বাঁচতে সবারই ঘর লাগে না

  
 যদি পুরনো ডায়েরি খুলিও-বা, ওখানে কী মিলবে, জানি!
 তাই তো এখন আর ঘাঁটি না ওসব স্মৃতি, সত্যিই ওসব পোড়ায় না আর।
 বয়স তখন অল্প খুবই, যখন তোমার ঘরের বউ হয়েছি।
 বিয়ে করার বয়সটা যা, তখনও আমার তা হয়নি!
 আর সে বয়সেই কী এক ঝড়ে শৈশবটাই গেল উবে চোখের পলক ফেলার আগেই!
 যেন একলাফেতেই বড়ো হতে হলো অনেকটুকুই!
 বাবা ডাকলেন...ছেলে ইঞ্জিনিয়ার, বুয়েটে পড়েছে। অনেক বড়ো চাকরি করে,
 বাবা-মা’ও অনেক ভালো...মা, তুই ভীষণ থাকবি সুখে!
 শুনে ভাবলাম, সেই ছোটো থেকে, কখনও তো মাকে পাইনি অমন,
 অন্য সবাই যেভাবে পায়...মা’র যে খুব অসুখ ছিল!
 এবার তো ভালোই হলো...দারুণ একটা মা পাবো...ছোট্ট একটা ঘরও পাবো...আহা, আদরে আদরে কত হবে সুখ!
  
 বাসায় সবাই বেজায় খুশি...পাত্র ভালো, ফ্যামিলি ভালো।
 আমি তো তখন অনেক ছোটো, ভালো কি খারাপ বুঝিই-বা কী!
 বয়স সবে পনেরো কেবল!
 চাচিরা বলে, এ বয়সেই কত মেয়ে তো মা হয়ে যায়! কত দেখেছি!
 ...আমি এসব বুঝব কীসে! আমি তো তখন পনেরো কেবল...
 দিন তো গেছে খেলে হেসে...স্কুলে যাই...ঘুরত মাথায়,
 বন্ধুরা সবাই মিলে ভার্সিটিতেই পড়তে হবে...ছিল অ্যাম্বিশিনের এটাই মানে...
 বলতেন অমন স্যাররা সবাই! স্কুলে তখন ফার্স্টই হতাম, পুরো ক্লাসের ক্যাপ্টেন হতাম...
 ওসব তখন অনেক কিছু! বুঝিনি কখনও, জীবন তো আরও বাড়তিই চায়,
 না পেলে তা, যেন জীবনই যে যায়!
 যা হবে হোক, পরিবারের কথামতো, নিয়ম মেনে বিয়েটা তখন হয়েই গেল!
  
 মা তোমার বলেছিলেন হেসে, এ মেয়ে তো আমারই মেয়ে,
 উচিত-পথেই তুলব গড়ে, ওকে রাখব খুবই যত্ন করে!
 শুনে কী যে ভালো লাগল...নতুন মায়ের আদর-শাসন সব অভাবই ঘুচিয়ে দেবে!
 বিয়ের পরেই বুঝে ফেললাম, তুমি আমার চেয়ে বংশটাকেই চেয়েছ বেশি!
 বড়ো ঘরের মেয়ে আসবে, তোমার ঘরটা আলো করবে,
 বড়ো ঘরের জামাই হলে বড়ো চাহিদা...সে তো তোমার মিটেই যাবে!
 বড়ো চাহিদা মিটলে পরে নিজের ঘরেও সুনাম হবে!
 শ্বশুর কত বড়ো মানুষ, জামাইও তাঁর কম-বা কীসে?
 হায়, তোমার মনে এত কিছু...বিয়ের আগে বলোনি তো!
  
 গুনে গুনে সতেরো দিনের হলো সংসার!
 সময় গেল...তোমার সাথে পাঁচটি দিনে, তোমার মায়ের সাথে দিন বারোতে।
 বিয়ে যে কী, তখন বুঝিনি তো, শুধু বুঝেছি তোমায় নিজের মতো...
 আর তুমি কখনও প্রেম বোঝোনি, বুঝেছ হিসেব!
 যেদিন এলাম তোমার ঘরে, সেদিন রাতেই বললে খেপে,
 আমার যে ঘরটা খালি, তোমার বাবার পড়েনি চোখে? চোখে কি উনি কমই দেখেন?
 আমি বললাম, এ-ই কথা? এটা এমন শক্ত কী আর!
 হয়ে যাবে! মনে মনে ভাবলে তুমি, ঠকেই গেছি...বিয়েটা করে কীই-বা হলো?
  
 মনে পড়ে খুব...বিয়ের আগে, বাবা একদিন কাছে ডেকে বলেছিলেন,
 দোকানে গিয়ে...গহনা যা চাও, নকশাগুলি দিয়ে এসো।
 ...ওসব আবার বাহানা কেমন? বুঝি না ছাই! এখানে আবার গহনা কেন? কেন তা চাই?
 এতগুলি দিন কাটল, সাজগোজ তো করিনি ভুলেও,
 এখন আবার গহনা নিয়ে করবটা কী?
 এই পাগলির কথা শোনে কি বাবা? বাবা যে তিনি!
 গায়ে যত গহনা লাগে, নানা নকশায় একটিও তার রইল না বাকি!
 গায়ে গহনা ছিল বিয়ের দিনেও...এরপর সব বাক্সে-বাঁধা!
 যে বাবাটি এত কিছু দেন, ঘর ভরতে কিছু আসবাব...দিতেন না কি?
 পরে বুঝলাম, আসবাব...সে তো কেবল ছুতোই ছিল,
 আসল কথা, সম্পর্কটা টেকেই যদি, সে টেকা হবে একতরফাই!
  
 বাবা বোধ হয় কিছু বুঝলেন...তাহলে কিছু আসবাব দিই না গড়েই...
 শুনে ভাবলাম, ঘর সাজানোর জিনিস? সে হবে’খন,
 আগে ঘর তো বুঝি...খুব বেশি দূর হলো না যেতে,
 তুমি ভালো করেই বুঝিয়ে দিলে, নতুন ঘরে থাকতে হলে,
 বাপের বাড়ি ভুলতে হবে...মাত্র দু-দিন যেতে না যেতেই!
 বলিনি কিছুই, সবখানে তো আর যায় না বলা...
 তোমার বাবা বললেন, পড়াশোনা তো ঢের হয়েছে, আর কত চাই?
 আমি ভাবলাম, এত কিছু ওরা বিয়ের আগে বলেনি তো!
 বউরা আবার কেন পড়ে? ওসব বাজে খরচের বাহানা যত!
 খুব করে চাইতাম, জানো, তুমি অন্তত একটু বলো,
 বলুক যে যা, আমি আছি তো...পড়াশোনাটা বন্ধ কোরো না, চালিয়ে নিয়ো!
 পরে দেখলাম, তুমিও ঠিক ওদেরই মতো!
 স্বামী যার থাকে না পাশে, তার শ্বশুরবাড়ির দিন-রাত্রি...একলাই কাটে!
  
 তোমার ঘরের কাজের বুয়া বিদেয় হলো, বলল সবাই...কী দরকার, দিবা তো আছে!
 তোমার ঘরে মাত্র গেলাম...এর মধ্যেই দেখি, পুরো ঘরটা আমারই কাঁধে!
 ভাবতেও খুব কষ্ট হলো...আমি তবে কাজের লোকই...অত ভার কখনও বইনি তো আগে!
 করা কী আর যাবে! কোমর বেঁধে কাজে লাগলাম...বাপের বাড়িতে কত সাধত খাই না বলে...
 আর এখন দেখি, কাজের ঠেলায় খিদেয় মরি, তবু খেতে পাই না...বরং খোঁটাই জোটে...
 ফার্নিচার সব আসবে কখন? নতুন বউ...অত কেন খায়? দু-একবেলা থাকলে উপোস,
 গায়ে-গতরে জোরটা বাড়ে...আমরা বুঝি ছিলাম না বউ?
 বাবাকে এসব বলিনি কিছুই...বাবার যে খুব হার্টের অসুখ...
 বরং বলি নিজেকেই, ঠিক হয়ে যাবে...আরেক ঘরে এরকমই হয়!
  
 খুব কষ্ট হলো...কাটল সময় যন্ত্রণাতে...না না, খাইনি বলে, এমনটা নয়!
 তোমার দিকে তাকিয়ে দেখি, তুমি ভীষণ নির্বিকারই...দিব্যিই আছ!
 ...খাওনি তুমি, খাব না আমিও...কাজ সেরে নাও, দু-জন মিলে খাব একসাথে...
 অমন কিছু শুনতে চেয়েও জিভ কাটতাম...লেখা আমার চোখে ছিল সবই, তুমি যেন তার বোঝোইনি কিছু!
 তুমি তো খুব ভালোই ছিলে...বন্ধু নিয়ে, স্বজন নিয়ে...হাসিঠাট্টায়...
 আর এদিকে বউয়ের খাওয়া জোটে বিকেল হলেই, তার আগে নয়...কখনও ভুলেও খোঁজ নিয়েছ?
 জেদ হলো খুব...এতটা এলাম...এসেছি যখন, সংসারটা কী, ছাড়ব বুঝেই!
 এদিকে আমি শেষ হচ্ছি, ওদিকে তুমি দারুণ আছ সবার সাথে...দেখে ভাবতাম, এরই নামটাই ‘বর’ বুঝি!
 ...এই, তোমার মা তো শোয়াই থাকে, ঘরদোর তো সামলে-টামলে রাখতে তুমিই, তাই না, বলো?
 তুমি কাজেকর্মে ভীষণ পটু, শুনেছি এমন...তাই তো তোমায় এনেছি ঘরে...মেয়ে তো আরও কতই ছিল!
 ফাঁকি দিয়ো না, মন দিয়ে কাজটা করো...যার মায়ের এত অসুখ, তার অত আদর কীসের?
  
 বুঝে নিলাম, এই ঘরে ক্লান্ত হলে খেতে পাবো না...
 আমি তোমার বউ যতটা, তার চাইতে অনেক বেশি কাজের বুয়া!
 দিন ফুরিয়ে রাত এসে যায়, কাজ যেন তবু ফুরোয় না আর! বুঝেছি আরও...
 আমার জন্য এ ঘরে কোনও থাকবে না প্রেম, তবে খাওয়া থাকবে...কিছু শর্তে!
 আমার হাতে তো ফোন ছিল না...তোমার মা-বাবা ফোন ধরলে কথা বলতেন হাসিমুখেই...
 বেয়াই-বেয়াইন ঠাট্টা শুনে ভাবত শুধু...মেয়ে আমাদের ভালোই আছে, ঘর গোছাতে ব্যস্ত তো খুব,
 তাই কথা বলবার পায় না সময় এতটুকও!...বাবা-মা তোমার হোক যেমনই, অভিনয়টা জানেন ভালোই!
 মেয়ে আমাদের ব্যস্ত কেমন, বাবা-মা’কেই ভুলল এমন...দেখা দরকার...এটা ভেবে বাবা এলেন বেয়াইবাড়ি...
 তখন বিয়ে হলো মোটে চৌদ্দ দিনই! বাবা এলেন, হাত মিষ্টিবোঝাই...বাবাকে আমি বলিনি কিছুই,
 কুটুমবাড়ির সবাই কত যত্ন নিল, শরীর-মনের খবর নিল...এত কিছুর পরও বাবা
 যেন কী করে সব বুঝেই গেলেন! আমার মাথায় হাত রাখলেন, কান্না চেপে হেসে বললেন, বাড়ি যাবি?
 আমি তো রাজি মুহূর্ততেই...যাব, বাবা! ওদিকে তোমার মা বললেন, বিয়ে তো হলো সবেমাত্র...এখন আবার বাপের বাড়ি...কেন গো, বাপু?
  
 একাই বাবা ফিরল বাড়ি আমার হাতে সস্তা একটা মোবাইল দিয়ে...মা, সময় করে ফোনটা করিস!
 এদিকে তুমি কয়েকটা দিন কোথায় যেন কাজে গেলে...
 আমি তখন বাসায় একা...একা মানে, আমার পাশে ছিলে না তুমি...অবশ্য, পাশে থাকলেও কীই-বা হতো!
 জানো, প্রতিদিনই ফোনটা হাতে মনে আসত, এই বুঝি তোমার ফোন আসবে!
 এমনি করেই দিন কাটল...কই, ফোন করোনি তো একটি বারও!
 কখনওবা, মায়ের ফোনে ফোন করতে, কথা বলতে...আমার কথা বলোনি ভুলেও!
 জানতে চাওনি, আমি কেমন আছি, খেয়েছি কি না, আমার কিছু লাগবে কি না...
 হয়তো মনে আসেইনি তা...দিবার সব ঠিক আছে তো?
 এদিকে তোমার মা-রত্ন আমায় বাসায় একলা রেখে বিকেল হলেই বেরিয়ে যেতেন!
 সেই কত রাতে ফিরতেন...আমি তো ঘরে তালাবন্ধ...যদি আগুনও লাগে,
 বদ্ধঘরেই মরব পুড়ে! তুমি তো এসব জানতেই না! আর জানলেও-বা কী!
 এসব যখন মনে আসে, তখন ভাবি, এই যে আমি তোমার মাকে মা ডাকতাম,
 সেই মা ডাকটা কি তবে ভুলই ছিল? তবে শাশুড়ি কখনও হয় না কি মা? সবাই মা কি তবে এমনিই ডাকে?
 না কি শাশুড়িরা মা চায় না হতেই...ছেলের বউয়ের?
  
 সতেরো দিন ঘোরার মাথায়...বাবা আমার আবার এলেন।
 এসে বললেন, অনেক হয়েছে ঘরকন্না...এবার আমার সাথে চল তো দেখি!
 বাড়ি ফিরে মাকে দেখি, খুব কাঁদছে! বাবা শুধোলেন,
 ওদের আর চাইটা কী, বল! সবই দেবো! ফার্নিচার তো?
 ওটা তো আমি দেবোই দেবো! ওদের আর কী লাগবে?
 শুনে আমি বলিনি কিছুই...অত অল্প বয়স,
 কোনটা বলি, কী যে বলি...বুঝতামই তো না!
 কী যে উচিত, কী অনুচিত, এসব ভেবেই মেয়েদের বুঝি জীবন কাটে!
 বুক পুড়ে যায়, হৃদয় ভাঙে...মেয়েরা কি তবু ঘরটা ছাড়ে!
  
 ভাবি, এসব হচ্ছেটা কী? কিছু বোঝার আগেই সবই শেষ হচ্ছে!
 সব দেখছি, সব শুনছি, মারমুখো হয়ে সবাই আছে ঠিক সামনে...
 কই, সেখানে আমার বরটা কোথায়? কত করে বলেছি তখন, এসো না পাশে...
 দু-জন মিলে সব কিছু ঠিক সামলে নেব!
 এলে না তুমি...মুখে তোমার কথা একটাই...হয় বিচ্ছেদ, নয় অর্থ!
 তোমার পড়াশোনা যে অনেক বাকি, বিদেশে যাবে, কত টাকা লাগবে...
 এসব শুনে বাবা বলল, কত লাগবে? যা লাগবে, দেবো সবই...তবুও আমার মেয়েটাকে নাও...
  
 এদিকে আমার ভেতর অন্য একটা ভয়ের বসত...এত শর্ত দিয়ে, ঝগড়া করে...সংসার কি হয় এভাবে?
 কিছুই বলিনি কাউকে...শুধু মনে আসত...সংসারটা টিকবে তো আদৌ?
 বিয়ে করে তো বর হয়েছ, স্বামী কখনও উঠবে হয়ে? পাশে আমায় রাখোই না যে...
 তুমি যে পুরুষ...অর্থ কি দেহ, কিংবা দুই-ই...তোমার ওটুক হলেই ঠিক চলে যায়...আমার কী হবে?
 মনকে বোঝাই, এ সংসারটা আর নয় হবারই...আমার যত স্বপ্ন ছিল, আনন্দ আর ছোটোবেলাটা,
 সবই যেন হারিয়ে গেল...কোথায় হঠাৎ! তোমরা যেন সবাই মিলে বয়স আমার বাড়িয়েই দিলে এক ধাক্কাতেই!
 নিজের মনের কাছেই হার মানলাম! তোমার কাছে মিনতি করে বললাম শেষে, আমায় একটু সময় দেবে?
 কিন্তু তোমার খুব তাড়া যে...টাকা আনলে আনো এখুনিই, নয়তো নয় কখনওই!
  
 আসলে তখন তোমার মনটা ছিল অন্য দিকে...জানতামই না, পরে জেনেছি!
 যা-ই হোক, আর কী করা যাবে! মনের সাথে যুদ্ধ করে, সরেই গেলাম!
 যেখানে আমার সম্মানই নেই, সেখানে আবার শান্তি কীসের?
 মুক্ত হবার এতদিনেও প্রশ্ন জাগে...আমি কি কখনও তোমার কাছে হাত পেতেছি?
 বলেছি কখনও, আমায় ঘরে তোলো, তোমার চলার পথের সঙ্গী করো...বলেছি অমন?
 তবুও কেন এই ক্ষীণকাঁধে এতটা বোঝা চাপিয়েই দিলে?
 কখনও তোমায় বলেছি এমন...আমায় এটা কিনে দাও, ওটা এনে দাও, দুজন মিলে ঘুরতে চলো...?
 আমি তো শুধু থাকতে চেয়েছি...তোমার পাশে...কোনও অভিযোগ কি চাহিদা ছাড়াই!
 আমি তো শুধুই ঘর চেয়েছি...গাড়ি চাইনি, বাড়ি চাইনি...ছোট্ট করে একটুখানি জায়গা চেয়েছি!
 আমি তোমার হাত চেয়েছি...আমায় শক্ত করে রাখবে ধরে, যে হাত এমন...তা-ই চেয়েছি!
  
 সেই ছোটো থেকে অশান্তিতেই হয়েছি বড়ো, বাবা-মায়ের মিল ছিল না এতটুকও!
 আমি তাই চাইনি কখনও, ঘরটা আমার ওরকমই হোক!
 যেদিন তোমার ঘরে গেলাম, ঠিক পরের দিনই সে ঘরটা ফুঁসতে দেখে কষ্ট পেয়েছি,
 অথচ তুমিই তখন ছিলে না পাশে!
 একটুখানি শান্তিই তো চেয়েছি কেবল, সেটুক চাওয়াও ভুল ছিল কি?
 আজ আমরা অনেক দূরে, তবু মনে পড়ে যায়...তুমি সবার কাছে রটিয়েছিলে,
 আমায় ফোনে নাকি ব্যস্ত পেতে, আমি নাকি কথা বলতাম কোন ছেলের সাথে!
 আমার সাথে নাকি আর থাকা যায় না! সব শুনেও চুপ থেকেছি।
 এই চুপ থাকার মানেটা জেনো, মেনে-নেওয়া নয়, মানিয়ে-নেওয়া।
 আমি তো ফেলেছি জেনেই, আর থাকবে না তুমি আমার পাশে! কী দরকার আটকে রাখার?
 তুমি মিথ্যে বলেছ, খুঁজেছ ছুতো...জানি সবই!
  
 তুমি বলতে, মেয়েদের নাকি ছেলে-বন্ধু মানেই হলো...সাথে শুয়ে থাকা যায়, এমনই তো কেউ!
 হয়তো তুমি অমনই ছিলে...তবু বিশ্বাস করো, বন্ধুতায়...আমি কখনও তফাৎ করিনি...
 ছেলে কি মেয়ে...বন্ধু তো বন্ধুই কেবল!
 শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করলেই শুয়ে পড়া যায়...এমন কখনও আসেনি মনে!
 তখন থেকেই কারও সাথে মিশতে গেলেই কী এক ভয়ে কুঁকড়ে আসি!
 কথা আগে বলতাম যা-ও, বিচ্ছেদের পর বলিনি তা-ও!
 নিজেকে বড্ড গুটিয়ে নিয়েছি! আড্ডা কি সাজ, হতো না কিছুই!
  
 বুঝেছি তখন, এখন আমার অন্য সময়!
 আনন্দ-ফুর্তি শিকেয় ছিল, সাজ কি খুশি হারিয়ে গেল...
 অনুষ্ঠান যত, এড়িয়ে যেতাম...বন্ধুদেরও দূরে রাখতাম...
 একটু ভালো থাকলেই সবাই ভেবেই নিত, ডিভোর্সি মেয়ে…সে-ও বোধ হয় চুপি চুপি প্রেম করছে!
 যার গোমড়া মুখে থাকাই নিয়ম, তারও আবার জীবন কীসের?
 সব কিছু যেন হারিয়েই গেল...সুখ-স্বস্তি, উচ্ছলতা কোথায় যেন চলেই গেল!
 ভলিবল আর ব্যাডমিন্টন, আবৃত্তি কি দাবাখেলা, বিতর্কের তীব্র সে ঝড়...সব কিছুই মিলিয়ে গেল!
 সবার চোখেই লেখা থাকত...ওসব এখন করতেই নেই, আমি যে এখন হয়েই গেছি অনেক অনেক বড়ো!
 আজ মনে হয়, সবার কথা শুনলেই বিপদ বেশি! তার চাইতে, নিজের মতো বাঁচলেই বরং দারুণ হতো!
 সেই তখন থেকেই এখনও যে কেঁদেই বাঁচি, তাতেও-বা কার কী এসে যায়!
  
 হঠাৎ করেই চারদেয়ালে বন্দি হলাম, পাপ না করেও পাপী হলাম সবার চোখে!
 বন্ধুরা নেই, কোনও আনন্দ নেই, শান্তি কি সুখ...কিছুই তো নেই!
 স্কুল, কলেজ পেরিয়ে কত বন্ধু ছিল...ওদের এখন পাই না কোথাও!
 জীবন কেমন হঠাৎ করেই বিষিয়ে গেল...পাশে কোনও আত্মীয় নেই, বন্ধুও নেই...
 সবাই যখন পর হয়ে যায়...তখন কেমন করে মানুষ বাঁচে?
 দেখি, হলাম নিজেরই ঘরে অন্য মানুষ, আমার দিকে তাকালেও চোখে কাঁপন লাগে...বুঝতাম সবই!
 ক্রমেই আমি হয়ে উঠলাম অবোধ শিশু, সবাই ধরে বোঝাতই শুধু...খুঁতটাও হঠাৎ বেড়েই গেল...সবারই চোখে!
 আমি তখন কথা গিলতাম...যেমন লোকে কিছু না ভেবেই গিলে ফেলে বিষ,
 ঠিক তেমনই আমিও অনেক কথা গিলতাম!
  
 মাঝে মাঝেই একা লাগত...খুবই বেশি! তখন মনে আসত, কেউ আমার পাশে থাকুক, আমার সাথে অন্তত দুটো কথা বলুক,
 আমাকেও মানুষ ভাবুক...আমারও যে একা লাগে, একটু বুঝুক...এই আমিটা কেমন আছি, আমার কেমন লাগছে এখন...
 কেউ একটু জিজ্ঞেস করুক...আমার খারাপ লাগে কি না, আমার কীসে কষ্ট হয়...তবু সেইসব দিনে এসব জানার কেউ ছিল না।
 ভাবত সবাই, দিবা তো একটা ফাজিল মেয়ে! শক্ত গোছের বাজে মেয়ে...সংসারটা তো ভেঙেই এল নিজের হাতে!
 সব শুনে-টুনে নিজেকে আবারও গুটিয়ে নিতাম...যেমনি শামুক গুটিয়ে রাখে তার নিজেকেই!
 কত কত কম্পিটিশন...সে পুরস্কারের বইগুলি...যখন দেখি, দু-চোখ তখন ঝাপসা হয়ে আমাকে বোঝায়,
 দিবা, একসময় তুইও তো পেতিস, মনে আছে?
  
 শুনেছি, তোমার একটা ছেলে হয়েছে, বেশ বড়োও নাকি হয়ে গেছে!
 এখনও তুমি ফোন করো...মাঝেমধ্যে...আমি ঠিকই বুঝতে পারি...যদিও অন্য একটা নম্বর থেকে।
 আমি তোমায় ধরে ফেললে কেন যে বল, আবার নাকি ফিরে আসবে!
 আচ্ছা, তুমি আমায় কী ভাবো, সত্যি করে বলো তো দেখি?
 তুমি ফোন কেন দাও, সত্যি আমি জানি না তা। আমার কাছে ক্ষমা চাইবার নেই তো কিছু!
 ক্ষমা চাইলে যদি করিও ক্ষমা, কী হবে, বলো? যা হারিয়ে গেছে, তা কী করে ফেরত দেবে?
 ওসব তুমি আর বোলো না, ওসব মানেই সময় নষ্ট...অহেতুকই!
  
 আমি ভীষণ ভয়ে থাকি, অবিশ্বাসে বঁচি...কেন, জানো?
 ভয়টা আমার তোমাদেরকেই, মানে সব ছেলেকেই...কাউকেই আর বিশ্বাস হয় না...
 ভাবি, সবাই বুঝি একই রকম! মুখে বলে, শুধু মনটা নেবে, অথচ কেড়ে নেয় সব-সবটাই!
 সামনে কখনও এগোতে গেলে কী যেন ঠিক পেছনেই টানে!
 আমি নতুন করে ভাবতে পারি না, নতুন কাউকে বুঝতে চাই না।
 আবার কোনও সম্পর্কে যাব, এমন কথা মনেই আসে না!
 যখন আমার সামনে সবাই ওসব বলে...বিয়ে করো, সংসারী হও...তখন খুব মনে হয়, দূরে কোথাও পালিয়ে বাঁচি!
  
 মনে পড়ে যায়, আমাদের কাবিনের পর প্রথম ঈদে ভেবেছিলাম,
 একটা সুতির হলেও শাড়ি দেবে...সুতির শাড়ির দামই-বা কত!
 আমারও তো ইচ্ছে ছিল, ঈদের সময় তুমি আমায় নতুন একটা শাড়ি দেবে,
 ওটা পরে তোমার সাথে ঘুরতে যাব!
 ঈদে আমায় দাওনি কিছুই...না না, ওটা দারিদ্র্য নয়...
 হয়তো আমার কথা তোমার আসেইনি মাথায়! সেবার ঈদে
 একটা পাঞ্জাবি কিনে তোমার হাতে দিয়েছিলাম, মনে পড়ে?
 ভেবেছিলাম, নতুন বউয়ের প্রথম উপহার খুব আদরেই নেবে...
 আমার দেওয়া পাঞ্জাবিটা খুশিমনেই পরবে তুমি, আর ওটা পরেই ঘুরে বেড়াবে ঈদের দিনে।
 ভুল ভেবেছি, পাঞ্জাবিটা পরোনি তুমি, এককোনাতেই রেখেছ ফেলে!
 ওটার নাকি এত কম দাম...কারও সামনে পরা যায় না...ওটা পরলে বন্ধুরাই-বা কী ভাববে!
 শুনে আমি খুব কেঁদেছিলাম, দেখোনি তা তুমি! অত কম বয়সে কী বোঝাটাই না চাপিয়েছিলে আমার কাঁধে!
 আমার শুধু দোষই ছিল, আর ছিল অপূর্ণতাও...এক উনমানুষের দায় চাপিয়ে কাঁধে টিকেছিলাম তোমার ঘরে!
  
 এসব কিছুই ভুলতে পারি না! সত্যিই আমার কী দোষ ছিল?
 কোন অপরাধে অত আঘাত নিয়েই বেঁচেছিলাম?
 আমি তো বেশি চাইনি কিছু...কেবল ছোট্ট একটা ঘর চেয়েছি...সবাই মিলে থাকতে চেয়েছি...
 তবুও কেন এত পুড়লাম? স্মৃতিরা সব তাড়িয়ে বেড়ায়...স্বাভাবিক আমি পারি না হতেই!
 নতুন করে বাঁচতে আবার ইচ্ছে করে না, ঠিক সাহস হয় না!
 স্মৃতি থেকে মুছে ফেলতে পারি না কিছুই...ওরা চোখের সামনে এসেই পড়ে...কী যেন সব প্রশ্ন করে!
 প্রায়ই মনে ভয় এসে যায়...আবার যদি অন্য পুরুষ চলেই আসে...এসে বলে, ভালোবাসি...
 যদি আমিও তখন ভুল করি, সে পুরুষের হাতটা ধরি...সে যদি হয় তোমারই মতো...
 আবার যদি অতীত আসে...যদি একই পথে আবারও হাঁটি...হাঁটতেই হয়...
 সত্যি তখন মরেই যাব...অতটা নেবার শক্তি যে নেই!
 আমি এখন ক্লান্ত ভীষণ...কী দরকার...ভালোই তো আছি...নিজেকে নিয়ে। একটা জীবন, কেটেই যাবে!
 যদি কখনও ভুল করেও স্বপ্ন দেখি---ছোট্ট একটা ঘর বাঁধবার, নিজেকে বোঝাই...
 সবার কি আর ঘর হয়? পর কি সবার আপন হয়? সত্যিকারের মানুষ কি আর সবার হয়?