ভাবনাদেয়ালের পলেস্তারা (১৯শ অংশ)

ভাবনা: একশো সাতাশ।

……………………………………..

ছবি আঁকতে জানি না বলে কোনো মেয়ে কখনো বলল না, ভালোবাসি।

কবিতা লিখতে জানি না বলে কোনো মেয়ে কখনো বলল না, ভালোবাসি।

ফটো তুলতে জানি না বলে কোনো মেয়ে কখনো বলল না, ভালোবাসি।

গাইতে জানি না বলে কোনো মেয়ে কখনো বলল না, ভালোবাসি।

মিষ্টি কথায় ভোলাতে জানি না বলে কোনো মেয়ে কখনো বলল না, ভালোবাসি।

দুইলাইন লিখতে জানি না বলে কোনো মেয়ে কখনো বলল না, ভালোবাসি।

ভালোবাসি বলতে জানি না বলে কোনো মেয়ে কখনো বলল না, ভালোবাসি।

সিক্সপ্যাক বানাতে জানি না বলে কোনো মেয়ে কখনো বলল না, ভালোবাসি।

হ্যাংলাপনা জানি না বলে কোনো মেয়ে কখনো বলল না, ভালোবাসি।

সুন্দর করে কথা বলতে জানি না বলে কোনো মেয়ে কখনো বলল না, ভালোবাসি।

একজামে ফার্স্টসেকেন্ড হতে জানি না বলে কোনো মেয়ে কখনো বলল না, ভালোবাসি।

খুশি করার কায়দা জানি না বলে কোনো মেয়ে কখনো বলল না, ভালোবাসি।

দামি শার্টটা পরতে জানি না বলে কোনো মেয়ে কখনো বলল না, ভালোবাসি।

অসীম ঔদাসীন্য থেকে বেরিয়ে আসতে জানি না বলে কোনো মেয়ে কখনো বলল না, ভালোবাসি।

অথচ, এই যে ভালোবাসতে জানি পরম নৈঃশব্দ্যের মতো, এর কি কোনোই দাম নেই? শুধু ভালোবাসলেই হয় না, চিৎকার করে-করে বলতে হয়, ভালোবাসি ভালোবাসি ভালোবাসি! কেন কেউ ভালোবাসা বোঝে না, অনুভব করে না, দেখতে পায় না? আমারও যে বড় বেশি ‘ভালোবাসি’ শুনতে ইচ্ছে করে! আর কতোটুকু ভালবাসতে জানলে পরে ‘ভালোবাসি’ শোনা যায়?

ভাবনা: একশো আটাশ।

……………………………………..

ছোটগল্প: শাস্তি

ব্রেকাপ হয়েছে দুইবছর হল।

শমীকের প্রচণ্ড জ্বর, কমছেই না; ছটফট করছে, আবোলতাবোল বকছে।

দোলা সারারাত অঝোরে কাঁদছে; বালিশ ভিজে গেছে। দোলা শাস্তি পাচ্ছে—ভালোবাসার শাস্তি।

শান্তা সারারাত চ্যাটিং করছে; অন্য অ্যাকাউন্ট থেকে। শমীক শাস্তি পাচ্ছে—ভালোবাসার শাস্তি।

যে ভালোবাসে, সে কষ্টে থাকে; যে বাসে না, সে সুখে থাকে। তবু মানুষ ভালোবাসে। মানুষ কষ্টবিলাসী প্রাণী।

ভাবনা: একশো ঊনত্রিশ।

……………………………………..

একগাদা খড়ে আগুন ধরিয়ে দিলে দাউদাউ করে জ্বলতে থাকে। দেখলে মনে হয়, এই বুঝি সবকিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেবে। আগুনটা নিভিয়ে দিলেন, কিংবা খড়ের পরিমাণ কমে এলে আগুনটা নিভুনিভু হয়ে গেল। ওটার দিকে তাকিয়ে সবাই ভাবে, “এই বুঝি শেষ। এ আগুন আর জ্বলবে না। খড়ের দিন শেষ।” একটা মৃদু শিখা কিন্তু রয়েই যায় সবার অলক্ষ্যে। আর কেউ না জানুক, ছাই হয়ে যাওয়া খড় তো জানে, ওর বুকের মধ্যে যে স্ফুলিঙ্গ আছে, একটু হাওয়া কিংবা একটু খড় পেলেই তা দপ্‌ করে জ্বলে উঠবে। দাউদাউ করে জ্বলে চারপাশটা আবারো ছারখার করে দেয়ার ক্ষমতা ওর এখনো ফুরিয়ে যায়নি। সে স্ফুলিঙ্গের খোঁজ একমাত্র ছাইই জানে, আর কেউ কখনো তার খোঁজ জানবে না।

জীবনের তীব্র দহনে ছাই হয়ে গেছেন? সামনে আর কোনো পথ নেই; নিজের অবস্থার দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে, নিঃশেষ হয়ে গেছেন? বিশ্বাস করুন, আপনার ভেতরের আগুনের কণাটা এখনো আছে। ভীষণ টাটকা, তেজি, জীবন্ত। খুঁজে নিন সেই স্ফুলিঙ্গটিকে। পৃথিবীতে একমাত্র আপনিই জানেন আপনার নিজেকে কীকরে জাগাতে হবে। ভয় কীসের? দুচোখে জল আছে, বুকের ভেতরে আগুন আছে। আর কী লাগে? পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম শিক্ষকও আপনাকে জেগে ওঠার ম্যাজিকটা কখনো শেখাতে পারবেন না। কোথায় আছে নিজেকে জাগানোর সেই মহৌষধ? আপনার নিজেকে প্রশ্ন করে দেখুন, উত্তর পেয়ে যাবেন। অভিযোগ করবেন না, সমালোচনা করবেন না, আপনার দুর্বলতার জায়গাগুলি নিয়ে ভাববেন না। শীর্ণকায় মা যখন তার ওজনের আড়াই গুণ ওজনের পঙ্গু ছেলেকে পিঠে বহন করে হাঁটেন, তখন কোথায় থাকে তার অক্ষমতা দুর্বলতা অসহায়ত্ব? আপনি কি সে মায়ের চাইতেও দুর্বল? লজ্জা করে না নিজেকে অমন করে ভাবতে? আত্মসম্মানে বাধে না একটুও? ভেতরের আবেগটাকে জাগান। আপনার মধ্যে অনেক শক্তি অব্যবহৃত পড়ে আছে। অপ্রয়োজনীয় বাজে কাজে নিজের সমস্ত জীবনীশক্তি এভাবে করে শেষ করে দিচ্ছেন?

ভাবছেন, আপনি শেষ? মরে গেছেন? আরে ভাই, আমি বলি কী, পুরোপুরি শেষ হয়ে যাওয়ার আগেই শেষ জ্বলাটা জ্বলে উঠুন। মরেই তো আছেন, মৃত্যুকে আর কীসের ভয়? পৃথিবী অবাক হয়ে দেখুক, আপনাকে শেষ করে দেয়া সহজ নয়। আপনার নিজের মধ্যে যে শক্তি আছে, তা দিয়ে লড়াই করে যান। আসুক মৃত্যু দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণা, তবু কখনো হেরে যাওয়ার আগে হারবেন না। নিজের সর্বশক্তি দিয়ে নিজেকে আরো একবার আঘাত করুন। সুখের স্পর্শে কষ্ট দূর হয় না, কষ্ট পালায় কষ্টের তীব্রতায়। আপনার যা গেছে, তা তো গেছেই। সেদিকে তাকিয়ে দুঃখ বাড়িয়ে কী লাভ হবে? আপনার যা নেই, তার জন্য আফসোস করলে কি তা পেয়ে যাবেন? আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি, আপনার যা আছে, তা দিয়ে আপনি পৃথিবী জয় করতে পারুন না পারুন, নিজেকে, নিজের পরিবারকে, নিজের সম্প্রদায়কে সম্মানিত করতে পারবেন। আপনার কারো সাহায্য লাগবে না। জীবনে সুন্দরভাবে বাঁচার জন্য যা যা প্রয়োজন, তার সবকিছুই দিয়ে আপনাকে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে। খুঁজে নিন সেসবকে। আপনার কাউকে আইডল মানার কোনো দরকার নেই। আপনি এমনকিছু করুন, যাতে আপনিই কারো আইডল হয়ে যান। সেরা কারো সাথে নিজেকে তুলনা করবেন না, নিজেকেই ছাড়িয়ে যান প্রতি মুহূর্তে। হেরে যাওয়ার জন্য আপনার জন্ম হয়নি, সংকোচে লুকিয়ে বাঁচার জন্য আপনি এই পৃথিবীতে আসেননি। নিজের সমস্ত শক্তিকে জড়ো করে ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে দাঁড়ান, পৃথিবী আপনাকে গ্রহণ করার জন্য অপেক্ষা করছে।

অনেকগুলো লুচি ভাজতে এক কড়াই তেলের প্রয়োজন হয় ঠিকই, কিন্তু ভাজাশেষে প্রায় সবটা বা অনেকটাই তেল কড়াইয়ে থেকে যায়। মানে, অনেকগুলো লুচি ভাজতে হয়তো ১ লিটার তেলে ডুবাতে হয়, অর্থাৎ অনেকটা তেল কড়াইয়ে রাখতে হয়, কিন্তু খরচ হয় মাত্র ২৫০ মিলিলিটারের মতো; কিন্তু তাই বলে আবার শুধু ২৫০ মিলিলিটারে কাজ হবে না।

জীবনের অনেককিছুই এই ডুবোতেলে লুচিভাজার তেলের মতো……..জীবনের এমন অনেক লুচিই শেষ পর্যন্ত আর ভাজা হয়ে ওঠে না বাকি ৭৫০ মিলিলিটার তেলের অভাবে, অথচ ২৫০ মিলিলিটার তেল অনেকেরই সঞ্চয়ে থাকে।

কৌশল, ধৈর্য আর পরিশ্রমের মাধ্যমে বাকি ৭৫০ মিলিলিটার তেল যোগাড় করে ফেলতে পারলে, জীবনের অনেক পথই দারুণভাবে খুলে যেতে পারে…….আর একবার গন্তব্যে পৌঁছে যেতে পারলে, ৭৫০ মিলিলিটার তেল তো বোনাস হিসেবে থেকেই যাবে…..তখন আরো কত লুচিই তো ভাজা যাবে, নিজে খেয়ে উদ্বৃত্ত থেকে গেলে অনেক অভুক্ত মানুষকেও সেই উদ্বৃত্ত লুচি খাওয়ানো যাবে। বাড়তি তেলের সুখ নিজেও ভোগ করা যায়, অন্যকেও ভোগ করতে দেয়া যায়। জীবনের অনেক ধনই বাড়তি, তবে সে ধন জীবনে অর্জন করতে না পারলে আসল ধনের সুখটাই চিরকাল অধরা থেকে যায়। হয়তো আমার চলতে খরচ হবে ১০ টাকা, আমার কাছে আছে ১৫ টাকা, বাড়তি ৫ টাকা আমি খুব সহজেই অভাবী কাউকে দিয়ে দিতে পারি। ওই বাড়তি টাকাটা খরচ করার জন্যই আরো ১০ টাকা কামাই করতে হয়, হয়তো সেই ১০ টাকা আমার কখনোই কোনো কাজে লাগবে না, কিন্তু সে ১০ টাকা না থাকলে যে ওই ৫ টাকাটা আমি কারো জন্য খরচ করতে পারব না। ২৫ টাকা থেকে ১০ টাকা নিজের জন্য ও ৫ টাকা পরের জন্য খরচ করা সহজ, কিন্তু ১৫ টাকা থেকে একই কাজটি করা সহজ নয়।

ভাবনা: একশো ত্রিশ।

……………………………………..

(কখনো-কখনো বাংলা মুভির নেশায় পেয়ে বসে। বিভিন্ন সময়ে লেখা কিছু পোস্ট জড়ো করলাম।)

# আজকের ঘরের-বাইরে’টা এমন, যেমনটার জন্য অপেক্ষা করে থাকা যায়৷ আবার সেটা এমনই, যেটা পেয়ে গেলে অপেক্ষার পালা ফুরিয়ে প্রতীক্ষার মুহূর্ত শুরু হয়ে যায়। কীসের জন্য প্রতীক্ষা? না, কীসের জন্য নয়, কারো জন্য৷ এই সময়ে সমস্ত শরীর-মন জুড়ে ভালো লাগে, লাগতেই থাকে, লাগাটা বাড়ে, কমে; ‘ভালো লাগছে, ভালো লাগছে, কেনো তা বলতে পারি না’ এই গানটার মতো অনুভূতি জাগে৷

এমন দিনে তেমন কেউ পাশে না থাকলে এমন কিছু নিয়ে থাকতে হয়, যার মধ্যে ডুব দেয়া যায়৷ তা-ই নিয়েই আছি৷

যে জমিদার বাড়িতে একটা কুকুর পর্যন্ত সভয়ে ঘোরাফেরা করে না, বুঝতে কিছুমাত্র বাকি থাকে না, সেই বাড়িকর্তার জমিদারি কতটা হতশ্রী৷ সেই বাড়ির গল্পো দেখছি৷ যে সুরের জমিদারির সুর হারিয়েছে বেসুরো হেঁয়ালিতে, সেই বাড়িটাকে দেখছি সত্যজিতের লেন্সে৷

বেগম আখতার, রোশন কুমারী, উস্তাদ ওয়াহিদ খাঁ, উস্তাদ বিসমিল্লা খাঁ৷ এঁরাও আছেন এখানে৷ সত্যিই আছেন!

দেখছি ‘জলসাঘর’৷ সুরের মুভি, সুরেলা মুভি৷ সুরই এখানে জানান দেয় ছন্দপতনের দায়ভার সবকিছুকে কীভাবে সুরমাধুর্য-রূপরসহীন করে দেয়৷

বাঙালির বড়ো সৌভাগ্য, সত্যজিত বাঙলায় জন্মেছিলেন৷ কখনো এমন কিছু লেখেননি, বানাননি, করেননি যা নান্দনিকতার বিচারে বিন্দুমাত্রও পিছিয়ে থাকে৷ কীভাবে সম্ভব! অমর হতে তাঁকে মৃত্যুপর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়নি৷ ‘শান্তভাবে বহমান এক বিরাট নদী’-র মতো তাঁর বিপুল সৃষ্টির রহস্য পুরোপুরি মানবজীবনের মতোই নাটকীয়৷ এই এক সত্যজিতেই বুঁদ হয়ে থাকা যায় দিনের পর দিন৷

# ‘আগন্তুক’ মুভিটা দেখলাম৷ সত্যজিত রায়ের৷ এক ক্ষ্যাপাটে বোহেমিয়ানের গল্প৷ মুভি চলে মুভির গতিতেই; ধাক্কাটা এসে লাগে একেবারে শেষ দৃশ্যে ৷ সত্যজিত রায় গ্রেট আর্টিস্ট৷ তাঁর কাছে সাইকোলজির যে পাঠটা পেলাম, তাতে হয়তো অভিনবত্ব নেই, কিন্তু মুগ্ধ করার মতো একটা ব্যাপার আছে৷ এই মুগ্ধতাই বেঁচে থাকে শেষ অবধি৷ গ্রেট ফ্লিমমেকারদের ক্রেডিটটা বোধ হয় এখানেই৷

# ‘অযান্ত্রিক’ দেখছি। মুভিটা মজার। ‘৫৮-র ভালোমানুষগুলোর কী সারল্য! আহা! ঋত্বিকের প্রথম মুভি। দেখে বোঝার উপায় নেই। আজন্ম ফিল্মমেকার নাকি এই ক্ষ্যাপাটে ভদ্রলোক?

সুবোধ ঘোষের এই গল্প আগেই পড়েছিলাম। ঘটক মশাইয়ের এই আশ্চর্য নিপুণ বিনির্মাণে মনে হচ্ছে, কফিনে শেষ পেরেক ঠোকার আগে ওই জগদ্দলকে নিয়েই একটুখানি জীবনকে আরও একটুখানিতে নিয়ে যাওয়া যায়।

জানি-ই তো, এভাবে আর চলে না হয়তো। ভাবছি, চলুক; তবুও। মরার চেয়ে বেঁচেবর্তে থেকে যাওয়া তো ঢের ভালো। কতো কিছু দেখা হলো না, জানা হলো না, বোঝা হলো না, পড়া হলো না। না-ই বা হলো। ইচ্ছেটুকু তো জিইয়ে রাখি অন্তত। কতকিছুর জন্যই তো বেঁচে থাকা যায়। ওইজন্যই না হয় বাঁচি।

# আকালের সন্ধানে, কাঞ্চনজঙ্ঘা, শ্রীমান পৃত্থীরাজ, তিন কন্যা, চারুলতা, স্বরলিপি, দাদার কীর্তি, দেবী, গল্প হলেও সত্যি, ঘরে-বাইরে, জন-অরন্য, মহানগর৷ এই লিস্টটা ফিনিশড্‌! মিশন সাকসেসফুল! হার্ডডিস্কে আরো আছে, মাথায়ও আছে কিছু৷ কত্তো-কত্তো মুভি এভাবেই থেকে যায়, দেখা হয় না৷ আজকে দেখবোই৷ অন্তত দুটো৷ হুমমমম্ …….

ভাবনা: একশো একত্রিশ।

……………………………………..

(২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরের ৩ তারিখে পাবনায় ঘুরতে গিয়েছিলাম। এই লেখাটি ওখানে বেড়াতে যাওয়ার আগে লেখা।)

আয় মন বেড়াতে যাবি। মনকে বেড়াতে নিয়ে যাচ্ছি। দেহও সাথে যাবে। আমি, ওরা কী করে, দেখতে যাবো। পাবনা যাচ্ছি। কালকে। শুক্রবার থাকবো, শনিবার সন্ধ্যের পর অবধি থেকে এই যন্ত্রণায় ফেরত আসবো। এই আসা ফিরে আসা নয়, ফেরত আসা। নাটোরে যাবো। হঠাৎ যদি বনলতা সেনের দেখা পেয়েই যাই, শান্তি না হোক, মুঠোয়-মুঠোয় অশান্তি নিয়ে হলেও ফিরবো—বনলতাকে না পাওয়ার অশান্তি। খালি হাতে ফিরবো না কিছুতেই। খালি হাতে ফিরতে-ফিরতে এখন আমি ক্লান্ত। আমার নিজস্ব পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবি জীবনানন্দের মতো যদিও বা ফুরায় ‘এ জীবনের সব লেনদেন’, কিছুমাত্র দুঃখ থাকবে না। সম্ভব হলে কুষ্টিয়াতেও যাবো। এখানে লালন আছেন। দর্শনের সহজ পাঠ এতো সহজে আর কেউ কখনো দেয়নি। কুষ্টিয়াতে আগেও গেছি। কুঠিবাড়ি ছুঁয়ে এসেছি। এই শহরের মানুষের মুখের ভাষা বড় মিষ্টি। ওরা বকেও ভারি মিষ্টি করে!

পাবনাতে আসার আমন্ত্রণ পেয়েছি আমার বন্ধু শোয়াইবের কাছ থেকে। অবশ্য আরো অনেকেই আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। তবে ওর আমন্ত্রণটা উপেক্ষা করা কঠিন ছিলো। আমন্ত্রণটাকে কিছুদিন আগে ফেসবুকে শেয়ার করেছিলাম, কিছুটা আমার নিজের শব্দের আর ভাবনার খেলায়। আবারও করছি। পড়ুন। ফেরানো কেনো কঠিন, বুঝবেন।

বন্ধু, পাবনাতে আমার বাসা যেখানটায়, মানে যে গলিতে, সুচিত্রা সেনের আদি বাড়ি সেই গলিটার মুখেই। সুচিত্রা সেন আমার কাছেই থাকেন; না, ভুল হলো, আমি সুচিত্রা সেনের কাছেই থাকি। মানসীরা কাছে থাকে না বন্ধু, ওদের কাছেই থাকতে হয়। ওই বাড়িটাতে একটা কাঁঠালচাপার গাছ আছে, মানে সুচিত্রার বাড়িতে। বন্ধু, আমার অনেকদিনের অভ্যেস, ভোরে আর বিকেলে হাঁটা। প্রতিদিন ভোরবেলা আমি হেঁটেহেঁটে বাড়ি ফেরার সময় সুচিত্রা সেনের বাড়ি থেকে চাঁপাফুল কুড়িয়ে নিই। বন্ধু, বৃষ্টির সময়ে এ ফুলের যে অপূর্ব মিষ্টি ঘ্রাণ তাতে আরো মাদকতা জড়িয়ে দেয় সুচিত্রার স্পর্শ। বন্ধু, থোকাথোকা চাঁপা ফুল হয়তো পাবে টিএসসি’তেই, কিন্তু সুচিত্রাকে কোথায় পাবে ওখানে? ওটা পেতেও তো আসতে পার, বন্ধু। জানি, তুমি সুচিত্রার দেহপল্লবে-চোখে-হাসিতে আজো হারিয়ে যাও। সত্যজিতের চারুলতা, মানে মাধবীও তোমাকে ভোলায় জানি, তবুও সুচিত্রাই তো বেশি ছোঁয়, না? এখানে এলে সেই ছোঁয়া কি একটুও পাবে না, বন্ধু?

এখানেই শেষ নয়। আমি তোমাকে মেন্টাল এ্যাসাইলামে ঘুরতে নিয়ে যাবো; এখানে নেহরু থেকে শুরু করে কারা আসেননি, বল? এরিয়াটা তোমার ভালো লাগবে।

ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের আশ্রমটাতে গেলে কী যে এক প্রশান্তি ছুঁয়ে যায়! ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউটটাও তো এখানেই। সরকারী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আছে, ওখানেও নিয়ে যাবো। আমার একটা ছোটো ভাঙ্গাচোরা বাইক আছে, বন্ধু। কোনো সমস্যাই হবে না।

সন্ধ্যায় পদ্মার পাড় ধরে হাঁটতে পারবে, বাঁধা নৌকাগুলো ওই সময়ে আর স্রেফ নৌকা হয়ে থাকে না, বন্ধু। ‘দিনের শেষে ঘুমের দেশে ঘোমটা-পরা ওই ছায়া’ দেখতে পাবে ওই নৌকাগুলোতে। অনিন্দিতা’তে হেমন্ত যেমনি করে রবি ঠাকুরকেও ছাপিয়ে ওই আশ্চর্য বিষাদমাখা চোখের মায়াবিনীতে আমাদের ভুলিয়ে রাখেন আজো, হলফ করে বলতে পারি, তুমি পদ্মাকূলে সেই মায়াবিনীর দেখা যদি নাও পাও, তবুও তোমার এতোটুকুও আফসোস থাকবে না।

আর পদ্মা পাড়ি দিলেই তো কুঠিবাড়ি। নিজের বাড়ি ছাড়া ওই একটা বাড়িকেই আমার এখনো আপন মনে হয়। রবি ঠাকুর তো আমার নিজের মানুষ; ওঁরই তো বাড়ি। লালনও আছেন ওখানে, তবুও তুমি আসবে না, বন্ধু?

………….অসাধারণ নিমন্ত্রণ! শুধু সুচিত্রা সেনের বাড়ির চাঁপাফুল কুড়িয়ে ছুঁয়ে দেখতেও তো শোয়াইবকে না বলতে ইচ্ছে করে না। দেখি, তাতেও যদি পাপের মোহটা একটু কমে; সুনীলের মতো……….

এই হাত ছুঁয়েছে নীরার মুখ/ আমি কি এ হাতে কোনো পাপ করতে পারি ?

ভাবছি, এই ইটপাথরের কোলাহলের শহরটা ভুলিয়েভালিয়ে কতোকিছু কেড়ে নেয়! আমি চাই, যেমন ছন্দে আমি ভাবি, কেউ আমায় অমন করে ডাকুক যাতে আমি ফেরাতে না পারি। ফেরাতে-ফেরাতে আমি এখন ক্লান্ত। দূরের ওই শহরের কতোকিছুই আমায় অবিরাম হাতছানি দিয়ে ডেকে যায়, আমার এইটুকু নির্লজ্জতায় কার কী এসে যাবে?

ভাবনা: একশো বত্রিশ।

……………………………………..

জুকারবার্গ দাদার বাসায় এলেই উনি শুধান, হোয়াটস্ অন ইয়োর মাইন্ড? . . . . . . . আজ্ঞে, দুটো ভাবনা ঘুরছে।

এক।

এই পৃথিবীতে ২ ধরনের মা সবচেয়ে দুঃখী। পুত্রদায়গ্রস্ত মা। অসুখী শাশুড়ি।

এই পৃথিবীতে ২ ধরনের বাবা সবচেয়ে দুঃখী। যে বাবা কন্যাদায়গ্রস্ত। যে বাবার ছেলে এখনো নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারেনি।

দুই।

আপনারা কি খেয়াল করে দেখেছেন, যারা ছাত্ররাজনীতি করে এবং অন্তঃদলীয় কিংবা আন্তঃদলীয় কোন্দলে প্রাণ হারায়, তাদের জন্য আমাদের খুব একটা খারাপ লাগে না? এই খারাপ না-লাগা’টা খুব কষ্টের। আমাদের মন খারাপ হয়ে যায় তখন যখন পেপারে পড়ি,

“বড়দা, সামনের মাসে আমার পরীক্ষা। দুই হাজার টাকা লাগবে।”

“ভাইদের লেখাপড়া শিখিয়ে বড় করার জন্য দিনরাত পরিশ্রম করেছি। বাড়িতে মা-বাবা খেয়ে না-খেয়ে দিন কাটান। আজ আমাদের সব শেষ হয়ে গেছে।”

হ্যাঁ, একটা বুলেট সবকিছু কেড়ে নেয়—স্বপ্ন, অবলম্বন। রাজনীতির কী নির্মম নিয়তি!

আমরা চাই, ছাত্ররাজনীতি আমাদের ছাত্রদের পরীক্ষা দিতে দিক। ওরা পাস করুক, চাকরি করুক। বেশিকিছু না হোক, ওর চাকরির সামান্য টাকায় কেনা লুঙ্গিফতুয়া পরে ওর বাবা আর শাড়ি পরে ওর মা পাশের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে অন্তত এইটুকু বলতে পারুক, “দেখেন দেখেন, আমার ছেলে কিনে দিয়েছে।” ওর কিনে-দেয়া সস্তা শার্টটা পরে ওর ভাইয়া বন্ধুকে বড়মুখ করে দেখাতে পারুক, “দোস্ত, আমার ভাইটা একটা চাকরি পেয়েছে। ওর জন্য দোয়া করিস ভাই।”

“তোমার সন্তানেরা তোমার সন্তান নয়। জীবনের নিজের প্রতি নিজের যে তৃষ্ণা, তারা হলো তারই পুত্রকন্যা।” চরম সত্যকথা। কিন্তু আমাদের মা-বাবা কাহলিল জিবরান বোঝেন না। তাঁদের সহজসরল মন শুধু ভারতচন্দ্র বোঝেঃ “আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে।” মা-বাবা নিজেদের মৃত্যুর ভয় করেন না, মৃত্যুর আগে ছেলেকে প্রতিষ্ঠিত দেখে যেতে না পারার ভয় করেন। আমরা চাই, আমাদের মা-বাবা যে স্বপ্নে খেয়ে না-খেয়ে দিন কাটান, সে স্বপ্নের বিকিকিনি স্রেফ একটা বুলেটে না হোক। মৃত্যুকে পরোয়া না করার ছেলেমানুষির মাঝে কেউই জীবনের অনর্থক অর্থ খুঁজে না নিক।

ছাত্ররাজনীতি করে যারা, তাদের প্রেমিকারা যে রুমালে তাদের জন্য রঙবেরঙের সুতোয় নকশা তুলে দেয়, স্বপ্ন বোনে, সে রুমাল কি কাফনের কাপড়ের? কিন্তু অতোটা দুঃসাহসী প্রেমিকারা এই সময়ে কেন? তবে কি আমরা দেশ পেয়ে দেশ হারাতে বসেছি? আরেকটা ’৭১ কি ফিরে আসছে? আমরা সুখী হাসিখুশি প্রিয়তমাদের জন্য একটা দেশ চাই। আমাদের দেশের মাটি হোক বাবার কাঁধের মতোই প্রশস্ত, মায়ের কোলের মতোই নিরাপদ।

ছাত্ররাজনীতি নিয়ে আমি কী ভাবি সেটা বোঝাতে সুনীলের ‘অর্ধেক জীবন’ থেকে কিছু কথা হবহু তুলে দিচ্ছি:

……..গুলিটা আমার বুকে লাগতেই পারত, লেগেছে পাশের ছেলেটির কাঁধে, সে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। তাকে টেনে নিয়ে যেতে যেতে মনে হল, যদি গুলিটা আমার বুকে লাগত, আমি প্রাণ দিতাম, সেই প্রাণদান কীসের জন্য? তা দেশের কোন্ উপকারে লাগত? এ তো নিতান্তই নির্বোধের মতন মৃত্যু। এই ছেলেটিও কি বাঁচবে? কিংবা এর ডান হাতটাই যদি অকেজো হয়ে যায়, তাতেই বা কোন আদর্শ জয়ী হবে? না, এভাবে প্রাণ দিতে আমি রাজি নই। এ পথ আমার নয়।

ভাবনা: একশো তেত্রিশ।

……………………………………..

ভাই, অনেক হইসে, এইবার থামেন! আপনি যা চান, তা পেতে হলে আপনাকেও আমার মত খারাপ রেজাল্ট করতেই হবে, একথা তো আমি বলি নাই! প্রতিদিন আমার কাছে অনেক মেইল আসে যেখানে মহোদয়গণ “আমার গ্রেড ভাল, এখন আমি কী করিব?” টাইপের প্রশ্ন করেন। বড়ই যন্ত্রণা! আরেক ধরনের মেসেজ পাই, যেগুলোতে থাকে, “আমার জীবনে তো কোনো ট্রাজেডি নাই। আমি কি বড় হতে পারব না?” জাতীয় আফসোস। আহা, কিসুকিসু মাইনষ্যেরে সুখে থাকতে ভূতে চুম্মা দেয়! আমি এরকম একজনকে বুদ্ধি দিসি, চিড়িয়াখানায় গিয়ে বাঘমামুকে পেপসোডেন্ট মাজন দিয়ে দাঁত মেজে দিতে।

যা-ই হোক, যাঁদেরকে সময়ের অভাবে সময়মত মেসেজের রিপ্লাই দিতে পারি না, তাঁদের কাছে বিনীতভাবে ক্ষমা চাইছি। আমি খুব চেষ্টা করি, হতাশা, বিষণ্নতা কিংবা ব্যক্তিগত কষ্টবোধের মেসেজের রিপ্লাই দ্রুত দিতে। ইংরেজি ফন্টে লেখা বাংলা মেসেজগুলো খুব বড় হলে (গরু রচনা টাইপ) পড়তে বেশ সময় লাগে। তাই, ওগুলোর রিপ্লাই দিতে দেরি হয়। তবে আমি সাধারণত রিপ্লাই দিই। অনেক মেসেজ Others-এ চলে যায়। ওখানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মেসেজও জমে থাকে। একটা মেসেজের কথা বিশেষভাবে মনে পড়ছে, যেখানে একটা মেয়ে সুইসাইড করার কথা ভাবছে, এমনকিছু কষ্টের কথা লেখা ছিল। আমার পরম সৌভাগ্য, মেয়েটাকে কাউন্সেলিং করে ওর সিদ্ধান্ত থেকে ফিরিয়ে আনতে পেরেছি। এই ছোটো জীবনে এমন সৌভাগ্য আমার আরো অনেকবার হয়েছে; অন্তত ৬৯ বার। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ।

ইনবক্সে প্রচুর মেসেজ আসার ফলে তাৎক্ষণিকভাবে আমার হেল্প দরকার, এমন অনেক মেসেজই অনেক নিচে চলে যায়। প্রচণ্ড ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও অনেকসময়ই এরকম অনেককেই হেল্প করতে পারি না, ওরাও ভুল বোঝে। এসবক্ষেত্রে খুব ভাল হয়, যদি আমাকে সরাসরি ফোন করে আপনাকে কীভাবে হেল্প করতে পারি সেটা বলেন। এতে আমি কিছু আফসোস থেকে বেঁচে যাব, আমার সত্যিই ভাল লাগবে। জীবনে আফসোসের বোঝা বাড়িয়ে কী লাভ?

আমার বাবা বলেন, মানুষের ক্ষতি করার সুযোগ দিনে একশ’টাও পাওয়া যায়, কিন্তু উপকার করার সৌভাগ্য হয়তো একশ’ দিনে একটাও হয় না। আরেকটা অনুরোধ . . . . . ‘ব্লাডি কিলার’ টাইপের নামের রক্তাক্ত খুলির প্রোফাইল পিকচারওয়ালা আইডি’র কেউ ইনবক্সে দয়া করে ‘অ্যাড মি’ লিখে পাঠাবেন না। আমি কনফিউসড হয়ে পড়ি, এটা কী রিকোয়েস্ট, নাকি থ্রেট!

আমার আরেকটা বদভ্যাস হল, ছবি না দেখে কিংবা পরিচয় না জেনে কাউকেই অ্যাড করার আগ্রহবোধ করি না। কার বন্ধু হচ্ছি, তার সম্পর্কে একটু হলেও তো জানতে ইচ্ছে করে, তাই না? আমার সম্পর্কে একটা অভিযোগ হল, আমাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠানো যায় না। ভাই, এর জন্য আমি নই, জুকারবার্গ দায়ী। প্রচুর পেন্ডিং ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টের জন্যই আমার বিরুদ্ধে এ ফেসবুকীয় ব্যবস্থা। কথা হল, আমি ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টগুলো রেসপন্ড করি না কেন? ভাই, সত্যি বলছি, সম্ভব নয়। এত সময় বের করে নেয়ার সাধ আছে, কিন্তু সাধ্য নেই। যাঁরা আমার ফ্রেন্ড না, ফলোয়ার, তাঁদের জন্য আমি সবকিছুই পাবলিক করে দিয়েছি। শুধু আমার ওয়ালে পোস্ট করা ছাড়া ফেসবুকের অন্যসব ফিচারেই আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারেন কিংবা যোগাযোগ বন্ধ করে দিতে পারেন। আমার সব পোস্টে শতভাগ অ্যাক্সেস ওপেন রাখি!

আহা! ফেসবুক না থাকলে জীবনটা এত আনন্দময় আর যন্ত্রণাদায়ক হত না। জুকারবার্গের দেখা পেলে স্যারকে কাঁচামরিচ দিয়ে চমচম খাওয়াতাম! ফেসবুক একটা ঝালমিষ্টি প্ল্যাটফরম, তাই ওই খাদ্য প্রদানাগ্রহ। (প্রদান+আগ্রহ=প্রদানাগ্রহ; অশ্বডিম্বসন্ধি)