বারান্দাটা ভালোবাসার!

যাকে পছন্দ করি, এমনকি কখনও-কখনও ভালোবাসিও মনে হয়, মানে যিনি আমার প্রিয় মানুষ, আমি দেখেছি, তার ক্ষেত্রে কয়েকটি ব্যাপার ঘটে। যেমন, আমি কিছুতেই উনার সামনে যেতে চাই না। আমি চাই না, দূর থেকে দেখার মুগ্ধতা থেকে আমি কখনও সরে আসি। ছোটবেলায় সুন্দর ঘ্রাণের পাঠ্যবইয়ের ভাঁজ ভেঙে ফেললেই কী যে ভীষণ অপাঠ্য মনে হতো! বড়-বড় মানুষগুলি পাঠ্য বইয়ের মতন। ভাঁজ ভাঙলেই সব শেষ! বড়দের বড় ভাববার মুগ্ধতাতেই একটা জীবন কাটিয়ে দেয়া যায় তো! কী দরকার তবে? এছাড়া দূর থেকে ভালোবাসায় এক ধরনের সুখ আছে। হয়তো বলবেন, পাগলের সুখ তো মনে মনে। হোক না! সুখে থাকতে আমি পাগল হতেও রাজি। এতে আপনার কোনও সমস্যা? প্রিয় মানুষ কখনও সামনে পড়ে গেলে এমন একটা নির্লিপ্ত ভাব নিয়ে থাকি, যেন আমি তাকে দেখিইনি, কিংবা স্রেফ অন্যদিকে তাকিয়ে থাকি ভীষণ সংকোচ নিয়ে যাতে ভুলেও চোখাচোখি হয়ে না যায়। এমনও হয়, আমি জানি, উনি আমাকে দেখে ফেললেও কিছুই হবে না, কারণ উনি আমাকে চেনেনই না, কিন্তু আমি নিজেই এক ধরনের তাগিদ ভেতর থেকেই অনুভব করতেই থাকি—আমি লুকিয়ে থাকবো, আমি লুকিয়েই থাকবো। হয়তো উনি আমাকে চেনেন না, কিন্তু আমি যে উনার সাথে প্রায় প্রায়ই কথা বলি উনাকে নিজের মনের আয়নার সামনে এনে! যদি ধরা পড়ে যাই, তখন কী হবে? এমন যদি হয়, আমি খুব ভুল কিছু করেটরে ফেলি, তখন? বড় মানুষ ক্ষমা করে দেয়, জানি। কিন্তু আমাকে ক্ষমা করলেও যে আমার ভীষণ লজ্জা লাগে! কেন এমন কাজ করবো যেটার জন্য ক্ষমা চাইতে হয়, কিংবা কাউকে বিব্রত হয়ে আমাকে ক্ষমা করে দিতে হয়? কী দরকার উনাকে বিরক্ত আর বিব্রত করার? না বাবা, এ-ই বরং ভাল। উনার দিকে তাকাবো পর্যন্ত না, কিন্তু সবসময়ই মন থেকে চাইতে থাকবো, উনি আমার দিকে একবার ভুল করে হলেও তাকিয়ে ফেলুন, হোক ওটা এমনিতেই উনার মনের ভুল, উনি আমাকে খেয়ালই করেননি, তবুও! আমি ভেবে নেবো, উনিও আমাকে দেখেছেন এবং উনার মনে হয়েছে, “ছেলেটি তো চমৎকার!” আমি চমৎকার, এটা ভাবতে সবসময়ই ভাল লাগে। এমনও হয়, আমি উনার পাশ দিয়ে হেঁটে চলে যাই, অথচ কিছুই বলি না, ছোট্ট লাজুক চাহনিতে একটুখানি হাসিও দিই না! ওরকম কারওর সাথে দেখা হয়েই গেলে যদি দেখা হওয়ার জায়গাটা হয় কোনও বইয়ের দোকান আর উনি হন লেখক, তবে উনার পাশে-পাশে হেঁটে-হেঁটে বইটই নাড়াচাড়া করবো, যেখানে উনার বইও থাকবে, উনি মাঝেমাঝে আমার দিকে তাকাবেন কিংবা তাকাচ্ছেন, এটা ভাবতে ভাল লাগবে বলে আমি ভাববো, তাকাচ্ছেন, যদিও উনি আমাকে চেনেন, এটা ভাবতেও সাহস হবে না আমার! উনার লেখা খুব পছন্দ করি, জড়তা ভেঙে এইটুকু বলতে পারি না পারি, সেকথা আপাতত শিকেয় তোলা থাক; একটুখানি কথা বলার, সালাম দেয়ার, প্রচণ্ড ইচ্ছেটা পর্যন্ত চেপে রাখবো, এবং উনি চলে যাওয়ার পর মনে হবে আর হতেই থাকবে ……….. কী মনে হবে, সেটা মনে আনতে পারছি না। আমি এসব ভাবি আর উপলব্ধি করি, শুধু ভালোবাসাই নয়, মাঝে-মাঝে শ্রদ্ধাও মানুষকে দূরে সরিয়ে রাখে৷

বাবা-মা চিকিৎসার প্রয়োজনে চেন্নাই যাচ্ছিলেন। ওদেরকে এয়ারপোর্টে বিদায় জানাতে গিয়ে এদিকওদিক কী কী কাজে যেন হাঁটছি, হঠাৎ দেখি, কয়েক হাত দূরেই কুমার শানু দাঁড়িয়ে। কুমার শানুকে কী যে ভালোবাসি, সে কথা সারাদিন লিখলেও শেষ করা যাবে না। বস্তুত, ভালোবাসার কথা গুছিয়ে লেখাও যায় না। আমার খুব সুখের সময়ে উনার কণ্ঠ আমাকে সঙ্গ দিয়েছে, নিদারুণ কষ্টের সময়েও উনি কত আন্তরিকভাবে পাশে থেকেছেন। উনার কাছে যে আমার অনেক ঋণ! উনার গান শুনি আর ভাবি, “বড় ভালোবাসি, বড় ভালোবাসি।” এমন মানুষকে হৃদয়ে না রাখাটাও অনেক অপরাধের কাজ! যারা গান গেয়ে আমাদের মনের মানুষ হয়ে গেছেন, তারা কখনওই জানতে পারবেন না, আমরা তাদের কত ভালোবাসি। আমার মা’কে নিয়ে কেউ বাজে কিছু বললে যেমন মাথায় রক্ত চড়ে, তেমনি লতাকে নিয়ে অপ্রীতিকর কিছু বললেও ওরকম রক্ত চড়ে যায়। আমার কাছে শিল্পীদের স্থান একেবারে রক্তের স্রোতের মধ্যে। কুমার শানুকে এতো ভালোবাসি, অথচ সেদিন এয়ারপোর্টে একটিবারের জন্যও মনে হয়নি, উনার সামনে গিয়ে বলি, “স্যার, আমি আপনাকে অনেক ভালোবাসি। ঈশ্বর আপনাকে ভাল রাখুন।” কিংবা, “একটা সেলফি তুলতে পারি, স্যার?” কিছুই বলতে পারিনি। (বড় মানুষের সাথে এ পর্যন্ত কখনও সেলফি তুলেছি বলেও মনে পড়ে না।) শুধুই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলাম, আর দেখেছি, কেউ-কেউ এগিয়ে গিয়ে ধুমসে সেলফি তুলে নিচ্ছে ফেসবুকে প্রোফাইলে কিংবা কভারে দেয়ার জন্য। আমার সেই একটু দূরে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে তাকিয়ে দেখাতেই ছিল সকল আনন্দ!

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় যখন বাংলাদেশে এলেন, বাতিঘরে সবার উদ্দেশ্যে কথা বললেন, তখন সারাটি সময় উনার ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। বসতে পারতাম, কিন্তু বসিনি, কারণ বসলে যদি আলসেমি জেঁকে বসে আর উনার একটি সামান্যতম কথাও প্রাণের ভেতরে না ঢোকে, সে ভয়ে। অথচ সেদিন নিজের জন্য একটাও অটোগ্রাফ নেয়া হয়নি, একটা ছবিও তুলিনি নিজের মোবাইল ক্যামেরায়, উনাকে বলতে পারিনি, “প্রিয় মানুষ, শীর্ষেন্দু! আপনাকে অনেক ভালোবাসি!” কিংবা, “আপনি কোনওদিনও জানতে পারবেন না, আপনার আর আমার জন্মদিন একই দিনে হওয়াটাও আমার জন্য অনেক শান্তির একটা ব্যাপার! আমি এর জন্য ঈশ্বরকে কয়েকবার ধন্যবাদ পর্যন্ত দিয়ে ফেলেছি!” বারবার ইচ্ছে করছিল, উনার পা ছুঁয়ে প্রণাম করি। আবার একইসাথে এই দ্বিধা আমায় গ্রাস করে দিচ্ছিল—এমন মানুষের পা স্পর্শ করার যোগ্যতা কোথায় আমার? সমরেশ মজুমদারকে দেখেছি চোখের আর মনের মিলিত ক্ষমতার সর্বোচ্চটুকু ব্যবহারে, শুনেছি উনার প্রতিটি কথা নিজের কানের আর হৃদয়ের সমস্ত শক্তিটুকু দিয়ে। মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখেছি, একটা মানুষ কতটা বড় হতে পারেন! বড় সরল মানুষ তিনি! বাংলাদেশের মানুষকে সত্যিই খুব ভালোবাসেন। দেখলাম, কত-কত মানুষ সামনে গিয়ে উনার পা ছুঁল, অনেকেই কত ভাল-ভাল প্রশ্ন করলো, উনার পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে নিল, আমি তার কিছুই করতে পারিনি। এটা আমার অক্ষমতা। আমি যে দেবতার সামনে গিয়ে কিছুই নিবেদন করতে পারি না! আমার সমস্ত অর্ঘ্য হৃদয়ের আকুতিতে।

একটা ভীষণ দারুণ কাজ কেউ করলেন, অথচ ওটা উনার রুটিনের কাজ নয় মোটেও। কেউ-কেউ আছেন, যারা এমনকিছু করেন, যেটা ভাবলে উনার সম্পর্কে সমীহ জাগে, কিন্তু ওটা করার পাশাপাশিও প্রয়োজন ছাড়াই এমনকিছু করার ক্ষমতা উনার আছে, যা উনাকে অন্যভাবে চেনায়। আপনার যা করার কথা তা-ই যদি আপনি করতে পারেন, তবে সেটা নিয়ে খুব গর্বের কিছু আছে বলে মনে হয় না। আপনার ওটা করতে পারারই কথা, আপনি পারছেন করতে। এ ঘটনার ফিডব্যাক হলো এই, “ও আচ্ছা, ঠিক আছে।” যখনই আপনি বাড়তি কোনও ক্ষমতার অধিকারী হয়ে যান, যেটা আপনাকে আপনার কাজের ক্ষেত্র হতে সম্পূর্ণই আলাদা করে পরিচিত করায়, কারণ সে ক্ষমতার ভাল রকমের গ্রহণযোগ্যতা আছে, তবে আপনি অবশ্যই বিশেষ কিছু, আর আপনাকে নিয়ে বলবো, “ও বাবা! দারুণ তো!” যারা পেশায় লেখক না, অথচ লেখেন এবং না-লিখলেই-বরং-পাঠকরা-বেঁচে-যেতো, ওরকম লেখকদের মধ্যে পড়েন না, তাদেরকে আমি একটু বেশিই শ্রদ্ধা করি৷ ওরা জীবনকে শুয়েবসে কাটাতে পারেন না। ওদের কলিগদের চাইতে ওদেরকে প্রায় দ্বিগুণ কাজ করতে হয়। ওদের কথা ভাবি আর শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। কয়েকজনের কথা বলি, কেমন?

শহীদুল জহির উনার লেখায় যাদু বাস্তবতা নিয়ে যে খেলাটা দেখান, সেটা কলকাতার অনেক ভাল লেখকের লেখাতেও পাই না। বাংলাদেশে উনি ছাড়া আর কেউই স্প্যানিশ সাহিত্যঘরানার এই বিশেষ দিকটি নিয়ে কাজ করেননি। উনি বিসিএস প্রশাসনের একজন সদস্য ছিলেন। কিন্তু ভাবুন তো, উনার মৃত্যুর পরেও উনি আমাদের হৃদয়ে যতটা জায়গা জুড়ে আছেন, এর ১০০ ভাগের এক ভাগ জায়গাও উনার সমসাময়িক আর কোনও আমলা নিতে পেরেছেন কি না? আবদুশ শাকুর ছাড়া আর কোনও সচিবকে লোকে মনে রাখবে? রাখবে না, কারণ আর কাউকে আলাদা করে মনে রাখার মতন কিছুই উনারা করতে পারেননি। রাজ্যকাল গত, রাজত্ব হত, রাজা নিহত। এটাই বেশিরভাগের নিয়তি।

হুমায়ূন আহমেদ এবং জাফর ইকবালের কথা বলে উনাদের ভিন্ন দিক সম্পর্কে পরিচয় করিয়ে দেয়াটাও এক ধরনের মুর্খামি। রসায়ন আর কম্পিউটার সায়েন্সের মতো বিষয় পড়িয়েও অমন সহজ ভাষায় কঠিন জীবনদর্শনকে একেবারে কম পড়াশোনা-জানা মানুষকেও বুঝিয়ে বলা এই দুই ভাইয়ের পক্ষেই সম্ভব। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অনেকেই হয়েছেন। কিন্তু উনাদের মতন করে ছোটোখাটো বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠতে পেরেছেন কয়জন? কোনও-কোনও শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ের চাইতেও বড়। হায়, এমনও হয়, কোনও-কোনও শিক্ষক, যে চেয়ারটিতে বসে উনি পড়ান, সে চেয়ারটির সমানও নন!

অন্নদাশংকর রায় ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলেন। অশোক মিত্রও ছিলেন আইসিএস অফিসার। ভেঙে বললে, দুইজনই ছিলেন আইএএস, মানে ইন্ডিয়ান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসের কর্মকর্তা। আরও অনেকেই ওই লিস্টে আছেন তো, তাই না? কিন্তু কয়জন আইসিএস অফিসারকে আমরা চিনি? কয়জনের নাম মৃত্যুর পরেও মানুষ মনে রেখেছে? রাখবেই বা কেন? ওরা যে শুধু বেতনের কাজটাই করেছেন। স্রেফ বেতনের জন্য যে কাজ, সে কাজের জন্য মনে রাখার কিছু নেই।

বুদ্ধদেব গুহ’কে উনার লেখার জন্য বড় বেশি ভালোবাসি। বাংলা সাহিত্যে হাস্যরসের গুরু যেমন মুজতবা আর শিবরাম, তেমনি প্রকৃতি-বর্ণনার গুরু বিভূতি আর বুদ্ধদেব। বুদ্ধদেবকে শ্রদ্ধা করি এইজন্য যে উনি পেশায় ছিলেন উনার সময়ের ব্যস্ততম চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট, আর নেশায় ছিলেন লেখক। উনি কলম ধরেছেন, এ আমাদের পরম সৌভাগ্য। উনার সমসাময়িক যারা চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট, তাদেরকে নিয়ে একথা বলার কোনও সুযোগ নেই যে উনাদের কেউ সিএ পাস না করলে খুব বড় কোনও ক্ষতি হয়ে যেত। কারণ, উনারা কেউই ক্লায়েন্টদের জন্য অপরিহার্য ছিলেন না। কোথাও চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্সি ফার্মের অভাব হয় না। কিন্তু বুদ্ধদেব গুহ আমাদের জন্য অপরিহার্য ছিলেন। ‘অন্যতম হওয়া’ আর ‘একমাত্র হওয়া’ একই কথা নয়। উনি না লিখলে আমরা হলুদ বসন্ত পেতাম না, সবিনয় নিবেদন পড়তে পারতাম না, মাধুকরী বোঝার সুখটা না পেয়েই পাঠকজীবন কাটিয়ে দিতে হতো।

আরেকজনের কথা বলি। তিনি পেশায় চিকিৎসক, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের স্টুডেন্ট ছিলেন, এবং উনার লেখা পড়ে উনার ওই পেশাগত পরিচয়টা মাথায় আনতেই মনে থাকে না৷ প্রিয় লেখক শাহাদুজ্জামান; কালো অক্ষরে ছাপা-হওয়া উনার সবকটা বই এখনো পড়তে না পারলেও, পড়ার ব্যবস্থা করেছি৷ উনার অনুবাদ সংকলন আছে: ভাষান্তরসমগ্র—বড় স্বাদু অনুবাদ। ক্রাচের কর্নেল বাংলাদেশি সাহিত্যের চিরস্থায়ী সম্পদ। ঈশ্বর রূপ ও গুণ দুটোই দিয়েছেন, এমন কিছু মানুষের মধ্যে উনি একজন।

আমার একটা অভ্যেস হলো, এ ঘরানার লেখকদের, অর্থাৎ সাহিত্য যাদের অন্য ঘর, তাদের মধ্যে যারা ভাল লেখেন, ছাপার কালো অক্ষরে উনাদের যা কিছু বের হয়, সবই কিনে ফেলি৷ যে যত ব্যস্ত, সে তত ভাল কাজে সময় দিতে পারে। ওদের লেখা পড়ি আর ভাবি, অতোটা ব্যস্ত না থাকলে কি লিখতেন অতো? কে জানে!

ভালোবাসতে পারি, অথচ কিছুতেই বলতে মনে থাকে না, কিংবা থাকলেও বলা হয়ে ওঠে না, ভালোবাসি৷ আমি প্রায়ই ভাবি, ওরে বাবা, ‘ভালোবাসি’ এটাও বলা যায়? এর চাইতে তো ডায়রিয়া বাধিয়ে বাথরুমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকাটাও সোজা। ‘ভালোবাসি’ বলবো ভাবলেও তো জিভটা কেমন জানি ভারি হয়ে ওঠে, জ্বরে গা পুড়তে থাকে! কাউকেই আমি ‘ভালোবাসি’ বলি না; অনেক ভালোবাসি, তবুও না। ভালোবাসার প্লাবনে হৃদয়ের একুল-ওকুল ডুবে-ভেসে যায় যাক, তবুও না! এই যেমন, মা’কে বলতে পারি না, বাবা’কেও না৷ ছোটোভাই পাপ্পুকে একদিন বলার পর ও অবাক হয়ে আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়েছিল, যেন জীবনে প্রথমবারের মতো একটা প্যান্ট-শার্টপরা শিম্পাঞ্জিকে দেখছে। এরপর শুরু করলো হাসি, সে কী ভীষণ হাসি, রীতিমতো অট্টহাস্য যাকে বলে আরকি! আমি বুঝলাম, বানরের গলায় ভালোবাসার মালা পরিয়ে ঠিক করিনি। ছোট ভাইবোন মাত্রই বানর গোত্রীয় প্রাণী।

এরপর ভীষণ অভিমানে ঠিক করেছি, ভালোবাসি বলবোই বলবো, ওরকমভাবে বলার মতো কোনও মানসীর সাথে দেখা হয়ে গেলে৷ একদম সত্যি সত্যি প্রেমটেম নিবেদন করে ফেলবো। কিন্তু হায়! বলা দূরে থাক, ঠিকভাবে তাকাতেও পারিনি কখনওই৷ ভালোবাসলে কী করতে হয়, কে জানে! ওরা বলে, ভালোবাসতে হলে নাকি অন্তত ঠিকভাবে তাকাতে হয়, কিন্তু আমি যে দেখলাম, এইরকম নিয়মটাও সবসময়ই যে খাটে তা নয়! ভালোবাসার মানুষের দিকে লোকে প্রেমময় লুক যে কীভাবে দেয়, কে জানে! আমি তো আমার ভালোবাসার মানুষের দিকে তাকাতে গেলেই আমার চোখ ট্যারা হয়ে যায়! মহা মুশকিল! একজন তো বলেই বসেছিল, “ওরকম হ্যাবলার মতন করে তাকিয়ে আছেন কেন?” এটা কী হলো? চাইলাম ডাকুক, প্রেমিক, মেয়ে ডেকে বসলো, হ্যাবলা। তবে কি হ্যাবলা মানেই প্রেমিক আর প্রেমিক মানেই হ্যাবলা? আরেকবার, এমন একজনকে চিনতে শুরু করেছিলাম, যে আমাকে আমি ওকে যতটা ভালোবাসতাম (এবং এখনো ভুলেটুলে বেসে ফেলি), তার চেয়ে বেশি ভালোবাসতো বলে দাবি করতো, এবং ভালোবাসা মেপে দেখার কোনও ইয়ার্ডস্টিক না থাকায়, আমি নিজের মতো করে মেপেটেপে কিংবা না মেপেই ধরেই নিয়েছিলাম, ও সত্যিই আমাকে ভালোবাসে৷ সত্যিটা হলো এ-ই, মা-বাবা’র ভালোবাসায়ই শুধু টেকেন-ফর-গ্রান্টেড ব্যাপারটা খাটে, অন্য ভালোবাসাকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে দিলে, সেটা থমকে নয় শুধু, কখনওকখনও একেবারে থেমেই যেতে পারে৷ আমি, ভালোবাসি, ভালোবাসি, এইরকমভাবে বলতে পারি না, তাই বলিওনি৷ হায়! সে বোঝেওনি৷ খুব বেশি ভালোবাসিটাসি এইসব যারা ফস্ করে-করে বলে দিতে পারে, তারা সত্যিই কতটুকু ভালোবাসে তা আমার জানা নেই, তবে ওরা বোধহয় ওরকমভাবে ভালোবাসিটাসি অনেককেই বলে৷ যা-ই হোক, ভালোবাসা ব্যাপারটাকে আমার আনকনডিশনাল এবং ফর-গ্রান্টেড হিসেবে ভাবতে ভাল লাগে, অথচ আমার দেখা হয়েছিল এমন এক চমৎকার মানুষের সাথে, যে অনেক ভেবেটেবে ঠিক করেছিল, আমাকে ভালো না বাসলেই বরং ও ভাল থাকবে, এবং ওর এই উপলব্ধি তখন আসে যখন আমি ওর ভালোবাসায় অভ্যস্ত হয়ে-হয়ে কীভাবে একা বাঁচতে হয়, সেটা আস্তে-আস্তে ভুলছিলাম।

তিনটি কাজ করা গেলে খুব ভাল:

একেবারেই অপরিচিত কাউকে ভালোবেসে ফেলা।

প্রেম করতে চাইলে দূরদেশ কিংবা অপরিচিত কোথাও করা।

যে ভালোবাসায় প্রত্যাখ্যাত হওয়ার নিশ্চয়তা রীতিমতো ঈশ্বরপ্রদত্ত, সে ভালোবাসা নিজের মধ্যেই প্রচ্ছন্ন অব্যক্ত নিভৃত রেখে দেয়া।