বিধির নকশা

 আমার পরিচয়, আমি গল্প বলি, থাকি ওই অচিন দেশে...
আমি তোমাদের গল্প শোনাব--ফুলের গল্প--ওই দূর পাহাড়ের।
হাজারো ফুলের পাহাড়টাকে ডাকত সবাই, ফুলের পাহাড়।
অতো সুন্দর কেউ দেখেনি কোথাও, জেনো। স্বর্গের বাগান যেন সে দূরের পাহাড়!
ফুলগুলি সব ফুটত কেবল ওই পাহাড়েই।
সুবাস ওদের কী অনন্য! রঙটা ওদের স্বপ্ন যেন!
 
বলত সবাই, ঈশ্বর নামেন ওই পাহাড়ে একবারই এক বছরেতে।
প্রকৃতি-যাদু আর ফুলের সুধা একাকার হয়ে রইত মিশে সে পাহাড়ে।
তবু ঝরবেই ফুল--নিয়তি এটাই। কিছু দিন আর কিছু রাত পর ফুলগুলি সব মাটিতে লুটাত।
ওদের নিয়ে হয়তো বিধির আলাদা কোনও নকশা ছিল। কে জানে তা!
ফুলগুলি সব রইল পড়ে, ঝরার পরে দেখল ওরা ওই আকাশে তারার আলো মিটিমিটি কেমন জ্বলে!
 
কিছু ঝরাফুল পোকায় খেল,
আরও কিছু উঠল টবে,
আরও কিছু ফুল দেবতার পায়ে নিয়ে নিল ঠাঁই,
জীবন সাজাতে কিছুকিছু গেল বিয়েবাড়িতে,
জীবন নেভাতে আরও কিছু গেল কোন সমাধিতে!
 
অনেক ফুলই তো রইল আড়ালে, দেখল না কেউ, তুলল না কেউ।
ওরা ওই পাহাড়েই থাকল বেঁচে মরার পরে,
চুপিচুপি দেখল কেমন ফুলগুলি সব ঝরছে যেমন একেএকে,
একদিন যে আদর পেত সবার কাছেই, তাকেই সবাই মাড়িয়ে চলে সৌন্দর্যটা ফুরিয়ে গেলে!
বালিরাশিতে যেমনি হারায় শস্যকণা--কেউ পায় না শত খুঁজেও, কেউ তো আর করে না যতন,
তেমনি জীবন হারিয়ে গেলে ভুলেও বুঝি কেউ খোঁজে না আগের মতন। এটাই জীবন!
 
একদিন যাকে প্রজাপতি এসে চুমু খেয়ে যেত,
দুলত হাওয়ায় ফুলের শরীর ইচ্ছেমত এদিকওদিক,
যেমনি পাখি ডানা ঝাপটায়, তেমনি করেই পাপড়ি দোলাত,
বর্ষা নামলে কাঁদত ভীষণ জলের সাথে লুকিয়ে ব্যথা--
সবাই দেখে বলত তখন, এই এক ফুলেই কাটাব জীবন,
ওর ঘ্রাণেতে মাতাল হবো, রাখব তুলে আদর করে বুকের মাঝে!
কতকত কথা, শপথ কত, ভালোবাসার আবেগ শত--খুব ভাল লাগে শুনতে ফুলের!
ফোটা ফুলগুলি ঝরে গেলে পরে আগের কদর কে-ই বা করে!
রঙ রূপ রস শেষ হয়ে আসে, চোখের সামনে পৃথিবী বদলে অন্য অচেনা চেহারা ভাসে,
ফুরিয়ে গেলে সবটুকু তেল, প্রদীপের দাম কে দেয়, বলো? খুব স্বাভাবিক!
 
আমি নিয়তির কথা বলছি, শোনো!
কোনও এক গাছের পাতা,
আরও কতশত বন্ধুর সাথে গল্পেসুখে দিন কাটাত।
পাতার গায়ে রোদ খেলে যায়,
নরম পাতা হাওয়ায় দোলে,
মেঘ এসেও ভিজিয়ে দিত আলতো করে,
এমনি করেই দিনগুলি তার যেত কেটে বেশ।
 
একদিন জানি কী হল,
এক পলকে পাতা ঝরল,
একটা পাতাই গাছের নিচে,
নেই তো সাথে খেলার সাথী।
একাএকা ওর ভাল লাগে না,
তবু কেন হায় কেউ আসে না!
 
আরেকদিন কী হলো রে,
পাতা চলল সোজা শহরে।
পড়ল গাড়ির চাকার নিচে,
ব্যথায় পাতার চোখটা ভিজে,
সে ব্যথা পাতার একার নিজের,
ব্যথার ভাগী কেউ হয় না।
একদিন বৃষ্টিতে,
পাতা গেল ভিজে, পচে,
পাতার শরীর টুকরো, টুকরো, টুকরো হয়ে,
যায় ছড়িয়ে এদিকওদিক জলের ধারায় কোথায় বয়ে।
সুখের রঙিন দিনগুলি হায় যায় ফুরিয়ে এক পলকেই,
মৃত্যু এসে নাড়ে কড়া।
 
জীবনের দামে মৃত্যু বিকোয় এমনি করেই!
শেষ দিনটা এলে কাছে, কাছে সেদিন থাকবে না কেউ।
সবাই তো ভাই সুখের মাছি, দুঃখ দেখার ধৈর্যটা কই?
দেখি, সুখের দিনে কত আপন হাওয়ায় দোলে, দুঃখ এলে সবাই কেমন পালায় ফেলে,
অনেক পুণ্য থাকলে পরে মানুষ যখন দুঃখে মরে, সত্যিকারের আপন তখন খুব বেশিতে দুজন মেলে!
সুখে বাঁচে সরবে, দুঃখে মরে নীরবে--এরই নাম মানবজীবন।