প্রেমান্ধতা/পর্ব-৪

 
সেই ভাই পেশায় কবিরাজ। মানে সম্পর্কবিচ্ছেদ, কারও শরীরে রোগ দেওয়া, জিন চালক দেওয়া, কাউকে উন্মাদ করে নিয়ে চলে আসা, কাউকে বশীভূত করে ফেলা, কাউকে বাণ মেরে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যাওয়া, সে এসবই করে। আর ওই যে গরু ছাগল হাঁস মুরগি, তার সবগুলিই তদবিরে কাজ হয়ে পাওয়া গুরুমান্য। সবাই মিলে ওর চারদিকে গোল হয়ে বসে আছে। আমাকে নতুন দেখে প্রথমেই লোকটা জিজ্ঞেস করল, ‘এটা কে?’ ওরা বলল, ‘বউ।’ সেই ভাই বলে, ‘ধুরর! তোরা ইয়ার্কি করিস কেন?’ ওরা বলে, ‘তাইলে দেখতে কী লাগছে?’ ভাইটা বলল, ‘বাড়ির কাজের লোক। এরকম পোশাকে কাজের লোক থাকে, দুদিনের নতুন বউ না।’ শুনে ওরা হা হা করে হেসে দিল। তবু আমার লজ্জা লাগল না। আমার শুধু অবশ লাগছিল।


ওকে এনে এসব গল্পের মাঝে নিহালের আম্মু বললেন, ‘কিশোর, বলো তো, এর মধ্যে সবার চেয়ে খারাপ মন কার?’ কিশোর বলল, ‘মামি! এর ভেতর তোমার ছেলের মতো শয়তানি কারও মনে নাই। হেসে হেসে কথা বলে। কিন্তু এর শরীরে যতটা না রক্তকণিকা, তার তিনগুণ ইবলিস আছে। চরম শয়তান আপনার এই ছেলে।’ ওরা ভেবেছিল, আমার কথা বলবে। কিন্তু পরিস্থিতি হয়ে গেল উলটা। ওরা কথা ঘুরাতে তাড়াতাড়ি হেসে দিয়ে বলল, ‘তুই যা মজা করিস!’ কথা পালটাতে এবার ওরা বলল, ‘আচ্ছা তুই বল তো, আমাদের বউয়ের মনে কী আছে?’ সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মেয়েটা বাপদরদি, সহজসরল, মানুষের জন্য কিছু করতে চায়। নেওয়ার চেয়ে দেওয়া পছন্দ করে বেশি।’


সব শুনে নিহালের আপুরা বলল, ‘ভাই, তুই এসব আর বলিস না। সানজিদা ভয় পাবে।’ সেই ভাই আশ্বাস দিয়ে বলল, ‘না রে মণি, ভয় পেয়ো না। তুমি তো আমার ছোটো ভাইয়ের বউ। তোমার জন্য আমি কেন এসব করব? আমাকে ভয় পেয়ো না।’ আর নিহাল বলল, ‘ভাই, তুমি যে এসব করো, সবগুলিই তো নেগেটিভ কাজ। সম্পর্ক ভাঙো, জীবন নষ্ট করো, এতে তো তুমি স্পষ্টই জাহান্নামি। একটাও ভালো কাজ তো করো না।’ ভাইটা বলল, ‘কেন এই যে বাবা-আম্মুর কথায় ছেলে-মেয়েকে আলাদা করে দিচ্ছি, এতে আব্বু আম্মু খুশি হচ্ছে। এটা তো একটা ভালো কাজ।’


ওই দিন রাতে ভাত খাওয়ার সময় ওর আব্বু আম্মু, বড়ো আপু দুলাভাই, ছোটো আপু দুলাভাই, বড়ো আপুর এক ছেলে এক মেয়ে, ছোটো আপুর এক ছেলে, নিহাল আর আমি সবাই মিলে খেতে বসেছি। খাওয়া শেষের দিকে। আমি আর শাশুড়ি ভাত নিয়েছি। ওর ছোটো দুলাভাই ইচ্ছে করেই দেরিতে ভাত খাচ্ছে, মানে ধীরে ধীরে। নিহালের খাওয়াশেষে ও অন্য রুমে গিয়ে শুয়ে আছে। নিহালের ছোটো দুলাভাই আমাকে দেখিয়ে তার ছেলেকে বলছে, ‘আব্বু এ কে? চিনো?’ ছেলে লজ্জা পেয়ে বলছে, ‘আমার মামি।’ কিন্তু সাথে সাথেই ওর আম্মু শিখিয়ে দিল, ‘উঁহু, কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবে, আমার মামার ঢাকার বাসার কাজের বুয়া।’


ওর দুলাভাই অনেকক্ষণ ধরে আমাকে বাগে ফেলার সুযোগ খুঁজছিল। এবার ধীরে ধীরে বলা শুরু করল, ‘সানজিদা, বেশি করে ভাত তরকারি নাও। তোমার বাপের বাড়ি তো দক্ষিণে। লবণ পানিতে তো ফল হয় না, না কি হয়? আমাদের এদিকে দেখো, কিছুর অভাব নাই। আম জাম কাঁঠাল কলা লেবু সব হয়, সব। এসব খাবে। বাপের বাড়ি এসব হলে তো খেতে। আর কিনে খাওয়াও তো টাকার ব্যাপার। এজন্যই শুকাতে শুকাতে তুমি এই অবস্থায়! আমাদের বাড়িতে সব আছে। খেয়ে অল্প কয়দিনেই মোটা হবে। এত চিকন হলে মজা নাই।’


এরকম আরও অনেক অনেক কথা অনর্গল বলেই যাচ্ছে, যেগুলি কলিজায় গিয়ে আঘাত করে। আমার আব্বু আম্মু তুলেও কথা বলছে। বাকিরা এসব শুনে হাসাহাসি করছে। আর আমার হাতের মুঠোয় থাকা মাখানো ভাত যেন হাতের ভেতরেই চাল হয়ে যাচ্ছে। চোখের পানি টপ করে পড়ল প্লেটে। আমি দ্রুতই লুকিয়ে ফেললাম চোখের পানি। তখন আমিও হাসিহাসি মুখ করে থাকার ভান করছি, মুখের ভেতর কোনওমতে ভাত ঢুকিয়ে দিচ্ছি। তবে অন্তরে মনে হচ্ছে, আমি আমাকে সব থেকে বিষাক্ত বিষটা জোর করে খাওয়াচ্ছি।


প্রায় বিশ মিনিটের মতো ওরা বলেই যাচ্ছে। আমার মনে হচ্ছে, ‘ইস্‌ নিহাল যদি এখন এখানে থাকত! কৌশলে যদি টপিকটা একটু পালটে দিত!’ ওরা দেখল, আমি ভাত নিয়ে মাখাচ্ছি, নয়তো হাতে নিয়ে বসে আছি, মুখে আর তুলতে পারছি না। আবার আমাকে বলছে, ‘খাও খাও। বড়ো বড়ো নলা করে খাও! আমাদের এখানে তো আর খাওয়ার অভাব নাই। খেয়ে নাও যত পারো।’


আমি তখন বললাম, ‘বেয়াদবি নিবেন না, আমি একটু ওয়াশরুমে যাব।’ বলেই বাইরে এলাম। নিহালকে ডেকে নিয়ে গেলাম। আমার এমনিতেই রাত্রে খুব ভয় লাগে, তার উপর এসব কথাবার্তা। বের হয়ে নিহালকে বললাম, ‘দেখো, এভাবে এসব বলছে, আমার তো কষ্ট হচ্ছে। তুমি একটু আসো না এখানে সবার মাঝে।’ নিহাল তখন দুলাভাইয়ের উপর মনে মনে রাগ করে আমাকে বলল ওখানে আর না যেতে। আমার হাত ধরে টেনে ঘরে নিয়ে বসিয়ে রাখল। এদিকে আমার আর না যাওয়াতে ওর দুলাভাইয়ের রাগ আরও বাড়ল। মানুষ অসহায়কে কথা শোনাতে না পারলে সহ্য করতে পারে না। এভাবে আমি মাঝখানে পড়ে চাপ খেয়েই যাচ্ছি।


ভোর পাঁচটার একমিনিটও দেরি হলেই ছোটো আপু চেঁচিয়ে ডাকে, ‘সানজিদা, এই সানজিদা, কত বাজে!’ আমি ধড়াক করে উঠে ঘর ঝাড় দেওয়া থেকে শুরু করে সারা দিন কাজ করি। এভাবে চলছিল। ১৪ই আগস্ট ওর বড়ো আপু, ওর মা, ওর আব্বু আর ও আমাকে বলল, আমি আর নিহাল খুলনা যাব ১৫ই আগস্ট, কিন্তু ওর ছোটো দুলাভাই আর আপু বা বাইরের কেউ জানবে না। চুরি করে যেতে হবে। সবাই জানবে, আমরা ঢাকা যাচ্ছি।


সকাল সকাল ঘুমিয়ে পরদিন সকালে ভোরে উঠে সব কাজ করে, ওইদিন আবার ৩ রকমের পিঠা, রুটি, ছাগলের গোশ(ত), ভুঁড়ি ইত্যাদি একের পর এক বানিয়ে সবাইকে খাইয়ে খুশিতে আত্মহারা হয়ে জিনিসপত্র গুছাতে গিয়ে আমার দুইটা ওড়না, আর ওর একটা প্যান্ট রেখে এসেছি ভুলে। সবার পা ছুঁয়ে সালাম করে বের হলাম। বের হবার আগে ওর ছোটো আপু বলছে, ‘নিহালের জন্য কিছু গোশ(ত) দিয়ে দাও। সানজিদা রান্না করে দেবে।’ কিন্তু ওর বাড়ির কেউই রাজি হলো না, কারণ ওরা সবাই জানে, আমরা ঢাকাতে না, খুলনাতে যাচ্ছি। উলটা আমার শাশুড়ি নিহালকে বললেন, ‘সানজিদাকে কয়দিন পর খুলনার বাসে তুলে দিস। ও ঘুরে আসবে। আর তুই বাড়ি আসিস। গোশ(ত) খেয়ে যাস।’


আমরা বের হবার পর ওর ছোটো আপু সব চেক করতে গিয়ে আমার একটা ওড়না আর নিহালের একটা প্যান্ট পায়। পথে এসে দিয়ে যান আমার শ্বশুর। পথে এক দূরসম্পর্কের ভাবি ঠাট্টা করে বলছিলেন, ‘পেটিকোট ব্লাউজ নিয়েছ তো? নাকি তা-ও ফেলে এসেছ?’ আমি বললাম, ‘না ভাবি, ওগুলি এক পিস করে তো, তাই ভুল করে হলেও পরেছি।’ দেখলাম, আমার কথাটায় ওর বড়ো আপু মাইন্ড করল মনে হয়। বের হয়ে আসার সময় ওর বড়ো আপু আর ওর আম্মু আমাদেরকে রাস্তা পর্যন্ত দিতে এল। পথে ওদের এক কাকা আমাকে ইঙ্গিত করে কুৎসিত একটা মন্তব্য ছুড়ে দিয়ে অপমান করল। ওরা কিচ্ছু বলল না তাকে। আমাকে বলল, ‘যা-কিছু হয়েছে, বাপের বাড়ির কাউকে বোলো না।’


চলাফেরা আর সব ক্ষেত্রে আমি যা-ই করি, ওরা খুব অবজ্ঞাভরে আমার দিকে তাকায়, নানাভাবে হিউমিলিয়েট করে। আসলে কিছুই করার ছিল না আমার। চলে এলাম খুলনা। ১৫ই আগস্ট। খুলনা এসে পৌঁছেছি বিকেল ৪টায়। বৃহস্পতিবার ছিল ওইদিন। ওর আপু বলে দিয়েছে, শুক্রবার রাতে ঢাকা চলে যাবে নিহাল। শুক্রবার আবার খুলনাতে ডাকবাংলা মার্কেট বন্ধ থাকে। তাই বাসায় এসে খেয়ে দেয়েই বের হই ওর জন্য শপিং-এ। সে আমাকে আগে থেকে বলে রেখেছে। ওকে থাকতে বললে হবে না। ওর অফিস আছে৷ শপিং-এ গিয়ে আমি ওর জন্য খুব সুন্দর একটা শার্ট আর একটা প্যান্টের পিস কিনে বানাতে দিয়ে এসেছি। শনিবার দেবে বলেছে। হালকা গোলাপি আভাযুক্ত এককালারের শার্ট, আর ব্ল্যাক প্যান্ট। বানাতে দিয়ে আমার বান্ধবীর বাসায় গিয়েছি দুজন। ওখানে দাওয়াত খেয়ে বাসায় চলে এসেছি রাতে। ওর মুখে সব সময় শুধু বিরক্তি। হাসে না, চোখ মুখ কুঁচকে রাখে। যেন কিচ্ছু ভালো লাগছে না তার।


এখন একটু থামছি। আমার নিজের গল্প মনে করতে বা কখনও মনের সামনে এলে নিজেরই ভয় লাগে, আবার মায়াও লাগে। মন চায়, সাহস করে একদৌড়ে গিয়ে ওকে নিয়ে আসি। আমার সহ্য হয় না। সারাক্ষণই কষ্ট পাই। ও অন্য কারও হতে পারে না। ও এখন অন্য মেয়ে নিয়ে বেড শেয়ার করছে, জান বাবু সোনা বলে ডাকছে, নিশ্চয়ই কত কেয়ার করছে নতুন মেয়েটার, এসব ভাবতেই মাথা গরম হয়ে যায়। মনে হয়, গায়ে বোমা বেঁধে নিয়ে ওর কাছে গিয়ে ওকে কোনওভাবে জড়িয়ে ধরি। আমিও মরি, সেও মরুক, তবুও সে অন্য মেয়ের না হোক! সেদিন আমি ওকে বান্ধবীর নম্বর দিয়ে কল দিলাম। রিসিভ করে আমার কান্না শুনেই ফোন কেটে দিয়ে অফ করে দিয়েছে। তবু ওর নিঃশ্বাসের শব্দটুকু তো শুনলাম!


আমি ওকে কিছু টেক্সট পাঠিয়েছি। ও অবশ্য একটারও রিপ্লাই দেয়নি। কয়েক হাজার বারের উপর নিজের টেক্সট নিজেই দেখেছি। মোবাইল হাতে নিয়ে বসে থেকেছি, যদি ও কিছু লিখে পাঠায়, সে আশায়! পাঠায়নি।


তুমি বউ নিয়ে এত্ত খুশি! অথচ বিয়ের দুদিন আগেও বলেছিলে, অন্য কোনও মেয়েকে ছুঁয়েও দেখবে না। আর আজ? অন্যায়ভাবে আমার বুকে ছুরি চালিয়ে অন্য মেয়ের বুকে ডুবে আছ! এ-ই তোমার ছয় বছরের ভালোবাসা! তোমাকে অন্য নম্বর থেকে ফোন দিলাম, ঠিকই ধরলে, আমার কণ্ঠ বুঝতে পেরে কেটে দিলে! ঠিক ছয় বছর আগে যেভাবে আমাকে হ্যালো বলতে, আজও সেভাবেই বললে। কী না করেছি তোমার জন্য? অথচ আজ আমার জায়গায় অন্য মেয়েকে এনে জোর করে বসালে! ওই মেয়ে ফোনটা ধরে তোমাকে বলল, ‘বাবু, তোমার ফোন!’ সেও তোমাকে বাবু ডাকে! আমার মতোই তোমাকে আদর করে! ছিঃ নিহাল!


আজ আমার আব্বু অসুস্থ বলে এভাবে ছুড়ে ফেলে দিলে ছয়টা বছরের ভালোবাসা! ওর আব্বুর ছাদওয়ালা বাড়ির কাছে হেরে গেল আমার ছয় বছরের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা! হায় রে জীবন! কুরআন ছুঁয়ে শপথের কথাও ভুলে গেলে, বাবু! তৃতীয়বার বিয়ে করার সময় আমার মুখটা একবারও মুখের সামনে ভেসে এল না! আমি বিশ্বাস করিনি যে তুমি বিয়ে করেছ, তা-ও আবার এই করোনার মধ্যে! আর আজ তোমার উচ্ছ্বসিত কণ্ঠস্বর শুনে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছি না এখনও!


হায় আল্লাহ! এমনও হয় দুনিয়ায়! আগে তো কখনও বুঝিনি! আমাকে যেমনি করে ভালোবাসা দিতে, ওকেও দাও বুঝি তেমনি করেই? হুট করে একটা নতুন শরীর কাউকে ছয় বছরের ভালোবাসা ভুলিয়ে দিতে পারে! তুমি এমন মানুষ, বাবু! আগে তো কখনও বুঝতে দাওনি এটা! টাকার কাছে তুমি এতটাই কাবু, এটা তো কোনও দিনই ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি! বাবু রে, এভাবে এত নিষ্ঠুরভাবে কাউকে আঘাত করতে নেই! সেও একটা মেয়ে! সে যদি আমার সম্পর্কে টেন পার্সেন্টও জানত, তবে নিশ্চয়ই কখনও একটা মেয়ের সাধনায়, অধিকারে ভাগ বসাত না কখনওই!


সব মিথ্যে সাজিয়ে বিয়ে করেছ! পারলে কীভাবে! ভালোবাসা নাহয় তোমাদের কাছে খেলনা, কিন্তু ওটা যে আমাদের মতো মেয়ের কাছে গোটা একটা জীবন! প্রতারণায় এতটাই অভ্যস্ত তুমি! এই করোনার জন্যও অপেক্ষা করলে না, এর মধ্যেই বিয়েটা করে ফেললে, বাবু! একসময় সাহানা এরকম লাইনে দাঁড়িয়ে ছিল, আজ দাঁড়াতে হলো আমাকে। জানি না একদিন জাকিয়াকেও এরকম লাইনে দাঁড়াতে হবে কি না! আজ বুঝি, প্রতারক হতে কি আর চেহারা লাগে! লাগে তো একটা প্রতারক মন! ছিঃ ছিঃ!


আমার মেসেজ দেখে সে রাগ করলে তুমি কি আদর করে রাগ ভাঙাও তার, আমাকে যেমন করতে? ওর উপরও ইচ্ছামতো অধিকার ফলাও আমার উপর যেমন ফলাতে? তোমার কণ্ঠ বলে দিচ্ছে তুমি অনেক মজায় আছ! কীভাবে পারছ? নতুন শরীর নিয়ে এত খুশি তুমি! মানুষ এমনও হয়! ছিঃ! যার কণ্ঠ না শুনলে তোমার ঘুম আসত না একসময়, আজ তার কণ্ঠ শুনেই ফোনটা কেটে দিলে! তোমরাই পুরুষ, তাই না, বাবু?


তোমাকে নিয়ে লিখছি, তাই তোমার মায়াচোখে আমার দিকে তাকানোটা মনে করে খুব কেঁদেছি! তোমার কণ্ঠ শোনার জন্য তৃষ্ণায় মরে যাচ্ছিলাম, তাই ফোন করেছি! বাবু রে, এভাবে কাউকে কলিজায় আঘাত দিতে নেই! এই সেক্সের দুনিয়ার বাইরেও একটা পরকাল আছে! ওটাকে ফেইস করতে হবে তোমার, আমার, সবার। এতটা কষ্ট কাউকে দিতে হয় না। আল্লাহকে ভয় করো, বাবু। তোমার নতুন বউ কিচ্ছু জানে না, জানলে তোমার সাথে এভাবে সংসার করতে পারত না। ওকেও নিশ্চয়ই মিথ্যার বেসাতি দিয়ে ভুলিয়ে রেখেছ, তাই না?


…এরকম আরও কিছু টেক্সট। আমি সত্যিই কিছু ভাবতে পারছি না! যে-কোনও মূল্যে আমি আমার নিহালকে চাই। এসব আমি যত ভাবছি, তত পাগল হয়ে যাচ্ছি। কুড়িল ফ্লাইওভার পার হয়ে একটা সুন্দর জায়গা আছে। লেকের উপর হাঁটার জায়গা করে দেওয়া। ওখানে ছবি তুলতে চেয়েছিলাম সামনের ঈদের পর ঢাকা ফিরে। হলো না। জীবনে কখনও ট্রেন ছুঁয়ে দেখিনি। তাই কমলাপুর থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত ট্রেনে নিয়ে যেতে চেয়েছিল সে। সুযোগ আর হয়ে উঠল না। কুড়িল ফ্লাইওভার পার হয়ে এয়ারপোর্ট যেতে ওখানকার রাস্তাটা খুব সুন্দর। ফুটপাত ধরে ওই রাস্তায় হাঁটতে চেয়েছিলাম ঈদের পর। ওর ফেইসবুক আইডিতে লাস্ট চারটা প্রোফাইল পিকচারই আমার তোলা, আমার এডিট করা। কাভারফটোতে ওর গায়ের হলুদ টিশার্টটা আমারই কিনে দেওয়া। ওর বায়োতে এখনও আরবিতে আমারই লেখা---সানজিদার কলিজা! ও এখনও চেইঞ্জ করেনি, ভুলে হয়তো।


কত কিছু মনে পড়ে! আমি একসময় ওর বউ ছিলাম, এখন আর নাই। এখন যে বউ আছে, সেও এক সময় থাকবে না, এমন তো হতেই পারে! তখন যদি সে ফিরে আসে আমার কাছে! আমি ওর জন্য অপেক্ষা করতে রাজি। যদি কোনও দিন পঙ্গু হয়েও সে ফিরে আসে, একটা বার যদি আমাকে ডাকে, একটু ছুঁতে দেয় তাকে, চোখ জুড়িয়ে দেখতে দেয়, পথ না পেয়েও যদি কখনও ফিরে আসে…আহা! আমার কী দোষ? আমি খুঁজে পাই না। এটা নিয়ে অনেক ভেবেছি, কিছুই মাথায় আসে না। আমার দোষ থাকলে আমি নিজেকে বোঝাতে পারতাম, মেনে নিতে পারতাম। এখন আমি কী দিয়ে নিজেকে বোঝাব?


আমাদের কত ছবি ফেসবুকে আছে ‘অনলি মি’ করা। কষ্টগুলি বারে বারে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। আর পারছি না সহ্য করতে। আমার কী হবে? আমি ওকে অন্য যে নম্বর থেকেই কল দিই না কেন, সেটাই ব্ল্যাকলিস্টে রেখে দেয়। ওর কাকিকে ফোন দিয়েছি। উনিও আমার সাথে কথা বললেন না। আমার মাথা সত্যিই কাজ করছে না। পরে কাকিকে আর-এক নম্বর দিয়ে কল দিয়ে অনুরোধ করেছি আমার সাথে কথা বলতে। জানলাম, আজ সে শ্বশুরবাড়িতে গেছে। অথচ সে আমাকে কিছুই বলেনি ফোনে। বলবেই-বা কেন? আমি এখন ওর কে? কীভাবে সম্ভব! যে মানুষটা কিছুদিন আগেও বলল, বিয়ে করবে না, সে-ই আজ অন্য মেয়ে নিয়ে শুয়ে আছে! সেই চেনা মানুষটাই! সেই নাক মুখ চোখ!


আমার কান্নাকাটি শুনে এদিকে আমার আম্মু খুব বিরক্ত। আজ দরজা খুলে চিৎকার করল। পাশের এক ঝগড়াটে মহিলা আমাকে ইয়াবাখোর দোষ দিয়ে পুলিশ ডেকে এনেছে। পুলিশ এসে কথা বলে গেল। বাসা ছাড়তে বলে গেল ওরা। আমাদের এই বিল্ডিংয়ে দুই জন মহিলা আছে। ওরা প্রতিদিনই কোনও-না-কোনও ঝগড়া বাধায়। প্রফেশনাল অনেকটা! আমার কান্নাকাটিতে আম্মু বিরক্ত হয়ে আমাকে বকেছে। দরজা খোলা ছিল। ওরা এসে গায়ে পড়ে ঝগড়া বাধানোর চেষ্টা করেছে। অনেক গালি দিয়েছে আমাদেরকে। এরপর ট্রিপল নাইনে ফোন করেছে ওই মহিলার বর। পরশুও এরকম করেছে ওদের পাশের ঘরের লোকের সাথে। তারা আবার এসপির ভয় দেখিয়েছে, তখন ট্রিপল নাইনে ফোন করেও কেটে দিয়েছে।


আমি আর বাঁচতে চাই না। আজ আমার আম্মুও আমার সাথে ভালোভাবে কোনও কথা বলল না। আবার ওদিকে ওরা পুলিশ এনে মানহানি করে গেল। এত কষ্ট অন্তরে পুষে পুষে বেঁচে আছি! কী নিয়ে বাঁচব আমি? একদিন আব্বু আম্মুও আমাকে ছেড়ে চলে যাবে। হোক সেটা কাল, না হয় পরশু। এরপর? তখন আমি কী করব? আমার এই জীবনের সত্যিই আর কিছু বাকি নাই। আমি কীভাবে ওকে ফিরে পাব, কেউ যদি আমাকে বলে দিত! আমি নিজেকে চিনি। একটা কিছু পছন্দ হলে আমি সেটা বাদ দিতেই পারি না। সেটা যা-ই হোক না কেন! কাল দেখলাম, আমার আগে নিহালের যেসব রিলেশন ছিল, সেসব মেয়েকেও অ্যাড করে ফেলেছে ওর আইডিতে।


আমি সহ্য করতে পারছি না। আমি কিছুতেই ওর মায়া কাটাতে পারব না। সত্যিই আমি যে-কোনও সময়ই মরে যাব! আমি আর পারছিইইইই…না! কত স্মৃতি, কত কথা! সে অবশ্য খুব ভালো আছে। আমি ওদের জন্য কী না করেছি? তা-ও সে আমাকে এমন ধোঁকাটা দিল! আমি ভুলতে পারছি না ওকে। ওর কথা ভেবে ভেবে আমি নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়েছি। আমার বার বার মনে হচ্ছে, এই মুহূর্তে মরে যাওয়াটাই বেস্ট ডিসিশন হবে আমার জন্য! সেই ছোটোবেলা থেকে স্ট্রাগল করতে করতে আজ আমি বড়ো ক্লান্ত! যা-ই হোক, আমি আমার মূল গল্পে ফিরে যাচ্ছি।


১৬ই আগস্ট। ইচ্ছা ছিল, ওইদিন আমার ফুপাত বোন কোনাল আপুর শ্বশুরবাড়ি যাব। ছোট্টবেলা থেকে একসাথে বড়ো হয়েছি। ২০১৩ সালে আপুর বিয়ে হয়। মাত্র একবারই গিয়েছি ওর বাড়িতে, তা-ও একদিনের জন্য। আর যাইনি। ওর ছেলে প্লে’তে পড়ে। ফোন করে যেতে বলত, কিন্তু আমি পড়াশোনা রেখে কোত্থাও যেতাম না। আমাদের বাসা থেকে বাসে মাত্র ৪০ টাকা আর ভ্যানে ১০ টাকার পথ। তা-ও যাইনি।


ওইদিন আপুদের বাড়িতে যাওয়ার কথা ছিল। উনিও জানেন। তবে নিহালের মনে একটা ভয় আছে। ও যেমনি তার আপুর বাড়িতে আমাকে পা ধরানোর জন্য নিয়ে যেতে চেয়েছিল, ও তাই ভাবছিল, আমিও তেমনি ওখানে নিয়ে গিয়ে হয়তো ওকে কথা শোনাব বা এরকম কিছু করব। সকাল হওয়া থেকে আপু একবার, দুলাভাই একবার আমাকে যেমন ডাকছে, তেমন ওকে ফোনে ফরমালিটি মেইনটেইন করে দাওয়াত দিচ্ছে বার বার। দুপুরে দাওয়াত খেয়ে বিকেলে ফিরব, এমনই পরিকল্পনা ছিল। আমিও ঘুম থেকে ওঠার পর থেকেই ওকে বলছি, ‘চলো, রেডি হও, গোসল করো…’ ইত্যাদি। সে শুয়েই আছে। নড়ছে না। আমি ওর জামা ধরে, পা ধরে, হাত, প্যান্ট এসব ধরে টেনে টেনে ওঠানোর চেষ্টা করছি। সে ওঠেই না।


এদিকে ক্ষণে ক্ষণে ওর আপুদের ফোন আসে। ফোনে তারা নিহালকে কোথাও না যেতে, দ্রুত ঢাকা যেতে বলছে। আম্মু ওর জন্য ওর পছন্দের বড়ো গলদা, বাগদা ভুনা করে রেখেছে। একটু পর পর খেতে দিই। কিন্তু ওই এক বিষয়ে কোনওভাবেই তাকে রাজি করাতে পারছি না। সে এক পর্যায়ে চিৎকার করে বলে ওঠে…‘আমার গায়ের শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত আমি এই বেড থেকে নামব না।’ আমি অবাক হয়ে বলি, ‘এত সিরিয়াস কেন হচ্ছ? এভাবে বলছ কেন?’


আমাদের ওই বাসার উলটো দিকের বাসাতে এক মেয়ের বিয়ে হচ্ছে। আমি সেখানে গিয়েছি। ওই বাসার আন্টিসহ ওঁর মেয়েরা আমাকে দেখে খুশি হচ্ছে। জামাই কই, ওকে কেন নিয়ে যাইনি, আন্টি এসব বলছেন। আমি ভাবলাম, যাই, ওকে নিয়ে আসি। বাসায় এসে আবার ওকে খোঁচালাম। ‘চলো যাই, আপুদের বাসায় না যাও, ওই বাড়ি তো চলো। বউকে কত সুন্দর করে সাজিয়েছে, বউ না দেখো, বরের মুখটা দেখে এসো। চলো না। সবাই তোমাকেও দেখতে চাইছে।’


দেখলাম, সে শুধু বিরক্তই হচ্ছে। আর চোখে মুখে কেমন যেন একটা অস্থিরতা আর আতঙ্ক ছড়িয়ে আছে। ভয়ার্ত একটা মুখ! তার একটাই কথা, শেষ রক্তবিন্দু থাকতে সে বেড থেকে নামবে না। আমার এবার আস্তে আস্তে রাগ হচ্ছে। আমি ওর সাথে কথা বলার সময়ও পাচ্ছি না। শুধু বার বার ফোন দিচ্ছে ওর আপুরা। লোকে বলে, চোরের মন পুলিশ পুলিশ। ওরা ভাবছে, আমাকে ওরা যেভাবে জ্বালিয়েছে, নিশ্চয়ই আমরাও প্রতিশোধ নেব বা ওরকম কিছু করব।


আমি এবার দরজা চেপে দিয়ে ওকে বলছি, ‘আচ্ছা, তুমি কি কখনওই আমাকে বুঝবে না? এমন কেন করছ?’ আব্বু আম্মু যাতে শুনতে না পায়, এমনভাবে আস্তে আস্তে কথাগুলি বলছিলাম। আমার স্যাক্রিফাইসের কথাগুলি আবার তুলে ফেললাম ওর কাছে। আসার পর থেকে সে একটুও ইজি হতে পারছিল না। সারাক্ষণই কীরকম একটা অস্থিরতা! এতক্ষণে এবার সে একটা পয়েন্ট পেয়েছে। সাথে সাথে আমাকে বকাবকি শুরু করেছে। আমার জন্য তার লাইফ শেষ। তার সব লস হয়েছে আমার জন্যই, এমন কথাবার্তা। কথা কাটাকাটি বেধে গেল দুজনের মধ্যে।


আমি রাগে দুঃখে পাশে-থাকা বসার টুলটা পা দিয়ে লাথির মতো মেরে দূরে সরিয়ে দিলাম। আর সেটা অসাবধানতায় ওর পায়ের দিকে গেল। আর অমনিই সে চিৎকার দিয়ে বলল, ‘আমাকে মারছ কেন? আমি কী করেছি? আমাকে কেন মারলে? স্বামীকে পেটায়, এ কেমন মেয়ে?’ এসব শুনে বাড়িওয়ালা, আমার আম্মু ভাই সবাই রুমে চলে এল। ছোটোখাটো হট্টগোল বেধে গেল তখন। সে তখন ব্যাগ নিয়ে লাফ দিয়ে বের হয়ে বলছে, ‘আমি চলে যাব। আমি আর একমুহূর্তও এখানে থাকব না।’


সে বের হয়ে যাচ্ছে, তখন আমি আম্মুকে বললাম, ‘আম্মু, প্লিজ, ওকে যেতে দিয়ো না। আমিও যাব ওর সাথে। প্লিজ, ওকে যেতে দিয়ো না।’ ওদিকে সে সব ছেড়ে ছুড়ে দৌড় দেবে, এমন একটা ভাব। আমি গিয়ে ওর হাতটা ধরে বলছিলাম, ‘আমাকে মাফ করে দাও। তুমি একা কেন যাবে? আমিও যাব তোমার সঙ্গে।’ সে আমাকে ধাক্কা মেরে চলে যাচ্ছে। আর শুধু বলছে, ‘এখানে আর একমুহূর্তও না। আমি চলে যাব। আমাকে পথ দেন, আমি চলে যাব।’ আমি আবার তার হাতটা ধরলে সে আমাকে জোরে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল। আমি হাউমাউ করে কাঁদছি। আমার মধ্যে সারাক্ষণই তাকে হারানোর ভয় কাজ করত। কেন জানি মনে হলো, সে এভাবে চলে গেলে আর ফিরবে না হয়তো। আমি তখন উন্মাদ হয়ে ওর হাতে কামড় দিলাম, যাতে ব্যথা পেয়ে সে একটু দাঁড়ায়। কিন্তু সেটা যে খুব জোরে দিয়েছি, তা নয়।


সে তখন আরও চিৎকার করে বলল, ‘আমাকে হসপিটালে যেতে হবে, আমি আহত আমি আহত! সরেন সবাই। আমার হাতে কামড় দিয়েছে সানজিদা।’ এসব শুনে আমার ভাই সামনে এসে ওকে নিয়ে বসাল। হাতে তেল পানি দিল। আর আমার গালে এক থাপ্পড় মারলে আমি ঘুরে দাঁড়াই, তখন ভাই প্রচণ্ড জোরে আমার পিঠে দুইটা কিল মারে। আমি ‘আল্লাহ গো’ বলে কেঁদে উঠি। কারণ ততদিনেও আমার ওদের বাসায় গিয়ে খাওয়া মারের ব্যথা যায়নি। ওই ব্যথার জন্য আমি হাতটা কাঁধেও নিতে পারতাম না।


ভাই তো বোনকে মেরে বোনাইকে বোঝাতে চেয়েছে। ভাই তখন মুখে বলছে, ‘তুই আমার বাড়িতে এসে জামাইয়ের সাথে তর্ক করিস। কত্ত বড়ো সাহস তোর!’ আমাকে কিলটা এত জোরে দিল যে আমার দম যেন আটকে গেছে, এমন মনে হলো। তখন আবার নিহাল দৌড়ে এসে আমার ভাইকে থামিয়ে বলল, ‘ভাই, ওকে মারবেন না। আমার বউকে আমি দেখব। আমাদের ব্যাপার নিয়ে আপনি মাথা ঘামাবেন না।’ বলেই আমাকে বুকে জাপটে নিল। আমি তো চারপাশের দুনিয়ার রূপ দেখতে দেখতে ক্লান্ত। আমার মাথা যেন পুরোপুরিই খারাপ হয়ে যাচ্ছে দিনে দিনে। আমি তখন নিহালকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছি। আর বলছি, ‘আম্মু ভাই এরা আমার আপন না। আমি শ্বশুরবাড়ি গিয়ে মার খেলাম। বাসায় এসেও খেলাম। আমি কই যাব?’ এসব বলছি। নিহাল আমাকে জড়িয়ে ধরে বলছে, ‘পাগলি রে, তোর আর আমার জীবন কষ্টের। কেউ আমাদেরকে চায় না। চল আমরা চলে যাই। আমাদের মতো করে বাঁচি।’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ।’ আম্মুকে ডেকে বললাম, ‘আমি আর কখনও তোমাদের কাছে ফিরব না, দেখো।’


আমার ভাই এসে তখন নিহালকে বলল, ‘তুমি যে সানজিদাকে ছেড়ে দৌড়াচ্ছিলে একটু আগে, এর জন্যই তো বোনকে শাসন করলাম, আর তুমিই এখন ওর ব্রেইন এভাবে ওয়াশ করছ! তুমি ওকে কই নিয়ে যাবে?’ নিহাল বলল, ‘আমরা দুজন আজ রাতেই ঢাকাতে চলে যাব।’ আমার ভাই বলল, ‘তুমি কাবিনের পরের দিন সানজিদাকে আমাদের ঘরে ফেলে মেরেছ, আমি শুনেও না শোনার ভান করেছি। সানজিদাও কিছু বলেনি। ও ঢাকাতে পরীক্ষা দিতে গেলে ওখানে একা পেয়ে ওকে মেরেছ, ওর ফোন ভেঙে দিয়েছ, এরপর ওকে একা নিয়ে গেলে বাড়িতে। বাড়িতে নিয়েও কীভাবে মারলে! এরপর ঢাকা নিয়ে গেলে। ওই দুমাসেও অনেকবার মেরেছ ওকে। আজ নিয়ে গিয়ে আবার যে ওকে মারবে না, তার গ্যারান্টি কী?’


নিহাল বলল, ‘কী গ্যারান্টি চান আপনি? লিখিত দিলে নেবেন? লিখিত নেবেন আমার কাছ থেকে?’ তখন ভাই বলল, ‘তুমি দেবে লিখিত?’ নিহাল বলল, ‘হ্যাঁ, নিন।’ ভাইয়ার কথাগুলি শুনে আমার মনে হলো, ‘আসলেই তো কথা সত্যি।’ আমি নিহালকে আবার বললাম, ‘তুমি আমাকে ফেলে যাবে না তো কখনও?’ ওখানে কুরআনশরিফ ছিল। ও তখন কুরআন একহাতে নিয়ে আমার হাতটা ধরে ওর হাতসহ কুরআনের উপর রেখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এই কুরআনের কসম, তোমাকে আমি কখনওই ছেড়ে যাব না।’ আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘সত্যি তো? মনে থাকবে তো?’ নিহাল আবার বলল, ‘হ্যাঁ, মনে থাকবে। আমি তোমাকে কখনওই ছাড়ব না।’


আমার ভাই এদিকে রুম থেকে একটা স্ট্যাম্প নিয়ে এল। সেখানে ও কলম দিয়ে আমার আর নিহালের ঠিকানা আর সম্পর্ক লিখল। এরপর লিখেছে, ‘সানজিদার স্বামী হিসেবে তার শারীরিক ও মানসিক সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিহালের। সানজিদার কিছু হলে সে দায় নিহালের।’ এবার নিহালকে ওখানে সাইন করতে বললে সে আর সাইন করতে রাজি হয় না। বলে, ‘তবে এখানে আমার দায়ও সানজিদার, এটা লিখুন।’ আমার ভাই বলে, ‘তোমার দায় আমাদেরই, যদি তুমি আমাদের কাছে থাকো। আর সানজিদার দায় তোমাদের, যদি তাকে তোমার কাছে রাখো। আচ্ছা, ঠিক আছে, আমি ওটাও লিখে দিচ্ছি, তুমি যখন চাও।’


তবুও সে সাইন করতে অস্বীকৃতি জানায়। ভাইয়া এবার রেগে গিয়ে বলে, ‘লিখিত গ্যারান্টি তুমিই দিতে চেয়েছ আগে। আর এখন সাইন দিচ্ছ না। তাইলে আমাকে দিয়ে এসব লেখালে কেন? আমাকে বাধ্য কোরো না কিছু বলতে, নইলে আমিও কিন্তু দেখে নেব।’ এদিকে আমি ভাইকে উলটা বকছি কেন সে আমার বরকে এরকম কড়া কড়া কথা বলছে, এজন্য। এক পর্যায়ে নিহাল সাইন করল। কিন্তু ওর যেটা সাইন, সেটা না দিয়ে একটু ঘুরিয়ে অন্যভাবে দিল। ভাই বলল, ‘এই সাইন কি ঠিক আছে?’ তখন আমিও তাকালাম। দেখি, সাইনটা সে ঠিক দেয় নাই। আমার তখন মনে হলো, ছিঃ! এমন কাজ সে কীভাবে করল! আমি তো তার সাথেই আছি। ওই কাগজ নিয়েই-বা কী হবে! কিন্তু তাতেও নিহাল এমন দুইনম্বরি করল! আমি আস্তে করে ওকে বললাম, ‘তুমি সাইনটাও দুইনম্বর দিতে পারলে?’


সে সাইন করে আমাকে বলল, ‘চলো, একটু বাইরে যাই। বাতাস খেয়ে আসি। আর আজ রাতেই আমরা ঢাকা চলে যাব। আমাদের জীবন আমাদেরই।’ আমরা দুজন বাইরে বের হলাম। বাসার পাশেই একটা ধানক্ষেত। মাঝ দিয়ে ইটের চিকন রাস্তা। হু হু করা বাতাস। আমি ওখানে গিয়ে বললাম, ‘চলো, আমরা বসি এখানে।’ সে বলছে, ‘না না। সোনাডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে বসব।’ আমি বললাম, ‘ওখানে প্রচুর ভিড় আর শব্দ। মোটেই নিরিবিলি না। আমরা এখানেই তো ভালো আছি।’ কিন্তু দেখলাম, সে বসতে রাজি না। আমি এরপর তার হাত ধরে ঝুলে পড়েছি যেন সে বসে। তারপর সে বসল।


বসে দুইমিনিট পর সে বলল, ‘তুই আর তোরা আমার সাথে এমন কীভাবে করলি? আমার সাইন কেন নিলি? স্ট্যাম্পে কেন নিলি?’ আমি বললাম, ‘দেখো, সাইন বা লিখিত স্ট্যাম্পের কথা প্রথমে তুমিই বলেছ। আর তা ছাড়া স্ট্যাম্প দিয়ে কী হয়, বলো? আমি তো তোমাকে ভালোবাসি। এমনকি, আমি বাসায়ও পর্যন্ত বললাম, আর ফিরব না। একেবারেই চলে যাব তোমার সাথে। তাহলে ওই স্ট্যাম্প দিয়ে ভাই কী করতে পারবে? আর সেটা নিয়েছে আমার ভাই, আমি তো না। তুমি এবার আমার কাছ থেকেও একটা স্ট্যাম্প নাও। আমিই লিখে দেবো যে আমার কোনও প্রকার ক্ষতির জন্য কেউ দায়ী নয়। আর তুমি তো আমাকে ভালোবাসো। তোমার হাতে মরলেও আমি নিজেকে ধন্য মনে করব।’


দেখলাম, ওর রাগ তবুও বাড়ছেই। বলল, ‘আমি কী করতে পারি, সেটা এবার তোদের আমি দেখাব। হয় আমার চৌদ্দগুষ্টি, না হয় তোর চৌদ্দগুষ্টি জেলের ভাত খাবে, নয়তো ফাঁসিতে ঝুলবে।’ আমি বললাম, ‘কী বলো এসব তুমি!’ ‘তুই তোর ভাইয়ের কাছ থেকে নিয়ে স্ট্যাম্প ছিঁড়ে ফেলবি, নইলে তোকে কী মজা দেখাব, তা তুই স্বপ্নেও ভাবিসনি কখনও!’ সে বলল। আমি তো সাথে সাথেই রাজি। বললাম, ‘আমি এক্ষুনি বাসায় গিয়ে ওটা চেয়ে নেব। না দিলে আম্মুকে বকব। নিয়েই ছাড়ব। এরপর তুমি নিজহাতেই ছিঁড়ো ওটা। তবু প্লিজ, আর এই ঝামেলা বাড়তে দিয়ো না। বাদ দাও না, বাবু! ভালোবাসি তো!’


‘দেখ, আমি রেগে বলে তোর মাফ নাই। আমি দেখিয়েই ছাড়ব!’ এইটুকু বলে ওর বাসায় ফোন দিয়ে এমন স্টাইলে কথা বলছে যেন সে লুকিয়ে লুকিয়ে ফোনটা করছে। সে বলল, ‘আব্বু, আপনি কোথায়? এক্ষুনি ফোন নিয়ে চেয়ারম্যানের কাছে যান। এরা আমাকে এখানে আটকে রেখেছে। আমাকে এরা মেরে ফেলবে আজই। সকালের ভেতর আমার লাশটাও গুম করে ফেলবে এরা। হয়তো সকালে এসে আমার লাশটাও আপনারা আর পাবেন না। এক্ষুনি চেয়ারম্যানের কাছে যান।’


আমি ওর দিকে বোকার মতো তাকিয়ে আছি। ওর ফোন-করা শুনে আমি কী করব, কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার মাথায় কিচ্ছু আসছে না। আমি ওকে বললাম, ‘ছিঃ! এটা কী করলে তুমি! ওরা এত দূরে! এখনই তো টেনশনে স্ট্রোক করে মারা যাবে তারা। এটা কী করলে তুমি! কেমনে পারলে এটা করতে? ছিঃ ছিঃ! আল্লাহ, এখন কী হবে!’ তখন সে বলে, ‘দেখ তুই, কী করতে পারি আমি!’


একই কথা ওর বড়ো আপুসহ আরও কয়েকজনকে ফোন করে বলল সে, একই স্টাইলে। এরপর দেখি, সে উঠে রাস্তা দিয়ে দৌড়চ্ছে আর জোরে জোরে বলছে, ‘আল্লাহ, আমার জীবনের মায়া আছে, আমাকে এরা মেরে ফেলবে, আমি পালাই!’ রাস্তার বামে গেলে বড়ো রাস্তায় যাওয়া যায়, সেদিকে না গিয়ে উলটা ডানে যাচ্ছে। ও এটা করছে জাস্ট মানুষকে জানাতে, একটা সিনক্রিয়েট করতে। আর আমি হতভম্ব হয়ে ওর পিছে দৌড়াচ্ছি আর বলছি, ‘প্লিজ, এসব বন্ধ করো, তারা চিন্তায় পড়ে যাবে। ক্ষতি হবে। থামো, যেয়ো না কোথাও। কে কী করবে তোমার! ছিঃ!’ আর চিৎকার করে বলেই যাচ্ছি, ‘দাঁড়াও নিহাল, দাঁড়াও!’


এভাবে দুই মিনিট দৌড়ানোর পর কাঁচা রাস্তা। দুজন লোক ওদিক থেকে হেঁটে আসছে। আমি তাদের অনুনয় করে বলছি, ‘ভাই, একটু ওকে ধরেন!’ কিন্তু তারাও অবাক কাণ্ড দেখে। তারা ধরেনি। এরপর সে থেমে গেল। আমিও গিয়ে ওর হাতটা ধরে কিচ্ছু বলতে পারছি না। বোকার মতো কাঁদছি, আর বাসার দিকে যাবার জন্য টানছি। একটু পর পর আম্মু আম্মু বলে ডাকছি। আসলে সে আমাকে যা দেখাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে, তা আসলেই আমি জীবনেও কল্পনা করিনি বা আমার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে সেও করেনি, এমনই হতো!


ওদিকে কে জানি এসব দেখে বাসায় গিয়ে আম্মুকে বলেছে, ‘দেখে এলাম, আপনাদের মেয়ে আর জামাই দৌড় প্রতিযোগিতা করছে। জামাই দৌড়াচ্ছে, আর মেয়েও পিছে পিছে দৌড়াচ্ছে। বড়োই অদ্ভুত দৃশ্য। শ্বশুরবাড়িতে এসে নতুন জামাইয়ের দৌড় এই জীবনে প্রথম দেখলাম।’ এসব শুনে মা, ভাই আর পাশের কয়জন লোক সেখানে ছুটে এল। ভাই এসে বলল, ‘এসব কী করলে তুমি? কীভাবে বলতে পারলে এত বড়ো জঘন্য মিথ্যা? কে তোমাকে আটকাল? আজ রাতে তোমাদের ঢাকা যাওয়ার কথা। আর কে খুন বা গুম করবে তোমাকে?’ নিহাল বলল, ‘আমি রাগের মাথায় বলে ফেলেছি। তবে এসব মিথ্যা।’ তখন আশেপাশের লোকজন বলল, ‘মিথ্যা যে, সে তো আমরাও জানি। তবে তোমাদের বাসায় যা জানিয়েছ, সেটা কীভাবে মুছবে এখন?’


(চলবে...)