প্রেমান্ধতা/পর্ব-২

 
কী জানি কোন ভুলে নিহালের ফোন থেকে আমার ফুপাত দুলাভাইয়ের নম্বরে কল চলে যায়। আর তিনি এসব ধ্বস্তাধস্তি মারধরের শব্দ শুনতে পান। ওদিকে ওর আপন বড়ো কাকি (জেঠি) দুমদাম মারের শব্দ শুনে হন্যে হয়ে এদিক সেদিক ঘুরে এই রুমের পাশে এসে বুঝতে পারেন, এখানেই মারধর চলছে, কিন্তু কে কাকে মারছে! তিনি কিছুই বুঝতে পারছেন না। কারণ নতুন বউ বাড়ি রেখে কে কাকে মারছে? নতুন বউ কী ভাবছে এসব দেখে? দিগ্‌বিদিক জ্ঞানশূন্য তিনি হুড়মুড় করে দরজায় এসে দরজা খুলতে বলেন। এদিকে ওরা তো হতভম্ব হয়ে গেছে যে মানুষ টের পেয়ে গেল কী করে!


বাইরে থেকে সবাই অনেক রিকোয়েস্ট করার পর ওরা দরজা খুলল। ঢুকে দেখে, আমার গলা তখনও ওর ছোটো আপুর বামবাহুর মধ্যে। ইয়া বড়ো শরীর তার। মোটা, কালো। সে আমাকে চেপে ধরে তখনও নাকে মুখে সমানে কিলাচ্ছে। আমি নিস্তেজ হয়ে হাত-পা নাড়াতে পারছি না, রক্তাক্ত অবস্থায় গোঙাচ্ছি। ওর জেঠি দৌড়ে এসে ওর কাছ থেকে আমাকে ছাড়িয়ে নিয়ে বুকে জড়িয়ে নিলেন।


আমি অজ্ঞানের মতো হয়ে আছি, নাক মুখ দিয়ে ফেনা বের হচ্ছে। তখনও ওরা বলছিল, ‘মাগি ঢং করছে। ওর কিচ্ছু হয়নি।’ কাকি বললেন, ‘কী এমন দোষে নতুন বউটাকে ধরে তোরা মারলি? নতুন এ বাড়িতে এসেই সারাদিন পুরনো মানুষের মতো একটার পর একটা কাজ করে যাচ্ছে! কী এমন অপরাধে তাকে মারলি, যে তোর মুখের দিকে তাকিয়ে খুলনা থেকে নড়াইল এককাপড়ে চলে এল? যদি সে অপরাধ করতই, তবে তার আব্বু-আম্মুর কাছে নালিশ দিতিস। নাহয় গ্রামের লোকজনই ডাকতিস।’


একে একে আশেপাশের লোকজনে ঘর ভরে গেল। সবাই জেনে যাচ্ছে, তখন ঘটনার মোড় ঘোরানোর জন্য ওরা অন্য ফন্দি আঁটল। ওর বড়ো আপু, যে দাঁড়িয়ে থেকে ওদের দুজনকে জোরে জোরে মারতে বলছিল, সে হঠাৎ করে ‘আল্লাহ গো, আম্মু গো, গেছি গো’ বলে চিৎকার শুরু করল, আর ওরা তাকে নিয়ে তড়িঘড়ি করে হসপিটালে গেল।


এদিকে আমি কাদার মতো লেপটে পড়ে আছি ওই কাকির কোলের মধ্যে। কাকি আমার ব্লাউজ তুলে দেখেন, আমার পিঠ ফুলে অনেক উঁচু আর গাঢ় নীলরঙের হয়ে আছে। মহিলারা কাকির কথায় মলম, কেউ সরিষার তেল ইত্যাদি দিয়ে মালিশ করতে লাগল। আমাকে ওরা যে গামছা দিয়ে মুছে দিচ্ছে, ওটা রক্তে ভিজে একাকার হয়ে গেছে।


ওরা এক পর্যায়ে দেখল, আমার দুলাভাইয়ের কাছে কল চলে গিয়েছিল। এবার ওরা সরাসরি দুলাভাইকে ফোন করে খুব রাগ দেখিয়ে অপমান করে বলল, ‘আপনাদের মেয়েকে মেরেছি। এসে সেটল করে নিয়ে যান।’ দুলাভাই তো অবাক! হচ্ছে কী এখানে!


আমার ভাই তখন বউ নিয়ে শ্বশুরবাড়ি গেছে, বেশ প্রত্যন্ত গ্রামে। ওই খবর শুনেই সেও রওনা দিয়েছে খুলনার উদ্দেশে। এদিকে আম্মু আমাকে ফোন দিচ্ছে, ফোনে পায় না। আমার ফোন কেড়ে নিয়ে ওরা অফ রেখেছিল। পরে ফোনটা খুললাম, তখন আমি ওই চাচি-শাশুড়ির ঘরে বসে নামাজ পড়ছি, পিঠে ব্যথা নিয়েও। আমার ফোন উনি ধরে আমার আম্মুকে বললেন, ‘কিচ্ছু হয়নি বেয়াইন। আপনার মেয়েকে নিয়ে কিছু না। ওরা ভাই-বোন ঝামেলা করেছে। ও ঠিক হয়ে যাবে।’… এসব বলে উনি আম্মুকে সান্ত্বনা দিলেন।


আমিও একটা বারও বাসায় বলি নাই যে ওরা আমাকে মেরেছে। আমি উলটা বলেছি, কারও আসার দরকার নাই। সব ঠিক হয়ে যাবে।


এদিকে চলতে লাগল কিসসা। ওরা ফোন করে ফোর্স করে করে আমার বাসার লোকজন নিয়ে গেছে। আমার ভাই, বড়ো কাকার মেয়ে, বড়ো খালার ছেলে, ছোটো খালু আর চাচাত মামা, যিনি ওদের ওখানে এসআই-এর চাকরি করেন, উনিসহ সবাই মিলে পরদিন বিকেলে এসে এখানে পৌঁছল।


এর ভেতর একবার ওর আব্বু, একবার আম্মু, একবার ওর দুলাভাই আমাকে চোখ রাঙিয়ে ভয় দিয়ে দিয়ে যা-তা বলছে। ওর কাকি আমার পিছু ছাড়ছেন না। জানেন, সুযোগ পেলেই ওরা আমাকে আবার মারবে। মেরে ফেলতে পারলে বলবে, সানজিদা সুইসাইড করেছে।


বিকেলে সবাই গেল ওদের বাড়ি। কোনও নাস্তাও দেয়নি ওরা কেউ। আমাদের কাছে শুনল সব। এদিকে অন্য রুমের কোনায় লুকিয়ে থেকে ওর ছোটো আপু আমাকে ইশারায় ডাকছে আর ফিসফিস করে বলছে…‘এদিকে আয়, বেশ্যা, তোকে এখানে পুঁতে দেবো।’ ওকে দেখতে তখন সত্যিই অদ্ভুত রকমের ভয়ংকর দেখাচ্ছিল!


পাশের কিছু লোকজন আমার খালুকে ডেকে নিয়ে বলল, ‘আপনি সানজিদার কী হন জানি না। তবে এরা কথা বলে রেখেছে। অ্যানিহাউ সানজিদাকে ঘর থেকে বের করবে। লাশ বানিয়ে হলেও বের করবে। ওদের আপনারা চেনেন না। অঘটন ঘটিয়েছে ছেলে, তাই আপনাদের মেয়েকে আনা লাগে। এজন্যই এনেছে। তবে রাখবে না, এটা শিওর। দরকার হলে পিটিয়ে মেরে ফেলবে। এ ঘর থেকে হয় সানজিদা যাবে, নয় ওর লাশ যাবে।’


আমার ভাই বাইরে বের হয়েছে একটু, এর ভেতর ওদের সেট-করা লোকজন আমার ভাইকে অনেক অপমান করেছে। এরপর ভাই আমাকে নিয়ে চলে আসতে চেয়েছে খুলনা। ভাই বলল, ‘যেখানে আমার বোনকে কেউ চাইছে না, সেখানে আমার বোনকে আর আমরা রাখব না।’


কিন্তু ওরা আমাকে তখন আসতে দিল না। এদিকে রাত্রে নিহাল আমাকে বোঝাল যে সে ভোররাতে উঠেই আমাকে নিয়ে ঢাকা চলে যাবে। আমাকে ছাড়া সে বাঁচবে না। আমার বাসার ওদের এটা বলতে বলল সে।


ওর কথামতো আমি ওদের বিদায় দিয়ে ওর সাথে ভোরে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিলাম ওর বন্ধুর দেওয়া শাড়ি আর স্যান্ডেল পরে। সাথে ছিল আমার কিছু বই।


১৪ জুন ২০১৯ তারিখ আমরা ঢাকা গেলাম। ওই দিনই খুঁজে খুঁজে একটা বাসা ম্যানেজ করলাম দুজন মিলে। একতলার বাসা, টিনশেডের। ভাড়া ৫০০০ টাকা। বাসাটির পূর্ব আর দক্ষিণ দিকে বড়ো বড়ো করে স্কুলের মতো জানালা। রুমে ফ্যান নাই। সারা দিন সকালে দুপুরে পূর্বদিকে, বিকেল থেকে সন্ধ্যা দক্ষিণদিকে সূর্যের উত্তাপ। আর আশেপাশে সব টিনশেডের নরমাল ঘর। সেখান থেকেও উত্তাপ আসে আমাদের ঘরে।


উত্তপ্ত জুন মাস তখন। সারাদিনই মনে হয়, আমি যেন সিদ্ধ হয়ে যাচ্ছি। আমার বিকাশে কিছু টাকা ছিল, ৫৫০০। সেগুলি উঠিয়ে ২৫০০ টাকা দিলাম বাসাভাড়া, আর ২৫০০ দিয়ে থালাবাসন, তরিতরকারি কিনলাম। বাকি ৫০০ দিলাম ওর হাতখরচ, চলাফেরার জন্য।


দিনে সারা দিন প্রচণ্ড রোদ। আবার উপরে টিন বলে রাত্রে অনেক ঠান্ডা। আমার আবার ঠান্ডা লাগে একটু বেশিই। তাই রাতে শীতের সময় আমি ওর এক্সট্রা লুঙ্গি আর আমার অন্য একটা ওড়না মিলিয়ে গায়ে দিতাম। কিন্তু ওকে কখনও কাঁথা বা নরমাল কম্বলও কিনতে বলতাম না। কারণ জানি, সেজন্য ওকে স্ট্রেস নিতে হবে।


ওর ইনকাম তখন মাসে ২০ হাজার টাকা। প্রতিটি টাকাই তার কষ্টের ইনকাম। তাই সে তার মতো করে খরচ করবে। আমি চাইনি, আমার জন্য তাকে ভাবতে হোক। সে অফিসে যায় ক্যাটক্যাটে ব্লু-এর উপর ফুল-দেওয়া বা বড়ো বড়ো স্ট্রাইপের কমলা শার্ট, জলপাই কালারের প্যান্ট এসব পরে। ধোয়া হয় না কতদিন, এমন সব পোশাক।


সে ফরমাল গেটআপ কী, তা বুঝত না। আমি আবার বিবিএ পড়েছি। ফরমাল ইনফরমালের উপরও পড়তে হয়েছে বিজনেস কমিউনিকেশন কোর্সে। আমি আমার ওই পুরনো জামাকাপড় পরেই খিলক্ষেতের ছোটোখাটো মার্কেটে ঘুরে ঘুরে পরলে দেখতে ফরমাল লাগবে, এমন ৫টা শার্ট, ম্যাচিং করে একাধিক হাতঘড়ি, অ্যাকটিভ ম্যান বডিস্প্রে, শ্যু, ৮-১০ জোড়া মোজা, ইস্ত্রি, বেল্ট, টাই ইত্যাদি পছন্দমতো কিনে এনেছি।


ও প্রতিদিন যা পরে আসে, পরদিন সবগুলি ধুয়ে দিই, সকালে আয়রন করে গায়ে পরিয়ে দিই। খুব ভোরে উঠে রান্না করি, রান্নাশেষে ওকে ডেকে তুলি, সে উঠে গোসল করে আসে, আমি সব খাবার রেডি করি। খাইয়ে দিই মুখে তুলে। কাপড়চোপড় পর্যন্ত পরিয়ে চুল আঁচড়ে ব্যাগটা গুছিয়ে দিয়ে কাঁধে তুলে দিই, জুতাটাও পরিয়ে দিয়ে গেইট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি যতক্ষণ দেখা যায় ততক্ষণ।


ও চলে গেলে রুমে এসে সব গুছিয়ে নিয়ে কিছু খেয়ে আমি বই নিয়ে পড়তে বসি। গোসলের সময় ওর একটা-না-একটা ড্রেস ধুয়ে দিয়ে নামাজ পড়ে খেয়েই আবার পড়তে বসি। ও ফেরার সময় আমাকে কল দেয়। তখন সব রান্না শুরু আবার।


প্রতিদিন ফেরার সময় ও আমার পছন্দের ভেলপুরি আনত। প্রতিদিনই দুইটা করে। আমি সেগুলি হাতে পেয়ে কী যে খুশি হতাম! তখন যেন পুরো পৃথিবীই আমার হাতের মুঠোয়! সেগুলি খেয়ে ও বসে বসে সিরিয়াল দেখে, মুভি দেখে ল্যাপটপে। এরপর খাওয়া-দাওয়া করে দিন শেষ।


এভাবেই যাচ্ছিল দিনগুলি।


ও বাসায় এসে কখনও ওর ফ্যামিলিতে ফোনে ৩৬, ৪০ সেকেন্ডের বেশি কথা বলে না। অথচ বাসার বাইরে গিয়ে ৪০-৪২ মিনিট করে করে কথা বলে, ওর ফোনে দেখা যায়। তো একদিন সন্ধ্যায় দুজন মিলে কিছু কিনতে বের হয়েছি, ফিরে আসার সময় ওর ছোটো দুলাভাইয়ের ফোন।


প্রথমেই জিজ্ঞেস করে, ‘বাসায়, না বাইরে?’ ও বলল, ‘বাইরে।’ এরপর ওর দুলাভাই অনেক কথা বলল। এক পর্যায়ে বলল, ‘সানজিদা শহরের মেয়ে। ও গ্রামে থাকবে না। তোর আব্বু-আম্মুকে দেখবে না। ও কাজের ক-ও বোঝে না, বুঝবেও না। সব মেয়ে সংসারের জন্য না। তোকে আবার বিয়ে করতে হবে।’


ও বলল, ‘আচ্ছা। যদি বিয়ে আব্বু-আম্মুকে দেখাশোনার জন্য করা লাগে, তবে আমি রাজি। আমি আবার বিয়ে করব।’ আমি সামনে দাঁড়িয়ে ওদের কথা শুনে থ হয়ে গেলাম!


বাসায় এসে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি বিয়ে করবে, সত্যি?’ সে বলল, ‘যদি সবাই বলে, তবে করব, তবে সেটা তো শুধু আব্বু-আম্মুর জন্যই। আমার জন্য তো তুমিই আছ। আমার আর কাউকে লাগবে না। ও বাড়িতে থাকবে, আমি এখানে তোমার সাথে থাকব।’ এই সান্ত্বনা পেয়ে হেসে বললাম, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে, বিয়ে করলে কোরো। সে সবই নিয়ে নিক, তবে তোমার ভাগ কিন্তু দেবো না।’ ও বলল, ‘না রে পাগলি। আমি শুধু তোমারই। তোমাকে ভালোবাসি তো!’


আমি শুনে খুশি হয়ে যাই, খুশিতে আমার চোখ বেয়ে জল নামে। এভাবে দিন যায়।


আমি তখন টুকটাক পরীক্ষা দিতাম, ও আমার সাথে যেত। সে যায় স্যুট-টাইয়ের সাথে বুটজুতা আর ইস্ত্রি-করা শার্ট পরে, আমি তার সাথে যাই ওই সেই একজোড়া বাসার স্যান্ডেল আর আমার বিয়ের আগের দুইটা থ্রিপিস নিয়ে গিয়েছিলাম ওর বাসায়, ওখান থেকে একটা পরে।


পরীক্ষা দিতে গেলে মনে যেন মিলনমেলা। যাদের সাথে দেখা হয় না অনেক দিন, পরীক্ষা দিতে গিয়ে তাদের অনেকের সাথেই দেখা হয়। সেদিন একদিন এক বান্ধবী আমার পায়ের দিকে আড়চোখে তাকায়। সেটা দেখেই একদিন আমি ওকে বললাম আমাকে একজোড়া বাইরে যাওয়ার মতো জুতা কিনে দিতে। বাইরে গেলে মানুষজন ওর এত ফিটফাট সাজের মাঝে আমার এই দশা দেখে ভালোভাবে নেয় না। আর তাতে ওরই মানসম্মান যাবে৷ নতুন বিয়ে করেছি, অথচ আমার পায়ে নরমাল স্যান্ডেল, আর আমি কিনা এসেছি পরীক্ষা দিতে। ওকে এসব বুঝিয়ে বলেছি। ও বলে, ‘আরে, থাক! পরে দেখা যাবে। চেনা বামনের পৈতা লাগে না।’ পরে আর আমাকে স্যান্ডেল কিনে দেয়নি।


এক সন্ধ্যায় নামাজ পড়ছি আমি। চুলায় রান্না চড়ানো। মাত্র তিন রাকাত পড়েছি। তখনই ওর ফোন। ধরলাম। ও বলল, ওই মুহূর্তে যেভাবে আছি, ওভাবেই রুমের একটা ব্যাগের পকেটে কিছু টাকা ছিল, সেটা নিয়ে বের হতে। ও নাকি একজোড়া জুতা দেখেছে এয়ারপোর্ট ফুটওভার ব্রিজের নিচে। দেরি করলে সেটা অন্য কেউ নিয়ে ফেলবে। আমাকে নামাজটাও শেষ না করে যেতে বলল। আমিও গেলাম। সে নিজের জন্য জুতা কিনল ১২০০ টাকা দিয়ে।


ফেরার পথে ১০ টাকা রিকশাভাড়ার পথ। আমি বললাম, ‘থাক, চলো এটুকু পথ দেখতে দেখতে আর গল্প করতে করতে হেঁটে যাই।’ আমরা তখন দুজন মিলে হেঁটেই আসছি। আসার পথে ফুটপাতে একজোড়া জুতা দেখে বললাম কিনে দিতে। আমি জুতাজোড়া পায়েও পরেছি। ও বলল, ‘এটা ভালো না, পরে কিনে দেবো।’ বললাম, ‘মাত্র ২০০ টাকার জুতাই তো। আচ্ছা, সমস্যা নাই।’ এটা বলে পা থেকে খুলে রেখে চলে এলাম।


একবার একটা বোরকা কিনতে চেয়েছিলাম। ব্ল্যাক আর অ্যাশ কালারের। খুব ভদ্র গোছের। কিন্তু সেটাও সে একটা কারণ দেখিয়ে রেখে দিল। আমি বোরকা আর জুতাটাই কিনতে চেয়েছিলাম, কারণ পরীক্ষা দিতে গেলে সবার সাথে দেখা হতো, আর পুরনো দুইটা থ্রিপিস প্রতিবার পরে গেলে ওরা কেমন কেমন করে তাকাত, তাতে খারাপ লাগত এটা ভেবে যে নিশ্চয়ই আমার বর সম্পর্কে তারা ভাবছে, সে কিপটা বা এরকম কিছুই ভাবছে। ওই দুইটা জিনিসে চেয়ে না পাওয়ার পর আর কখনওই কিছু চাইনি।


আমাদের টিনশেড ওই রুমটার পূর্বদিকের জানালার গা ঘেঁষে একটা পিপুল গাছ আছে। সেই জানালাটা আবার একটু ভাঙা। ওটা বন্ধ করা যেত না পুরোপুরিভাবে। ওকে অফিসের জন্য রেডি করে বিদায় দিয়ে এসে ঘর গুছিয়ে খেয়েদেয়ে আমি পড়তে বসতাম। পড়তে পড়তে প্রতিদিন সাড়ে এগারোটায় আমার মাথা ঘুরে ঘুম চলে আসত। ঘুমিয়ে যেতাম। আর প্রতিদিনই খারাপ স্বপ্ন দেখতাম। কোনও দিন দেখি, আব্বু মারা গেছে, কোনও দিন আম্মু। কোনও দিন আমাকে সাপ বা মহিষে দৌড়ানি দেয়। নয়তোবা বোবায় ধরে।


প্রতিদিন এরকম হতো। তাই ভয়ে আমি দরজা খোলা রেখে ঘুমাতাম। অবশ্য তার জন্য আমাকে পাশের বাসার ভাবিরা ভালো-মন্দ অনেক কিছু বলেছে। আমার রুমের সামনেই ওয়াশরুম। সেটা দুইটা পরিবারের। উপর থেকে পানি পড়ত ওয়াশরুমে আর থাকার ঘরেও। তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না। আমার সব দিনই মনে হতো, ভালোবাসা থাকলে আকাশ ছোঁয়া যায়। এসব ছোটোখাটো ব্যাপার কিছুই না।


আমি ওকে নিয়ে স্বপ্নের জাল বুনতাম। একদিন আমাদের সব হবে। মাথার উপর ইট-রডের ছাদ হবে, গাড়ি হবে, নতুন প্রজন্মের জন্ম হবে, সন্তানের নামও রাখা শেষ, মেয়ে হলে নাম হবে সানি (রৌদ্রোজ্জ্বল), কিন্তু নামটা ওর এক্স-গার্লফ্রেন্ড সোনিয়ার সাথে মিলে যায় দেখে পরে বাদ দিই। এরপর নাম রাখি সাবিহা নিহাল। সানজিদার সা, আর নিহাল’টা সরাসরি। আর ছেলে হলে নাম হবে আলিফ।


ও সন্ধ্যায় বাসায় এসে ঘুমানোর সময় আমাকে ওই গাছের কথা বলে গল্প বানিয়ে বানিয়ে ভয় দেখাত। আর আমিও জড়োমড়ো হয়ে ওর গায়ে গা ঘেঁষে ঘুমাতাম। আমার এমনিতেই মনে মনে জিন-পরীর ভয় সব সময়ই লাগে। ওর বুকের মধ্যে ঘুমানোর সময় আমার কাছে মনে হতো, এটাই স্বর্গ!


ওই সময়টায় সব শুক্রবারেই কোনও-না-কোনও পরীক্ষা থাকত। কোনও কোনও দিন ওভারল্যাপও হতো। যেমন সাধারণ-বিমার অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার আর সিজিডিএফ-এর অডিটরের পরীক্ষা একই দিনে একই সময়ে পড়েছিল। জুলাই মাসের ১২ তারিখ ছিল সেটা। কোনওভাবে যদি কোনও শুক্রবারে পরীক্ষা না থাকত, তবে আমাকে তার হাত ধরে সন্ধ্যার শহরের কৃত্রিম লাল-নীল লাইটের আলোয় হাঁটতে দিতে বায়না ধরতাম। ভ্যান, রিকশা, বাস, সিএনজি কিচ্ছু না, হেঁটেই যেতাম সব জায়গায়। সব সময় ওর টাকা বাঁচানোর চেষ্টা করতাম। আর নিজেও টিউশনি খুঁজতাম যেন ওকে কিছুটা সাপোর্ট দিতে পারি।


পরীক্ষার সময় ভোর ৪টায় উঠে রান্নাবান্না করে দুজনের জন্য বক্সে খাবার নিয়ে এরপর অল্পস্বল্প পড়াশোনা করে ওর সব কাজ করে দিয়ে, এমনকি জুতাটাও মুছে দিয়ে ওকে কাপড় পরিয়ে ওর চুল আঁচড়ে দিয়ে বের হতাম। আমি ঢাকা শহরের রাস্তা আলাদা করতে পারা দূরে থাক, মানুষগুলিও যেন একই রকম দেখি। বের হয়ে ওর হাত ধরে হাঁটতাম। পরীক্ষা দেওয়ার আগে মুখে তুলে খাইয়ে দিতাম ওকে। এরপর পরীক্ষা দিতাম। কিংবা পরীক্ষা দিয়ে কখনও কখনও খাইয়ে দিতাম। এভাবে যায় দিন।


আমি ১৪ জুন ঢাকাতে যাই, আর ১৯ জুন আমার কমবাইন্ড ৪ ব্যাংকের জেনারেল অফিসারের রিটেন পরীক্ষা ছিল। তখনও আমার গায়ে ব্যথা। আর সারাপিঠে ওর বোনের মারের নীল নীল দাগ। আমার বসতেও কষ্ট হতো। ওভাবে পরীক্ষা দিতে গিয়ে আমি ভালো করতে পারিনি। রিটেনে বাদ পড়ে যাই।


ডিভোর্সের আগে আমি প্রায় ৮-৯টা পরীক্ষা দিই। একটাতেও ফেইল করিনি। ডিভোর্সের পর এসে, যেগুলির প্রিলিতে পাস করেছি ডিভোর্সের আগে, সেগুলির রিটেন আর নতুন দেওয়া পরীক্ষাগুলিতে গড়পড়তায় একচেটিয়া ফেইল করি। ২৫শে জুন আমার প্রাইমারিতে পরীক্ষা ছিল। আমাকে পরীক্ষা দিতে দেবে না ওরা কেউই। পরীক্ষা-সেন্টার আবার খুলনা দেওয়া ছিল। আর আমি তখন ঢাকাতে।


আমি অনেক হাতে পায়ে ধরলাম ওর, অনেক রিকোয়েস্ট করলাম, কিন্তু ওর ফ্যামিলির কথা ছিল, নিহালকে খুলনা আসতে দেবে না। তাই সেও আসবে না। পরে আমি আমার বাসা থেকে সবাইকে দিয়ে ফোন করালাম। এরপর রাজি হলো। কিন্তু খুবই নেগেটিভলি। আমি সব গুছিয়ে নিয়ে ঢাকা রিজেনসির উলটো দিকে দাঁড়িয়ে রইলাম। এরপর সে ওখানে এলে দুজন একসাথে বাসে উঠলাম। মজার ব্যাপার হলো, তখনও আমি ঢাকার ওই বাসগুলিতে উঠতে পারতাম না। কেমন যেন দৌড় দিয়ে দিয়ে চলে বাসগুলি।


দেখলাম, আমার সাথে কথাও বলছে না সে। এভাবে রাত জেগে এলাম খুলনা। বাসায় এসে পৌঁছলাম সকাল ৭টায়। সকাল ১০টায় পরীক্ষা ছিল বোধহয়। আমি ব্যাগ রেখেই বের হলাম। সেও আমার সাথে বের হলো।


পরীক্ষা দিলাম। দিয়ে বাসায় না গিয়ে গেলাম রূপসা নদীর পাড়ে। ওখানে সুন্দর একটা জায়গা আছে। সেখানে বসে থাকলাম দুজন। পা ঝুলিয়ে গল্প করছি, আর চটপটি খাচ্ছি। আমাদের কাবিনের পরে একদিন আমাকে ও মেরেছিল আমার আব্বুর বাসাতেই। এরপর রাগ করে এখানে এসে চটপটি খেয়েছিল। সেই চটপটি আমাকেও খাওয়াল সেদিন।


এমন সময় হুট করে জনি ওর তিনটা ফ্রেন্ড নিয়ে হাজির। ওরা আমাদের দিকে বারবার তাকাচ্ছে। মানে আমার বর দেখছে ওরা। কেমন সে বর, যার জন্য আমি জনিকে রিফিউজ করেছি! জনি হলো আমার স্কুলের বন্ধু। ক্লাসমেট ছিল। ভার্সিটির অ্যাডমিশনের সময় জনি আমাদের আর-এক ফ্রেন্ডকে দিয়ে আমাকে জানায় যে, সে আমাকে পছন্দ করে, মানে ভালোবাসে। আমি তাকেও বুঝিয়ে বলেছি যে ভালোবাসা-বাসিতে আমি নাই। এখন পড়ার সময়। সামনে পরীক্ষা। আমাকে পড়তে দে, আর ওকেও পড়তে বল। আগে ক্যারিয়ার তৈরি হোক। সময় হলে আমাদের আব্বু-আম্মুদের বলে যদি তারা চায় তো বিয়ে করলেই হলো। এসব প্রেম-ভালোবাসা ভুল, মিথ্যা। এসব করা সময়ের অপচয় ছাড়া আর কিছুই না।


আরও বলেছিলাম, আমি এসবে বিশ্বাসী না। আর আমিও জনিকে পছন্দ করি, তবে স্রেফ ফ্রেন্ড হিসেবে। সে একটা ছেলে, এটাও আমি কখনও ভাবিনি। যেমন একটা মেয়েফ্রেন্ডের সাথে আমি মিশি, ওর সাথেও সেরকমই মিশেছি। তবে সে আমার জীবনসঙ্গী হবে, এভাবে ভাবলেও আমার গা গুলিয়ে আসে কেন জানি। ওর সাথে মারামারিও করেছি। তবে প্রেমিক ভেবে ওর হাত ধরব, এটা ভাবতেই আমার নিজের কাছেই নিজেকে ছোটো লাগে। কেন জানি ওকে আমি এই সম্পর্কে বাঁধতে পারবই না বোধহয়। এসব বলে দিই।


ওর পুরো নাম সাইফুল হাসান জনি। আমি ওকে সাহা বলে ডাকি। ও জাহাঙ্গীরনগরে অ্যাডমিশন টেস্ট দিতে গিয়ে আমার জন্য ঢাকা থেকে চুড়ি আর ওয়ালম্যাট নিয়ে আসে। আমি তখন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমবর্ষে ভর্তি হয়ে গেছি। মিথ্যা বলে ডেকে এনে সে ওগুলি আমাকে দেয়। আমি হুট করেই ভেবে ফেলি, ‘এসব নিলে ও ভাববে, আমি ওর প্রেমের প্রস্তাব মেনে নিয়েছি। আর আমি কেন একটা ছেলের কাছ থেকে এসব নেব?’ তাই আমি ওর গিফট নিইনি। ও অনেক রিকোয়েস্ট করেছিল তখন নিতে। কিন্তু আমার প্রচণ্ড লজ্জাবোধ হচ্ছিল। আমি না নিয়েই ফিরে আসি বাসায়। আর রাগ করে ও তখন ওই গিফটগুলি ভার্সিটির পাশের লেকে ফেলে দিয়ে চলে যায়। এরপর তিন বছর আর যোগাযোগ হয়নি ওর সাথে।


তিন বছর পর ২০১৭ সালে আমার ভাই আমার সাথে ঝগড়া করে আমাকে পিছন থেকে হুট করে যখন বিদেশি লাইটার দিয়ে আঘাত করে করে আমাকে মেরে ফেলছিল, তখন আমি তিন দিন অজ্ঞান হয়ে হসপিটালাইজড ছিলাম। সেখান থেকে বাসায় আসার পর কেন জানি জনি আমাকে নক দিয়েছিল। কেমন আছি, এটা জিজ্ঞেস করে। আমি তখন আমার হাতে ক্যানোলাসহ মাথায় ব্যান্ডেজের ছবিটা ওকে দিই।


আমার ওরকম ছবি দেখে জনির পাগল হয়ে যাওয়ার দশা! অনেক কান্না করে দিয়ে সেই দিনই আমার ২০১১ সালের এসএসসি পরীক্ষার সব ফ্রেন্ডকে নিয়ে আমাদের বাসায় আসে। তিন বছর পর সেই দিন থেকে আবার ও আমার টুকটাক খোঁজ রাখত। ওষুধ খেয়েছি কি না, পভিসেভ দিয়ে জায়গাটা পরিষ্কার করেছি কি না, ব্যস্‌ এটুকুই!


এরপর আবার সে আমাকে প্রপোজ করে, তখন আমি নিহালের সাথে রিলেশনে আছি। আমি সেটা জনিকে বলে দিই। কিন্তু সে বিশ্বাস করেনি। এরপর আমার বিয়েও হলো, জানল। কিন্তু আমার বর কখনও দেখেনি। তাই ওইদিন রূপসাতে গিয়ে আমাদের দুজনকে একদৃষ্টিতে হাঁ করে দেখছিল। নিহালকে আমি আগেও বলেছি জনির কথা। তাই নিহাল জানত সবই।


নিহাল ছিল ৫ ফিট ৪ বা ৫ ইঞ্চি। গায়ের রং কালো। আর সাহা ৫ ফিট ১০ ইঞ্চি, গায়ের রং শ্যামলা। নিহাল জনিকে দেখে আমাকে বলল, ‘চলো, আমরা চলে যাই, নইলে রিফাত শরীফ মিন্নির মতো কাহিনি হবে।’ আমি বললাম, ‘ছিঃ! ক্যাম্নে বলো এসব! আমি ওর সাথে নিজ থেকেই কথা বলি না আমার ক্লাসমেট হওয়া সত্ত্বেও। কীসের সাথে কী রিলেট করো তুমি!’


সেদিন কথা আর না বাড়িয়ে আমি ওকে নিয়ে চলে এলাম বাসায়। একদম সোজা বাসায়। ভেবেছিলাম, ক্যাম্পাসে যাব। যেখানে আমরা বান্ধবীরা একসাথে চা খাই, পুরি খাই, আর ওকে তখন টেক্সট করতাম বা ওর সাথে কথা বলতাম, সেখানে ওকে নিয়ে যাব। কিন্তু এসবের কিছুই হয়নি। সোজা বাসায় ফিরে এলাম।


ওইদিনই রাত্রে ঢাকা চলে যাবে সে। রাত ৯টার পর একসেকেন্ডও লেট করলে হবে না। আম্মু বলল, ‘এতদিন পর এলে, কয়দিন থাকো, ঘুরে যাও।’ আম্মুকে কিছু না বলে আম্মুর সামনেই আমাকে সে বলল, ‘তুমি থাকতে চাইলে থাকো, আমি থাকব না।’ কিন্তু আমি তো ওকে ছাড়া থাকব না। তাই সাথে সাথেই রেডি হয়ে চলে গেলাম ওর সাথে ঢাকায়।


আমার পরীক্ষা কাছে এলে ওর বাসা থেকে ফোন করে করে বাড়িতে ডাকত, যাতে করে আমি একা থাকতে না পারি, পড়াশোনা করতে না পারি, আর পরীক্ষাও ভালো না হয়। কিন্তু তখন ওর ছুটি থাকত না বলে ও আমার সাথে যেতে পারত না। এভাবে ঈদ চলে এল। ঈদুল আজহা। তখন ওর বড়ো আপু ফোন করে আমাকে বলল, ‘সানজিদা, তুমি তোমাদের বাড়িতে যাবে কবে? তুমি না-গেলে নিহাল বাড়িতে আসতে পারছে না। শুধু তোমার জন্যই আটকে আছে ও। তুমি খুলনা গেলে ও বাড়িতে আসতে পারে। ওর জন্য একটা হাঁস রেখেছি। ও খুব পছন্দ করে। আর ছাগল কুরবানি দেবো। ও ছাগলের গোশ(ত) খুব পছন্দ করে।’ আমি বললাম, ‘আমি তো জানি না, আপু। তবে আমি ওকে জিজ্ঞেস করে আপনাকে জানাব।’


কলটা কেটে আমি কাঁদছিলাম একা একা। ভাবছি, আমার ভাইয়ের বিয়ের পর থেকে আমাদের জীবনে ঈদ আর নাই। ভাই ভাবিকে নিয়ে ঈদের ১ সপ্তাহ আগে চলে যায়, ১৯-২০ দিন পর ফিরে। আম্মু যদি কোনও দিন জিজ্ঞেস করত, ‘কবে আসবি?’, তবে ভাই আম্মুকে প্রচুর বকাবকি করত। ভাইয়ের বিয়ের পর প্রথম ঈদে আমি আমার টাকা দিয়ে সবার জন্য ঈদের জামাকাপড় কিনেছিলাম। আব্বু-আম্মু তো সবার জন্য কিনেছিল, তবুও আমি আলাদা করে কিনেছিলাম। পোলাও-এর চাল, সেমাই, গরুর গোশ(ত) ৫ কেজি, ইত্যাদি। সেইবারও ওরা হুট করে রেডি হয়ে বের হলো যখন, তখন বুঝলাম, ওরা এখানে ঈদ করবে না, ওরা চলে যাচ্ছে। সেই থেকে আমরা আর তেমন ঈদ উদ্‌যাপন করি না। ঈদের দিন আব্বু-আম্মু আর আমি মরার মতো পড়ে থাকি।


তো তখন বসে বসে আমি ভাবছি, যদি আমি এখন আব্বুর বাড়িতে যাই, তাহলে আমার ভাবি আমাকে নিয়ে কি-না-কি ভাববে। আর নিহালদের বাড়িতেও তো আমাকে নেবে না। তাহলে আমি যাব কই?


অনেক ভেবে বের করলাম, আমি কোথাও যাব না। না শ্বশুরবাড়ি, না বাপের বাড়ি। তবে রাত্রে আমি একা থাকতে পারি না। যাত্রাবাড়িতে আমার এক বান্ধবী থাকে। সে প্রেগন্যান্ট, তাই ঈদে বাড়ি যাবে না। আমি ওখানে গিয়ে এই কয়দিন থাকব। আর ঈদের চার-পাঁচ দিন পর খুলনা যাব। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলব, ‘বর অনেক বিজি। হুট করে অফিস থেকে কল এসেছে, তাই চলে গেছে। এজন্যই আমি শ্বশুরবাড়ি থেকে এসেছি একাই।’ সেটা ওকে বললাম। তখন আবার আমার প্রতি ওর দয়া হলো। বলল, ‘না। তুমি কেন একা থাকবে? আমার সাথে যাবে আমাদের বাড়িতে।’


আমি তো মহাখুশি আমার যাওয়ার একটা জায়গা হলো ভেবে! যেই কথা সেই কাজ। অফিস ছুটি দিল। আমিও সব গোছগাছ করে রওনা দিলাম নড়াইল, ওদের বাড়ির উদ্দেশে। সেদিন সম্ভবত ৮ আগস্ট ২০১৯।


রান্না করে বক্সে ভাত নিয়ে বের হলাম দুজন। অনেক কষ্টে একটা গাড়িতে সিট পেলাম। রাস্তায় পড়তে হয়েছিল ১৬ ঘণ্টার জ্যামে। দুপুরের জন্য নেওয়া ভাত আমরা বাসে বসে খেয়ে নিই। তখন প্রায় দুইটা বাজে। প্রচণ্ড গরমে প্লাস্টিকের বক্সে ভাত নষ্ট হয়ে গেছে। খাওয়ার সময় ও আমার দিকে তাকায়, আর আমি ওর দিকে তাকাই। কেউ কাউকে কিচ্ছু বলতে পারছি না। নষ্ট হয়ে যাওয়া ভাত আঠালো হয়ে গেছে, তবু গড়গড় করে দুজনই খাচ্ছি।


আমি কিচ্ছু বলতে পারছি না এটা ভেবে যে, সে আমাকে বকা দেবে, কেন ভাত নষ্ট করলাম! আর সে কিছু বলতে পারছে না এটা ভেবে যে আমি কষ্ট করে রান্না করেছি, সে না খেলে যদি আমি রাগ করি! এভাবে চলার কিছুক্ষণ পর দুজনেই ফিক করে হেসে দিয়েছি৷ আর খেতে পারিনি। এভাবে দিন গড়িয়ে রাত এল। আমরা দুজন বাসে বসে আমার ল্যাপটপে ৩টা ভূতের মুভি দেখেছি রাতভর। সময় তবু যেন কাটেই না।


ভোর ৫টায় আমরা নড়াইলে ওদের বাড়ি গিয়ে পৌঁছলাম। হাত-মুখ ধুয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। আমরা যেদিন রওনা দিই, ওইদিনই ওর ছোটো আপু আমার যাওয়ার কথা শুনে বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়ি চলে যায়। পাশাপাশিই দুই বাড়ি। ওরা আমাকে দেখাচ্ছে যে, সে অনেক দিন পর পর এ বাড়িতে আসে। কিন্তু আমি যাওয়ার দিন বিকেলে সে ওখানে গেছে, এটা ওদের কথার ভেতর থেকে আমি জেনেছিলাম পরে।


সকালে ঘুম থেকে উঠে শাশুড়ির সাথে রান্না করতে গেলাম। রান্না ঘরে যাওয়ার শুরু থেকেই শাশুড়ি আমাকে বললেন, ‘শোনো সানজিদা, তোমাকে কিছু কথা বলব। তোমাকে শুনতে হবে।’
- আচ্ছা, জি বলেন।
- তুমি যে অন্যায় করেছ, তার কোনও মাফ হয় না। কিন্তু আমরা মাফ করতে চাইছি। তার জন্য তোমাকে নিহালের ছোটো আপু আর দুলাভাইয়ের পা ধরে মাফ চাইতে হবে। তোমার জন্য ওরা এ বাড়িতে আসে না৷ তোমাকে ওদের বাসায় গিয়ে পা ধরে মাফ চাইতে হবে। ওর অনেক দয়া। তুমি গিয়ে ওদের পা একদম শক্ত করে ধরবে, দেখবে, মাফ না করে পারবে না। যতক্ষণ মাফ না করবে, ততক্ষণ পা ছাড়বে না।
- জি আচ্ছা।
- তাহলে কীভাবে কখন যাবে, সেটা আমি ব্যবস্থা করে তোমাকে বলে দেবো।
- জি আম্মু।


দিনটা গেল ওঁর সাথে রান্নাবান্নাসহ অন্যান্য কাজে। আমি খুব ভালোবেসেই কাজ করছি। পড়াশোনায় যদি সময় না দিই তো সেই সময়টুকু যেখানে দিই, তখন আমি নিজের শতভাগই দিই। শুধু পড়তে বসলেই নিজের সবটুকু দিয়ে পড়তে পারি না। যা-ই হোক, সেদিন বেশ কাজ করলাম, তিন রকমের পিঠা, রুটি ইত্যাদি বানালাম। সবকিছুই নিখুঁত করার চেষ্টা করলাম। আর বললাম, ‘আম্মু, একদিন আপনার সব কাজ আমিই করে দেবো। ঘরে বাইরে সব সামলাব। অলরাউন্ডার হব একদিন।’ উনি কিছু বললেন না, হাসলেন শুধু।


আমাকে নিয়ে গেছে, আমাকে ওদের পা ধরাবে, তাই ওরা দুই বোন কেউই বাড়িতে এল না। অথচ ওরা সারাদিন পড়েই থাকে বাপের বাড়ি। আমি তো পুরোই গণেশ হয়ে গেছি। আমাকে অপমান করলেও বুঝি না, কিছুই গায়ে মাখি না। আম্মু বলে দিয়েছিল, ‘গিয়েছিস নিজের পছন্দে, আমাদের কোনও কথা শোনাস না কোনও দিনই। আর যা-ই হোক, বিয়ে হয়েছে। এই যে যাচ্ছিস, আর জ্যান্ত মানুষ এখানে ফিরিস না। শ্বশুরবাড়িই তোর বাড়ি।’ আর আঙ্কেল বলেছিলেন, ‘সর্বোচ্চ স্যাক্রিফাইসটা করবে, যেন বুকে হাত রেখে বলতে পার যে তোমার কোনও আফসোস নাই।’


আমিও তেমনভাবেই দিন পার করে যাচ্ছি। কষ্ট দুঃখ অপমান কিচ্ছু গায়ে লাগে না। সেলফ-রেসপেক্ট কী জিনিস ভুলে গেছি, আমার মধ্য থেকে সমস্ত পারসোনালিটি ডিলিট করে দিয়েছি। বাড়িতে লোকজন আসে, বউ খোঁজে। পায় না। সবাই বলে, ‘এ তো যেভাবে কাজকর্ম করে বেড়াচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে, এই বাড়িরই মেয়ে৷’ ‘তা ঈদে কী কিনে দিলে বউকে?’ সবাই এসব জিজ্ঞেস করে। মুখ রাখতে তখন শ্বশুর বললেন নিহালকে যেন আমাকে একটা শাড়ি কিনে এনে দেয়। উনি নিজে পারবেন না। ব্যস্ত, তাই।


নিহাল তখন আমাকে আর ওর বড়ো আপুর মেয়ে নিতুকে নিয়ে পাশে দুই কিলোমিটার দূরের বাজারে গেল। আমি তো মোটেই কিনব না। আমি জানি, নিহালের কাছে টাকা নাই। বেতন তুলে বাসাভাড়া দিয়ে গেছে। সব ভাগ ভাগ করা টাকা। বাড়িতে খরচের জন্য কিছু দিয়েছে, খুলনা গেলে দুই-তিন হাজার খরচ হবে, এরপর ঢাকা ফিরে তার বেতন না-পাওয়া পর্যন্ত চলার জন্য রেখে আর কিছুই থাকবে না। সেই টাকা থেকে শাড়ি কিনতে হবে। টাকাগুলি আমার সাইডব্যাগে রেখেছিল। সেখান থেকে পাঁচহাজার টাকা চুরি হয়ে গেল। টাকা বের করতে গিয়ে দেখি ওই অবস্থা।


(চলবে…)