বদলে যাওয়ার গল্প

সালটা খুব সম্ভবত ২০০৯। ডিসেম্বরের কোন এক সন্ধ্যা। চট্টগ্রামের জামাল খানের চেরাগি পাহাড়ের মোড়। পিঠেপুলি, চটপটি, ফুচকা আর লিকার চায়ের গরমে শীতের সন্ধ্যার ওম জেঁকে বসেছে সে মোড়ের পরতে পরতে। সে রঙিন সন্ধ্যায় কথার তুবড়ি ছুটছিলই তো ছুটছিল!

ছেলেটি প্রতিদিনের মতো সিগারেট ফুঁকছে আর ধুমসে আড্ডা দিচ্ছে ব্র্যাক ব্যাংকের সামনের জায়গাটিতে দাঁড়িয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাসকরা বেকার মেধাবী ছেলে; ধাক্কা খেতে খেতে ধরেই নিয়েছে, চাকরিবাকরি মামাচাচা ছাড়া হয় না। ঘুম থেকে ১২টায় উঠে, ১ ঘণ্টা ধরে আয়েশ করে ব্রাশ করে, ব্রাঞ্চ (brunch) সারে, রিটায়ার্ড বাবার অভিসম্পাত আর মায়ের চোখের জলের আটপৌরে আলপনায় ওর সকালটা ফুরোয় ২:৩০টায়। এরপর মেসেঞ্জার অন করে বিছানায় একটু গড়িয়েটড়িয়ে ফ্রেশ হয়ে বের হয়, পড়ন্ত বিকেলে প্রেমিকার চোখে সন্ধ্যানামা দেখে। যার কিছু নেই, তারও একটি প্রেমিকা থাকে। স্বপ্ন দেখে, একদিন সেও একটা চাকরি জুটিয়ে প্রেমিকা অন্যঘরে যাওয়ার আগেই নিজের ঘরে পাকাপাকিভাবে নিয়ে আসবে। সেকথা সে মেয়েটাকে বলেও। পৃথিবীর অন্য ১০টা পুরোনো বোকা প্রেমিকার মতো এই রূপসীও বিশ্বাস করে, একদিন সত্যি সত্যি ওরকম দিন আসবে। ওই স্বপ্নদেখা পর্যন্তই সন্ধ্যাটা থমকে থাকে। ফ্রি ফ্রি স্বপ্ন দেখতে ভাল লাগে তো! স্বপ্নপূরণের জন্য কাজ আর এগোয় না। স্বপ্ন স্রেফ স্বপ্নেই মরে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে। প্রেমিকার বিয়ের কথা চলছে। এমনসময়ে কী করতে হয়, বেকার ছেলেটি জানে না, কিংবা জানতে ইচ্ছে করার সাহসটুকু করে না। শুধু জানে, একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। মিথ্যে স্বপ্নের বুননে ঝলমলে হলদে সন্ধ্যাবাতি জানিয়ে দেয়, সাড়ে ৭টা বাজে, ওকে বাসায় দিয়ে আসতে হবে। মেয়েটা বাসায় ফেরে, ছেলেটা প্রতিদিনকার আড্ডায় যায়। ওখানে ওর বন্ধুরা আছে। সবাই ওর মতো; বেকার মানুষ, ব্যস্ত ভীষণ! যতটা বেকার, ততটাই ব্যস্ত! চাকরি নেই, তবুও অন্তত একটা করে প্রেমিকা আছে। সময় কেটে যায় দিব্যি! পরিশ্রম করার ইচ্ছে কম, স্বপ্ন দেখার সাধ বেশি। বাবার কষ্টের টাকায় ভাত গিলে আর নিজের টিউশনির টাকায় বাদামখাওয়া প্রেম করে। পরিবারের বোঝা কাঁধে না নিয়ে নিজেই বোঝা হয়ে আছে অনেকদিন ধরেই। ঈশ্বরপ্রদত্ত বাবার হোটেল আছে, ফ্রিতে থাকাখাওয়া যায়। আশেপাশের লোকজন ধিক্কার দেয়, ওটা সয়ে গেছে, এখন আর গায়ে লাগে না। ওরা ঘুমায়, জেগে উঠে আবারও ঘুমিয়ে পড়বে বলে। মাঝেমাঝে চাকরির জন্য পরীক্ষাটরীক্ষা দেয়। ঠিকমতো পড়াশোনা করে না; পরীক্ষা দেয়, এটাই সান্ত্বনা। চাকরি পায় না, সিস্টেমের চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করে, বলে বেড়ায়, “ঘুষ ছাড়া চাকরি হয় নাকি? মামাচাচা নেই, কে বলবে আমার জন্য? সব শালারা করাপ্টেড!” বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে একটাসময়ে সে আন্দোলনে রাস্তায় নামে, ফেসবুকের ওয়াল তোলপাড় করে। পড়াশোনা করার চাইতে ওটাই ঢের সহজ। প্রেমিকাও ভাবে, ও তো অন্তত চেষ্টা করছে! একদিন আমরাও ওই ফানুসের মতো ইচ্ছেঘুড়ি হব। ………… ১১টায় বাসায় ফিরে, রাতটা কাটায় ভার্চুয়ালে। ফেসবুকে বড় বড় কথায় জানিয়ে দেয়, ও কিছুতেই ছোট নয়। কিছু থাক না থাক, একটা স্ট্যাটাস তো আছে! ফোনের ঝড়ে রাতের আবেগ তুলোর মতো উড়তে থাকে। চ্যাটিং আর ডেটিংয়ের নেশায় রাত ভোর হয়। মা জানে, ছেলে রুমের দরোজা বন্ধ করে পড়ছে। বাবাকে বোঝায়, তুমি দেখো, আমাদের নিতুর বিয়েটা বাবলাই দেবে!

একটা চাকরি দরকার, চাকরি! মধ্যবিত্তের প্রাণ না থাকলেও চলে, কিন্তু চাকরি লাগেই! দিন কাটে, রাত ফুরোয় স্বাধীনতা বিকিয়ে দেয়ার চুক্তিপত্রে স্বাক্ষরের প্রতীক্ষায়। সাদরে দাসত্ববরণের শতাব্দীপ্রাচীন আয়োজন চলে ঘরে ঘরে।

সেই শীতের সন্ধ্যাটি সবকিছু বদলে দিল! ওই বেকার যুবকটি দেখল, ব্লুজিন্স-ইয়েলোটিশার্ট পরা একটা ছেলে জীপ থেকে নামল। সাথে একজন পুলিশের পোশাকপরা বডিগার্ড, সারাক্ষণ শশব্যস্ত স্যারের সেবায়। ওই ছেলেটি একটা বইয়ের দোকানে ঢুকে গেল। ওখানকার অনেক লোকই ওকে চেনে। অনেকেই হাসিমুখে হ্যান্ডশেক করছে, কুশল বিনিময় করছে। জানা গেল, সেই ছেলেটি পুলিশে চাকরি করে; এএসপি। ২৪ ব্যাচের একজন কর্মকর্তা। একেবারে হতদরিদ্র অবস্থা থেকে উঠেআসা একজন সেলফমেইড মানুষ। পুলিশে চাকরি পাওয়ার সুবাদে ওর অর্জন তিনটি : এক। ওর গ্রামের বাড়িতে নতুন টিনের চাল লাগিয়েছে। ওর বুড়ো মাকে এখন আর জংধরা টিনের ফুটোয় গলেপরা বর্ষার পানি সরাতে হয় না। দুই। গ্রাম্য অশিক্ষিত বুড়ো বাবা-মা’কে ওর সরকারি গাড়িতে করে চট্টগ্রাম শহরটি ঘুরে দেখিয়েছে। অপার বিস্ময়ে ওর বাবা-মা জেনে গেছে, ওদের ছেলেকে থানার ওসিও ‘স্যার’ ডাকে! তিন। ওকে এখন আর শত সেলাইয়ের ছেঁড়াশার্ট পরে বাইরে যেতে হয় না। প্যান্টের হাঁটুর কাছের ফুটোটায় আঙুল ঢুকিয়ে কেউ আর মজা করতে পারে না। ………… চাকরি পাওয়ার আগে শহরে সে এক বড় ভাইয়ের রুমে ফ্লোরে থাকত, এতে ওর ভাগের মেসভাড়া অর্ধেক দিলেও চলত। বেঁচে-যাওয়া টাকায় গ্রামের কলেজে ইন্টারপড়ুয়া ছোটবোনের পড়ার খরচ আর নিজের খাওয়ার খরচটা মেটাত। ৪টা টিউশনি করতে হত। ওতে যে টাকা আসত, সে টাকা কারোর কারোর একটা টিউশনির টাকার সমপরিমাণ। ডিগ্রি কলেজের স্টুডেন্টদের এর চাইতে দামি টিউশনি জোটে না।

সেই একটি আশ্চর্য সন্ধ্যা সবকিছু পাল্টে দিল। নিজের প্রতি প্রচণ্ড ধিক্কার ক্ষোভ জেদ আর অভিমানে সেই ছেলেটি পুরোপুরি বদলে গেল। হঠাৎই জেগেওঠা সময়ের দাবিতে অভিযোগ করার অভ্যেস থেকে সরে এসে পরিশ্রম করার মানসিকতা গড়ে তুলল। ও হয়ে গেল একেবারে অন্যমানুষ! পরপর ৩বারের চেষ্টায় সে এখন বিসিএস প্রশাসনের ৩১ ব্যাচের একজন কর্মকর্তা। ওর বাবাকে এখন আর মুখ লুকিয়ে রাখতে হয় না। ওর মাকে সবাই বলে ‘ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের মা’। ওর কথা এলে বন্ধুরা গর্ব করে বলে, একটাসময়ে আমরা একসাথে আড্ডা দিতাম।

জীবন আমাদের কখন কোথায় নিয়ে যায়, সেটা নিয়ে আগে থেকে আমরা কেউই কিছু ভাবতেও পারি না!