বই কিনে কেউ প্রেমিকা পায় না

বই পড়ার তুলনায় না-পড়তে আমি ভালোবাসি৷আমি চাই আমার কাছে কিছু বই থাক৷ সময় আর অবসর মত নাড়াচাড়া করা যাবে৷ আসলে, বই পড়া জীবনের সবচেয়ে পরিশ্রমসাধ্য কাজ৷ এবং আমি মূলত কুঁড়ে৷ . . . . . . . . বই পড়তে চাস না? কষ্ট হয় পড়তে? পড়ে আরও কষ্ট পাস? পড়িস না৷ যখন ভাল লাগবে, পড়বি৷ বা, নাহয় না-ই পড়লি৷

সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের এই কথাগুলো দারুণ লাগল৷ আমার সাথে পুরোপুরি মিলে, তাই৷ তবে, সন্দীপন ও-ই করেও সন্দীপন!—এটা মাথায় থাকে না৷ আমি বই কিনি যত বেশি, পড়ি তত কম৷

বই উপহার দিলে খুশি হয়, এমন প্রেমিকা পাওয়া যেকোনো পুরুষের জন্য সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার৷ কেন? প্রিয়া বই পড়ুক আর না-ই বা পড়ুক, পকেটের পয়সা তো বাঁচিয়ে দেয়! অ্যাতো কম পয়সা খরচ করে মেয়েদের ভুলিয়েভালিয়ে রাখা কম আনন্দের কথা নয়৷ একটা ক্যাডবেরিতেও ঢের বেশি পয়সা দৌড়ে পালায়! বইয়ের দাম নিশ্চয়ই অন্য অনেক গিফটের দামের চাইতে কম।

সেদিন এমনই এক ভাগ্যবান বন্ধুকে নিয়ে বুকশপে গিয়েছিলাম৷ প্রিয়ার জন্মদিন, ও বই দেবে৷ কিনলও৷ দুটো বই৷

প্রথমটা, সহজ পদ্ধতিতে চাইনিজ রান্না৷ বুঝলাম, আপাতত ও নয়, ওর হবু শ্বশুরবাড়ির লোকজন ভাগ্যবান৷ (বউ ভাল রাঁধতে জানে, এটা দারুণ একটা ব্যাপার! যে মেয়ে ভাল রান্না করে খাওয়ায়, তাকে ভালোবেসে ফেলা যায় খুব সহজেই। জানি, হেটাররা বলবে, তাহলে তো ভাল রাঁধুনি বুয়াকে বউ বানিয়ে ফেললেই হয়! যা ইচ্ছা বলুক গিয়ে! যার রুচি যেমন, সে তো তেমন পরামর্শই দেবে!)

কিছু শিবের গীত গেয়ে ফেলি এ ফাঁকে। সতীনাথ ভাদুড়ীর একটা অবজারভেশন শেয়ার করছি: খাবার জিনিসের মধ্যে দিয়েই লোকে হয় সবার চাইতে আপন; অচ্ছেদ্য পারিবারিক জীবনের সম্বন্ধগুলি যেখানেই খুব মিষ্টি দেখেছি, সেখানেই লক্ষ্য করেছি, স্ত্রী স্বামীকে বেশ নিত্যনূতন খাইয়ে রাখেন।

ভাদুড়ী মশাই, আপনাদের জেনারেশানকে আমি বরাবরাই এই জাতীয় কিছু ব্যাপারে ঈর্ষা করি। অধুনা অরন্ধনরন্ধনপটীয়সী আধুনিকারা রান্নাঘরের ছায়া মাড়ান হাউসমেডদের পা দিয়ে। কিংবা শাশুড়িদের। রান্নার বই কিংবা টিভি-শো দেখে-দেখে সিদ্দিকা কবীর সাজেন অতি যত্নে। সেই যত্ন মাথার রাজ্যে আনাগোনা করে যতটা, মনের রাজ্যে ততটা নয়। রান্নাঘর থেকে বইয়ে যাওয়া যতটা সহজ, এর উল্টোটা ঠিক ততটাই কঠিন! তবে সেই রান্না খাওয়ার সময় টিভি-শো’র অনিন্দ্যসুন্দরীর কথা ভেবেই বেশ তৃপ্তি নিয়ে খাওয়া যায়। মাথাখারাপ করে দেয়া সুন্দরীরা সব রান্না শেখায়। তাই ওদের ঢংটাই আমায় টানে বেশি। আমি মোটামুটি নিশ্চিত, সেই সুন্দরীর রান্না তার বেচারা বরটির ভাগ্যেও জোটে না অতটা। অন্তত সেই দিক বিবেচনায়, অধুনা শিক্ষিতা বধূ জিন্দাবাদ!

বন্ধুদের দেখেছি, বৌয়ের রান্নার তারিফে কী শুকনো মুখে থ্যাঙ্কস্ বলে। দোষটা বৌয়ের যতটা, তারচে’ বেশি বোধ হয় শাশুড়ির। উনি কেন ধরেই নেন, বিয়ের পরও মায়ের হাতের রান্নাই মেয়ে আর মেয়ে-জামাই খেয়ে যাবে আয়েশ করে? পড়াশোনার যোগ্যতায় যতই ওপরের দিকে হোক না কেন, বাঙালির স্বভাবই হল অন্তত আরও একটি ব্যাপারে ‘অতিরিক্ত যোগ্যতা’র পরীক্ষায় পাস করতে না পারলে মনের দরোজার বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখা। অন্তত আমার ক্ষেত্রে তা-ই। বেহালা-বাদক আইনস্টাইন, ফুটবলার নিলস্ বোর, ছবি-আঁকিয়ে রবীন্দ্রনাথ বরং আমার কাছে বড় বেশি আদরের। হোক গান। সাহিত্য। রান্না। কিংবা অন্য কিছু। তবে হ্যাঁ, মূল যোগ্যতা না থাকলে ওই ‘অতিরিক্ত যোগ্যতা’র কদর কম। কারণ ওতে সেটা তো আর ‘অতিরিক্ত’ থাকে না!

ন্যায্য পাওনার চাইতে উপরি, ফাও, বাড়তি—এগুলোর প্রতি উদাসীন এ জগতে কে? এই ফাঁকে বলে রাখা ভাল, সব ঔদাসীন্যই কিন্তু সত্যিকারের নয়। পাওনাদারের কাছ থেকে পয়সা ফেরত চাইতে যে ভুলে যায়, সে-ই আসলে ভুলোমনের অথেনটিক সার্টিফিকেটটা পায়। কত কী স্বপ্ন-টপ্ন নিয়ে ছেলেরা বিয়ে করে, আর শেষমেশ কিনা বসে-বসে Bridges of Sighs বানায়!

এবার শিবের গীত থেকে আধে-পরস্ত্রীর কাছে ফিরে যাওয়া যাক। আমার বন্ধুটি এরপর কিনল, ঘরে বসেই রূপচর্চা৷ এইবার বুঝলাম, আমার বন্ধুটি মহা ভাগ্যবান–বিয়ের পর বউয়ের পার্লারের খরচও যাবে বেঁচে! আহা আহা!! ভাগ্যবান পুরুষ হওয়া মস্ত বড় সৌভাগ্যের ব্যাপার৷ বলা বাহুল্য, ওই দুটো বই-ই বন্ধুকে বন্ধুপ্রিয়ার পছন্দ করে দেয়া৷

বন্ধুর সৌভাগ্যে ঈর্ষা হল৷ বরের পয়সা অনেক মেয়েই বাঁচায়, কিন্তু প্রেমিকের পয়সা বাঁচায় কজন মেয়ে?

বইয়ের দোকানে গেলে অন্ধও দেখতে পায়৷ সবসময়ই আগের বারের প্রতিজ্ঞা থাকে, ওই বারই বই কেনা শেষ৷ আগের গুলি না পড়ে নতুন বই কেনা আর নয়। তবুও চোখ সরে না, মন মানে না৷ (আমার কোনও দোষ নাই, সব দোষ বইয়ের৷) যে পুরুষ তার গার্লফ্রেন্ডকে সামনে রেখেও হাতটা ধরে না, সে তো অতি পাষণ্ড! আমি পাষণ্ড নই৷ আরও একটু সময় পর, আধটু করে আলতোভাবে চুমু খাওয়ার ইচ্ছেটা যে পুরুষ পাবলিক প্লেসে দমিয়ে রাখতে পারে না, সে তো রীতিমতো বর্বর! আমি বর্বরও নই৷ তাই, আমি কিনি, আমি উহাদিগকে কিনি৷ কাহাদিগকে কিনি? এ যে ক্লীবগোত্রীয় পুরাতন প্রেয়সী, এ যে বিশ্বস্ত মূক সহচরী, ইহার রহস্যের কি অন্ত আছে? আসলে, বই কেনায় আর রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই৷

আমাকে কেউ সাধারণত উপহারটুপহার দেয় না৷ তাই, আমি-ই দিই৷ বইয়ের দোকানগুলি থেকে মাঝেমাঝেই ফোন আসে—স্যার, নতুন বই এসেছে। দোকানে নতুন বই এলে ওরা বইয়ের লিস্ট মেইলে পাঠিয়ে দেয়। ছাপা ভাল, কাগজ ভাল, এমন বই কেনায় আনন্দ আছে৷ সে আনন্দেই সুখ!

স্কুলে যখন ছিলাম, তখন বছর শুরুর সময়টাতে বই হাতে পেতাম৷ মনে আছে, বাবা সবসময়ই স্কুলের বইয়ের সাথে আরো বেশ কিছু ‘অপ্রয়োজনীয় বই’ও কিনে দিত৷ কিনে দেয়া বইয়ের সংখ্যা আমার আগের ক্লাসের শেষ টার্মের রেজাল্টের সমানুপাতিক৷ বাবার সংগ্রহেও অনেক বই ছিল। বইয়ের প্রতি আসক্তি বাবার কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া৷

আমি অনেকদিন পর্যন্ত ছোটো ছিলাম৷ ছোটো মানে, যাদের হাতে বড় টাকা থাকে না৷ বই কেনার জন্য মায়ের কাছে টাকা চাইলেই পাওয়া যেত৷ মেয়েদের টাকা আর টুথপেস্টের টিউবের পেস্ট একই রকমের৷ সব শেষ হয়ে গেলেও কিছু না কিছু থেকেই যায়৷ কীভাবে যেন মেয়েদের চাইলেই পয়সা পাওয়া যায়৷ বই কেনার টাকা চাইলে মা কখনওই ‘না’ বলেনি৷ আসলে, পরে-পরে বাবার কাছে চাইতে কেমন যেনো লজ্জা লাগত৷ সে লজ্জা কোত্থেকে সৃষ্টি হয়েছিল, জানি না। মায়ের কাছেই বেশি চাইতাম৷ মা যেকোনো মূল্যে বাবার কাছ থেকে নিয়ে কিংবা নিজের আয় করা টাকা থেকে আমাকে বই কিনে দিত।

মাঝেমাঝে মায়ের সাথে বই পড়ার কম্পিটিশন হতো৷ কে কত বেশি বই পড়তে পারে! মা আমাকে প্রায়ই জিতিয়ে দিত৷ বাবা হাসত শুধু৷ সেই হাসির মানে যে কত মধুর, এখন বুঝি; আমিও হাসি৷ বাবা-মা’রা যে কত অবলীলায় বাবা-মা হয়ে ওঠে! ভাবতে সত্যিই অবাক লাগে!

যা-ই হোক, বছরের শুরুতে স্কুলের ঝলমলে শিশুরা নতুন বই হাতে পেপারে ফটোসেশন করে৷ আমি কেন বাদ যাব? আমি তো বড় হতে চাইনি; আমাকে বড় করে দেয়া হয়েছে। আমার কী দোষ?! তা-ই আমি সবসময়ই বছর শুরু করি বই কিনে, বছর কাটাই বই কিনে, বছর শেষ করি বই কিনে। আমার সকল সময়ই বইময় সময়। বছরের এমন কোনও সময় নেই, যখন আমার হাতে টাকা আছে, কিন্তু আমি বই কিনছি না। আমার পক্ষে বই না কিনে বাঁচা সম্ভব নয়।

অনেকেই বই কেনে, বুদ্ধিমানরা বই পড়ে, বোকারা বই পড়তে দেয়৷ অভিজ্ঞতা বলে, শেষ কাজটি প্রায়ই শেষ হয় সম্প্রদান কারকে৷ আমি অবশ্য আরও এক কাঠি বেশি সরেস৷ স্রেফ বই পড়ার অভিনয়েই আমার দিন কাটে৷ বছর-বছর আমার ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারটি কলেবরে বেড়ে যায় যতখানি, পড়ার ব্যাপারে আমার ঔদাসীন্য বাড়ে ততধিক৷ প্রাপ্তির রোমন্থন আর অপ্রাপ্তির হিসেব — এ দুইয়ের মিথস্ক্রিয়ায় ভাবনাগুলো ঘুরপাক খায়৷ ভাল লাগার কাছে ভাল না-লাগা মুখ থুবড়ে পড়ে প্রায়ই৷ এর জন্য ভাবনাদেয়াল দায়ি অনেকাংশেই।

আমার বছর শুরু হয় বই কিনে, কাটে বই দেখে, শেষ হয় কেনা বইগুলো পড়ার (ব্যর্থ) প্রত্যয় পরের বছরের কাঁধে চাপিয়ে৷ পয়সা দিয়ে ভাললাগা কিনি, আফসোস দিয়ে বেচি৷ আর এই দুয়ের মাঝে পড়ে আমার বছরগুলি চুরি হয়ে যায়৷ এক পাড়ে ভালোবাসা, অন্য পাড়ে মন্দবাসা৷ মাঝখানে ব্রিজ৷ সে ব্রিজ পেরুনো হয় না কখনওই৷ তবুও সেই ব্রিজে হাঁটতে-হাঁটতে নিচের বহতা নদীর দিকে তাকিয়ে বলি, এই বেশ ভাল আছি! বেঁচে থাকাটা তো দেখছি ভালই!

পুনশ্চ। একটা সময়ে আমি কী কী বই কিনি, ফেসবুকে শেয়ার করতাম। আমার ইচ্ছে ছিল, আমি যা পড়ি কিংবা পড়ার বা সংগ্রহ করার জন্য কিনি, অন্যরাও তা কিনুক, জমাক, পড়ুক। দেখলাম, লোকে খুব বাজে কথা বলতে থাকে এ নিয়ে, আমাকে আহত করে একধরনের অসুস্থ সান্ত্বনা পায়। এখন আর শেয়ার করি না। কী দরকার! যে আনন্দ শেয়ার করলে কষ্ট বাড়ে, থাক না সেটা লুকিয়ে!

ভাল কথা, আমি লুকিয়ে ফেসবুককে ভাবনাদেয়াল ভাবি, ডাকি। ওটা ভেবে নিতেই ভাল লাগে।