প্রেমান্ধতা/পর্ব-৬

 
আমি এবার সেই মামাকে আর আব্বু-আম্মুকে দোষারোপ করা শুরু করলাম। আল্লাহকেও দোষ দিচ্ছি। কেন আমার লাইফে এত কষ্ট! আব্বু অসুস্থ, ভাই হয়ে গেছে ভাবির, আমার আপন মামা, সেও মারা গেল বাইক অ্যাক্সিডেন্টে, আমার ফুপুও মারা গেল। হেনা আপু ছিল আমার আর-এক বড়ো ছাতা, সেও মারা গেল বাচ্চা ডেলিভারির সময়। এই যে এতগুলি মৃত্যু, এরা একজনও স্বাভাবিকভাবে মরেনি। এক-একটা অস্বাভাবিক কাহিনি। যারা আমার লাইফের ছাতা হয়ে ছিল, সবাই একে একে দুনিয়া ছেড়ে চলে গেল। ভরসা করলাম স্বামীর উপর। ৫ বছরের রিলেশনের পর ১ বছরের কাবিন আর দুইমাসের সংসার, কুরআন ছুঁয়ে শপথ-করা শুধু একজনই বর আমার, যাকে একবার গোপনে, আর-একবার ফ্যামিলির মতে বিয়ে করেছি। সেও এভাবে হারাবে আমার জীবন থেকে! আমি এ শোক কীভাবে সইব? হে আল্লাহ, কাউকে তো পাঠাও যে আমাকে একটু বুঝবে!


আমার ফুপু মাঝবয়সে মারা গেছে জরায়ুর ক্যানসারে। এরপরই দাদি স্ট্রোক করে বিছানা-ধরা, দাদির কয়দিন পর আব্বু অ্যাক্সিডেন্ট করে বিছানা-ধরা, সেখান থেকে কয়দিন পর আমার একমাত্র মামা ২৮ বছর বয়সে রোড অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায় ফেব্রুয়ারির ৩ তারিখ, আর ৮ মার্চে এসে আমার হেনা আপু মারা গেল বাচ্চা ডেলিভারির সময়। চালনার বিশ্বনাথ ডাক্তার ভুলে অন্য নাড়ি ছিঁড়ে ফেলেন, তাই। এখানে একটা মৃত্যুও স্বাভাবিক না। যদিও হায়াত-মওত সৃষ্টিকর্তার হাতে। আমি নিহালকেও বলেছি, আমার লাইফে খুব কাছের এতগুলি মৃত্যু আমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। আর এদিকে অসুস্থ আব্বু তো আছেই। আব্বু মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন হয়ে শুধু বেঁচে আছে মানুষের দোয়ায়। ২২ দিন ঢাকা মেডিকেলে থেকে বেঁচে এসেছে কোনও রকমে। আমি আমার আব্বুর মুখের দিকে তাকাতে পারি না। কলিজা ছিঁড়ে যায়, কারণ আমার আব্বুকে সব দিন এলাকায় নেতাগিরি করে বেড়াতে দেখেছি, আর এখন তার চোখে মুখে কী যে কষ্ট! তাকানো যায় না ওই অসহায় মুখের দিকে। তা-ও ভালো যে আমার আব্বুকে তার আম্মু-ডাকা, বুড়ি-ডাকা আদরের মেয়েকে এতটা কষ্টে দেখা লাগছে না। দেখলেও সে বোঝে না। সে এখন মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন। আমি এসবও ওকে খুলে বলেছি। অনুনয় করে বলেছি যে এত কিছুর পর ও যেন আমাকে এরকম করে আর-এক কষ্ট না দেয়। সে শুধু শান্ত কণ্ঠে বলেছে, ‘আল্লাহকে ডাকো, সব ঠিক হয়ে যাবে।’


এদিকে হায়, আমার অ্যাডমিটগুলি সবই নিহালের ল্যাপটপে ছিল। চেয়ে চেয়ে নিয়েছি। তাই আমার রোল সে জানে। কোথায় সিট পড়ে, তা-ও সে জানে। আমি তখন বোধহয় পঞ্চম- বা ষষ্ঠবারের মতো বাসা থেকে বিতাড়িত হয়ে বান্ধবীর বাসায়। অথচ আমার ২৮ সেপ্টেম্বর পরীক্ষা। আমি পরীক্ষা নিয়ে ভাবছিই না। আমি শুধু সুযোগ খুঁজি নিহালকে একটু কল করার। বান্ধবী আমাকে বোঝাল, ‘পড়োনি তো কী হয়েছে, পরীক্ষাগুলি দাও। প্রিলি তো, বেসিক বা কপাল দিয়ে উতরে গেলেও যেতে পারো। হোক বা না হোক সামনে এগোতে তো হবে।’


পরীক্ষার আগে আম্মু লুকিয়ে লুকিয়ে আমাকে ফোন করে। আব্বু আমার জন্য খুব কান্না করছে। আমি বাসায় না-এলে আব্বু পানিও খাবে না বলছে। আবার চলে এলাম বাসায়। এর ভেতর অনেক কাহিনি ঘটছে, অনেকটা বাই-প্রোডাক্টের মতো। যেমন কেউ করুণা করে, কেউ সুযোগ নেয়, কেউ-বা হ্যারাস করে বা মজা নেয়। দুই-একজন পুরুষমানুষ আমার পাশে এসে দাঁড়াতে চায়, আমাকে মানসিকভাবে সাপোর্ট দিতে চায়। আমি সবই বুঝি আর নিহালের জন্য আরও বেশি করে কাঁদি। বাসায় এসে রেডি হয়ে ২৭ সেপ্টেম্বর রাত ১১টার বাসে পরীক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিলাম। এটাই প্রথম ঢাকা যাওয়া, যেখানে আমার সাথে কেউ নাই, সামনে কেউ নাই। কাউকে কিছুই বলার নাই। আমি ফিরে না এলেও কারও কিছু এসে যাবে না। হয়তো আমি মরে পড়ে থাকলেও খোঁজ নেওয়ার কেউ নেই। কেউ আমাকে চায় না আর। এদিকে আমি ঢাকার ঢ-ও চিনি না।


আমি আমার ঘটনাগুলি বলার চেষ্টা করছি মাত্র। তবে অনুভূতিগুলি আমি কাউকে কোনও দিনই বোঝাতে পারব না। আমি হয়তো অনুভূতি-প্রকাশে খুবই বাজে। তাই পারি না। তবে সব সময়ই মনে হতো, চার-পাঁচজন আজরাইল প্রতিটা মুহূর্তে আমার জানটা ধরে বের করে নেওয়ার জন্য টানাটানি করছে। আমার দম আটকে যেত। নিঃশ্বাস নিতে পারতাম না। আম্মুকে ধরে মারতাম। নিজের বুকে কিল-ঘুষি মারতাম।


আমাদের বাসা তখন বেশ ভেতরে ছিল। গ্রাম্য পরিবেশে। সাত মিনিটের ইটের রাস্তার গলি দিয়ে বের হয়ে এরপর ইজি-বাইক পাওয়া যায়। একাই টিকিট কেটে এসে রেডি হয়ে রাত সাড়ে দশটায় বের হলাম। গাড়ি ধরে ঢাকায় গেলাম। আমার এক বান্ধবী তখন ঢাকাতে আইবিএ-এর ভর্তি-কোচিং করত। এখন জিপিতে এমটিও হিসেবে কর্মরত আছে। ও আমাকে বলেছিল, যদি দরকার হয় ফোন দিতে, ও রাস্তা চিনিয়ে দেবে। বাসে ওঠার জন্য ওই রাত্রে একা বের হয়েছি, তবুও ভাই একটা বার আসেনি। সে তার এক সম্বন্ধী, মানে বউয়ের বড়ো ভাইকে নিয়ে সারাক্ষণই এই সেই কবিরাজের কাছে ঘুরে বেড়ায়। এটাই তার নেশা।


আগে ঢাকায় গেলে আমি বাসা থেকে সব ড্রেসের ছবি তুলে পাঠাতাম, সব দেখে যেটা সে পরতে বলত, সেটাই পরে বের হতাম। কোন বাস, কয়টার বাস, পাশের সিটে ছেলে না মেয়ে, এসব ক্ষণে ক্ষণে জিজ্ঞেস করত। একটু পর পর জিজ্ঞেস করত কতদূর গেলাম। স্ট্যান্ডে পৌঁছুলে সাথে করে নিয়ে যেত বাসায় বা হোটেলে। সেদিন রেস্ট নিয়ে পরের দিন পরীক্ষা দিতে নিয়ে যেত। নিশ্চিন্তে পরীক্ষা দিয়ে সেদিন ঘুরতে নিয়ে যেত। পরদিন বাসে তুলে দিত। এই প্রথমবার আমার কাউকে বলার নাই। সারাপথ মুখ ঢেকে কাঁদতে কাঁদতে গেছি আমি।


আমি ঢাকা পৌঁছলাম। গুলিস্তান বাসস্ট্যান্ড থেকে একটু আগে একটা মোড়ে ভোর পাঁচটায় নামিয়ে দিল। আমি কিছুই চিনতে পারছি না। গুগল-ম্যাপও বুঝতাম না ভালো। রাস্তার পুলিশের কাছ থেকে শুনে শুনে বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে ওটার আশেপাশে একটা বসার জায়গায় বসে আছি। ওখানে আশেপাশে ওরকম অনেক লোকই থাকে সব সময়। এই জায়গাটাতেই আমি নিহালের সাথে বসে থাকতাম। আমি ফিরতি বাস নিতাম একটু লেট দেখেই, যাতে সকালে খুলনা পৌঁছই। আর যতক্ষণ বাস না ছাড়ত, ততক্ষণ সে আমার পাশে বসে বসে খুনসুটি করত। আমি ওর হাত ধরে হাঁটতাম। নিচে নেমে পেয়ারা-মাখা, আমড়া-মাখা, ভেলপুরি, ফুচকা, চানাচুর এসব খেতাম। সবশেষে চা খেয়ে দুজন আবার এসে বসতাম। ওর বাসা থেকে ফোন করলে আমার পাশে বসেও মিথ্যা বলত যে সে বাসার নিচে এসেছে কিছু কিনতে। কখনওই বলত না যে আমি তার সাথে।


আমার পরীক্ষার সময় বসকে ফাঁকি দিয়ে দিয়ে আমাকে নিয়ে এদিক সেদিক যেত। বস একবার ওর সিম ট্র্যাক করে ওকে ধরে ফেলে। অনেক বাজে অবস্থায় পড়ে গিয়েছিল সেবার। জার্নির সময় আমি তার কাঁধে আর সে আমার কাঁধে ভর দিয়ে বসে বসে ঘুমাতাম। যতক্ষণ আমি তার পাশে থাকতাম, একসেকেন্ডও তার হাত আমি ছাড়তাম না। আমি বসে আছি আর ভাবছি, এই যে জানালা দিয়ে নিচে যে মসজিদটা দেখা যাচ্ছে, এটা ছুঁয়ে আগে কতবার সে প্রমিজ করেছে, কখনওই আমাকে ছেড়ে যাবে না। আর আজ? এসব ভেবে ভেবে একা একাই কাঁদছি।


আগের দিন ২৭ তারিখ আমি সারাদিন কিচ্ছু খাইনি। সেদিন ২৮ সেপ্টেম্বর সকাল। তখনও আমার ক্ষুধা নাই। শুধু আছ দুর্বলতা। একটু সকাল হলে নিচে নেমে বাস খুঁজছি। কিচ্ছু চিনি না। আগারগাঁও সিট পড়েছে। কোন বাস যায় জানিও না। একা একা বাসেও উঠতে পারি না। ফ্লাইওভারের নিচে দাঁড়িয়ে আছি। আগেও এই জায়গাটায় আমি অপেক্ষা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। আর নিহাল এয়ারপোর্টের বাসে উঠে চোখ মুছতে মুছতে চলে যেত। আর মেসেজে বলত, ‘নিহালের দেহ যাচ্ছে, মনটা ফ্লাইওভারের নিচে মেয়েটার কাছে রেখে। আমার পাগলিটা!’


আমি বার বার ফোনটা হাতে নিয়ে চেক করি। মনে হতে থাকে, ইস্‌ সে যদি একটা মেসেজ দিত!...এসব ভাবতে ভাবতে খেয়াল করলাম, রিকশাওয়ালা-মামা চেঁচিয়ে বলে, ও ভাবি, এত্ত ফোন টিপলে হয়! আনমনা হয়ে রাস্তায় অনেক মানুষের কথা শুনেছি আমি। নানান উপায়ে, বাজেভাবে। আমি একজন পুলিশের কাছে জিজ্ঞেস করলাম। উনি দেখিয়ে দিলেন কোন দিকে বাসটা পাব। সেখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি বাসের গায়ে কোথাও আগারগাঁও লেখা থাকে কি না। দেখতে দেখতে একটা পেয়ে যাই। খুব কষ্টে উঠি। একদম সামনে ইঞ্জিনের উপরে সিট।


সেই সামনে বসে আমি কাঁদছি। অঝোরে। আমি কিচ্ছু চিনি না। ভয়ও করছে। এক বন্ধুকে কল দিলাম। সে একটু অভয় দিল। বলল, ‘ঠিক জায়গায় নামিয়ে দেবে, ভয়ের কিচ্ছু নাই। সবাই এমন অচেনাভাবেই এ শহরে পা রাখে।’ বাইরে তখন হালকা গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি। সামনে যেতে যেতে কয়েকটা পরিচিত বাস পেলাম। এসব বাসে করে নিহাল আর আমি একসাথে চলেছি বহুবার। আমার কলিজা ছিঁড়ে আসছে। মনে হচ্ছে, এই বাসগুলি আমাদেরই। আমার আর নিহালের বাপ-দাদার সম্পত্তি। আমি কাঁদছি। মনে হচ্ছে, এরকমই কোনও-না-কোনও বাসে ও বসে আছে। আমি ওকে খোঁজার চেষ্টা করছি আপ্রাণ। একটু দেখতে পেলেই লাফ দিয়ে বাস থেকে নেমে ওর কাছে ছুটে যাব।


ওর বাসা খিলক্ষেত, অফিস মিরপুর ডিওএইচএস। আমি জানি না সেসব কোন দিকে। ঢাকা শহরটা পুরোটাই আমার কাছে একই রকম লাগে। এখনও। আমি ওকে কল দিয়েছি। ধরে না। একের পর এক পরিচিত মোড় আসছে, যেসব মোড়ে ওর সাথে যাওয়া হয়েছে কোনও-না-কোনও পরীক্ষায় বা কোনও কাজে। আমার মনে হচ্ছে, এই মোড়টা আমার আপন। এটা আমারই মোড়। আমার বাপের মোড়। আর কারও না। কাঁদতে কাঁদতে শুধুই ফোন চেক করি। হুট করে তার মেসেজ! ‘বাস পেয়েছ, পাগলি? কতদূর এসেছ?’ আমি পাগল হয়ে গেলাম। সারাটা পথই আমার চোখ ভেজা। আমি আবার কল দিলাম। ধরল না।


এবার মেসেজ দিয়ে বললাম, জানি না কোথায় আমি। বর্ণনা দিলাম যে এরকম এরকম মোড়। সাইনবোর্ড পাচ্ছি না নাম দেখার জন্য। তবে ১০-১১ মিনিট আগে উঠেছি। অমুক বাস। অমুক রঙের। সে একটু পর পর মেসেজ দেয় আর জিজ্ঞেস করে, ‘এবার কেমন মোড়?’ আর আমিও মেসেজে বিবরণ বলছি, আর সে জানায় আর কতক্ষণ সময় লাগবে। আমার মনে হচ্ছে, নিহাল আমার সাথে সাথে যাচ্ছে। আহা আহা! আমি তখন বললাম, ‘আমি আসব বাসায়?’ সে বলে, ‘খবরদার! এটা ভুলেও কোরো না।’ আমার আরও দু-এক বন্ধুকে বলেছি আমি এখানে বা ওখানে। ওরা আমাকে ফোনে ফোনে ঠিক জায়গায় চিনিয়ে নিয়ে গেল। নেমে স্কুলটার নাম ভুলে গেছি। একদম মেইন রাস্তার সাথেই স্কুলটা। এক ভাইয়ের সাথে দেখা হলো। আমার এক ফেইসবুক-বন্ধু উনি। সেখান থেকেই জানি, উনি এক বড়ো ভাই। ওইদিনই প্রথমদেখা। মিরপুর কনফিডেন্স কোচিং-এ পড়েন। উনি বিসিএস ছাড়া আর কোনও পরীক্ষা দিতেন না তখন। আগারগাঁও থাকেন। যাচ্ছিলেন কোচিং-এ। মেসেঞ্জারে বলেছিলাম, আমি আগারগাঁও। উনি এসেছিলেন।


উনি আমাকে বেশ সময় দিলেন। একটা বসার জায়গা করে দিয়ে পড়তে বললেন। এর ভেতর নিহাল আমাকে মেসেজের পর মেসেজ দিয়েই যাচ্ছে। দুপুরে পরীক্ষা ছিল। পরীক্ষার দুই ঘণ্টা আগে আমাকে কল দিল নিহাল। কিচ্ছু না বলে সে শুধু হাউমাউ করে শব্দ করে কান্না করছে। আমি বললাম, ‘কান্নাকাটি কেন করছ? আমি তো তোমারই! তোমার জন্যই সব করছি! ছেড়ে যেয়ো না আমাকে। আমি ঘরে বাইরে সব কাজ করে দেবো তোমার। তোমাকে কিচ্ছু ভাবতে হবে না, আমি সবাইকে ম্যানেজ করে ফেলব।’ কান্না কান্না কণ্ঠেই সে জিজ্ঞেস করল, কোথায় কোন স্কুলে সিট পড়ল, পরীক্ষা কখন শুরু, কখন শেষ, হলে কখন ঢুকব, কখন বের হব ইত্যাদি। আমি সব বললাম। বলেই আমি নিজেও হাউমাউ করে কাঁদছি।


লোকজন দেখলে বিপদ হবে ভেবে সামনে আর-এক ফাঁকা জায়গায় গেলাম আমি আর সেই ভাইয়া। আমি ওঁকে সংক্ষেপে বললাম আমার সব ট্রাজেডির কথা। এবার আমি পড়া বাদ দিয়ে বসে বসে কাঁদছি। একটু পর পর আমার বান্ধবী আর নিহাল সমানে ফোন দিচ্ছে। আমি ভেবে নিলাম, পরীক্ষা দেবো না। কেননা নিজের উপর মেনটাল টর্চারটা বেশি হয়ে যাচ্ছে মনে হচ্ছে। এত কষ্টের ভেতর পরীক্ষা দিতে গেলে আমি বোধহয় অজ্ঞানই হয়ে যাব। বান্ধবীকে ফোন করেও ওরকম কাঁদছি। আর বললাম, ‘দোস্ত, আমি পরীক্ষা দেবো না।’ ও আমাকে বোঝাল। পরীক্ষা দিতে বলল। ‘এত সময় টাকা এনার্জি খরচ করে এসেছিস। পরীক্ষাটা দে। টেকা বা না টেকা পরের ব্যাপার।’


আমি আবার বাসায় ফোন দিয়ে আম্মুকে বললাম, ‘আমি পরীক্ষা দেবো না।’ আম্মু নির্বিকার! ‘যা করিস কর গে। আমাকে কেন বলছিস। টাকার গাছ হয়েছে, তাই খরচ করতে গেছিস। তাতে কী।’ মায়ের কথা আমার মাথায় ঢুকল না, আমার শুধুই নিহালকে মনে পড়ছে। আজ সে আমার পাশে থাকলে কী কী করত, কী কী হতো, এসব ভাবছি। আমি পাশের ওই ভাইকে বললাম, ‘আমি পরীক্ষা দেবো না। কারণ আমি ওভারশিওর যে আমি কোয়ালিফাই করব না। আমার নিজের নামটাই মনে আসছে না ক্ষণে ক্ষণে। কী পরীক্ষা দেবো আমি?’ উনি কিছু বললেন না।


পরে আমার আব্বুর অসুস্থতার কথা মনে পড়ল। ঘরে ঢুকলে যেভাবে অসহায়ভাবে আমার দিকে তাকায়, সেটা মনে পড়ল। আমি আবার ভাবলাম, আমি পরীক্ষা দেবো। মরে গেলে যাই। তবু পরীক্ষা বাদ দেবো না। ফরমকেনা থেকে শুরু করে এখানে আসা পর্যন্ত খরচ-হওয়া এই দেড় হাজার টাকা থাকলে আমার আব্বুর এক মাসের ওষুধ কেনা যেত। আমি সেটা নষ্ট করব না। আল্লাহ চাইলে আমি আন্দাজে বৃত্ত ভরাট করলেও সেগুলিকে তিনি সঠিক বানাতে পারেন। আমি ধরেই নিয়েছি, কপাল ছাড়া আর কোনও গতি নাই। আমি এমনিতেও কিচ্ছু পড়ি না। পড়লেও এত কষ্টে কিছু মনে থাকার কথা না। ওই ভাইয়ার কাছে আমি অনেক কৃতজ্ঞ। আমার অবস্থা দেখে আমাকে জোর করে খাওয়ানোর জন্য নিয়ে যাচ্ছিলেন। মোড়ে যেতেই মনে পড়ল, এই জায়গায় তো নিহালের সাথে এসেছি। সোজা দিয়ে ডানহাতেই তো পুরনো বিমানবন্দর, মানে যাদুঘর। আর বামের মোড়ে গিয়ে বামহাতেই ছিল বাণিজ্যমেলা। পাশেই ছিল সবুর ভাই যে মেডিকেলে পড়ে, সেটা।


বাণিজ্যমেলা থেকে নিহাল আমাকে ২০ টাকা করে নেয়, এমন চার-পাঁচ জোড়া কানের দুল কিনে দিয়েছিল। আমি বাসায় গিয়ে দুই ভাবি আর দুই কাজিনকে দিয়ে বলেছিলাম, নিহাল সবার কথা মনে করে কিনে দিয়েছে। সবাই অনেক খুশি হয়েছিল যে মানুষটা তাদেরকে মনে রেখে এসব কিনেছে। আমি শিওর হওয়ার জন্য ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করলাম সামনে বিমান-যাদুঘর কি না। ভাইয়া বললেন, ‘হ্যাঁ।’ আমার এবার মাথার ভেতর থেকে শুরু করে পা পর্যন্ত জ্বলছে। এই তো সেই রাস্তা! ওর হাত ধরে হাঁটছিলাম। মোড় থেকে এমনভাবে আমার হাত ধরে টান দিয়েছিল যে আমি উঁচু জুতা মচকে গিয়ে পড়ে যাই। আর আমাকে দেখে পাশে দাঁড়ানো অনেকগুলি মেয়ে হেসে উঠেছিল। এরপর গলদাচিংড়ির চপ খেতে খেতে খুঁড়িয়ে হেঁটেছিলাম। বাস পাইনি। রিকশায় খরচ হবে বেশি ভেবে ব্যথা-লাগা পা নিয়েও সেদিন হেঁটেছিলাম। এখানে তার আসারই কথা! কোথায় আমার নিহাল! এসব ভেবে ভেবে আমি হুট করে কেঁদে উঠছি, আর নতুন দেখা-হওয়া ভাইয়াটা অনেকটা আনইজি ফিল করছিলেন।


নিহাল আমাকে বিমানবন্দর যাদুঘরে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু টিকিটের দাম বাড়িয়েছিল, তাই যাওয়া হয়নি। অনেকক্ষণ ওই মোড়ের যাত্রিছাউনিতে বসে ছিলাম। অনেক পরে বাস পাই। এসব ভাবছি, আর এদিকে আমার খাওয়ার কোনও অনুভূতিই নাই। আমার নিহালকেই লাগবে! আমার নিহাল কই? শুধুই কাঁদছি আর ভাবছি, নিশ্চয়ই নিহাল আজ এখানে আসবে! কারণ এখানে সে আমাকে এনেছিল একদিন। আর আজই প্রথম আমি একা একা এখানে। বার বার নিহালের ফোন ধরে ধরে আমি কেঁদে কেটে হয়রান। ওদিকে নিহালও কাঁদছে।


পরীক্ষার সময় হল। সেই এনএসআই পরীক্ষার দিন আর-এক ঝামেলা। ব্যাগ বা ফোন কিছুই নিতে দিচ্ছিল না। এটা দেখে ভাইয়াই আমার ফাইলপত্র তাঁর কাছে রেখে আমাকে পরীক্ষা দিতে বললেন। পরীক্ষা দিতে ঢুকব। আগের পরীক্ষাগুলিতে আমি ঢোকার আগে নিহাল আমার সিটপ্ল্যান দেখে দিত, আর বাইরে একটা জায়গা দেখিয়ে দিত। পরীক্ষাশেষে আমি সেখানে গিয়ে দাঁড়াতাম। আজ আমি একাই আমার সিটপ্ল্যান দেখতে গিয়ে মানুষের ভিড়ে হুমড়ি খাচ্ছি। যাওয়ার আগে আমি নিহালের হাতে একটা চিমটি দিয়ে ঢুকতাম। আর আজ…


এক পর্যায়ে আমি পরীক্ষা হলে ঢুকে গেলাম। ভাইয়া বললেন, পরীক্ষাশেষে থাকার ট্রাই করবেন। থাকতে না পারলে এক আন্টিকে দেখিয়ে দিয়ে বললেন যে ওঁর কাছে আমার ফাইলপত্র রেখে যাবেন। পরীক্ষাহলে গিয়ে বসলাম। মন বসছে না পরীক্ষায়। অস্বস্তি লাগছে। নিহালের কথা মাথায় আসছে বার বার। আমার শুধুই মনে হচ্ছে, সে বাইরে অপেক্ষা করছে আমার জন্য। তবু আব্বুর মুখটা কল্পনা করে ঠিকঠাক হয়ে বসলাম।


পরীক্ষা শুরু। মনে হচ্ছে, আমার মতো অসহায় আর কেউই নাই। আধঘণ্টা পরীক্ষা দিয়ে আর পারলাম না। কেঁদে ফেললাম। আমি কাঁদছি। নিঃশব্দে। টপটপ করে চোখের পানি পড়ছে। আমার মনে হচ্ছে, নিহাল এসেছে নিচে। আমার জন্য অপেক্ষা করছে। সে খুঁজছে আমাকে। আমাকে রুমেও দিয়ে যেত আমার নিহাল। আমার পাশে ছেলে না মেয়ে, জানালা দিয়ে সেটাও দেখত। পাশে ছেলে হলে দূরে সরে বসতে বলত ইশারায়। তারপর যেত। আমি এই প্রথম একাকী আছি কোনও পরীক্ষায়। প্রতিটা সিঙ্গেল সেকেন্ডে ওর সব স্মৃতি মিস করতে করতে আমি আর আমি নাই। বদ্ধপাগল লাগছে নিজেকে। শুধু মনে হচ্ছে, এটা হতে পারে না। নিহাল আমারই। শুধুই আমার। নিহাল ছাড়া আমার জীবন মূল্যহীন। আর কিচ্ছু নাই।


মনের সাথে যুদ্ধ করে আমি সর্বোচ্চ ৩০ মিনিট পরীক্ষা দিয়ে আর দিইনি। খারাপেরও একটা লেভেল আছে। আমি যে পরীক্ষা দিয়েছি, এটাই মনে হচ্ছে না, ভালো হবার তো প্রশ্নই আসে না। হলে বসে চোখের পানিতে বাকিটা সময় কাটালাম। খাতা জমা দিয়ে বাইরে এসে দেখি, প্রচুর বৃষ্টি। খুব বড়ো বড়ো বৃষ্টির ফোঁটা। সবাই দাঁড়িয়ে আছে করিডোরে। কেউই নামছে না। আমি ভিড় ঠেলে নেমে এসেছি। কেউই বাইরে আসছে না। অথচ আমি দাঁড়াতে পারছি না। শুধুই মনে হচ্ছে, নিহাল আমাকে খুঁজছে। সে তখন কীভাবে দাঁড়িয়ে থাকত, ভিড়ের ভেতর দিয়ে উঁকি দিয়ে দিয়ে আমাকে খুঁজত, সেসব মনে ভাসছে। আজও নিশ্চয়ই সেটাই করছে। আমার মনে হচ্ছিল, নিহাল বাইরে আছেই আছে! সে না এসে পারে না!


সবাই দাঁড়ানো। আর আমি ঠেলেঠুলে ঝুমবৃষ্টিতে বাইরে এসে সবার মুখের দিকে তাকাচ্ছি। হাজার হাজার লোকের ভিড়ে আমি শুধু একটা মুখ খুঁজছি। আমার চিরচেনা প্রিয়মুখ। আমার নিজের একটা মানুষ! এভাবে ভিজতে ভিজতে আমি বাইরে এসেছি। চোখটা জ্বলে যাচ্ছে পরীক্ষাশেষে একটাই চেনামুখ দেখার জন্য। সব মানুষের মুখের দিকে তাকাচ্ছি। এই বুঝি ওকে পেয়ে যাব! কেউ কেউ ছাতা নিয়ে কাঁধ উঁচু করে হাঁটছে। হঠাৎ দেখি, আমার নিহালের মতোই একজন স্বাস্থ্যবান মানুষ ছাতা মাথায় দ্রুত সামনে এগোচ্ছে। আমি হন্যে হয়ে একনিঃশ্বাসে দৌড়ে গিয়ে লোকটার শার্ট পিছন থেকে টেনে ধরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছি।


লোকটা পিছন ফিরলেই দেখি, এতক্ষণ ধরে যার জন্য তৃষ্ণায় আমার দুচোখ ফেটে যাচ্ছে চৈত্রমাসের বিলের মতো, সে না, অন্য কেউ। আমি ‘সরি’ বলতেও ভুলে গেছি তখন। জানি না লোকটা আমাকে কী ভেবেছিল সেদিন। হয়তো বাজে মেয়ে বা ভিখারি অথবা পাগল ভেবেছে। লোকটাও দাঁড়ায়নি অত বৃষ্টির ভেতর। চলে যায়। আমার এসব কিছুই গায়ে লাগছে না। আমি শুধুই নিহালকে খুঁজছি! সহ্য করতে না পেরে আমি কাদার উপর বসে পড়েছি। বৃষ্টির বড়ো বড়ো ফোঁটার সাথে চোখের পানি মিশে যাচ্ছে। কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। আমার চোখমুখ একদমই ফোলা।


কিছুক্ষণ পর দেখি, ভাইয়া একটা ছাউনির নিচে দাঁড়িয়ে আমাক ডাকছেন। তিনি এসে আমাকে উঠিয়ে নিয়ে গেলেন ওখানে। আল্লাহর কসম, আমি তখনও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছি। এক আন্টি জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার কী হয়েছে, মা?’ ভাইয়াটা কথা কাটিয়ে দিলেন এটা বলে যে, ‘ওর খুব আশা ছিল পরীক্ষা নিয়ে, ভালো হয়নি, তাই কাঁদছে।’ আমি যেন বাঁচলাম আন্টির কৌতূহলমাখা দৃষ্টির হাত থেকে! আমাকে ভাইয়াটা সেদিন যে সাপোর্ট দিয়েছেন, আমার রক্তের সম্পর্কের কারও সাপোর্টের চেয়ে তা কোনও অংশেই কম না। উনি না থাকলে কী হতো জানি না।


এরপর আমরা হাঁটতে শুরু করলাম চন্দ্রিমা উদ্যানের দিকে। ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে সব বলেছি ভাইয়াকে। কীসের জন্য এমন করছি। তিনি আমাকে অনেক বোঝালেন। এরপর অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলাম ফোনের জন্য। আর তার ফোন আসে না। প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করে এরপর আমিই তাকে ফোন দিলাম। সে ফোন ধরল না। কয়েকবার দেওয়ার পর ফোন রিসিভ করল। অত্যন্ত ক্রুদ্ধস্বরে চেঁচিয়ে তার প্রথম কথা…‘কী সমস্যা? কী হয়েছে?’ আমি সত্যিই অবাক হয়ে গেলাম। উত্তর না দিয়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি পরীক্ষার আগে এতবার ফোন দিচ্ছিলে। এখন ফোন ধরছই না। আমি ভেবেছিলাম, তুমি এতভাবে সব খোঁজ খবর নিচ্ছ, নিশ্চয়ই তুমি হলের সামনে আসবে। তাই আমি অর্ধেক পরীক্ষা দিয়ে বের হয়ে এসে তোমাকে খুঁজেছি। পাইনি তোমাকে। অনেক প্রত্যাশা করেছিলাম তোমাকে আজ। তুমি এলে না। তোমার বা আমার আম্মু যেমন আব্বুর স্ত্রী, আপুরা যেমন দুলাভাইদের স্ত্রী, শাস্ত্রমতে এখনও আমি তোমার স্ত্রী। একটাবার কি আসা উচিত ছিল না তোমার? তুমি এলে না। আর প্রত্যাশা করব না। হয়তো শেষ দেখা আগেই হয়ে গেছে। আর জ্বালাব না তোমাকে।’


আমার কথা শুনে সে ছটফট করে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কোথায় আছ এখন?’ আমি বললাম, ‘‘চন্দ্রিমা উদ্যান’ লেখা সাইনবোর্ড রেখে আরও সামনে চলে এসেছি।’ আমি এবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘আসবে?’ কোনও উত্তর নাই। আমি বললাম, ‘তোমার কি একটা বার আসতে বা আমাকে দেখতে মনে চায়নি?’ সে বলে, ‘তুই তোর ভাই আর মামার সাথে আসবি পরীক্ষা দিতে। আমি কী?’ আমি তাকে বোঝালাম, ‘আমার মামা বা ভাইয়ের জায়গায় তুমি থাকলে তুমি আমার জন্য ওদের থেকেও বেশি করতে। আমার তোমাকে লাগবে, ওদেরকে না। যদি আসতেই না চাও, তবে পরীক্ষার আগে কল দিয়ে কান্না করলে কেন?’ সে বলল, ‘ভালো লেগেছিল, তাই।’ আমি বললাম, ‘এখন আর ভালো লাগছে না?’ এরপর সে রাগ দেখিয়ে চেঁচিয়ে মুখ খারাপ করে বলল, ‘ভাব চু*চ্ছিস কেন? কীসের অহংকার রে তোর? সামনে আসিস, জ্যান্ত পুঁতে ফেলব তোকে, খানকি কোথাকার!’ বলেই মুখের উপর ফোনটা কেটে দিল।


আমি আবার ফোন দিলাম কয়েকবার। কেটে দিল। চন্দ্রিমা উদ্যান রেখে আমি সংসদভবনের সামনে এসে গেছি। বান্ধবী ফোন করে জিজ্ঞেস করছে, আমি কোথায় আছি। আর ওকে আমি কেঁদে কেঁদে বলছি সব। নিহাল আমাকে যা যা বলল, সবই বললাম। ও চিন্তায় পড়ে গেল। আর এমন জায়গায় আমাকে কাঁদতে মানা করল। ওর বাসায় যেতে বলল। কিন্তু আমার এতটাই অসহায় লাগছে, মনে হচ্ছে, আমি এই মুহূর্তে আম্মুকে দেখতে চাই। এখনই! রাস্তার কেউ কেউ আমার এইসব পাগলামি দেখে দেখে হাসছে।


সেই ভাইয়াটা তখনও আমার সাথেই আছেন। আমাকে একা রেখে বাসায় যেতে পারছেন না। ভাইয়া আমাকে একটা বুদ্ধি দিলেন। নিহালকে মেসেজ দিতে বললেন যে, ‘আমি গুলিস্তান না, গাবতলি দিয়ে খুলনা চলে যাচ্ছি। তুমি ভালো থেকো।’ আমিও দিলাম। সাথে সাথে সে কলব্যাক করল। কল করে আবারও ছটফট করে বলল, ‘পাগলি রে, তুই কি কখনওই আমাকে বুঝবি না? আমার সাথে দেখা না করে খবরদার যাবি না।’ আমি বললাম, ‘আমার টিকিট কাটা হয়ে গেছে।’ কান্না করে করে নিহাল তখন আমাকে বলল, ‘এক্ষুনি টিকিট পালটাও। ওদের বলো, তুমি পরের বাসে যাবে। টাকা না দেয় তো না দিক। আমি আসছি। পায়ে পড়ি, এভাবে যেয়ো না। আমার সাথে একটাবার দেখা করে যাও।’ আমি অভিমানি কণ্ঠে বললাম, ‘কেন দেখা করব? তুমি তো আমাকে কষ্টই শুধু দাও।’ সে বলল, ‘ঝগড়া করার জন্য হলেও তুমি আমার সামনে প্লিজ আসো।’ আমিও এবার ইমোশনাল হয়ে বলেই দিলাম, ‘আমি আসছি। মিথ্যা বলেছি এতক্ষণ। আমি গুলিস্তানেই আসছি। আমি কি গাবতলী চিনি যে যাব!’ সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘আমিও জানতাম! তুমি আমাকে না দেখে যেতেই পারো না। আমার সোনা পাগলিটা! আসো, আমি এখানেই আছি।’ ফোনে সে আমাকে কী যেন এক নাম বলল বাসের। সেই বাসে উঠতে বলল।


এদিকে বাস না পেয়ে আমি হাঁটতে হাঁটতে ফার্মগেট চলে এসেছি ভাইয়ার সাথে। আম্মুকে ফোন করে কাঁদছি…‘আম্মু, তোমার জন্য আমার প্রাণ পুড়ছে।’ আম্মু জিজ্ঞেস করল সাথে কেউ আছে কি না। আমি বললাম, এক বড়ো ভাই আছেন। আম্মু তাঁর সাথে কথা বলতে চাইল। ভাইয়াকে আম্মু ফোনে বলল যে আমি ঢাকা কিছুই চিনি না। আর এটাই আমার প্রথম একা যাওয়া ঢাকাতে, মানসিক অবস্থাও খারাপ। তিনি যেন আমাকে একা না ছাড়েন। তারপর ভাইয়ার নম্বর নিয়ে রাখল আম্মু।


রাত ৮টার দিকে একটা বাস পেয়ে ভাইয়া আমাকে নিয়ে গেলেন গুলিস্তান। এর ভেতর সে আমাকে বার বার মেসেজ দিচ্ছে আমি কতদূর এলাম, সেটা জানতে। জ্যাম ঠেলেঠুলে পাক্কা এক ঘণ্টা পর রাত ৯টায় গিয়ে এক পর্যায়ে গুলিস্তান পৌঁছলাম। আমি ভাইয়াকে বললাম, সাথে না দাঁড়িয়ে আশেপাশে থাকতে। নইলে আমাকে তাঁর সাথে জড়িয়ে কি-না-কি কাহিনি বানিয়ে দেয়। ভাইয়া মোড়ে থাকলেন। আমি চলে গেলাম স্ট্যান্ডে। গিয়ে দেখি, সে ওখানে দাঁড়িয়ে একজনের সাথে কথা বলছে। আমি স্ট্যান্ডের সিঁড়ির নিচে দাঁড়াতেই সে একপলকে আমাকে দিকে তাকিয়ে আছে। আমি একটু এগোলাম, সেও একটু এগিয়ে এল। আমাকে বলল, ‘চলো, সাইডে গিয়ে দাঁড়াই।’


আমরা স্ট্যান্ডের পেছনে যেখানে ভাঙা অকেজো বাস থাকে, ওখানে গিয়ে দাঁড়ালাম। দুজনেই চুপচাপ তাকিয়ে আছি দুজনের দিকে। একসাথেই দুজনেই বলে ফেললাম, ‘তুমি এত শুকিয়ে গেছ কেন?’ কান্না কান্না চোখে হেসে দিয়ে বললাম, ‘দেখলে? আগেও আমাদের এমন হয়েছে অনেকবার।’ এমন হতো, কল দিলে আমার কল ঢুকত না। পরক্ষণেই ওর কল আসত। আমি বলতাম, ‘এমন হয় কেন?’ সে বলত, ‘দুজনেই একসাথে কল দিচ্ছি, তাই কারও কলই যায়নি। পরে আমি দিয়েছি।’ আবার প্রায়ই এমন হতো, আমিও মেসেজ দিয়েছি, ‘কী করো?’ মেসেজ সেন্ড হবার আগেই ওর মেসেজ চলে আসে, ‘কী করো?’ আমরা তখনই একবার করে ভেবে নিতাম, আল্লাহ আমাদের দুজনকে দুজনের জন্যই পাঠিয়েছেন, তাই এমন হয়। না হলে কই খুলনা, আর কই নড়াইল! কীভাবে মিলত!


যা-ই হোক, আমি বললাম, ‘আমার তো শুকানোরই কথা। আমি যে স্বামীহারা, আমি যে ভালোবাসাহারা। কিন্তু তুমি তো আমাকে ছাড়া ভালোথাকার জন্যই আমাকে ফেলে চলে এসেছ। তোমার কেন এমন হলো?’ সে বলল, ‘আমার চার কেজি ওজন কমে গেছে।’ ‘চার কেজি!!! কীভাবে??? যে তুমি ডায়েট করেও পঞ্চাশ গ্রাম ওয়েট কমাতে পারতে না, উলটা বেড়েই চলত, প্রতি তিন-চার দিন পর পর ওজন মাপতে, কিন্তু বাড়তি ছাড়া কমতি হয়নি কোনও দিনই। সেই তুমি আজ মাত্র উনসত্তর কেজি???’


ওর ওয়েট ছিল তিয়াত্তর কেজি। আমি থাকতে ওর ভাতটা পর্যন্ত মুখে তুলে খাইয়ে দিতাম। বাসায় ঢোকার পর থেকে বের হওয়া পর্যন্ত তার কোনও কাজ ছিল না। কাজের মধ্যে ছিল ল্যাপটপে মুভি বের করা, আর ওয়াশরুমটা করা। বাকি সব দায়িত্ব আক্ষরিক অর্থেই আমার। ওর সব কাজ করতে আমার ভালো লাগত। তার পিউবিক হেয়ার পর্যন্ত রিমুভ করার দায়িত্ব ছিল আমার। তাকে কখনও সেলুনে যেতে হতো না, আমিই চুল দাড়ি কেটে দিতাম। আমার যত্নের কারণে ওর ওজন কোনওভাবেই কমত না। আর এদিকে আমার ওজন দিন কে দিন কমতে কমতে আমি হাড্ডিসার হয়ে যাচ্ছিলাম।


নিহাল আমাকে একদিন বলছিল, আমি খুলনা এলে নাকি সবাই আমার দিকে তাকিয়ে নিহালকে দোষারোপ করবে যে নিহাল মনে হয় আমাকে খেতে দেয় না। আমি বলেছিলাম, ‘আমার ফ্যামিলি এমন না। তারা কখনওই এমন এসব বিষয় নিয়ে প্রশ্নও করবে না।’ কথাটা অবশ্য ও অন্যভাবে নিয়েছিল। ভেবেছিল, আমাকে কেউ ভালোবাসে না। মুখে তুলে বলেছিল আমাকে, ‘সানজিদা, তোমার ফ্যামিলি আমার হাতে তোমাকে দিতে পেরে মহাখুশি। বেঁচে গেছে চিরতরে। তুমি আসলে ওদের বোঝা ছিলে। বয়স হয়েছে তো!’ শুনে আমি কিছু বলিনি। ভেবেছি, কথায় কথা বাড়বে, অশান্তি বাড়বে। থাক!


ওর হাইট ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি, আর ওজন ৭৩ কেজি। উচ্চতার তুলনায় বেশ ভারী ছিল সে। তাই হাঁটতে হাঁটতে পায়ের ফাঁকে ঘষা লেগে লেগে ঘা হয়ে থাকত, আর তার পায়ের আঙুলে শক্ত শক্ত কড়া ছিল। এই দুই জায়গায় প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা মলম দেওয়া লাগত। আমি নিজের গায়ের ক্ষতে মলম দিতে ঘেন্না করলেও ওর গায়ে দিতে গিয়ে ব্যাপারটা নিয়ে কখনও ঘেন্না করিনি। খুব ভালোবেসেই আমি কাজগুলি করতাম। অথচ ওদের বাড়িতে যখন কুরবানির ঈদে গেলাম, তখন ওর আম্মু আর বোনেরা ওর মুখে হাত দিয়ে বলেছিল, ‘ইস্‌! মণি, তুই তো একদম শুকিয়ে গেছিস রে! সানজিদা কাজকাম পারে না তো, রান্নাবান্না হয় না হয়তো। খেতে পারিস না ঠিকমতো, তাই না?’ ও কোনও প্রতিবাদ করেনি সেদিন, শুধু হেসেছিল। আর এদিকে আমার হাড্ডিসার আর কালো হওয়াটা ওদের কারও চোখেই পড়েনি।


একবার ওর জ্বর হয়েছিল। ওই সময়গুলিতে আমি রাত জেগে জেগে গামছা ভিজিয়ে ওর মাথায় জলপট্টি দিতাম। হাত পা টিপে দিতাম। আর প্রতিদিন ঘুমানোর সময় ওর চুলে বিলি কেটে দিতাম, যাতে ভালো ঘুম হয়। ঘুমিয়ে গেলে আমি হাঁ করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। ঘুমন্ত নিহালের দিকে ঠায় তাকিয়ে থাকতে কী যে ভালো লাগত! ও ঘুমিয়ে পড়লে ওর চোখে মুখে যেন পুরো পৃথিবীর সৌন্দর্য ভর করত! আর ভাবতাম, ভালোবাসা কী এক রহস্য রে! যে আমার রক্তের কেউই না, জেলারও কেউ না, এমন একটা মানুষের প্রতি আমার এত্ত টান! আম্মুর কথাও মনে পড়ে না এখন, শুধু এই মানুষটাকে ছাড়া অন্য কিছুই ভাবতে পারছি না। ও ঘুমিয়ে থাকলে ওর চোখে কপালে চুমু দিতাম, আর সাথে সাথে নানান ভঙ্গিতে যত বেশি পারি, সেলফি তুলে নিতাম৷ কারণ ওর সাথে আমি সেলফি তুললে ও খুবই বিরক্তবোধ করত।


একবার একটা পরীক্ষাশেষে সে আমাকে যমুনা ফিউচার পার্কে নিয়ে গিয়েছিল। সব দেখে ফেরার সময় একদম এন্ট্রি-গেইটের সামনে সবুজ একটা গাছ আছে, ওটার সামনে নানান বয়সের, নানান পোশাকের মানুষ সেলফি তুলছে দেখেছিলাম। ওখানে ওর সাথে একটা সেলফি তুলতে চাইলাম। সে রাজি তো হয়নি, উলটা আমাকে ক্ষ্যাত, আনস্মার্ট, গাঁইয়া বলে গালি দিছিল। অভিমানে আমি আমার হাতঘড়িটা খুলে আছাড় মেরেছিলাম। ও সেটা রাস্তা তুলে এনে আমাকে একটা মোটা পিলারের সাইডে নিয়ে আমাকে পায়ের স্যান্ডেল খুলতে বলে। আমি খুললে সে তার বুটজুতা দিয়ে আমার পা তার সর্বশক্তি দিয়ে চেপে চেপে পিষে দিচ্ছিল। আর ফিসফিস করে বলছিল, ‘খবরদার মাগি, চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাক। টুঁ শব্দ করলে আজকে তোর কপালে খারাবি আছে।’ আমি বললাম, ‘আমি অনেক ব্যথা পাচ্ছি তো!’ সে বলল, ‘খানকি, চুপ করে থাক, ব্যথা পা তুই! সহ্য কর, নরমাল ফেইসে থাক। নইলে তোর খবর আছে আজকে।’ তাতে আমার পা ছিলে মাংস দেখা যাচ্ছিল, অনেক রক্ত বেরিয়েছিল। সেদিনের পর থেকে ওর সাথে সেলফি তুলতে গেলে আমি কয়েকশোবার ভাবি।


সেলফি তোলা নিয়ে আরও অনেক অনেক কাহিনি আছে। সেসব ছয়টা বছরের কাহিনি, সব বলা সম্ভবও না। তবু দু-একটা না বলে পারছি না।


(চলবে…)