ভাবনাদেয়ালের পলেস্তারা (২০শ অংশ)

দুই পেশার মানুষের প্রতি আমার অসীম পরিমাণ অন্ধ শ্রদ্ধাবোধ আর ভালোবাসা কাজ করে: শিক্ষক আর ডাক্তার

ডাক্তারের পয়সা কম দিলে রোগ কম সারবে। শিক্ষকের পয়সা কম দিলে উন্নতি কম করা যাবে। এ দুটো কথা আমি সবসময়ই আপ্তবাক্যের মতই মেনে চলি।

যে দেশে শিক্ষকরা যত বেশি অসহায়, সে দেশ তত কম উন্নত। শিক্ষকদের বেতন অনেক দেশেই অন্যান্য পেশাজীবীদের তুলনায় বেশি। সে দেশে শিক্ষকদের আন্তরিকতা আর দায়বদ্ধতার কালচার অনেক আগে থেকেই তৈরি হয়ে আছে। আমাদের দেশে শিক্ষক আর ভিক্ষুক দুই শ্রেণীর পেশাজীবীদের পার্থক্য বড়োজোর প্রত্যয়গত; অক্ এবং উক্। এটা আমাদের জন্য বড় লজ্জার। যথার্থ সম্মান না পেলে কেউ যথার্থ সেবাদানে আগ্রহী হবেন না, এটা খুব বুঝিয়ে বলার মত কিছু নয়। আধুনিক সিঙ্গাপুরের প্রতিষ্ঠাতা লী কুয়ান ইউয়ের একটা কথা আমার খুব প্রিয়: If you pay peanuts, you will get monkeys for your Ministers. দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আমাদের দেশে আমরা আমাদের পূর্বপুরুষ বানরদের কাছ থেকে সেবা নেয়ার মানসিকতায় বেড়ে উঠি। ফলে, বড় হয়ে আগের জন্মে ফিরে যাই। আশ্চর্যজনকভাবে আমাদের জন্মান্তর হয় রিভার্স ওয়েতে; মানবসন্তান থেকে বানরে প্রত্যাবর্তন।

আমাদের দেশে শিক্ষকদের কাজের প্রতি আন্তরিকতা ওভাবে করে অনেক আগে থেকেই তৈরি হয়নি। এটা ঠিক, যে কাজে উনি নিয়োজিত মানে শিক্ষকতা, সে কাজের বাইরের কাজগুলোও কাজ, এবং নিঃসন্দেহে ভাল কাজ। এর সাথে এটাও ঠিক, যে ছেলে বাবা-মা’র সেবা না করে শ্বশুর-শাশুড়ির সেবায় নিজেকে সবসময়ই নিয়োজিত রাখে, সে ছেলের সেবাদানের উদ্দেশ্য একটা নির্বোধও বোঝে। কিন্তু মূল কাজে ফাঁকি দেয়ার কালচার আমাদের দেশে অনেকটা নীরবে সম্মতিপ্রাপ্ত বিধায়, ওটাকে কেউ অতটা গর্হিত কাজ বলে মনে করেন না। এতে যে অসুবিধাটি হয়েছে, তা হল, ক্লাসে যে শিক্ষক নিয়মিত পড়ান, সেটি উনার দায়িত্ব হলেও স্টুডেন্টরা সেটাকে ধরে নেয়, উনার বিশেষ গুণ হিসেবে। যে সেবাটা ওদের প্রাপ্য, সেটা পেলে যদি ওরা সেটাকে মনে করে বিশেষ সুবিধা, এক্ষেত্রে ওরা নিজেরাও পাস করার পর ওরকম একটা কালচার হৃদয়ে ধারণ করে সেবাপ্রদান করবে, এতে অবাক হওয়ার কিছুই নেই। অধিকার আর আনুকূল্যের পার্থক্য যে জাতি তার সন্তানদের শেখাতে পারে না, সে জাতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে।

Translate into English:

ডাক্তার আসিবার পূর্বে রোগী মারা গেল।

ডাক্তার আসিবার পরে রোগী মারা গেল।

ছোটবেলায় আমরা ওপরের দুটো ট্রান্সলেশন শিখতাম না? এটা শেখানোর উদ্দেশ্য ছিল মূলত before এর আগে, after এর পরে had বসে এবং এরপরের verb এর past participle form হয়, এটা শেখানো। কিন্তু আমি ভাবি, এরকম বাক্যও তো শেখানো যেত; এই যেমন, কুকুর আসিবার পূর্বে/ পরে বিড়াল পালাইয়া গেল। ………. ওরকম কিছু তো শেখানো হয়নি। যারা প্রথম ওরকম দুটি বাক্য দিয়ে অনুবাদ শেখানোর প্ল্যান করেছিলেন, তাদের অবচেতন মনে এটা নিশ্চয়ই ছিল বলে অনুমান হয়, মানুষের মৃত্যুর সাথে ডাক্তারের একটা যোগসূত্র আছে। মডার্ন মুমূর্ষু রোগী ডাক্তারের সেবা না পেলে শুধু দৈববলে বেশিক্ষণ বাঁচে না।

অবশ্য অনেকসময়ই ডাক্তার আর রোগীর সম্পর্ক নিয়ে ভাবলে ইদানীং আমার প্রায়ই টম অ্যান্ড জেরি কার্টুনটির কথা না-চাইতেও মনে পড়ে যায়। কেন পড়ে, সে আলোচনায় যাচ্ছি না এই কৃতজ্ঞতাবোধ থেকে যে, বাস্তবিক অর্থেই, ডাক্তারের সেবা যে কী বস্তু, এটা মানুষ নিজে কিংবা কাছের কেউ অসুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত বোঝে না। যে লোক বাতাসের সাথে লড়াই করে বাঁচতে চায়, তাকে মাঝে-মাঝে পানিতে ডুবিয়ে রাখাই তো ভাল, তাই না? ডাক্তাররা তাই মাঝেমধ্যেই স্বেচ্ছায় অনশন ধর্মঘটে যান, কর্মবিরতি পালন করেন। আমি এতে দোষের কিছু দেখি না। অধিকার আদায়ের জন্য কণ্ঠের জোরও কখনো-কখনো দেখাতে হয়। তবে যে ব্যক্তিটি দারিদ্র্যের কারণে প্রতিদিনই অনশন করতে বাধ্য হন, তাকে নিছক ব্যক্তিস্বার্থে কিংবা খেয়ালিপনায় চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত করেন যে ডাক্তার, সে ডাক্তার শুধু একদিন না, দিনের পর দিন অনশন করে থাকলেও আমাদের কিছু এসে যায় না। অবশ্য ওরকম ডাক্তারদের অনশন ধর্মঘটে যেতেও হয় না। ওদেরও একটা সম্প্রদায় আছে; তবে সেটি দুর্বল সম্প্রদায়। যে সম্প্রদায়ে ব্যক্তি গোষ্ঠীবদ্ধ হওয়ার আগেই শক্তিশালী হয়ে যায়, তাই সে সম্প্রদায়ে সাধারণত একতা কম থাকে।

ডাক্তারি পড়া বেশ শক্ত। চান্স পাওয়া তো আরও শক্ত। ডাক্তারি কারা পড়ে? যারা স্কুল-কলেজে ফার্স্ট-সেকেন্ড হয়, ভাল রেজাল্ট করে, তারাই তো, না? এর মানে কী দাঁড়াল? ডাক্তাররা সাধারণত দেশের মেধাবী স্টুডেন্ট। তবে, ডাক্তারি পাস করার পর ডাক্তারদের যে চরম হতাশার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, সেটা মাথায় রাখলে অনেক বাবা-মা’ই তাঁদের সন্তানদের ডাক্তারি পড়াতেন না। আমাদের দেশে এখনো বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারটি সবচাইতে অবহেলিত ক্যাডারগুলির একটি। ডাক্তারদেরকে যে অবস্থায় চাকরি করতে হয়, সেটা আগে থেকে জানলে অনেকেই বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারে আসতেন না। অবশ্য ডাক্তারদের যে মেধা আর বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারে যে ‘কম্পিটিশন’, এ দুই ব্যাপার মাথায় রাখলে এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, যে ডাক্তার ক্যান্ডিডেট বিসিএস প্রিলি কোয়ালিফাই করতে পারে, অথচ চাকরিটা পায় না, সে ডাক্তার বিরল প্রজাতির প্রাণী। তবে এ নিয়ে আলোচনা পর্যালোচনা ভিন্নমত থাকতেই পারে। আমি নিজে আমার ডাবল স্ট্যান্ডকরা ডাক্তার কাকাকে দেখেছি, দুইবার বিসিএস দিয়েও বিসিএস হেলথ ক্যাডারে সাফল্যের সাথে অসফল হতে। তাই আমি সে তর্কে যাচ্ছি না, তবে এখন এটা ভাবতে ইচ্ছে করছে, সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন আমরা আর দেখব না, জাস্ট ঘুম থেকে উঠেই তেমন কোন প্রিপারেশন ছাড়াই স্রেফ বেসিকের জোরে বিসিএস প্রিলি পরীক্ষা দিয়ে প্রিলি পাস করে-ফেলা ডাক্তাররা দেশের সেরা বিদ্যাপীঠ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের অ্যালামনাই। সেদিন শিক্ষকরা শুধু একটা ট্রান্সলেশনই ছাত্রদের শেখাবেন : ডাক্তার আসিবার কারণে রোগী মারা গেল।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের নাম কেন বললাম? কারণ এখনো মেডিক্যালে চান্স পাওয়ার ক্ষেত্রে সবচাইতে কঠিন ওখানে চান্স পাওয়া। ‘ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ’ কথাটি শুধু সহজ-কঠিন বোঝানোর জন্যই বলা, আর কিছু নয়। আচ্ছা, আমার লেখাটি যারা পড়ছেন, ‘এখনো’ শব্দটি নিয়ে তাদের মধ্যে কনফিউশন শুরু হয়ে গেছে না? যাওয়ারই তো কথা! আমার নিজের মধ্যেও লেখার সময়ই ভেতর থেকে খুব আপত্তি কাজ করছিল। কেন? ………. বলছি।

মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা ফাঁস-হওয়া প্রশ্নে নেয়া হয়েছে, এই অভিযোগটি সবার মধ্যে খুব শক্ত করে ‘প্রমাণিত সত্য’ হিসেবে গেঁথে যাওয়ার পর আমি এ ব্যাপারটি নিয়ে অন্তত শতাধিক মেসেজ আর ফোন পেয়েছি, যাদের মোটামুটি সবাইই আপনার আমার নিরীহ ছোট ভাইবোন। ওদের মেসেজগুলি পড়লে এক ধরনের অসহায়ত্ব কাজ করে। ………… কী ধরনের?

একটা মেসেজের কথা বলি। ওখানে একটা ছেলের প্রোফাইল লিংক আর কিছু ‘আপত্তিকর’ ছবি দেয়া ছিল, যেগুলি দেখে আমার দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস হয়েছে, এ ষণ্ডা আকৃতির মেধাবী গর্দভ বড় হয়ে নিশ্চিতভাবেই পাষণ্ড প্রকৃতির একজন ‘ডাক্তার’ হবে। ও জাতীয় মেধায় প্রথম ২০ জনের মধ্যেই আছে এবং ঢাকা মেডিক্যালে পড়ার জন্য অপেক্ষা করছে। ওর কিছু ওয়ালপোস্ট দেখলাম। যে ছেলে ভুল করেও শুদ্ধভাবে বাংলা কিংবা ইংরেজি, এর কোনটাই লিখে না (ডাক্তার সাহেবকে ‘লিখতে পারে না’ বললে আবার না মানহানির মামলাটামলা ঠুকে দেন! অক্ষমের ‘অনর্জিত সম্মানবোধ’ আবার খুব তীব্র হয়।) সে ছেলে কোন যাদুতে এমন রেজাল্ট করতে পারে সেটা বুঝতে নাসার গবেষক হতে হয় না। এরকম উদাহরণ আরও অনেক আছে। এ ব্যাচের স্টুডেন্টরাই একদিন আপনার আমার কিংবা আমাদের কোন প্রিয় মানুষের ওপেন হার্ট সার্জারি করবে এবং ‘ভুলে’ দুএকটা ছুরিকাঁচি হার্টের মধ্যে যত্ন করে ফেলে রেখে সেলাই করে দেবে।

আমি বলছি না, এ ব্যাচের সবাইই অযোগ্য। আমি বলছি, একটা ত্রুটিপূর্ণ পরীক্ষাপদ্ধতি সব সফল পরীক্ষার্থীর মেধাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে দেয়। সম্প্রতি ৩৫তম বিসিএস পরীক্ষার প্রিলি আর রিটেন শেষ হয়ে গেল। নিয়োগপ্রক্রিয়ায় সরকারের কঠোরতা এবং আন্তরিকতার কারণে খুব সুষ্ঠুভাবে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ক্যান্ডিডেটরা পরীক্ষা দিয়েছে। ভাইভা পরীক্ষাও এরকমভাবে হলে, আমরা বিশ্বাস করি, ৩৫তম বিসিএস পরীক্ষায় যারা ক্যাডার হবেন, তাদের হেড অফিস অবশ্যই খালি নয়। ঝড়ে বক মরার মত করে ক্যাডার হবেন খুব কম ব্যক্তিই। কিন্তু গত মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে যারা যারা ভবিষ্যতে ডাক্তার হবেন, তাদের কাছে ফি দিয়ে দেখানো দূরে থাক, যদি তারা রোগীদের জন্য ফ্রি থাকাখাওয়ার ব্যবস্থাও করে দেন, সেক্ষেত্রেও কোন কোন সাহসী কৃপণ রোগী তাদের কাছ থেকে সেবাগ্রহণ করতে রাজি হবেন, সেটা সময়ই বলে দেবে। এখন তো আমাদের দেশের লোকজন মাথাব্যথার জন্যও ইন্ডিয়াতে ছোটেন, তখন নিশ্চিতভাবেই চুলে ব্যথা করলেও ইন্ডিয়াতে ছুটবেন; এবং ছোটাই উচিত!

পিএটিসি’তে একদিন ক্লাসে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের একজন অবসরপ্রাপ্ত সচিব মহোদয় খুব অসাধারণ একটা কথা বলেছিলেন : সরকারী চাকরি করার সবচাইতে বড় অসুবিধা হল এই যে, সরকারকে ইচ্ছেমত গালাগালি করা যায় না। যদি সরকারকে গালাগালিই করতে না পারলাম, তবে নাগরিক হয়ে লাভ কী?……….. অনেকদিন পর অনেক রাগ আর অভিমান থেকে স্যারের কথাটা হঠাৎ কেন জানি মনে পড়ে গেল।

ভাবনা: একশো পঁয়ত্রিশ।

……………………………………..

: ভাইয়া, একটা কথা বলার ছিল।

: দূর গিয়া মর। জ্বালাইস না।

: ভাইয়া, আসলেই জরুরি কথা। আপনার জন্য জরুরি।

: বলে ফ্যাল।

: আমি না আপনার জন্যে মেয়ে খুঁজা বন্ধ করে দিসি।

: অ।

: অ না ভাইয়া, আমি সিরিয়াস।

: খোঁজা শুরু করসিলি কবে?

: ভাইয়া, আসলেই করসিলাম। আল্লাহর কসম।

: খুব ভালো করসিস। এখন স্প্রাইট দিয়া ভিজাইয়া মুড়ি খা। আমি লিখতেসি। দূর হ।

: শুনেন না ভাইয়া, আমার সিক্সথ সেন্স বলতেসে, আপনার না জীবনেও বিয়ে হবে না।

: ছেলেদের বিয়ে হয় না গাধী, ছেলেরা বিয়ে করে।

: ও আচ্ছা, ওইরকম আরকি! আপনারে না কেউ বিয়ে করবে না, ভাইয়া। এটা কিন্তু একদম সত্যি কথা। আপনি দেইখেন।

: ক্যান? কী হইসে?

: আমি যাদেরকে আপনার কথা বলসি, সবাই বলসে, আপনি নাকি এই পুরা জগতের। আপনারে পার্সোনাল প্রোপার্টি বানানোর অধিকার কারো নাই।

: বুঝসি। তোকে আর মেয়ে দেখতে হবে না।

: ভাইয়া ভাইয়া, শুনেন না শুনেন না, আপনি বিয়ে করে ফেললে কতোজন মন খারাপ করবে। মানুষের মন খারাপ করে দিলে গুনাহ হয়, ভাইয়া।

: তোরে কোনো কাজ দিলে তো জীবনেও করিস না। ইউ আর জাস্ট গুড ফর নাথিং। জ্বালাইস না। তোর দৌড় কদ্দূর আমি বুঝে গেসি।

: এহহ! আপনারে বলসে! আপনার খালি মানুষকে পাম মেরে মেরে কাজ করানোর ধান্দা!

: তোরে কী পাম মারসি আমি?

: ক্যান? আমি আপনার লেখা পছন্দ করি বলে আপনি আমারে বলসেন যে আপনার সব লেখাগুলা কপি করে দিতে। আপনার চুল সুন্দর বললে কি আপনি মানুষকে চুল গুনে দিতে বলেন? নিজের কাজ নিজে করেন গিয়ে!

: চুপ থাক ফাজিল একটা! থাপ্পড় খাবি! তোরে কোনো কিসু করতে হবে না।

: থ্যাঙ্ক য়্যু ভাইয়া! আমার এক সুন্দরী বান্ধবীকে বলসিলাম আপনার কথা। আচ্ছা, ওকে না করে দিবো। কী আর করা! হিহি……….

(এরকম একটা ছোটো বোন থাকলে সকালবিকাল খালি তুলে আছাড় মারতে ইচ্ছা করে না? ছোটো বোনগুলা সব দুনিয়ার আকাইম্যা!! যতো বেশি কিউট, ততো বেশি আকাইম্যা।)

ভাবনা: একশো ছত্রিশ।

……………………………………..

আমরা যারা সপ্তাহের বাকি ৫টা দিন ভূতেরমতো ব্যস্ত থাকি, তাদেরকে ২টা ছুটির দিনে কিছু বলা যাবে না। এই যেমন………

এতোক্ষণ ঘুমুতে হয় নাকি?

নিজের রুমটা তো একটুঝাড়মোছ করতে পারিস।

কাপড়গুলো একটু গুছিয়ে রাখলে কী হয়?

কম্পিউটার টেবিলের ওপর ধুলো জমে গেছে, দেখিস না?

ঘরের টুকিটাকি কাজটাজও কাজ, না?

যা, বাজার থেকে এটা নিয়ে আয়, ওটা নিয়ে আয়।

সারাদিন কম্পিউটারে বসে কী করিস? পিঠ ব্যথা করে না!

সারাদিন শুধু মুভি দেখলে হবে?

এতো এতো বই পড়ে কী হবে?

জীবনে কী করলি?

কোনো কাজ নাই, খালি গান শোনা!

সারাদিন শুয়ে আছিস কেনো?

যা, স্নানটান করে আয়, খাবি না? যখন ইচ্ছা তখন স্নান করা, এটা কেমন বদভ্যাস?

কোনো কাজেরই কোনো ঠিক নাই, এরকম কেনো?

বন্ধ পেলেই খালি ঘুরতে যাওয়া, না?

কোনো কাজ নাই?

বিকেল হলেই প্রোগ্রামে যাওয়া। উনি সংস্কৃতিসেবক এসেছেন! ঢং!! (ঘুরতে যাবো না তো কি ঘরে বসে বসে ইয়া বড়োবড়ো ঘোড়ার ডিম পাড়বো?)

চুল কাটাবি কখন? দেবদাস হবি?

অকর্মার ধাড়ি একটা! ব্লা ব্লা ব্লা . . . . . .

এরকম আরো অনেক অনেক কিছু!!

প্রিয় সংগ্রামী ভাই ও বোনেরা, আসুন, আমরা মাজাতির এই সীমাহীন অন্যায়-অত্যাচার-অবিচার-এর বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে রুখে দাঁড়াই। এখনই!

আসুন, অলসতার জয়গান গাই। সময় ফুরোবোর আগেই জীবনটাতে একটু হলেও বাঁচি, নিজের মতো করে। (ইয়ে মানে, অন্তত রুখে দাঁড়ানোর ব্যাপারটাতে আর অলসতা না করি, কেমন?)

ভাবনা: একশো সাইত্রিশ।

……………………………………..

আমার ইনবক্সে শুধু বিসিএস আর ক্যারিয়ার নিয়ে কথা বলতে ভাল লাগে না। খুব-খুব বেশি বিরক্ত লাগে!! শুধু বিসিএস আর ক্যারিয়ার নিয়ে জানতে আমার বন্ধু হওয়ার কী দরকার? আমার সব কনটেন্টই তো পাবলিক-করা! একটু কষ্ট করে পড়ে নিলে কী হয়? আর বিসিএস পরীক্ষায় প্রথম হয়েছে, এমন কারো ফ্রেন্ডলিস্টে থাকলেই বিসিএস ক্যাডার হয়ে যাওয়া যাবে, এটা কোন আইনের বইতে লেখা আছে? আমি তো চাকরি পাওয়ার আগে কোন চাকরকে চোখেও দেখিনি অতো। তাতে কী হয়েছে? আমি চাকরি পাইনি? চাকর হইনি? আপনাকে কেউ যদি সারাক্ষণ ক্যারিয়ার নিয়ে জ্বালাত, আপনার কেমন লাগতো, একটু ভেবে দেখবেন? আমার ক্ষুদ্র সামর্থ্যে যতটুকু সম্ভব, ততটুকু তো করেই যাচ্ছি, তাই না? অনুপ্রেরণামূলক লেখালেখির চাইতে আমার বরং অন্যধরণের লেখা লিখতেই বেশি ভাল লাগে। ওগুলোই আমার বেশি প্রিয়। তবুও তো লিখি, না? এরপর আমাকে এমনকি গাইডবইয়ের নামও জিজ্ঞেস করতে হবে নাকি? অনেকে আবার কড়া-কড়া কথা লিখে দুর্ব্যবহারও করেন। এমন করেন কেন, ভাই? আমাকে দেখে কি একটুও মায়া হয় না? (কান্নার ইমো হপ্পে!)

বিশ্বাস করেন, আমিও একটা মানুষ!! আমার দিনও ২৪ ঘণ্টায়। জনসেবা করা আমার একমাত্র কাজ নয়! আমাকেও গান শুনতে হয়, মুভি দেখতে হয়, বই পড়তে হয়, সুন্দরীদের সাথে ফ্লার্ট করতে হয়। ইনবক্সে কোন সুন্দরীর ‘হাই-হ্যালো’ দেখলে আমিও খুব খুশি হয়ে লাফিয়ে উঠি; ঠিক আপনার মতোই! চুপিচুপি সুন্দরী মেয়েদের প্রোফাইলে ঢুকে-ঢুকে ওদের ছবি দেখি, আর ভাঙচুরটাইপের ক্রাশ খাই! আপনিও তো খানটান, নাকি খান না? না খেলে ডাক্তার দেখান; দ্রুত! আপনার মেসেজ আপনার জন্য যতটা গুরুত্বপূর্ণ, আমার জন্য ততটা হবে কেন? তবুও তো রিপ্লাই দিই, না? আপনার একটা সিলি মেসেজের জন্য আরেকজনের অনেক অনেক গুরুত্বপূর্ণ মেসেজ চলে যায় ১০০টা মেসেজের পর। আর আমার চোখেও পড়ে না। বলেন, এটা কি ঠিক? ইহা আমার পার্সোনাল প্রোফাইল, বিসিএস ফ্যাক্টরি নহে। আমি একজন অতি সাধারণ ফেসবুক ব্যবহারকারী, আমি কিছুতেই মোটিভেশনের মুরগি নই যে সারাক্ষণই মোটিভেশনাল ডিম পাড়ব।

ফেসবুকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আফসোস করে বলেছিলেন, এ জগতে, হায়, কে সুন্দরীর ভাইয়া হতে চায়?! আমিও চাই, পৃথিবীর কোনো সুন্দরীই আমাকে ‘ভাইয়া’ না ডাকুক। ডিয়ার সুন্দরী রমণীগণ, আপনাদের ঘরে কি বাপভাই নাই? তবু কেন ঘরের বাইরেও ভাই খুঁজে মরতে হবে? এমনিতেই সুন্দরী মেয়েদের কলিজায় কোনো হার্ট থাকে না, তার উপর সারাক্ষণই ভাইয়া ভাইয়া করলে কেমন লাগে বলেন? আপনিও তো এমন করেই ভাবেন, নাকি ভুল বললাম? আমি কিছুতেই হিপোক্রিট হতে পারি না বলে আরও অনেক পার্থিব সুখ, যা আমিও পেতে পারতাম, তা পাইনি। আমি যা বলার সরাসরি বলি। হিপোক্রিটদেরকে লাত্থি মেরে দূরে সরিয়ে দিই। পৃথিবীতে চলতে গেলে সবাইকেই লাগবে কোন দুঃখে? আমার কাছে পৃথিবীর সবচাইতে অশ্রাব্য গালিঃ হিপোক্রিট! Better to be a scoundrel than to be a hypocrite! আমি যা না, তা ভেবে প্লিজ আমার কাছে আসবেন না। সত্যি বলছি, হতাশ হবেন! আমি সেইন্টটাইপ কেউ না। আমি ভেতরে-ভেতরে ‘সত্যের মত বদমাশ’, একেবারে আদিমটাইপের! আমার জৈবিক অনুভূতিগুলো হুবহু আপনার মতোই। রাস্তায় ১০০ টাকা পড়ে থাকতে দেখে সেটির ওপরে ‘কেউ যাতে দেখে না ফেলে’ স্টাইলে খুব সন্তর্পণে দাঁড়িয়ে গিয়ে সুবিধামতো সেটিকে আপন করে নেয়ার মতন ছোটবেলার অভিজ্ঞতা নিয়ে আমিও বড় হয়েছি। আমারও বাথরুম পায়। মেজাজ খারাপ হলে আমারও ভাঙচুর করতে ইচ্ছে করে। কারো-কারো নাকে ঘুষি বসিয়ে দিতে ইচ্ছে করে, নিদেনপক্ষে ‘শুয়োরের বাচ্চা’ বলে গালাগালি করতে ইচ্ছে করে। আমি এলিয়েন না, ভাই। আপনার মতোই আমারও রাগ হয়, কষ্ট হয়। হাসিমুখে থাকি বলে খুব যে সুখে আছি, তা তো নয়। হয়তো বা পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর করে হাসতে-পারা মানুষটি পৃথিবীর সবচাইতে দুঃখী মানুষ। সবার মন ভাল করে দেয় যে, তার মনটা প্রায়ই খুব খারাপ হয়ে থাকে। আপনি তা কোনদিনও জানতেই পারবেন না। দিনের শেষে বাচ্চুকেই ঠিক মনে হয়…….আসলে কেউ সুখী নয়।

ভাবনা: একশো আটত্রিশ।

……………………………………..

হুমায়ূন আহমেদ একদিন স্কিন স্পেশালিস্টের কাছে গেছেন। উনার কথাতেই সেদিনের কথাটা বলি:

গোটা পঞ্চাশেক রোগী বসে আছেন। আমার নম্বর হলো একান্ন। বসে আছি তো বসেই আছি। একটু লজ্জা লজ্জাও লাগছে। কারণ ডাক্তারের বিশাল সাইনবোর্ডে লেখা—চর্ম ও যৌন রোগ বিশেষজ্ঞ। আমার কেবলই মনে হচ্ছে, সবাই বোধ হয় আমাকে শেষের রোগের রুগী বলেই ভাবছে।

ভাই, বলেন তো, এই জিনিস হুমায়ূন আহমেদ ছাড়া আর কে লিখতে পারতেন? আমাদের দেশে আর কে কবে লিখতে পেরেছেন, আমাকে একটু দেখান। যারা লেখক হুমায়ূনের পরিচয় ভুলে শাওনের স্বামী হুমায়ূনকে নিয়ে নাচানাচি করতে বেশি পছন্দ করেন, তাদের বলছি, বেশি চুলকানি হলে হয় জায়গামত পেভিসোন লাগান, কিংবা হুমায়ূন ১ রাতে যে নন্দিত নরকে লিখেছেন, সেরকম একটা নন্দিত নরকে লিখতে আপনাকে সহস্র এক আরব্য রজনী দেয়া হল। পারলে লিখেন দেখি এক লাইন! ফাজিল চুলকানিগোষ্ঠী!

আগে একটাসময়ে বাংলাদেশের লোকে শুধু পশ্চিমবঙ্গের সুনীল-সমরেশ-শীর্ষেন্দু পড়তো। হুমায়ূন ঘরের পাঠক ঘরে ফিরিয়ে এনেছেন। হুমায়ূন বাংলাদেশে পাঠকের সংখ্যা বাড়িয়েছেন, এই কথার উত্তরে উনি মজা করে বলেছেন—

আরেকটা ভুল কথা আমার সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে। আমি নাকি বইয়ের পাঠক বাড়িয়েছি। আমি কিন্তু পাঠক বাড়াইনি। পাঠক বাড়লে তো সবার বই-ই বেশি বিক্রি হতো। আমি শুধু নিজের পাঠকই বাড়িয়েছি। পাঠক যদি বাড়াতাম, তাহলে তো সব বইয়ের বিক্রি বাড়ত।

সত্যিই তো! আমাদের পাঠক যতোটা না বই পড়ে, তার চেয়ে বেশি হুমায়ূন আহমেদের বই পড়ে। জাপানি লোকজন যতোটা না বই পড়ে, তার চেয়ে বেশি হারুকি মুরাকামির বই পড়ে। হুমায়ূন আহমেদ সস্তা বাজারি লেখক, এক লেখকের এই কথার প্রতিক্রিয়ায় এক প্রকাশককে আমি টকশো’তে বলতে শুনেছি, “ভাই, হুমায়ূন আহমেদের বই ছাপাই বলেই তো আপনাদের মতো কিছু লেখকের বই ছাপিয়ে যে লসটা হয়, সেটা পুষিয়ে উঠতে পারি। নাহলে তো আপনাদের মতো লেখকদের বই ছাপানোর সাহসই করতাম না।” আমিও বলি, আমরা অনেকদিনই যতোটা না বাংলাদেশের খেলা দেখেছি, তার চেয়ে বেশি সাকিবের খেলা দেখেছি। আমাদের সৌভাগ্য, সাকিব আমাদের দেশের সন্তান।

আমাদের এই মুহূর্তে হুমায়ূনের মতো অন্তত একজন ফাজিল লেখক আর সাকিবের মতো আরো কিছু বেয়াদব প্লেয়ার বড্ডো বেশি দরকার।

পুরোনো কথাতেই ফিরে আসি, যা আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি:

যদ্যপি আমার গুরু শুঁড়িবাড়ি যায়,

তথাপি আমার গুরু নিত্যানন্দ রায়।

এই দুইলাইন খুব বিখ্যাত। আহমেদ ছফার ‘যদ্যপি আমার গুরু’ তো অনেকেই পড়েছেন। কিন্তু লাইন দুটি আসলে কার লেখা? আনন্দবাজার পত্রিকা থেকে উদ্ধৃত করছি:

‘যদ্যপি আমার গুরু শুঁড়িবাড়ি যায়/ তথাপি আমার গুরু নিত্যানন্দ রায়’। দু’লাইন উদ্ধৃত করে ‘উত্তরশুঁড়িদের’ উৎসর্গ করা হয়েছে সেই পুরাণটি। লেখক গোরা রায়। আপাত অপরিচিত এই ভবঘুরে লেখক সুরা নিয়ে গভীর তত্ত্বালোচনা খেলাচ্ছলে লুফে নিয়েছেন তাঁর দেশ-বিদেশের হরেক গল্পে। বোতল নিয়ে সেই আশ্চর্য বইয়ের নাম বোতল নয়, পাঁইট পুরাণ(বিভাব)। মুখবন্ধ-এ নিজের কথা লিখছেন লেখক, ‘গোরা রায়ের জন্ম ত্রেতাযুগে। প্রথাগত শিক্ষার বাইরে নানান বিষয়ে জ্ঞান আহরণ এবং বিনামূল্যে বিতরণই তার জীবনের উদ্দেশ্য।… ভূ-পর্যটক গোরা প্রমাণ করতে চান পৃথিবীর তিনভাগই জল।’ আর তা প্রমাণ করতে এক আশ্চর্য জলজ-দর্পণ রচনা করেছেন গোরা। পরিশেষে ওয়াইশবিয়ার থেকে স্কটিশ এল-সহ নানা পানীয় এবং চাট-তথ্য টীকাকারে। রাধাপ্রসাদ গুপ্ত ওরফে শাঁটুলবাবু-র যোগ্য উত্তরশুঁড়ি কি তবে এই বার বোতলমুক্ত হলেন? সঙ্গে বইটির প্রচ্ছদ। স্পেনের আলিকান্তের একটি শুঁড়িখানার ছাদের ফ্রেস্কো এবং বিভিন্ন বিয়ার কোম্পানির লেবেল, বিজ্ঞাপন ও বিয়ার-সংক্রান্ত কার্টুন ব্যবহার করে প্রচ্ছদটি নির্মাণ করেছেন সৌম্যেন পাল।

শ্রীম কথিত শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণকথামৃত-এর চতুর্বিংশ পরিচ্ছেদ ‘পিতা ধর্মঃ পিতা স্বর্গঃ পিতাহি পরমন্তপঃ’-তে পাই—

[গুরুকে ইষ্টবোধে পূজা — অসচ্চরিত্র হলেও গুরুত্যাগ নিষেধ]

গিরীন্দ্র — মহাশয়! বাপ-মা যদি কোন গুরুতর অপরাধ করে থাকেন, কোন ভয়ানক পাপ করে থাকেন?

শ্রীরামকৃষ্ণ — তা হোক। মা দ্বিচারিণী হলেও ত্যাগ করবে না। অমুক বাবুদের গুরুপত্নীর চরিত্র নষ্ট হওয়াতে তারা বললে যে ওঁর ছেলেকে গুরু করা যাক। আমি বললুম, সে কি গো! ওলকে ছেড়ে ওলের মুখী নেবে? নষ্ট হল তো কি? তুমি তাঁকে ইষ্ট বলে জেনো। ‘যদ্যপি আমার গুরু শুঁড়িবাড়ি যায়, তথাপি আমার গুরু নিত্যানন্দ রায়।’

অর্থাৎ, লাইন দুটো শ্রীরামকৃষ্ণের। পরবর্তীতে বিভিন্ন স্থানে ব্যবহার করা হয়েছে। অসচ্চরিত্র হলেও গুরুত্যাগ নিষেধ—বড় দামি কথা! তাইতো দেখি, মদ্যপ গুরু কমলকুমার মজুমদারের পায়ের কাছে একজন শিষ্য সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কীভাবে দিনের পর দিন পড়ে থাকেন। সৎ চরিত্রের মূর্খ অপেক্ষা অসৎ চরিত্রের পণ্ডিতের সাহচর্য উত্তম।

একটা ক্যুইজ দিয়ে শেষ করি: কেউ কি বলতে পারবেন টকশো’র ওই নাকউঁচা লেখকের নাম কী?

ভাবনা: একশো ঊনচল্লিশ।

……………………………………..

ভাইয়েরা, ‘মেয়ে পটানোর’ একটা ফ্রি বুদ্ধি দিই, কাজে লাগবে।

মেয়েদের অ্যাটেনশন পেতে চাইলে কাউকে ঈর্ষা যত কম করবেন ততই ভালো। একেবারেই না করে থাকতে পারলে আরও ভালো। আমার অল্প অভিজ্ঞতায় দেখেছি, ঈর্ষাপরায়ণ ছেলেদের মেয়েরা পছন্দ করে না। এর কারণ এ নয় যে, মেয়েরা ঈর্ষা জিনিসটা পছন্দ করে না; বরং এজন্য যে, ঈর্ষা জিনিসটা সম্পূর্ণই মেয়েলি একটা জিনিস। যে ছেলে ঈর্ষা কম করে, সে ছেলে নিজের যোগ্যতার উপর আস্থা রাখে। মেয়েরা আত্মবিশ্বাসী উদারমনের ছেলে পছন্দ করে। এরকম ছেলেরা সাধারণত মানসিক দিক দিয়ে দৃঢ় হয়, এদের আত্মবিশ্বাসও হয় প্রবল। অন্যকে সম্মান সে-ই করতে পারে, যে নিজে সে সম্মানটা পেয়ে এসেছে কিংবা পাওয়ার যোগ্যতা রাখে। অন্যকে ঈর্ষা করার মানেই হল, এটা মন থেকে বিশ্বাস করে ফেলা যে, সে নিজে কাজটা করতে পারবে না; এতে করে নিজের প্রতি ভালোবাসা আর সম্মান কমে যায়। যে নিজেকে সম্মান করতে জানে না, সে অন্যের সম্মানের জায়গাটাই ধরতে পারে না। যে ছেলে কিংবা মেয়ে কোনদিনও স্কুল-কলেজে ফার্স্ট-সেকেন্ড হতে পারেনি, সে নিশ্চয়ই ফার্স্ট-সেকেন্ড যারা হয়, তাদেরকে সহ্যই করতে পারে না। এই সহ্য না-করতে পারার ব্যাপারটা আস্তে আস্তে ওর রক্তে মিশে যায়। যখন সহ্য করতে পারে না এবং অসুস্থ ঈর্ষা দেখায়, তখন ওর আশেপাশের সবাই বুঝে ফেলে, ও একজন দুর্বল মানুষ। মেয়েরা বুদ্ধিমতী; ওরা তো বোঝেই! সভ্যতার সেই আদিলগ্ন থেকে শুরু করে এখনো পর্যন্ত মেয়েরা কখনোই দুর্বল মানুষ পছন্দ করে না। যার কাছে নিরাপত্তা পাবে না, তার কাছে একটা মেয়ে কেনই বা যাবে? যে অপরের সুখ সহ্য করতে পারে না, তার নিশ্চয়ই নিজের নিরাপত্তার অভাব রয়েছে। এরকম মেরুদণ্ডহীন ছেলেকে কোন মেয়ে ভালোবাসবে? ওকে বড়োজোর করুণা করা যায়, ভালোবাসা যায় না। যার মধ্যে উঠে দাঁড়ানোর শক্তি নেই, সে-ই কেবল উঠে-দাঁড়ানো মানুষের সামনে কিংবা পেছনে হামাগুড়ি দিতে-দিতে ঘেউ-ঘেউ করে চিৎকার করে। কুকুরের মতো চিৎকার করে তারাই, যাদের সিংহের মতো লড়াই করার ক্ষমতা নেই। এমন কুকুরস্বভাবের ছেলেকে কোন মেয়ে-ই বা ভালোবাসতে চাইবে? যে ছেলে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে না, সে ছেলে আরেকজনকে দাঁড়ানোর নিশ্চয়তা দেবে কীভাবে? ঈর্ষা করেই যার দিন কেটে যায়, সে নিজের দুর্বলতায় আত্মতুষ্ট। যে নিজের দুর্বলতাকে জয় করতে পারে না, সে পৃথিবীর মুখোমুখি হবে কীভাবে? মেয়েরা কিন্তু দেরিতে হলেও এসব বুজরুকি ধরে ফেলে।

আবারও বলছি, আপনি মেয়েদের সালওয়ার-কামিজ পরে ঘুরে বেড়ালে যেমন মেয়েরা আপনাকে পছন্দ করবে না, ঠিক তেমনি ‘মেয়েদের ঈর্ষা’ বুকে নিয়ে বেঁচে থাকলেও মেয়েরা আপনাকে পছন্দ করবে না। আমার নিজের কাছে অন্যের ভালকিছুতে ঈর্ষান্বিত ছেলেকে চুড়িপরা অবলা মেয়ের মতো লাগে। (আমি বলছি না, সব মেয়েই চুড়িপরা অবলা।) অসুস্থ ঈর্ষাপরায়ণ পুরুষমাত্রই দুর্বল; অতএব, মেয়েদের করুণার পাত্র।

ভাবনা: একশো চল্লিশ।

……………………………………..

: আপনার অনেক কথা একেবারেই আমার নিজের, আপনি ওগুলো লিখেন কেনো? লিখলেও বা সবাইকে বলেন কেনো? কিছু কষ্ট আমার নিজের থাক না! আপনি সবাইকে এখন থেকে ওগুলো আর দেবেন না। আমার কথা অন্যকে দিয়ে দেবেন কেনো আপনি? কোন অধিকারে?

: কী বলছেন এইসব? আপনার কষ্টের কথা কেনো আমি বলতে যাবো? আমি আমার অনুভূতির কথা লিখি।

: আপনার অনুভূতি? আপনি যদি আমার কষ্টের অনুভূতিগুলোকেও নিয়ে নেন, তবে আমি কী নিয়ে বাঁচবো? মানুষকে কিছু না কিছু নিয়ে তো বেঁচে থাকতে হয়। নাহলে মানুষ মরে যায়। আমি না হয় কষ্ট নিয়েই বাঁচি। সবাই আমার কাছ থেকে সবকিছু নিয়ে নিলো। হায়! দুঃখটুকুও রাখার যোগ্যতাও নেই আমার?

: আমার কোনো কথায় কষ্ট পেলে আমাকে ক্ষমা করে দেবেন।

(ভাবতে থাকলাম, হঠাৎ এ কী হলো আমার? ইদানীং কাউকে কিছু দিতে পারছি না, অথচ ঠিকই গুনেগুনে কষ্ট দিচ্ছি। নীলনীল রঙের দগদগে সব কষ্ট। কষ্ট পাওয়ার জন্যে বেঁচে থাকা যায়, কিন্তু কষ্ট দেয়ার জন্যে বেঁচে থাকা যায় নাকি?)

: না, আপনার কোনো দোষ নেই। কেউ আমায় কিছুই দিলো না; আপনি অন্তত কষ্টটুকু তো দিলেন। কিছু না পাওয়ার চেয়ে কষ্ট পাওয়াও ভালো। আমি ভালো কথা শুনলেও কষ্ট পাই, খারাপ কথা শুনলেও কষ্ট পাই; এতোই কষ্ট, এখন তো আর কাঁদতে পর্যন্ত ইচ্ছে করে না। কাঁদতে না পারলে, কষ্ট আরো বাড়ে, বাড়তেই থাকে।

এইটুকু বলেই মেয়েটা ঝরঝর করে কাঁদতে লাগলো। প্রকৃতি এমনই নির্মম, যাদেরকে মন খারাপ করে থাকলে একটুও মানায় না, তাদেরকে পৃথিবীর সব কষ্ট দিয়ে রাখে। আমি ওই মুহূর্তে ঠিক বুঝতে পারছিলাম না, কী বললে মানুষের কষ্ট কমে। সহ্য হচ্ছে না, অথচ ওর জন্যে কিছুই করতে পারছি না; এতোটাই নিথর বোবা হয়ে রইলাম। মাঝে-মাঝে এমনকিছু মুহূর্ত আসে, যখন কাছের মানুষ বুকে জড়িয়ে ধরলে সেটা পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ভাষার চেয়েও অনেকবেশি শান্তি দেয়। যখন শূন্যতা লেপ্টে থাকে ভাবনার সমস্ত গা জুড়ে, হাত বাড়ালেও কেউ এসে ধরে না, তখন খুব কান্না পায়। তবুও কাঁদতে ইচ্ছে করে না। যে অশ্রুর মৃত্যু অর্থহীন, সে বুঝি জন্মেই শুকিয়ে যায়।

সবচেয়ে কাছের, সবচেয়ে আপন, কিংবা ভালোবাসার মানুষগুলোর সাথেই আসলে আমরা সবচেয়ে খারাপ ব্যবহারটা করি বড় স্বাচ্ছন্দ্যে। খুব বেশি অবহেলায় ওদের অস্তিত্বকে বাঁচিয়ে রাখি। তারা আমাদের সবসময়ই ভালোবাসার এমন এক বিশাল সমুদ্রে মুড়িয়ে রাখেন, আমরা নিশ্চিন্তে ধরেই নিই এর জল কখনোই শুকানোর নয়। তাদের এক সাগর নিখাদ ভালোবাসার বিনিময়ে আমরা যেন তাদেরকে এক আকাশ নিরেট কষ্ট ফেরত দিই, দিতেই থাকি।

অদৃশ্যে যেহেতু কিছুই নেই, সেহেতু সেখানে সকল দৃশ্যমান সম্পর্কের অস্তিত্বমাত্রই শূন্য, ঠুনকো, একেবারেই অর্থহীন। এমন ফাঁকা সম্পর্কের দেনাপাওনার হিসেবটাও ফাঁকাই থেকে যায় শেষ পর্যন্ত। যে সম্পর্কের আগাগোড়া সমস্তটাই একেবারে মিথ্যে দিয়ে গড়া, সে সম্পর্কে জড়িয়েথাকা দুজনের কেউ অন্যকে সত্যি করে কিছুই দেয় না; ব্যাপারটা ওদের চেয়ে ভাল করে আর কেউই বোঝে না।

কোনদিনও একটা ‘ডট’ও ওরা কেউ কাউকে লিখে পাঠায় না, ভুল করে কেউ কারো জন্য একটা নিঃশ্বাসও ফেলে না। ওরা দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকে, অথচ কেউ কাউকে দেখে না; ওরা বকে যায়, অথচ ওদের মধ্যে একটা কথাও হয় না। এও জীবন?

ওদের দুজনের সমস্ত অস্তিত্বজুড়ে পরস্পরের কাছ থেকে কেবল একটি কথাই বারবার সঞ্চরিত হয়—আর কত!

এই দুইটি শব্দে ভর করে কতবার যে ওরা মরে গেছে, মরে যাচ্ছে, সে হিসেব দুজন ছাড়া আর কেউই জানে না। জানবেও না কোনোদিনই।

অনেক ঝড়তুফানেও টিকে থাকা যায়, কিন্তু যে ভিতটার উপর মানুষ দাঁড়িয়ে থাকে, সেটাই যদি সরে যায়…….

রাগ হয়; কখনো কখনো কষ্ট। কেউ বাঁচে রাগে, কেউ বাঁচে কষ্টে, কেউবা বাঁচে রাগষ্টে।

পুনশ্চ। রাগ+কষ্ট=রাগষ্ট। মাত্র বানালাম।