ভাবনাদেয়ালের পলেস্তারা (৩য় অংশ)

ভাবনা: পনেরো।

…………………………

আজকাল দিনগুলো কাটে—খুন করে-করে। আমার মধ্যে, আমি, প্রচণ্ডভাবে, শুধুই ‘আমি’ হয়ে যাচ্ছি দিনদিন। বাকিরা, হয় অনাহূত, নতুবা বহিরাগত হয়ে ধরা দেয় প্রায়ই। যারা ছিল, ওদেরকে, ‘নেই’ করে ফেলি প্রতি মুহূর্তেই। অমন নির্দয়, খুনিরাও হয় না। রোজ যেমনি একজন কাছের মানুষকে মেরে ফেলি, তেমনি প্রায়শই, তাদের কারো একজনের মধ্যে টুক্ করে ঢুকে পড়ি। কখনো-কখনো, সরাসরি নয়, ভায়া হয়ে যাই—কেননা, কেউ-কেউ, ঠেলে সরিয়ে দিতে, এতোটাই ভাল পারে, সরাসরি যাওয়ার সাহসটাই হয় না। দূর পরদেশের চেনাঅচেনা রাস্তায় রাস্তায়, আনমনে হেঁটে বেড়াই। অচেনা রাস্তায় হাঁটলে, নিজেকে এতো যে হাল্কা লাগে! হাত-পা ছুঁড়ে-ছুঁড়ে, দুলতে-দুলতে হাঁটি। দোকানের সামনে গিয়ে-গিয়ে, ম্যানিকুইনগুলোকে ভেংচি কাটি। অচেনা কারো সাথে কথা বলতে গেলে, শরীরে মনে অসীম সংকোচহীনতা এসে ভর করে। কারো-কারো সাথে, হারিয়ে যেতে পর্যন্ত ইচ্ছে করে! অলস অবসরে, বা কাজের ফাঁকে, যখন মনে আসে, কতদিন দেখা হয় না প্রিয়জনদের সাথে, কষ্টে মনটা হুহু করে কেঁদে ওঠে। আবার পরক্ষণেই, হেসে ফেলি এটা ভেবে, আমার এমন কষ্টের বিনিময়েই তো ওরা ভাল আছে। এই পরবাসী জীবনের ছোটোবড় কত ঘটনা আড়াল করি ওদের কাছ থেকে, ওরা কষ্ট পাবে বলে। আবার ভয়ও হয়, না জানি ওরাও, কত কিছুই আমাকে জানায় না, এই দূরদেশে আমি কষ্ট পাব বলে। হাসির নিপুণ অভিনয়ে, কত-কত কান্না আড়াল হয়ে যায়। আমিও সব বুঝি, ওরাও সব বোঝে। অথচ, দুই পক্ষই এটা বিশ্বাস করে খুশি হয়ে উঠি—অভিনয়ে কোনো ভুল হয়নি। পরদেশে শুধু কাজ আর কাজ। সারাদিনের পরিশ্রম শেষে ঘরে ফিরে কোন প্রিয়মুখ চোখে পড়ে না, যাকে দেখে ক্লান্তি দূর করা যায়। ঘরে ফেরার পর, যাকে ‘তোমাকে এতো ক্লান্ত দেখাচ্ছে কেন?’ বলার মতো কেউ নেই, তার চাইতে দুঃখী আর হয় না। তবু, বেঁচে থাকতে হয়—নিজের জন্য, দেশে ফেলেআসা প্রিয় মানুষগুলোর জন্য। এক চোখের জলই, যত্ন করে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। এই পরবাসে, আর কেউই পাশে এসে পরম মমতায় হাত বুলিয়ে দেয় না—চোখের জল তাই, ভাল বন্ধুটির চাইতেও বিশ্বস্ত। কখনো, স্বপ্নে বাবা এসে পরম মমতায় মাথায় হাত রেখে বলে, “কষ্ট হচ্ছে নাতো, বাবা?” ধড়ফড় করে ঘুম ভেঙে যায়। বালিশে মুখ গুঁজে চিৎকার করে ‘বাবা বাবা’ বলে কাঁদি। কোত্থেকে যেন ছোটোবোনটা পাশে এসে হাত ধরে বলে, “ভাইয়া, ঘুমো। কালকে ভোরে উঠতে হবে তো!” কিছু বলতে পারি না, শুধু, ওর দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি। এখানে, ইচ্ছে হলেই, প্রাণখুলে ইচ্ছেরা নিঃশ্বাস নিতে পারে না। আমার হৃদয়ে চোখে ইচ্ছেতে কে যেন মুহূর্তে-মুহূর্তে শেকল পরিয়ে দেয়! পরাধীনতা বড় ভয়ংকর জিনিস! প্যারিসের চাকচিক্য, আধুনিকতা, বিলাস—কেবলই চোখে চাখা যায়, উপভোগ করা যায় না—অত টাকা আছে নাকি? আমি আমার মতো করে হাওয়ায় পয়সা উড়িয়ে ভাল থাকলে, যারা আমার দিকে তাকিয়ে আছে, ওরা বাঁচবে কীকরে? উপভোগের ইচ্ছেটাকেও আস্তে-আস্তে গলাটিপে মেরে ফেলতে শিখে গেছি। মায়ের হাতের রান্না খাওয়া হয় না কতদিন! ঘন মসুরের ডালটা মা বড় ভাল রান্না করে, সাথে, বোনের ঘিয়েভাজা বেগুনভাজি। আহা, একটু খেতে পারতাম! খেতে বসলেই, খাবারটা কোনোরকমে গিলে ফেলি। আলাদা খাবারের আলাদা স্বাদ—এখন আর পাই না। অনেকগুলো প্রিয় মানুষের সাথে একসাথে বসে আড্ডা হয় না কতদিন! পুরোনো বন্ধুদের মনে হতে থাকে—পৃথিবীর সেরা মানুষ, নিজের শহরের গরীব রাস্তাটাকেও বারবার ছুঁতে ইচ্ছে করে। কাঁদতে-কাঁদতে বুকে ব্যথা ওঠে, সারাদিনের পরিশ্রমে শরীরটা প্রায়ই আর চলতে চায় না। টেনে-টেনে, হিঁচড়ে-হিঁচড়ে শরীরটাকে চালাই, কাজ করাই, বোঝাই—এখানে বসে থাকতে আসিনি। অসুস্থতা জেঁকে বসতে চায়, হঠাৎ, নড়েচড়ে বসি—না না, যে করেই হোক, আমাকে তো সুস্থ থাকতেই হবে—আমার নিজের জন্য না হোক, আমার আপনদের জন্য হলেও। ওরা কত নির্ভরতায় আমাকে মনে করে। তাছাড়া, এই পরদেশে অসুস্থ হলে আমার সেবা করবেই বা কে? ডাক্তারের অত এক্সট্রা খরচ, সেও তো কম কথা নয়। আমি সে বাড়তি টাকা পাবো কোথায়? আমাকে যে সুস্থ থাকতেই হবে! ক্যুরিয়ার অফিসে পৌঁছে দেয়ার আগে, লাগেজভর্তি জিনিসপত্রগুলোতে, একটু বেশি করেই হাতটা ছুঁইয়ে-ছুঁইয়ে দিই—জানি, আমার হাতের স্পর্শ আছে ভেবে, ওরা বারবার এগুলোতে হাত বোলাবে। আমিও ধরে নেবো, দেশে ফিরে ওদের হাত ছুঁচ্ছি। মা যখন প্রতিবার ফোনটা রাখার সময় আদর করে চুমু খায়, তখন সমস্ত দূরত্বই আমার অনুভূতির কাছে হার মানে, মুখ থুবড়ে থাকে। মনে হতে থাকে, এইতো মা! আমাকে আদর করছে, মায়ের চোখটা নাচছে আমার দিকে তাকিয়ে-তাকিয়ে। অমন নিবিড় স্পর্শের জন্য প্রতিদিন বেঁচে থাকা যায়। মায়ের জন্য কেনা জিনিসগুলো, আলাদা করে সরিয়ে নিয়ে, বারবার চুমু খেতে থাকি, চোখে ছোঁয়াই। শপিংয়ের সময়, হঠাৎ কোনো মেয়েকে দেখে, আদরের ছোটবোনটার মতো মনে হয়। ইচ্ছে হয়, ওয়ালেটের সবকটা ইউরো খরচ করে ওকে অনেককিছু কিনে দিই। আচ্ছা, ও কি হারমোনিকা বাজায়? কিনে দিলে, নেবে? ভাবতে-ভাবতেই, ঝাপসা চোখ আর মানুষের ভিড়ে, মেয়েটি কোথায় যেন হারিয়ে যায়। কষ্টমাখা প্রবাসী দিনগুলো ফুরোয় ভেজা লোনারাতের নৈঃশব্দ্যে। এরকম আরো অনেককিছু ভাবতে-ভাবতে আমার দম আটকে আসে। আর পারি না! সত্যি-সত্যি চোখ ভিজে ওঠে…….

দ্রুত আমি আমার নিজেতে ফিরে আসি। একটা বড় নিঃশ্বাস নিই। আমি সেখানে নেই, এই আমি এইখানে! এই বেশ ভাল আছি!—এটা মনে আনতে বড় ভাল লাগে। অন্যকেউ হয়ে, ওর জীবনটাতে ঘুরে আসার মধ্যে এক ধরনের অসীম আনন্দ আছে। একেকজনের জীবন একেক স্বাদের। নানান জীবনের নানান বৈচিত্র্য নানান সময়ে নানান রঙ ধরে। নিজের জীবনটাতে বাঁচতে-বাঁচতে হাঁপিয়ে উঠলে, অন্যের জীবনটাতে একটুখানি ঘুরে তো আসাই যায়, না? আমি তো আর কাউকে কোনো বিরক্ত করছি না! এতে কত্তো লাভ! নানান দেশ, নানান সময়, নানান প্রেক্ষাপট, নানান ঘটনা, নানান জীবন—সবকিছুতেই আমি আমার মতো করে, নিজের নিয়মে থেকে যেতে পারি, যতক্ষণ খুশি! বেশি সুখ পেয়ে যাচ্ছি—কখনো এমন অনুভূতি জাগলে, নরকে গিয়েও ঢুঁ মেরে আসতে ভাল লাগে। আমি না, ইদানিং আর বোরড্ হই না! মনের যাতায়াতের তো কোনো পাসপোর্ট লাগে না, পারমিশন নিতে হয় না, টিকেটের খরচ নেই, থাকাখাওয়ার চিন্তা নেই—স্রেফ চলে গেলেই হয়, যেখানে খুশি—শুধু ইচ্ছেটা লাগে। চলে যাই, ফিরে আসি—যখন, যেভাবে খুশি।

ভাবনা: ষোলো।

…………………………

একজন ‘সে’ থাকলে, বলতাম—

“হ্যালো! শুন না, আজ না রান্নায় মন নেই…….তুমি বাসায় ফিরতে কিছু নিয়ে আসবে?”

ওর মন ভাল থাকলে বলতো—

“সেকি! আমি আসতে-আসতে তো সন্ধের পর হয়ে যাবে। এতক্ষণ না খেয়ে থাকবে নাকি!?”

আর মেজাজ খারাপ থাকলে বলবে—

“’তোমার রান্না করতে কবে ভাল লাগে বলতো?”

(আমি তো জানি, ও জানে—ওর প্রিয় কতকিছু, আমি ওকে রান্না করে খাওয়াই। এই যে এসব বলছে, এটা তো শুধু ওর মেজাজটা এখন খারাপ বলে। নাহয় কি ও এভাবে আমার সাথে কথা বলতো কখনো? আমি তো সবই বুঝি!)

আমার মনটা ভাল হলে বলবো………

“সন্ধে হলেও সমস্যা নেই—তুমি আস, একসাথে খাবো। এর মাঝে আমি কিছু একটা খেয়ে নেবো।”

আর মেজাজ খারাপ হলে বলবো……..

“রান্না করতে আমার কবে ভাল লাগে মানে? কী বলতে চাও তুমি? সরাসরি বল। রান্না করতে ভাল লাগুক না লাগুক—তবুও তো প্রতিদিনই রান্না করি, নাকি করি না?……. ব্লা ব্লা ব্লা………”

(কেন বলবো? ওই যে আমার মেজাজ খারাপ, তাই! আমি আমার স্বামীর সাথে মেজাজ দেখাবো নাতো কি আমার বান্ধবীর স্বামীর সাথে মেজাজ দেখাবো? একশোবার দেখাবো, হাজারবার দেখাবো। বিয়ে তো করেইছি ঝগড়া করার জন্য। যার বিয়ে হয়েছে, অথচ, ঝগড়া করার কেউ নেই, তার তো সত্যিকারের বিয়ে হয়ইনি!)

ভাবনা: সতেরো।

…………………………

ধরুন, চৈত্রের প্রখর রোদ। তাপমাত্রা চরমে। একফোঁটা পানি, সাম্রাজ্যের চাইতেও বড়। ফেসবুকের অনেক পেইজে পাখিদের জন্য ছাদে বা বারান্দায় পানি রাখার আহবান—পাখিরা একটু শান্তি পাক্‌।

ঝিলম কোনো পেইজেই লাইক, শেয়ার, কমেন্ট করেনি, শুধু, পাখিদের জন্য বারান্দায় আর ছাদে রোজ পানি রেখে দিয়েছে। কিছু পাখি পানি খেয়েছে, ওদের মধ্যে চড়ুইই বেশি। তা দেখে ঝিলমের সে কী শান্তি!

এমন পোস্ট যারা দিয়েছিল, তাদের পরিচিত কয়েকজনকে ও চেনে। আড্ডা দেয়ার সময়, কথাপ্রসঙ্গে ওরা বলছিল, “সবাইকে পানি রাখতে বলে ওরা, অথচ, নিজেরাই পানি রাখে না পাখিদের জন্য। যতোসব ভণ্ডের দল!” ওরা পোস্ট হাঁকায়, কিন্তু সে কাজটা নিজেরা কেন করে না—এ নিয়ে অনেকেই অনেক কটুকথা বলেছে আড্ডায়। ঝিলম কিছুই বলেনি। ওর মনে এল, পাখিদের জন্য কিছু করা দরকার ছিল। ওরা তো সেটা করেছেই। নিজেরা পানি রাখলে যতো পাখি পানি পেত, সবাইকে সেটা করতে অনুরোধ করায় আরও বেশি পাখি পানি পেয়েছে। এটাও তো এক ধরনের ভাল কাজ। আপনি আচরি ধর্ম শিখাও অপরে—এ বাক্যটা ওরা মানেনি, কিন্তু ধর্মটা তো অনেককেই পালন করতে উদ্বুদ্ধ করেছে। এও বা কম কীসে?

মানছি, আমি পানি রাখলে, ভাল হতো। আমি রাখিনি ঠিকই, তবে, আমি আরও ১০ জনকে দিয়ে পানি রাখিয়েছি—এতে পাখিদের আরও বেশি সুবিধে হলো না? আপনাকে বলছি, আমি যা করেছি, আপনি সেটা করতে পারতেন? সে ক্ষমতা বা ইচ্ছে আপনার আছে? আমি যা করিনি, আপনি সেটা করেছেন, এবং সেটা শুধু আপনিই করেছেন, আপনি আর কাউকেই সেটা করাতে পারেননি। মোট হিসেবে, কাজটি বেশি করল কে? আপনি? নাকি, আমি?

আপনাকে বলছি, একদম চুপ করে থাকুন। আপনি জানেন, আপনি কী করতে পারেন। আপনি জানেন না, আমি কী করতে পারি। আমি নিজেই তা জানি না, আপনি জানবেন কোত্থেকে? আপনি আমাকে থামিয়ে দিলে আপনার আমার কিছু এসে যাবে না, কিন্তু অনেকেরই ক্ষতি হয়ে যাবে। আপনি সেটা বুঝবেন না, অতএব, চুপ করে থাকুন—নিজে যা করতে পারছেন না, তা আমাকে করতে দিন।

কেউ করে—একাই।

কেউ করায়—দশজনকে দিয়ে।

লাভ বেশি কোনটাতে?

আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক চুয়েটে পড়ার সুযোগ পাননি। সে না পাওয়ার জেদ থেকে উনি হাজার-হাজার স্টুডেন্টকে ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার প্রেরণা আর সাহস যুগিয়েছেন। উনার অনেক স্টুডেন্টই ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে, যারা কখনো ভাবতেও পারেনি, ওরা জীবনে তেমন কিছু করতে পারবে।

আমার কাকা চুয়েটে পড়েছেন। এরপর নিজে ভাল চাকরি করে নিজেকে, নিজের ফ্যামিলিকে, আর অবশ্যই, দেশকে অনেককিছু দিয়েছেন, দিচ্ছেন, আশা করছি, দেবেনও। উনাকে দেখে হয়তো দুইএকজন অনুপ্রাণিত হয়ে থাকবে, এর বেশি নয়। সে দুএকজনও নিজেদের তাগিদে উনাকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছে, উনি নিজ থেকে ওদেরকে অনুপ্রেরণা দেননি।

সমাজের প্রতি, দেশের প্রতি, সর্বোপরি মানুষের প্রতি কার অবদান বেশি? আমার শিক্ষকের? নাকি, আমার কাকার? কে অধিক সম্মানের দাবিদার?

অভিযোগ করে কী হয়? সবাইকেই প্রত্যক্ষভাবে কোনো কাজে অংশ নিতেই হবে কেন? আমরা যারা অভিযোগ করছি, আমরা কয়জনকে দিয়ে কাজটা করাতে পারি? বিজলি বাতির নিজেরই আলো আছে, তা দিয়ে সে আলোকিত করে। চাঁদের নিজের আলো নেই, সেও আলোকিত করে। কার ক্ষমতা, প্রভাব আর অবদান বেশি? আপনারা বুদ্ধিমান, জ্ঞানী। আপনারা বিচার করুন।

কেউ-কেউ থাকেন সরবে।

কেউ-কেউবা, নীরবে।

কেউ-কেউ থাকেন স্বশরীরে।

কেউ-কেউবা, অশরীরে।

…….থাকলেই তো হলো, তাই না?

সকলের মিলিত গানে, কল্যাণের সুর ভাসুক—এটাই আমাদের প্রার্থনা।

ভাবনা: আঠারো।

…………………………

প্রত্যেক মা-ই ননস্টপ ঘ্যানরঘ্যানর করে যাওয়ার অসীম প্রতিভা নিয়ে পৃথিবীতে আসেন। এ কাজে কোনো যুক্তি লাগে না, কোনো কারণ লাগে না, জাস্ট ঘ্যানরঘ্যানর করার সদিচ্ছাটা লাগে। যথারীতি, অনেকক্ষণ ধরেই, মা পুরোনো কিছু বিষয় নিয়ে ঘ্যানরঘ্যানর করেই যাচ্ছেন। যা নিয়ে কথা বলে কোনো লাভই নেই, মা জাতীয় প্রাণীদের, তা নিয়ে কথা বলার ধৈর্য আর উৎসাহ, দুটোই এপিক লেভের। এমনকি, প্রিয় টিভিসিরিয়ালের প্রিয় মেয়েটা অকারণে বকা খেলেও, সব রাগ এসে পড়ে নিরীহ এই আমার উপর।

মা প্রায়ই, যত্নেরাখা উনার কিছু কষ্টকে ঝেড়েমুছে পরিস্কার করেন। কষ্টগুলো ধুলোমুক্ত হয়ে ঝকঝকে তকতকে হয়—আর ওই ধুলোগুলো ফুল ফ্যামিলিসহ এসে পড়ে আমার ধৈর্যের ঘাড়ে। মা’র এইসব ক্যাচালের তন্নিষ্ট শ্রোতা—একমাত্র আমিই। আপুর বিয়ে হয়ে গেছে, শোনার আর কেউই নেই। এই কারণে, অনেকসময় চুপচাপ শুনে যাই, আবার কখনো-কখনো নিজেই ক্যাচাল শুরু করে দিই! অনেকক্ষণ মা’র বকরবকর পকরপকর শোনার পর রেগেমেগে বললাম, “আপনি আসলেই একটা বদের মা!” “কী! আমার মা বদ!? আমার মতো মেয়ে বলে সব সহ্য করে এই ফ্যামিলিতে মুখগুঁজে পড়ে আছি। তোদের…..তোদের চৌদ্দ গুষ্ঠি…….বকরবকর পকরপকর বকরবকর…….!!” মেয়েরা যা ভুল শোনে, তাতে রিঅ্যাক্ট করে কয়েকগুণ বেশি; কারণ ওরা বেছে-বেছে এমনকিছুই শোনে, যেটাতে খুব সহজেই তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠার সুযোগ সবচাইতে বেশি।

কাজ হইসে! মিশন সাকসেসফুল!! ইয়েসসস্‌!!! মা রেগে ছিলেন বলে খেয়ালই করেননি, আমি মা’কে ‘বদের বেটি’ বলি নাই, ‘বদের মা’ বলেছি, মানে, আমি আসলে, নিজেকেই বদ বলেছি! উনার মাথা ঠিক ছিল না, তাই, উনি ধরেই নিয়েছেন, উনার মাকে আমি বদ বলেছি! নারীমনের যাবতীয় চিরন্তন ক্যাচালপিপাসা মিটিয়ে, অনেকক্ষণ পর, মাথা ঠাণ্ডা হলে, মা জিজ্ঞেস করলেন, “অই, তুই কি তখন আমাকে ‘বদের মা’ বলসিলি? নাকি, ‘বদের বেটি’ বলসিলি?” “কেন, বদের মা বলসি!” স্বাভাবিকের চাইতে শীতল কণ্ঠে বললাম। “অইইইইই…….তুই আমার সাথে বিটলামি করস!? তোর সাহস তো কম না!” ব্যস্‌! আবার শুরু হয়ে গেল!! বকরবকর পকরপকর বকরবকর পকরপকর………..!!! এ কাজে পৃথিবীর কোনো মেয়েই কোনোদিন ক্লান্ত হয়নি। মাও হলো না। আমার জায়গায় আমার লক্ষ্মী আপুটা থাকলে অবশ্য, কায়দাটায়দা করে, মাকে অনেক আগেই শান্ত করে ফেলত। কিছু-কিছু মেয়ে, মানুষকে শান্ত করে দেয়ার অদ্ভুত ক্ষমতা রাখে—আমার আপুও ওরকম টাইপের। ‘শয়তান আমি ভার্সাস্‌ আমার লক্ষ্মী আপু’র একটা নমুনা দিই।

একজনকে জরুরি প্রয়োজনে ফোন দেয়ার কয়েক ঘণ্টা পর তার কলব্যাক…….তুমি আমাকে ফোন দিসো, মেজাজ খারাপ কইরা ফেলসো বাল—আমি পরীক্ষা দিচ্ছিলাম, আর এর মধ্যে রিং বাইজা উঠসে! বুঝো কিসু? তুমি একটা পুরাই ফালতু……. ব্লা ব্লা ব্লা…….

আমার আপু হলে বলতো:

ওহ্‌, আমি সত্যিই খুব লজ্জিত। কাজটা আসলেই খুব খারাপ হলো। আমার জন্য তোমাকে ওরকম একটা পরিস্থিতিতে পড়তে হলো। নেক্সট টাইম আর হবে না। প্লিজ প্লিজ, তুমি কিছু মনে কোরো না। আমি রিয়েলি সরি…….!

আমি অলরেডি যা বলে দিয়েছি:

অই বাল, আমি কি তোমার মাথায় সিসি ক্যামেরা লাগাই রাখসি যে, তুমি পরীক্ষা দাও, না হাগোমুতো করো, সব দেখতে পাই!? শালার ফাউল এক্খান! আর কী বালের পরীক্ষা দাও ফোনের রিংটোন অফ্‌ না কইরা? আজাইরা যত্তোসব! শুনো, তোমার সাথে কোনো পিরিতের আলাপ চোদাইতে ফোন দিই নাই। যাক্‌, যেইজন্য ফোন দিসিলাম…….ব্লা ব্লা ব্লা…….

ভাবনা: উনিশ।

………………………….

ডাক্তারসাহেব একটু রাগি, চোখের দিকে তাকালেও বুকের ভেতরের তাপমাত্রা অনেকখানি নেমে আসে। অনেক অভিজ্ঞ, একটু বকেনটকেন, তবে, মানুষ ভাল। ভাল ডেন্টিস্ট হিসেবে খ্যাতি আছে।

বুঝলে, আমার বয়সিরা সবাই তো ওইপারে, আমি এখনো করে খাচ্ছি।

জ্বি স্যার, ঠিক।

ঠিক মানে? তুমি কি সবকিছুতেই ঠিক-ঠিক কর নাকি? সেই কখন থেকে আমার সবকিছুতে অ্যাগ্রি করে যাচ্ছ!

না স্যার, আপনার কথা ভাল লাগছে। তার উপর, আমার দাঁতের ভবিষ্যৎ এখন আপনার হাতে। আপনার সাথে ডিসঅ্যাগ্রি করাটা ঠিক হবে না, স্যার।

হাহাহাহা……ভাল বলেছ। আমার প্র্যাকটিসিং পিরিয়ড তোমার বয়সের দেড়গুণ। কী বুঝলে?

জ্বি স্যার, বুঝেছি।

বুঝেছি মানে কী? কী বুঝেছ?

আপনি অনেকদিন ধরেই দাঁতের সাথে আছেন।

ইন্টিলিজেন্ট!! আমি তো সরকারি লোকজনকে স্টুপিড ভাবতাম! হাহাহাহাহা………

সরি স্যার, ভুল হয়ে গেছে। আমি এখন থেকে স্টুপিড হওয়ার চেষ্টা করবো।

তুমি আমার সাথে ফাজলামো কর? জানো, আমার ছেলের বয়স তোমার চাইতে বেশি। মেয়ে তোমার এইজের হতে পারে। দুজনই ডেন্টিস্ট। আমার ওয়াইফ ও ডেন্টিস্ট, বিয়ের পর আমি প্র্যাকটিস করতে দিই নাই।

শুনে খুব খুশি হলাম স্যার।

কী শুনে?

আপনার ফুল ফ্যামিলিই দাঁতাল।

হাহ্‌ হাহ্‌ হাহ্‌………ইয়াংম্যান, আই অ্যাপ্রিশিয়েট ইয়োর সেন্স অব হিউমার! তুমি পাবনায় আসলে আমার সাথে গল্প করতে চলে এসো।

স্যার, ইজ ইট অ্যান ইনভাইটেশন? অর অ্যা চ্যালেঞ্জ?

বোথ্‌!! হাহাহাহা………দেখি হাঁ কর। হাঁআআআআআ………..

আর কথা বাড়ালাম না। বাধ্য ছেলের মতো যা যা করতে বললেন, করলাম। আহা, কোনো এক ডেন্টিস্টের হাতে জোওওরে একটা কামড় দিতে পারতাম, জীবনটা ধন্য হয়ে যেত! চোয়ালে এতো ব্যথা করে হাঁ করে থাকার সময়! ডেন্টিস্ট বোঝেন না, মুখ বন্ধ করতে দেন না। শুধুই প্রতিশোধ নিতে ইচ্ছা করে শুধুই প্রতিশোধ নিতে ইচ্ছা করে …………. এ জীবনে কোনো ডেন্টিস্ট কামড়াতে না পারলে বেঁচে থেকে কী লাভ? ঘেউঁউঁউঁউঁ…….

ভাবনা: বিশ।

……………………..

এই বেকার ‘আমি’টারও যখন, মাঝে-মাঝে একটু ইনকামটিনকাম করতে ইচ্ছে করে, তখন ৩০ টাকার রিকশাভাড়ার দূরত্বে, রিকশা না নিয়ে হাঁটা দিই – – – a penny saved is a penny earned নিয়মে, টাকা বাঁচানোটাকেই ইনকাম ধরে নিই……..আর মনে-মনে বলি, “হাঁটো ধ্রুব, হাঁটো!…….হাঁটা স্বাস্থ্যের জন্য ভাল।” ……..হাহাহাহা……..

রাস্তা ধরে এলোমেলো হেঁটে যাই। কী কী যেন ভাবি…… মাঝে-মাঝে খালি রিকশার হাঁকডাক —

“ভাইয়া, যাবেন?”

উত্তর দিই না, চুপ করে থাকি – – – যার পকেটে টাকা নেই, চুপ করে থাকলেই তাকে ভাল মানায়। আমি হেঁটেই চলি……. মাঝে-মাঝে রাস্তার দু’পাশের উঁচু-উঁচু বিল্ডিংগুলো অবাক হয়ে দেখি……..ভাবি, অমন একটা বাড়ি মানুষের থাকে!?……. ধ্যৎ! না থাকার কী আছে!? আমার নেই বলে কি কারো থাকবে না নাকি? কী ভাবছি এটা!? আজব!!

আচ্ছা, আমার একটা বাড়ি নেই কেন!? না না, অমন বিশাল একটা দশতলা বাড়ি আমার লাগবে না—অতটা দিয়ে আমি কী করবো? কিন্তু, আমার একটা ফ্ল্যাটও নেই কেন!? ওটার তো খুব প্রয়োজন……. অন্যের বাড়িতে থাকা- – – বড় যন্ত্রণার, বিরক্তিকর। অনেক টাকা ভাড়া দিয়ে থাকলেও মনে হয়, বাড়িওয়ালা করুণা করে রেখেছে। আচ্ছা, যাদের একটা বাড়ি থাকে, ওরা অন্যদের গরীব ভাবে, না?

ভাবছি, আমাদের গ্রামের জমিটমি সব বিক্রি করে এক কোটি টাকা হবে না? কোটি টাকায় তো…….একটা ফ্ল্যাট পাওয়াই যাবে।

না থাক, ওসব যেভাবে আছে, সেভাবেই থাক।

কেন আমার একটা ফ্ল্যাটও নেই, তাই মনটা একটু খারাপ হলো। অবশ্য, বেকার মানুষের মাঝে-মাঝে মনখারাপ হওয়া তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু না।

পরক্ষণেই, আমার অভ্যাসবশত, ধরে নিলাম, এই বারিধারার সবকটা বাড়ি আমার…!!!

কীইইইই….??? ওমাগো মাআআআ…!!! ভয়ে চোখ বন্ধ হয়ে গেল।

আমায় ক্ষমা কোরো ঈশ্বর! এত বাড়ি আমার চাই না…… এই শত-শত বাড়ি দিয়ে আমি কী করবো!? আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে……প্লিজ, আমায় ক্ষমা করো…আমার, একটা ফ্ল্যাটও চাই না…কিচ্ছু চাই না…তবুও, এতগুলো বাড়ির মালিকানা থেকে আমায় মুক্তি দাও। একটা বাড়িও না থাকার কষ্ট আছে, কিন্তু তা কখনোই এতগুলো বাড়ি থাকার যন্ত্রণার মতো নয়। যার অনেক সম্পদ, তার জীবন বলতে আদৌ কি কিছু আছে? বাড়তি টাকা, বাড়তি জ্বালা।

“সবগুলো বাড়ি আমার”—-এই ধরেনেয়া’টা থেকে, দ্রুত বের হয়ে এলাম।

আহ্, কী শান্তি কী শান্তি!

আমার একটাও বাড়ি নেই, এটাও শান্তি! আমাকে কিছু নিয়েই টেনশনে থাকতে হয় না। শান্তি আর শান্তি।

আহা, জীবন শান্তিময়…….

আর হ্যাঁ,

ঐ যে হেঁটে ৩০ টাকা ইনকাম করেছি, সেটা ইনকাম না ছাই!!

মোড়ের দোকানটায় গিয়েই অনেকক্ষণ হাঁটার পুরস্কার হিসেবে নিজেকে ৫০ টাকার একটা কোণ আইসক্রিম আর ২৫ টাকার একটা চিপস্ কিনে দিয়েছি!!

সবসময় এমনই হয়……

এ-ই হচ্ছে আমার ইনকামের নমুনা…!! যোগবিয়োগে লস হয়ে যায়, তবু, বেশ কিছু শান্তি ইনকাম করে ফেলি।

ভাবনা: একুশ।

……………………..

বৃন্তি মাস্টার্স করতে বাইরে ছিল অনেকদিন, এখন আবার দেশে। ও আমার সবচাইতে কাছের বান্ধবী। ওর আড়াই বছরের ছেলেটা, প্রায় দুবছর হলো, খালার কাছে বড় হচ্ছে। খালাকেই ডাকে ‘মা’, মাকে কিছু ডাকে না! বান্ধবী ছুটি পেয়ে বাসায় এলে, ছেলেকে কেনাসুখের আনন্দ দিতে কোন কমতি রাখে না। কী না কী কিনে দিয়ে ছেলেকে কাছে টেনে নিতে পারবে, সে ভাবনায় ঘুম হয় না ওর। যে মায়েরা সন্তানের কাছে থাকতে পারে না ব্যস্ততার কারণে, তারা ওর পাশে এলেই, মাসের পর মাসের দূরত্ব ঘুচিয়ে ফেলতে চেষ্টা করে কয়েক ঘণ্টায়ই—কিছু খেলনা আর খাবারটাবার দিয়ে। আমি দেখি আর ভাবি, এতোই সহজ! এই শিশুরা মানুষ তো, রোবট তো আর না! সেদিন দেখলাম, অনেক খেলনার সাথে ছোট্টো একটা পাখিভর্তি খাঁচা কিনে দিয়েছে ছেলেকে। পাখিগুলো চেঁচায়, ছেলে ভয়ে খাঁচা থেকে দূরে সরে যায়। আমি কিছুতেই বুঝলাম না, অতোটুকু একটা ছোট্ট হৃদয়, একটা একহাত লম্বা খাঁচায় কিছু বন্দি পাখির ছটফট করা দেখে কী আনন্দ পাবে? এমনকি, পায়ও যদি, এমন আনন্দই বা তাকে কেন দিতে হবে? এর চেয়ে, ও বাসার ছাদে একটা কাককেই মুক্ত আকাশে উড়তে দেখুক না—সেটাই ভাল নয় কি?

আমার নিজের ছোটবেলাটার কথা একটু করে লিখতে ইচ্ছে করছে। লিখি, কেমন? আজও ভাবি, ক্লাস ফাইভে বৃত্তি না পাওয়াটা—পরীক্ষার খাতায় দুষ্টুমি করে আঁকা রবীন্দ্রনাথের শাড়িপরা ছবিটার জন্য নয়তো? ওই বয়সে, পরীক্ষার হলে, মনে হয়েছিল, মায়ের লাল সুতিশাড়িটা রবীন্দ্রনাথের গায়ে খুব মানাবে, তাই, দেরি না করে পরিয়েও দিলাম। স্যারের ভাবনা হয়তো অতো গভীরে যায়নি। সেটা স্যারের চিন্তা করার সীমাবদ্ধতা, ওতে আমার কী দোষ? ছোটবেলায় খুব ছবিআঁকার নেশা ছিল—যা দেখতাম, তা-ই এঁকে ফেলতে ইচ্ছে করত। পড়ার বই, রাফখাতা, নোটখাতা, বিছানার চাদর, পরার জামা, টেবিল ক্লথ, টাকা, আরও অনেককিছুকেই আমার এই ইচ্ছের চরম মূল্য দিতে হয়েছে; এমনকি, বাথরুমের দেয়ালেও পানি দিয়ে, যা পারতাম, তা-ই আঁকতাম—বাথরুমের ভেতরে দুকাজ একসাথে চলত! একসময় ডায়রিও লিখতাম। ডায়রিতে শুধু কষ্টের কথা লেখা হতো, অসীম ছিল সেসময়ের কষ্টে-ব্যাপৃতি, এতোটাই যে, পাতাগুলোও যেন যন্ত্রণায় কাতরাতো—লেখায় সুখও থাকত, তবে কম। একসময় মনে হল—জীবনের কষ্টগুলোকে কাগজের পৃষ্ঠায় আটকে রেখে কী লাভ? ওরা মুক্ত হয়ে ঘুরুক! অমনিই, দিলাম ছেড়ে ডায়রিলেখা। যা লিখেছি, তাও সব ছিঁড়ে পুড়িয়ে ফেললাম। এখন আর ছবি আঁকা হয় না। কিন্তু ছবির প্রতি মায়াটা থেকে গেছে, ওই মায়া যায় না। যা-ই দেখি, যা-ই পড়ি, মনে-মনে তার একটা ছবি এঁকে ফেলি। মনের বিস্তৃত ক্যানভাসে অদৃশ্য জিনিসগুলোর একটা সুন্দর বা অসুন্দর দৃশ্যমান রূপ দিই—নিজের মতো করে….আমার মনের রাজ্যে আমিই তো সবচেয়ে স্বাধীন। ইচ্ছে হলে, ভালোবাসাকে মানুষ বানিয়ে খুব করে আদর করে দিই, আবার কখনো, আচ্ছামতো মাইরও দিই। কখনোবা, কষ্টগুলোকে পার্পেল কালারের বেলুনে ভরে আকাশে উড়িয়ে দিই। কষ্টের বেলুন বড় সুন্দর করে ওড়ে। চোখের জলকে ধরে মেরে তক্তা বানাতে ইচ্ছে করলেও, বানাই না—ওকে ছাড় দিই, ছেড়ে দিই। ও থাক, শুধু ও-ই তো থাকে আমার সাথে-সাথে সবসময়ই। বিশেষ কোনো সুখকে যত্ন করে বোতলে ভরে শক্ত করে ছিপি আটকে দিই। মেকি সুখকে আইসকিউব করে রাখি। মেকি দুঃখ এলে, তা ঢিল বানিয়ে ছুঁড়ে মেরে সেই দুঃখেরই কপাল ফাটিয়ে দিই। ভাল ইচ্ছেগুলো, সুগন্ধি বানিয়ে শরীরে মনে মেখে রাখি। খারাপ ইচ্ছেগুলোকে ধ্বংস করতে না পারলেও, অন্তত কুৎসিত কদাকার সব স্ট্যাচু বানিয়ে রাখি।

‘শুভ সকাল’ বললেই, একটা সুন্দর সকালের ছবি চোখে ভেসে ওঠে, ওরকম ছবি জমতে জমতে স্তূপ হয়ে ওঠে, আর বইতে পারি না, প্রায়শই তাই, কিছু ছবি—কারো ইনবক্সকে জ্বালাতন করে! হিহিহিহি…….যখন যা-ই পড়ি, তার একটা ছবি মনে-মনে কল্পনা করতে থাকি, মাঝে-মাঝে সে কল্পনা বাস্তবের চেয়েও সত্য হয়—ভয় হয়, যদি এমন কারোর সামনে কল্পনা করে ফেলি, যার কিনা অন্যের কল্পনা পড়ার ক্ষমতা আছে! সবকিছু ঠিকই থাকে—তবে কখনো-কখনো, সবকিছুর কল্পনায় ছবি আঁকতে গেলে কোথায় যেন আটকে যাই….এই যেমন, যখন পরি—অবশ্যই কল্পনায়—ফরমাল গ্রিনশার্ট, ইয়েলোপ্যান্ট, ব্লুবেল্ট, ম্যাজেন্টাটাই, রেডশু, পিংকশকস্‌, আরও ভেতরে চলে যাই…..ব্রাউন ইয়ে……!! হাহাহা……আমি একটা বদবুড়ি……তবে, আপনি…..বদনা। (মনে-মনে, মাঝখানটায় একটা স্পেস বসিয়ে দিয়ে পড়বেন না যেন, কিছুতেই!) “এই মেয়ে, তুমি এত হাস কেন? তুমি কি জানো, যারা বেশি হাসে, তাদের অনেক কষ্ট থাকে….. লুকানো? তোমার কীসের এতো কষ্ট?” “কষ্ট!? আমার!? আমার কষ্ট—সে কী বস্তু আবার!? আমার তো কোনো কষ্ট নেই, স্যার! আমার যে কোনো কষ্টই নেই, সেটাই আমার একমাত্র কষ্ট…..!! হাহ্‌ হাহ্‌ হাহ্‌……”