ভাবনাদেয়ালের পলেস্তারা (৩৮শ অংশ)

ভাবনা: দুইশো ষাট।

……………………………………..

১। পাশের বাসায়, ‘সাফা’ নামের এক ইট্টুশ পিচ্চি ওর বাবাকে ডাকছে……অ্যাঅ্যাঅ্যাই সাফার আব্বুউউউ……..!

২। A-এর ছবি, B-এর জন্য তোলা হলে, সেটা C-কে দেয়াটা—B-এর সাথে অন্যায়, এবং C-কে অপমান করা হয়…….তবে, A-এর ছবি এমনিতেই তোলা হলে, সেটা অবশ্য B টু Z যে কাউকেই দেয়া যায়।

৩। আমাদের কল্পনাশক্তি, যতটা ‘একাকিত্ব’ কল্পনা করতে পারে এবং আমাদের হৃদয় যতটা একাকিত্ব অনুভব করতে পারে, আমরা আসলে তার চেয়ে আরও অনেক বেশি একা। ভাগ্যিস, কতটা একাকিত্বে আমাদের বাস, সেই গভীরতার খোঁজ আমরা জানিই না! জানলে বেঁচেথাকাটা হয়তো অসম্ভব হয়ে যেত!

৪। প্রচণ্ড ভালোবাসার কোন জীব বা জড় থেকে অনবরত পাওয়া কষ্ট, হৃদয় থেকে ধীরেধীরে ভালোবাসাগুলোকে সরিয়ে মস্তিষ্কে দিয়ে দেয়। তখন সে জীব বা জড়ের প্রতি হৃদয় আর কোনও ভালোবাসা অনুভব করে না, কেবল মস্তিষ্ক মনে রাখে, ও ভালোবাসার……ছিল, আছে, কিংবা থাকবে। কথা হল, প্রাণহীন জড় বস্তুও কি কষ্ট দিতে পারে? হুমম্‌ পারে। কখনও-কখনও সে কষ্ট, তাজা প্রাণের জীবের কাছ থেকে পাওয়া কষ্টকেও ছাড়িয়ে যায়।

৫। যে মিথ্যেকে সত্য ধরতে হয়, আর যে সত্যকে মিথ্যে ধরতে হয়, তা কখনও জীবনের ‘প্রয়োজন’ হতে পারে না। হয়তো একে জীবনের ‘অপ্রয়োজন’ বলাই ভাল!

৬। জীবনের সাথে অযাচিতভাবে লেগেথাকা মানুষগুলো, কিংবা সম্পূর্ণ বিচ্ছেদেথাকা মানুষগুলোও……অকারণে কষ্ট দিচ্ছে?

নিন্দুকেরা, নিন্দায়নিন্দায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাচ্ছে? যে কাজটির নিন্দা করা হচ্ছে, সে কাজটি আসলে করাই হয়নি, এমন হচ্ছে? যারা অন্যায় করছে, তারা বাহবা পাচ্ছে, আর হাজার চেষ্টা করেও নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করা যাচ্ছে না?

আরররে ধুউররর! সব বাদ!

কী দরকার এত কষ্ট করে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার? এই যে তারা বুঝতেই পারছে না, আদৌ সে কাজটি আসলে করাই হয়নি, এরও সমাধান আছে……হুউম্‌!

কারও কোনও ক্ষতি হবে না, এমন কিছু অন্যায় কাজ, নিন্দুকদের সাথে করেই ফেলা যায়!

এরপর, ভাল কাউকে অন্যায় করতে দেখে নিন্দুকেরা এবার নড়েচড়ে বসবে!

যারা খাবার ছাড়াই জাবর কাটত, তাদের দিব্যি খাবার জুটে যাবে!

ব্যস্‌!

এবার নাহয় কারও সত্যিকারের ‘নিন্দনীয়’ কাজ নিয়েই নিন্দুকেরা নিন্দা করুক!

ভাল যারা, ওরা আরামসে ভাল থাকুক!

৭। আমরা যখন কোনও একটা জিনিসের দিকে নির্দিষ্ট করে তাকাই, তখন সেই জিনিসটা ছাড়াও আশেপাশের অনেক কিছুই আমরা দেখতে পাই। কারও চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলার সময়, সে হাত নাড়ালে, সেদিকেই না তাকিয়েও তা দেখা যায়।

জীবনের ক্ষেত্রেও, তা-ই……….

একই কথা সম্পর্কের ক্ষেত্রেও খাটে।

যেকোনও সম্পর্কের নির্দিষ্ট ফোকাসের বাইরেও, চারপাশটা, একটা নির্দিষ্ট বিস্তৃতি পর্যন্ত ঠিকই দেখতে পাওয়া যায়।

৮। ব্লক করে নিজেকে বাহাদুর ভেবে ফেলেন, না? কাজটা ভাল করেন না। ব্লক করেন, আবার আনব্লক করেন, এর মানে কী? আপনাকে চোখের বালি কি আর এমনিই ডাকি? কত্ত অহংকার মানুষের! আরে বাবা, আমি তো আর আপনার সাথে প্রেম করতে যাচ্ছি না। অনেক দিনের একটা অভ্যেস আপনাকে বিরক্ত করা, তাই করি। আমার এমন পাগলামিতে কারও কিছু এসে যাবে না। এমনকি, আপনারও না, আমারও না।

এতদিন যা যা বলছি সব……সব আপনার মাথায় ঘুরবে। আমার কথা চিন্তা করে আপনার সময় যাবে। সবকিছুতে আমি থাকব ছায়া হয়ে। কাউকে বলতেও পারবেন না, শুধু নিজেনিজে পুড়বেন। পুড়েপুড়ে ছাই হয়ে যাবেন। এটাই হোক আপনার জন্য পানিশমেন্ট।

আপ্নে ইলেকট্রিসিটি কোথাকার একটা! ইচ্ছা করে, একদম চাইপ্পা ধইরা লঅঅম্বাআআ বানাইয়া ইলেকট্রিক তারের ভেতর ঢুকাই দিই! তারের ভেতরে পজেটিভ হয়ে বাঁচবেন, নেগেটিভের সাথে খুব গলাগলি কইরা কাঁপতেকাঁপতে বাঁচবেন। হুউউহহ্!

৯। এক আপু তার মেয়েকে অনেক দামি এক প্যাকেট চকলেট কিনে দিয়ে প্রায় বিলাপের সুরে সমানে চিল্লাচ্ছে! কারণ, তার মেয়ে একটা চকলেট খেয়ে, আর খাচ্ছে না……চকলেটের দাম যত বেশি, স্বাদ তত কম!

বললাম, আহ্‌ আপু! রাগতেসো ক্যান? তোমার তো খুশি হওয়ার কথা!

“কী? খুশি হব!? অ্যাত্ত টাকা দিয়ে চকলেটবক্স কিনে দিলাম! আর এখন খেতে মজা না বলে আর একটাও খাবে না, আর তুমি বলছ আমাকে খুশি হতে!? টাকা কি পাছায় ধরে?”

(আসলে উনি ‘গাছে’ বলতে গিয়ে, ‘পাছে’ বইলা ফেলসেন, আর অতি রাগে ‘পাছে’ বলতে গিয়ে ‘পাছায়’ বলে ফেলসেন! হিহিহি)

হুম, খুশিই হবেন………কারণ, একবার ভাবেন তো, এই চকলেট যদি তার মজা লেগে যেত, তাহলে বারবার সে এই দামি চকলেট কিনতে চাইত। আরে! আপনি তো বাঁইচ্চা গেসেন, আপু!

“আরে! আসলেই তো! আমি তো সেই বাঁচা বাঁইচ্চা গেসি!”

হে হে হে…….

ভাবনা: দুইশো একষট্টি।

……………………………………..

এক বছর আগে এই দিনে পৃথ্বীর সাথে অন্বীর দেখা হয়েছিল। একটু ভুল হল। দেখা হয়নি, তারা আসলে দেখা করেছিল। পৃথ্বীর হয়তো অনাকাঙ্ক্ষিত দেখা, আর অন্বীর……কাঙ্ক্ষিত।

বারবার পৃথ্বীর শর্তে আটকে, দেখা হতে, বছরেরও বেশি সময় পেরিয়েছে। অবশেষে পৃথ্বী শর্ত ছাড়াই দেখা করেছিল।

“বইগুলো কি তোমার আছে?” “আমি জানি নাতো…….”

বইগুলো ছিল অন্বীর কাছে। ও চায়নি পৃথ্বী এতো কষ্ট করে যে উপহার সাথে এনেছে, তা ফেরত দিয়ে পৃথ্বীকে বিব্রত করতে। প্রিয়জনের পুরনো উপহারটিও তো নতুনের মত গ্রহণ করা যায়। প্রেমিকের ব্যবহৃত আধোয়া টিশার্টটি প্রেমিকা কত যত্নে রেখে দেয়, কখনও গন্ধ শুঁকে, কখনওবা বুকের সাথে নিবিড় মমতায় জড়িয়ে রাখে।

“কিছু অবজারবেশন আছে, বাসায় পৌঁছে মেসেজে……নাহ্‌, ফোনে বলব।”

পৃথ্বীর এখনও বলার সময় হল না। ও এখনও ভাবছে, কী অবজারবেশন বলা যায়!

৩৬৫ দিন। অনেকটা সময়……অনেক….অন্বী তাও প্রতীক্ষায় আছে……অবজারবেশন শোনার।

অনুভূতির বাইরেথাকা কাউকে দেয়া কোনও কথা রাখার দায়………শতাব্দী পেরোলেই বা কী এসে যায়!

“কী দেখো? তাকায় আছ কেন? আমার কি লজ্জা পাওয়া উচিৎ?”

বলেছিলেন। কি, পৃথ্বী? মনে আছে তো? নাকি ভাবছেন………কত অন্বী আসে, যায়! অতো মনে থাকে নাকি?

আপনি মুখে যা-ই বলেন না কেন, আপনি সামনাসামনি বেশ লাজুক! হিহিহি……এখনও মনে আছে, লজ্জা পেতেপেতেই সেদিনের কথাগুলো বলছিলেন!

আচ্ছা, প্রথম আমাকে দেখে, কয়েক সেকেন্ডের জন্য অমন অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলেন কেন!? আহারে, স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন, এই ভেবে যে………পরবর্তী কতগুলো মিনিট (বাট, ফিল লাইক……কয়েক বছর!) এই ***-এর সাথে সময় কাটাতে হবে!

আচ্ছা মশাই, দরজায় তো ১০০টা তালা দেয়া ছিল না, তা দৌড়ে পালিয়ে গেলেন না কেন? হুঁ?

এক মুহূর্তের জন্য একটা সেক্সি লুক দিয়েছিলেন! দেখেছি কিন্তু! ভাগ্যিস, সেই লুক আর দ্বিতীয়বার দেননি! তাহলে কিন্তু আমি আর তাকিয়ে থাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতাম না! হুউম্‌!

আপনার মোবাইলটা না একদম রেস্টুরেন্টের জুস বানানোর ব্লেন্ডারে দিয়ে ব্লেন্ড করে ফেলতে ইচ্ছে করছিল! তারপর সেই জুস আপনাকে…….হুমম্‌…….এতো ফোন আসে মানুষের!

থুতনিতে যে বিশেষ উদ্দেশ্যে হাতটা রেখেছিলেন………ইসস্‌ দম বন্ধ হয়ে যেত তো!

মিস্টার! শার্টের হাতা থেকে হাতটাই তো খুলছিলাম! এমন একখান ভাব উনার………যেন প্যান্টের চেইন খুলছিলাম!…..হুহহ্!

(ইসস্‌ আপনার ওই হাত দুটো তো আমি সেই কবেই নিয়ে নিয়েছি! আমার হাত নিয়ে আবার আমার সাথেই ভাব দেখায়! এহহ্‌!)

“না, না, প্লিজ চুল টেনো না…….অন্য কিছু নিয়ে যত ইচ্ছা টানাটানি করতে পারো! সমস্যা নাই!”

ইসসস্‌ আমার তো খুউউব চুল টানতে ইচ্ছে করছিল………টেনেছিও! কিন্তু আরও ইকটুসখানি টানতে মন চাচ্ছিল!

কামড়াতে ইচ্ছে করছিল! কানেও কামড় দিতে ইচ্ছে করছিল!

“মেয়ে বলে কী? পাগল নাকি? আমি আমার বৌকেও এখনও পর্যন্ত কিছু খাওয়ায় দেই নাই……ওকে খাওয়ায় দিলে……ও তো খুশিতে একদম মরেই যেতো!………আর এই মেয়ে বলে কিনা আর নাকি খাবে না!”

হুম, ভাল লাগছিল তো খুউউব………হাতে খেতে…….কেমন জানি আদরআদর লাগছিল! চিকেনের সাথে হাতটাও খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছিল যে……..

“ও এই মাস জন্মমাস তোমার! বাহ্‌! কত তারিখ?”

স্রেফ একটা দায়সারা প্রশ্ন! কাজেই, উত্তরটা, নিষ্প্রয়োজন ছিল।

“আমি তো জানতাম না যে এতটা হট তুমি! তাইলে তো…….”

“আমি তো বুঝতে পারিনি তুমি এমন করবে! তাহলে তো এখানে আসতাম না, অন্য কোথাও যেতাম…….”

ইসস্‌ কী করেছি আমি? হুঁ? কিছুই তো করিনি! আজব! একদম যা যা করতে ইচ্ছে করছিল……..সব যদি করতাম, তাইলে ভাল হতো! হুমমম্‌!

“ওয়েটারকে অতো কথা বললে কেন?”

কেন? বলব না কেন? বলেছি একটা কফির কথা, ওরা কেন দুইটা কফি দিবে? ওকে কফিটা ফেরত নিয়ে যেতে বললে কী হতো? প্রেস্টিজ চলে যেতো? প্রেস্টিজ বুঝি অতোই ঠুনকো? ওরা কী ভাবতো? স্রেফ একটা কফির দামের জন্য এমন করছি!? নাহয় সেই কফির দামটা ওয়েটারের টিপসের সাথে এক্সট্রা দিয়ে দিতাম!………ওদের ভুলটা তো ওরা স্বীকার করত! স্বীকার করাতে দিলেন না!

টেবিলের নিচে ঢুকে, আপনার জুতোগুলো খুলে, পায়ে কামড় দিতে ইচ্ছে করছিল……খুউউব!

আচ্ছা, আমি সারাক্ষণই আপনার দিকে তাকিয়ে ছিলাম, তাই না!? আচ্ছা, সেই ‘তাকিয়ে থাকা’টা কী এক্সপ্রেস করছিল!? কিছুই বোঝেননি?

“কী কালারের ড্রেস পরেছ? ব্ল্যাক?”

“না, ইয়োলো!”

“মিথ্যা বললে তো……”

হিহিহি……

দেখলাম তো সেদিন………চিনতেই তো পারলেন না! কথা বলতেবলতে তো পাশ কাটিয়ে চলে গেলাম সোজা রেস্টুরেন্টে!

কেমন একটু লজ্জালজ্জা লাগছে এখন………এসব লিখতে!

(টিপস নিয়ে, আপনার ওয়াশরুমে দেরিকরা নিয়ে, বই কিনতে যাওয়া নিয়ে, আগে বলেছি; তাই আর বললাম না।)

এই সবকিছুই পৃথ্বীর জানার মধ্যে………অজানা যা আছে, থাক। সেসব নাহয় না-ই বা বলল অন্বী! কী হবে বলে মনের কথা! বললে বরং দামি আবেগটা সস্তা হয়ে যায়………তার চাইতে ওসব কথা মনেই থাক!

অন্বী তার অনুভূতির কিছুই প্রকাশ করতে পারে না।

আর পৃথ্বী………একবিন্দুও বুঝতে পারে না।

নিরেট কষ্ট পাথরের ভার ঠেলে, একটু নিঃশ্বাস নিতে-নিতে বাস্তবতায় পৌঁছে বলে………এ-ই ভাল!

দ্বৈত ব্যঙ্গস্বরে বলে………তবুও জীবন সুন্দর!

হয়তো জীবন………সত্যিই সুন্দর!

ভাবনা: দুইশো বাষট্টি।

……………………………………..

এক।

১৮ ডিসেম্বর।

মাধব, দুই বছর আগে এমনই এক অক্টোবরের ১০ তারিখ আপনাকে প্রথম নক করেছিলাম।

অনুভূতির নির্লজ্জতার কাছে হার মেনে, এই আইডিতেও নক করা।

কী ভীষন বাজে একটা দিন এই দিনটা আপনার কাছে, তাই না, মাধু?

কোনওদিন কথা হয়নি, হবে না…….দেখা হয়নি, হবে না।

শুধু একটাবার আমায় বলবেন, মাধু, ঠিক কী কারণে আপনার এতটা বিরক্তি আমার উপর, তা অন্তত আপনি নিজে জানেন তো? কতটা ঘৃণা করেন আমাকে?

সে আপনি করতেই পারেন………আপনার ব্যাপার, আমার শুধু কারণটা জানার ইচ্ছে।

আমায় ভালোবাসে না, এমন কাউকে ভালোবাসা কষ্টের বৈকি!

কিন্তু বিপরীতভাবে ভাবলে, এমন কারও কাছ থেকে প্রচণ্ড ভালোবাসা পাওয়া, যার প্রতি এক বিন্দু অনুভূতিও কাজ করে না, সেটাও নিশ্চয়ই তার জন্যে অনেক কষ্টের কিংবা বিরক্তির…….

কাউকে, অকারণ কষ্ট দেয়ার অধিকার সত্যিই কারও নেই!

এটা ভাবতেই মাথায় আসে, কী ভীষণ স্বার্থপর আমি!

আপনাকে ভুলে যেতে পারব না, তা কিন্তু নয়! আসলে আমি পারতে চাই না।

তবুও, নীরবতার পথেই তো হাঁটছি………আজ তো আর হয় না বলা কিছুই……….মনের যত কথা আর ব্যথা, মনেই গিলে ফেলি!

সামনের বার এই দিনে, আমরা দুজন কে কোথায় থাকি, কে জানে!

ভাল থাকবেন, মাধব………খুব ভাল!

আরও অনেককিছুই লিখেছিলাম। অনেকটা সময় নিয়ে যা লিখলাম, স্রেফ এক স্পর্শে তা মুছে দিলাম! কী হবে এসব অনুভূতির প্রকাশ করে? যার কাছে আমার অনুভূতির কোনও দাম নেই, তার কাছে কোনও অনুভূতি প্রকাশ করলে বরং সে অনুভূতি সস্তা হয়ে যায়।

দুই।

সে ছিল নেটওয়ার্কের বাইরে………তাইতো হাতড়ে পাইনি খুঁজে তারে!

আহ্‌! উনি সাজেক গেছেন! সবাই বলে, সাজেক সৌন্দর্যে অপরূপ! যাওয়া হয়নি কখনও।

সাজেক এক রকম মানুষ হলে, তার সৌন্দর্যে এতো মানুষের মুগ্ধতা দেখে, খুব খুশি হয়ে যেত!

সাজেক অন্য রকম মানুষ হলে, কেবল সে সুন্দর বলেই মানুষ তাকে এতো ভালোবাসে, আর অমন সুন্দর না হলে………কী যে হত, এটা ভেবে সে খুব মন খারাপ করত।

ভাগ্যিস, সাজেক মানুষ নয়! স্থির এবং নির্বাক প্রকৃতি সবসময়ই সুন্দর, অথচ ভাবলেশহীন। আহা, সব মানুষ যদি অমন নির্বাক স্থির প্রকৃতি হয়ে যেত!

হেহেহেহে……..

তিন।

মুখে তো এখনও লেবু-কোক লেগে আছে! এক বছর হয়ে গেছে!? সত্যি? মনে হয়, মিথ্যা!

আবার অন্যভাবে………

বছরের পর কতকত বছর পেরুলো, কতকাল আগের সেই কবেকার দেখা……..মাত্র এক বছর হয়েছে!? সত্যি? মনে হয়, মিথ্যা!

সময়ের বহমানতা অনুভব আর আবেগ নির্ভর।

কেমন আছ?

ভাল। তুমি?

আমিও।

বাবু, কী কর?

বসে আছি। তুমি?

আমিও………লাঞ্চ করসো?

না………তুমি?

(কিছুক্ষণ অপেক্ষা, মেসেজ আসে না।)

ওকে, পরে ফোন দিব।

না না………সরি, সোনা, কিছু বলো। আমি আছি তো!

(হিহিহি……পাশের সিটে বসা ছেলেটার, তার গার্লফ্রেন্ডের সাথে করা টেক্সটিং, লুকিয়েলুকিয়ে দেখে ফেলসি! হিহি….আর হ্যাঁ, লাভ সাইনটা নীল কালারের ছিল…..)

: ছিঃ মেয়ে! এসব করতে হয় না!

: হিহিহি জানি তো!

(আরও খারাপ যা করছি, তা হল, এই কনভারসেশন সবটা লিখে মোবাইলের স্ক্রিনে রেখে, জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়ে আছি। শুধু আড়চোখে খেয়াল রাখছি, ছেলেটা দেখে কি না! হিহি……কাজ হইছে! ছেলেটা দেখেছে! হেহেহে……সাথেসাথে মেসেজিং বন্ধ করে, গেইম্‌স নিয়ে বসেছে! হিহিহিহি…..)

আমি যা করলাম, ঠিক করলাম না।

ওরা যা করছে, তা কতটা ঠিক? যে সম্পর্ক ভেঙেই যাবে, ওটা নিয়ে এতো লুতুপুতু কীসের? দুধের বাচ্চা, সেও নাকি প্রেম করে!

(দ্বৈত বলে, এই বেটি! তোর কী? ওরা যা ইচ্ছা করুক গিয়ে!

আমি বলি, আমি জীবনে যে সুখ পাই নাই, আমি সে সুখ কাউকে পেতে দিব না। হ্যাঁ, আমি হিংসা করি, কোনও সমস্যা? হিহি……)

চার।

বউয়ের হাতের মজার রান্নাগুলো শুধু খেতে থাকুন, আর ভুঁড়ি বাড়াতে থাকুন। কোনও ব্যাপার না! কিন্তু, আমারটা কোথায়?

আপনি জীবনে যে কতগুলো প্রেম করেছেন! ঈশ্বরই জানেন! ডজনখানেক হবে না? এগুলি কোনও ব্যাপার না! সব দিকেই এক্সপার্টাইজ থাকা ভাল।

আচ্ছা, আপনি আরও বাজে কোনও কভার ফটো খুঁজে পান নাই বলে এটা দিলেন? আপনার পিকে আপনার পাশে আমি নাই কেন? বউকে নিয়ে পিক দিতেই হয় কেন আপনাকে? আচ্ছা, আমি না আমার ঘড়িটা কোথায় রেখেছি, মনে করতে পারছি না। একটু খুঁজে দেবেন?

যারা বিয়ে করে ফেলে, তারা সবসময় জেঠু আর বাবাদের দলে পড়ে। অতএব, আপনি এখন জেঠু। নমস্কার, জেঠু! ফর্সা জেঠুমশাই, আপনার পিকে আপনাকে দেখতে ভূতের মত দেখায়, এটা কি আপনি জানেন? মুখে একটু কয়লা মেখে পোজ দিয়েই দেখেন না কেমন দারুণ পিক আসে! কালো ছেলেদের পিক সুন্দর আসে। কেমন জানি রৌদ্রে ট্যান্‌ড টাইপ দেখায়। দেখতে সেক্সি লাগে!

এই যে দাদা! আপনি যে এইভাবে ড্যাংড্যাং করে ছেলে কতগুলার সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, এদের কেউ যদি আপনাকে একটা ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়, তখন কী হবে? আপনি না কেমন জানি! মুখে শুধু ফটরফটর, কামের বেলায় ঘণ্টা! যাকগে! আমি কাউকে নিয়ে চিন্তা করি না! এত মহব্বত নাই আমার মধ্যে! আপনার লেখা পড়ি, তাই আপনার জন্য একটু চিন্তা আসে আরকি! দেখেশুনে চলাফেরা করবেন, বুঝলেন, স্যার? দিনকাল খারাপ, জানেন না? আমি এই জায়গায় আছি, ওই জায়গায় আছি, এগুলো পোস্ট করে জানানোর কী আছে? বেকুব একটা! আপনাকে যে আর কত শিখায়ে দিতে হবে! আপনি একেবারেই যা-তা!

সাঁতার না জেনে নৌকায় উঠেছেন কোন আক্কেলে? আপনাকে দেখে ভয়ে তো গলা শুকিয়ে আসল! খ্যাখ দিয়ে একটা খোখ খেতে হবে যে! আমাকে খ্যাখ-খোখের পয়সা কে দিবে যে? বদ্দা, আমার ইচ্ছে করছে, আপনাকে পেছন থেকে ধাক্কা মেরে জলে ফেলে দিতে! তারপর গান ধরতে………আহা, কী আনন্দ আকাশে-বাতাসে! এই শীতে আপনি যদি এখন জলে পড়ে যান, কেমন মজা হবে!

ও দাদা, শুনেন না একটু! আমি অতি ছরি অ্যান্ড দুঃখিত। এতক্ষণ যা বলেছি, সব কাটাকুটি, কেমন? বাঁধভাঙা আবেগে যা মন চায়, তা-ই বলে ফেলেছি। টাটা।

ভাবনা: দুইশো তেষট্টি।

……………………………………..

এক।

(কোনও এক বিকেলে লেখা)

মায়ের হাতের চা’টা খেতে ভাল, নাকি ব‌উয়ের—এ দ্বন্দ্বে না জড়ানোর নাম‌ই সংসার।

ভাল কথা, বিকেলের পর বাতিঘর-এ আসছি। কেউ ওদিকটায় থাকলে আড্ডা হতে পারে। (বিসিএস, আইবিএ, ক্যারিয়ার এসব বাদ দিয়ে আড্ডা, প্লিজ! আমার সাথে কথা বলবার মতো অন্য কিছু না থাকলে কথা বলবেন না, তবুও ওসব নয়, প্লিজ!)

উনিশে এপ্রিল দেখছি। ঋতুপর্ণ সত্যিই মাস্টারপিস।

দুই।

জানেন, এতটা আবেগ নিয়ে কেউ কখনও কিছু করেনি আমার জন্য! আপনি যা করেছেন, সেটা হয়ত খামখেয়ালিবশতই করেছেন, কিংবা স্রেফ আমাকে খুশি করতেই করেছেন, কিন্তু এটা আমার কাছে স্বপ্নের মত। আমার জন্য কেউ এতটা করতে পারে, এটাই মাথা থেকে যাচ্ছে না। এত মুগ্ধতা কেউ আমায় দেয়নি। আপনি দিয়েছেন। আর এই যে ‘ভাল থেকো’ লিখে দেন, এই কথাটা কেন লিখেন? আপনি কি জানেন, আমি কত চেষ্টা করি যেন কেউ বুঝতে না পারে আমি যে ভাল থাকি না!

তবে আজকের দিনটা সত্যি মনে রাখব। আমার স্মৃতির পাতায় রয়ে যাবে। হয়তো আমাদের আর কখনও কথা হবে না, দেখাও হবে না আর। আপনার এতটুকু আবেগ আমার উঠোনে ফেলে গেলেন, আমি সেটাকে যত্ন করে তুলে রাখব। মাঝেমাঝে বের করব, ধুলো ঝাড়ব, মুছব, আর ভাবব, আহা, এমন না হলেও তো ক্ষতি ছিল না, এরপর আবার তুলে রাখব।

এই যে লিখছি এতো যত্ন করে এতো কিছু, এসব আপনার কাছে ডালভাত, না? আমার কাছে কিন্তু না। আপনি আমায় ভাল থাকতে বলেছেন, আমি সত্যিই ভাল থাকব। আর………প্লিজ, আপনিও ভাল থাকবেন।

আমাকে হলদে পাখি ডাকলেন কেন?

হলদে পাখি? নাহ্‌! আমি হলদে পাখি না। আমি স্বপ্ন, যেটা সবাই দেখে।

তিন।

যন্ত্রণাময় সেই দিন………

২৭ অক্টোবর ২০১৬

সুদূর অতীতেরও কোনও এক ছোট্ট সুখকে যেমন আমি ভুলি না, তেমনই, ফেলেআসা কোনও কষ্টকেও আমি কখনও ভুলে যাই না। বারবার মনে করি, নিজেকে কষ্ট দিই। কষ্টের রঙ বদলায় না, কষ্টের যে অনুভূতি, তার রঙ বদলায়। একই কষ্ট—সময়ের সাথেসাথে এর পরিবর্তনগুলিকে অনুভব করি।

দ্বৈত প্রায়ই বলে, “যে দুঃখ চলে গেছে বহু আগে……নির্ভেজাল কষ্ট দিয়ে, কেন তাকে বারেবারে মনেকরা? নিজেকে এমন কষ্টদেয়া?”

আমি বলি, “কষ্টের, পুনঃপুন স্মরণে কেবলই কি কষ্টই ফিরে পাই? কষ্টের স্মৃতিতে শিক্ষা থাকে, সুখও থাকে। খুঁজে নিতে জানতে হয়।”

কষ্ট ভোলার, কষ্ট সহ্য করার, কষ্টে ধৈর্য ধরার, কষ্ট থেকে মুক্তির সঠিক পথটা বের করার, কষ্টের সময়ে চারপাশের মানুষজন এবং পরিস্থিতিকে ভালভাবে বুঝতে এবং চিনতে পারার, প্রাপ্য কোনও কষ্ট হয়ে থাকলে, পুনরায় যেন এমন ভুল আর না হয়, সে বিষয়ে সতর্ক থাকার……..ইত্যাদি, ইত্যাদি—এই বিষয়গুলোর মধ্যেও এক ধরনের শক্তি আছে—কষ্টের স্মরণে ওই শক্তি বারবার ফিরে পাই।

তাইতো, সুখকে যেমনি মনে রাখি খুব আদরে…….তেমনি দুঃখকেও।

আপনার আগের আইডিটার জন্য আমার প্রচণ্ড কষ্ট হয়, অনেকবেশি মিস করি ওই আইডিটাকে। কত অনুভূতির সাক্ষর হারিয়ে গেল!

মনে আছে, রুদ্র……বলেছিলাম আপনাকে………আপনার আইডিটা নিয়ে এক হেমন্তবিকেলে……আমার কেমন যেন একটা ভয় কাজ করত………শুধু মনে হত, বারবারই মনে হত, কী যেন হবে, সব কিছু যেন হারিয়ে যাচ্ছে………আপনি হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন………মনে আছে, রু?

অস্থিরতা সহ্য করতে পারছিলাম না, তাই আপনাকে বলেও দিয়েছিলাম সেই আশংকার কথা………মনে পড়ছে না, রু?

গত অক্টোবরের এ সময়টার প্রতিটি দিনকে আমি স্পষ্টভাবে অনুভব করি।

এমন দিন, আর কখনও না আসুক। কারও জীবনেই এমন ঝড় না উঠুক………এমনকি যারা আপনার জীবনে ওই ঝড় এনেছিল, ওদের জীবনেও।

কিছু মানুষ অবিবেচক ও সীমাহীন রকমের নিষ্ঠুর হতে পারে। ওরা নিজেকে ছাড়া আর কাউকেই ক্ষমা করতে পারে না। যে সমাজে এমন মানুষ বেশি, সে সমাজে বিচার কিংবা ন্যায্য অধিকারের নাম আনুকূল্য। এমন সমাজকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা মানে বোকার স্বর্গে বাস করা।

কত্তদিন পর, সেদিন মেসেজ দেয়ার জন্য, আমার আইডিতে লগইন করি, দম বন্ধ হয়ে আসছিল আমার! কয়েক মিনিটও থাকতে পারিনি………পুরানো মেসেজগুলো পড়তে ইচ্ছে হচ্ছিল, কিন্তু পারছিলাম না!

জীবনে কখনওই এমন কিছু যেন আমরা অবলীলায় না করি, যেখানে বৃষ্টির শাস্তি রোদে পেতে হয়—সবার জন্যই এ প্রার্থনা থাকল।

ভাল থাকুন, রুদ্র, খুব ভাল…….যেভাবে ভাল থাকলে একটা দিনের জন্যও খারাপ থাকতে হবে না, সেরকম।

চার।

Colour Changing Toilet LED Sensor

প্রথমে দেখে ভাবছিলাম, ওইখানে নানান রঙের বাত্তি জ্বললেই কী আর না জ্বললেই বা কী!

পরে মনে হইল, নাহ্ ভালই তো………অনাদিকাল থেইক্কা সেই এক রঙের গু দেখতেদেখতে বিরক্ত! এখন নানান রঙের গু দেখা যাবে! লাল, নীল, বেগুনি গু দেখেদেখে ছোটঘরের সময়টা তাইলে ভালই কাটবে! (ইয়াম্মিইইই……)

জীবনে রং আসে, রং যায়…….গুয়েরও তো ইচ্ছা করে একটু রংবদল করতে!

পার্থক্য কেবল………জীবন, রংবদলের খেলা শেষে, সত্যিসত্যিই একদিন সাদাকালো হয়ে যায়…….গু, তার রং বদল করে যত রংই ধারণ করুক না কেন, সবকিছুর পরও, তার আসল রংটাই থেকে যায়।

ভাবনা: দুইশো চৌষট্টি।

……………………………………..

প্রায়ই ভাবি, প্রতারিত হয়েছি বলে কেন অন্যের জন্য নিজেকে অন্ধকারে রাখব! আমার তো কোনও দোষ ছিল না, তবে কেন নিজেকে কষ্ট দেব! তাহলে তো নিজের সাথেও প্রতারণা করা হবে! নিজেকে তো ভালরাখার কথা, তা না রেখে কেন এভাবে কষ্টদেয়া প্রতিনিয়ত……জীবনটা তো আমার, তবে কেন অন্যের প্রতারণায় প্রতারিত হয়ে নিজের জীবনটা নষ্ট করব! আর নিজেকে কষ্ট দিতে চাই না!

ভাল থাকতে চাই আমি, তবুও কেন যে পারছি না! কীভাবে ভাল থাকব?

কোনও একটা সম্পর্কে জড়ানো, কিংবা কারও প্রেমে পড়ে যাওয়া খুব খারাপ জিনিস। খারাপ মানে, খুবই খারাপ। আপনি কারও প্রেমে পড়ে গেলে আপনি নিজে চলবেন না, সে আপনাকে চালাবে। তার পছন্দ মত চলতে বাধ্য হবেন আপনি। যেমন ধরুন, আপনি বই পড়তে খুব পছন্দ করেন, সে পছন্দ করে না; তাহলে কিন্তু আপনি আপনার বইপড়ার অভ্যেসটা ধরে রাখতে পারবেন না। যে বই নিয়ে রাতদিন নাওয়াখাওয়া ভুলে থাকতে পারতেন, সেই বইকেই বিরক্ত লাগবে! অবাক লাগছে? আপনি আঁকতে খুব পছন্দ করেন! তো কী হয়েছে! প্রেমে পড়েই দেখুন না, আঁকতে বেমালুম ভুলে যাবেন! খুব সোজা ওটা! লিখতে ভাল লাগে? কোনও একদিন ভুলেই যাবেন, আপনিও একসময় ভাল লিখতেন—অন্তত দ্বিতীয়বার পড়ার মত ভাল! শুনতে হাস্যকর শোনালেও এটাই সত্যি। আসলে নিজের চাইতে বেশি জ্ঞানী লোকের প্রেমে পড়া ভাল। এতে আর কিছু হোক না হোক, নিজের ক্ষমতাকে আরও বাড়ানোর অনুপ্রেরণা পাওয়া যায়, এর সাথে জীবনটাকেও অনেকটা চেনা হয়ে যায়। কিন্তু হায়! মানুষ স্বভাবগতভাবেই ভুলের দিকেই আকৃষ্ট হয়। সেই হিসেবে মানুষ কখনও ঠিক মানুষের প্রেমে পড়ে না। আপনি যার প্রেমে পড়বেন, প্রায়ই দেখা যায়, সে আপনার জন্য ভুল মানুষ, এবং সে আপনাকে সব ভুলিয়েই ছাড়বে!

একটা ছেলেকে অনেক ভালোবেসেছিলাম, সাথে তার প্রতি বিশ্বাসও ছিল যে সে কখনও বিশ্বাসঘাতকতা করবে না, কিন্তু নিয়তির কী খেল! যেটা ভেবে ভয় পেতাম, সেটাই ঘটেছে আমার সাথে, তা আবার এমন সময়, যখন বাবা হারিয়ে এতিম হয়ে আমি সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছি! যে মানুষটাকে পাশে পাবো ভেবেছিলাম, সে ওই সময় অন্য মেয়েদের সাথে সময় কাটানোতে ব্যস্ত ছিল। কীভাবে যে কেটেছে একএকটা সময়, তা এক আল্লাহ্‌ আর আমিই জানি! কেউ যখন কষ্টে থাকে, তখন একমাত্র সে ছাড়া আর অন্য কেউ সে কষ্টের প্রকৃত তীব্রতা কোনওভাবেই বুঝতে পারে না। যার কষ্ট, কেবল সে-ই বোঝে, কেমন যে লাগে, বাকিরা স্রেফ তা অনুমান করতে পারে! কথায় আছে না, বিপদ যখন আসে, তখন তা চারিদিক থেকে আসে……..এসবের ভেতরে কীভাবে যে অনার্স ফাইনাল একজামটা দিলাম, সে আমি ভাবতেও পারি না!

আমি এখন তাকে ভুলবার চেষ্টা করছি, তবু পারছি না। নিজেকে অনেক কষ্ট দিয়েছি, আর দিতে চাই না, যদিও তার সাথে আমার সম্পর্ক কখনওই খুব মসৃণ কিছু ছিল না। প্রতিনিয়তই সে আমাকে সন্দেহ করত। এমনকি আমার পরিবারের লোকজন, বান্ধবীদের সাথে সময় কাটানোও সহ্য করতে পারত না। সময়টা অনেক কষ্টে কেটেছে, তবুও মেনে নিয়েছি সবকিছুই; এমনকি, সে অনেক ভুল কাজ করেছে অনেকবারই, আমার সাথে সম্পর্কে থাকা সত্ত্বেও অন্য মেয়েদের সাথে সম্পর্কে জড়াতে চাইত, এসব আমি জানতে পারার পর প্রমাণসহ তাকে দেখালে সে ভুলস্বীকার করে ক্ষমা চেয়ে সুযোগ চাইল, আর আমিও তাকে সুযোগ দিই, কিন্তু সে এরপর যে কাজ করেছে, তা ক্ষমা করার মত নয়! যে সময়টাতে সে আমার পাশে থাকবে ভেবেছিলাম, সে সময়টায় তাকে আমার পাশে পাইনি, এখন সে আবার ক্ষমা চেয়ে সম্পর্কটা ঠিক রাখতে চাচ্ছে, কিন্তু আমি তাকে আর সুযোগ দিতে চাই না। এখন বড় সমস্যা হল, আমি নিজেকে কিছুই বোঝাতে পারছি না! ওকে ভালোবেসে একেবারে অবুঝ হয়ে গেছি। আমি যথেষ্ট বুদ্ধিমতি ও যুক্তিবাদী, কিন্তু আমি নিজের সাথে নির্বোধের মতন আচরণ করছি!

আমি অনেকটা মরার পথ থেকে ফিরে এসেছি যেন! পড়াশোনা প্রায় বন্ধই হয়ে যাচ্ছে। ৩ মাস ধরে ভার্সিটিও যাওয়া হয় না। ৬৭টা বিভিন্ন ট্যাবলেট আর ৮ বোতল সিরাপ আমি একসাথে খেয়েছিলাম ১মাস আগে। কিন্তু তাও মরলাম না! অনেক অসুস্থ হয়ে গেছি।

আমার খুব বাঁচতে ইচ্ছে করছে।

আমার না খুব কষ্ট হচ্ছে! আগে কখনও এমন জীবন কাটাইনি। অনেক দুষ্টু আমি—সারাদিন সবার মাথা খাই, আর খুব পেইন দিই। আর আজ আমি সেই মেয়েটা এমন কেন হয়ে গেলাম! একেবারেই চুপ হয়ে গেছি আমি! পুরো দিনে মিলে ৫টা শব্দও যেন মুখ থেকে বের হয় না! রাতদিন বিরতিহীনভাবে শুধু চোখে পানি ঝরতে থাকে। পানি ঝরতেঝরতে আমার চোখগুলো ভীষণ ব্যথা হয়ে গেছে। আমি যে এখন এইসব লিখছি, তাও পানি ঝরছে আর ঝরছে। মাঝেমাঝে ইচ্ছে করে চিৎকার করে কাদঁতে। তাও পারি না……কেন বড় হয়ে গেলাম!

কেন সবাই আমাকে বিয়ে দিয়ে দেয়ার জন্য এমন উঠেপড়ে লেগেছে? মানুষ কি ভুল করে না? কেন কেউ আমাকে একটুও বোঝে না? মেয়েরা প্রেমে পড়লেই কি অনেক বড় হয়ে যায়? আমি এখনও কত ছোট! আমার যে এখনও টপসজিন্স পরে আগের মত ঘুরতে ইচ্ছে করে সবার সাথে। মাথায় কাপড় দিয়ে, শাড়ি পরে বউ হয়ে থাকার মত বড় তো আমি এখনও হইনি। এটা কেউই কেন বুঝে না? এতো নিষ্ঠুর কেন হয়ে গেল সবাই? আমার যে এই বদ্ধ জীবনে দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, কেউই কেন এটা বুঝতে পারছে না? আমি যে এখনও সেই ছোট্ট মেয়েটিই আছি, কিন্ত কেন সবাই মিলে আমাকে জোর করে বড় করে দিচ্ছে? আমাকে বোঝার মত একটা মানুষও কেন পাঠালেন না আল্লাহ্‌?

আমি তাকে ভুলতে পারি না, ওর সাথে এখন যে মেয়েটি ঘোরে, ওকে সহ্যই করতে পারি না। আমি আমার বাসার লোকজনকে আমার মনটা বোঝাতে পারি না। আমি বাঁচব কীকরে? জীবনে কারও উপর আর নির্ভর করে নয়, একাই চলতে চাই, কিন্তু সেই সাহসটা যে পাই না……নিজেকে কীভাবে বুঝাব আমি!

পাদটীকা। ওপরের দৃশ্যকল্প অপরিচিত কোনও কিছু নয়। এমন অনেকেরই সাথে হয়। মেয়েটা এখন কী করবে? আমি বলি কী, এক কাজ করো, বোন। তোমার প্রাক্তন প্রেমিকের বর্তমান প্রেমিকাকে বুঝিয়েশুনিয়ে তোমাকে বোন হিসেবে গ্রহণ করতে রাজি করিয়ে ফেলো। এরপর তোমার প্রাক্তন প্রেমিককে রাজি করাও তোমাকে দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করতে। ব্যস্‌ হয়ে গেল! এরপর দুই বোন একসাথে সুখেশান্তিতে থাকো! কী? পারবে তো? বাসার লোকজন কেন তোমাকে বিয়ে দিয়ে দিতে চাচ্ছে, বোঝো না? তোমার বাবা নেই মানে হল, তোমার মাথার ওপরের বটগাছের ছায়াটা আর নেই। বোঝো না তুমি? পিতৃহীন সন্তানের অবুঝ হলে চলে না। একটু ধীর হও, নিজের আচরণে স্থিরতা আনো। পড়াশোনায় যে তোমার মন আছে, সেটা বাসার লোকজনকে তোমার কাজের মাধ্যমে দেখাও। তাহলে ওরা তোমাকে পড়াশোনা করতে দেবে। বিয়ে করে ফেলা কোনও সমাধান নয়। পড়াশোনা শেষ করো, নিজে কিছু একটা করো। সবার আগে নিজের জীবন। ওটাকে সুন্দর করার চেষ্টা করো। প্রেম-ভালোবাসা কখনওই জীবনের চাইতে বড় নয়।

ভাবনা: দুইশো পঁয়ষট্টি।

……………………………………..

আমি এখন ২৪+। একজন গৃহিণী, একজন ছাত্রী, একজন মা। ১১ বছর হল আমার বিয়ে হয়েছে, অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ। হাসবেন্ড একজন ঠিকাদার। বিয়ের আগে আমি পড়াশুনায় বেশ ভাল ছিলাম, ভাল গাইতে পারতাম, আবৃত্তি করতাম। বাবার আর্থিক অবস্থার আকস্মিক অবনতি ঘটায় আমাকে সায়েন্স নিতে দেয়া হল না, সায়েন্স পড়তে নাকি অনেক টাকা খরচ হয়। বাসা থেকে আর্টসে ভর্তি করানো হল, আর তখুনিই বিয়ে, মানে, ক্লাস নাইনেই! বিয়ের আগে কথা ছিল, শ্বশুরবাড়ি থেকে পড়াবে, এবং গানটাও কন্টিনিউ করতে দেবে। আমার বাবার শর্ত ছিল, বিয়ের দুবছরের মধ্যে কোনও বাচ্চা নেওয়া যাবে না। এইসব শর্ত মেনে বিয়ে হল। বিয়ের পর সবকিছু আচমকা পালটে যায়, ওরা আমাকে আর পড়ালেখা কন্টিনিউ করতে দিল না, ওদিকে এক বছরের মাথায় বাচ্চা নিতে হল, গান তো দূরের কথা! আমার মাথায় বাজ ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা! এভাবেই তিন বছর কাটল। তারপর আমি আমার বাচ্চাকে যে ডাক্তারের কাছে দেখাতাম, তাকে একদিন কথায়কথায় বলেছিলাম, আমি পড়তে চাই, কিন্তু বাড়ি থেকে পড়তে দেয় না, আর বেরোতেও দেয় না, কারও সাথে মিশতেও দেয় না। তখন তিনি আমাকে ওপেনে এসএসসি প্রোগ্রামে ভর্তি করিয়ে দিলেন, এবং একটা গাইডবই কিনে দেন, কিন্তু সে পড়াটাও আমার জন্য সহজ হল না। বাসায় পড়াশোনা করা অ্যালাউড না, তাই রাত্রে সব কাজ সেরে সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর পড়তে হতো। অংক আর ইংরেজি কিছুই বুঝতাম না, সব সাবজেক্টই তিন মাস টেস্টপেপারস পড়ে অনেকটা বুঝে, না বুঝে মুখস্থ করেছিলাম। তাও সেই তিনমাসে প্রতিদিন পড়তে পারতাম না। প্রতি বৃহস্পতিবার বাপের বাড়িতে বেড়াতে যেতাম, আর শুক্রবার থেকে শনিবার বিকেলের মধ্যে শ্বশুরবাড়িতে ফিরে আসতে হত। এভাবে পরীক্ষা দিলাম। রেজাল্ট আসল ৩.৭৫।

আমার এসএসসি পাসের খবরে হাসবেন্ড প্রথমে রাগারাগি করলেও পরে মত দেয় পড়ার ব্যাপারে। আবার তার বাবার কাছ থেকেও মত নিতে বলে, আর সেখানেই গণ্ডগোলটা বাঁধে। আমার শ্বশুরমশায় বলেন, দেখি ভেবেচিন্তে! এই-সেই করে উনি ভর্তির টাইমটাই পার করে দেন! আমি খুবই হতাশ হয়ে পড়ি, এরপর এক রাজনৈতিক নেতাকে ধরে প্রাইভেট কলেজে অ্যাডমিশন নিই। মিউজিক সাবজেক্ট নিয়ে ইন্টারমেডিয়েট পাস করি। আমার কোনও ধরনের প্রাইভেটে যাওয়া বারণ ছিল, বাসায় নিজেনিজেই বই, গাইড আর ইন্টারনেট থেকে পড়তাম। রেজাল্ট আসে ৩.৯২। মিউজিকে এপ্লাস ছিল। ভেবেছিলাম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মিউজিক ডিপার্টমেন্ট পড়ব। প্রস্তুতি নেয়া শুরু করি। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমার পিছু ছাড়ল না।

২০১৬ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির নিয়মে পরিবর্তন আসে। সনাতন, আর ওপেন থেকে যারা এসএসসি, এইচএসসি পাস করেছে, তারা ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবে না। মাথায় বাজ পড়ল! তবুও নিজেকে শান্ত করলাম এই বলে যে অন্য কোনও বিষয় নিয়ে অনার্স পড়ব। খোঁজ নিয়ে দেখি, সেখানেও একই অবস্থা, ন্যাশনালেও পড়া যাবে না। ভেঙে পড়লাম ভীষণভাবে। আমি পরীক্ষা দিতে যাওয়ার দিনে ভোরে উঠেই সকালের নাস্তা, দুপুরের রান্না, সব সারতে হত, বাড়ির সব কাজকর্ম শেষ করতে পারলেই আমার শাশুড়ি আমাকে পরিক্ষা দিতে যেতে দিতেন। যখন এইচএসসি’তে পড়ি, তখন আমাদের বাসার সব কাজের লোককে বিদায় করে দেয়া হয়েছিল, যাতে আমি কাজের চাপে পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হই। কখনও দুপুরে রেস্ট নিতে দেয়া হত না, শোবার ঘরে একটু আসতে দেখলেই, উনারা ফোঁস করে উঠতেন—তুমি লেখাপড়া করতেসো, তোমার বিলাসি সখ পূরণ করতেসো, আবার এতো আরাম কীসের? একেবারে ঘরে আসতে-আসতে রাত ১২টা, কোনও দিন তারও বেশি বেজে যেত। কান্না করার জন্য স্বামীর বুকটাও ছিল না মাথার নিচে, বা সান্ত্বনা দিয়ে শক্তি যোগানোর মতো তার হাতটাও ছিল না আমার মাথার উপর। আমার দিকে তার কোনও খেয়ালই ছিল না, শুধু শরীরের ক্ষুধা মেটাতেই আমার কাছে আসত। এভাবে চলতেচলতে একসময় আমার মানসিক চাপ খুব বেড়ে যায়, দিনরাত সবসময়ই কাঁদতে থাকতাম, তবু যেন কেউ দেখেও দেখত না! খেতে পারতাম না, ঘুমাতে পারতাম না। একসময় আমার কিছু মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। ২০১৪ সালের শেষের দিকে বাবা এসে আমাকে নিয়ে যায়। তারপর বগুড়ায় পরিতোষ ঘোষের কাছে চিকিৎসা করানোর পর আমি সুস্থ হই, এইচএসসি দিই।

২০১৬’তে আমি যখন দেখলাম কোথাও অ্যাডমিশন হচ্ছে না, খুব কষ্ট পেয়েছি, কারণ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার মত সামর্থ্য বা সুযোগ, কোনওটাই আমার নেই। এইচএসসি’তে কিছু বাচ্চাকে প্রাইভেট পড়াতাম, সে টিউশনির টাকা দিয়েই কলেজের খরচ আর বই-খাতাপত্রের যোগান দিই, কিন্তু ওইটুক সামান্য টাকায় তো আর প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ চলে না। কী করব, কিছুই মাথায় আসছিল না। শুধু মনে হচ্ছিল, মরে যাই! সেই তীব্র চাপ আমি কোনওভাবেই সহ্য করতে পারছিলাম না, তারপর আগপিছ না ভেবেই সতেরোটা ঘুমের ওষুধ খেয়ে ফেলি। ভেবেছিলাম, মানুষ তো বাঁচেই আশা নিয়ে, তো জীবনে কোনও আশা না থাকলে বেঁচে থেকে কী লাভ? সে যাত্রাতেও বেঁচে যাই! এরপর ভাবলাম, জীবনটা এভাবে নষ্ট করব? তারপর সিদ্ধান্ত নিলাম, থাক, অন্য কিছু করব। মেকআপ নিয়ে ভাবলাম, তখন আমার যতটুকু গহনা ছিল চুপ করে রাখা, তা বিক্রি করে ঢাকায় পার্সোনা থেকে ব্রাইডাল মেকআপের কোর্স কমপ্লিট করি এবং পাশাপাশি চেষ্টা করি, উপরমহলের কারও সাথে যোগাযোগ করার। তখন একজন মানুষ পাই যিনি ছিলেন রাজশাহী জেলার প্রাক্তন ডিসি, ওইসময় তাঁর প্রোমোশন হয়েছিল, একটা কালচারাল প্রোগ্রামে তার সাথে আমার পরিচয় হয়। তাঁকে আমি আমার সমস্যা বলি। তিনি আমার কাগজপত্র নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর সাথে কথা বলেন, এবং আমাকে এই বলে আশ্বস্ত করলেন, “আপনি আপনার লক্ষ্য ঠিক রাখুন, আর এতটুকু জেনে রাখুন যে আপনি পড়বেনই আর সেটা ন্যাশনালেই।” স্যারের কথায় মনে অনেক সাহস পাই। আমাকে ওই সামান্য সাহস দেয়ার জন্যও তখন পাশে কাউকেই পাইনি।

পরে কোর্সটা শেষ করে বাড়ি ফিরি। এর কিছুদিন পর ডিগ্রির সার্কুলার দেয়, আর ওটাতে তখন অ্যাপ্লাই করি। আমি রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে ব্যাচেলর অফ মিউজিক-এ পড়ছি, আর পাশাপাশি ওপেনে বিএ কোর্স করছি। এর মাঝে যা সমস্যা, তা হল, আমার বাসা থেকে বের হওয়া, বিশেষ করে, কলেজে যাওয়া পারমিট করা হচ্ছে না, স্যারদেরও আমার বাসা থেকে এমনভাবে বোঝানো হয়েছে যে উনারা আমাকে ক্লাস করতেও দেন না, আর বাসায় আমাকে এতোটাই কাজের চাপে রাখা হয়েছে যে শরীরে কোনও শক্তিই পাই না, আমার গলা প্রায় ভেঙে গেছে, গাইতে পারি না। সবদিক থেকেই প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। আবার ওদিকে আমার বাচ্চাকে পড়ানো, টিউশনি করা, রান্নাবান্না করা, বাড়ির সকল গেরস্থালি কাজকর্ম, বাজারহাট সবই একার হাতে করতে হয়। আমি অবসরে বই পড়তে ভালোবাসি, সেটাও আমার শ্বশুরবাড়ির কারও পছন্দ নয়। আমি মনের কথাগুলি বলব, আমার এমন কোনও মানুষ নাই। আমি আবৃত্তি করি, বাচ্চাকে নিয়ে আবৃত্তি ক্লাসে যাই, এটা নিয়ে আমাকে খোঁটা শুনতে হয়। আমি আর্ট করি, পরিবারের মতের বিরুদ্ধে বাচ্চাকে আর্টের ক্লাসে নিয়ে যাই। আমি ছবি আঁকি যখন বাড়ির সব লোক ঘুমায়, তখন। মনখারাপ হলে মাঝরাতে ব্যাল্কনিতে বসে বই পড়ি। বই পড়লে মন কিছুটা শান্ত হয়।

আমি আমার এই পৃথিবী থেকে পালাতে পারব না। এর মধ্যেই আমাকে সুন্দরভাবে বাঁচতে হবে। আমি এইসব পরিস্থিতি থেকে সরে কিছু করতে চাইও না, তবে কীভাবে করব, কীকরে নিজেকে তৈরি করব, বুঝতে পারি না। আমার খুব ইচ্ছা, অসহায় মহিলা আর শিশুদের জন্য কিছু করার, একজন আদর্শ নারী হয়ে ওঠার। আমি নিজেকে এমনভাবে গড়তে চাই, যেন আমাকে দেখে অন্য অসহায় মেয়েরা মনে জোর পায়, কেউ যেন হাল ছেড়ে না দেয়, প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে সামনের দিকে এগিয়ে যায়; কিন্তু কীভাবে যে তা করব, সেটাই আমি বুঝে উঠতে পারছি না………

ভাবনা: দুইশো ছেষট্টি।

……………………………………..

ক্যারিয়ার তো শেষই! এখন স্রেফ বেঁচেথাকা, আর কিছুই নেই জীবনে! আমি চাই না, একটা ছেলের জন্য আমার জীবনটা এভাবে নষ্ট হয়ে যাক! আমি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছি, কিন্তু আমি ভালভাবে বাঁচতে চাই! আমি জানি, আমার কোনও যোগ্যতা নেই, কিন্তু আমি যোগ্য হতে চাই।

এক বছর প্রায় শেষ ইন্টারের। মাইলস্টোন কলেজে যখন ভর্তি হই, তখন একটা ছেলেকে ভাল লেগে যায়। সে ভাল স্টুডেন্ট, পড়াশোনায় মনোযোগী। মাঝেমাঝে ডিরেক্টর স্যার আর ক্লাস টিচাররা আম্মুকে ডেকে নিয়ে আমার সামনেই বলতেন, মেয়েটার যত্ন নেন, ও ভাল কিছু করতে পারবে। আমার এসএসসি’র পয়েন্ট ৪.৮৯। আমি জানি, এটা অনেকের চোখেই খারাপ রেজাল্ট। রেজাল্ট ভাল করার জন্যই হয়তো ইন্সটিটিউশন বদলানো, পাবনা ছেড়ে ঢাকায় আসা। আজও ভাবলে অবাক লাগে, আমার রেজাল্ট শুনে আমার স্কুলের স্যাররা পর্যন্ত কেঁদেছিলেন। তাও ভেবেছিলাম, যা হওয়ার হয়ে গেছে, এখন তো আর কিছু করা যাবে না, আমি আগামী দুই বছর ভালভাবে পরিশ্রম করলে নিশ্চয়ই ভাল কিছু করতে পারব।

কিন্তু সব এলোমেলো হয়ে গেল! জীবনটাই ওলটপালট হয়ে গেল! স্বপ্নগুলি হঠাৎ করে কেমন জানি ধোঁয়াশা হয়ে গেল! কিছুই ভাবতে পারতাম না। রাজউক কলেজের একটা ছেলে লাইফে আসে, ওকে অ্যাক্সেপ্ট করাটাই লাইফের সবচাইতে বড় ভুল ছিল। অসময়ের প্রেম সময়ের সব সম্ভাবনাকে নষ্ট করে দেয়, জীবনটাই ধ্বংস করে দেয়! অল্প বয়সের প্রেম মানেই নিজেকে ক্রমেই শেষ করে দেয়ার এক মনোরম ফাঁদ।

প্রথমপ্রথম কয়েকদিন সবই ঠিকঠাক চলল। একদিন কোনও কারণ ছাড়াই ও আমাকে ছেড়ে চলে গেল! ওর নাকি আমাকে এখন আর ভাল লাগে না, অন্য কার জানি প্রেমে ও এখন মাতোয়ারা। মানলাম, আমাকে ওর আর দরকার নেই। ঠিক আছে। কিন্তু যাওয়ার আগে আমার সব স্বপ্ন ধ্বংস করে দিয়ে চলে গেল। ছোটবেলা থেকে আমার স্বপ্ন ছিল, দেশের সেরা ৩টা মেডিক্যাল কলেজের যেকোনও একটাতে পড়ব।

ও যাওয়ার আগে আমাকে বলে গেল, আমি নাকি খারাপ, আমার নাকি অন্য মেয়েদের ফলো করা উচিৎ, আমার মা-বাবার নাকি কপাল খারাপ কারণ আমি ওদের মেয়ে, আমার লাইফ পার্টনার যে হবে তার নাকি লাইফই শেষ! আমি ওর কথাগুলি শুনে কিছুই মাথায় আনতে পারছিলাম না। কয়েকদিন আগেও তো আমি ওর কাছে পৃথিবীর সবচাইতে ভাল মানুষ ছিলাম, সব থেকে বড় কথা, যখন ও জেনেছিল আমার স্বপ্ন ঢাকা মেডিক্যালে পড়া, তখন এমনভাবে আমাকে বিদ্রূপ করেছিল যে মনে হচ্ছিল, আমার বুঝি কোনও অধিকার কিংবা যোগ্যতাই নেই স্বপ্ন দেখার। যাওয়ার আগে শেষ কথা বলেছিল, তুই গ্রামের মেয়ে, গ্রাম থেকে ঢাকায় এসেছিস, খ্যাত্‌-আনস্মার্ট, পড় ভাল করে!…….ওর কথার ধরনে একটা ঘৃণ্য হাসি আর তাচ্ছিল্য লুকিয়ে ছিল। এ ঘটনার পর আমার বারবারই মনে হচ্ছিল, আমার বুঝি আর বাঁচার অধিকার নেই!

প্রায়ই মনে হত, হ্যাঁ, আমিই বুঝি খারাপ! নিজের উপর ঘৃণা হত। কান্না ছিল আমার নিত্য সঙ্গী। আম্মু-আব্বুকে কিছু বুঝতে দিইনি, কারণ আমি আমার পরিবারের একমাত্র মেয়ে, সবাই অনেক আদর করে আমাকে। আমার দুই খালামণি আর তিন মামার সবাই শিক্ষিত, একমাত্র আম্মুই তেমন পড়াশোনা করেননি। আম্মু আমার জন্য অনেক কষ্ট করেছেন, আমাকে নিয়ে উনি অনেক স্বপ্ন দেখেন। আমার ইচ্ছা, আমি আম্মুর স্বপ্ন পূরণ করব। আম্মু চান, উনি জীবনে যা করতে চেয়েছেন কিন্তু করতে পারেননি, উনার মেয়ে তা করে দেখাবে। কেবল আমার জন্যই আমার আম্মু অনেক কষ্ট করে পনেরো দিনের মধ্যে পাবনা থেকে ঢাকায় শিফট করেন। আমার পড়াশোনায় যাতে কোনও বিঘ্ন না ঘটে, তার সকল ব্যবস্থাই আম্মু করে দিয়েছেন। মাইলস্টোনে হোস্টেল আছে, কিন্তু আমার সুখের জন্যই আম্মু ঢাকায় বাসা নিয়ে চলে এসেছেন।

আমার আম্মু এখানে একটা ছোটখাটো চাকরি নিয়েছেন আমার পড়াশোনার খরচ চালানোর জন্য। অফিস থেকে ফিরেই সেলাই করতে বসেন, সেখান থেকেও কিছু আয় হয়। আম্মুকে সারাদিনই হাড়ভাঙা খাটুনি খাটতে হয়। আম্মু এটা করছেন যাতে আমি ভাল থাকি, শুধুই এজন্য। অথচ, আমি এ কী করলাম! কলেজে আমাদের শায়লা মিস, যিনি আমাকে ক্লাসের সব থেকে ভাল মেয়ে ভাবতেন, আমি উনার বিশ্বাসের কী মর্যাদা দিলাম! আমি সবার স্বপ্ন ভাঙলাম, সবার আশা ভাঙলাম। একটা ছেলে আমার পুরো লাইফটাকে শেষ করে দিয়ে চলে গেল! একটা ভাল স্টুডেন্ট দিনদিন খারাপ স্টুডেন্ট হয়ে গেলে তার নিজের এবং আশেপাশের সবার যে কেমন লাগে, তা সহজেই অনুমান করা যায়।

আমি সবকিছু শেষ করে দিতে চেয়েছিলাম। ভাবতাম, আর বাসায় ফিরব না, রাস্তা পার হওয়ার সময় ট্রাকের নিচে লাফিয়ে পড়ব। কিন্তু আমি তা করতে পারিনি, বারবার আম্মুর মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠত। আমার খুব বাঁচতে ইচ্ছে করে, স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে করে, আম্মুর স্বপ্ন পূরণ করতে ইচ্ছে করে, আব্বু-আম্মুকে খুশি দেখতে ইচ্ছে করে। আমি এমন কেউ হতে চাই, যাকে একসময় একজন মানুষ খারাপ বলেছিল বলেই সে পুরো পৃথিবীর কাছে ভাল হয়ে গেছে!

আমার কিছু কথা। শোনো মেয়ে, এ বয়সে প্রেম করলে লাইফ তো শেষ হবেই। খুবই স্বাভাবিক! আল্লাহ্‌কে ধন্যবাদ দাও যে, দেরি হওয়ার আগেই ওইসব ফালতু প্রেমভালোবাসা থেকে মুক্তি পেয়েছ। এতো অল্প বয়সের প্রেম শেষ পর্যন্ত টিকে যাওয়ার সম্ভাবনা ০.০১% বা তারও কম, যদিও প্রেম করার সময় সবারই মনে হয়, এটাই তো জীবন! ওই প্রেমটা করতে থাকলে কিছু সময় নষ্ট হত আর তুমি তোমার স্বপ্ন থেকে ক্রমশই দূরে সরে যেতে। ম্যাট্রিক-ইন্টারে প্রেম করে জীবনে ভাল কিছু করতে পেরেছে, এমন স্টুডেন্টের সংখ্যা অতি অতি অতি নগণ্য। আচ্ছা, প্রেম করার সময় তো জীবনটাকে রঙিনই মনে হত, তখন তো আর জীবনটাকে এমন ধূসর মনে হয়নি, তাই না? গাধা কোথাকার! জীবন বরং এখনই রঙিন! বড় বাঁচা বেঁচে গেছ! অল্প বয়সে এসব প্রেমট্রেম অতি থার্ডক্লাস জিনিস, পড়াশোনা ফেলে সময় নষ্ট করার ধান্দা। পড়াশোনা করো। তোমার জন্য তোমার ফ্যামিলি এতো কষ্ট করছে, আর তুমি কিনা পড়াশোনা না করে ভেসে বেড়াচ্ছ প্রেমসাগরে! লজ্জাও করে না তোমার? ছিঃ! তোমাকে জন্মদেয়ার শাস্তি দিচ্ছ তোমার আম্মুকে? পাঠ্যবইয়ের পড়া, অবসরে গল্পের বই, এক্সট্রা-কারিকুলাম অ্যাক্টিভিজ………এইসব ঠিকমতো করারই তো সময় পাওয়া যায় না, ওইসব প্রেম-মহব্বত করার আজাইরা সময় পাও কোথায় তোমরা? ঢাকা মেডিক্যালে পড়ার স্বপ্ন দেখছ, ভাল কথা। তা এরকম পড়াশোনা না করে ঢ্যাংঢ্যাং করে ঘুরে বেড়ালে তোমার চেহারা দেখে মেডিক্যালে ভর্তি করাবে তোমাকে? বেসিক স্ট্রং করার চেষ্টা করো, আজকাল এপ্লাস গরুগাধারাও পায়। ঢাকা মেডিক্যালে পড়তেই হবে, ওখানে পড়তে না পারলে জীবন শেষ হয়ে যাবে, এমন না। যারা জীবনে খুব সফল হয়েছে, ওরা সবাই ঢাকা মেডিক্যালের স্টুডেন্ট ছিল না। অনার্সে কোথায় পড়বে, সেটা সময়ই বলে দেবে। কিন্তু ইন্টারে ফাঁকি দেয়া যাবে না, পড়াশোনা করতে হবে ঠিকভাবে। ইন্টারে ফাঁকি দেয়ার মানেই হল জীবনের সমস্ত সম্ভাবনাকে নিজের হাতে খুন করা। নাউ দ্য চয়েজ ইজ ইয়োরস্‌। এইসব অল্প বয়সের ভালোবাসার দুই পয়সারও দাম নাই। এই বয়সের প্রেম মানেই স্লেভারি টু ইয়োর ইম্যাচিউর ইমোশনস্‌—স্রেফ ফালতু কাজে টাইমপাস।