ফিরে-দেখার সন্ধ্যায়

 
: কেমন আছো? আগের চাইতে অনেক মোটা হয়ে গেছো, না?
চুলগুলো অত বড়ো রাখো কেন?
ছেলেদের বড়ো চুলে একটুও মানায় না, ভীষণ হ্যাংলা মনে হয়।
হাতে এখনও সেই পুরনো অভ্যেসে ব্যাজ বাঁধো দেখছি।
চামড়ার বেল্টের ঘড়ি এখনও? ডানহাতেই পরো? কেডস চলছে এখনও?
…দেখছি, ছাড়তে পারলে না অনেক কিছুই!
তা, কবে এলে দেশে?
পরিবার নিয়ে এসেছো? না কি একা?
সবাই ভালো আছে?


: এই তো আছি একরকম!
যেমন দেখো, যেমন বোঝো, আছি সেরকমই, আগের মতোই।
কেন, জানো না, মানুষের ভেতরটা যে কখনও বদলায় না?
হ্যাংলাই তো ছিলাম,
সেজন্যেই না তোমার সাথে আর…
মাসখানেক তো হয়ে এল দেশে এলাম,
এখানে আসতে দেরি হয়ে গেল।
একাই এলাম। ওদের রেখে এসেছি।
আমার ছোট মেয়েটা এবার
টেনথ-স্ট্যান্ডার্ড একজামে বসছে। এই জুনেই!
মা’কে দেখতে এসেছি।
মায়ের শরীরটা বড্ড খারাপ, এবার বোধহয়
ইন্ডিয়া নিয়ে যেতে হবে। দেখি,
ওখানে গিয়ে যদি কিছু হয়…।
কবে এলে বাড়িতে?
ছেলে-মেয়ে ভালো আছে?
তুমিও তো মোটা হয়েছো বেশ,
কী করে এত ওজন বাড়লো?
আগের মতো এক্সারসাইজ করো না?
কোথায় সেই ফিটফাট শরীর,
আর কোথায় এখন কী একটা জলজ্যান্ত হাতি!
প্রচুর খাও নাকি এখন?
খাবারের মেন্যুটাও বোধহয় পালটেছে, না?
একা এলে? না কি পরিবারসহই?


: ওদের নিয়েই এসেছি।
দুজনেই ব্যস্ত থাকি, বাচ্চাদের সময় দেওয়া হয় না, তাই ভাবলাম…
আর শরীর!
মেয়েরা বিয়ের পর কিছু না খেয়েও মোটা হয়ে যায়, জানো না?
আর সময়ই-বা কোথায় অত এক্সারসাইজ করার!
ছেলেমেয়ের স্কুল, আমার অফিস, বরের অফিস, বাসার কাজ…
রান্না-করা, বাচ্চা-পড়ানো, ঘর-সামলানো…এর পর আবার ওসব ব্যায়াম-ফ্যায়াম!
শেষ কবে আয়না দেখেছি, সেটাই তো ভুলে গেছি!
তোমার খবর বলো। সব ঠিক চলছে তো?


: হ্যাঁ, সবার যেমন চলছে…সবার যেমন চলে…


: তেইশটা বছর কী করে যেন একমুহূর্তেই কেটে গেল! তাই না…?


: হ্যাঁ, গুনে গুনে তেইশটা বছর হতে চললো,…তোমার সাথে শেষদেখার…


: তোমার মা নিশ্চয়ই এখন তোমার বউকে নিয়ে বেশ খুশি?
এমনই তো তিনি চেয়েছিলেন,
এখন খুশি আছেন তো?


: মা’র আর খুশি থাকা…
সেই তো…একাই থাকেন দেশে!
কতবার বললাম লন্ডনে আমাদের সাথেই থেকে যেতে,
শুনলেনই তো না…!
আছেন একরকম! এ বয়সে যেমন থাকে…
ছেলের বউয়ের আদর কপালে আর জুটলো কই, বলো?
বিয়ের এক বছরের মাথায়ই তো রিমিনাকে নিয়ে গেলাম ওখানে!
মাকে এককাপ চা-ও তো করে খাওয়াতে হয়নি কখনও রিমিনার,
উলটো, যে ক’দিন সে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে আসত বাড়িতে,
মা-ই সব করে খাওয়াতেন!
নিজেই যে পছন্দ করে এনেছেন, পছন্দের মান রাখতে হবে না…!


: ওভাবে বলছো কেন?
তুমিও তো দিব্যি একুশটা বছরের সংসার ঠিকই পার করে দিলে, তাই না?
কেন, ওকে পছন্দ হয়নি তোমার?
তা হলে, আমি যে কানকথায় শুনতাম,
তুমি যে ক’দিন দেশে থাকতে,
বউকে কখনও চোখের আড়ালই করতে না…আমি ভুল শুনেছি তবে?
লন্ডনে তোমার প্রথমবাচ্চা হবার পর, ফেসবুকে ছবিও দিয়েছিলে।
ক্যাপশনে লিখেছিলে, বউ ঘুমুচ্ছে, মেয়ে পাহারা দিই।
ভালোবাসা না থাকলে এমন করে কেউ লেখে বুঝি…?


: তুমি দেখেছিলে সেগুলো!
কই, জানতাম না তো!


: দেখেছিলাম, তোমার মামাতো বোনের মোবাইলে দেখেছিলাম।
ও-ই দেখিয়েছিল…অবশ্য, আমি জানতে চেয়েছিলাম,
তুমি কেমন আছো…


: হ্যাঁ, লিখেছিলাম।
আসলে বিদেশের মাটিতে বাচ্চা-সামলাবার মানুষ কই পাবো, বলো?
সেদিন বড়ো মেয়েটার সবে এগারোটা দিন পেরুলো,
এরই মধ্যে রিমিনা রাত জাগতে জাগতে ভীষণ ক্লান্ত,
প্রায় টানা কয়েক রাত চোখে ঘুম নেই…।
তারপর আমিই ওকে বলেছিলাম, তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমোও,
আমি দেখছি।
আর ওখানে তো বাচ্চার দেখাশোনার জন্যে,
বাবা-মা দুজনেই প্রথম ছ’মাস ছুটি পায়।
কোনও আয়া নেই, বাড়িতে কেবল আমি আর রিমিনা,
আমাদের দুজনকেই অলটার করে করে বাচ্চা মানুষ করতে হয়েছে।
বাচ্চার একটু সর্দি পর্যন্ত লাগানো যাবে না,
একটু সর্দি হলেই সরকার যদি জানতে পারে,
সোজা এসে ওদের দায়িত্বে বাচ্চাকে নিয়ে নেবে,
সেজন্য বাধ্য হয়েই করতে হতো এসব।


: কেন, করতে চাওনি বুঝি?
তোমরা ধনীদেশের নাগরিক,
একটু আধটু মানতে তো হবেই…


: না মেনে উপায় আছে!
পেট চলবে কী করে,
একটু এদিক ওদিক হলেই যে দেশে পাঠিয়ে দেবে…!
আর এ বয়সে দেশে এসে করবোটা কী?
কিছুটা বাধ্য হয়েই করতে হয়, বলতে পারো।
তারপর, তোমার অফিস কেমন চলছে?


: চলছে…
তা, কতদিন আছো দেশে?


: দু’মাসের ছুটি নিয়ে মা’কে ডাক্তার দেখাতে এসেছিলাম।
একমাস তো চলেই গেলো!
আগামী মাসের বারো তারিখ রাতে ফ্লাইট,
এর মধ্যে আবার মা’কে নিয়ে সাতদিনের জন্য ইন্ডিয়া যেতে হচ্ছে।
প্রয়োজন পড়লে ছুটি বাড়ানো যাবে,
তবে ইচ্ছে নেই।
তুমি এখনও মায়ের ওপর রেগে আছো, তাই না?
অবশ্য রাগাটাই স্বাভাবিক।
মা হয়তো তাঁর ছেলেকে নিয়ে একটু বেশিই উদ্বিগ্ন ছিলেন,
কিন্তু কী জানো, আমাদের একসাথে হওয়াটা
আসলে ভাগ্যেই লেখা ছিল না…


: আচ্ছা, তা হলে আজকাল নিজেকে এ-ই বলে মানিয়ে নিয়েছো! ভালো!


: রেগে যাচ্ছ?


: একুশ বছর বাদে যখন যে যে যার যার জীবনে
পুরোদমে আটকে গেছি,
এখনও সেই পুরনো রাগ ধরে বাঁচা কি আদৌ সম্ভব!
এ রাগ নয়,
এ যে কী, বলে বোঝানো যাবে?
তুমি পারো, বলতে?
শেষপর্যন্ত আমাদের ইগোটাই জিতে গেল,
তাই না…?


: বয়সটাই অমন, রক্ত গরম ছিল যে,
তাই বুঝতে পারিনি কী করতে যাচ্ছি!
মায়ের প্রতি মাঝে মাঝে রাগ হয়,
আবার সেই সাথে এ-ও মনে হয়, মা তো!
হয়তো তিনি ভেবেছিলেন, এটাই নিয়ম!
মায়ের মনের ভয়, বোঝোই তো!
তা ছাড়া বাবা তো কখনও আমাদের খোঁজও নেননি,
মা-ই মানুষ করেছেন। এ কারণে মায়ের কিছু ভুল থাকা সত্ত্বেও,
কিছুই বলতে পারিনি।
আর তোমার প্রতি অনুশোচনা আমাকে আজও তাড়িয়ে বেড়ায়।
সামান্য ক্ষমাটুকু পর্যন্ত চাইনি আমি!
একটা দম্ভ ছিল ভেতরে, আমি কেন ক্ষমা চাইবো?
পরে যখন সত্যটা সামনে এল,
অনেক পরে বুঝতে পারলাম,
যা-কিছু আমাদের দুজনের সাথে ঘটে গেছে,
তার সবটাই ছিল সাজানো।
কিছু মানুষের আমাদের সম্পর্কের প্রতি ক্ষোভ আর কিছু মানুষের বোকামি,
এই দুই মিলে আমাদের সম্পর্কটাকে কেমন ভেঙেই ছাড়লো, তাই না?
কিন্তু যখন বুঝলাম, তখন ফিরেযাবার রাস্তাটা আর পেলাম না,
অনেক অনেক দেরি হয়ে গেল!
আচ্ছা, তুমিও কি পারতে না অমন জেদটা ধরে না রাখতে?
কেন ছেড়ে গেলে অমন জেদ করে?
কেন আটকালে না?
কেন বোঝালে না, আমার ভুল হচ্ছে?
তুমি কি পারতে না, বলো?


: হ্যাঁ, আমি পারতাম!
কিন্তু তা হলে বাকি জীবনটা আমাকে তোমার কাছে মাথা নিচু করে,
একজন অপরাধী সেজেই সংসার করে যেতে হতো।
সেটা কি ভালো হতো?
সেখানে সুখ থাকতো কোনও?
তুমি তখনও কি পারতে তোমার মা’কে কিছু বলতে?
তুমি এর পরও তোমার মায়ের কথাই বিশ্বাস করে যেতে!
আমার প্রতি আসলে তোমার কোনও বিশ্বাসই ছিল না, রাফসান!
জানি, তুমি কেবলই আমার অবয়বকে ভালোবেসেছো,
আমার যোগ্যতাকে চেয়ে এসেছো।
না হলে, তোমার মা প্রথম যেদিন তোমাকে বলেছিলেন,
আমি নাকি কলেজে অনেক বন্ধু বানিয়েছি,
কেন সেদিন মা’কে বললে না,
‘ওসব বন্ধু কলেজে গেলে দুএকটা সবারই হয়।’?
কেন তোমার মায়ের সন্দেহমাখা কথাগুলোকে
দিনের পর দিন প্রশ্রয় দিয়ে গেলে?
কেন তাঁর সব কথাই দূরে থেকে বিশ্বাস করে গেলে?
আমাকেও কি দিয়েছিলে সুযোগ, কিছু বলার?
আমি কী করিনি, বলতে পারো?
আমি যে আমার ভালোবাসা প্রমাণ করার জন্যে,
পরিবারকে না জানিয়েই তোমাকে বিয়ে পর্যন্ত করেছিলাম, ভুলে গেলে সব?
তুমি থাকতে শহরে, তোমার খালার বাসায়।
সেখানেই থেকে পড়ালেখা করেছো,
আমিই তোমাকে বাইরে যাবার জন্য স্কলারশিপের কথাটা বলেছিলাম,
তার জন্য যা যা আমার করার, আমি সবই করেছি।
মনে পড়ে, তোমার লাস্ট সেমিস্টারের ফি-টার কথা?
তুমি এম্বেসিতে দাঁড়ালে, প্রথমবার কী একটা ভুল হলো,
অতগুলো টাকা পুরোটাই জলে গেল।
আমি আমাদের বিয়ের জন্যে কিছু টাকা জমিয়ে রেখেছিলাম।
ভেবেছিলাম, নিজের বিয়েতে সব পছন্দের জিনিস দিয়ে বউ সাজবো,
আর সেইসব টাকা তোমার সেমিস্টার ফি’তে চলে গেল।
আমার কাছে তোমার চাইতে হয়েছিল?
ভেবেছিলাম, তোমার সিএ’টা হয়ে গেলে তারপর আর চিন্তা কীসের…!
সে-ই তুমিই কিনা…
পারলে কী করে, রাফসান…
আমাকে জেরা করতে?
আমাকে সন্দেহ করতে?
সেই ছোট্টবেলার বন্ধু ছিলাম আমরা,
একসাথে খেলেছি, একসাথে পড়েছি,
একই সাথে বড়ো হয়েছি।
সেই তুমিই কিনা মাত্র কয়েকটা বছর দূরে যেতেই আমার চেনাস্বভাব, চেনাঅভ্যেস…
সবই ভুলে গেলে?
মনে পড়ে, তোমার প্রথম প্রেজেন্টেশনের দিনের কথা?
আমার টিউশনির টাকায় কেনা তোমার সেই টাইয়ের কথা?
তুমি বলেছিলে, তোমার টাইকেনার টাকা হচ্ছে না।
বলেছিলে, তুমি টাই বাঁধতেও জানো না।
আমি এখান থেকে টাই কিনে নিজেই আমার আঙ্কেলের কাছে
টাইবাঁধা শিখে তোমাকে টাই পাঠিয়েছিলাম,
চিঠিতে সব নিয়মও লিখে দিয়েছিলাম…মনে পড়ছে না?
তোমার মা কতটা জানেন, তুমি ক্যাম্পাসে কটা দিন না খেয়ে থেকেছো?
তুমি যে খালার বাসায় দিনের পর দিন ভর্তা দিয়ে, ডাল দিয়ে
কোনও রকমে ভাতটুকু পেটে পুরে ক্যাম্পাসে চলে যেতে,
সেমিস্টার-ফিয়ের টাকা নিয়ে, এক সেমিস্টার ফুরোলেই,
তোমার দুশ্চিন্তা শুরু হয়ে যেত,…মা জানেন এসব?
না না, আমি তোমার মায়ের দোষ ধরছি না, রাফসান…
আমার প্রতি তোমার ভরসাটুকু যে পর্যায়ে ছিল,
আমি সেটাই প্রকাশ করছি।
আমাদের এগারো বছরের সম্পর্কে তুমি কখনও আমাকে
একটা সুতোও কিনে দাওনি।
আমরা যেদিন কোর্টম্যারেজ করি, তুমি সেদিন
আমাকে একটা কালোপেড়ে সাদা সুতির কাপড় দিয়েছিলে,
তা-ও তোমার মায়ের কেনা।
আমি কী পেয়েছিলাম তোমার কাছে, রাফসান?
আমি কী চেয়েছিলাম তোমার কাছে, বলতে পারো?
আমি তো বেশ ছিলাম সেই সুতির শাড়িটা পেয়ে…
কোনও অভিযোগই তুলিনি!
তুমি কেন চলে গিয়েছিলে, আমি কি জানি না?
আমি কি বুঝিনি?
তুমি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিলে, রাফসান!
আমার কাছে, তোমার প্রয়োজন ফুরিয়ে এসেছিল,
তুমি ছুটি চাইছিলে আমার কাছে থেকে।
প্রয়োজনের সম্পর্কে প্রয়োজনটাই ফুরিয়ে গেলে
আর কি টিকে থাকে তা?
তুমি জানতে, আর ছ’মাস বাদেই তুমি লন্ডনে পাড়ি জমাচ্ছ।
এদিকে আমাকে ছাড়তে গেলে তোমার যে একটা অজুহাত চাই-ই!
বিয়েটা তো আর অকারণে ভাঙা যায় না!
তোমার মা তোমার সহায় হলেন,
পাড়াপ্রতিবেশির কাছে আমাকে নিয়ে বাজে বাজে কথা রটিয়ে
তোমার কাজটা সহজ করে দিলেন।
মায়ের দোষ তুমি কেন দেখবে, রাফসান?
তোমার মায়ের তো কোনও দোষ ছিল না,
আমাদের সম্পর্কটা যে কেবলই সম্পর্ক ছিল,
ভালোবাসা ছিল না…!
তোমার মনে আছে, যখন বাড়ি আসতে, তখনকার কথা?
আমার জানালার ওপারে তোমার বাসার বারান্দা,
সারাদিন তুমি বারান্দায় আমাকে দেখার জন্য বসে থাকতে,
আর আমি জানালা দিয়ে মাঝে মাঝে উঁকি দিতাম,
ইশারায় আমাদের কত কথা হতো, মনে আছে?
জানালা দিয়েই তোমার পছন্দের রান্নাগুলো তোমার হাতে এগিয়ে দিতাম।
কোনও কোনও দিন আমরা যদি সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে,
নদীর ধারে গিয়ে বসতে পারতাম অনেক রাত পর্যন্ত,
তুমি আমার হাতের উপর হাত রেখে লক্ষ কোটি কথা বলতে, মনে পড়ে?
আমি কিছুই ভুলিনি, রাফসান…
আসলে ভোলার মতো কিছু তো নয় এসব!
সেই ছোট্টবেলা থেকে আমরা একসাথে বড়ো হয়েছি,
একসাথে মানুষ হলাম,…এত সহজে ভোলা যায়?
আজও কিছুই ভুলিনি আমি,
কেবল নিজের প্রতি কিছু ধিক্কার জন্মায়!
এমন অন্ধ ছিলাম কেন, রাফসান?
এত কেন বোকা ছিলাম?


: হ্যাঁ, আমারও সব মনে পড়ে,
আমি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।
ছোট থেকেই অভাবে মানুষ হয়েছি,
বাবাকে কখনও কাছে পাইনি,
বাবা কখনও কোনও দায়িত্ব নেননি আমার,
এমনকি কোনও খোঁজও রাখেননি।
মা একা একা কোনও রকমে আমাকে মানুষ করলেন,
খাওয়া-পরা দিতেই মায়ের জান চলে যাবার জোগাড়!
আমি স্টুডেন্টভিসায় যাচ্ছিলাম,
আমার প্লেনের খরচ জোগাড় করতেই মা হিমশিম খেয়ে যাচ্ছিলেন!
কিছু টাকা জমানো ছিল, কিন্তু ওতে হচ্ছিল না।
মা একটা জমি বিক্রি করে দিলেন,
ওখানে গিয়ে আমার ডিগ্রিটা কমপ্লিট করতে আরও দু’বছর লেগে যেত,
তারপর যদি ওয়ার্কপারমিট না পাই, তা হলে ওরা ডিগ্রি শেষ হতেই,
সোজা দেশে পাঠিয়ে দেবে।
যে করেই হোক, ওদেশে থাকার একটা পাকাবন্দোবস্ত করতে হবে,
সারাক্ষণ এসবই ঘুরতো মাথায়।
এদিকে স্কলারশিপের এত বড়ো একটা সুযোগ আমি হাতছাড়া করতে চাইছিলাম না,
তোমাকে ভীষণ বোঝা মনে হচ্ছিল আমার,
আমার অভাব আমার সব বোধ কেড়ে নিয়েছিল,
আমি অকৃতজ্ঞের মতো মুখ লুকিয়ে চলে গিয়েছিলাম
তোমার জীবন থেকে…সমস্ত দায় এড়িয়ে।
আমার এ পাপ, আমার এ অপরাধ…
আমাকে আজও ভীষণ তাড়া করে ফেরে…
রিমিনা আসলে ভালো মেয়ে, কিন্তু সে তো তুমি নয়,
কখনও হতেও পারবে না…
আজও ভাবি কেবলই, ভেবেই যাই…
কী দিয়ে শোধরাবো এ পাপ?
এ যে আমার আমৃত্যুর বোঝা! আহা, কেউ যদি জানতো…!
হ্যাঁ, আমি রিমিনাকে সব কিছু দিয়ে আগলে রাখার চেষ্টা করি।
সবাই ভাবে, খুব ভালোবাসি বোধহয়, এজন্যই এমন চোখে চোখে রাখি!
আসলে আমি তোমাকে যা দিতে পারিনি,
অথবা তোমাকে যেভাবে হারিয়েছি,
সেভাবে আর কিছু হারাতে চাই না।
কিন্তু ভেতরটা কি কখনও দেখানো যায়?
কী আছে এখানে…সে কেবল আমিই জানি!


: না, তোমার প্রতি রাগ, অভিমান…
কিংবা ঘৃণা, কিছুই নেই আমার…
শুধু কিছু প্রশ্ন ছিল।
হয়তো সূর্যের আলো পাইনি আমিও,
কিন্তু নিয়নবাতির আলোয় এ জীবনের বাকি রাতগুলো
কেটে যাবে ঠিকই…কেটে যায়ও!
জীবনটা বদলাতে যে একটা জীবনই কেবল লাগে!
রিমিনাকে ভালো রেখো, ভালো থেকো।


: শেষবেলাতেও আমাকে ক্ষমা চাওয়ার স্থানটুকু দিলে না…
যেমন ভিখিরি ছিলাম, তেমনি ভিখিরিবেশেই ফিরে যাচ্ছি।
হ্যাঁ, সম্পর্কটা কেটে না গেলে কী করে বাঁচতাম দুজনে!
জীবনটা পার করতে গেলে যে কিছু না-পাওয়া, কিছুটা আক্ষেপ,
কিছু কষ্ট কষ্ট স্মৃতি, কিছু কালোমেঘ,
আর কিছুটা দুঃখ…লাগেই!