ফুলের মিথ্যে-বলা

 
ধ্যত্!!! সব ভুলে যাই, কিচ্ছু মনে থাকে না৷ ভালোবাসতেও না৷ কেউ ভালোবাসলে তাকেও ভালোবাসতে হয়, এটাও মনে থাকে না৷ প্রতিবারই ভাবি, পরে সময় করে ভালোবেসে দেবো, হাতে অনেক সময় নিয়ে অনেক ভালোবাসবো৷ এরপর ভুলে যাই৷ সময় হলেও ভালোবাসি না, সময় করেও ভালোবাসি না৷ ইচ্ছে করে কিংবা কিছু মিন করে যে ভালোবাসি না, তা নয়৷ সমস্যা হলো, ভালোবাসতে ভুলে যাই ৷ ভুলে যাই মানে, ভালো যে বাসি, এটা বোঝাতে কখনওই মনে থাকে না৷ বিশ্রীরকমের সমস্যা!! ভালোবাসাও বোঝাতে হয়! হবে না-ই বা ক্যানো? যারা আমাদের ভালোবাসে, তারা দুই রকমের হয়৷ কেউ-কেউ, আমরা ভালোবাসি, এটা না দেখালেও বুঝে নেবে, ভুলে গেছি; ওরা আমাদের বোঝে, তাই ভুল বুঝবে না, আবারও ভালোবাসবে৷ এরা হাতেগোনা৷ বাকিরা আর কোনওদিন মনেও করবে না হয়তো৷ ভালোবাসা না পেলে মাথা ঠিক থাকে না৷ তবুও, ঔদাসীন্যের দাম দেবার দায় তো আর সবার নেই৷ এমনকি যাদের আছে, তারাও তো আমাদের চিরঋণী করে আর কখনওই ভালোবাসবার সময়টুকু পর্যন্ত না দিয়ে ফাঁকি দিতে পারে; একেবারেই দূরে সরে যেতে পারে৷ কত কিছুই তো ঘটে!
তাই আমার নিউ ইয়ারস্ রেজোল্যুশন: যারা আমাকে ভালোবাসে, তাদেরকে ভালোবাসতে আর ভুলে যাবো না৷
রুমে কিছু ফুল রেখে দিই। রুমে একা তো আর থাকি না, সাথে আমার মনটাও থাকে। ওর জন্যই ভাবি, থাকুক, কিছু ফুল থাকুক। অমন কোমল শরীরের কাছে পৃথিবীর কঠোরতম সম্রাটের মুকুটও হেলে যায়। ফুলের আশ্চর্য সব ক্ষমতার কাছে পৃথিবীর সবচাইতে শক্তিশালী কামানও বড় অসহায়। এই এক ফুলেই হৃদয় থেকে শুরু বুলেট পর্যন্ত, সবকিছুই জিতে নেয়া যায়। আমার সবচাইতে প্রিয় ফুলগুলির বেশিরভাগই শাদা, কিংবা শাদাটে। রজনীগন্ধা, হাসনাহেনা, বকুল, বেলি, জুঁই, কাঠগোলাপ, কদম, কাঁঠালচাঁপা, চন্দ্রমল্লিকা, চামেলি, শিউলি। শাদাশাদা ফুলগুলি যখন অপলক তাকিয়ে থাকে, তখন ওদেরকে ছুঁয়ে-ছুঁয়ে মনের সবটুকু প্রেম-রূপ-রস নিঙরে শুধুই ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। প্রেয়সীর ঠোঁটের মতন নরোম ফুলের পাপড়িগুলি যখন চোখে, অধরে, ঠোঁটে ছোঁয়াই, তখন যে শিহরণটা খেলা করে শরীরের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে, তার তুলনা আর তৃতীয়টি নেই---‘দ্বিতীয়টি’ লিখতে ইচ্ছে করলো না কেন, সেকথা বলতে ইচ্ছে করছে না। ফুলের বাগানে কাটানো টুকরো-টুকরো সময় পৃথিবীর অপূর্বতম সুন্দর কিছু মুহূর্ত। ফুল কক্ষনো মিথ্যে বলে না। তবু হায়! ওকে ঘিরেই মিথ্যে বলা হয়ে যায়! আজ সকালে বিছানা ছাড়ছি আবার ছাড়ছি না, এমনসময়ে রুমের কোনায় রাখা গ্লাডিওলাসগুলির তাকিয়ে থাকতে বড় আরাম লাগছিল। মনে হচ্ছিল, বুঝি এক্ষুনিই দুম করে কাউকে ভালোবেসে ফেলতেও পারবো! কিন্তু হায়! সিলিংয়ের কোনায় লেজ-নাড়ানো বিশ্রী রকমের বড়সড় একটা টিকটিকি ছাড়া ভালোবাসার মতো আর কাউকেই পেলাম না! কেউ-কেউ বলে, বিয়ে করার জন্য একটা প্রেম থাকলে অনেক সুবিধে। আমার মনে হল, আরে বাবা, যেকোনও সময় শারীরিক কিংবা অশারীরিক প্রেম করার জন্য হলেও তো একটা বিয়ে করতে ইচ্ছে হয়। এসব ভাবলে ‘বিয়ে করতেই হবে কেন?’ এই গোঁয়ার্তুমিটাকে মাথা থেকে ব্যবহৃত টিস্যুর মতোই আর-ফিরে-না-আসুক নিয়তে ছুঁড়ে ফেলে দিতে ইচ্ছে করে। কিছু-কিছু ভাবনা টিস্যুর মতো, কাজ ফুরিয়ে গেলে ফেলে দিলেই অস্বস্তিটা ঝেড়ে পালানো যায়।
কী হচ্ছে এসব? ফুল থেকে টিকটিকি হয়ে মানসীতে গিয়ে থামল! আমার কী দোষ? ডাকলাম প্রেয়সীকে। সে এল না, এল টিকটিকি! তেলাপোকা তো আর আসেনি যে তেলাপোকাকে প্রেয়সীর কাছে নিয়ে ছেড়ে দেবো! আচ্ছা, মেয়েরা কি একটু একটু টিকটিকি টাইপের? নাকি, টিকটিকিরা মেয়ে টাইপের? নাকি, ওদের কারওরই কোনও টাইপ নেই? ইয়ে মানে, আপনি কি বুঝতে পেরেছিলেন, আমি ইচ্ছে করেই আপনার সময় নষ্ট করার জন্য এলোমেলো লিখছি? এখনও বুঝতে পারেননি? আচ্ছা, একটা সংক্ষিপ্ত প্রশ্নের উত্তর দিন। মার্কস ৫, সময় প্রেম করার মুহূর্তে এক প্যাকেট বাদাম শেষ করতে যতক্ষণ লাগে। (‘মুহূর্ত’ কেন বললাম? প্রেম করার সময়টাতে ৫ ঘণ্টাও অতি ক্ষুদ্র একটি মুহূর্ত।)
প্রশ্নটি হল: টিকটিকি-মেয়ে এবং মেয়ে-টিকটিকির মধ্যে ৫টি সাদৃশ্য লিখুন।
এ পরীক্ষায় ফেল করলে এর শাস্তিস্বরূপ আপনার বাসায় মসুরির ডাল রান্না করার সময় হঠাৎ কারেন্ট চলে যাবে, এবং বাতি জ্বলে ওঠার আগেই অন্ধকারে একটা টিকটিকি পড়ে ডালে আমিষের পরিমাণ অহেতুক বৃদ্ধি করবে! আপনি কিছুই জানবেন না, শুধু ডালের স্বাদে একটু বৈচিত্র্যে মুগ্ধ হবেন। মজার না? হিহিহি........
ওপরের কথাগুলি প্রসূত হয়েছে ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক/আজ বসন্ত’ এর কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের জন্য। ওই কবিতার কারণে নয়, বরং অন্য একটির অনুরণনে। ব্যাপার হলো, কেন জানি না, আজ সকাল থেকেই গত কয়েক ঘণ্টা ধরে উনার কিছু লাইন মাথায় ঘুরপাক খেয়েই যাচ্ছে খেয়েই যাচ্ছে.......
ফুলকে দিয়ে মানুষ বড় বেশি মিথ্যে বলায় বলেই
ফুলের ওপর কোনওদিনই আমার টান নেই|
তার চেয়ে আমার পছন্দ আগুনের ফুলকি -
যা দিয়ে কোনওদিন কারও মুখোশ হয় না|
‘ফুলকে দিয়ে মানুষ বড়ো বেশি মিথ্যে বলায়।’ সত্যিই তো! ফুল কিনতে যে হৃদয় লাগেই লাগে, তা তো আর নয়, স্রেফ পয়সা হলেও তো ফুল মিলে যায় খুব সহজেই। কত-কত চতুরের মনে এক, মুখে আরেক। অন্য লোকে বুঝবে কী করে? আবার এমনও হয়, কেউ-কেউ বুঝেও ফেলে, তবুও নিজের আত্মমর্যাদার কথা ভেবে কিছুই বলে না। মানুষ ফুলকে দিয়ে বলায়, ভালোবাসি, পাশে আছি, ভালোবেসো কিন্তু, শুধু তোমাকে ভেবেই তো সবকিছু, এমন করেই ভালোবেসে যাবো, এবং, এরকম আরও অনেককিছুই। যে মিথ্যের কোনও দায় নেই, সে মিথ্যের এস্টাব্লিশমেন্টমাত্রই লোভনীয়। ভারি নিষ্পাপ দেখতে, শুনতে কিংবা ভাবতে, এমন কোনওকিছু কিংবা কাউকে দিয়ে সেই বলিয়ে-নেয়া কিংবা করিয়ে-নেয়াটা হয়ে গেলে তো আর কথাই নেই! অবশ্য এর অন্যথায় হলে সেই দায়মুক্তি যে সবসময়ই সত্যিটাতেই হতো, তাও নয়। মিথ্যের দায় ঘোচে অনেকসময়ই মিথ্যেতেই। তবুও মানতে পারি না, ফুল কেন মিথ্যে বলবে? কেন ফুলকেও সন্দেহ করতে বাধ্য করতেই হবে? যে ফুল কাঁটাকে আড়াল করে, সে ফুলের মহত্ত্ব কেন কিছু বেহায়াপনার কাছে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকবে? একটাসময়ে মন থেকে নিই আর না নিই, মেনে নিই। ভালোবাসার এমন নানান মাত্রিক নির্লজ্জ কসমোপলিটান চেহারার সরব কিংবা নীরব প্রদর্শনীতে আমরা প্রতিনিয়ত কী বিশ্রীভাবেই না অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি! তাইতো মনে সংশয় উঁকি দেয়, ফুলের সাবলীল প্রতিশ্রুতির ভাষা হৃদয়ের উষ্ণতা কিংবা শীতলতার খোঁজ কতটুকুই বা দেয়? সব তাজা ফুলেই তো আর তাজা হৃদয়ের খোঁজ মেলে না। আচ্ছা, সে সান্ধ্যভাষার দ্ব্যর্থতার দায় কার? হায়! অমন দাবিতে এখনও অনভ্যস্ত যারা, তাদেরকে একপেশে করে রাখে ভালোবাসার পোকায়-কাটা চাদরে মোড়া পুরো সমাজের সব মুখোশপরা মানুষ। ওদের জন্য কারওরই কোনও ভালোবাসা নেই। শুধু আছে করুণা: আহা! ওরা কত সরল, তাই বেমানান। ওরা নিচেও নামতে পারে না, আবার ওপরে উঠতে গিয়েও ধাক্কা খেয়ে ফিরে-ফিরে আসে। ওদের জন্য কেউ দুই লাইন লিখে না। ওদের কোনও ফটোসেশন হয় না। ওরা নেই-বন্ধু’দের দলে। ওদের সংবেদনশীল মনটা আছেই বারবার দুমড়েমুচড়ে যাওয়ার জন্যই। ওরা কথার বলবার, ফিরে তাকাবার, এমনকি ভাববারও অযোগ্য! ওদের কোনও জাত নেই, ধর্ম নেই, এমনকি ছকটকও নেই; ওরা শুধুই ওরা!
আরেক ধরনের মূকাভিনয়ের কথা বলি। সে অভিনয় নেই-ভালোবাসা অভিনয়। কেন সে অভিনয়? এইজন্যই, হয়তো ‘ভালোবাসি’ বলে দিলে বন্ধুত্বটাই আর থাকবে না। তার চাইতে এ-ই ঢের ভাল! ভালোবাসাটুকু থাক লুকানো, বন্ধুত্বের আড়ালে। আর কিছু হোক, না হোক, মানুষটা তো অন্তত দূরে সরে যাবে না, দূরে সরিয়েও দেবে না। এমনকিছু মুহূর্ত আসে, যখন যাকে ভালোবাসি, অথচ সে বাসে না, কিন্তু না বাসলেও কাছে আছে, এই অনুভূতিটুকুও মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। এই বেঁচে-থাকাটা জলের বোতল কাছে নেই বলে মদের বোতলে একগুচ্ছ রজনীগন্ধাকে তাজা রাখার চেষ্টার মতন। ভালোবাসা গ্রহণ করা বড় শক্ত কাজ। এর চাইতে বন্ধু হয়ে থাকা যায় ভাবনার খুব কম খরচেই। তবুও বুকের ভেতরে প্রচণ্ড ভালোবাসা নিয়ে সহজ বন্ধুত্বের অভিনয় করে যাওয়াটা সত্যিই ভীষণ কঠিন। ধরুন, কারওর সাথে আপনি ওরকম অভিনয় করেই যাচ্ছেন। যার সাথে করছেন, সেও এটা মেনে নিচ্ছে। কেন নিচ্ছে? এখানে দুটো ব্যাপার থাকতে পারে। সে হয়তো বা জানেই না যে আপনি অভিনয় করছেন, অথবা যেকোনও কারণেই হোক সে আপনার সাথে সম্পর্ক রাখতে চাইছে অথচ সেই সম্পর্কের কোনও নাম দিতে চাইছে না। আপনি চাইছেন, সে আপনাকে ভালোবাসুক আর না-ই বাসুক, অন্তত বন্ধু ভাবুক। প্রয়োজনে যেকোনও মূল্যে। যদি এমন হয়, ও শুধুই ওই মূল্যের বিনিময়ে আপনাকে বন্ধু ভাবছে, তাহলে আপনি কি সেই মানুষটার কাছে সবসময়ই হেরে যাচ্ছেন না, যাকে ও সত্যিই ভালোবাসে কিংবা বাসবে? এরকমও দেখেছি, কে কাকে ভালোবাসে, অন্যকেউ তা জানে না। এমনকি, কখনও-কখনও ওরা দুইজন নিজেরাও জানে না, জানতে চায় না---ভয়ে কিংবা সংশয়ে। ভালোবাসার রঙটা চোখে একবার পুরোপুরি ধরে গেলে, এমনও হতে পারে, সে রঙ সয়ে যাওয়ার আগেই চোখ অন্ধ করে ফিকে হয়ে যেতে পারে! ভালোবাসার ধাঁধানো রঙ সবাই সহ্য করতে পারে না। আবার দুজন মিলে ভালো বেসে-বেসে ভালোবাসার আলোয় রঙের ছটায় নিজেদের রাঙিয়ে নিয়ে আলোর ঝর্ণাধারায় অবগাহন করার সুখে মিশে থেকে যেতে পারে অনন্তকাল।
কোনও ব্যাপারে কোনও কনক্রিট কিছু সিদ্ধান্ত দেয়া না গেলে কিংবা পরিস্থিতির কারণে ঠিক ওই মুহূর্তে দিতে ইচ্ছে না করলে এমবিএ’র ক্লাসে একটা কথা আমরা প্রায়ই শুনতাম আর বলতাম, Depends........... জীবনের অংকেও দেখি সেই Depends...........!! এ হিসেব বড় বেহিসেবির হিসেব। এ হিসেব শুধু হেঁয়ালিতেই মিলে। এ সম্পর্কের নাম নামহীন সম্পর্ক; ফেসবুকে It’s complicated!, জীবনে Death otherwise!