প্রেমান্ধতা/পর্ব-৮

 
ওর আব্বু তখন পাশ থেকে বললেন, ‘এই নিহাল, তুই বলে দে যে তুই ওর সাথে সুখে ছিলি না। বল যে ঢাকায় গিয়েও ঝগড়া হয়েছে। বল যে ওর তোর দেখাশোনা করত না, তোকে রান্নাটাও করে খাওয়াত না ঠিকমতো। বল, এখুনিই বল!’ ও আবার ভয়ে বলে, ‘হ্যাঁ, আমরা সুখে ছিলাম না। আমার আব্বুর কথা সত্য।’ এরপর উনি বলেন, ‘এই নিহাল, তুই বল যে ওই মেয়ে তোকে মেরেছে!’ নিহাল বলে, ‘হ্যাঁ, সানজিদা আমাকে নখ দিয়ে খামচি দিয়েছে। খামচি দিয়ে রক্ত বের করে ফেলেছে। একদিন আমার ঘাড়ে কামড়ও দিয়েছিল। আমি ঘুমালে আমার নাকের উপর বালিশ চেপে ধরেছে দুই-একবার।’ এত সব নিষ্ঠুর কথা ওরা বলছে, আর আমি তখন হাউমাউ করে কাঁদছি। ওর বড়ো দুলাভাই বলে, ‘আমাদের এখানে আনলি কেন? কেন আনালি এখানে?’ ওর আব্বু বলেন, ‘সানজিদা যত দিন বাড়িতে ছিল, ততদিন আমরা সুখে ছিলাম না। ঘরের একটা কুটোও সে কোনও দিন এখান থেকে ওখান সরায়নি।’ আমাদের বাড়িভর্তি মানুষ। পাশের বাড়িগুলির প্রায় ১০-১২টা ছেলে-মেয়েকে আমি ফ্রিতে, কাউকে কাউকে টাকায় প্রাইভেট পড়িয়েছি। ওরা সবাই টুকটাক আমাকে চিনে, যদিও আমি কখনও কারও বাসায় বা বাইরে অকারণে যেতাম না। সেসব লোকজনেও বাড়ি ভর্তি। আমি সবার সামনে হাউমাউ করে কাঁদছি।


এসব দেখে আমার বাসায় অসুস্থ আব্বু, আম্মু আর ভাইটার কেমন লাগার কথা! বাড়িটা পুরো জাহান্নামের আগুনে যেন জ্বলছে! আমার ভাই আর সহ্য করতে না পেরে আমাকে যা-তা বলে গালি দিচ্ছে। কেন আমি এখনও তার জন্য কাঁদছি, সেজন্য আমাকে গালাগালি করছে। এক পর্যায়ে ওরা ওরাই আর মাঝখানে থাকা সেই মুস্তাফা ভাই সিদ্ধান্ত নিলেন, ‘সব ওকে। কাল টাকা এনে ডিভোর্স-পেপারে সাইন হবে, ব্যস্‌! ততক্ষণ নিহাল এখানেই থাকবে।’ এসব বলে ওরা রকিবকে রেখে গেল নিহালকে দেখে রাখার জন্য। বাকি সবাই বাড়িতে চলে গেল টাকা আনতে।


আমার জীবন যে সে মুহূর্তগুলিতে কীভাবে চলছিল, আমি জানি না। আমি এখানে সাংবাদিকদের মতো করে শুধু ঘটনার প্রবাহই লিখছি, কিন্তু আমার ভেতরের অনুভূতিগুলি আমি লিখে প্রকাশ করতে পারব না। প্রকাশ করা সম্ভব না হয়তো কোনও দিনই! সেই ১৮ বা ১৯ মার্চ থেকে টুকটাক করে লিখছি এটা। সময় পেলেই খানিকটা লিখি। আজ ২ মে। আমার হাতে এখন অনেক সময়। কিন্তু সাহস বা শক্তি পাচ্ছি না কেন জানি! মনে হচ্ছে যেন আমার হাত ধরে কয়েকজন মিলে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমাকে নিজের সাথে প্রচণ্ড যুদ্ধ করতে হচ্ছে লিখতে গিয়ে। এক লাইন লিখছি আর কাঁদছি। চোখের পানিতে লেখাগুলি ঝাপসা লাগছে। বার বার মনে আসছে, আমার নিহাল ফিরে আসবে তো আমার কাছে? এত স্মৃতির ভার আমি একা কীভাবে বইব? আমি যে ভুলতেই পারছি না কোনওমতে! এরকম কেন হবে? হওয়া তো উচিত না!


সেদিন আমাকে এক ভাইয়া বললেন, ‘এই পৃথিবীতে উচিত-অনুচিত এ দুইটা জিনিসের অস্তিত্ব কেবলই আমাদের মস্তিষ্কে। বিশ্বাস করো, আবেগ আর বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটো জিনিস।’ উনি আরও বললেন, নিহাল যা করেছে তা যেমনি উচিত করেনি, তেমনি আমি যা করছি তা-ও আমি উচিত করছি না।…ভাইয়ার কথা সবই বুঝেছি, কিন্তু আমি নিজেকে কিছুই বোঝাতে পারছি না। মনে হচ্ছে, ও মরে যাক, সাথে আমিও মরে যাই। আবেগ ছাড়া বাস্তবতা চলে কীভাবে! খোঁড়া লাগে না এমন জীবনকে চালাতে? আমার শুধু মনে আসছে, আমার যা হয় হোক, তবু সে অন্য কারও না হোক। আমার জীবনের সব ধাপই শেষ হয়ে গেছে! এখন আমাকে আর কোনও কিছুই আকর্ষন করে না, কেন জানি। আমি এত কিছু ভুলব কীভাবে? এত স্যাক্রিফাইস, এত ভালোবাসা! আমি কখনওই কিছু চাইনি তার কাছে আর আজ সে অন্য মেয়ের জন্য কত কিছু করবে! আমার সহ্যক্ষমতা ক্রমেই কমে আসছে।


যা-ই হোক, ওরা চলে গেল টাকা আনতে। আর নিহাল রকিবকে নিয়ে রয়ে গেল আমাদের বাসায়। সেই সাদা শার্টটা তখনও ওর গায়ে। ভেতরের গেঞ্জির যে অংশটুকু বাইরে থেকে বোঝা যাচ্ছে, সেটুকু আর শার্টের কিছু অংশ ময়লায় কালো হয়ে আছে। আমি কেমন জানি অবশ অবশ অনুভব করছিলাম। ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছি বার বার। হাজার হাজার কথা বলছি, যেন স্বপ্নের ভেতর বোবায় ধরার মত। একটা শব্দও মুখ দিয়ে বাইরে বের হচ্ছে না। আমি শুধুই তাকিয়ে আছি। ‘আমার নিহাল আমাকে ছাড়তে পারে না।’ এটাই বার বার মনে আসছে। ওকে আমি ময়লা শার্টে দেখতে পারি না, নিজেই ধুয়ে দিই। তবু মুখ ফুটে যেন বলতে পারছি না, ‘বাবু, শার্টটা পালটাও তো। ধুয়ে দিই। কী ময়লা করে ফেলেছ, দেখো তো!’ যেন বলছি সবই, তবু শব্দ হচ্ছে না।


আমার সেই বান্ধবী এসেছিল, সিনথিয়া। সবাই চলে যাবার পর নিহাল রকিবকে নিয়ে বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে সামনের ধানখেতের মাঝের রাস্তাটা দিয়ে। মুখে হালকা মিষ্টি মিষ্টি হাসি। আমি মেঝের সাথে লেপটে থেকে কাঁদছি। হাউমাউ করে কাঁদছি। মৃত্যযন্ত্রণা আমাকে বেঁচে থাকতেই যেন ধরে ফেলেছে। আমার বান্ধবী আমাকে একটু ভালো রাখার জন্য বাইরে নিয়ে যেতে চাইল। বাসা থেকে বিশ টাকার পথ, একটা সুন্দর জায়গা। রাস্তার এক পাশে ধানক্ষেত, অন্য পাশে নদী। দেখে মনে হয়, যেন নদীর ওপারে গেলেই বুঝি আকাশটাকে ছুঁতে পারব। ল্যাপটপের ব্যাকগ্রাউন্ডে যেমন আকাশ দেখা যায়, ওরকম ছবির মতো নীল আর সাদা মেঘের আকাশ। সে আমাকে সেখানে নিয়ে গেল। ওখানে ওর হাজব্যান্ড বালির টেন্ডার নিয়েছিল। তাই ওখানে ভাইয়াকে থাকতে হয়। সে আমাকে সেখানে নিয়ে গেল। সে আমাকে হাসানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু আমার অন্তরে যে ঝড় বয়ে যাচ্ছে, সেটা আমি কোনওভাবেই থামাতে পারছিলাম না।


যাওয়ার সময় যখন বের হচ্ছি, তখন দেখি, আমার নিহাল রাস্তার উপর দাঁড়ানো। আমি হেঁটে যাওয়ার সময় ওকে ক্রস করতে গিয়ে ওর মুখের দিকে আবার তাকালাম। আমার কলিজাটা ছিঁড়ে যাচ্ছিল। বান্ধবী আমার হাত ধরে হাঁটছিল। আমরা ওই রাস্তার মাথায় গেলাম। প্রায় সাত মিনিটের গলির রাস্তা, ওইটুকু হেঁটে বড়ো রাস্তায় নেমেই অটোতে বসলাম। কেন জানি পেছনে তাকালাম। তাকিয়ে দেখি, আমার নিহাল সেই মায়া মায়া চোখ নিয়ে কাঁধটা একটু বাঁপাশে বাঁকা করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে ওই মোড়ে দাঁড়িয়ে। আমার পেছনে পেছনে এসেছে হয়তো। আমি জানতাম না। ওকে দেখে আমি ডুকরে কেঁদে দিয়েছি আবার। এরপর সেই জায়গাটায় নিয়ে গেল। সেখান থেকে সন্ধ্যায় আমাকে ওর বাসায় নিয়ে যেতে চাইল। কিন্তু আমি তো যাব না। আমার মন শুধু বলছে, আমার এখানে আসাই ঠিক হয়নি। ওখানেই থাকতে হতো। ওকে ছুঁয়ে দেখতে না পারলেও চোখের দেখা দেখতে তো পেতাম এই সময়টুকুতে। আমি ওকে না দেখে একমুহূর্তও বাঁচতে চাই না। আমার এখানে ভালো লাগছে না, আমার ওকে দেখতে ইচ্ছে করছে। আমার গায়ে যেন জ্বালা ধরে গেছে। আমি ওদের বললাম, ‘আমাকে এক্ষুনি বাসায় দিয়ে আসো। আমি নিহালকে দেখব। এক্ষুনিই!’


ওরা আমাকে আবার নিয়ে এসে বাসার সামনের মোড়ে দিয়ে আম্মুকে ফোন করে বলে গেল। আর আমি ওই গলির রাস্তা ধরে আক্ষরিক অর্থেই একদৌড়ে বাসায় এসে হাজির। বাসায় এসে দেখি, নিহাল আর রকিব পাশের রুমে বসে ফোন টিপাটিপি করছে। আমি বারান্দার লাইট অফ করে দিয়ে জানালা দিয়ে উঁকি মেরে মেরে মেরে নিহালের মুখটা দেখছি। আহা, শান্তি! এরপর আম্মু টেনে নিয়ে শুইয়ে দিল। ওই রাতে আব্বু আম্মু দুজনেই আমার পাশে ঘুমাল। সবাই একটু ঘুম ঘুম মতো, তখনই আমি উঠে গিয়ে নিহালের পায়ের কাছে গিয়ে বসলাম। আস্তে করে নিহালের পায়ে চুমু খেয়ে হাত রেখে নাড়া দিতেই ও ভয় পেয়ে আতঙ্কে উঠে বসল। তাকিয়ে দেখে, আমি। বলল, ‘ওহ্‌! তুমি? লাইট জ্বালাও।’ আমি বললাম, ‘না। লাইট অফ থাক।’ সে বলল, ‘ঘুমাওনি? যাও ঘুমাও।’ আমি বললাম, ‘তুমি ঘুমাবে?’ ও বলল, ‘টায়ার্ড লাগছে কিছুটা।’


আমি তখনও ২৭, ২৮, ২৯ সেপ্টেম্বর এই তিন দিন ভাত দূরে থাক, ঠিকমতো পানিও ছুঁইনি। ও খাটের উপর বসা, পা দুটো বিছানার এই মাথার দিকে। আর আমি মেঝেতে বসে প্রভুহীন কুকুরের মতো ওর পায়ের উপর দুহাত দিয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘একটা রিকোয়েস্ট করব? রাখবে, বাবু?’ ও বলল, ‘কী রিকোয়েস্ট?’ আমি বললাম, ‘আজ রাতে আমার সাথে দু-রাকাত তাহাজ্জুত নামাজ পড়বে?’ বলল, ‘এখন?’ আমি বললাম, ‘না। রাত দুইটায়।’ বলল, ‘এত রাতে…কীভাবে?’ আমি বললাম, ‘আমিই তোমাকে ডেকে তুলব।’ বলল, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে। যাও, ঘুমাও এখন।’ আমি গিয়ে শুয়ে পড়লাম। একবার এপাশ আর-একবার ওপাশ করি। এক সেকেন্ডও ঘুম হয়নি। চেপে চেপে কান্না করে আমার গলা মুখ ব্যথা, চোখ মুখ ফোলা।


ঠিক রাত ১টা ৫৫তে উঠে আমি ওর রুমে গিয়ে আবার ওর পায়ে হাত বুলিয়ে নাড়া দিলাম। ঘুম ভাঙছিল না ওর। অনেক ঝাঁকুনি দিয়ে দিয়ে ঘুম ভাঙিয়েছি। তবু শব্দ করিনি মুখে। শব্দ অবশ্য বের হচ্ছেও না। সে মোবাইল দেখে বলে চোখ মুখ কুঁচকে বলে, ‘এত রাতে উঠে এসেছ কেন তুমি?’ আমি বললাম, ‘তাহাজ্জুত পড়বে না?’ বলল, ‘ওহ্‌!’ আমি বললাম, ‘চোখ মুছতে থাকো। আমি ওজু করে আসি।’ ওজু করতে গিয়ে মনে পড়ল, তখন আমি অপবিত্র। আমার পিরিয়ড চলে। কিন্তু এতক্ষণ আমার মনেই ছিল না। ফিরে এসে বললাম, ‘নাহ্‌, হলো না। আমার নামাজ হবে না।’ ও বলল, ‘এত রাতে ঘুম থেকে তুললে কেন তাহলে? কী সমস্যা তোমার?’ আমি ওর এই কথার উত্তর দিলাম না। আমাদের আর নামাজটা পড়া হলো না, এটা নিয়ে আমার মন প্রচণ্ড খারাপ। এত নেক নিয়ত করেও নামাজটা পড়তে পারলাম না।


আমার তো মুখ দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না, হাত পা-ও নাড়াতে পারছি না যেন, এতটাই দুর্বল হয়ে আছি আমি তখন। এবার ধিমিয়ে ধিমিয়ে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে গায়ের সব শক্তি দিয়ে ওকে আবার বোঝাতে শুরু করলাম। ‘বাবু, বাবু রে! আমাকে তুমি ছেড়ে যেয়ো না। আমি বাঁচতে পারব না। আমার ফুপু, এরপর দাদি, ২৮ বছর বয়সি একমাত্র মামা, পরের মাসেই ২৯ বছর বয়সি ফুপাত বোনের মৃত্যু আমাকে শেষ করে দিয়েছে। তুমিও তো দেখেছ আমার আব্বু সুস্থ থাকতে কতটা ইয়াং এনার্জিটিক ছিল। মাঝে মাঝে আব্বু মোটরবাইকে করে ক্যাম্পাসে আমাকে দিতে গেলে বন্ধুরা ভাবত, আমার বড়ো ভাই। আর আজ সেই মানুষটা অ্যাক্সিডেন্ট করে চোখের সামনে বেডে পড়ে আছে। আমি সেই অ্যাক্সিডেন্ট থেকে আব্বুর মুখের দিকে তাকাই না। আমার কলিজা ভেঙে কান্না আসে।’


আমার মনে অনেক কষ্ট জমে গেছে গত দুই-তিন বছরে। এই অবস্থার ভেতরও তোমাকে আমি আমার ত্রাণকর্তার মতোই দেখেছি। আমাকে তুমি এমন অবস্থায় ফেলে যেয়ো না। আমি সত্যিই মরে যাব তুমি আমাকে ছেড়ে চলে গেলে। আমি কী নিয়ে বাঁচব, তুমিই বলো! আমাকে ছেড়ে যেয়ো না। আমি তোমার জন্য আমার ওই বোনের লাশ ফেলে তোমার কাছে ছুটে গিয়েছিলাম, মনে আছে? জীবনে প্রথম খুলনা জেলার বাইরে গিয়েছি, তা-ও একা একা নড়াইলে, সেটাও তোমার জন্য। আমি তোমার সাথে অন্যায় বা ভুল করে থাকলে আমি তোমার পরিবারসহ সারাগ্রামের মানুষের পা ধরে ধরে মাফ চেয়ে নেব। একসময় সবার মন জয় করে নেব। আমার ভরণপোষণও তোমাকে দিতে হবে না। চাকরি যতদিন না হয়, ততদিন দরকার হলে টিউশনি করে চালিয়ে নেব। একদিন আমরা দুজন মিলে সব করব। সব হবে আমাদের। ঘরের বাইরের সব কাজ আমিই করব। দেখো, আশেপাশের বউদের থেকেও আমি আমি তোমাকে ভালো রাখব। আমাকে ফেলে যেয়ো না, জান। আমাকে ছেড়ে যেয়ো না।’


এসব বলে কেঁদে কেঁদে ওর পায়ের উপর আমার হাত আর মুখ রেখে ফ্লোরের উপর বসে আছি। কয়েকবার করে ওর পায়ের পাতার উপরে চুমু খেয়েছি। আমার চোখের পানিতে ওর পা ভিজে গেছে। ‘আমি মুসলিম, আমি কুরআন, নামাজ আর আল্লাহকে বিশ্বাস করি। আমি এই তিন জিনিসের কসম খেয়ে বলছি, সকালে ঘুম থেকে উঠে আর রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে তোমার পা-ধোয়া পানি দিয়ে আমার মুখ ধুব। আমাকে শুধু ফেলে যেয়ো না।’ এভাবে কেঁদে কেঁদে রাত দুইটা থেকে পরদিন দুপুর একটা দুইটা পর্যন্ত একটানা কেঁদেছি তার পায়ের উপর। সে খুবই বিরক্ত আমার উপর। কিছু সময় ঘুমাচ্ছে, কিছু সময় হাই তুলছে, কিছু সময় শুয়ে আছে, কিছু সময় মোবাইল গুঁতাচ্ছে। এক-একবার চেয়ারম্যানকে ফোন করে বলে, ‘কাকা, সানজিদা খুব কান্নাকাটি করছে। আমাকে ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করছে। আমাকে আপনারা বাঁচান।’ কাকা কী বলেন ফোনের ওপাশ থেকে, সেটা আমি শুনতে পাই না। নিহাল আবার বলে, ‘তাড়াতাড়ি আসেন আপনারা।’


ভোর থেকে আমার গোঙানি আর কান্নার শব্দে আশেপাশের লোকজন দিয়ে বাড়ি ভর্তি। আমার কান্নার সাথে সাথে আরও অনেকেই কাঁদছে, আর নিহালকে বলছে, ‘ভাইয়া, সানজিদার বাপটা অসুস্থ, মানসিক শারীরিক, দুইভাবেই। সানজিদা এক প্রকার এতিম। এত্তটা কান্না যে মেয়ে তার স্বামীর জন্য করছে, সেই বউ ফেলে আপনি চলে যাবেন? আপনার কি একটুও খারাপ লাগবে না? এতটা দিনের সম্পর্ক বলেই না সে এমনভাবে আপনাকে চাইছে। মেয়েটা অশিক্ষিত বা কুৎসিতও না। চিন্তায় চিন্তায় শেষ হয়ে যাচ্ছে শুধু। ওর এমন পরিবেশ ছিল না। আল্লাহর পরীক্ষায় আজ ওর এই অবস্থা। ওর বাপটাও একসময় নেতাগিরি করে মানুষের উপকার করে বেড়িয়েছে আর আজ সে নিজের মেয়ের বেলায় বেডে পড়ে আছে। এমন নিষ্ঠুরতা করবেন না। জীবন সবার জন্যই অনিশ্চিত। একে ফেলে আপনি সুখী হতে পারবেন? মিলিয়ে নেন, ভাইয়া। কত কিছুই তো হয় সংসারে। ছেড়ে দেওয়াটা কোনও সমাধান না।’ ইত্যাদি ইত্যাদি।


নিহাল তখন সবার সামনে, মানে ওই মানুষগুলির সামনে বলল, ‘না না, আমি আমার সানজিদাকে ফেলে কই যাব? সবাই এলে আমি বলব, আমি সানজিদাকে চাই। আসুক সবাই। আমি এটাই বলব।’ সেদিন যে মানুষগুলি আমার বিপদে এসেছে, ট্রাস্ট মি, ওদের কাউকেই আমি ডেকে নিয়ে আসিনি। সৃষ্টিকর্তা কীভাবে কীভাবে জানি পাঠিয়ে দিয়েছেন। দূত হিসেবে। কারণ ওই গ্রামেও আমি ঠিকমতো কারও সাথে কথাও বলি না। কয়টা ছেলে-মেয়ে এসে পড়ে যেত, ফ্রিতেই পড়াতাম। আর টাকায় পড়াতাম মাত্র দুজনকে। অভ্র আর বুশরা ছিল ওদের নাম। অথচ ওই সময় ওরা সবাই পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আমাকে বুঝতে চেষ্টা করেছে। ওই লোকগুলি এটাও বলেছে যে সবাই এলে তারাও হেল্প করবে যেন নিহাল নির্ভয়ে এই কথাটা বলার সুযোগ পায়।


আমি আর লিখতে পারছি না। আমার এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে, আমাকে যদি আমি জড়িয়ে ধরতে পারতাম, তবে এখনই নিজেকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরে গলাটা ছেড়ে একটু কাঁদতাম। এতটাই মায়া লাগছে নিজের প্রতি! কষ্টগুলি যেন গলার কাছে এসে এসে আটকে আছে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। আমার নিহাল রে! আমার বাবু রে! আমার ছয়টা বছরের সাধনা রে!!! নিহাল এত সুন্দর করে মিথ্যা বলতে পারে, ওসব মনে পড়লে ভাবি, আমি ওর মিথ্যাতেই নাহয় বেঁচে থাকব আজীবন, তবুও আমি ওকেই চাই! সেদিন আমাদের বাসায় জড়ো-হওয়া মানুষজন এক-এক কথা বলছে। আমাদের বোঝাচ্ছে। আমি কাঁদছি। এ পর্যায়ে আমার কান্নার শক্তিটুকুও যেন শেষ হয়ে আসছে। নিহালও আমাকে বলছে, ‘পাগলি, এত কাঁদলে হবে? আমি তো আছি। আমি তোরে ছেড়ে যাব না। ভালোবাসি তো!’


আগের দিন ভোর প্রায় ৪টার দিকে নিহাল আমাকে গায়ে গতরে হাতড়ে বলছে, ‘তোমার গায়ে তো কিচ্ছু নাই।’ ওই মুহূর্তেও তার কিস করার অনুভূতিও এল। আর এদিকে আমি কেঁদে মরছি। আমার বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলে একটা সিস্ট আছে। সেখানে হাত দিয়ে চেক করে বলল, ‘তোমার টিউমার তো বড়ো হয়ে গেছে। ডাক্তার দেখাও।’ আমি বললাম, ‘না, সিস্ট অনেক দিন ধরে এরকমই আছে। বড়ো ছোটো হচ্ছে না।’ এরপর আমি ওর পা ধরে এটাও বলেছিলাম, ‘আমাকে একটু সুযোগ দাও। আমি মোটা হয়ে যাব। দুই মাসেই মোটা হয়ে যাব। তুমি যা চাইবে, তা-ই হবে। শুধু আমাকে ছেড়ে যেয়ো না।’ মানে দুনিয়ার সব রকম উপায়েই বলেছি। কোনও অপশন ফাঁকা রাখিনি।


এরপর দুপুরে ওরা সবাই এল বাড়িতে। সবার সামনে আবার ডাকা হচ্ছে ওকে। আমার বাড়ির আশেপাশের মানুষগুলিও সবাই ভাবছে, এবার গিয়ে নিহাল সবাইকে বলবে, সে ছাড়বে না সানজিদাকে। আমি ওদিকে ওর পা ধরে কেঁদেই যাচ্ছি। লোকজন সবাই ওকে ডাকলে ও আমাকে সরিয়ে দিয়ে উঠে চলে যাচ্ছে ওই রুমে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী করবে ওখানে গিয়ে?’ আমাকে বলে গেল যে সে সবাইকে বুঝিয়ে বলবে। আমি এই ঘরে আল্লাহ গো আম্মু গো করে করে গোঙানি আর কান্নায় আকাশ-পাতাল এক করছি। সবার সামনে গিয়ে বসল নিহাল। ওই মানুষগুলি বার বার বলছে, ‘নিহাল ভাইয়া আপনাদের কিছু বলতে চায়। ওকে কিছু বলতে দিন। ভাইয়া, বলেন বলেন। আমরা আছি, সমস্যা নাই। আপনার মনে যা আছে, সবার সামনে তা বলেন।’ নিহাল চুপ করে মুখ নিচু করে বসে আছে। নিহালের আব্বু পায়ের উপর পা তুলে মহাখুশিতে পা নাচাচ্ছেন। কথায় কথায় ফিক ফিক করে হাসছেন। ওরা আসার সময় অনেক দেরি করে এসেছে।


নিজেরাই কাজি এনেছে, সেই মুস্তাফা ভাইয়া আর ওইদিন আসেননি। ওঁর নাকি কী এক পরীক্ষা ছিল। উনি সম্ভবত আজম খান কলেজে মাস্টার্স করছিলেন তখন। তাঁকে আমি চিনতাম না, যদিও মুস্তাফা ভাইকে আমার ভাড়া-করা গুন্ডা বলে নিহাল পরিচয় দিয়েছিল সবার কাছে। ডিভোর্সের অনেক পরে একদিন সেই ভাই আমি বেঁচে আছি, না সুইসাইড করেছি, সেটা জানতে ফোন দিয়েছিলেন। তখন উনি জানালেন যে, নিহালের বাসা থেকে তাঁকে অনেক বুঝিয়েছে। ইনডিরেক্টলি টাকা দেওয়ার কথাও বলেছিল। মুস্তাফা ভাইয়া সেটা কৌশলে রিফিউজ করেন। তখন ওরা আমার চরিত্র খারাপ, আমি সংসার ভাঙতে চাই, আমি ঘরের কাজকর্ম করি না, আমি সবার সাথে ঝগড়া করি, আমি অহংকারী আমাকে নিয়ে এরকম নানান বাজে বাজে আর নেগেটিভ কথা বলে যেন মুস্তাফা ভাইয়া এটা বোঝেন যে আমি আসলেই বউ হবার যোগ্য না। এটা বুঝে হলেও যেন তিনি ডিভোর্স হতে হেল্প করেন।


নিহালকে ওর আব্বু, নিহালের ছোটো আপুর শ্বশুর, নিহালের বড়ো দুলাভাই, রকিবের আব্বু সবাই হুংকার দিয়ে দিয়ে বলছেন, ‘অ্যাই, তুই কথা বলিস না কেন? বলিস না কেন যে তুই সুখে ছিলি না ওর সাথে?’ নিহাল এবার মুখ খুলল। কিন্তু দেখলাম, আবারও সেই একই কথা। ‘আমরা সুখে ছিলাম না। এত কিছুর পর আর আসলেই সম্ভব না। আমি মুক্তি চাই সানজিদার হাত থেকে।’ সবাই অবাক হয়ে গেল। আমাকে সবাই ডেকে বলল, ‘তুই এখনও কাঁদছিস! নিজকানে শুনে যা সে কী বলছে।’ বলেই ওরা আমাকে টেনে নিয়ে গেল সবার মাঝে ওই রুমে। আমি রুমে যেতেই দেখি, নিহালকে খাটের ওই মাথায় রেখে তিন পাশ দিয়ে ওর এক কাকা, ছোটো আপুর শ্বশুর, বড়ো দুলাভাই বসা। আর পেছন সাইডে ওয়াল।


আমি রুমে ঢোকার পর ওরা আমাকে সামনে বসতে দিল। আমি বললাম, ‘বাবু, তুমি কি সত্যিই আমাকে ভালোবাসো না? সত্যিই আমাকে আর চাও না?’ সে কোনও কথা বলছে না। ঠান্ডা মাথায় চুপ করে বসে আছে নিচের দিকে তাকিয়ে। আমার কাছে আর কেউ কিছু জিজ্ঞেস করছে না। চেয়ারম্যান বলেলন, ‘এত দেরি না করে তাড়াতাড়ি কাজ সারেন। অনেক দূর যেতে হবে।’ চেয়ারম্যান তখন আমাদের সবার সামনে টাকাটা গুনে তিন লক্ষ টাকা এক বান্ডিল করে আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘এই যে তোমার কাবিনের টাকা। তুমি কি পুরোটা বুঝে পেয়েছ? চেক করে নাও।’ আমি একঝটকায় ওঁর হাতে ধাক্কা দিয়ে টাকাটা ফেলে দিয়ে টাকার উপর জুতাপায়ে উঠে দাঁড়িয়ে জুতা দিয়ে টাকাগুলি ডলা দিয়ে দিয়ে নষ্ট করার চেষ্টা করছি।


তখন ওরা কিঞ্চিৎ রেগে গেল। চেয়ারম্যানও। আমার সেই মামা আর পাশের কিছু মহিলা আমাকে ধরে সরিয়ে ধরে রাখলে ছড়িয়ে-যাওয়া টাকাগুলি ওরা আবার তুলে ঠিকঠাক করল। এবার কাজিসাহেব কী জানি হাবিজাবি বললেন, এরপর আমাকে বললেন, ‘মা, তুমি সাইন করো।’ আমি বললাম, ‘আমি সাইন করব না। মরে গেলেও করব না। আমার নিহালকে আপনারা আমার কাছ থেকে কেড়ে নেবেন না। আপনাদের উপর আল্লাহর গজব পড়বে!’ এরপর বুকে দুইহাত বেঁধে নিচু হয়ে হাঁটুর ভেতর মুখ দিয়ে ‘আল্লাহ, আমাকে বাঁচাও! আমাকে রক্ষা করো!’ বলে বলে চিৎকার করছি। কারা কারা জানি আমার হাত জোর করে বের করার চেষ্টা করেছিল। পারে নাই।


আমার কান্নার ভেতর আমি তখনও দু-একবার দেখেছি, ওর আব্বু হাসছেন। ওদিকে নিহাল বিরক্ত ও চুপচাপ। আমি এবার বললাম, ‘আমি ওকে একটু ছুঁয়ে দেখব।’ কিন্তু আমাকে ওর পাশে কেউ যেতেই দিচ্ছে না। তবু জোর করে সবাইকে ধাক্কা দিয়ে ঠেলেঠুলে গেলাম ওর কাছে। ওকে শক্ত করে সবার মাঝে জড়িয়ে ধরে বললাম, ‘বাবু, আমাকে ফেলে যেয়ো না। আমাকে পর করে দিয়ো না। আমাকে ছেড়ে যেয়ো না। তোমার পায়ে পড়ে আমার জীবনটা ভিক্ষা চাইছি। ভিক্ষা দাও আমাকে!’ তখন সবাই আমাকে টেনে সরিয়ে আনছে আর বলছে, ‘কার জন্য কাঁদিস তুই? যাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিস, তার চোখে নাই একফোঁটাও পানি! সরে আয় এদিকে।’ এই বলে ওরা আমাকে টেনে সরাচ্ছে, আর তখনও আমি ওকে বলে যাচ্ছি, ‘বাবু রে, আমার হাতটা ছেড়ো না। আমাকে দয়া করো। এমন অবিচার কোরো না। উপরে আল্লাহ আছেন। দেখো, সবাই আমাকে টানছে। তুমি আমার হাতটা ধরো বাবু, আমাকে ছেড়ো না।’ নিহাল কিছুই না বলে একঝটকায় হাতটা সরিয়ে নিল।


এবার চেয়ারম্যান নিহালের দিকে আঙুল তুলে বললেন, ‘এই মেয়ে নিয়ে তুই সংসার করবি না? করবি কি না বল!’ হয়তো একমুহূর্তের জন্য হলেও তাঁর নিজের মেয়ের মুখটা তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল। এর ভেতর আমার ভাই চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে আমাকে গালি দিচ্ছে। কেউ আবার বোঝাচ্ছে। ‘যে তোকে চায় না, তার সাথে তুই কেমনে থাকবি?’ এসব। ওরা পেপারটা এবার নিহালের কাছে দিয়ে বলল সাইন করতে। নিহালের দুলাভাই ওকে চেঁচিয়ে বলছে, ‘তুই সাইন কর! কেন করবি না? দুজনই সাইন করবি! আজ আমাদের এখানে আনলি কেন না করলে? এই মুহূর্তে সাইন কর!’ আমার ভাই আমাকে বলছে, ‘এই শুয়োরের বাচ্চা! তুই কাঁদছিস কার জন্য? তোর মা, ভাই, না অসুস্থ বাপের জন্য? এক জানোয়ারের জন্য কাঁদছিস যে তোকে চায় না। কুত্তার বাচ্চা, তুই মরতে পারিস না?’ কাজিসাহেব বলছেন, ‘ভাই ভাই, প্লিজ সাইনটা করবেন না। আর-একবার ভাবুন। ভাই, সাইন করবেন না।’ নিহাল হুট করে তাকিয়ে দেখল, ফোনে ভিডিও হচ্ছে। তখন সে একটু হালকা করে কাঁদল, অথচ ঠিক আগের মুহূর্তেও সে ছিল স্বাভাবিক, নির্বিকার। এরপর সে গড়গড় করে সাইন করে দিল। আমার ভাই আমাকে বলল, ‘দেখ, নিজের চোখে দেখে নে কীভাবে সাইন করছে! আবার কাঁদিস তুই? তোকে যদি আজকে গলা টিপে মেরে না ফেলি!’


এরপর ওরা আমাকে দিল পেপারটা। আমি তখনও সাইন করছি না। হাত শক্ত করে মুঠ করে বসে আছি আর চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কাঁদছি। তখন আমার ভাই আমাকে বলল, ‘তোকে যে বাদ দিল, তাকে নিয়ে কান্না! তুই আজ এখানে সাইন না করলে, আল্লাহর কসম, তুই ত্যাজ্যপত্রে সাইন করবি।’ এবার ওরা চলে যাবে, তাই ব্যাগপত্র গোছানোয় তাড়াহুড়ো করছে। নিহাল ওর দুলাভাইকে বলছে, ‘ভাইয়া, তাড়াতাড়ি কাজ সেরে এখান থেকে চলেন। বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে যাবে।’ প্রায় ১০ মিনিট আমাকে সবাই মিলে বোঝানোর পর আমি রাগে দুঃখে অভিমানে বামহাত দিয়ে সাইন করে কাগজে একটা থু মেরে দিয়ে সে রুম থেকে বের হয়ে এসেছি। নিহালের আব্বু দেখি মহাখুশি। উনি দাঁত বের করে কী এক ঠাট্টা করে করে হাসছেন। আমার আর সহ্য হলো না। আমি ওর গালে একটা চড় কষে দিলাম। নিহাল সাথে সাথেই ‘এই বেশ্যা মাগি, তুই আমার আব্বুর গায়ে হাত তুললি কোন সাহসে?’ বলে আমার নাক বরাবর জোরে একটা ঘুসি মেরে দিল। আমার নাক ফেটে দরদর করে রক্ত ঝরছে। সে নিজেও হাতে একটু ব্যথা পেয়েছে। আমি ওর হাতের দিকে তাকিয়ে আছি, আর ওর জন্য কষ্ট পাচ্ছি।


তখন সবাই আমাকে আটকে ধরাধরি করে বাইরে আনল। আমি দরজা ধরে চিৎকার করে কাঁদছি আর ছটফট করছি। এমন সময় রকিব দেখি ফোন চাপতে চাপতে এই রুমের দিকে শিস দিতে দিতে আসছে ব্যাগ নিতে। আমি উন্মাদ হয়ে উথালপাতাল করছি তখন। সে হাতের কাছে এলে আমার অনেক কথা মনে পড়ে গেল। আমি একটা থাপ্পড় মারলাম রকিবের মুখে। রকিব আমার দিকে ঘৃণা ভরে তাকিয়ে থুউউউ…শব্দ করে দেয়ালের উপর জোরে থুতু ছুড়ল। এরপর ওরা সবাই বেরিয়ে এসে রাগ দেখাতে দেখাতে নিহালকে নিয়ে চলে গেল। এদিকে আমি বারান্দায় গ্রিলের ভেতর আটকানো। হাত পা ছুড়ে ছুড়ে কাঁদছি সর্বোচ্চ জোরে শব্দ করে। আমাকে দেখাচ্ছে আর্তনাদরত পশুর মতো। পেছন ফিরে বারান্দার দিকে একবারও তাকিয়ে নিহাল আমাকে দেখল না, ওদের সাথে গল্প করতে করতে চলে গেল। এদিকে আমি হাত পা ছুড়ে কাঁদছি আর আমার নিহালকে একবার ছুঁয়ে দেখার তৃষ্ণায় মরে যাচ্ছি। আমি দেখলাম, ওরা চলে গেল।


৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৯। আর মাত্র দুই দিন পর অক্টোবরের ৩ তারিখ আমাদের ফরমাল বিয়ের ম্যারেজ-ডে ছিল। ঘটনা এখানেই শেষ হলেও পারত। কিন্তু হয়নি। আমার অনুভূতিগুলি নিয়ে আমি আল্লাহর দরবারে আজও দাঁড়িয়ে। নিহাল আমাকে টুকটাক মেসেজ বা কল দিত। আমিও দিতাম। সব ঠিক করে ফেলতে চাইতাম। সেই দিন থেকে আজ অবধি এমন একটা দিনও আমি কাটাইনি, যেদিন আমি কান্না না করে কাটিয়েছি। অনেকবার সুইসাইড করতে গিয়েছি। সে আমাকে রাত ৩টায় মেসেজ দেয়। বলে, আমাকে স্বপ্নে দেখেছে। প্রাণ পুড়ছে আমার জন্য। আমার পরীক্ষাগুলির আগের রাতে সে যোগাযোগ করত। আর এদিকে কেঁদে কেঁদে আমি সেই সব পরীক্ষায় ফেইল করেছি। অথচ ডিভোর্সের আগে আমি সব চাকরির পরীক্ষায় টিকেছি। ডিভোর্সের পর শুরুর দিকে দুইটা ব্যাংকের প্রিলি টিকে আর বাকি সবকটাতে ফেইল করেছি।


সিনিয়র অফিসারের ভাইভা দিতে গিয়ে নিজের নাম পর্যন্ত ভুলে গেছি। আধঘণ্টা লেট করে পৌঁছেছি। ভাইভাতে প্রথম প্রশ্ন ছিল, ‘আপনার ডিভোর্স কেন হলো?’ আমি জানি, ওসব তো ইমোশনের জায়গা না, প্রফেশনাল জায়গা। তবু আমি প্রথম প্রশ্নেই কেঁদে দিয়েছি। এরপর ১০টা প্রশ্নের ভেতর মাত্র ৩টা পেরেছি। ৫টার ভেতর ৪টা ম্যাথ যেখানে আনসার করেছি, আর রিটেন পার্টে আমার দেওয়া ৩টা চাকরির পরীক্ষার মধ্যে যেটাতে সবচাইতে ভালো পরীক্ষা দিয়েছি, সে সিনিয়র অফিসার পোস্টের ফাইনাল লিস্টে আমার নামই আসেনি। ওদিকে প্রাইমারিতে এসেছে আর এসেছে সাধারণ বিমাতে। এরপরও তার সাথে অনেএএএক কথা হয়েছে। সে একবার আমাকে দোষ দেয়, আবার পরক্ষণে দোষ দেয় না। মাঝে মাঝে আমাদের ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের ছবি দেয়। বলে, সে নাকি মিস করে। আরও বলে, আমি এতদূর এসেও ভার্জিন ছিলাম। সেক্সুয়াল অনেক ব্যাপার বুঝতাম না, পারতাম না। সব ও-ই আমাকে শিখিয়ে নিয়েছে। আমাদের দুজনের ঘনিষ্ঠ ছবি দেখে আমি কখনও ভড়কে যাইনি। বলতাম, এটা আমার গর্ব।


সে আমাকে অনেকবার বলেছে, সে আর কখনও বিয়ে করবে না। এর মাঝে ‘সানজিদা বিয়ে করেছে’ এইরকম একটা কথা সে তার বন্ধুমহলে রটিয়েছে। কেন এটা করেছে, আমি জানি না। এরপর হুট করে সে করোনার ভেতর এপ্রিলের ১২ তারিখ বিয়ে করে নিয়েছে। বিয়ের দুই দিন আগেও আমাকে মেসেজ করেছে। খুবই নরমালভাবে, কিছুই টের পেতে দেয়নি ঘুণাক্ষরেও। আমি একদিন স্বপ্ন দেখি, ওদের বাসায় মেয়ের বাসা থেকে লোকজন এসেছে। আমি ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম পরের দিন। সে ওটা সত্য না বলে উড়িয়ে দেয়। বলে, ‘পাগলি, তুই কী করে ভাবলি যে তোকে ছাড়া আমি বাঁচব? আমি প্রয়োজনে মরে যাব, তা-ও আমার শরীরের শেষ রক্তবিন্দু থাকতে অন্য একটা মেয়ের সাথে আমি থাকতে পারব না। কখনওই না!’ এর কয়দিন পরই সে বিয়ে করল। ওর ছোটো দুলাভাই এটা আমাকে জানিয়েছিল।


আমাদের ডিভোর্সের তিন-চার দিন পর ওর ওই দুলাভাই আমাকে মেসেজ দেয়, ‘কে হারল? কে জিতল?’ আমি প্রথমে বুঝিনি মেসেজটা কে দিল। পরে বুঝে শুনে আমি রিপ্লাই করলাম, ‘কোন প্রতিযোগিতায়? কার কার মধ্যে?’ ওর দুলাভাই বলল, ‘যার যোগ্যতা নাই, তাকে যোগ্য আসনটা দিলে সে রাখতে পারবে না, পূর্বের অবস্থায় ফিরে যাবে, এটাই তার প্রমাণ।’ আমি রিপ্লাই দিলাম, ‘আপনারা বয়সে বড়ো। হয়তো না-বুঝে কখনও ভুল করেও ফেলেছি। আমাকে মাফ করে দেবেন, দুলাভাই।’ আসল ঘটনা হলো, আমার ফেইসবুক বায়োতে আগে একসময় লেখা ছিল: ‘হারব না। হয় জিতব, নয়তো শিখব।’ এই ব্যাপারটা উনি ওভাবে নিয়ে যাবেন, আমি তা ভাবতেও পারিনি।


নিহালকে এটা বলেছিলাম। নিহাল আমাকে বলল, ‘আমরা দুজন ঠিক থাকলে ওরকম জুতার দোকানের কর্মচারী একদিন বুঝত, কার জায়গা কোথায়।’ আমি বললাম, ‘আমি তো তোমাকে চেয়েছি। তুমি কেন আমাকে বাদ দিলে?’ সেদিন ও কিছু না বলে অন্য প্রসঙ্গে চলে যায়।


ডিসেম্বরে ওই দুলাভাই মেসেজ দেয়। ‘কী খবর? এই শীতে একা থাকা যায়? কষ্ট হয় না? আর-একজন খুঁজে নাও।’ এরপর সে-ই এই করোনার ভেতর নিহালকে বিয়ে দিয়ে আমাকে মেসেজ দিল, ‘সুখবর! নিহালের বিয়ে হয়ে গেছে। অনেকক্ষণ রিপ্লাই করিনি দেখে কল দিয়ে দেখল আমার সিম অন আছে কি না।’ আমি রিপ্লাই দিলাম, ‘আমার তরফ থেকে শুভকামনা রইল। (সানজিদা)’ তখন নিহালকে ফোন দিয়ে দেখি, আমি ওর ব্ল্যাকলিস্টে। তাই ওর ফ্রেন্ড কমল ভাইয়াকে ফোন দিলাম। উনি আমাক অনেক বোঝালেন নিজেকে বদলে ফেলতে।


নিহালকে ওর দুই দুলাভাই মিলে বিয়ে দেয় ১২ তারিখ। বিয়ে করে ওই দিন রাতটুকু বাড়িতে এনে পরদিন সকালেই চলে যায় শ্বশুরবাড়ি। কমলভাইকেও নাকি ডেকেছে। বলেছে, ‘দোস্ত, আয় ঘুরে যা। আমার শ্বশুরবাড়ির পাশে একটা সুন্দর জায়গা আছে। আমরা ঘুরছি ওখানে।’ মেয়ের নাম নাকি জাকিয়া। ন্যাশনালে, কোন একটা কলেজে অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়ে। বাপের ছাদওয়ালা একতলা বাড়ি। বোধহয় ওরা দুই ভাই-বোন। আহামরি কিছু সুন্দরী না। গায়ের রং শ্যামলা। পৌনে চার কিলোমিটার দূরে শ্বশুরবাড়ি।


ডিভোর্সের তিন মাস শেষ হয় ডিসেম্বরের ২৯ তারিখ। ওইদিন নিহাল আমাকে মোবাইলে এমবি ভরতে বলে। রাত্রে নাকি অনেক কথা বলবে। আমি ভাবলাম, ‘সবকিছু বোধহয় ঠিকঠাক করবে। সে আমার কাছে ফিরে আসবে হয়তো।’ কিন্তু রাত্রে ফোন করে বলল, ‘আজ আমাদের সম্পর্কের লাস্ট ডে। কেমন আছ?’ এরকম আমাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আরও নানান কথা। ডিভোর্সের পরে লাস্ট ফোন দিয়েছিলাম ১৯৯তম দিনে। অনেক ভালো আছে আমার নিহাল। যে মাগরিবের নামাজ পড়ে বিছানায় বসে বলত, ‘আমার পাগলিকে ছাড়া আর কোনও মেয়েকে আমি ছোঁব না কোনও দিনই!’, সে আজ অনেক ভালো আছে অন্য মেয়ের বুকে।


(পরবর্তী পর্বে সমাপ্য)