প্রেমান্ধতা/পর্ব-৭

 
একবার ঢাকা রিজেনসির সামনের ফুটওভার-ব্রিজের উপরে সন্ধ্যার পর আমার পেছনে গাড়ির লাইট রেখে ওই অবস্থায় ছবি তুলতে চেয়ে অনেক অপমানিত হয়েছিলাম আর এক পর্যায়ে মারও খেয়েছিলাম। অবশ্য ওর বন্ধু দুলু ওভাবে ছবি তুলেছিল, ওর দেখাদেখি এরপর আমি তুলতে গেলে সে আমাকে বন্ধুর সামনেই ক্ষ্যাত, গাঁইয়া বলে গালি দেয়, কিন্তু ওর ফ্রেন্ডকে সে কিছু বলে নাই। বন্ধু ওকে যখন বলল, ‘থাক, বাদ দে।’, ও তখন বলে, ‘এই ফালতু মেয়েটাকে নিয়ে যে কী কষ্টে আছি, তা যদি বুঝতি, তাহলে তো হতোই!’ আমি ওর দিকে চুপচাপ তাকিয়ে ছিলাম। আমি আসলেই বুঝতে পারতাম না, এমন সময় কী বলতে হয়।


যা-ই হোক, সে কেন শুকিয়েছে, সে সম্পর্কে কিছুই বলেনি স্পষ্ট করে। আমাকে জিজ্ঞেস করল সামিনা (আমার পাকনা ভাইজি) তার কথা বলে কি না। আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, সামিনা সব সময় ফুপা ফুপা করে। বাসায় কেউ এলেই তার সাথে গল্প করে, ‘আমার ফুপিকে নআইল বিয়ে দিয়েছি। আমার ফুপা ইঞ্জার (ও আসলে ‘ইঞ্জিনিয়ার’ বলতে চায়)। সে ঢাকায় আছে। আমার জন্য অনেকগুলি পটেটো আর চিপস আনবে ফুপা।’’ আমি এবার ওর হাত দুইটা ধরে ওর চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বাবু, তুমি কি আমাকে আর ভালোবাসো না?’
- বাসব না কেন?
- তাহলে আমার ফোন কেন ধরো না? ফোন কেন দাও না? কী বলে এসেছিলে আর কী করলে বাসায় ফিরে গিয়ে?
- হুমম্‌…
- কী হুম? আমাকে চাও না আর?
- বাসা থেকে যা করবে, তা-ই। আমার নিজের কোনও মতামত নাই এখানে।
- বাসা যা করার করুক গিয়ে! কিন্তু তোমার মনে কী আছে, বলো না প্লিজ। ভালোবাসো না??
- বাসব না কেন?…আজব!
- কাউকে ভালোবাসলে তাকে ছাড়া দেড় মাস থাকা যায়?
- দেখো, বাসা যা বলবে, সেটাই হবে। আমার আর কিছু বলার নাই।
- কেন তোমার কিছু বলার নাই? কেন? তাহলে বললে যে ভালোবাসো? তা কি তবে মিথ্যা? ওই মসজিদটা আমাদের প্রেমের সাক্ষী। অনেক প্রমিজ করেছিলে ওটা ছুঁয়ে। সেটা কী ছিল তবে? এখন বলতে পারবে আবার?
আমাদের দুজনের হাত একসাথে মসজিদ ছোঁয়া তখন। আমি ওকে বলছি, ‘বলো তো এখন। তোমার মনে সত্যি এখন কী বলে?’ সে বলল, ‘বাসব না কেন? আজব!’ আরও বলল, ‘দেখো সানজিদা! ভালোবাসা মানে শুধু একটা মেয়ে না। ভালো থাকা মানে শুধু একটা ছেলে একটা মেয়ে না। সবাইকে নিয়েই ভালোবাসা।’ আমি বললাম, ‘আমি তো সবাইকে নিয়েই ভালো থাকতে ও ভালোবাসতে চেয়েছি। আমি তো যৌথ পরিবার পছন্দ করেছি আজীবন। একা থাকতে চাইনি তো কখনও!’


ও হয়তো বোঝাতে চেয়েছে, ওর বাসার কেউই আমাকে চায় না। তাই আমাকে নিলে সবাই তাকে ছেড়ে যাবে। কিন্তু আমার পাগল মন যে এসব কিচ্ছু বুঝতে চায় না। আমি অনেক বোঝালাম তাকে। দেড় মাস পরে ওকে পেয়ে আমার মনে হচ্ছে, আমার পেটটা চিরে ওকে সেখানে আটকে রাখি। যেন কেউ ছিনিয়ে নিতে না পারে। ওকে অনেক বোঝাই, কোনও কাজ হয় না। আম্মু ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করল আমি কোথায় আছি। আমি বললাম, ‘আমি স্ট্যান্ডে। নিহাল এসেছে, আম্মু। একটু বোঝাও না ওকে!’ বলেই ফোনটা নিহালের কানে ধরেছি।


দেখি, সে আম্মুকে অসম্মান করে করে কথা বলছে। আম্মু জিজ্ঞেস করেছিল, ‘নিহাল তুমি কি আসলেই ওকে চাও না? না কি চাও? চাইলে তোমার বউ তুমি নিয়ে যেতেই পারো। আর না-চাইলে কেন তাকে এভাবে উঁকিঝুঁকি দিয়ে কষ্ট দিচ্ছ? তুমি আমাদের না-চিনলেও সানজিদাকে তো চিনো। তাই না?’ এর জবাবে সে খুব চেঁচিয়ে বাজেভাবে রিঅ্যাক্ট করে। ‘ওহ্‌ আমার দেখা করতে আসাটাই ভুল ছিল, নাহ্‌? ভুল করেছি আমি? আর আমি চাই কি না মানে কী? কাকে আনতে যাব? কেন? আপনাদের মেয়েকে বোঝান, আমাকে এসব কেন বলেন? আমি কি ওকে বিরক্ত করি নাকি? সে-ই তো আমাকে বিরক্ত করে! লজ্জা করে না আপনাদের? আমার টাইম নাই আপনার সাথে কথা বলার৷ ফোন রাখেন আপনি। যত্তসব!’ বলেই ফোনটা আমাকে দিয়ে দিল। আর কথাই বলল না। আমি এবার ওকে অনেক রিকোয়েস্ট করছি, ‘প্লিজ বাবু, ঠান্ডা হও। রাগ কোরো না।’ তখন নিহাল বলল, ‘আমি চলে যাব। আমার এখানে আসাটাই ভুল হয়েছে।’


আমি তখন নিচে বসে পড়ে ওর পা চেপে ধরেছি। ‘প্লিজ, যেয়ো না। তুমি তো যাবেই। কিন্ত এভাবে যেয়ো না। আর আমাকে একটাবার বলো, তুমি আমাকে চাও কি না, তুমি আমাকে ভালোবাসো কি না।’ হাজারবার প্রশ্ন করেও সোজা উত্তর পাইনি। তার একটাই কথা, ‘ফ্যামিলি যা করবে, তা-ই হবে। এখানে আমার কোনও কথা নাই।’ ওর পা ধরে কান্নাকাটি চলল প্রায় আধঘণ্টা বা একঘণ্টা, খেয়াল করিনি। এরপর থেকে আর ঘড়ি দেখাদেখি নাই। ওর পা চেপে ধরে ওকে অনেক বুঝিয়েছি। ভালোভাবে মন্দভাবে কেঁদে অভিমানে…সবভাবে। অসহায়ভাবেও। বলেছি, ‘আমার যে তুমি ছাড়া আর কেউই নাই। আব্বুও কতটা অসুস্থ! আমি কই যাব! আমাকে ছেড়ে যেয়ো না।’ এসব বলছি আর ডুকরে ডুকরে কাঁদছি।


আমি অনেকক্ষণ তার পা ধরে কান্নার পর সে আমাকে জোরে লাত্থি দিয়ে পা ছাড়িয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছিল। আর বলছিল, ‘এইখানে আর এক মুহূর্তও না। আমি চলে যাব। এখানে আসাটাই আমার ভুল হয়েছে।’ ওর লাথি খেয়ে আমি একটু দূরে ছিটকে পড়েছি। ওর কথা শুনে আমি দ্রুত উঠে ওর শার্টটা পেছন থেকে শক্ত করে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলছিলাম, ‘প্লিজ, এভাবে যেয়ো না। আমার উত্তরটা তো দিয়ে যাও…’ তখন আশেপাশের দু-একজন এসব টের পেয়ে গেল। তারা এসে থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে এখানে?’ তারা প্রথমে ভেবেছে, প্রেমের সম্পর্কে সর্বনাশ করে সে চলে যাচ্ছে, এমন কিছু। তারা নাকি অনেকক্ষণ ধরে আমাদের বাসের পেছনে দাঁড়িয়ে কথাবার্তা-বলা, আমার ওর পা-ধরা বা আমার রিকোয়েস্ট-করা, কান্না, আমাকে ওর লাথি-মারা এসব দেখেছে। আমাদের দুজনের কাছে এসে ওরা শুনল। শুনে ওর কলার আটকে ধরল একজন। ধরে ওকে জেলে দেবে বলছে। আমি সেই লোকটার প্রতি খুব রেগে গেলাম। আমি বললাম, ‘আমার স্বামীর কলার ছাড়েন। আপনাদের তো সে কিছু করেনি। যা করার আমাকে করেছে। আপনাদের কী সমস্যা? আপনারা কেন তাকে অপমান করছেন?’


ওই লোকগুলি এবার বাসস্ট্যান্ডে বলে ওখানকার দুই-চারজন গন্যমান্য লোককে ডেকে ওকে একটা রুমের ভেতর বসিয়ে জিজ্ঞেস করছে, সে আমাকে কী করতে চায়। নিহাল স্পষ্ট করে ওদেরকে জানিয়ে দিল, ‘আমি ওকে চাই না। ও আমাকে শুধু শুধু বিরক্ত করছে। ও আমাকে জোর করে এখানে এনেছে। আনার পর ও আমাকে আটকে রেখেছে। এখন আমার ফ্যামিলি যা বলবে, আমি সেটাই করব। আমার নিজের চাওয়াও ওটাই।’ তখন ওরা আমাকে ডেকে এবার বলল, ‘দেখো বোন, ওকে জেলে দিতে চেয়েছি। আর তুমি আমাদের উপর রাগ করলে! সে তো তোমাকে চায়ই না।’ এরপর নিহাল ওদের কী কী বলেছে, সেগুলি ওরা আমাকে বলল। সে মুহূর্তে আমি আমার কানকে বিশ্বাস করতে পারিনি। আমি বললাম, ‘না। ও এটা বলতেই পারে না। ও আমাকে ভালোবাসে।’


এবার আমাকেও ওই রুমে ডেকে নিয়ে ওর সামনে বসিয়ে ওরা ওকে আবার জিজ্ঞেস করল, নিহাল আবারও মাথাটা নিচু করে সুন্দর করে ছোট্ট ছোট্ট স্বরে বলল, ‘এত কিছুর পর আমার দ্বারা সংসার-করা সম্ভব না। আর আমার ফ্যামিলি যদি ওকে নিতান্তই চায় তো সেটা ভিন্ন কথা। না চাইলে আমার কিছুই করার নেই। ও আমাকে আর বিরক্ত না করলে আমি খুশি হব।’ আমি এবার রাগে দুঃখে কষ্টে বমি করে দিয়েছি।


২৭ তারিখ সারাদিন সারারাত, এরপর ২৮ তারিখ সারাদিন শেষে রাত চলছে, আর আমি এক ফোঁটা পানিও ছুঁতে পারছি না। অল্প কয়দিন আগে প্রেশার মাপিয়েছিলাম। প্রেশার ছিল উনষাট বাই পঁয়ত্রিশ। অনাহারে, কান্নায়, টেনশনে আমি যেন কবরে অর্ধেক পা নামিয়ে ফেলেছি। আমি তখন মাথা গরম করে পাগল হয়ে এক কাজ করে ফেললাম। আমি বমি করার পর আবার রুমে ঢুকে বললাম, ‘তুই আমাকে এটা কী শোনালি, অমানুষ! মানুষ এত খারাপ কেমনে হয়! মানুষ এমন হতে পারে না। আমাকে এটা শোনানোর আগে আমাকে মেরে কেন ফেললি না।’ বলেই ওর পায়ের আঙুলের দিকে রাগে ক্ষোভে আমার পা দিয়ে একটা গুঁতো দিয়েছি। এই কাজটা আমি সহ্য করতে না পেরে করে ফেলেছি।


ওইখান থেকে কয়েকজন আমাকে হসপিটালে আর ওকে জেলে নিতে চাইল। আমি নিজকে আবারও সামলে বললাম, ‘আমি এমনিতেই দেড় মাস টেনশনে শেষ, আর লাস্ট দুই দিন পানিও ছুঁইনি, তাই বমি হয়েছে। আমার হসপিটালে নেবেন না, প্লিজ। বাসায় গেলে আমি সুস্থ হয়ে যাব।’ এটা শুনে ওরা দৌড়ে গিয়ে আমার জন্য রুটি, কলা, পানি, কিছু পটেটো-চিপস আর মিস্টার-টুইস্ট এনে আমাকে খেতে বলল। কিন্তু পানি ছাড়া আমি কিচ্ছু খেতে পারিনি। পানি খেয়ে দেখি আর-এক জ্বালা। না খেয়ে ছিলাম, ভালো ছিলাম। এবার দেখি, আমার সারাশরীর কাঁপছে। ও একবারও আমার দিকে এগিয়ে আসছে না, বরং বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে আছে। দেখি, একজন নিহালের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলছে, ‘এহহ্‌ ধর একে, হারামির বাচ্চা অমানুষরে আজ জেলে দেবো। ফোন দে এর বাপরে।’ আমি তখন আবার দৌড়ে গিয়ে সামনে গিয়ে পড়েছি। ওর কোলের উপর বসে সবার দিকে দুইহাত তুলে বলেছি, ‘আপনারা কেউ আমার স্বামীর সাথে এমন করবেন না, প্লিজ। কেউ জেলের কথা বলবেন না, প্লিজ। আমরা দুজন সব মিলিয়ে নেব।’ কিন্তু কোনও কাজই হচ্ছে না।


বাসস্ট্যান্ডে আমার পরিচিত অনেক সিনিয়র আপু ভাইয়ারা। সবাই পরীক্ষা দিয়ে খুলনা ফেরার জন্য বাসের অপেক্ষায়। তবে আমার এই রূপে অনেকেই চিনতে পারেনি। হয়তো কেউ কেউ চিনেছেও। ডিভোর্সের অনেক পরে আমার এক ফ্রেন্ড ফেরদৌস, ইকোনমিক্স ডিসিপ্লিনে পড়ত, আমার ইয়ারমেট, সে ফোনে বলেছিল, সে সবই দেখেছে ওইদিন। তবে পাছে আমি লজ্জা পাই, তাই সে সামনে আসেনি বা কথা বলেনি। আমি বললাম, কেন আসোনি? তোমারই তো সামনে আসার কথা ছিল। সামনে এসে অট্টহাসি দিতে, আর বলতে, ‘সানজিদা…দেখ, তোর ভুলের শাস্তি। ফুল রেখে কাঁটার দিকে হাত বাড়ানোর প্রতিদান। নে, কড়ায় গন্ডায় বুঝে নে!’ ওই ছেলেটার পুরো নাম ফেরদৌস ইসলাম। আমার ইয়ারমেট। ইকোনমিক্সের খুব ভালো ছাত্র। দেখতে গোলগাল গড়ন, ফরসা করে। ওর ফ্যামিলিও আমাদের মতো আইলায় সব হারিয়ে নতুন করে জীবন গড়েছিল শুধু ‘পড়ালেখা’ নামের পুঁজি আর অজস্র স্বপ্ন বুকে নিয়ে। ছয় ভাই ওরা। একজন বাদে সবাই যার যার ক্লাসের ফার্স্ট বয়। ফেরদৌস সবার বড়ো। ওদের ডিসিপ্লিনের সেরা খেলোয়াড়দের মধ্যে একজনও সে। খুবই ভালো খেলে। মানুষ হিসেবেও সোজাসাপটা নিরেট।


সে তার জীবনে বুঝতে শেখা থেকেই আমাকে না দেখেই অনেক পছন্দ করত। আমার এক কাকার সাথে একই রুমে থাকত। কাকা আমাকে নিয়ে ওর সাথে গল্প করত। বলত, আমি পড়াশোনা ছাড়া কিচ্ছু বুঝি না, আড্ডা, ঝগড়া, পাড়ার হুড়োহুড়িতে আমি নাই। যে স্কুলে আমার বাপ-দাদা পড়েছে, যেখান থেকে কেউ কখনও স্ট্যান্ড করেনি বা এ-প্লাস পায়নি, সেখানে থেকে আইলার পর রাস্তার উপর ঝুপড়িতে থেকে এনজিও’দের ত্রাণ খেয়ে আমিই প্রথম এ-প্লাস পাই, একুশেটিভি চ্যানেল থেকে আমার উপর প্রতিবেদন করে, প্রথম আলো, দৈনিক পূর্বের দিশা পত্রিকায় অদম্য-মেধাবী কলামে নিউজ হয়, ডাচ-বাংলা ব্যাংকে আমি স্কলারশিপ পাই, এসব শুনতে শুনতে মনে মনে সে আমাকে ভালোবেসে ফেলে। কাকা জানত না আমি কোন ডিসিপ্লিনে পড়ি। তাই শুধু আমার নামটা ভরসা করে ব্যাচমিটিং-এ খুঁজে খুঁজে সে আমাকে বের করে। এরপর পরিচিত হয়। পরে এগুলি সব বলেছিল আমাকে। ক্যাম্পাসে গেলে কারণে অকারণে আমাকে ডেকে আমার সাথে সময় কাটানোর বা ভালোভাবে মেশার চেষ্টা করত সে।


সাইফুরস ম্যাথ সলভ করার অজুহাতে আমাকে প্রায়ই ফেরদৌস লাইব্রেরিতে ডাকত। একদিন প্রপোজও করেছিল। কিন্তু আমি ওকে সব সরাসরি বলে দিয়েছিলাম যে নিহালের সাথে আমার রিলেশন। আমি নিহালকে খুব ভালোবাসি। ব্রেইন থেকে তাকে মোছা সম্ভব না। এসব কথা ওকে বলার পরও ও আমাকে পছন্দ করত। আমার কাছে প্রায়ই নিহালের কথা শুনত আর বলত, ‘এই সম্পর্ক টিকবে না। ও তোমার মূল্য বুঝবে না।’ শুনে আমি রাগ করতাম ওর উপর। ভাবতাম, ও এসব বলছে ঈর্ষান্বিত হয়ে। ও চায় না, আমাদের সম্পর্কটা বেঁচে থাকুক। যখন নিহালের সাথে ঝগড়া করে আমার মন খারাপ থাকত, তখন ফেরদৌস আমাকে ফোন করে ক্যাম্পাসে ডেকে নিয়ে হাসির গল্প বলে বলে মন ভালো করে দিত। নিহালের সাথে ঝগড়া করে ফোন ভেঙে ফেলতাম। ফেরদৌস সেটাও শুনে তার এক্সট্রা একটা স্মার্টফোন আমাকে চার-পাঁচ মাসের জন্য দেয়। আমার ল্যাপটপে কোনও ঝামেলা হলে ও বাসায় এসে নিজের ল্যাপটপটা দিয়ে যেত।


আমি এর সবই নিহালকে বলতাম। নিহাল ফেরদৌসকে ‘আলু’ ডাকত। আর খুবই হিউমিলিয়েট করে করে কথা বলত। আমার আম্মুও ফেরদৌসকে পছন্দ করত। কিন্তু আমি যে অন্য কোথাও কমিটেড! আর আমার ফেরদৌসের উপর ওরকম কোনও ফিলিংস আসত না। আমার একমাত্র ধ্যান জ্ঞান স্বপ্ন নিহালই। পরে আমি বিয়ে করে ফেললে ফেরদৌস এক বছর অনেক কান্নাকাটি করেছে। এমনকি অসুস্থ হয়ে সাইকিয়াট্রিস্ট দেখিয়েছে। পরে সে ন্যাশনাল ভার্সিটির এক মেয়েকে বিয়ে করে নিয়েছে। ৪০তম রিটেন দিয়েছে, আর রুপালী ব্যাংকের ক্যাশ অফিসার হিসেবে চাকরি পেয়ে এখন বউ নিয়ে রংপুরে আছে। সে খুব ভালো আছে। তাই ওকে বললাম, ‘তুমি কেন সেদিন সামনে এলে না? আসা উচিত ছিল। এসে অট্টহাসি দিয়ে যেতে। আমার তো জ্ঞানের অভাব আছে!’ ফেরদৌস তখন বলল, ‘নাহ্‌। তুমি তো আমাকে ঠকাওনি। আমাকে তো সব জানিয়েছিলেই। তোমার কী দোষ? আর আমি সামনে গেলে তুমি অপমানবোধ করতে, তাই যাইনি।’


যা-ই হোক, যেহেতু তারা আমার কথা শুনছে না, তাই আমি আম্মুকে ফোন করে ওদের কাছে ফোনটা ধরিয়ে দেওয়ার আগে আম্মুকে বললাম, ‘ওদের বলো নিহালকে জেলে না দিতে।’ আম্মু ওদের বলল, ‘আপনারা অনেক করেছেন, ধন্যবাদ। কিন্তু ওকে জেলে দেবেন না। ও আমাদের মেয়েজামাই। আমরা দেখব।’ নিহালও আমাকে খুব রিকোয়েস্ট করে বলছিল, ‘প্লিজ, আমি তোমার সাথে খুলনা যাব। আমাকে যেন জেলে না দেয়, তুমি একটু দেখো। আমরা সারাজীবনই একসাথে থাকব। আমি তোমাকে ভালোবাসি।’ ওরা আম্মুর কথা শুনল। আমরা এ যাত্রায় বাঁচলাম। কিন্তু ওই লোকজন বলল, নিহাল যেন তার ফ্যামিলি নিয়ে খুলনা এসে সব মীমাংসা করে। নিহালও রাজি হলো। এরপর নিহালের বাসায় ফোন দেওয়া হলো। নিহাল সাইডে গিয়ে ফোনে আবারও বানিয়ে বানিয়ে কথা বলা শুরু করল। ও বাসায় বলল, আমি নাকি পরীক্ষার অজুহাত দিয়ে ঢাকায় এসে লোকভাড়া করে ওকে আটকিয়েছি। ও আবার আগুন ধরিয়ে দিল ওর বাসার সবার মাথায়।


এদিকে ওখানকার লোকজন নিহালের উপর ভরসা পাচ্ছিল না। সবাই বলছে, এই ছেলে মাঝপথে গিয়ে মেয়েকে ফেলে দৌড় দেবে। খুলনা যাবে না। ওই মুহূর্তে একটা ছেলে এগিয়ে এল। সে নিহালকে বলল, ‘কী ভাই? প্রয়োজন শেষ, মেয়ের চেহারা নষ্ট হয়ে গেছে, আর মেয়ে খারাপ হয়ে গেল? এক্ষুনি বাদ দিয়ে দিতে হবে?’ ওই লোকটাও নাকি খুলনা আসবে ওই রাতে। এগিয়ে এসে দায়িত্ব নিল নিহালকে সহিসালামতে খুলনা নিয়ে আসার। আমি বা নিহাল কেউই তাকে চিনি না। ওখানকার লোকজনও রাজি হয়ে গেল যে ওই ছেলেটা আমাদের দুজনকে খুলনা আনবে। টিকিট কাটা হলো। রাত দুইটার গাড়ি। একদম লাস্ট ট্রিপ। সিট পাচ্ছিল না। ইঞ্জিনকাভারে নিহাল, বাস কন্ডাক্টরের ছোট্ট সিটটায় সেই ভাইটা৷ পরে ভাইয়ার নাম শুনলাম মুস্তাফা। আর একদম শেষ লাইনের শেষ সিটে বসে আছি আমি।


বাস ছাড়ার একটু আগে এসে ওখানকার দুই-তিনজন আমার নম্বর নিয়ে গেল। আর কিছু খাবারও দিয়ে গেল। এখন আমি তো সেটা নেব না। কিন্তু তারা খুব করে বলছে নিতে। আমার মতো বোন তাদেরও আছে, এমনভাবে আমাকে দেখে তাদের খারাপ লাগছে। আমাকে ওরা বোন বলে ডাকল। তখন নিতে রাজি হলাম। ওদের ধন্যবাদ দিয়ে বাসে উঠে পড়লাম। বাসে উঠে খাবারগুলি নিহালের হাতে দিয়ে বললাম, ‘অনেকক্ষণ ধরে কিছু তো খাওনি, এটা খেয়ো।’ সে রাগি রাগি চোখে খাবারটা নিয়ে কোলের উপর রাখল।


বাস ছাড়ল। আমি লাস্ট-সিটে আর নিহাল ইঞ্জিনকাভারে। যেন টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া। আমার শুধুই মনে হচ্ছে, ‘ইস্‌! যদি ওকে একটু ধরে বসতে পারতাম!’ এদিকে আমার বমি আসছে, কিন্তু বের হবার মতো কিছুই নাই পেটে। রাত দুইটায় আমরা ফেরিঘাটে এসেছি। কিন্তু অনেক জ্যাম। ঝড়বৃষ্টির কারণে ফেরি সারারাত বন্ধ ছিল। বাস ফেরিঘাটে আসামাত্রই আমি একদৌড়ে চলে গেছি নিহালের কাছে। ওকে বোঝাচ্ছি।


আমার কথাবার্তা সবই কাকের ঠ্যাং বকের মাথা লাগছে তার কাছে। ‘আমি গ্রামের সবার পা ধরে মাফ চেয়ে নেব, যদি তুমি বলো। কখনও ফোন চালাব না, ফেইসবুক তো দূরে থাক। যা বলবে তা-ই করব, ঘরের বাইরের সব কাজ করে খাওয়াব, আমার ভরণপোষণও দিতে হবে না। শুধু এতদিনের সম্পর্কটুকু তুমি নষ্ট করে দিয়ো না। সম্পর্কটা থাক। অন্তত তোমার দাসী হিসেবে আমায় রাখো, নিহাল! প্লিজ!’ ইত্যাদি ইত্যাদি অনর্গল বলেই যাচ্ছি। ওদিকে সে একদমই কংক্রিট। আর কোনও উত্তর নাই, শুধু ‘ফ্যামিলি যা করবে তা-ই হবে’ ছাড়া।


বাস থেকে নেমে ওর পা জড়িয়ে ধরেছি অন্ধকারে। প্রতিটা ক্ষণ আমি তাকে রিকোয়েস্ট করেছি সম্পর্কটা রাখতে। ‘আমি একদিন সবার মন জয় করে নেব আমার ব্যবহার দিয়ে। মানুষ প্রথমপরিচয়ে অনেক সময় অনেককে পছন্দ করে না। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে একসময় দেখা যায়, অপছন্দের ওই মানুষটাই সব থেকে পছন্দের হয়ে যায়। আমি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ কুরআন তাহাজ্জুত দুয়া রোজা করে করে সব ঠিক করে নেব। তুমি চাইলে আমি খাস পর্দা করব, অথবা যদি চাও জিনস টপস পরাতে, আমি তা-ও করব। যেভাবে বলবে, আমি সেটাই করব। শুধু আমাকে ছেড়ে যেয়ো না।’ আমার সব কথায় তার একটাই কথা…ফ্যামিলি যা করবে তা-ই।


তার যে দু-একজন লোক আমাকে চেনে, ফেইসবুক বা ফোনে পরিচিত সবাইকে নিহাল বেশ আগেই আগস্টের ১৮ তারিখ আমাকে রেখে বাসায় যাওয়ার পর বলে রেখেছে।…‘সানজিদার সাথে কথা বোলো না/বলিস না, ওর সাথে আমার ডিভোর্স হবে।’ চেয়ারম্যান একবার জানালেন যে নিহালকে নিহালের দুলাভাই বলে দিয়েছে… ‘ডিভোর্স একটা হবেই। হয় নিহালের, নয়তো নিহালের বোনের।’ মানে নিহাল আমাকে রাখতে চাইলে তার দুলাভাই তার বোনকে ডিভোর্স দেবে। তাই নিহাল হয়তো এগোতে চাইলেও পরক্ষণে ক্যালকুলেশনের কারণেই আবার ফিরে যায়।


আমাকে ডিভোর্স দিলে আবার সে নতুন মেয়ে পাবে, কিন্তু আমাকে রাখতে গেলে তার বোনকে ডিভোর্সি হতে হবে, বোনকে সারাজীবন তাকেই টানতে হবে। তার বোন শিক্ষিতও না যে নিজের মতো চলবে। তার বেতন তো আর অত বেশি না যে বোনের উটকো ঝামেলা সে কাঁধে নেবে। আর বোন যদি ওর বাড়িতে স্থায়ীভাবে এসে যায়, তবে বাড়িতে ঝামেলা একটা-না-একটা লেগেই থাকবে। তার বোন মানুষ হিসেবে সুবিধার তো না! এই কথাগুলি অবশ্য ডিভোর্সের পরে একদিন ফোনে নিহালই বলেছিল আমাকে।


বাসে আমি আমার পাশের জনকে অনেক অনুরোধ করে নিহালের সিটে পাঠিয়েছিলাম। এরপর নিহাল আমার পাশে, ওর খুব ঘুম পাচ্ছে। আমি আমার কোলের উপর ওর মাথা রেখে ওকে ঘুমাতে দিয়েছি। পরক্ষণে আমিও ঢুলে পড়ে যাচ্ছি ঘুমে। তাই পরে দুজন দুজনের কাঁধের উপর ভর দিয়ে বসে ঘুমাচ্ছি। রাত দুইটা থেকে ভোর ছয়টা পর্যন্ত অপেক্ষা করে আমাদের বাস ফেরিতে উঠল। এর ভেতর ওকে একবার বড়ো আপু, একবার ছোটো আপু, একবার এই দুলাভাই, একবার সেই দুলাভাই, এই বন্ধু, সেই বন্ধু কল দিচ্ছে, আর সে বলছে, সে আটকানো অবস্থায় আছে। ‘সানজিদা পরীক্ষার নাম করে ঢাকায় এসে গুন্ডা ভাড়া করে আমাকে জোর করে তুলে নিয়ে যাচ্ছে।’ এটাই সবাইকে বলছে, এমনকি কমল ভাইকেও বলেছে। অফিসে ফোন করে বলেছে। আত্মীয়স্বজন বা বাসার সবাইকে বলছে। ফেইসবুকেও নক করে করে লোকজনকে বোঝাচ্ছে।


আমি ওকে বললাম, ‘তুমি এসব কী বলছ? মিথ্যা কেন বলছো? ঝামেলা বাড়বে ছাড়া কমবে এতে? সমস্যা কারও হবে না। সম্পর্কটা নষ্ট করলে তোমার আমার সবই যাবে। অন্য কারও কিচ্ছু হবে না।’ অফিসে ফোন করে বলছে, ‘স্যার, এত রাতে আপনাকে ফোন করার দুঃখিত! আমার অনেক বড়ো বিপদ। আমার জন্য দোয়া করবেন, স্যার। আমার বউ আমাকে জোর করে তুলে নিয়ে যাচ্ছে গুন্ডা দিয়ে। যদি বেঁচে থাকি, অফিসে আসব, স্যার!’ অনেক সময় হয় না, মেয়েরা ছেলের অফিসে কমপ্লেইন করে চাকরিটা নষ্ট করে? এজন্য আগে থেকেই ও এমনটা করছে, যাতে আমি কখনও ওর অফিসে গিয়ে ওর বিরুদ্ধে কিছু বললেও ও পার পেয়ে যায়। কিন্তু ছয়টা বছরে সে আমাকে এ-ই চিনল! এ আফসোস আমি কোথায় রাখব! ও যা করছে, তা হলো, ম্যানহোলের কাদা-নোংরার মধ্যে পড়ে গিয়ে আগুন আগুন বলে চিৎকার করার মতো একটা ব্যাপার। কিন্তু এতে যে কেবল ক্ষতিই হচ্ছে! সামান্য বাতাসকেও সে এমন ঝড় বানিয়ে ফেলে নিমিষেই!


সকাল দশটা সাড়ে দশটার দিকে খুলনা এসে পৌঁছলাম। সোনাডাঙ্গা এসে বাস থামল। বাসস্ট্যান্ডটা থানার সামনেই। থানার সামনেই বাস থামল। আমার ভাই এগিয়ে গেল আমাদের রিসিভ করতে। মোটরসাইকেলটা সাইডে এক চায়ের দোকানে রাখা। নেমে ভাই আমাদের তিন জনকে দেখে কথা বলে গাড়িটা আনতে ওই দোকানের দিকে গেলেই নিহাল আমাকে বলছে, ‘তোমার ভাই দেখো থানায় গেছে বোধহয়। নিশ্চয়ই আমাকে ফাঁসানোর জন্য কিছু করছে।’ আমি বললাম, ‘ধুউর! কী সব হাবিজাবি ভাবো তুমি! আর করলেও আমি তোমার পক্ষে থাকলে কীসের আবার কী! আমি থাকতে তোমার কিছু হতে দেবো না আমি।’ ভাইয়া মোটরসাইকেল নিয়ে এল। এটা দেখে নিহাল বুঝল যে ভাই থানায় যায়নি।


এরই মধ্যে নিহাল ফোন করে সেই মামাকে আনাল, যিনি নিহালের ছোটো দুলাভাইয়ের সম্পর্কে মামা হন। আমার ভাই আর ওর মামার সামনে সেই মুস্তাফা ভাইয়াটা নিহালের কাছে আবার ক্লিয়ারলি জিজ্ঞেস করলেন, আমার ব্যাপারে সে কী করতে চায়। আমি তখনও নিহালের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছি। নিহাল নিচের দিকে তাকিয়ে সুস্পষ্টভাবে বলল, ‘এত কিছুর পর আমি আর চাই না এসব। আমার পক্ষে ওর সাথে কিছুই কন্টিনিউ করা সম্ভব না।’ ওর মুখ থেকে এটা শোনার পর আমি যেন দুনিয়াতেই নাই তখন। আমার চোখ দিয়ে হড়হড় করে পানি পড়ছে। আমি আমার হাতটা ওর হাত থেকে ছাড়িয়ে নেবারও শক্তি পাচ্ছি না। এতটাই অবশ লাগছে পুরো শরীর। আমি হাঁ করে নিহালের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। নড়ার শক্তি হারিয়ে ফেলেছি।


নিহাল সেই মামাকে বলল, ‘মামা, আপনি আমাকে নিয়ে যান। আমি আপনার সাথে থাকব যতক্ষণ বাসা থেকে কেউ না আসে।’ মামা বললেন, ‘আরে পাগল! উঁহু, তা হয় না।’ আর সেই মুস্তাফা ভাই নিহালকে বললেন, ‘তুমি এখনও ওই বাড়ির জামাই। অতএব, এখন বউকে নিয়ে বাসায় যাও। গোসল করে খেয়ে রেস্ট করো। সময়মতো তোমার বাড়ির লোকজন চলে আসবে।’ ভাইয়ের সাথে আমার পাশের বাসার এক আন্টিও এসেছিল রিসিভ করতে। একটা অটো-বাইকে সেই আন্টি, নিহাল আর আমাকে তুলে দিল সবাই মিলে।


আমরা বাসার পথে। আমি নির্বিকার হয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছি। সেই আন্টি আমার গায়ে একটু নাড়া দিলে আমি নিহালের দিকে দিকে তাকালাম। দেখলাম, সে বাইক থেকে নেমে যাওয়ার পাঁয়তারা করছে। তখন আন্টি ইশারায় নিহালকে ‘কী হয়েছে?’ এমন কিছু একটা জিজ্ঞেস করলেন ভ্রূ দুইটা একসাথে উঁচু করে। আমি নিহালের মুখের দিকে তাকিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলাম। সে আমার হাতটা শক্ত করে ধরে বলল, ‘পাগলি তোকে আমি ভালোবাসি তো!’ আমি বললাম, ‘তুমি বললে যে আর চাও না আমাকে! কেন বললে? বলো, কেন কেন?’ সে বলল, ‘রাগের মাথায় আমি কত কথাই বলি। সব তো আর সত্যি না। বলেছি তো কী হয়েছে? বললেই কি ডিভোর্স হয়ে গেল নাকি?’ আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘তাহলে? বাসো? সত্যিই?’ সে মুখটা মায়া মায়া করে দুবার উপর নিচে নাড়াল। বোঝা গেল, ইশারায় বলছে, ‘বাসি তো।’


আমি বললাম, ‘এখন উপায়…??? এত সময় ধরে সবাইকে যা বলেছ, এসব সমাধান করব কীভাবে আমরা?’ সে আমাকে আশ্বাস দিয়ে বলল, ‘সবাই এলে সবার সামনে বলব যে আমরা দুজন একসাথে থাকতে চাই। তার জন্য সবার হেল্প চাইব। আব্বু এলে আব্বুর পা ধরে বলব, ‘আমি সানজিদাকে চাই।’ সোনা, তুই আমার জন্য পারবি না আমার সাথে সাথে আব্বুর কাছে ওটা বলতে?’ আমি বললাম, ‘তোমার সাথে আমি সব করতে রাজি। তবে তুমি আমাকে ছেড়ো না। তুমি আমাকে ফেলে যেয়ো না।’


অটো থেকে নেমে বাসায় চলে এলাম। বাসায় আমার মামা, ভাই, আর নিহালের ওই মামা যে লোকটাকে ডেকে এনেছিলেন, সেই লোকটা। আমরা বাসায় এসে নিহালকে রেস্ট করতে দিলাম। গোসল করতে অনেক রিকোয়েস্ট করলাম যেহেতু সে সারারাত টেনশন আর জার্নির মধ্যে ছিল। কিন্তু সে গোসল করল না। আমি সোজা গোসল করে এসে ঠিক ঠিক ওর পাশে গিয়ে বসলাম। ওর পাশে বসার, পাশে থাকার খায়েশ আমার মেটেনি। ওর পাশে থাকতে পারলে একধরনের শান্তি লাগত, যদিও সে তখন আমাকে দেখে কেমন জানি বিরক্ত হচ্ছিল। যা-ই হচ্ছে বা চলছে, আমি সেসব দিকে খেয়াল না-করে সুযোগ পেলেই দৌড়ে গিয়ে তার হাতটা ধরে বসি, তার চোখে মুখে তাকাই।


ওকে খেতে দিলাম। এদিকে আমার নিজের কিন্তু খাওয়া নাই। তখন ২৯ তারিখ সকাল এগারো সাড়ে এগারোর মতো বাজে। আমি তখনও এক ফোঁটা পানিও খেতে পারছি না। নিহাল ভাত খাচ্ছে। আর আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি পাশে বসে। আমার বড়ো ভালো লাগছে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে। আর যদি বাসার কেউ নিহাল সম্পর্কে কোনও নেগেটিভ কথা বলছে, আমি তাতে রাগ করে সাথে সাথে প্রতিবাদ জানাচ্ছি। দরজা আটকে দিয়ে আমি ওকে ভাত বেড়ে খাওয়াচ্ছি। সে ভাত খেতে খেতে একমুঠ ভাত হাতে নিয়ে বলল, ‘এই ভাতের কসম, তোরে আমি নিয়েই যাব। তুই যাবি না আমার সাথে?’ আমি ওর কপালের মাঝখানে একটা চুমু দিয়ে বললাম, ‘ওরে আমার সোনা পাগলু! আমি কেন যাব না? আমি অবশ্যই যাব তোমার সাথে।’ তখন সে বলল, ‘তোর ভাই তোকে যদি যেতে না দেয়, তখন?’ আমি বললাম, ‘আমার স্বামীই আমার অভিভাবক। ভাই যেতে না দিলে আমার ভাই-ই লাগবে না। তোমার জন্য আমি পুরা দুনিয়ার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে রাজি।’ সে বলল… ‘মনে রাখিস, বাবু।’ আমি বললাম, ‘আচ্ছা।’ এখন নিহাল চোখ নাচাতে নাচাতে বলছে, ‘তোরে নিয়ে ঢাকায় কেন, শ্রীলংকায় যেতে হলেও যাব। বাঁচলে একসাথে, মরলেও একসাথে মরব, মনে রাখিস তুই।’ আমার বুকটা তখন গর্বে এত্ত বড়ো হয়ে গেছে। মনে হতে লাগল, ‘আমার জীবন সার্থক। এই মানুষটাকে আমি আমৃত্যু ছাড়ব না। পৃথিবীতে এমন একটা কাজও নাই যা আমি ওর জন্য করতে পারব না।’


এসব স্মৃতি মনে এলেই আমার মন বলে, এত কিছুর পর ওকে ছেড়ে বাঁচা আমার পক্ষে সম্ভব না। আর ওর মুখে একটাই কথা, এত কিছুর পর আমার সাথে থাকা ওর পক্ষে আর সম্ভব না। অথচ সামান্য কিছুকেও এত কিছু সে নিজেই বানিয়েছে। আমার মন শুধুই বলে, ওর ফিরে আসা উচিত। ওকে ফেরা লাগবেই! জানি না কী আছে কপালে!


যা-ই হোক, সেদিনের ঘটনায় ফিরে যাই। দেখলাম, একটু পরেই ওর বাসার লোকজন এসে হাজির। আসার পরই ওকে ডাকা হলো তাদের সামনে। সে রুম থেকে চলে যাচ্ছিল। এই রুম থেকে বের হবার সময় আমি দরজার কোনায় দাঁড়িয়ে হাত এঁটে ধরে বললাম, ‘কী হবে এবার? কী করবে?’ সে উত্তর দিল, ‘দেখছি ব্যাপারটা। আমি দেখব। সবাইকে বলব, ‘আমরা একসাথে থাকতে চাই। চিন্তা কোরো না, পাগলি।’ এটা বলে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে পাশে একটা ফাঁকা রুম ছিল, সেখানে ওয়ালের কাজও এখনও শেষ হয়নি, সেই রুমে গেল সবার সামনে। এদিকে আমি রুমে বসে আল্লাহ আল্লাহ জিকির করেই যাচ্ছি। সে সবার সামনে গিয়ে বসল। ওর বাসার লোকজনের সাথে সেই মুস্তাফা ভাইও মধ্যস্থতাকারী হয়ে এসেছিলেন সেদিন। ওর আব্বু দুলাভাইয়েরা মুস্তাফা ভাইকে অনেকক্ষণ ধরে বুঝিয়ে পড়িয়ে এনেছে যে যে-কোনও মূল্যেই যেন ডিভোর্স হয়। ডিভোর্স মাস্ট মাস্ট মাস্ট!


তো সে ওখানে আসার পর তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, ‘কী করতে চায় সে এই ব্যাপারে?’ নিহাল আবারও স্পষ্ট করে ছোটো ছোটো শব্দে বলে দিল, ‘এত কিছুর পর আমি আর ওর সাথে থাকতে চাই না।’ এরপর আমাকেও সেখানে ডাকা হলো আমার কথাও শোনার জন্য। নিহালের বামপাশে আমি বসা। সে আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘সানজিদা, এত কিছুর পর আমার বাসায় গেলে তুমি সম্মান পাবে? আর তুমিও কি নিজে যেতে পারবে আদৌ?’ আমি কেঁদে উঠে বললাম, ‘কেন পারব না, আমি পারব। আমি সব পারব, শুধু তোমাকে ভুলতে পারব না, তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পারব না। আমাকে তুমি ছেড়ে যেয়ো না।’


(চলবে…)