বৈধতার চেয়ে মহৎ

 
অনেক বছর আগের কথা। আমি বোধহয় ক্লাস ফোরে কি ফাইভে বা আরও কম। মা তখন তুমুল একজন জীবনযোদ্ধা, জীবনের কঠিন পথে একলাই হাঁটছে। মায়ের শরীরে ও মনে ভরাযৌবন---এপার ভেঙে ওপার গড়ে, আবার ওপার কেটে এপার ভরে…এরকম। মায়ের পৃথিবীতে দুইজন মানুষ: আমি আর মা নিজে।


আমাকে ছাড়া মা কখনও কোথাও যেত না, কোথাও গেলে আমাকে সাথে নিয়েই যেত। তো সেবার দাদুবাড়ি যাচ্ছি। বাসে উঠেছি মায়ের সাথে। হঠাৎ খেয়াল করলাম, পাশের সিটের একজন ভদ্রলোকের সাথে মা লাজুক ভঙ্গিতে কথা বলছে। আমি দেখলাম, ওদের মধ্যে ক্রমেই পরিচয় হচ্ছে। কথায় কথায় কত কী যে উঠে আসছে---জীবনের অলিগলি, বাবার কথা, বাবার খুন, আমার কথা, আরও কত কী…সব, এক এক করে সব কিছুই। এই প্রথম মা যেন এমন কাউকে পেয়েছে যার সাথে মনখুলে গল্প করা যায়, যাকে অব্যক্ত সব বেদনার কথা বলা যায়। আমি মায়ের কোলে চোখবন্ধ করে আছি।


জন্মের পর থেকে আমি সব সময়ই মাকে কাঁদতে কিংবা গম্ভীর হয়ে থাকতে দেখেছি। শেষ কবে মাকে হাসতে দেখেছি, তা আমার স্মৃতিতে নেই। একটু করে হাসির ছলে ঠোঁট বাঁকিয়েই কেমন যেন থেমে যেত। মাকে দেখলে মনে হতো যেন হাসির উপরেই জগতের সকল নিষেধাজ্ঞা আরোপিত, যেন একটু হেসে ফেললেই কিংবা বেশি হাসলেই দারুণ করারোপ হয়ে যাবে, এমন একটা ব্যাপার। আমি খুব করে চাইতাম, আমার মা একটু হাসুক। মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করে থাকতাম, মা কখন ফিক্‌ করে হেসে ফেলবে। হাসলে মাকে কেমন চমৎকার যে দেখায়…আহা! তবু মা কখনও হাসত না। বাবা চলে যাওয়ার সময় মায়ের হাসিটুকু সাথে করে নিয়ে গিয়েছিল। বাবার উপর রাগ হতো এটা ভাবলেই। আবার মন বলত, বোকা মেয়ে, যে মানুষটা খুন হয়ে গেছে, তার উপর রাগ করতে হয় না! আমি বাবার ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকতাম আর বলতাম, বাবা, তুমি মাকে একটু হাসতে বলো না! মা হাসে না কেন?


তো, সেদিন চোখবন্ধ করে থাকলেও আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, মা বেশ প্রাণখুলে হাসছে, ঘনঘন কথা বলছে লোকটার সাথে। এর আগে কখনও মাকে এভাবে এত ঘনঘন কথা বলতে ও খুশিতে হাসতে দেখিনি। ছোট্ট আমার ভেতর কৌতূহল বাড়ল। হঠাৎ বেশ কিছুক্ষণ নীরবতা। অনুভব করলাম, মা কেমন জানি কাঁপছে। পরে বুঝলাম, মাকে উনি পরম সোহাগে পিঠের দিকে হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরেছেন, মার তাতে কোনও বাধা বা আপত্তি কোনওটাই নেই, মা-ও সায় দিচ্ছে, মনেমনে হয়তো চাইছে…আরও হলে হোক না! এই সময়টায় হঠাৎ গন্তব্য চলে আসায় মাকে নামতে হচ্ছে, তাই হাতটা সরে গেল।


ভদ্রলোক আমার হাত ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন পরম স্নেহে, জীবনে প্রথমবার আমার কাছে ওই স্নেহটাকে বাবার স্নেহের মতোই মনে হয়েছিল। দেখলাম, আমাদের সাথে সাথে লোকটিও নেমে গেলেন যদিও তাঁর গন্তব্য ছিল অন্য জায়গায়। লোকটিকে আমাদের সাথে নামতে দেখে মা খুব হাসছিল। আমি চুপ করে সব দেখছিলাম। মনে আছে, আমার তখন অনেক ভালো লাগছিল।


একসাথে তিন জন রিকশায় উঠলাম। মা আমাকে কোলে নিল। পাশে সেই ভদ্রলোক। আমি, মা আর ওই লোকটা। এই প্রথম আমার নিজেকে কেমন এক পরিপূর্ণ পরিপূর্ণ লাগল। সে অনুভূতি কতটা বিহ্বল করে রেখেছিল সে মুহূর্তে, লিখে বোঝাতে পারব না। আমরা কেউ কিছু বলছিলাম না, অথচ তখন আমার বোধের মধ্যে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ যে ভাষা, যার নাম সুখ, তা খেলে যাচ্ছিল মুহুর্মুহু। সত্যিই, কিছু নীরবতার কাছে সমস্ত কোলাহল ঋণী হয়ে থাকে।


মায়ের চোখের খুশির ছটায় মায়ের শ্যামলা মুখখানি আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল। রিকশায়ও যেন জগতের সকল নৈঃশব্দ্য এসে ভর করল। সেই তিনচাকায় গোটা পৃথিবী থমকে দাঁড়াল। কিছু সময় পর মায়ের বোরকার বোতাম খুলে লোকটার হাত চলে গেল মায়ের বুকের মধ্যে। মায়ের নিঃশ্বাস ঘন হয়ে উঠল, সাথে ঘন হচ্ছিল চারপাশের সন্ধের আঁধার।


অবাক-করা ব্যপার হলো, সেদিন আমার রক্ষণশীল মাকে একমুহূর্তের জন্যও বিরক্ত হতে দেখিনি। মা বেশ উপভোগই করেছে পুরো ব্যপারটা। আমি মায়ের কোলে বসে ছিলাম বলে লোকটার হাত মায়ের বুকে সাঁতরাচ্ছে, সেটা খুব বুঝতে পারছিলাম। ওঁর নড়নড় হাতের ছোঁয়া আমার পিঠে লাগছিল, মা অনেকটা ইচ্ছে করেই আমাকে আলগা করে ধরে ছিল। আমার মা, যে মানুষটি দুঃখে আছে কি সুখে আছে---তাতে এই জগতের কারও কিছু এসে যায় না, তাকে সুখী করছে যে মানুষটি---হোক না তা সমাজবিরুদ্ধ, রীতিবহির্ভূত, নীতিবর্জিত---তাঁর প্রতি আমার মনে অসীম ভালোবাসা জন্মাল। আমি শুধু মাকে সুখী দেখতে চেয়েছিলাম। সেই সুখের উৎস নিয়ে ভাববার ইচ্ছে বা সময় আমার হয়নি, কেননা আমি আমার মাকে সব সময় কাঁদতে দেখেছি এবং আরও দেখেছি, মায়ের অশ্রু মুছে দেওয়ার জন্য আমি বাদে একটা প্রাণীও এই পৃথিবীতে নেই। যে পৃথিবী একটা মানুষের কান্না থামাতে পারে না, অথচ তার হাসি থামাতে দৌড়ে আসে সকল মেকি ও কপট কর্তব্যবোধ নিয়ে, সে পৃথিবীর উপর আমার আস্থা উঠে গেছে বহু আগেই। আমার কাছে আমার দুঃখিনী মায়ের সুখ পৃথিবীর সবচাইতে বড় সত্যের চেয়েও সত্য।


সেদিনের চারপাশটায় ফিকে অন্ধকার ক্রমেই ঘন হচ্ছিল। চারিদিকে ঘরেফেরার তাড়া সবার। সবাই কেমন একটা খুব ব্যস্ততায় বা দিনের অবসাদে বিষণ্ণ হয়ে আছে, শুধু এই দুইজন মানুষের ঘরেফেরার কোনও তাড়া নেই, শুধু মনের মধ্যে আছে পথ ফুরিয়ে যাবার ভয়। কিছু পথ না ফুরোলেই বরং সুন্দর। কিছু মুহূর্ত থমকে গেলেই বরং মহৎ। পৃথিবীর সবচাইতে ধ্রুব যে সত্য---মৃত্যু, তা কেবলই স্বস্তি আর শান্তির হিসেব রাখে, বৈধতার বা অবৈধতার নয়।


আমি শুনতে পেলাম, ভদ্রলোক রিকশাওয়ালাকে ধীরে চালাতে বললেন। সময় আজ ধীরে হাঁটুক।


আঁধার কেটে কেটে রিকশা চলছে। হঠাৎ সেই এবড়োখেবড়ো রাস্তার এক গর্তে পড়ে রিকশার গতি পাল্টে যায়…মায়ের যে হাতটা আমাকে ধরে ছিল, সে হাতটা শুরু থেকেই বেশ আলগা ছিল, ধীরে ধীরে সময়ের দাবিতে আরও আলগা হবার কারণে আমি রিকশা থেকে ধপাস করে পড়ে যাই রাস্তায়। এবার মা হতভম্ব! ভীষণ তাড়াহুড়োয় আমাকে তুলছে…আমি শুনতে পাচ্ছি, কিছু সময়ের জন্য মায়ের কণ্ঠস্বর অনুতপ্ত পাপীদের কণ্ঠস্বরের মতো শোনাচ্ছে। মায়ের চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছিল যেন অন্য কোনও পৃথিবী থেকে মা এইমাত্র এইদেশে, এইখানে ফিরল…মা বুঝি মাত্রই ফিরল এইখানে!


সেদিন রিকশা থেকে পড়ে গিয়ে হাঁটুতে ব্যথা পেয়েছিলাম। আজ বুঝি, কিছু ব্যথা বড় সুন্দর, বড় পবিত্র, বড় প্রার্থিত। কিছু ব্যথার জন্য সারাজীবন ধরে প্রতীক্ষা করে থাকা যায়। কিছু ব্যথা না পেলে জীবন বড় অপূর্ণ থেকে যায়।


সেখানেই লোকটা রিকশা ছেড়ে মাকে বিদায় জানালেন। লোকটা যেতে যেতে ফিরে তাকাচ্ছিলেন, আমার মা-ও কেমন জানি ব্যাকুলচোখে লোকটার দিকে তাকাচ্ছিল। মায়ের সে দৃষ্টিতে দরদ ছিল, কৃতজ্ঞতা ছিল, প্রেম ছিল। আমি সব দেখেও কিছুই না বোঝার ভান করে যাচ্ছিলাম, মায়ের সেই পরিবর্তিত চেহারাটা উপভোগ করছিলাম। জীবনে এমন কিছু সময় আসে, যখন অভিনয়ের নামই জীবনযাপন।


দাদুবাড়ি পৌঁছা পর্যন্ত রিকশায় বসে বসে মা মুচকিমুচকি হাসছিল। সাথে হাসছিল আমার স্বর্গ, আমার পৃথিবী।


সেবার আমি এই জীবনে প্রথম- ও শেষবার মাকে মাত্র একবার সুখী হতে দেখেছিলাম। আমার জ্ঞান হবার পর থেকে আজ পর্যন্ত একেবারে ভেতর থেকে খুশি হয়ে উঠতে মাকে আর কখনও দেখিনি। সেদিনের পর থেকে মাকে কখনও মনখুলে হাসতে দেখিনি, ঠোঁটখুলে হাসলেও কখনও মায়ের চোখদুটোকে হাসতে দেখিনি। ওই ক্ষণিকের প্রেম, স্পর্শ, অবৈধতা, অসামাজিকতা আমার মাকে প্রথম একবার সুখী করেছিল। এর পর তাঁর সাথে আর কখনও দেখা হয়নি, মাকেও কখনও হাসতে দেখিনি আর।


হায়, কিছু পাপ দ্বিতীয়বার করতে না পারার দুঃখ মৃত্যুতেও ফুরায় না!


এখন ভাবি, ওই মানুষটাকে আর কখনও পেলে, দেখে চিনতে পারলে পায়ে ছুঁয়ে প্রণাম করতাম, হাতজোড় করে হলেও তাঁকে ধরে আমার অসুস্থ মায়ের কাছে নিয়ে আসতাম…মাকে আর একবার সত্যিকার অর্থে হাসানোর জন্য, সুখী করার জন্য।


এখন তো বড় হয়েছি। এখন বুঝতে পারি, আহা, কী নিখুঁতই না ছিল সেই ক্ষণিকের প্রেমটি, কী যে গভীরতা মিশে ছিল সেই স্পর্শে! গোটা একটাপৃথিবী একপৃথিবী সুখের কাছে স্তব্ধ হয়ে পড়ে ছিল সেই সন্ধ্যায়। জীবনে একবার, শুধু একবার সত্যি সত্যি প্রেম এলে সত্যি সত্যি নগণ্য এই জীবন উৎসর্গ করে দেবো…একদম সত্যিই!


আজকাল---
প্রেমের মধ্যে ডুবতে ডুবতে কত মানুষই তো প্রেমহীন হয়ে বেঁচে থাকে!
আলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কত মানুষই তো অন্ধ হয়ে যায়!