বাকিটা অনুমিত

 
আমি শিলা। দিনাজপুরের মেয়ে। বেশ কিছুদিন ধরে আমি খুব ডিপ্রেশনে ভুগছি। সম্প্রতি আমার জীবনে বড় একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। তার পর থেকে সব সময়ই মনে হচ্ছে, আমার মরে যাওয়াই উচিত। বেঁচে থেকে কী করব আমি? আমার আশেপাশের প্রতিটি মানুষের ঘৃণা-অপমান আর সহ্য করতে পারছি না। আমি সুন্দরভাবে বাঁচতে চাই। বিয়ের এক বছরের মধ্যেই এতটা প্রতারিত হব শ্বশুরবাড়ি থেকে, তাও আমার স্বামীর দ্বারা, এটা আমি কোনও দিনই ভাবিনি।


হ্যাঁ, মাত্র এক বছর হলো আমার বিয়ে হয়েছে। এক বছরের মাথায় গত ৩১ ডিসেম্বর তারা পরিকল্পিতভাবে আমাকে ঘর থেকে বের করে দিল, কিছু বুঝে-ওঠার আগেই। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের একেবারেই সাধারণ এক মেয়ে আমি। সব সময়ই সাদামাটা চিন্তাভাবনা করেই চলেছি। অনেক সুখের স্বপ্ন নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে গিয়েছি। সেই স্বপ্নদেখার পুরস্কার হিসেবে পেয়েছি ডিভোর্স। ওরা ডিভোর্স দেওয়ার পরও থেমে নেই। খুবই নোংরা নোংরা কথা বলে বেড়াচ্ছে আমাকে নিয়ে তাদের এলাকায়, মানে গাইবান্ধায়, যেখানে আমি থাকতাম। আর বলে বেড়াচ্ছে আমাদের এলাকায়ও, আমাদের পাড়াতে, বিভিন্ন লোকের মাধ্যমে। বাড়ি থেকে বের হবার মতো কোনও পরিবেশই নেই। আমার হাজব্যান্ড বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের একজন সদস্য। ওকে বিয়ে করে এখন আমার বাবা-মা’র মানসম্মান বলে আর কিছু নেই। আমাকে সবাই যা নয়, তা-ই বলছে।


আমার হাজব্যান্ডের চারিত্রিক সমস্যা ছিল, আরও কিছু ত্রুটি ছিল, সেসব মেনে নিয়েই আমি সংসার করছিলাম। শ্বশুর-শাশুড়ির নির্যাতনও সহ্য করছিলাম। জীবনটা এমন হবে, কখনও ভাবিনি। আমাকে নিয়ে এমন সব নোংরা কথা বলছে এখন আমার হাজব্যান্ড এবং তার বাবা-মা যে সেসব মুখে-আনার মতো না। আমি সমাজে মানুষের সামনে বের হতে পারছি না। কাউকে মুখ দেখাতে পারছি না। কেউ তো আর প্রকৃত ঘটনা বিশ্লেষণ করতে যাচ্ছে না, যা শুনতে ও মানতে ভালো লাগছে, তা-ই দিয়ে আমাকে জাজ করছে। আমরা একটা জাজমেন্টাল পরিবেশে বাস করি। কিছু জেনে বা না জেনেই অন্যকে নিয়ে কথা বলতে থাকি। খুবই যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছি। মনে হচ্ছে, আত্মহত্যা করি, এটাই একমাত্র সমাধান। তাতে কী লাভ হবে, তাও জানি না। তবু বারবার মনে আসছে, জীবন থেকে পালিয়ে-যাওয়াই একমাত্র পথ। আমার কিছুই ভালো লাগে না। মৃত্যু ছাড়া আর কোনও রাস্তা মনে হয় খোলা নেই আমার সামনে। এই মুহূর্তে আমার কী করা উচিত, আমি বুঝতে পারছি না।


পারিবারিকভাবে দেখাশোনার মাধ্যমেই আমাদের বিয়েটা হয়েছিল গত ২০১৯-এর ১৭ জানুয়ারিতে। ছেলে বিসিএস ক্যাডার হওয়ার কারণে আমার বাসার লোকজনের এই বিয়ের ব্যাপারে অনেক আগ্রহ ছিল। আমার বিয়েটা হয়েছিল একদমই গ্রামে। বিয়ের পর থেকেই আমার শাশুড়ি, ননদ, নন্দাই সবাই খারাপ আচরণ করত আমার সাথে। আমার হাজব্যান্ডসহ ওদের পরিবারের সবার মানসিকতা কেমন যেন ছিল। পুরোপুরিই সেকেলে গ্রাম্যমানসিকতার মানুষ। ওরা চাইত, আমিও ওদের মতো হয়ে যাই। বিয়ের পর থেকেই শ্বশুরবাড়ি থেকে আমার বাবার বাড়ি আসা একেবারেই বন্ধ করে দেয়। যদি আসি, তা হলে আমার আব্বুর গিয়ে আমাকে আনতে হবে, আর ফেরার সময় আমার শ্বশুর এসে আমাকে নিয়ে যাবেন। বরের সাথে আমাকে কখনও আসতে দেওয়া হবে না, ওর সাথে একসাথে কোথাও যাওয়াও ছিল বারণ। দুপুরে বিশ্রাম নেওয়া যাবে না। বিয়ের দুদিন পর থেকেই ওরা আমাকে বাড়ির সমস্ত কাজে লাগিয়ে দিল। আর কাজশেষে তাদের চোখের সামনে বসে থাকতে হবে, এর পর নতুন কাজ করতে দেওয়া হবে। ঘরের বউয়ের বিশ্রাম-নেওয়া নিষেধ।


আমার হাজব্যান্ডের পোস্টিং এখন রংপুরে। সরকারি মহিলা কলেজে। ও বিয়ের পর গাইবান্ধা থেকেই যাওয়াআসা করত। সেটাতে ওর বাবা-মায়ের খুব আপত্তি। তাঁদের কথা ছিল, তাঁদের ছেলে রংপুরে থাকবে, আর আমি তাঁদের সাথে গ্রামে থাকব। ছেলের সাথে থাকা যাবে না, গ্রামে থেকে তাঁদের ঘরের কাজকর্ম করতে হবে। এটাতে আমার আপত্তি ছিল। আমার হাজব্যান্ড এমন ছিল যে বাবা-মা যদি বলেন, তুই বউয়ের সাথে কথা বলবি না, শ্বশুরবাড়ি যাবি না, তা হলে সে তা-ই করবে। আমাকে চড় মারতে বলা হলে আমাকে চড়ই মারবে।


আশ্চর্যের ব্যাপার, বিয়ের সময় আমার শ্বশুরবাড়ি সম্পর্কে কোনও খোঁজখবরই নেওয়া হয়নি। পাত্র বিসিএস ক্যাডার, শুধু এটা দেখেই বিয়েদেওয়া হয়। এমন নয় যে আমার বাবা কন্যাদায়গ্রস্ত ছিলেন, তবে আমার পরিবার ছিল বিসিএস-ক্যাডার-মোহগ্রস্ত! ওদিকে ওদের পরিবারে ওর মা মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাজ করতেন একসময়। ওর তখন বাবা কিছুই করতেন না। বোনেরা রাস্তার সরকারি গাছ পাহারা দিত, তার বিনিময়ে প্রতিমাসে কিছু গম পেত। আর আমার হাজব্যান্ড অন্যের জমিতে চাষ করত, আর গ্রামের মানুষের সহযোগিতায় পড়ালেখা চালাত। পরে সে ঢাকা ভার্সিটিতে ইতিহাসে ভর্তি হয়। তার মুক্তিযোদ্ধা কোটা ছিল, তা দিয়ে সে পরবর্তীতে বিসিএস ক্যাডার হয়।


যা-ই হোক, এসব কোনও ব্যাপার না। ব্যাপার হচ্ছে, অবস্থার উন্নতি হলেও ওদের মনমানসিকতার কোনও উন্নতি হয়নি। কিছু চাষা আজীবন চাষাই থাকে, ওদের জন্ম ও কর্ম দুইই বাজে। ওদের বাড়ির পরিবেশও অনেক নোংরা। ওর বাবা-মা আমাকে এটার ওটার বাচ্চা বলেও সব সময় গালি দিত, শুনেও সে কিছুই বলত না। ওরা বড় হয়েছেই এসব শুনে শুনে, তাই এটা ওর কাছে স্বাভাবিক ছিল। আমাদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোনও প্রাইভেসিই ছিল না। ওকে কোনও কথা বললে ও ওর বাবা-মা’কে ধরে বলে দিত আর কাঁদত। এমনকি গ্রামে ওর আশেপাশের ভাবিদের বাড়িতে গিয়ে গিয়ে, অথবা আমার সামনেই আমাকে নিয়ে সমালোচনার ঝড় তুলে দিত। আর খুব খুব কাঁদত, সবাই ভাবত, আমিই খারাপ, ওরা সবাই আমাকে আমি যা নই, তা-ই বলত। আমার বাবার বাড়িতে ফোন করে করে আমার নামে বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যাকথা বলত। এসব নিয়ে ওর সাথে আমার ঝগড়াও লাগত। আমি কষ্ট পেতাম, এটা ওকে বলতাম, কিন্তু ও যা, তা-ই থেকে যেত, কোনও লাভই হতো না।


একটাসময় সামান্য একটা কারণে সে আমার নামে থানায় জিডি করে। এটা আগস্টের কথা, ঈদের পরদিন ছিল। গ্রামের বাড়িতে পুলিশ এল। আমাকে ওই দিনই ডিভোর্স দেওয়ার সিদ্ধান্ত হলো, তবে যা-ই হোক, সেটাতে ওরা সাকসেসফুল হয়নি। আমরা আগস্টে রংপুরে ফ্ল্যাটভাড়া নিলাম। বিয়ের ১ সপ্তাহ পর থেকে সে আমাকে সামান্য সামান্য কারণেও মারত। রংপুরে এসেও তা হয়েছে। এটা নিয়ে ওর মধ্যে বিন্দুমাত্রও কোনও অনুশোচনা কখনওই দেখিনি। ও নাকি ওর মাকে ওর বাবার হাতে মার খেতে দেখতে দেখতে বড় হয়েছে। স্বামী স্ত্রীকে মারবে, এটাই স্বাভাবিক ওর কাছে। না মারলে স্ত্রী বেয়াড়া হয়ে যায়। সত্যিই আমি ওর শিক্ষা ও অবস্থানের সাথে ওর আচরণের কোনও মিলই পেতাম না। আমি ন্যাশনালে পড়েছি, আর ও পড়েছে ঢাবি’তে, এটা নিয়েও ওর মধ্যে অনেক আত্মতৃপ্তি ছিল, অহংকার ছিল। ওর বাবা-মা’কে ছেড়ে আমাকে নিয়ে রংপুরে থাকতে হতো বলে আমার সাথে ভালো আচরণ করত না। ও নাকি একা থাকলেই ভালো থাকে। এদিকে আমি একটুতেই রেগে যেতাম, এটা ওরা কাজে লাগিয়েছে। রংপুরে এসেও আমাদের মধ্যে ঝগড়া লাগলে পাশের ফ্ল্যাটের সবাইকে ডেকে এনে আমার নামে বলত আর কাঁদত। পরে কলেজে গিয়ে সব কলিগকে আমার নামে বলত, সেটা আমি তখন জানতাম না, ডিভোর্স যখন হয়ে গেছে, তখন জেনেছি। কলেজের সবাইকে আর ও যে মেয়েদের সাথে আজেবাজে চ্যাটিং করত, তাদের বলে রেখেছিল যে আমি একটা মানসিক রোগী। এখনও এটাই বলছে। আমার চরিত্র নিয়ে নোংরা নোংরা কথা বলছে। এমনই নোংরা কথা, যা আমি মুখেও আনতে পারব না। অথচ ওর চারিত্রিক সমস্যার প্রমাণও আমি পেয়েছি নানাসময়ে। আমি সব কিছুর পরও সব সহ্য করে চুপ থেকেছি।


আমাকে ডিভোর্স দেওয়ার পরিকল্পনা চলছিল রোজার ঈদের পর থেকেই। আমার সাথে সম্পর্ক খারাপ করার জন্য ওর মা ওকে তাবিজ দিয়েছিলেন, ওঝাবাড়ি গিয়ে গিয়ে মন্ত্রপড়া এটা ওটা ওকে খাবারের সাথে মিশিয়ে খাওয়াতেন। এদিকে ওরা আমার আব্বুর সাথে আমার সম্পর্কটা নষ্ট করে দিল। যা ঘটত, তাও বলত, যা না হতো, সেটাও নিয়ে বানিয়ে মিথ্যা বলত। আমার আত্মীয়দের কাছেও আমাকে খারাপ বানাল আমার শ্বশুর-শাশুড়ি-স্বামী মিলে। আমাকে কেউ বিশ্বাস করত না, এখনও করছে না। সবাই বলছে, আমার কারণেই আমার ডিভোর্সটা হয়েছে। এর জন্য আমিই দায়ী। আমি কেন সব মেনে নিলাম না, কেন সব সহ্য করলাম না, কেন আমার মেজাজটা গরম, সবাই এখন এসব বলছে। আমার মামা-চাচা সবাই বড় ব্যবসায়ী। তাঁরা চেয়েছিলেন আমাকে কোনও ব্যবসায়ী-ছেলের সাথে বিয়ে দিতে। সেটা হয়নি বলে তাঁরাও আমার তেমন খোঁজখবর নিতেন না। কিন্তু ওঁরা আবার আমার হাজব্যান্ডের কথা বিশ্বাস করতেন। বাইরের সবার কাছে ও খুবই মিষ্টভাষী আর সুন্দর করে মানুষের ব্রেইনওয়াশ করে মনের মধ্য ঢুকে যেতে পারে। আসলে ওরা চেয়েছিল একটা দাসী। তাই আমাকে ওদের আর ভালো লাগেনি।


আমার বাসা দিনাজপুর সদরেই। দিনাজপুর সরকারি কলেজ থেকে পরিসংখ্যানে অনার্স-মাস্টার্স করছি। আমি আমার স্বামীকে খুব ভালোবাসতাম, এখনও বাসি। আমি বিয়ের পর আমার আম্মুর কাছে অনেক মারও খেয়েছি শ্বশুরবাড়িতে ফিরে যেতে চাইতাম না, তাই। আমার ওখানে ভালো লাগত না। ওরা ভালো আচরণ করত না। আমার হাজব্যান্ড আমাকে বুঝত না, আমাকে সময় দিত না। আমার কোনও গুরুত্বই ওর কাছে ছিল না। ও আমাকে সব সময় এটা বলত: এই একবছরে তুমি আমার তেমন কিছুই হতে পারোনি, আমার বাবা-মা আত্মীয়স্বজন, ভাই-বোন, কলিগ, বন্ধুবান্ধব এরা আমার জীবনে তোমার বহু আগে এসেছে, তাই এদের গুরুত্ব আমার কাছে অনেক বেশি। আমি কী করি কী করি না, এসব নিয়ে তুমি কিছু বলতে পারবে না। আমার জীবন আমি আমার মতো করে চালাব। আমি তোমাকে বিয়ে না করলে নিশ্চয়ই কোনও অশিক্ষিত মূর্খ ব্যবসায়ীর সাথেই তোমার বিয়ে হতো, আমি বাদে আর কোনও বিসিএস ক্যাডার তোমাকে বিয়ে করত না। তুমি তো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ একটা স্টুডেন্ট, ঢাবি’তে তো পরীক্ষা দিয়েও চান্স পাওনি। এরকম আরও অনেক কথা চলতেই থাকত।


এসব মানসিক নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে গত মার্চে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলাম। আধাবোতল হারপিক খেয়েছিলাম। হসপিটাল পর্যন্ত যেতে হয়েছিল। তখন ও বলেছে, আমি বারবার আত্মহত্যা করতে চাই, কেননা আমি একটা মানসিক রোগী, আমার অন্য কোথাও সম্পর্ক আছে, আমি নাকি কার কার সাথে দেখা করি, আমার চরিত্র খারাপ ইত্যাদি ইত্যাদি, তাই সে আমাকে ডিভোর্স দিতে চায়। গত ১১ ডিসেম্বর আমাকে নিয়ে সে আমার বাবার বাড়িতে এল, ১৭ ডিসেম্বর সে তার গ্রামের বাড়িতে চলে যায়, যাবার সময় আমাকে বলে গেছে, তুমি চিন্তা কোরো না, আমি তাড়াতাড়ি এসে তোমাকে বাড়ি নিয়ে যাব। আমি খুবই বোকা ও সরল ধরনের একটা মেয়ে। বাইরের কুটিল পৃথিবীটা সম্পর্কে বেশি কিছু জানি না আমি। আমি ওর প্রায় সব কথাই বিশ্বাস করতাম।


আমাদের বাসা থেকে বের হয়ে ২ দিন সে আমার সাথে স্বাভাবিকভাবেই কথা বলে, আর ২০ তারিখ থেকে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। শুনেছি, সে নাকি ৩১ তারিখে আমাকে ডিভোর্স দিয়েছে। আমি এখনও লেটার পাইনি। আমি একা একা মনোহরপুর গ্রামে গিয়েছিলাম, ওখানে গিয়ে এসব শুনলাম। আমাকে ওদের ঘরে ঢুকতেই দেওয়া হয়নি। আমি সেখানে যাবার পর অনেক গালাগাল করেছেন ওর মা, গ্রামের লোকজন। ওরা সবাই মিলে গ্রামের চেয়ারম্যান-মেম্বারকে ডেকে এনে আমার সাথে নোংরাভাষায় কথা বলিয়েছে। ফোনে আমার আম্মু-আব্বু’র সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে। ওদের অপমান করেছে। পরদিন আমাকে মারধর করে ওখান থেকে বের করে দিয়েছে। আমি আমার হাজব্যান্ড, শ্বশুর-শাশুড়ির হাতেপায়ে ধরেছি, খুব আকুতিমিনতি করেছি, কিন্তু ওরা কেউই আমার কোনও কথা শোনেনি। আমি ওকে এটাও বলেছিলাম, আমি তোমার পায়ের জুতার মতো হয়ে থাকব, আমকে দাসী করে রাখো, তোমার বাড়ির পাপোশ বানিয়ে রাখো, তবু সংসারটা ভেঙো না। আমি তোমাকে ভালোবাসি, আমাকে থাকতে দাও, এরকম আরও অনেক কিছুই বলেছিলাম। ও শোনেনি আমার কোনও কথাই।


আমাদের সমাজে ডিভোর্সি মেয়েদেরকে খুব খারাপচোখে দেখা হয়। ওদের পাশে কেউ দাঁড়াতে না পারলেও ওদের নিয়ে কটূক্তি করতে এ সমাজ ছাড়ে না। সে আমার হাজব্যান্ড ছিল, আমি তার সাথেই সারাজীবন থাকতে চেয়েছিলাম। পৃথিবীতে এমন একজনও অপরিহার্য মানুষ নেই, যার সাথে সারাজীবন থাকতেই হবে, এটা আমিও বুঝি কিন্তু নিজেকে কোনওভাবেই বোঝাতে পারছি না। শতচেষ্টাতেও নিজেকে স্বাভাবিক করতে পারছি না। বারবারই মনে হচ্ছে, তা হলে মানুষ বিয়ে করে কেন? সংসারটা ভাঙার জন্য? একা একা থাকার জন্য?


আমি সচ্ছল-মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। বাবা-মায়ের মানসম্মান আমার জন্য শেষ হয়ে গেছে। আমার ছোট একটা বোন আছে, একটা ভাই আছে। বাবার বয়স হয়েছে। আমার জন্য তাঁর চিন্তা বেড়েছে। কখন কী হয়ে যায়, বুঝতে পারছি না। আমি নিজেও চাইছি এখান থেকে বের হয়ে আসতে কিন্তু কিছুতেই তা করতে পারছি না। আমি খুবই ইমোশনাল একটা মেয়ে, আমার শুধুই কান্না পায় আর ভাবতে থাকি, আমার কী ভুল ছিল? কী অন্যায় করেছি আমি? আমি তো কখনও কারও কোনও ক্ষতি করিনি, তবে কেন আমার সাথেই এমন হলো?...আমি সত্যিই ভালো থাকতে চাই!


আমার এক বান্ধবী পরামর্শ দিল, ওকে ভুলে যাওয়ার জন্য অন্য কারও সাথে প্রেম করতে হবে। ও বলল, শিলা, কারও সাথে প্রেম কর, নিজেকে সময় দে। সকল সংস্কার আর ভয় থেকে বেরিয়ে আয়, কিছু না কিছু কাজে বিজি হয়ে যা। খুঁজলে পেয়ে যাবি তেমন কাউকে যাকে তোর ভালো লাগবে। তা হলেই এটা সম্ভব। কিন্তু আমি এটা মেনে নিতে পারছি না। আমাদের ফ্যামিলি অনেক কনজারভেটিভ। আমি জীবনে কখনও প্রেম করিনি। আমার কিছুই ভালো লাগছে না। আমি এই পরিস্থিতি থেকে বের হতে চাই। আমি তো ভালো সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি না, আমি কারও সাথে প্রেম করব কীভাবে? এই মুহূর্তে আমার কাউকেই ভালো লাগবে না। আমাকে দিয়ে প্রেম হবেও না, হলে আগেই হতো। আর যার তার সাথে চাইলেই কি প্রেম হয়ে যায়? বললেই কি হয়ে যায় ওসব? কাউকে ভালোলাগার একটা ব্যাপার আছে তো! আর একটা সম্পর্ক ভেঙে গেলে কষ্টপাওয়া কি অস্বাভাবিক? আমি কষ্ট পাচ্ছি, তাই বলে কি আমাকে এভাবে করে বলতে হবে? কেন আমার বান্ধবী আমাকে ওটা করতে বলল? ও আমাকে বলে, জীবনে যা করিস নাই, তা করা যাবে না, এই থিওরি কই পেয়েছিস? একজন পুরুষের সাথে শোয়ার আগে কারও সাথে শুয়েছিলি? প্রথমকিসটা করার আগে কাউকে কিস করেছিলি? প্রত্যেক জিনিসেরই একটা ফার্স্টটাইম থাকে।


সে আরও বলে, তোদের ফ্যামিলি কনজারভেটিভ তো কী হয়েছে? তুই যে এখন বাজে অবস্থায় আছিস, এতেই-বা তোর ফ্যামিলির, এই পৃথিবীর কী এসে যায়? তুই কনজারভেটিভ না কি অন্য কিছু, এটা নিয়ে কার কী এসে যায়? এইসব হাস্যকর কথা বলিস না তো! আমি অনেককে দেখেছি, অন্য কারও সাথে জড়িয়ে গিয়ে ভালো আছে, হয়তো সে আগের জনকে ভুলতে পারে না, কিন্তু ভালোই আছে। প্রেম করতে না চাইলে কারও সাথে প্রেম প্রেম খেলতে তো পারিস। নতুবা কোনও কাজে গভীরভাবে নিজেকে নিযুক্ত করে নে।…ওর এসব কথা শুনে আমি দিনদিন আরও কনফিউজড হয়ে যাচ্ছি। আমার সাথে যা হয়েছে, তা অনেকের সাথেই হয়, অহরহই হয়। তবু কারও মেনে-নেওয়ার ক্ষমতা অনেক বেশি, কারও-বা কম। এটা নিজের ইচ্ছা আর অভ্যাসের ব্যাপার। আমি বুঝি, সমাজের সব কিছুকে কেয়ার করার কিছু নাই। কিন্তু ঝামেলা হচ্ছে, মধ্যবিত্তদের গায়ে কাদা লাগে বেশি, আর সমাজের বিত্তবানদের কেউ কিছু বলতে যায় না। আমাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। আমি জবের প্রিপারেশন নিতে চাইছি, কিন্তু ভয় পাচ্ছি, কেননা আমার বেসিক অনেক দুর্বল। চাকরি করব, এটা কখনওই ভাবিনি। আমাকে এই পরিস্থিতি থেকে বের হতে হবে। আমার হাতে সময় অল্প। আমি আগের মতো ভালো থাকতে চাই।


আমি খুবই নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করি, তাই তেমন কারও সাথে আমার যোগাযোগ নেই। আমি জানি, সে আমায় কিছুদিন পর ভুলেই যাবে। আমি সবাইকে মনে রাখি, কিন্ত আমার দুর্ভাগ্য, আমায় কেউ মনে রাখে না। কিছু ভালো লাগছে না। মরে যেতে ইচ্ছা করছে। আমি ভালো থাকব কীভাবে? দিনে দিনে হতাশা বাড়ছেই আর বাড়ছে। আমার জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেল! সব সময়ই মনে হয়, আমি মরে যাই! আমি ভালো থাকতে চাই। আমি খুব খারাপ আছি, প্রচণ্ড খারাপ আছি। আমার এতটা খারাপ থাকতে একটুও ভালো লাগছে না। দুঃখ সহ্য করা যায়, কিন্তু খারাপ-থাকা সহ্য করা যায় না।