলো, ওরা নাকি নতুন ভর্তি হওয়া ছেলেমেয়েদের র‍্যাগ দেয়। ওরা একবার এক মেয়েকে ডেকে বলেছিলো, এই মেয়ে, বড়ো ভাইদের চোখে পড়ে না? বেয়াদবের মতো চলে যাও, সালাম দাও না, দেখলে হাসো না। এইসব কী? মেয়েটাকে নানান ধরনের কথাবার্তা বলে ওরা সবাই মিলে নাজেহাল করে দিয়েছিলো। মেয়েটা হাত চুলকাচ্ছিলো দেখে ওকে ওরা বলে, কী ব্যাপার, তুমি কি ভাল চুলকাতে পারো নাকি? দেখি আমাদের সবার হাত চুলকায়ে দাও তো! পরে মেয়েটা কান্না করতে শুরু করলে ওরা ওকে ছেড়ে দেয়। এইসব কথা বলার সময় আমার কাজিনের চোখেমুখে এক ধরনের গর্ব দেখেছি। আমার ভাবতেও লজ্জা হয় যে আমার আপন কাজিন এমন মানসিক বিকারগ্রস্ত!
আমার নিজের অভিজ্ঞতাই বলি। ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর যখন হলে উঠি, তখন এক পলিটিকাল ভাইয়া আমার সাথে অনেকটা জোর করে প্রেম করতে চায়। আমি রাজি না হওয়াতে উনারই এক পলিটিকাল বান্ধবী এক রাতে আমার রুমে কয়েকটা মেয়েকে নিয়ে আসে আর আমাকে থাপ্পড় দিয়ে বলে ফার্স্ট ইয়ারের মেয়েরা নাকি বেয়াদব, বড়ো আপুদের দেখলে ঠিকমতো সালাম দেয় না, মাথা উঁচিয়ে হাঁটে, ডায়নিং-এ নাকি টেবিলের উপর শব্দ করে থালা বাটি গ্লাস রাখে, কোনো কথাই শুনে না, ইত্যাদি ইত্যাদি। এরপর আমাকে রাত ১০টায় রুম থেকে বের করে দেয় নেত্রীরা। আমার রুমের সব জিনিস বের করে দেয়, আমাকে বলে, হলের ত্রিসীমানায় যেন আমাকে আর না দেখে। আজ পর্যন্ত সে ঘটনার সুবিচার দূরে থাক, হলে সিট পর্যন্ত পাইনি।
কেস স্টাডি-৫৪।
তখন ভার্সিটিতে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি সম্ভবত। ক্যান্টিন-২’তে নাস্তা খেতে গেছি। দেখি, এক ছেলে ক্যান্টিনের টেবিল থেকে ভাত, ডালের গামলা সরিয়ে রেখে তার উপর দাঁড়িয়ে মাইকেল জ্যাকসনের মুনওয়াক প্র্যাকটিস করছে। পাশে দাঁড়িয়ে আমার এক বন্ধু সার্কাসের রিং মাস্টারের মত নাচের ইন্সট্রাকশন দিচ্ছে। একটু এগিয়ে গিয়ে বন্ধুকে ঘটনা জিজ্ঞেস করলাম। কাহিনি হচ্ছে, এই ছেলের গতকাল মাত্র ক্লাস শুরু হয়েছে, আর আজকেই সে ক্যান্টিনে গিয়ে লাঞ্চ করার পাশাপাশি মোবাইলে ফুল ভলিউমে গান শুনছিলো, যা প্রকৃত অর্থেই সেখানে থাকা অন্যদের বিরক্তির উদ্রেক করছিলো। এর জন্যই এই ট্রিটমেন্ট। একটু পরেই দেখি সেই জুনিয়র ছেলেটা আমার বন্ধুর সাথে হালিম মামার দোকানে আসলো আর আমার বন্ধু তাকে একটা পেপসি অফার করলো। পেপসির বোতল হাতে নিয়ে ছেলেটা হাসিমুখে বলছিলো, “ভাই, এইরকম র‍্যাগ তো মাঝেমাঝে খাওয়াই যায়!” আমার বন্ধু বিরক্ত হয়ে ‘গেলি!’ বলার আগেই তাকিয়ে দেখি সেই ছেলে তিড়িংবিড়িং করে পগার পার!
কেস স্টাডি-৫৫।
আমি তখন বিলাসখনি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র ৩ দিন বয়সী ছাত্র। ইমিডিয়েট সিনিয়রকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিলাম। আমাকে সন্ধ্যাবেলা সিনিয়রদের রুমে ডাকা হল। ওটা ছিলো আমাদের জন্য জাহান্নাম। কারো ডাক পড়া মানে জীবন শেষ। বুকে অনেক সাহস নিয়ে গেলাম। কী ভুল করেছি, খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আমাকে আনুমানিক সন্ধ্যা ৭টা থেকে কোনো কথা না বলে দাঁড় করিয়ে রাখা হল। আমি দাঁড়িয়ে থাকলাম, তারা তাদের কাজ করতে লাগলো। রাত ২টার সময় আমাকে জিজ্ঞেস করা হলো, দাঁড়িয়ে থাকতে কস্ট হচ্ছে কি না! আমি বললাম, হচ্ছে। একজন বললো, বস, আমি বসতে গেলাম,হাঁটু অর্ধেক ভাঁজ করতেই আমাকে থামতে বলা হলো এবং কল্পিত চেয়ারে বসে রেস্ট নিতে বলা হলো। আমি বেশিক্ষণ থাকতে পারিনি, পড়ে গিয়েছিলাম। রাত প্রায় ৩টায় আমাকে তারা প্রথম জিজ্ঞেস করেছিলো, রাতে খেয়েছিস কি না!
যা-ই হোক, সবখানেই কিছু ভাল মানুষ থাকে, আমি এমনই এক ভাল মানুষের কাছে জানতে পেরেছিলাম যে আমার সেদিনের দোষ ছিলো সিনিয়রকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠানো!
সে ঘটনার পর ওইদিন ওই রুমে উপস্থিত কোনো সিনিয়র ভাইয়াকে কখনো ফেসবুক ফ্রেন্ড বানাইনি। এটা নিয়েও পরে অনেক কথা হয়েছে। দাদা,আমাদের ভার্সিটির যাদেরকে চিনেন,তাদেরকে আমার কথা জিজ্ঞেস করবেন, হয়ত সবাই-ই চিনবে আমাকে, কারণ আমি প্রোগ্রামগুলিতে গান করি। আমি সবসময়ই র‍্যাগ-এর বিপক্ষে ছিলাম, আছি, থাকবো, কিন্তু ক্যাম্পাস জীবনের কোনো মজাই মিস করিনি। র‍্যাগিং না খেলে কিংবা না দিলে ক্যাম্পাসের মজা থেকে নিজেকে বঞ্চিত করা হয়, এ কথা আমি মানি না। আবার র‍্যাগিং-এর মাধ্যমেই জুনিয়রদের সাথে সিনিয়রদের সেতুবন্ধন তৈরি হয়, এটা একেবারেই বানোয়াট কথা। আমার প্রচুর জুনিয়র আছে, বন্ধু আছে, সিনিয়র আছে, যারা সম্মান করে, ভালোবাসে, স্নেহ করে আমাকে।
কেস স্টাডি-৫৬।
আমি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। সবাই বলে কলেজে নাকি র‍্যাগিং বলে কিছু নেই! এটা পুরোপুরি সত্য কিংবা মিথ্যা, কোনোটাই না।
আমি যখন প্রথম কলেজে আসলাম, তখন মহা আনন্দে ঘুরতাম, কাউকেই চোখে দেখতাম না। একদিন বড়ো আপু আর ভাইয়াদের সামনে অনেক জোরে শব্দ করে হাসছিলাম। উনারা আমাকে ডেকে দেড় ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন আর বলেছিলেন, দেখি, হাসো তো! জোরে জোরে হাসো। একটানা হাসতে হবে, থামা যাবে না! আমি ভয়ে কেঁদে ফেলেছিলাম।
আরেকদিন দুইজন ভাইয়া আমাকে ডেকে একটা বড়ো পিঁপড়ার পিছুপিছু হাঁটতে বলেছিলো। আমি কিছু দূরে গিয়ে যখন দেখলাম, ভাইয়ারা অন্য দিকে মনোযোগী হয়ে গেছে, তখন পিঁপড়াটা পিষে দিয়েছিলাম, মনে হচ্ছিল যেন প্রতিশোধ নিচ্ছি।
কেস স্টাডি-৫৭।
আলহিয়া ভার্সিটিতে নাম ধরেধরে লিস্ট আকারে র‍্যাগিং দেয়া হয়। বড়ো ভাইয়া কোনক্রমে মোবাইল নাম্বার কালেক্ট করতে পারলে কল দিয়ে রুম থেকে বের করেকরে র‍্যাগিং করে। যেনতেন র‍্যাগ না, রীতিমতো ফিজিক্যাল র‍্যাগ, উনারা সেটাকে ‘পরিচিতি পর্ব’ নাম দিয়েছেন। এই র‍্যাগ খেলে নাকি অনেক সুবিধা আছে। যেমন, নোট দেয়, জিএফ পাওয়ায়ে দেয়, ভার্সিটিতে প্রবলেম (মারপিট সংক্রান্ত) হলে হেল্প করে, সাঁকো’র (এখানকার বিখ্যাত রেস্টুরেন্ট) বিল দেয়, এরকম আরো অনেক কিছু। শুনে আমার কাছে মনে হয়েছে, পুরাই খচ্চর মার্কা সিস্টেম!
র‍্যাগিং শুরু হয় রাত ১০টায়, চলে ৩টা পর্যন্ত। কাপড় পুরোপুরি খোলায়, বগলের লোম কাটায়, *র্ন মুভি দেখায়.........এইসব কাজ করার সময় মাঝেমধ্যে সামনে সিনিয়র আপুরাও থাকে। যারা র‍্যাগিং-এর সময় যা করতে বলে, তা করতে রাজি হয় না, তাদের নানানভাবে চাপ দেয়। অন্যদের কোনো কথা বলতে নিষেধ করে দেয়, এরপর অনিচ্ছুক ছেলেটিকে ওই রাতের বেলায় বুকপানি পর্যন্ত পুকুরে নামিয়ে রাখে। ক্লাসরুমেও র‍্যাগিং চলে স্যাররা না থাকলে। সিনিয়রিটির ভিত্তিতে র‍্যাগিং চলে।
আমি মধুবন্তী ভার্সিটিতে পরিসংখ্যান আর খাম্বাজ ভার্সিটিতে ফলিত পরিসংখ্যানে চান্স পেয়েছিলাম। আলহিয়ায় আসি শুধু মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার লোভে। কিন্তু সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি, এখানে আর পড়বো না। অনেক সুখে আছি! চরিত্র সবার আগে! এখন দ্বিতীয়বার আবার অ্যাপ্লাই করবো যেখানে যেখানে র‍্যাগিং নাই, সেখানে সেখানে। আর ডিফেন্সে। এইসব র‍্যাগিং কালচার চলতে থাকলে দেশের ভবিষ্যৎ কর্ণধাররা হবেন কিছু মানসিক বিকারগ্রস্ত উন্মাদ গ্রাজুয়েট।
কেস স্টাডি-৫৮।
আমি একজন সেকেন্ড টাইমার ছিলাম। এই বছর গিয়েছিলাম মালহার ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষা দিতে, আমার খুব কাছের বন্ধু প্রথমবারে চান্স পেয়েছিলো, তাই ভাবলাম, তার কাছে গিয়ে উঠবো। একজামের আগের দিন বিকেলে তার মেসে গিয়ে উঠি। তার মেসে তারা ১০ জন ছাত্র ছিলো। আমি আমার বন্ধুর রুমেই থাকলাম, সন্ধ্যার পর পাশের রুম থেকে একজন এসে আমাকে বললো ওই রুমে আমাকে ডাকছে। আমি গেলাম। তারপর গিয়ে দেখি ওই মেসের সবাই খাটে বসা, আর আমার মত যেসব ছাত্র পরীক্ষা দিতে এসেছে, তারা জেলখানার কয়েদির মত গুটিসুটি মেরে দূরে বসা। তারপর সবাইকে ওরা র‍্যাগিং দিতে লাগলো। আমাকে বললো আমি সানি লিওনের *র্ন দেখছি কি না। দেখিনি, উত্তর দিলে জিজ্ঞেস করলো কেন দেখি নাই, আমি হিজড়া কি না, সেই জন্য নাকি, *র্নে সাউন্ড কেমন হয়। ওই সাউন্ডগুলি মুখে করে শোনাতে, বিভিন্ন নামতা বলতে, এইরকম আরো অনেক কিছুই বললো। তারপর আবার রাত ১১টায় থার্ড ইয়ারের বড় ভাই এলো ৩ জন, তারা নাকি আবার বড়ো বড়ো নেতা। তারা আরো খারাপ কথা বলতে লাগলো। তারপর এক বড় ভাই বললো একটা নগ্ন মেয়ের ছবি আঁকতে, তা না হলে কাল পরীক্ষা দিতে দিবে না। আমি ভয়ে কোনোমতে একটা আঁকলাম, তারপর সে ছবির পুরো দেহের একটা-একটা করে নাম লিখতে বললো। তারপর মেঝেতে এক ফোঁটা পানি ঢেলে দিয়ে বললো সাঁতার কাটতে। আমি বললাম, এটা কীকরে সম্ভব? ওরা বলে, তুই তো অনন্ত জলিল, তাই সম্ভব কর যেভাবেই হোক! তারপর সেটা শেষ হওয়ার পর মেঝেতে একমুঠ চাল ছিটিয়ে দিয়ে বললো সব চাল খুঁটেখুঁটে তুলতে। আমি বললাম, ভাই, ঝাড়ু দিয়ে ঝাড় দিয়ে তুলি? তারা বললো, না একটা-একটা করে তুলবি, দরকার হলে সারারাত ধরে তুলে সকালে পরীক্ষা দিতে যাবি। এইভাবেই সব ক্যান্ডিডেটদের র‍্যাগিং দিলো রাত ৩টা পর্যন্ত।
আমি এখনো ভাবি, এরা কোন যোগ্যতায় ভার্সিটির স্টুডেন্ট হয়? এদের মধ্যে এতটুকুও মানবতা নেই। এদের কঠিন শাস্তি হওয়া উচিত।
কেস স্টাডি-৫৯।
মফস্বল শহরের কোনো মেয়ের মেঘমল্লার বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়া কখনোকখনো অভিশাপ। যে শহরে তার আপনজন নেই, সেই শহরে এসে কার কাছে সে প্রথমে উঠবে? কিছুতেই যেন কোনো সমাধান হয় না! তিন বছর আগে যে শহর ছেড়ে যেতে হয়েছিলো, তিন বছর পর আবার সেই শহরেই ফিরতে হল। হ্যাঁ, তিন বছর আগে ও কেদারাতেই থাকত, নামকরা স্কুলে পড়ত। এসএসসি পরীক্ষার আগে ওকে চলে যেতে হল কেদারা শহর ছেড়ে। ওর আব্বু সরকারি চাকরি করতো। তারপর আবার ভর্তি পরীক্ষায় চান্স পেয়ে কেদারাতে আসা। চেনা শহর আর চেনা রইল না। সব কিছুই খুব নিষ্ঠুর। একটা সময় ক্লাস শুরুর দিন এলো। সে হলে গেলো কিন্তু সেখানে থাকার জায়গা নেই। কোথাও ব্যবস্থা হয়েও হলো না যেন। অবশেষে তার এক স্কুল বান্ধবীকে খুঁজে পাওয়া, যোগাযোগ করে তার বাসায় ওঠা। অনাত্মীয় শহর কতটুকু আত্মীয়তা করতে পারে, কে জানে! তবুও তারা ওকে একমাস রেখেছিলো। তাদের প্রতি সে কৃতজ্ঞ আজো।
অবশেষে হলে ওঠা। যার নাম অবৈধ মেয়ে হিসেবে হলে থাকা। একজনের রুমে কাপড়চোপড়, আর অন্যজনের রুমে রাতে থাকা। রাত ১১টার আগে ঘুমাতে যাওয়া যাবে না, সন্ধ্যা ৬টার পর রুমে থাকা যাবে না। এইভাবে চুরির সংসার চলছিলো। আরো অনেক কাহিনি। এরপর আমাদের রুমে সিট বরাদ্দ প্রথম যার কাছে দেয়া হলো, সে অন্ধ। তার রুমে গেলাম। সে এবং তার অন্য রুমমেট বললো, তুমি ম্যাডামের কাছে যাও। গেলাম। আমাকে অন্য রুমে দেয়া হলো। পাঁচ তলায়। ওরা আমাকে ঘোরায়। আজ রুমে উঠা যাবে না। কাল উঠো। তাদের রুমে যাই, কিন্তু ভেতরে ঢুকতে দেয় না। জোর করে ঢুকে গেলাম একদিন। নিজের অধিকারের জন্য জায়গা দখলের মত কাপড়ের ট্রাংক রেখে দিলাম। এরপর আবার যখন গেছি, যেতেই দেয়া হয় না, এরপর বললো, তোমার বাড়ি কই, কয় ভাইবোন, নানান টাইপের ইন্টারভিউ; তারপর বললো, তোমাকে আমাদের পছন্দ হয়নি, তুমি অন্য রুমে যাও। এই কথা শুনে আমার মনের ভেতর থেকে এক ধরনের চাপা কান্না বের হয়ে আসতে চাইলো। ভেবেছিলাম, কষ্টের শেষ হতে যাচ্ছে, অথচ কীসের কী! তখন পাঁচতলায় দাঁড়িয়ে মনে হল এখান হতে ঝাঁপ দিই। এত কষ্ট সিটের জন্য, আমি এমন কী করলাম, যার জন্য তাদের পছন্দ হল না? আর কী কী গুণ থাকলে আমাকে তাদের পছন্দ হত?
নিজেকে সামলাতে পারছিলাম না। সিঁড়ি থেকে নামছিলাম কাদঁতেকাঁদতে। বুঝলাম, আমার কোনো ঠাঁই নেই এত বড় পৃথিবীতে। তার পরদিন ম্যাডামের কাছে সব খুলে বললাম। কয়েকদিন ঘোরার পর এক রুমে দেয়া হলো। সেখানে গিয়ে দেখা করতে গেলাম, ঢুকলাম, ইন্টারভিউ হল। বললো, এখন রুমে উঠা যাবে না, রুমমেট আসুক, তারপর। এরপর সে আসল। আমি আসলাম দেখা করতে। রুমে ঢোকার পর বসালো, তারপর রুমের নিয়মকানুন বললো, রুমে থাকা যাবে না, রুমে পড়া যাবে না, রুমে আসবে, কথা বলবে না, আর অমুক আপুর সাথে মিশবে না, উনি খুব নোংরা, খারাপ। উনার সম্পর্কে আরো অনেক বাজে কথা আমাকে বলা হলো। এক মেয়ে আরেক মেয়ের সম্পর্কে কী পরিমাণ যে বাজে কথা বলতে পারে! আমি শুধু শুনলাম, কিছুই বললাম না। আমার স্বভাব হলো, লোকে অন্যের সম্পর্কে যা বলে, আমি তা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনি, এরপর তার সাথে মিশি, তারপর আমার বিচারে সে অপরাধী হলে, তাকে দূরে সরিয়ে রাখি। কিন্তু এ পর্যন্ত আমি যাদের সম্পর্কে বাজে কথা শুনেছি, তাদের সবাইকেই দেখেছি, আদতে ভাল। তাই লোকে যাকে খারাপ বলে, যাচাই না করেই তাকে খারাপ ভেবে ফেলাটা ঠিক নয়।
সে কথা থাক। এই আপু ছাড়া আর একজন বড় আপু ছিলো, তার নাম জেবা। আপু খুব শান্ত, খুব ধীরে আর মিষ্টি সুরে কথা বলতো। আমাকে খুবই আদর করতো। আমাকে কবিতা পড়ে শোনাতো। তার ছোট বাবুদের খুবই পছন্দ, সে বলতো, আমি বাবু। সে আমাকে শাড়ি পরিয়ে সাজিয়ে দিতো। চা বানিয়ে পাশে বসিয়ে রাখতো। আমার জামাকাপড় সে তার কাছে রেখেছিলো। আমাকে বলতো তার সাথে ঘুমাতে। সে ছিলো ভীষণ শুকনা। আমি রুমে আসার পর সে আপুই ছিলো সবচেয়ে সিনিয়র। তার সাথে আমার তিন মাসের পরিচয় ছিলো। সে চলে যাবার আগে আমার হাত ধরে বলেছিলো, শিলা, বছরের পর বছর যাদের সাথে থেকেছি, তাদের জন্য যা মায়া আছে হৃদয়ে, তুমি এই তিন মাসে আমার হৃদয়ে ওদের চেয়ে বেশি জায়গা নিয়ে ফেলেছ। খুব ভাল থেকো। আপু চলে গেলো, রুমে আমি, আমার বেডমেট, সেই তথাকথিত নোংরা আপু, আর একজন আপু। আমার বেডমেট আপু ভীষণ সুন্দরী। যতটা না পড়াশোনা, তার চেয়ে বেশি রূপ নিয়ে গবেষণা করতো। সবসময় ওই সংক্রান্ত কার্যক্রম চলতো। আর এই আপুর সহযোগী আর এক আপু ছিলো। তখন রুমে আমরা চারজন। ওই দুই আপু সব সময় পুটুরপুটুর করে কথা বলতো। আমার তো কারো সাথে কথা বলা দরকার। কিন্তু ওই দুই আপু আমাকে, বাকি আপুটার সাথে মিশতে নিষেধ করেছে। আমি এমনিতে চুপ করে থাকতে পারি না, তার উপর সবসময় একাএকা কী করে চুপ করে থাকি? আমি ওই আপুর সাথে কথা বলতে গেলে উনি তেমন একটা কথা বলতেন না। এদিকে যিনি আমার বেডমেট আপু, তিনি খুব শক্ত মনের। খুব ছোট্ট খাট সেটি, একজন মানুষ ভাল শোয়া যায়, কিন্তু দুজন মানুষ শুতে বেশ কষ্ট। আমাকে বললো, শোনো মেয়ে আমি কোলবালিশ ছাড়া ঘুমুতে পারি না। আমার কোলবালিশে হাত দিবে না। এককাতে ঘুমাবে। বেশি নড়াচড়া করবে না। আমার টেবিল ব্যবহার করতে পারবে না, তবে পায়ের এক সাইডের ওই জায়গায় কিছু বইখাতা রাখতে পারো। একটা র‍্যাক কিনবে, তাতে সব কিছু রাখবে, কাপড় রাখার কোনো জায়গা পাবে না, রুমে থাকবে না, কমকম থাকবে, দুপুরে ঘুমাতে আসবে না, গোসল করবে অল্প সময়ে, কাপড় নাড়বে একেবারে ওই দড়ির শেষে, আমার কাপড় সরাবে না। আর তুমি বোরকা পর কেন? বোরকাপরা মেয়ে আমাদের পছন্দ না, আর ওই আপুর সাথে কথা বলবে না।
সেই রাতে দুরুদুরু বুকে তার সাথে ঘুমালাম। সারাটা রাত এককাতে ঘুমালাম। সকালে উঠে দেখি পিঠ নাড়াতে পারছি না। তারপর নিজের কাঁথা ভাঁজ করলাম। এর পর উনি আমায় ডেকে বললেন, এই মেয়ে, শুনো, এত বড় হয়েছ, এখনো কাঁথা ভাঁজ করতে পারো না। নাও, আবার করো। হলো না, আবার করো, চারকোণা সমান করো। এবার হয়েছে। এই.......আপু, দেখেছো, এই মেয়ে কাঁথা ভাঁজ করা শেখে নাই। বলেই সে কী হাসি! আমি তখন রাগ করি নিজের উপর, মনেমনে ভাবি, চারকোণা ঠিক নেই, তাই এতবার ভাঁজ করিয়েছে। কিন্তু ভাঁজ তো হয়েছে, এত নিখুঁতের কী দরকার!
সেই শুরু। অন্য আপুটা আমার সাথে কথা বলতেন না তেমন একটা। আমি বুঝতাম, এই দুই আপুর মধ্যে খুব মিল। একজন অন্যজনের সাথে থাকা ছাড়া যেন চলেই না! একজন অন্যজনের সাথে খেতে যাবে, একজন টিভি দেখতে গেলে অন্যজনও যাবে। কিন্তু অপর যে আপু আছে, তার সাথে ওরা কথা বলবে না। স্বাভাবিকভাবেই ওই আপুর সাথে আমি কথা বলি। ওদের সাথে কথা বলতে ভাল লাগে না, কারণ রুমে যখন থাকি, তখন ওরা বলতো কোন মেয়ে কী করেছে, কোন ড্রেস ভাল লেগেছে, কোন ছেলে কী বলেছে, কোন ড্রেসের সাথে ম্যাচিং করে কোন অর্নামেন্ট পরতে হবে। আর গীবত তো আছে, যাবতীয় সিরিয়ালের মেয়েদের মত কাজকর্ম। আমার একদম মন টানত না। আমি ওদের ভয় পেতাম। আমার শরীর খারাপ হলে আমার বেডমেট বিছানায় উঠতে দিতো না। বলতো, মাটিতে থাকো। একদিন তার টেবিলে বই রেখেছিলাম, ছুঁড়ে ফেলে দিলো। আপু অনেক জোরে শব্দ করে পড়তো। এত জোরে যে আমি কানে বালিশ চাপা দিলেও কাজ হবে না। উনার সাথে থাকতে একদিন বললো, তুমি ন্যান্সি আপুর সাথে কেন কথা বল? দেখ না আপুটা পচা, উনার পায়ের নীচে ময়লা থাকে? আমি সেদিন বলেছিলাম, তাকে তো আমার খারাপ মনে হয়নি। আমাকে তো কারো সাথে কথা বলতে হবে!
আসলে ন্যান্সি আপু খুব ভাল মেয়ে, অনেক স্নেহ করতো আমাকে। আমার একটু শরীর খারাপ হলে আপু নিজে রান্না করে খাওয়াতো। কখনো খাবার এনে দিত নিচ থেকে, প্রায় বিকেল আমরা চা বানিয়ে গল্প করে করে সময় কাটাতাম। আপু খুব ভাল নজরুলসংগীত পারতো, আমাকে শুধু গান শোনাতো। কবিতা ভাল পড়তে পারতো না, কিন্তু আমি পছন্দ করি তাই পড়তো আর হাসতো। এরপর আমি সিটহোল্ডার হলাম। আমার বেডমেট আসল। আমি চেষ্টা করলাম আমার সর্বোচ্চটুকু দিয়ে সাহায্য করার।
সেই থেকে শুরু। বাকি দুই দুষ্টু আপু আমার বেডমেট পাপিয়াকে কে বোঝালো। কী বোঝালো জানি না, তবে ও অনেক চালাক মেয়ে, উভয় কূল রক্ষা করতো। এক মুখে অবলীলায় দুই কথা বলতো। আমার এক্স বেডমেট আর অন্য আপু আমার জুতা দেখলে রুম থেকে বাইরে বের করে দিত, আমার জামা বারান্দায় শুকাতে দিলে তার টেনেটেনে জামা সেইখানে পাঠিয়ে দিত, যেইখানে কাক নিত্য টয়লেট করে। ক্লাস থেকে ফিরে গোসলে যাবো, দেখি, জামা পড়ে আছে মাটিতে। কিংবা কাক কাজ সেরেছে। আমার জামায় কলার খোসা দিয়ে রাখতো। আমার এক্স বেডমেটের পড়ার টেবিল আমার বেডের পাশে। সে ১০০ পাওয়ারের হলুদ বাল্বযুক্ত টেবিল ল্যাম্প ব্যবহার করতো। সেই আলো ফোকাস করে দিতো আমার মুখের উপর। রাত ১২টা পর্যন্ত পড়ে আবার ভোরে উঠতো। কখনো রাত তিনটায় উঠতো। একএক দিনের সে সব কথা লিখতে গেলে বই হয়ে যাবে!
........যত দিন যেতে লাগলো, তত তারা অত্যাচার শুরু করলো। আমাকে গোসল করার সুযোগ দিবে না, কত রকম নিয়ম চালু হলো! আমার জন্য সব নিয়ম বদলে গেলো। আমি রুমে পড়তে পারি না, আমার রুমে থাকার অধিকার কম। আর যে টেবিল একটা ছিলো আগের রুমমেট আপুর, সেটি আমি পেছনের বারান্দায় ফিট করি। তখনো পর্যন্ত কেউ বাইরে টেবিল দেয়নি, কারণ বাইরে জামাকাপড় শুকাতে দেয় আর ময়লা ফেলে, এখানে সেখানে বিড়াল মল। এদিকে আমার পরীক্ষা এগিয়ে আসছে, আর আমি রুমে পড়তে পারি না, বারান্দায় পড়ি, কিন্তু আমি যখন পড়তে বসি, তারা গান ছেড়ে দেয়, চিৎকার করে, আমাকে শুনিয়েশুনিয়ে পচা কথা বলে। আমি শুনি আর কাঁদি। এর মাঝে বাচ্চা একটা টেবিল কিনি, সেটা কোলে নিয়ে মাঠে, বারান্দায়, যেখানেই জায়গা পাই, ফিট করে পড়ি। এরপর মাঠে পড়ি, ছাতা মেলে। আরো অনেক কিছু।
এরই মাঝে আমার বিয়ে হয়, সেখানেও কষ্ট, সব মিলিয়ে অনেক কষ্ট! আমি নিয়মিত ঘুমের ওষুধ খাই; একটা, কখনো আরো বেশি। কান্না ছাড়া আমার জীবনে আর কিছু নেই। এতই মানসিক নির্যাতন যে স্বপ্নে দেখতাম, কে যেন আমাকে গলা টিপে ধরেছে। আবার ওদিকে তারা আমাকে দেখলে মুখ কালো করে থাকতো। এটা খুব কষ্ট দিতো। যা-ই হোক, তারপর ২য় বর্ষ পরীক্ষা সামনে, আমি রুমে এসেছি নামায পড়তে, আমি নামায পড়ছি, তারা গান ছেড়ে দিলো জোরে, আমি বললাম, আপু একটু আস্তে সাউন্ড দিবেন? আমাকে বললো, বেয়াদব মেয়ে, আমারে সাউন্ড কমাতে বল, সাহস তো কম নয়! বলেই থাপ্পড় দেবো বলে মারতে গেলো, আমি তখন তার তখন হাত ধরে ফেললাম। ভয়ে আমার শরীর কাপঁছে। আমি বললাম, আপনার হাত আছে, আমার নেই? এরপর অন্য আপু বললো, শিলা, তুমি রুম থেকে বের হও, তুমি রুমে উঠার পর হতে এই রুমের শান্তি শেষ। তোমাকে আমাদের ভাল লাগেনি, বোরকাপরা মেয়ে আমাদের পছন্দ নয়। এ রকম আরো অনেক কথা। এগুলো র‍্যাগিং বলবো, না কী বলবো আমি তো জানি না।
কেস স্টাডি-৬০।
সত্যি বলতে কী, আপনাকে অন্ধের মতো ফলো করি, দাদা.......আপনি র‍্যাগিং-এর বিপক্ষে জেনে আমি অনেক বেশি খুশি, কারণ এই জিনিসটা এক সময় আমাকে অনেক বেশি যন্ত্রণা দিয়েছে।
কাউকে বিনা কারণে দোষ দেওয়াটা খুব খারাপ লাগে আমার কাছে। তো একদিন ক্লাসে আমাকে সবার সামনে আনা হল। “এই তুই নাকি অনেক বড় হনু হয়েছিস, মেয়েদেরকে মিসডকল দিস?” আমি তো আকাশ হতে পড়লাম! আমি বললাম, “নাতো ভাই, আমি তো কাউকে এমন মিসডকল দিইনি!” উনি, “কী.......মুখেমুখে তর্ক? তুই এক আপুকে মিসডকল দিয়েছিস........তোর নম্বর থেকে মিসডকল এসেছে!” তখন আমি সাথেসাথে আমার পকেট থেকে আমার দুইটি ফোন বের করে দিলাম। বললাম, ভাই, যে নাম্বার থেকে মিসডকল এসেছে, আপনি সে নাম্বারে কল দেন, দেখেন, আমার ফোন বাজে কি না। স্বাভাবিকভাবেই কোনো ফোনই বাজলো না........আমি তখন রাগে আর কষ্টে নীরবে কেঁদে গেলাম একা দাঁড়িয়ে......উনারা সবাই নিজেরা নিজেদের কাজে বকবক করছে, আর আমি একা ক্লাস এর কোণায় দাঁড়িয়ে কাঁদছি। একসময় ওরা বললো, যা, বাইরে গিয়ে কাঁদ। আমি চলে এলাম। তারা যে একটা ভুল করছে, তার কোনো বিচার নেই, আর এদিকে আমাকে কাঁদতে হচ্ছে........রাতের কথা আর না হয় না-ই বলি আজ........কী যে অশ্লীল কাজে সেইসব রাত পেরোতো, তা ভাবলে এখনো ঘেন্নায় গা রিরি করে।
কেস স্টাডি-৬১।
জীবনের প্রথম অভিজ্ঞতা......কালিঙ্গড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন ভর্তি পরীক্ষা দিতে গেলাম, তখন ২-৩ জন, সম্ভবত বড় ভাই, এসে বললো, এই ছেলে, এদিকে এসো। গেলাম। বললো, ক্যান্ডিডেট? হুমম্‌। বললো, ইউনিভার্সিটি বানান করো। বললো, হয়নি। আবার করো। করলাম। আর সাহস করে বলে ফেললাম, ইউনিভার্সিটি বানান কেউ ভুল করে? পরে বললো, গান পারো? হুম, পারি। বললো, গেয়ে শোনাও। লালনের গান। শোনালাম ২টি। পরে ঘাড়ে হাত দিয়ে বললো, কিছু মনে কোরো না, এমনিই মজা করলাম। এরই মধ্য দিয়ে শেষ হল কাবি’র পর্ব।
পরেরটা খুবই ভয়াবহ.....! ধৈবত বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। এখনো মনে আছে সেদিন অর্থনীতি পরীক্ষা। গেলাম। ৪ জন বড় আপু এসে নাম জিজ্ঞেস করল। বললাম। তারা বললো, সোজা হয়ে দাঁড়া। পা বাঁকা নাকি? ধমকের কণ্ঠে ‘দাঁড়া’ শোনার পর টানটান সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। পরে বললো, জামার হাতা ছাড়। ছাড়লাম। পরে কী যেন জিজ্ঞেস করায় একটু ত্যাড়া কথা বললাম। পরে বললো, পানিতে নাম এখুনিই! এত সহজে কি আর নামি! তবু অবশেষে হেরে গিয়ে নামতে হল। সে দিনের পরীক্ষা ছিলো বিকেল ৫টায়। আর এ ঘটনা ঘটে ১১টায়। তাই আর পরীক্ষা দেয়া হলো না। কাঁদতেকাঁদতে রুমে ফিরে এলাম। আর এদিকে কোন ইউনিভার্সিটিতে চান্স পাইনি। এজন্য মনটা ভীষণ খারাপ ছিলো। পরে ভীমপলশ্রী বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়ার পরে আর র‍্যাগ খাইনি। অন্তত এ দিকটা এড়িয়ে চলতাম।
প্রিয় পাঠক, এতদূর পড়ার পর র‍্যাগিং নিয়ে আপনাদের মধ্যে হয়তো কিছুটা মিশ্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম নিয়েছে, এবং এমন নেয়াটাই স্বাভাবিক। কোন র‍্যাগিং ভাল, কোন র‍্যাগিং খারাপ, কোনটা সফট র‍্যাগিং, কোনটা হার্ড র‍্যাগিং, কোন র‍্যাগিং-এর প্রভাব ইতিবাচক, কোন র‍্যাগিং-এর প্রভাব নেতিবাচক, এইসব বিচারে আমি যাবো না, কেননা আমি বিশ্বাস করি, আমার এই লেখা পড়ে যে কেউই সে বিচার নিজস্ব বিবেচনাবোধ দিয়ে করতে পারবেন। র‍্যাগিং নিয়ে আমার নিজস্ব কিছু ভাবনা লিখে লেখাটি শেষ করছি।
এক। কলেজ কিংবা ভার্সিটিতে যে বড়ো ভাইয়ারা র‍্যাগিং দেয়, ওরা যেহেতু চাকরিতে আগে ঢোকার কথা, সেহেতু যাকে র‍্যাগ দেয়া হচ্ছে, পাস করার পর তাকে ওরাই ভাল চাকরি দেবে সম্পর্কের (ব্রাদারহুড!) খাতিরে---এর চাইতে বাজে যুক্তি আর হয় না। ভার্সিটি থেকে পাস করার পর কয়জন বড়ো ভাই ফোন ধরে আর যারা ফোন ধরে, তারা হেল্প করার মতো অবস্থানে আছে কি না, কিংবা থাকলেও হেল্প করার মানসিকতা রাখেন কি না, সেইসব খোঁজখবর একটু নিয়ে দেখুন! আমি ভার্সিটিতে পড়ার সময় কখনোই কোনো বড়ো ভাইকে ‘গোনার মধ্যেই’ ধরিনি কিংবা ধরার সময় পাইনি। ভার্সিটিতে পড়ার সময় এবং ভার্সিটি থেকে পাস করার পরবর্তী সময়ে কখনোই উনাদের কাউকে আমার ন্যূনতমও কোনো কাজে লাগেনি এবং ভবিষ্যতেও কোনো কাজে লাগার বিন্দুমাত্রও কোনো সম্ভাবনা কিংবা আশংকা নেই। বরং উনাদের অনেকেই নানান কাজে আমাকে অসংখ্যবার ফোন করেছেন, করেন এবং সামনেও করবেন; আর আমিও হাসিমুখে উনাদের হেল্প করেছি, করছি, করে যাবো।
দুই। ভার্সিটিতে পড়ার সময় আমি যথেষ্ট বিনয়ী, পরিশ্রমী এবং আত্মমর্যাদা বোধসম্পন্ন ছিলাম। এর ফলে আমার যে লাভটা হয়েছে, তা হলো এ-ই, অনেক সিনিয়র আমাকে খুব পছন্দ করতেন এবং আমাদের সম্পর্ক ছিলো পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের এবং ভালোবাসার। তাঁদের অনেকের সাথে আমার এখনো যোগাযোগ আছে, তাঁরা আমাকে ‘তুই’ বলেই সম্বোধন করেন, এবং আমিও তাঁদের প্রতি প্রকৃত অর্থেই ব্রাদারহুড অনুভব করি। একই ব্যাপার আমার সাথে আমার জুনিয়রদের সম্পর্কের বেলায়ও সত্য। এই সম্পর্ক তৈরি করার জন্য আমাকে কখনোই র‍্যাগ খেতে কিংবা দিতে হয়নি। ভাল কথা, আত্মমর্যাদা বোধসম্পন্ন হওয়া আর বেয়াদব হওয়া, কখনোই এক কথা নয়। বেয়াদব জুনিয়রকে সোজা করার জন্য, লাইনে আনার জন্য সফট র‍্যাগিং দেয়া যেতে পারে, তবে সেটা যেন দেয়া হয় শুধুই তার সংশোধনের জন্য, তার ভালর জন্য, র‍্যাগদাতার দাদাগিরি কিংবা নির্লজ্জতা প্রদর্শনের জন্য নয়।
তিন। যে বড়ো ভাইয়া কিংবা আপু র‍্যাগিং কালচারের একনিষ্ঠ ধারক ও বাহক, তাঁদের বেশিরভাগই কাজের কাজ করার চাইতে অকাজের কাজ করার ব্যাপারে বেশি উৎসাহী। খোঁজ নিয়ে দেখুন, জানতে পারবেন। এর ফলাফল খুব একটা সুখকর নয়। ভার্সিটি কিংবা কলেজ থেকে পাস করার পর তাঁদের ক্যারিয়ারের অবস্থা খুব একটা ভাল হয়েছে বলে আমি দেখিনি। যার নিজের ক্যারিয়ারেরই ঠিক নেই, সে আপনার ক্যারিয়ার কী ঘোড়ার ডিম ঠিক করে দেবে বলে আপনি আশা করে বসে আছেন? ভার্সিটিতে পড়ার সময় জীবনকে অনেক সহজ মনে হয়, পাস করে বের হওয়ার পরেই বোঝা যায়, লাইফের লাথি কাহাকে বলে, কত প্রকারের ও কী কী!
চার। উপরের লেখায় কিছুকিছু র‍্যাগিং-এর কথা লিখেছি, যেগুলি ভীষণ রকমের নোংরা এবং জঘন্য অপরাধও। আমার ক্ষমতা থাকলে আমি ওইসব র‍্যাগদাতাদের ধরে ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলি করে মেরে ফেলার নির্দেশ দিতাম। যে ব্যাটা ব্যাটাগিরি দেখাতে পারে সবলের সাথেও, কেবলই দুর্বলের সাথে নয়, সে-ই আসল ব্যাটা; বাকিরা সবাই কেবল চেহারায় ব্যাটা। স্পষ্ট করেই বলছি, ওইসব র‍্যাগিং থেকে কিছুই শেখার নেই, বরং একজন শিক্ষার্থীর মনে সেগুলি খুবই বিরূপ প্রভাব ফেলে।
পাঁচ। লিও তলস্তয়ের বিশ্বখ্যাত উপন্যাস ‘আনা কারেনিনা’ শুরু হয়েছে বাইবেলের অমূল্য কথাটি দিয়ে: Vengeance is mine, and I will repay. এই এপিগ্রাফের অর্থ খুবই ভয়ংকর। স্রষ্টা নিশ্চয়তা দিয়ে বলছেন, হে মানুষ, শোনো! তোমার প্রতি যে অন্যায়ই করা হোক না কেন, যদি তুমি তার যথার্থ প্রতিবাদ নাও করতে পারো, অন্যায়কারীকে তাৎক্ষণিকভাবে তার প্রাপ্য শাস্তি দিতে নাও পারো, ভেবো না। সব কিছুই আমার খাতায় লেখা হচ্ছে। যে তোমার প্রতি অন্যায় করেছে, সে তার কৃতকর্মের সমুচিত জবাব পাবে, এবং জীবিত অবস্থাতেই পাবে। তোমার প্রতিশোধ নেয়ার প্রয়োজন নেই, যা করার, আমিই করবো। আমি বদলা নিই, সবসময়ই নিই, প্রাপ্য শাস্তিটা সবাই কড়ায়গণ্ডায় বুঝে পাবেই পাবে। অপেক্ষা করো, সময় হলেই তুমি তা প্রমাণসহ দেখতে পাবে।
প্রিয় র‍্যাগদাতাগণ, যাকে আজকে র‍্যাগ দিচ্ছেন, সে হয়তো কখনো না কখনো উঠে দাঁড়াতে পারবে; কিন্তু জীবন যখন আপনাকে র‍্যাগ দেবে, তখন আর কখনোই মেরুদণ্ড সোজা করে উঠে দাঁড়াতে পারবেন না, চিরতরে পঙ্গু হয়ে যাবেন।