ফিরোজা রঙের অববাহিকা

 
আমার কাছে এসো না, আসতে হয় তো
আমার কবিতার কাছে এসো।
শারদীয় গাছের পড়ন্ত পাতায়,
আমি যা চাই, তা লিখে নিই।
এসে গেছেন? বসুন তবে।
(প্রিয় পাঠক, কেউ সত্যিই এসে গেলে তাকে আর ‘তুমি’ করে বলা যায় না।)
একটি বেদীর উপরে আমার কিছু কবিতা রেখেছি; পড়ার জন্য নয়, এমন কিছু কবিতা।
সেগুলি বাদ দিয়ে পড়বেন অনুগ্রহ করে।


এক শরতে আমার বিবেকটিকে হলদেখামের বাইরে বের করে দেয়া হয়েছিল।
বিশ্বাস করুন, এটিতে এখন অপ্রয়োজনীয় একটি শব্দও আর নেই।
নীরব, অন্ধকার কক্ষের যে নরম বিছানায়
অনেকদিন ধরেই কেউ কখনও শোয় না, সেখানে
ঢুকেই শুয়ে পড়বেন না যেন! একটু সময় নিন,
নিজের মনকে জিজ্ঞেস করুন,
বরফের উপরে বসে আজও কনকনে ঠোঁটে কে বাঁশি বাজায়?


যে ক্লান্ত, তাকে ধন্যবাদ দেয়ার মতো কেউ নেই,
কারণ সে ঘুমিয়ে পড়ে।
কিছু জায়গা আছে, যেগুলি তন্দ্রালু,
অনেক আশ্চর্য অর্ধকবিতা সে জায়গাগুলির চারপাশে ভাসতে থাকে।
যেরকম করে আমরা বাড়ির আঙিনায় বাগান করি শরতের প্রথম দিকে,
ডুব মারবার আগে কবিতারা কবির চোখের রূপসাগরে ওরকম করে ভাসে।


কেউ এলেও-বা কী হবে?
এখন যদি কেউ চুপচাপ আসে, তবে সে
আমার পিঠে হোঁচট খেয়ে জিজ্ঞেস করবে, তুমি কি ক্লান্ত?
চায়ের পেয়ালায় ছড়ানো গোলাপের পাপড়ির মতন মোলায়েম তার হাতদুটো
আমার চুল ভেদ করে মগজে পৌঁছে যাবে, আমি জানি।
সে তখন তার রেশমি স্কার্ফটি খুলে আমার বুকে
রেখে দেবে যাতে আমি ঠাণ্ডায় জমে না যাই।


এ পৃথিবীতে সে-ই কেবল ঠোঁট দিয়ে আমার জ্বর মাপত।
আজকে তার আসার কোনও কথা ছিল না, এসে গেল!
আমি নিজের খোঁজ করতে গিয়ে কেবলই তাকে খুঁজে পাই।
বেয়াড়া মনে সব থেকে যায়। ভুলে যাই না বলে জীবনে আজকাল নিরাপত্তা কমে যাচ্ছে।


আমারই এক পরিত্যক্ত কবিতায় হোঁচট খাচ্ছিলাম, তখন মনে পড়ল,
আগেও খেতাম আর সে তাকিয়ে দেখত।
এবং যদি অমন কিছুই আমার বিশ্রামের কিংবা আত্মার পায়চারিতে
নিয়মিত হয়ে উঠত, তবে সে নিঃশব্দে প্রদীপটিকে অস্পষ্ট করে রেখে বলত,
এইবার ঘুমিয়ে পড়ো।


প্রায়ই একটি আলো বিশ্বাসঘাতক হয়ে উঠত, এবং
ওই দূরে রৌদ্র হয়ে ল্যান্ডস্কেপগুলির স্বপ্ন ভেঙে
শরতের সন্ধেয় জোনাকিজ্বলা শীত নামিয়ে দিত।
যে সহজেই কষ্ট পেয়ে যায়, তাকে কষ্ট দিয়ে কিছু হৃদয় পালিয়ে যেত।
এমনই এক অসহ্য সময়ে প্রদীপের শিখা স্যাঁতসেঁতে
হাওয়ায় আগুন ধরিয়ে দেয়। তখন মৃত্যু
উঠোনের প্রাচীর বেয়ে উঠে আর জ্যান্ত সন্ধেটির চারপাশে
ঢ্যাংঢ্যাং করে ঘুরে বেড়ায়।


যে ছদ্মবেশী লোকেরা উচ্চস্বরে কথা বলে,
তারা গাছের ঘ্রাণের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যায়।
আমার পাশের বেঞ্চিতে বসেথাকা মহিলার
চোখ শুকনো হয়ে আসে, মাথা কাঁপতে থাকে,
এবং তিনি নিজের চোখে নিজেকে মরতে দেখেন।
ভাবি, মানুষ কত নিঃসঙ্গ! যার সবই আছে, অথচ
সে যা চায়, তা-ই নেই, তাকে দেখে বাঁচার অর্থটা শিখে নেয়ার কথা ছিল।


গাছের পাতারা নেমে আসে তো আসুক! জানি,
ভবিষ্যতেও পাতাদের গাছে উঠতে হবে নেমে যাওয়ার জন্যই।
এমন উত্থান নিরর্থক। এইসব না ভেবে
আমি কেবল এখানে একা বসে থাকব, লক্ষ্যহীনভাবে।
আমি যখনতখন চুপ হয়ে যেতে পারি, কথা শোনার জন্যও পাশে কাউকে রাখি না, যদিও
আমি বলতে পারি না যে আমার কারও সাথে কথা বলার দরকার নেই।
আমার কবিতা যখন কাঁচাচোখে সবার দিকে তাকিয়ে থাকে,
তখন কেউ ফিরেও তাকায় না। বুঝতে পারি, আচ্ছা, তবে এই শরতের প্রথম দিনটি তিক্ত!


বাতাস অন্তহীন জলের মতো বয়ে চলে সেখানে, যেখানে
একটি নদীর ফিরোজা রঙের অববাহিকা জেগে ওঠে,
এবং অন্ধকারের রশ্মিও কখনওই ম্লান হয় না।
সেখানে গাছগুলি ডুবেযাওয়া জাহাজের মুখোশ ঝুলিয়ে রাখে,
গুল্মগুলি বড়ো জঙ্গলের মাকড়সা আর জলের জেলিফিশ খেয়ে বাঁচে,
একটিই রাস্তা, যেটি সমুদ্র থেকে উঠেআসা সাপের মতো সামনের দিকে নির্ভয়ে চলে যায়।
সাথে, একটি হ্রদও দেখা যায়, সে হ্রদের মধ্যে আমার স্বপ্নগুলি ডুবে আছে।