বারোটা বছর ধরে

অপেক্ষায় থাকতে থাকতে বারোটা বছর পেরিয়ে গেল। ষোড়শী ছিলাম যখন, তখন থেকেই এই অপেক্ষাটার শুরু। জানো, সনক? আমি প্রতিদিনই ভেবেছি, আজই বোধহয় আমার অপেক্ষার শেষ দিন, শেষ রাত। আর একটু পরেই বোধহয় ভোরের আলো ফুটবে, আর আমায় চিরমুক্তি দেবে এই আঁধার থেকে। সেই আলো আর ফুটল না, আমি যেন শুধু অমাবস্যাই দেখে গেলাম।


তোমাকে কোনও দিনই মুখে বলিনি ভালোবাসার কথাটা, কিন্তু তুমি কি সত্যিই অতটা অবুঝ ছিলে? বোঝোনি কিছুই? কখনও না? না-ই যদি বুঝতে, তাহলে আমার ওসব অপলক তাকিয়ে থাকার জবাবে তুমি ওই রহস্যময় মুচকি হাসিটা ছুড়ে দিয়ে দিয়ে কীসের জবাব দিতে?


আমি তো ভুল দেখিনি, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছি সবই আমি। তবে, ওসব কি শুধুই ছেলেভুলানো হাসি ছিল? আমাকে ছেলেমানুষ ভেবে তুমি থামিয়ে রাখতে ওরকম করে?


আজ আমি আটাশ। বারোটি বছরের প্রত্যেক তেরোটি পার্বণে আমি তোমাকে খুঁজি। একদম নিখুঁত করে নিজেকে সাজিয়ে আমি তোমাকে খুঁজতে বেরোই, যেন আসল সত্যটা কেউ ধরতে না পারে। আমার বাড়ির লোকেরা, প্রতিবেশি, স্বজন, বন্ধুবান্ধব এমনকি পাড়ার দোকানদারেরা পর্যন্ত এই বারোটা বছর সন্দেহ করে করে ধরে নিয়েছে তোমার কথা। আর বিয়ে থা না-করে এটা ওটার অজুহাত দিয়ে দিয়ে সেই সন্দেহকে আমি একটু একটু করে সত্য প্রমাণ করে ফেলেছি।


আমি যে তোমার অপেক্ষায় বসে থেকে থেকে আমার বয়সটা বাড়াচ্ছি, এটা সবাই বোঝে, এক তুমি ছাড়া। আমার এখন আর ভয়, সংকোচ, দ্বিধা কিংবা লজ্জা নেই। আর দেখো, এসব যার জন্য ঝেঁটিয়ে বিদেয় করেছি, আমার তো সেই তুমিটাও নেই! আমি প্রায়ই ভাবি, আমার সত্যিই কি কিছু আছে নিজের বলতে?


জানলে জানুক সবাই সত্যটা। আমি তো আর চুরি করিনি। আর লোকের কথা? লোকেদের কাজই তো কথা বলা, কথা ছড়ানো। করুক ওরা যা ইচ্ছে।


আচ্ছা, তুমি ছুটির দিনেও তো আমাদের এদিকে আসতে পারো। নাকি এদিকের রাস্তাটাও ভুলে গেছ, সনক? শুনলাম, বিয়ে নাকি তুমিও করোনি এখনও। আমায় ভালোবাসো না বুঝলাম, কাকে ভালোবাসো তবে? কে সে, বলো? আমি খুঁজে দেবো কাউকে?


সবাই ভাবে, তোমার জন্য আমি অপেক্ষা করছি, আর আমার জন্য তুমি। তারা এটাও ভাবে, আমরা নাকি লুকিয়ে দেখা করি, সময় হলে সবাইকে সব জানাব! হা হা হা…। আমিও ভাবি, আহারে, এসব জল্পনাকল্পনার একফোঁটাও যদি মিলে যেত!


আমি পুজোর সময় প্রতি বছরই তোমাদের ওদিকটায় যাই। তোমার এলাকায়ই তো আমাদের শহরের সবচেয়ে বেশি পুজোমণ্ডপ সাজানো হয়। আমি সেই ষষ্ঠী থেকে শুরু করে বিসর্জনের দিন পর্যন্ত প্রতিদিন তোমাদের এলাকায় ঠাকুর দেখতে যাই। সরু সরু গলি অথবা খুব ছোটো জায়গায় যে মণ্ডপগুলো আছে, আমি ওগুলোও বাদ দিই না। ইস্‌, যদি দেখা হয়ে যায় তোমার সাথে! আমাকেও এখন তোমাদের এলাকার লোকজন ভালো করেই চেনে। আগে নামে চিনত, এখন চেহারায়ও চেনে।


ওরা কীসব কানাঘুষাও করে, আমার কানে আসে। আমি অবশ্য কিছুই মনে করি না। ওরা যা বলে, তার সবই সত্য, সত্য না হলেও আমি মেনে নিই ওদের কথা। তবুও তুমি ফিরে এসো। তুমি ফিরে এলে আমি একপৃথিবীসমান অপমান, অপবাদ, গ্লানি মাথাপেতে নিতে রাজি আছি। সনক, ফিরে এসো! আমার অপেক্ষার অবসান হোক এবার।


এই বোকা! পুজোয়ও মানুষ এমন পালিয়ে থাকে? পালাবার জায়গাটা কে দেয়? বারো বছর ধরে আমি তোমার জন্য যেই জায়গায় নিয়ম করে খুঁড়ে খুঁড়ে গর্ত করে যাচ্ছি, তুমি কি নিশ্চিত, পালিয়ে থাকার জন্য এর চেয়েও নিরাপদ আর কোনও জায়গা আছে?