বছরশুরুর পঙ্‌ক্তিমালা

 রাত ফুরোতেই ঝকঝকে এক নতুন বছর!
পুরনো গেলো নতুন এলো চোখ মেলতেই! এ কী যাদু!
নতুন সাজে আজ প্রভাতে দূর পাহাড়ের আদিম গায়ে রঙ ছড়িয়ে সূর্য ফোটে,
সেই আলোতে চোখ ধাঁধিয়ে পুরনো বছর ক্লান্ত পায়ে নিজের কবর নিজেই খুঁড়ে বিদেয় হলো।
নতুন আলোয় নতুন বছর স্থির শরীরে ডাকল কাছে ছড়িয়ে জ্যোতি।
ঘুম ভেঙে তা-ই আলিঙ্গনে নিলেম বেঁধে, ভুল যা ছিল শুধরে নেবো, এই শপথে।
সূর্যটা আজ উঠল যখন, পেরিয়ে বছর বছর এলো, আশার আলো লাগল গায়ে,
নতুন দিনের এই উপহার আদর ভরে মাথায় নিলেম।
শুভক্ষণের এ উৎসবে প্রার্থনা আজ,
কাছের দূরের যে যেখানের, থাকুক ভালো, মাতুক সুখে,
বছর ঘুরুক আনন্দেতে, বাঁধন যতো, এক হয়ে থাক এ বছরে,
রোগটা সারুক শরীরমনের, চাকরি জোটাক বেকার যতো,
করুণাধারায় ভিজুক সবাই, দেশটা হাসুক সবার হিতে।
 
নতুন প্রাণে নতুন সুরে নতুন ফুলে জাগবে বছর, দুঃস্বপ্নের প্রহরগুলো সরিয়ে দূরে, হতাশা আর কষ্টটুকু ভুলিয়ে দিয়ে।
অনন্তটা এখন আমায় আর টানে না আগের মতো,
এই বছরে যা না হবে, তা হবে না আর কখনো, রাখবো মাথায়, সময় বেঁধে নামবো কাজে।
সব ইতিহাস সরিয়ে দূরে এক ইতিহাস আমিই হব, দিচ্ছি কথা!
বন্ধু শোনো, একটু বোসো, হাতটা মিলাও, বিদায় নেবার ঘণ্টা বাজে,
কাজ ডেকে যায়, শাসায় আমায়, বন্ধু তুমি আর ডেকো না আগের মতো,
কাজ ফুরোলে দেখতে পাবে, দেখবে সবাই, পরম সুখে সেদিন ডেকো।
 
গেলো বছরে ধূসর সময় কফিনঘরে মনের দেহের শরীর ঢেকে শিখিয়ে গেলো, সময় হলে যাবো চলে, পথের কোণায় লুটবে স্মৃতি! আজ যা আছি, কাল তা রবে বদলে খানিক, আমি রবো না। ফানুস-জীবন উঠবে যখন ভীষণ বেগে, জেনো নিশ্চয়ই, সামনে পতন, পড়লে ধুলোয় কেউ রবে না তোমার পাশে। মানুষ ধরো, যতোই টানো ভালোবেসে, অকৃতজ্ঞ সব বাঁচবে মানুষ কৃতঘ্নতায়। ওদের ভালো ভাববে যতো, কাঁটায় ওরা বিঁধবে ততো। দুঃখে থাকো, কিংবা সুখে, দিনটা তোমার বদলে যাবে তোমার কাজে, কালের সাজে। এমন বিধি ভিন্ন হলে হায় কখনো, যা হয় সেদিন, গ্রহণ কোরো, নিয়তি মেনো। স্বপ্ন সুখের ভারটা বাড়ায়, প্রাপ্তি দুঃখের হালকা ক্ষোভে বাঁধ ভেঙে দেয় সব সাহসের। প্রখর শিখায় সেদিন বেঁচো!
 
আসলে বছর, পুরনো পেপার লাফায় দূরে, পুরনো পোশাক পালায় সরে, পুরনো কথা নতুন সুরের হাওয়ায় নড়ে।
অবশ বছর মুখোমুখিতে আমায় বসায়,
সব গতকাল--সমস্বরে অন্ধকারের বয়ান ধরে, শোকগীতি গায়, ভয়টা দেখায়, চোরাবেদনা তাড়িয়ে বেড়ায়।
স্মৃতিরা এসে ভিড় করে রয়, কিছু হতাশা ছায়ায়ঘেরা, কিছু অর্জন স্বস্তিমোড়া, যন্ত্রণা আর দুঃখগাথা--থাকেই সেতো!
কষ্ট-স্মৃতি আগুন পোড়ে, ছাই হয়ে যায়, ছাইয়ের শরীর হাওয়ায় ওড়ে, চোখটা পোড়ায় যখন ভাবি,
বন্ধু তবু ছিলে তুমি, না হোক সুখে, দুঃখে এসে হাত ধরেছ,
পৃথিবী যেদিন সরেছে দূরে, দুলেছে মাটি, ভেঙেছে আকাশ মাথার ওপর, বলেছে সবাই, “বিদেয় হলেম, ভালো থেকো”,
সেদিন আমায় একটু আশার আধটু আলোয় বেঁধেছিলে এটুক বলে, “ভয়টা কীসের? এইতো আছি পাশেই দেখ, আগের মতোই।
সুখে আমায় পাও বা না পাও, দুঃখে জেনো ঠিকই পাবে। সারাটি জীবন আমায় রেখো এ বিশ্বাসে।”
 
উল পশমের নিরেট বাধায়, কুয়াশা শীতের দৌড়ে পালায়,
যে কুয়াশা মনকে ঘিরে, সে কুয়াশা পালায় কীসে? নতুন বছর তার যাদুতে খুলুক সে জট।
আজ যারা নেই, কালকে ছিল, সবাই ওরা থাকুক ভালো বেশ আদরে।
অনাহারীর জুটুক খাবার, বস্ত্রহীনের জুটুক কাপড়, ওষুধ জুটুক সব পীড়িতের।
জীবনটাকে যে সাজ মানায়, সে সাজ সাজুক জীবনে সবার,
প্রেম প্রীতি আর ভালোবাসার বৃষ্টি নামুক কথায় কাজে। মায়ার ডোরে বাঁধুক জীবন।
বিষণ্ণ সব ছন্দগুলো হাওয়ায় মিলাক, পাপের বোঝা একটু কমুক,
অভাবটুকু যাক হারিয়ে, রুদ্ধ হৃদয় জাগুক আজি শুদ্ধ বোধে,
রক্তে নাচুক পুণ্য অহং, ন্যায্যতা আর সত্য আসুক, কুৎসা ঘুচাক,
অসূয়া সরে চারুতা নামুক চিত্তে সবার, স্বস্তি সুখের রৌদ্র উঠুক!
রোগবালাইয়ের দাপট কমুক, বাণিজ্যেতে ঋদ্ধি ঝরুক,
লিপ্সা ধনের দূর হয়ে যাক সত্য হুঁশে, আঁধার কেটে আলোয় ভরুক জীবন সবার।
যা কখনো হয়নি বলা, ভালোবাসা আর অনুকম্পায়, এমন কথা হৃদয় নাচাক আশায় জাগাক,
সকল দুঃখীর কষ্ট সরুক এই বছরে, বৃদ্ধ পিতার, বৃদ্ধ মাতার অশ্রু মিলাক সুখের ছোঁয়ায়, এই বছরে।
 
নানান রঙ হরেক ঢঙে চোখ ধাঁধালো, নানান সুর ভিন্ন ছলে মন ভরালো,
এমন করেই কী খুশিতে ঘুরলো বছর সুরের রঙের সব ইশারায়!
অচিন রঙের অচেনা সুরের দারুণ দেশের পথিক হব এই বছরে,
সূর্য হাজার হবে জড়ো, জ্বলবে বুকে প্রবল ধাতে নিশিত তেজে,
তারার ডানায় ভর করে আজ লক্ষ ভুবন দেবো পাড়ি আলোর খোঁজে,
বৃদ্ধ আধি নবীন ভাবে চাইবে জীবন, স্বপ্নপথের স্বপ্ন সকল উঠবে গেয়ে সে গাথাতে, যে গাথাটা হৃদয় গাঁথে।
কখনো ফাঁকে, এক পেয়ালা কফির কাপে, রঙিন সুতোয় পুরনো সুখে যাবো ভেসে যখন যেটুক, বন্ধু তুমি তখনো থেকো আমার পাশে।
যেমন মায়ায় দুঃখ সরাও, তেমন মায়ায় সুখেও বেঁধো।
আমাদের সব গল্প ঘুরে ঘাসফুলেদের কানে-কানে, কী তার মানে, মুহূর্ত সব বুঝুক ভুলুক,
হাওয়া তো জানে! সেই হাওয়াটা যে হাওয়াতে ভাসিয়ে দিতাম দুঃখ যতো,
দুজন মিলে। হাতটা তোমার বাড়িয়ে দিয়ো আগের মতো,
আমায় পাবে ঠিক তেমনই যেমনি পেতে, করছি শপথ।
 
বছর গেলো ভুল কুড়িয়ে, বছরশুরুর লক্ষ্যরা সব চলল হেলায় বেশ খুঁড়িয়ে,
রইলো হিসেব গোলমেলে খুব। সবই হলো আমার দোষে--এমন করেই সবাই ভাবে। এটাই নিয়ম।
মানছি সবই, বলছি তবু, সবকিছু শেষ যায়নি হয়ে আজ এখনো,
প্রাণটা আছে যে অবধি, থাকবো লেগে সাধ্যে কুলায় যেটুক যতো।
এই প্রহরের কষ্ট এমন তাড়িয়ে বেড়ায় অযুত জীবন--আমি একা নই এই ধূসরে, এটাও জানি।
বন্ধু ভেবে নিয়েছি টেনে যারেই কাছে, প্রথম আঘাত সেই করেছে!
জীবনটা হায় ধ্বংস হয়ে স্তূপ পড়ে রয়। সেই স্তূপেরই রাজপথটায় কী এক সুখে নিজেই হাঁটি।
পাপেট-জীবন কেটেছে এমন বছরজুড়ে।
ভেবেছি ভুলে, খেলিয়ে সময় হিসেব ছেড়ে এমনিই বুঝি কাটে জীবন মুঠোয় হাতের।
পুরনো যতো স্বপ্নগুলোয় দুঃস্বপ্নের পাহাড় গড়ে কেটেছে বছর,
ক্ষণের মোহে জীবনটাকে তুচ্ছ বোধে হারিয়ে হেলায় ফুরেছে প্রহর।
 
একেক শীতে বছরগুলোর মৃত্যু ঘটে,
বছরশেষের রাতটা কাঁপে হিমের চাদর জড়িয়ে গায়ে, ঝরাপাতার রথটা চেপে বছর ঘুরে বছর আসে,
নতুন বছর এলো যে তাই, ফুলের সাথে, পাখির সাথে কুহেলি হাওয়া দ্বন্দ্ব বাধায়।
কুহেলিকার সিংহ বেঁধে, লুকিয়ে রাখো সুরের খাঁচায় ছদ্মবেশে। ও যদি আজ
হঠাৎ ক্ষেপে, কিছু না বুঝে ভয়টা দেখায়, ওর ভয়েতে বছর পালায়,
পুরনো বছর থাকবে সাথে! মাথায় রেখো! বৃথা ভুলের বইটা খুলে পড়তে হবে আগের চালে।
 
নতুন বছর মনে এনে দেয় এমন মানুষ,
যে কখনো মনের কোণে একটুখানিও দেয় না উঁকি, একটা বছর!
বছর ঘোরে এক চাকাতেই, অন্য চাকায় স্বপ্ন ঘোরে, ভালোবাসায় মাখিয়ে জীবন এরই মাঝে মানুষ ঘোরে।
এক বছরের সকল বোঝায় পরের বছর চাপায় মাথা,
বছরশুরুর মুহূর্তটা সংকল্পের ফর্দে ভাসে--এসব দেখে, একটু দূরে, চুপটি করে নিয়তি বুঝি মুচকি হাসে।
ক্যালেন্ডারের উল্টে পাতা বিক্রি বাড়ে।
দেখো ভেবে, নতুন বছর একটি তারিখ, আর কিছু নয়, এই নিয়ে কী তুঘলকি হয়!
নতুন বছর, মিনতি রেখো কেবল এইটুক, পুরনো নামে আর ডেকো না পুরনো আমায়,
আমায় চিনো নতুন নামে, যেকোনো নাম, যেমন খুশি! সেই নামেতে থাকবো বেঁচে,
হোক না বাজে, ভুল করে তাও চেয়ো না ফিরে পুরনো ব্যথায় পুরনো নামে এই বছরও!