বছর ফুরনোর লিপিকা

এই তো বছরখানেক আগের একটা নববর্ষ...
আমাদের সম্পর্কটা কিছুপথ এগোনোর শুভারম্ভ।




আমার তখনও নিজস্ব একটা মুঠোফোন কেনা হয়নি। রাত ১২টা বাজবে বাজবে, এর ঠিক দুসেকেন্ড আগে কী যেন একটা খুদেবার্তা টুক করে এসে পৌঁছল রাত্রির সমস্ত নীরবতার বেড়াজাল ভেদ করে!




আমার মধ্যে কেমন জানি রক্তের স্রোত ক্রমশ উষ্ণ হয়ে উঠতে লাগল...বুঝতে দেরি হলো না...সমস্ত ভাবনায় শুধু একটাই দাবি...যে করেই হোক ওই বার্তাটা আমার এক্ষুণি দেখা চাই! সাধ্য ছিল না, তাই সাধ জাগার পরেও চাতকীর চেতনা মুখ ফিরিয়েই রাখল! এ যেন ঠিক সভ্য যুগে নিষিদ্ধ ভদ্রতার প্রলেপ!!




কী ছিল সেই বার্তায়? নিশ্চয়ই কবিতার কিছু লাইন ছিল? না না...গাঢ় আবেগমেশানো কিছু চাওয়া...বা নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে দীর্ঘ কোনও উপাখ্যান! আচ্ছা, এ-ও তো হতে পারে, কালকে অঙ্কে ভুল করাতে সেই নিয়ে কোনও দীর্ঘ অবোধভাষণ...আমার উত্তরের আশায় নিশ্চয়ই মুঠোফোন হাতে নিষ্পলক তাকিয়ে আছেন তিনি! ইসসসস্! আর পারছি না! আচ্ছা, রূপকথায় তো কত পরী, কত ঠাকুমা আসেন, আর কত কত ম্যাজিক করে সব ঠিক করে দিয়ে যান...আমার জন্যেও কেউ আসুক না! আমি তো খুব করে চাই...কোন‌ও ঠাকুমা এসে ওঁর পাঠানো ভালোবাসাটুকু আমাকেও একটুখানি ছুঁয়ে দেখতে দিক!...দিক না...কী হয় দিলে...!!




সারারাত কেটে গেল এপাশ-ওপাশ করে। ঘুমুতেই পারলাম না যতক্ষণ না ছুুঁয়েছি টুকরো টুকরো শব্দে-বাঁধানো তাঁর অনুভূতিগুচ্ছ...!




বছরের প্রথমদিন হিসেবে সব জায়গায় নতুন বই বিতরণের ধুম লেগেছিল, কত করে চেয়েও আমাদের দুজনের একটু কাছে এসে কথা বলার উপায় হলো না! ১১টা নাগাদ যখন হালকা জলখাবারের সময় হলো, তখন পাশ কাটাতেই ওঁর গলা শুনতে পেলাম...এই, একটু থেকো!




কত ছোট্টো দুটি শব্দ...তবু যেন শতলাইনের অমর অজর অক্ষয় পঙ্‌ক্তিগুচ্ছে সজ্জিত!




পাঁচ মিনিট, কুড়ি মিনিট...তিরিশও পেরিয়ে গেল...একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছে সময়, শুধু আমিই রয়ে গেলাম পিছু, একটি পদধ্বনি শোনার অপেক্ষায়..! এভাবে কেটে গেল দুশো ষাট মিনিট। জানালার ধারে পাঁচিল ঘেঁষে আমি দাঁড়িয়েই ছিলাম তাঁর দিকে চেয়ে, উনি কী যেন একটা মিটিংয়ে ছিলেন। একেকবার করুণ চোখে একবার আমার দিকে তাকান, আবার মিটিংয়ে ফেরেন। ভীষণ রাগ উঠেছিল আমার সেদিন! চোখ-মুখ ফুলিয়ে চলে এসেছিলাম বাড়ি, কান্না ধরেই রাখতে পারছিলাম না কোন‌ওমতেই! কেমন অহেতুক বোকা বোকা কান্না, তাই না !




ভালোবাসলে নাকি পাথরের শক্ত বুকেও শিশুমনটা জেগে ওঠে, এমন শুনেছি।




উনি আহত মনে বাড়ি ফিরে আমাকে মেসেজ পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু আমার আর তা দেখা হয়নি। ভেবেছিলেন, ওঁর উপরে ভীষণ চটেছি। আমি আসলে মিটিংয়ের লোকজনদের উপর চটেছিলাম! হি হি হি...সে আর কে বলবে ওঁকে! কেন‌ই-বা বলবে! থাক্, একটু দাম দিক না আমার প্রতীক্ষার!!




পরদিন ক্লাসে যাবার আগে-পরে কতবার যে আমায় মিহি গলায় ডেকে ডেকে সারা হয়েছিলেন, ভাবলে এখনও মনে একধরনের আবেশ ছড়ায়। একটা নোট দেখানোর ছিল ওঁকে, কিন্তু আমি নিজে না গিয়ে ওটা অন্যজনের হাতে পাঠিয়েছিলাম। তখন সে কী এক অস্ফুট আর্তনাদ তাঁর চোখে ঝরেছিল...লিখতে গেলে শব্দের বুকেও আমার প্রতি রেষ জেগে উঠবে!!




বলে পাঠিয়েছিলেন, 'যাও, গিয়ে ওকে আসতে বলো।' অগত্যা, আর প্রাণে সইল না। দরোজায় গিয়ে দাঁড়াতেই আমাকে বলেছিলেন, 'দেখো, আমার হাতগুলো ঠান্ডা হয়ে গেছে, গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে, তুমি এমনও পারলে...!'




সেই মুখখানি আমায় সেদিন এত যে মায়ায় বেঁধেছিল! ভরসা, বিশ্বাস, আশ্রয় সবই খুঁজে পেয়েছিলাম, আমার চিরসুখের ছাউনি তো ওই চোখেই, সেই মাহেন্দ্রক্ষণে বুঝেছিলাম!




মুখ ফুলিয়ে বলেছিলাম, 'আমায় যে অতটা সময় দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন, তাই ঠিক করেছি, আর কথাই বলব না!'




শুনে তিনি কাঁদো কাঁদো গলায় বলেছিলেন, 'আমাদের প্রথম নববর্ষে তোমাকে একটু নিজের করে পেতে চেয়েছি, একটু সময় তোমার ভালোবাসা পাব বলে অপেক্ষা করে ছিলাম, তোমার হাতদুটো আলিঙ্গনে বেঁধে কিছু কথার বিনিময় করব তোমার-আমার শহরে, এমন‌ই ভেবেছিলাম। আচ্ছা থাক, বলে আর কী হবে, তুমি তো শুনতেই চাও না, আমার সাথে কথা বলতেই তো চাইছ না! এভাবেই বুঝি শুরু হলো আমাদের প্রথম নববর্ষ!?'




ভালোবাসা ও মায়ায় মাখামাখি আমার মানুষটার অভিমানের ঝড়ে আমি পারলামই না কিছুতে খড়কুটোও আঁকড়ে ধরতে! ভারাক্রান্ত মনে সংকোচসাগরে গুঁজে-দেওয়া হাতদুটো ধরে বলেছিলাম, 'ঝগড়া করেই শুরু হলো নতুন বছর যখন, দেখবেন, রোজ রোজ আপনার সাথে আমার একপশলা করে ঝগড়া হবে! আচ্ছা করে দেবো একদম...আমায় দাঁড় করিয়ে রাখা, না...!'




আমার অমন প্রগলভতায় আমার চিবুকে আলতো টান দিয়ে উনি হেসেই লুটিয়ে পড়লেন। বিশ্বাসের, ভরসার আর মমতার তৃপ্ত শ্বাস ফেলে আমাদের ভালোবাসার নতুন বছরের সূচনা হয়েছিল।




দেখুন না, আজ কতগুলো নববর্ষ এসে শূন্যহাতে, দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফেলে শুষ্ক পাতা মাড়িয়ে একাই চলে যায়...! আজ যেন আর আসেই না নববর্ষ আমার জীবনে। আপনি ছিলেন আমার আবিষ্কৃত সব থেকে অভিনব, সব থেকে মৌলিক  রুবি, সব থেকে ভিন্ন কেউ, যাকে আমি চেয়েছি হয়তো অজানা কোনও আর্জিতে। আমার মধ্য থেকে কেউ যখন বলে মাঝে মাঝে, আমি আপনাকে হারিয়ে ফেলেছি, তখন ভীষণ অসহায় লাগে আমার, ভয় হয়...বড্ড ভয় হয়... হ্যাঁ, আজ‌ও!




একাকিত্ব আমি কখনওই ভয় পাইনি; জানেন, পাই না এখনও, ভেতরে থেকে ডাক আসে অবিরত...আমি হারাইনি আপনাকে, হারাতে পারি না! আপনি ঠিকই আছেন, আমার রক্তের উষ্ণ স্রোতে, আমার পাগলামো-মাখা সব চাওয়াতে, অবাধ্য সব যুক্তিতে, প্রতিটি বছরের সূচনাতে, আমার বালুকাবেলাতে, আমার প্রতিটি উত্তপ্ত শব্দে...!




আপনি জানেন, আমি অন্য কাউকে পেয়েছিলাম একদিন! তিনিও ছিলেন যেমনি অভিনব, তেমনি মৌলিক, তেমনি সরল। শুধু একটা জায়গায় আপনি আর তিনি ভিন্ন। কোথায় জানেন? অভিনবত্বের জায়গায় দুজন একেবারে স্বতন্ত্র!! মানুষটা সম্পূর্ণ ভিন্ন কেউ, তাঁর মাঝে যেমন আপনি নেই, আপনার মাঝেও তেমন ওঁর ছায়া নেই, যা আমি বরাবরের মতো চেয়েছি। তাঁর মাঝে অনেক বড়ো একটা মন আছে, অনেক অনেক ভালোবাসা আছে। তিনি খুব করে ভালোবাসতে জানেন, আবার নীরবে ভালোবেসে সরে দাঁড়াতেও জানেন!




তাঁকে আমি ব্যাখ্যা করতে চাই না; যেমন আপনাকে করিনি, তেমন ওঁকেও করব না। আমার ভালোবাসার লুকোনো সৌন্দর্যগুলো আমি আমার কাছেই রাখতে যে বড্ড ভালোবাসি! কেবল আমার কাছেই ওসব অমূল্য, আর কেউ পারবে না সেগুলো আগলে রাখতে, হয়তো ওতে অমন অনিন্দ্যসুন্দর ধূসর‌ই হয়ে যাবে! অতটা স‌ওয়া যায় কি, বলুন!




কিন্তু জানেন, আমি তাঁকে তাঁর মতো করে ভালোবাসা দিতে পারিনি, আমার ভালোবাসায় যে শক্তিই নেই ! তাই আমি তাঁকেও হারিয়েছি মনে হয়! হায়, বুঝি ফ্যাকাশেই সমস্ত ভালোবাসা আমার! হ্যাঁ, তাঁর ভালোবাসার কাছে আমার সমস্ত কিছু সত্যিই বড্ড ফ্যাকাশে ঠেকেছে! আমার কাছে ভালোবাসা দেবার মতো সেই সুধাভাঁড় নেই, হয়তো সব মিলিয়ে গেছে কালের গর্ভে, না হয় কখনও ছিলই না! ভালোবাসা যায় যাকে, তেমন মেয়ে আমি নই, এটা এখন আমি  বিশ্বাস করি। আগাগোড়াই ব্যর্থ একজন মানুষ আমি!




হে আমার প্রিয় ভালোবাসা,
তোমায় অনেক যত্নে সাজিয়েছি, তুমি নাহয় সেখানেই কোন‌ও এক বদ্ধ চিলেকোঠায়, না-পড়া চিঠির খামে পড়ে থেকো নিভৃতে! কোন‌ও এক বিদায়ের ক্ষণে অবেলায় কেউ হয়তো তোমাকেও ছোঁবে...! সেই হৃদয়মথিত আয়োজনে আমি নাহয় না-ইবা র‌ইলাম!