প্রেমান্ধতা/পর্ব-৩

 
নিহালও বুঝেছে কাজটা কার। ওটা নিতুরই কাজ। যা-ই হোক, সে বাজারে গেল। আমি যেতে চাইনি, নতুন মানুষ বাজারে গেলে কেমন দেখায়! কিন্তু ওর জোরাজুরিতে আমাকে যেতেই হলো। শাড়ি কেনা হলো একটা। এরপর দেখি, নিতুর কেমন জানি হিংসা লাগছে। ক্লাস টেনে পড়ে ও। ওর মামার টাকায় আমার শাড়ি কেনার কারণে ওর থ্রিপিস কেনা হচ্ছে না ভেবে ওর মুখ একদমই কালো। আমি এটা বুঝতে পেরে নিহালকে বলে কয়ে নিতুর জন্য আড়াই হাজার টাকার শপিং করালাম। আমি আবার খুব চা খাই। কিন্তু এটা বলা তো যায় না ওখানে। আমি যে নতুন মানুষ।


নিহাল সেটা জানত। চা খাওয়ালো এক ঘুপচি দোকান থেকে। আবার এদিকে আমার মাত্র একটাই ব্লাউজ, যেটা আমার শাশুড়ির বেশ পুরনো একটা জলপাই রঙের ব্লাউজ। সেটাই অদল বদল করে করে পরি। আর-একটা অবশ্য আছে, কিন্তু গোল্ডেন কালারের ওটা কেমন জানি শক্তমতো কাপড়ের। আমার একজামের ডিফেন্সের সময় বানানো হয়েছিল, ওটা পরে থাকা যায় না। আর পেটিকোটও আমার একটাই। আমার প্রেজেন্টেশনেরই জন্য বানানো। বেশ পুরনো। তো বাসায় আসার পর সবাই বলল, ‘শুধু শাড়ি পরবে? ব্লাউজ পেটিকোট কই?’ সন্ধ্যায় আবার গিয়ে সে একটা ব্লাউজ বানাতে দিয়ে এল। আমাকে এসব না দিলেও আমার ওটা নিয়ে কিছুই বলার ছিল না। আমার যা আছে আর যা নেই, তা দিয়েই মানিয়ে নিতে আমি সদাপ্রস্তুত। আমি শুধু ভালোবাসাটুকুই চেয়েছিলাম সব সময়, কোনও বস্তুগত কিছুই না।


পরদিন ওর আব্বু আমাকে ডেকে বললেন, ‘আমি তোমাকে কিছু বলতে চাই, এবং সেটা অবশ্যই শুনতে হবে, করতে হবে। এর কোনও ব্যতিক্রম হবে না।’ আমি বললাম, ‘জি আব্বু।’ ওঁর ওই একই কথা। ছোটো আপু দুলাভাইয়ের বাসায় গিয়ে পা ধরে মাফ চাওয়ার ব্যাপারেই কথা বললেন উনিও।


আমি শ্বশুরকে খুব ভালোবেসে ফেলেছিলাম ওই কয়দিনেই। আব্বুর আদরের মেয়ে ছিলাম, ওঁকেও ওরকমই ভেবে ফেললাম। আমি তখন ওঁকে বললাম, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে, আব্বু। আপনি যা বলবেন, সেটাই আমি করব। কিন্তু আমার অপরাধটা যদি একটু বলতেন…’ উনি বললেন, ‘গত ঈদে তুমি গুন্ডা ভাড়া করে এনেছ, যেটা তোমার অন্যায়। এর মাফ হয় না। কিন্তু আমি মাফ করতে চাইছি।’ আমি বললাম, ‘আব্বু, ওই সময় তো আপনার ছেলে ফোন দিয়ে দিয়ে আমার বাসা থেকে লোক এনেছে। আর যারা এসেছে, ওরা কেউই আমার পর না। গুন্ডা না, আব্বু।’ কিন্তু আমার কথায় কোনও কাজ হলো না, উনি সিদ্ধান্তে অনড়।


এল-শেইপের টিনশেড ঘর ওদের। পূর্বদিকে দুইটা রুম, উত্তরদিকে একটা রুম, আর মাঝে একটা রুমে তিনটা দরজা। আমাকে মাঝের ওই রুমে আটকে রেখে ওরা পূর্বদিকের ওই মাথার রুমে গিয়ে সব মাথা একজায়গায় করে কী কী সব বুদ্ধি করত, যা দেখলেই ভয় লাগে।


দিন গেল। রাত্রে শুতে দিল পূর্বদিকের শেষের রুমটায়। প্রচুর গরমের দিন। ওই ঘরে একটা বিশাল বড়ো ফ্যান। স্টিলের। ধান ওড়ায় সেটা দিয়ে। ওটা ছাড়লে ঝড়ের মতো বাতাস হয়। ওটা ছাড়া আছে। আমি শুয়ে শুয়ে ওকে বললাম, ‘আচ্ছা, আমাকে দিয়ে তোমরা পা ধরাবে ঠিক আছে। আমিও ধরব যেহেতু সবাই মিলে বলছ। কিন্তু তুমি তো জানোই…আমার বাসার লোকজনকে ফোন করে করে তুমিই এনেছ। এনে তাদের গুন্ডা আখ্যা দিলে। আমি এখনও আমার বাসায় একটা বার বলিনি যে তোমরা কেউ আমাকে মেরেছ। ধামাচাপা দিয়ে দিয়েছি পুরো ঘটনা। তাহলে আমার কী দোষ যে পা ধরতে হবে, বলো? তা-ও বড়ো ননদ নন্দাইয়ের না, শ্বশুর শাশুড়ির না, ছোটো ননদ নন্দাইয়ের বাড়িতে গিয়ে প্রথমবার! আমার সত্যিই কষ্ট লাগছে না, পা ধরলে আমার গা পচেও যাবে না। যা যেভাবে বলবে, আমি করব সেভাবেই। কিন্তু অকারণে পা ধরালে পরে ওই মানুষগুলির প্রতি আমার ভক্তির লেভেলটা কোথায় যাবে একবার ভেবেছ?’


আমার এই কথা শোনামাত্রই সে উলটাপালটা বকাবকি শুরু করল, অযথা ইলজিক্যাল গোছের কথা বলতে লাগল। আমরা দুজন ফ্যান ছেড়ে কথা বলছি। পাশের রুম থেকে নিতু আমাদের কথাগুলি কিছুটা শুনে না শুনে কী জানি আঁচ করে শোয়া থেকে উঠে ওর নানা-নানিকে ডেকে আনল। ওরা হুড়মুড় করে ঘরের দরজায় এসে শোরগোল শুরু করে দিল। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। দরজা খুললাম। সবাই ঘরে ঢুকে আমাকে ইচ্ছামতো গালিগালাজ করতে লাগল। আমি বুঝলাম, ওরা জাস্ট একটা সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। পেয়ে গেল!


এক পর্যায়ে আমি বুঝতেই পারছি না কী করব বা বলব। ওরা চেঁচামেচি করে আশেপাশের সব লোক জড়োও করে ফেলেছে। আমি এবার সব থামাতে হাতজোড় করে কাঁদছি আর বলছি, আমি জানি না কী বলব কী করব, আমাকে মাফ করে দেন আপনারা। আমার ভুল হয়েছে। আর ওরা শুধু চেঁচামেচিই করছিল না, সাথে আমাকে মারতেও আসছিল। ওদের মধ্যেই দুই-একজন বাকিদের আমার দিকে তেড়ে আসার সময় জোর করে থামাচ্ছিল।


অনেক কষ্টে সবাই থামল, চলে গেল। তবে শর্ত দিয়ে গেল....দরজা খুলে ঘুমাতে হবে। দরজা লাগানো যাবে না। থাকল দরজা খোলা। আমরা ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। ঝগড়াঝাঁটি যা-ই হোক, আমি ভালোবাসি তাকে, এটাই আমার শেষকথা। ঘুমানোর সময় ঠিকই তার বুকের ভেতর বাহুর উপর মাথা দিয়ে ঘুমিয়েছি। আমি সব সময় বলতাম, ‘এভাবে হাতের উপর ঘুমাতাম ছোটোবেলায়, আম্মুর হাতের উপর। আর এখন তোমার হাতে।’


রাতটা পোহাল। সকালে উঠে নিহাল তার আব্বুকে বলল, ‘আব্বু, পায়ে ধরালে ব্যাপারটা জটিল হয়ে যাবে। তাই পা ধরাটা বাদ দিই নাহয়।’ কিন্তু ইতোমধ্যেই ওর ছোটো আপু জানে যে আমি পা ধরতে যাচ্ছি ওদের বাড়িতে। এর ভেতর নিহালের আব্বুও জানালেন, ‘হ্যাঁ, ব্যাপারটা জটিল হচ্ছে।’ আর ওদিকে বাড়িতে নানান মানুষ আসছে গতরাতের ঘটনা জানতে, ওদের সবাইকে নিহালের আম্মু অদ্ভুত সব বানোয়াট কথা বলেই যাচ্ছেন। আমি নাকি ডিভোর্স চাইছি, আগে গুন্ডা এনেছিলাম, এবার ডাকাত আনব ইত্যাদি হাবিজাবি কথাবার্তা।


নিহাল ওদের ফোন করে বলল, ‘আমরা আসছি। এসে মাফ চাইব শুধু।’ এটা শুনেই ওর আপু চিৎকার করে ফোনে বলল, ‘ওসব বেশ্যা-টেশ্যা যেন আমার বাড়িতে পা না রাখে। খবরদার। তুই এলে আসিস, নাইলে নাই।’ এই কথার পর আবার নিহালের বিবেকে একটু বাধল। সে তার আম্মুকে বলল যে সেও যাবে না, কারণ সে নিজহাতে একটা মেয়েকে বাড়িতে এনেছে। তাকে যখন ওরা যেতে দেবে না, তাকে এভাবে গালি দিয়ে কথা বলল, তখন সেও যাবে না।


এটা ওর আব্বু শুনে হুংকার দিয়ে বললেন, ‘কী বললি তুই! তুই যাবি না? তোর বাপ যাবে। কোথাকার কোন মেয়ে, সে যাক না যাক, তোর কী তাতে? তোকে তোর বোনের জন্যই তাদের বাসায় যেতে হবে!’


ভয় পেয়ে সেদিন বিকেলেই যেতে রাজি হয়ে গেল নিহাল। কিন্তু বাইরে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছিল, আর যাওয়া হলো না ওইদিন। কথা হলো, পরদিন সকালেই যাবে।


পরদিন গেল। একা একা গিয়ে ঘুরে এল। এরপর ছোটো আপু আর দুলাভাই চলে এল তাদের একমাত্র ছেলেকে নিয়ে। বাড়িতে বাইরের কেউ বা নতুন কেউ এলে তখন সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে শাশুড়ি আমাকে বলেন, ‘সানজিদা, গোসল করে নাও, কলে পানি চেপে দিচ্ছি, আসো।’ যথারীতি এটা বলে ঘরের ভেতর মানুষজন নিয়ে যা-তা বলে যাচ্ছেন। ওঁর আবার কানে সমস্যা। কম শুনেন। তাই উনি আস্তে বলছেন ভেবে জোরে বলছেন। সেসব কথা নিহালও শুনতে পাচ্ছে, আমিও। আমি নিহালের মুখের দিকে তাকাই, নিহাল ব্যাপারটা বুঝে উপরে চালের দিকে তাকায়। সে লুকাতে চায় কিছু একটা।


ওদিকে ঈদের আগের দিন একটা ঘটনা ঘটল। সকাল থেকে নিহাল বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি ঘরে গেলে সে বাইরে, আমি বাইরে গেলে সে ঘরে, এমন অবস্থা। আর আমি সারা দিন কাজ করেই কাটিয়েছি। বিকেলে সে তার পাশের ভাই-বন্ধু নিয়ে বাজারে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর আশেপাশের বাচ্চাকাচ্চা পোলাপান এসেছে নতুন বউয়ের কাছ থেকে হাতে আলপনা আঁকতে। আমি এঁকেও দিয়েছি কয়েক জনের। একজন আমাকে আন্টি ডেকেছে। সবাই ভাবি মামি কাকি ডাকছিল। এর ভেতর ওই আন্টি ডাকটা শুনে আমার পিলে চমকে উঠল।


আমার ভাইয়ের মেয়েটা আমার কলিজা। আমার ওর কথা মনে পড়ে গেছে। আমার মাথা যেন আর কাজ করছে না। ভাইজিটা আমাকে বারবার ফোন করে বলছিল কয়দিন ধরে...‘ফুপি, তুমি কবে আসবে? ফুপা কেন আমার সাথে কথা বলে না? ফুপাকে নিয়ে আসবে। গরুর গোশ(ত) রাখব তোমাদের জন্য, আর বাগদা চিংড়ি।’


আমার ওসব মনে পড়ছে, আর খুব অসহায় লাগছে। খুব প্রাণ পুড়ছে। কিন্তু বাপের বাড়ি দিনে বারবার ফোন দিলে ওরা খুব মাইন্ড করত। তাই ওই সময়ে কল দিতে পারিনি। তাই আমি নিহালকে কল দিই কয়েকবার। মেসেজ পাঠাই, ‘সামিনার জন্য প্রাণ পুড়ছে। তুমি একটু বাসায় আসো না! কেমন যেন মনে হচ্ছে, আমার কেউ নাই। সবাই অপরিচিত। তুমি প্লিজ বাসায় আসো না!’


সে একটা মেসেজ দিয়ে বলল যে আট মিনিটের ভেতর আসবে। পনেরো-বিশ মিনিট পর আবার আমি কল দিই। সে ফোন না ধরে বরং কেটে দিয়ে মোবাইলটা অফ করে রাখে। আর আমারও পাগলমনটা তখন একেবারে ভেতর থেকে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে। আমি তখন নিতুকে বললাম, ‘আম্মু, তুমি একটু আলপনা আঁকো না! আমার মাথা ঘুরছে। আমি আসছি।’ এই বলে আমি আমাদের রুমে যাচ্ছি, আর তখুনিই নিতু সাথে সাথে বলে উঠল…‘কীহ্‌? এতটুকুতে রগ চটে গেছে?’


কথাটা আমি সত্যিই ভাবিনি যে ও বলবে। আমি হেসে দিয়ে বললাম, ‘ওরে না পাগলি! আমার কেমন যেন লাগছে। আমি আসছি এক্ষুনি।’ বলে রুমে এসে শুয়ে আছি। আমার খুব প্রাণ পুড়ছে তখন।


নিতু ওই ছেলে-মেয়েদের উঁকি মেরে দেখতে বলেছে আমি রাগ করেছি কি না। ওরা সবাই এসে এসে উঁকিঝুঁকি মারছে। আমি উঠে বসে মুখে হাসি দিয়ে বললাম, ‘ভেতরে এসে বসো তোমরা।’ কিন্তু আমার কথায় কেউ কান দিচ্ছে না। প্রায় তিন ঘণ্টা পর নিহাল বাসায় এল। সবাইকে রাত্রের খাবার খেতে দিলাম। খাওয়া শেষে সবাই শুয়েও পড়ল। তখন আমি নিহালকে আস্তে করে কানে কানে বললাম, ‘চলো না, একটু বাইরে বের হই। প্রাণটা খুব ভারি লাগছে। একটু নিরিবিলিতে কথা বলি?’ ও বলল, ‘আচ্ছা, চলো।’


এরপর আমরা আস্তে করে দুজন বের হই। ঘরের বাইরে গিয়ে ঘাসের উপর বসে আমরা কথা বলছি। আমি একটু অভিমান করে দাবি আর অধিকারের জায়গা থেকেই বললাম, ‘কেন এর দেরি করলে! জানো, আমার বাসার জন্য কত্ত প্রাণ পুড়ছিল! কাল ঈদ। আমার জীবনে এটাই প্রথম আব্বু-আম্মুকে ছাড়া ঈদ। তবে তুমি তো আছই! তুমি পাশে থাকলে আমার আর কিছুই লাগে না। তাই তোমাকে বারবার কল দিচ্ছিলাম। এই তোমার ৮ মিনিট!’ দেখি, সে খুব কড়া মেজাজে আছে, আর আমার সেই নিহাল হিসেবে কথা বলছে না। তাই ওকে বললাম, ‘চলো, রুমে যাই।’


ওর সাথে মন খুলে কথা বলতে পারলাম না। আমার অন্তরটা ভারি হয়ে পড়ে আছে। পরদিন সকালে ঈদ। আমি ঢাকা থেকে আসার সময় বলেছিলাম, ‘দেখো, আমি সব ফেলে খুলনা থেকে নড়াইল এসেছি শুধু তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে। আগের ঈদে কতই-না সিনক্রিয়েট হলো। হয়তো সবাই রেগে আছে আমার উপর। প্লিজ, তুমি একটু বাড়িতে এপাশে ওপাশে থাকবে, তাহলে সারাদিন কাজ করেও আমি ক্লান্ত হব না।’ ও বলেছিল, ‘আচ্ছা, থাকব।’


ভোর পাঁচটায় উঠে ঘর বারান্দা উঠান ঝাড়ু দিয়ে আগের দিনের তিনবেলার সব থালাবাসন নিয়ে কলপাড়ে যাই। আর শাশুড়ি যায় বাইরের উঠান ঝাড়ু দিয়ে গরুর আর কবুতরের খাবার দিতে। থালাবাসন মেজে শাশুড়ির সাথে তরিতরকারি কাটাকাটি করে রান্না চড়িয়ে দিয়ে এরপর হাত-মুখ মাজি আমি। সেটাই করলাম। এরপর নিহাল আর নিহালের আব্বু গোসল করে নামাজে যাবে, তার আগে সেমাই খাওয়ালাম রান্না করে। ওই দিন অনেক কাজ থাকে।


নামাজে যাওয়ার সময় নিহাল বাচ্চাকাচ্চাদের টাকা দেওয়ার পর গোপনে আমাকে ডেকে দরজার কোনায় দাঁড়িয়ে আমার হাতে ৫০০ টাকার একটা নোট গুঁজে দিয়েছিল। আমি জানি, ওর টাকা শর্ট, তাই নিতে চাইনি। না নিলে পাছে কষ্ট পাবে, তাই নিয়ে আবার ওর মানিব্যাগে ঢুকিয়ে দিই পরে। নামাজ পড়ে একটু ঘোরাঘুরি করে পরে এল। এরপর ছাগল কুরবানি দিতে গেল। ঈদের জন্য দা কাঁচি ছুরিতে ধার দেওয়ার কাজটাও আমিই করেছি। ছাগলের জন্য মালা বানানো ইত্যাদি কাজসহ মাচার জন্য বাঁশটাও আমাকে দিয়ে কাটিয়েছে ওরা। অনেকেই বলেছিল, ‘তোমরা নতুন মানুষ দিয়ে এসব করাচ্ছ!’ কিন্তু আমার ভালো লেগেছিল এই ভেবে যে শিখে তো নিতে হবে আমাকে!


ঈদের দিনও সারা দিন একটা পুরনো ড্রেস পরে একবার নিহালের আব্বুর সাথে দা বটি ছুরি কাঁচিতে ধার দেওয়া, আর-একবার নিহালের সাথে গোশ(ত) আর হাড্ডি কাটা। এরপর নিহালের আম্মুর সাথে গোশ(ত) কাটাকাটি, ভুঁড়ি পরিষ্কার করে রান্না শুরু করা, এসব করেছি একটার পর একটা। কোনও বিশ্রাম ছাড়াই। সারা দিনে কেউ একবারও আমাকে বলল না, ‘গোসল করে নতুন শাড়ি পরো।’ আমিও কাজের পর কাজ করলাম সারা দিন। ভাবলাম, নিশ্চয়ই আজ সবার মন পাব!


মানুষ আসে গোশ(ত) খুঁজতে। তারা বাড়িতে এসে বউ খুঁজে পায় না। বাসার কাজের লোকের মতোই কাজ করে যাচ্ছি তো যাচ্ছিই। বিকেলে এক মহিলা এলেন। সরকারি হাইস্কুলের শিক্ষিকা। উনি খুবই গর্জিয়াস সাজে এসেছিলেন। আমাকে ডেকে পাশে বসিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আমি কী করছি, কোথা থেকে পড়েছি, কী করতে চাই, বাড়িঘর কোথায়, এসব। সব শুনে অনেক প্রশংসা করলেন। ওদের বাড়িতে বসে ওই একজন মানুষই শিক্ষিত পেয়েছিলাম আমি। অনেক দোয়া করলেন উনি আমাকে। বললেন, ‘সময় তো কেবল শুরু। বিসিএস-এর জন্য ভালো করে শুরু করো।’ আর আমার কাজের, কাজের ইচ্ছার আর সিমপ্লিসিটির খুব প্রশংসা করলেন।


যাক, সবকিছু মিলে ঠিকঠাক গেল দিনটা। আমি অনেক খুশি। আমিও ভুলে গেলাম আমার ভাইজি, আম্মু-আব্বুকে। ভাবলাম, আজ নিশ্চয়ই সবাই আমার সারাদিনের মেহনতের জন্য হলেও আমাকে ভালো বলবে, আমাকে একটু হলেও পজিটিভলি নেবে ওরা।


বিকেলে নিহালের ছোটো আপুর বাসার ফ্রিজে গোশ(ত) রাখতে গেলেন আমার শ্বশুর। গেলেন তো ভালোভাবেই। বাসায় এসেই ওঁর মুড-টুড সব চেইঞ্জড! উনি বাসায় এসেই আমাকে ডাকলেন...ডেকে বললেন, ‘সানজিদা, আজ তোমাকে কিছু কথা বলব। এবং, সেটা অবশ্যই তোমাকে করতে হবে। এর উপর কোনও কথা চলবে না। কথা বলেও কোনও লাভ হবে না, জেনে রেখো।’ আমি মাথা নিচু করে বললাম, ‘বলেন, আব্বু।’


উনি আমাকে এবার বললেন, ‘দেখো, কাল সকালের ভেতর তোমার আব্বু-আম্মুকে আমাদের বাসায় আসতে হবে। আসতে হবে মানে হবেই। নইলে তোমাদের খুলনা যাওয়া হবে না। তাঁরা এলে তোমাকে নিয়ে যেতে পারবেন। অন্যথায়, নিহাল তো যাবেই না, আর তুমিও কখনওই খুলনা যেতে পারবে না। ওঁরা যতদিন না আসবেন, ততদিন তুমি এখানেই রয়ে যাবে। পরীক্ষা-টরীক্ষা আমি বুঝি না। আর নিহাল ঢাকায় চলে যাবে, কারণ ওর চাকরি আছে।’


ওঁর কথা শুনে আমি পড়ে গেলাম মহামুসিবতে! কারণ ঢাকা থেকে আসার আগে আমার আম্মু ফোন করে নিহালের কাছে জিজ্ঞেস করেছেন, ‘তোমাদের নিতে কে এলে ভালো হবে? আমি, না কি সানজিদার আব্বু, না কি ওর ভাই?’ নিহাল বলেছিল, ‘এত নতুন বেলায় আপনাদের আসার দরকার নেই। আর আমার ছুটি কম। নিতে আসা-যাওয়ার সময় হবে না। তার চেয়ে ভাই-ভাবিকে ঈদ কাটিয়ে আসতে বলেন। এদিক থেকে আমরা দুজনও ঈদের চার দিন পর খুলনা আসব। সানজিদাকে এক সপ্তাহের জন্য রেখে আমি ঢাকা ফিরব। এক সপ্তাহ পর সানজিদা একা আসবে বা আমি গিয়ে নিয়ে আসব ঢাকাতে।’


সেই কথামতো ভাই-ভাবি গেছে ভাইয়ের শ্বশুরবাড়ি। আর আব্বু-আম্মু দুজন মাত্র বাসায়। ভাই-ভাবি তো আসতে পারবে না, তারা অলরেডি ওখানে। আর আব্বু হলো মারাত্মক অসুস্থ। ২০১৭ সালের জুনে আব্বু মোটরগাড়িতে অ্যাক্সিডেন্ট করে ফিজিক্যালি ও মেনটালি অনেক অসুস্থ। কোত্থাও যায় না। ওয়াশরুমে পর্যন্ত আব্বুর সাথে একজনকে যেতে হয়। এই অবস্থায় আমি কাকে ডাকি!


আমি ঘুমানোর সময় আবার ওকে বললাম, ‘প্লিজ। একটু বাইরে চলো না। কথা বলব তোমার সাথে।’ বাইরে যেতে চাওয়ার কারণ হলো ঘরে কথা বলার কারণে আগের দিন অনেক কিছু হয়েছিল। রাত্রে বাইরে অন্ধকারে বসে দুজন কথা বললে কেউ শুনবে না। বাইরে গিয়ে আমি ওকে ওই কথাগুলিই বললাম। ‘দেখো, আব্বু যেটা বলল, সেটা তো করতে হবে, কিন্তু কীভাবে কী করব, তুমি আমাকে একটু হেল্প করো। ওঁরা না জানলেও তুমি তো সবই জানো।’


দেখলাম, সে আরও রেগে উঠল। ‘কীহ্‌! কেউ আসবে না? কেন আসবে না? আমি কখন বলেছি যে ওদের কারও আসা লাগবে না? এই ব্যাপারে আব্বুর কথার বাইরে কিছুই হবে না!’ ইত্যাদি ইত্যাদি বলতে লাগল রেগে রেগে। সে ছিল প্রচুর মিষ্টি কথা আর প্যাঁচের লোক, যা কারও ধারণারও বাইরে! যেদিক থেকে ঝড়টা আসে, সেদিকেই ছাতা ধরতে জানে নিহাল। প্রয়োজনে এর জন্য যতবার নিজের জবান ও চেহারা বদলে ফেলতে হয়, ততবারই বদলে ফেলে অনায়াসেই। এদিকে সে আমাকে অনেক প্যাঁচানো প্যাঁচানো কথা বলতে শুরু করেছে…তোমার জন্য অনেক করেছি, অনেক লস করেছি, অনেক সহ্য করেছি…আর কত? ইত্যাদি ধরনের কথাবার্তা।


এবার আমিও কথার পিঠে বলে ফেললাম, ‘স্যাক্রিফাইস তো আমিও করেছি। আমিও তো নিজের বিয়েতে ভাবির ঈদের শাড়ি পরে চলে এসেছি। তোমার কথায় আমি একাই এসেছি, কাউকে নিয়ে আসিনি। তিন দিন পর তোমরা ভাই-বোন মিলে আমাকে মারলে, তবুও কাউকেই বলিনি। আমার বাসা থেকে লোক ডেকে এনে তাদের তোমরা গুন্ডা বলেছ। আমি তা-ও কিছু মনে করিনি। একটার পর একটা এত বড়ো বড়ো শর্ত দিলে আমি পারব কীভাবে, বলো?’


দক্ষিণদিকে মুখ করে আমরা এসব কথা বলছিলাম। সে আমাকে পুকুরপাড়ে নিয়ে গেছে। আমি ওদের বাসায় যে দুইবার গিয়েছি, দুইবারই রাতে ওখানেই নিয়ে গেছে সে। তাই আমি ঘর আর বারান্দার বাইরে আর কিচ্ছু চিনি না। পুকুরপাড়ের পাশে ভাগাড় আছে, তা-ও আমি জানতাম না। দক্ষিণদিকের বাতাস আমাদের মুখের কথা ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে বাসার দিকে, আমি সেটা খেয়াল করিনি। এক ভাই, যিনি আমাদের রিলেশনের কথা আগে থেকেই জানতেন, গোপনে বিয়ের বুদ্ধি তিনিই দিয়েছিলেন, সেই ভাই অন্ধকারে আমাদের পিছেই বসে বাতাস খাচ্ছিলেন, তা-ও জানতাম না।


উনি হঠাৎ সামনে এসে বললেন, ‘সানজিদা, আমি তোমার অমুক ভাই, চিনেছ? ফোনে আমার সাথে কথা বলেছিলে।’ আমি তখন লজ্জায় পড়ে গেলাম। আমি কোনও উত্তর দিতে পারছিলাম না। সে ভাইয়ার সাথে এই ঝগড়ামুহূর্তে কথা হবে ভাবিনি। তাই কিচ্ছু না বলে চুপচাপ নিহালকে নিয়ে আর-একটু দূরে চলে এলাম।


কাঁদছি আমি তখন। নিহাল আমাকে প্রচুর প্যাঁচানো আর মেনটাল স্ট্রেস দেওয়ার মতো কথা বলেই যাচ্ছে, যেন সে সব স্যাক্রিফাইস একাই করেছে, আমি কিচ্ছু করিনি। তার জীবনে আমার জন্য অনেক লস হয়েছে। আমি হচ্ছি তার জন্য একটা পুরাই লস-প্রজেক্ট। এসব কথাবার্তা। আমি সহ্য করতে না পেরে কাঁদছি আর ভাবছি, ‘আমি কার জন্য কী করলাম! হে আল্লাহ! আমার এ কী হলো!’ আমি খুব কষ্টের মাথায় একবার বলে ফেলেছি, ‘আমি কি এই গাছে এখন ঝুলে পড়ব! ঝুলে পড়ব বলছি কিন্তু!’ এই কথাটা ওরা ওদের ওদের অস্ত্র হিসেবে কাজে লাগাল।


ও তখন হুট করে চিৎকার করে বলল যে আমি নাকি তাকে বাইরে ডেকে নিয়ে সুইসাইড করে ওদের সবাইকে ফাঁসাতে চাইছি। লোকজন জড়ো হলো। তিন-চার জন মহিলা। ওরা একদম পাশের ঘরেরই। আমরা রুমে চলে এলাম। রুমে এসে ওর আব্বু আমাকে মারতে এলেন। আমি সামনে যাকে পাচ্ছি, তারই পা ধরছি। সবাই চেঁচামেচি বকাবকি করছে। কেউ কেউ বলছে, একটা মাত্র শ্বশুর-শাশুড়ি, তুই কেন তাদের দেখবি না?...একি মহিলা! এ কেমন বউ! কেউ বলছে, দেখে তো ভালো ভেবেছিলাম! কেউ বলে, এই বউ পাগল! কেউ বলে, এ-ই শিক্ষার হাল! তুই ডিভোর্স চাস? মরতে চাস? মরতে চাস, না ফাঁসাতে চাস? ইত্যাকার নানা কথাবার্তা।


ওদের কেউই একটা বারও আমার পক্ষে কোনও কথা বলছে না বা নিরপেক্ষ হয়ে কথাও বলছে না। এই পৃথিবীতে যে একা, সে পুরোপুরিই একা। সে অসহায়, সে আপাদমস্তকই অসহায়। আমার মনে আছে, ওইদিন আমি নিহালের পায়ের উপর চুমু খেয়ে আমার প্রাণভিক্ষা চেয়েছিলাম। ওরা বলছিল, তোকে ভাগাড়ে ফেলতে একমিনিট টাইমও আমাদের লাগে না। এটা লক্ষ্মীপাশা, মনে রাখিস! তোর কাকা না আর্মির কমান্ডার? ডাক তো আজ তাকে! বস্তাবন্দি করে দেবো আজ তোর চৌদ্দগুষ্টিকে!


আমি বুঝলাম, এত দিন আশেপাশের সবাই আমাকে ভালো বলছিল, তাই ওরা সুযোগ পাচ্ছিল না। ওইদিন মিথ্যা বলে জিতে গিয়ে সবাইকে ওদের পক্ষে পেয়ে এভাবে আমার মতো এক অসহায় মানুষকে নিয়ে সবাই এত লাফালাফি করছে। ওইদিন দুনিয়ার অশ্রাব্য ভাষায় যা গালিগালাজ শুনলাম, তেমন কিছু আমি আমার সারাজীবনেও কখনও শুনিনি। এভাবে রাত বাড়ল, অনেক রাত পর্যন্ত এমন চলল।


পরের দিন ভোরে উঠে আমার লজ্জায় মনে হচ্ছিল, এইখানে একটা গর্ত থাকলে আমি সেখানে লুকিয়ে থাকতে পারতাম। কাউকে মুখ দেখাতে ভীষণ লজ্জা লাগছে। ওদিকে মানুষ আসছে দলে দলে। বউ দেখতে। আমার তখন কুত্তার থেকেও অসহায় অবস্থা। এরকমই ছিলাম সেদিন, উদ্‌ভ্রান্ত পাগলের মতো। যতদূর চোখ যায়, কোনও চেনা-মানুষ নাই, যার হাত ধরে বাড়ি ছাড়লাম, সেও আমাকে চেনে না। সকালে উঠেই নিহাল আমাকে দরজা বন্ধ করে একদফা পিটিয়েছে। আমি দাঁতে দাঁত চেপে ওর সব মার সহ্য করে চুপ করে ছিলাম, একটুও চেঁচাইনি। আমাকে ঘুসি মারতে গিয়ে ওর ডানহাতে একটুখানি ছিলে গেছে, আমি সেখানে ডেটল লাগিয়ে দিয়েছি তুলা দিয়ে। এদিকে আমার নিজের নাক দিয়ে রক্ত ঝরছে, সেদিকে আমার খেয়ালই নেই। চোখ, গাল, মুখ, ঠোঁটসহ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ফুলে উঠেছে, জ্বরও আসছে বোধহয়।


আমি একটা পুরনো জামা পরে এই ঈদের সময় আমার শ্বশুরবাড়িতে বসে আছি। তখন আমাকে মানুষ যতটা না বউ হিসেবে দেখেছে, তার তিনগুণ যেন চিড়িয়াখানার বিরল কোনও জন্তু হিসেবে দেখছে। আর আমিও প্রভুহীন কুকুরের মতো হাঁ করে এর ওর মুখের দিকে তাকিয়ে একটু সহানুভূতি, একটু মায়া আর ভালোবাসা খুঁজেছি।


ওর আব্বু আমার আম্মুকে ফোন করেন। ফোনে আমার আম্মুর সাথে ঝাড়ি মেরে মেরে কথা বলে তাদের নড়াইলে এসে আমার ব্যাপারটা সেটল করে আমাকে নিয়ে যেতে বলেন। আম্মু অনেক অনুনয় বিনয় করে সব বুঝিয়ে বললেও কাজ হচ্ছিল না। উনি আরও হুংকার দিয়ে দিয়ে কথা বলছিলেন। আমার জন্য আমার আম্মুকে যাচ্ছেতাই ব্যবহার সহ্য করতে হচ্ছে।


এত কিছু হচ্ছে, তবুও একসেকেন্ডের জন্যও নিহালের উপর আমার রাগ আসছে না। আমার মনে হচ্ছে, এই লোকটাই আমার একমাত্র আপন। এক পর্যায়ে আমি নিহালের পায়ের পাতায় চুমু খেয়ে খেয়ে ওকে বোঝাই যে আমি আসলেই নিরুপায়। তখন নিহালের ভেতর আবার একটু মনুষ্যত্ব জাগ্রত হয়। ও গিয়ে ওর আব্বুকে বলে, ‘আব্বু, আমাদের আশেপাশে ভালোবেসে অনেকেই বিয়ে করেছে। কারও পরিবার বিয়ের পর এতটা জটিলতা তৈরি করেনি। আপনারা কেন আমাদের জন্য জীবনটা এমন জটিল করে দিচ্ছেন? সবার কেন এত সমস্যা আমাদের দুজনকে নিয়ে? আপনারা সবাই তো এটাই চাইছেন যে আমি মেয়েটাকে ডিভোর্স দিই। তাহলে আমি আর কথা বাড়াব না। আমি ওকে আজই ডিভোর্স দিয়ে দিচ্ছি।’


এইটুকু বলে সে আমাকে বলল, ‘এই, তুমি রেডি হয়ে নাও।’ এটা বলে আমাকে জড়িয়ে ধরে সে কাঁদছে আর বলছে, ‘পাগলি রে! কেউ চায় না তোকে! তুই অনেক ভালো থাকবি, আমার দোয়া থাকবে তোর সাথে। চল, তোকে মুক্তি দেবো আমি।’ এদিকে আমিও কাঁদছি অঝোরে। তখন ওর আব্বু এসে বললেন, ‘ডিভোর্স দিবি, তুই দিবি। সেখানে আমার গায়ে দোষ মুছিস তুই? কত বড়ো সাহস তোর!’


আব্বু এটা বলামাত্রই নিহাল চিৎকার করে বলে, ‘এসব কী হচ্ছে আমার বাড়িতে! কী হচ্ছে!’ এরপর আমাকে বলছে, ‘তোর মতো খানকি এনে আমার বাড়িতে আজ সিনেমা চলছে। তোরে এই বাড়িতে আমি করুণা করে এনেছি। তোরে না আনলে কী ছেঁড়া যেত আমার!’ এদিকে আমি মুখের ভেতর ওড়না চেপে দিয়ে কান্না চাপার চেষ্টা করছিলাম প্রাণপণে। কিন্তু অন্তর থেকে আসা কূল-কিনারাহীন কষ্টের ঢেউ কি আর থামে! তবুও চেষ্টা করেছি প্রাণপণ।


ওর আব্বু এবার এসে আবার বললেন, ওর ছোটো বোনের নির্দেশ, খুলনাতে কেউ যাবে না। এখান থেকেই ঢাকাতে চলে যেতে হবে। খুলনাতে যাওয়া হবে না, এটাই ফাইনাল। ওরা আমাদের আমার আব্বুর বাড়িতে যেতে দেবে না। এসব ভাবলে এখনও কলিজাটা কালো হয়ে আসে। যদি দেখানো যেত বা আল্লাহ যদি বিচারটা দ্রুত দেখাতেন, তা-ও হয়তো সুখ পেতাম! যা-ই হোক, এরপর প্রভুহীন কুকুরের মতো আমি শুধু নিহালের মুখের দিকে তাকাচ্ছিলাম। আমি মিলাতে পারছিলাম না কিছুই।


ওদিকে নিহালের আব্বু এবার আমার আম্মুকে ফোন করে বললেন, ‘সানজিদা বা নিহাল কেউই খুলনা যাবে না কখনও। এখান থেকেই ঢাকা চলে যাবে।’ এটা শুনে আম্মুর এবার রাগ হলো। আম্মু বলল, ‘আপনাকে আমি সব বুঝিয়ে বলেছি। আপনারা মেয়েটাকে একা নিয়ে গিয়ে ধরে কী যে খেলা দেখানো শুরু করলেন! এত খেললে আমরাও কিন্তু বাধ্য হব। আমার মেয়ে আর জামাইকে সোজা যেন আমার বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।’ বলেই ফোনটা রেখে দিলেন।


এইবার তো আমার শ্বশুর আরও রেগে গিয়ে সারাবাড়ি লাফাচ্ছেন আর নানান অশ্রাব্য ভাষায় গালি দিচ্ছেন আমার আম্মুকে আর আমাকে। আর নিহালকে বলছেন, ‘ওকে একাই বাসে তুলে দে, দূর হোক আপদ। তুই যাবি না। ও একাই এই বাড়ি থেকে চিরতরে চলে যাবে আজই। আর কখনও ওকে এই বাড়িতে আনব না।’ ইত্যাদি কথাবার্তা। এবার নিহাল আমাকে বলল, ‘শুনো, তোমাকে আমার বন্ধু কমলের বাসায় আজ রেখে আসব। আর ওদের বলব, তোমাকে খুলনার বাসে তুলে দিয়েছি। ওর বাসায় ওর আব্বু-আম্মুও নাই, তারা ইন্ডিয়াতে গেছে। বাড়িতে ও একা। সো, কেউ জানবে না। বাসায় বলব, তুমি চলে গেছ আর আমি কাল ঢাকা যাবার নামে বের হয়ে তোমাকে ওখান থেকে নিয়ে খুলনা যাব।’ ও আমাকে যা যা বলছে, আমি তাতেই শুধু সম্মতিসূচক মাথা নেড়েছি।


ওর ছোটো বোনের বুদ্ধির বাইরে এ বাড়ির কেউ যায় না। এর ভেতর সে চলে এল, সাথে বড়ো আপুও এল বাড়িতে। আমাকে এবার মাঝখানের রুমে রেখে দিল। আমি বসে আছি। সেই রুমের তিনপাশে দরজা। দুইটা দরজায় ছিটকিনি দেওয়া আর একটা দরজা শুধু চেপে দেওয়া। ওটাতে ছিটকিনি দেওয়া না। সেই দরজা দিয়ে আর-এক রুমের ভেতর দিয়ে বের হতে হয়। ওই রুমে ওরা নিতুকে বসিয়ে রেখেছে।


ওর বোনকে অনেকবার বলতে শুনেছি, ‘ওর আব্বু অসুস্থ, ভাই শ্বশুরবাড়ি, তা ওর (সানজিদার) দুলাভাই কই? ওর এক কাকাত দুলাভাই ছিল না?’ আমরা সব কাকার ছেলে-মেয়েই একজন করে, হয় ছেলে, নয় মেয়ে। আমাদের কারওই দুলাভাই নাই। সবাই মিলে আমরা দুলাভাই শালী যা-ই হই, তা-ই। বিয়ের সময় আমার ফুপাত ছোটো দুলাভাই ছিলেন। উনিই আমাকে ওদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন, ওরা ওঁকে ইংগিত করে এসব বলছিল।


তো, আমি ওই রুমেই আছি। আমার বাপের বাড়ির হয়ে আমার সেই দুলাভাই ফোন দিয়েছেন। নিহালের সাথে কথা বলতে চাইছেন। নিতুও শুয়ে পড়েছে। হঠাৎ আমি রুম থেকে বের হলাম, সেটা ও বুঝে উঠতে পারেনি। নিহালকে খুঁজতে গিয়ে তাকে কোনার ওই রুমে দেখি। নিহাল শোয়া, ওর মাথার কাছে ওর দুই বোন আর ওর আব্বু মাথা একজায়গায় নিয়ে বুদ্ধি করছে। ওর আম্মু কানে কম শোনেন, তাই তাঁকে ওরা বুদ্ধি করার সময় নেয় কম।


আমাকে দেখে চারটা মাথা হুট করে সরে গেল! কেমন যেন ওরা কোনও অনৈতিক কাজ করছে, আর ঠিক সেই মুহূর্তেই আমি ধরে ফেলেছি, এমন একটা ভাব চলে এল ওদের চোখে মুখে। এদিকে আমিও অপ্রস্তুত। এটা দেখে যেমন ভয় পাচ্ছি, তেমন লজ্জা। আমি তৎক্ষণাৎ পিছন ফিরে সেই রুমে চলে যেতেই বাকি দরজাটাও বন্ধ করে দিল ওরা। আমি এবার রুমের ভেতর একাই বন্দি, তিনটি দরজাই বন্ধ।


আমি শুয়ে শুয়ে কাঁদছি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। আর আগারওয়ালের বইটা বের করে ওতে লিখেছি, ‘আসলেই মায়ের থেকে বেশি যে ভালোবাসে, সে হলো রাক্ষস!’ রাত হলো। আমরা আবার শুতে গেলাম। তখন আমি আবার ভাবছি, যা হয় হোক না। একমাত্র এই লোকটাই আমার আপন। একটু পর সে রুমে এসে গোয়েন্দাদের মতো করে করে কথা বলছে। ওর কণ্ঠস্বর আতঙ্ক আতঙ্ক গোছের শোনাচ্ছে।


ওরা ওরকমভাবে বুদ্ধি করত সব মাথা একজায়গায় নিয়ে, যেটা আমি ছোটোবেলায় খেলা করতে গিয়ে নিজের দলের ভেতর এমন স্টাইলে বুদ্ধি-করা ছাড়া বড়ো হওয়ার পর আর কোথাও দেখিনি। ওরা একটু বাতাস উঠলেই সেটাকে ধরে ঝড়ে পরিণত করে ফেলে, সেটা নিতুও বলত। হুটহাট করে মানুষকে বিচার করত পুরোটা না দেখে, না বুঝেই। আর ভালো-মন্দ সবকিছুতে ওরা দল বাধত হুটহাট। আমি একদিন কথার মাঝে নিহালকে বলেছিলাম, ‘তোমরা যেভাবে কোনও কারণ ছাড়াই দল বেঁধে ফেলো, তোমাদের না কেমন যেন উপজাতিদের মতো লাগে। জানি না অন্যায় কিছু বলেছি কি না।’ ও কিছু না বলে হেসেছিল শুধু।


পরের দিন ওর মামাত ভাই সম্পর্কে হয়, এমন একজনকে আনল বাসায়। নাম কিশোর, বয়স ৪২, কিন্তু দেখে মনে হয় বয়স সর্বোচ্চ ১৭। তার দুইটা বউ। বড়ো জন মুসলিম, ছোটো জন সনাতনধর্মের ছিল। কিন্তু এখন দুই বউই কোনও ধর্মেই নাই। নামাজ পূজা কিচ্ছু কেউ করে না। ওরা উন্মাদের মতো বরকে ভালোবাসে নাকি। তবে দুই সতীন দুই রুমে থাকে। কোনও দিনই ওদের মধ্যে ঝগড়া বা মনোমালিন্য হয়নি।


ওদের বাড়িতে ২৮টা রাজহাঁস, ১৯টা ছাগল, ৩-৪টা গরু, ৩০-৩২টা মুরগি, ৩০-৩২টা পাতিহাঁস। সবই ওই দুই বউ মিলেমিশে পালে। সে ছোটো বউকে এনেছিল মন্ত্রতন্ত্র করে। মেয়েটাকে দেখে পছন্দ হয়েছিল, এরপর কী এক তেলপড়া নাকি করেছিল। সেই মেয়ে তারপর উন্মাদের মতো ছুটে চলে এসেছিল ওর কাছে। এরপর সে আর কোনও দিনই এখন পর্যন্ত বাপের বাড়ি যায়নি। যেতে চায়ও না। এ সবই সেই ভাইয়ের মুখ থেকে শোনা।


(চলবে…)