ভাবনাদেয়ালের পলেস্তারা (৩৯শ অংশ)

ভাবনা: দুইশো সাতষট্টি।

……………………………………..

ছোটবেলা থেকে স্টুডেন্ট হিসেবে আমি খুব একটা খারাপ ছিলাম না। সবসময় ভাল রেজাল্ট করার কারণে আমার কাছ থেকে সবার প্রত্যাশাটাও বেশি ছিল। পরাজয়ের গ্লানি যদি ভোগ করতে পারি, তবে জয়ের আনন্দ উপভোগ করার সুযোগটা কেন আমি পাব না? যদি পরিবারের কাছেই ভুল করার অধিকারটুকু না পাই, তবে আমি কোথায় যাব? এসএসসি’তে গোল্ডেন এপ্লাস পেয়েছিলাম। এরপর ইন্টারে উঠে অন্য শহরের একটা কলেজে ভর্তি হই। পড়াশোনা ছেড়ে দিই বললেই চলে! সারাদিন ঘোরাঘুরি করতাম, আড্ডাবাজি করে সময় কাটাতাম। জীবনটাকে দারুণ রঙিন মনে হত। ওই বয়সে বাসা থেকে দূরে গেলে যা হয় আরকি! যে বয়স স্বাধীনতার দায় বোঝার বয়স নয়, সে বয়সে পরাধীনতাই ভাল। যখন পদযুগল অবাধ ও অবাধ্য, তখন শেকলই মনোরম অলংকার।

ফার্স্ট ইয়ারের প্রথমদিকে একজনের সাথে সম্পর্ক তৈরি হয়, যা ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে উঠতেই ভেঙে যায়। পুরো এক বছর পড়াশোনা করিনি বললেই চলে। সেকেন্ড ইয়ারে আমি ভাল করে পড়ালেখা শুরু করেছিলাম, ফার্স্টটার্মে ভাল রেজাল্ট আসে, কিন্তু তখন বাবা কোনওভাবে আমার পুরনো সম্পর্কটির কথা জানতে পারেন। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন, সম্পর্কটি তখনও আছে, আমাকে জোর করে বাসায় নিয়ে যান, এবং বিয়ে দিয়ে দেয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন।

বাবা অবশ্য আগে থেকেই আমার উপর বিরক্ত ছিলেন। উনি চেয়েছিলেন, আমি সিএ পড়ি, তাই এসএসসি’তে সায়েন্সে পড়লেও এইচএসসি’তে অনেকটা জোর করে কমার্সে ভর্তি করিয়ে দেন। কিন্তু আমার অ্যাকাউন্টিং করতে ভাল লাগে না। আমি প্রায়ই এ ভেবেভেবে বিরক্ত থাকতাম যে আমি যে সাবজেক্ট নিয়ে পড়াশোনা করছি, সে সাবজেক্ট আমার একটুও ভাল লাগে না। বাবার সাথে এ নিয়ে আমার প্রায়ই মানঅভিমান চলত। সবাই আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে শুরু করল, আমি নাকি পড়াশোনা করি না, কিন্তু আমি ওদের কীভাবে বোঝাবো যে এসব আমার জন্য নয়! বাবা, কাকা, বন্ধুবান্ধব সবাই আমাকে কেবল কথা শোনায় সরাসরি কিংবা ঘুরিয়ে। আমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না, আমি জীবনে আর কিছু করতে পারব না, এইসব বলে। ফ্রেন্ডদের সাথে দেখা হলে বলে, এ মেয়ে একদিন ভাল স্টুডেন্ট ছিল, এখন মাথা নষ্ট হয়ে গেছে। এসব শুনলে খুব বেশি কষ্ট হয়। বাবাও বলেন, তুমি অনেক পড়েছো আর পড়তে হবে না, এখন বিয়ে করো। ওদের কাউকে বোঝাতে পারি না, আমি বিয়ে করতে চাই না, আমি পড়াশোনা করব। আমি শুধু চাইতাম, যারা আমাকে সবসময় বেশি কথা শোনায়, তাদের বুঝিয়ে দিতে, আমি আদৌ তাদের কথার মত সস্তা কি না! ওরা বড়বড় কথা বললে খুব কষ্ট হত! কেন আমাকে বিয়ে করতে হবে এখনই! বিয়ে করবার মত মানসিক বয়স আমার এখনও হয়নি। খুব ইচ্ছে করত, মরে যাই! কেন সবাই বলছে, আমি আর কিচ্ছু করতে পারব না?

এসবের কারণে ইন্টারের রেজাল্ট খুব খারাপ হয়—৩.৩৮। পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছিলাম পরিবারের উপর রাগ করে। কোনও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাইনি। পরিবারের সবার অপ্রিয় হয়ে গেলাম। সবার থেকেই দূরে সরে গেলাম। বাবা আমায় আর পড়াবেন না বলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, পরে ওরা ওদের পছন্দ অনুযায়ী ল’তে একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দেয়। ঢাকায় আসার পর অনেক বেশি একা হয়ে পড়ি। আমার বাবা-মা আমার সাথে কথা বলেন না। মা তো অনেক কাঁদেন আমার ব্যর্থতার জন্য, আমি তাদের স্বপ্ন পূরণ করতে পারিনি। অল্প বয়সের একটা প্রেমের কারণে আমার জীবনটাই নষ্ট হয়ে গেল! বাবা মাসে একবার আমাকে ফোন করেন, যখন টাকা পাঠান, তখন। তাও কখনও আমার সাথে ভাল করে কথা বলেন না। আমি ছোটবেলা থেকে কখনও একা থাকিনি, আর ঢাকায় আসার পরে আমি ভীষণ একা হয়ে যাই, বাসা থেকে কেউ আমার খবর নেয় না। প্রেম করার অপরাধে বাবা-মা ছাড়াও অন্য যারা আমার উপর খড়গহস্ত হয়েছিলেন, তারা আমার অস্তিত্ব সম্পর্কে আদৌ জানেন কি না, সন্দেহ! আমাদের সমাজে তারাই আমাদের বেশি কথা শোনায়, বেঁচে থাকার জন্য যাদেরকে আমাদের তেমন লাগে না।

আসলে কেউ আমাকে ভালোবাসে না, আমি প্রতিদিন বাবা-মায়ের ফোনের জন্য অপেক্ষা করি, কিন্তু ফলাফল শূন্য! মা মাঝেমাঝে ফোন দেন, কিন্তু ভাল করে কথা বলেন না, আমার পড়াশোনার কোনও খবর নেন না, আমি খেয়েছি কি না, সুস্থ আছি কি না, কোনও সমস্যা হচ্ছে কি না, তেমন একটা জিজ্ঞেস করেন না। আমার উপর কারও কোনও বিশ্বাস নেই। কারণ, আমি ইন্টারে খুব খারাপ রেজাল্ট করেছি, ইন্টারে পড়ার সময় আমি আমাকে বিয়ে করাতে দিইনি।

একাকীত্ব আমাকে ভীষণভাবে গ্রাস করে নেয়। আমি একটা মেস বাসায় থাকি, নিজেকে সবসময়ই গুটিয়ে রাখি। বড় সমস্যা হচ্ছে, আমার আশেপাশের সকলেই আমাকে সবসময় ডমিনেট করতে চায়। হতাশা, একাকীত্ব, পিছুটান—সব মিলিয়ে প্রথম বছরের রেজাল্ট খারাপ হল, দ্বিতীয় বছরে এসে বুঝলাম, পড়তে হবে, নাহলে আবারও রেজাল্ট খারাপ হবে। বাসার উপর রাগ করে টিউশনি করতে শুরু করি, তখন থেকে ভার্সিটির টাকা বাসা থেকে নিই না, রেজাল্টও ভাল হয় কিছুটা, কিন্তু এসজিপিএ বাড়লেও সিজিপিএ বাড়ে না।

রেজাল্ট ভাল হলে কিছু আত্মবিশ্বাস এমনিতেই চলে আসে; আমারও এলো। অন্যরা সমীহ করতে শুরু করল। কিন্তু আমি কোনও শান্তি পাই না, যেখানে পরিবার নেই, সেখানে সুখ থাকে না। এছাড়াও নানান সমস্যা তো আছেই—পারিপার্শ্বিক সমস্যা। আমি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছি, কতকত যে কাঁদি, কেবলই কাঁদি, তার কোনও হিসাব নেই, কিন্তু কোনও স্বস্তির জায়গা কোথাও খুঁজে পাই না।

যেহেতু আমি মেয়ে, কাজ ছাড়া বাইরে বের হই না, বলতে গেলে প্রায় সময় রুমেই থাকি, আমি নামাজে বা এমনি কখনও কেঁদে ফেললে আমার রুমমেট, পাশের রুমের মেয়েরা ভীষণ বাজে মন্তব্য করে; কেউ বলে বয়ফ্রেন্ড খেয়ে ছেড়ে দিসে, নয়ত এত বিষণ্ণ কেন? আরও বাজে কথাও ওরা বলে। লোকে অন্যদের নিয়ে বাজে কথা বলতে বড় ভালোবাসে; এমনভাবেই বলে, যেন ও নিজে একমাত্র শুদ্ধ মানুষ! ওদের কথা শুনলে আরও বেশি খারাপ লাগে। অপ্রিয় সত্য মেনে নেয়া যায়, কিন্তু অপ্রিয় মিথ্যা কেমনে মানি?

কিছুদিন ধরে আমার শ্বাসকষ্ট হয় বলে ডাক্তার দেখিয়েছি; উনি ইসিজি করাতে বলেছেন। এটা করাতে আমার লজ্জা লাগে, তাই এখনও করাইনি, কিন্তু পাশের মেয়েরা খুব খারাপ মন্তব্য করে এটা নিয়ে, আমি নাকি আসলে প্রেগন্যান্ট, আমার নাকি শরীর খারাপ কোনও গোপন কারণে, ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব শুনলে খুব লজ্জা লাগে।

এই পৃথিবী আমার জন্য নয়। প্রায়ই মনে হয়, মরে গেলে হয়ত বেঁচে যাব।

একটা ব্যর্থ প্রেম পুরো জীবনটাকেই ব্যর্থ করে দিল যেন!

ভাবনা: দুইশো আটষট্টি।

……………………………………..

আমি একটা পাবলিক ভার্সিটিতে পড়ছি। এবার থার্ড ইয়ারে উঠবো। মেডিক্যাল অ্যাডমিশন কোচিং করার সময় ফোনে এক ছেলের সাথে পরিচয় হয় ২০১৪ সালের শেষের দিকে, আস্তেআস্তে ২০১৫’তে তার সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ি। ওই সময়ে পড়াশোনা না করায় দুটো গোল্ডেন এপ্লাস নিয়েও কোনও মেডিক্যালে চান্স পাইনি। যা-ই হোক, ওর সাথে এখনও রিলেশন আছে। দূরত্বের কারণে আমাদের এখনও দেখা হয়নি। কাজের জন্য ও অনেক দূরে থাকে। দেখা করার জন্য আমি ওকে খুব একটা জোর করিনি কখনও, তবে আমার প্রতি ওর ভালোবাসাটা আসলেই কেমন, কিংবা আদৌ ওর আমাকে বিয়ে করার ইচ্ছে আছে কি না, তা জানার জন্য ওকে একবার মিথ্যে বলেছিলাম যে আমার বিয়ে ঠিক হচ্ছে, তখন ও বলেছিল যে পরেরদিনই ও আসবে। এরপর আরও কিছু পসেসিভ কথা বলে আমার ব্যাপারে। এসব শুনে আমি অনেকটা নিশ্চিত হই যে ও আসলেই আমার ব্যাপারে সিরিয়াস। এরপর থেকে সম্পর্কটা আমার কাছে আরও বিশ্বস্ত ও গভীর হয়। আমরা ভিডিও কলে কথা বলতাম, এবং ওর ইচ্ছেমতই বলতাম, মানে, ও যা করতে বলতো, তা-ই করতাম। আমরা সব ব্যাপারেই অনেকটা স্বামীস্ত্রীর মত অবাধে কথা বলেছি।

একদিন কী মনে করে যেন একটা ফেইক আইডি খুলে ফেসবুকে ওকে নক দিই। ওকে বিশ্বাস করাই যে আমি একটা মেয়ে এবং একটা বিশেষ সমস্যার কারণে আমি এই ফেইক আইডি থেকে ওর সাথে কথা বলছি। কিছুদিন সেই আইডি থেকে ওর সাথে কথা বলার পর দেখলাম, ও আমার সাথে যেরকম করে সব ব্যাপারেই অবাধে কথা বলে, ঠিক একই স্টাইলে ওই ফেইক আইডি’র মেয়ের সাথেও ও কথা বলছে। তবে, ওই মেয়ের সাথে সে সেক্স সম্পর্কিত কথা বলতো না। এসব ব্যাপার আমি ওকে পরে জানাই, ও অস্বীকার করে। এরপর স্ক্রিনশট দিয়ে দেখানোর পর ও ভুল স্বীকার করে নেয়, আমার কাছে মাফ চায়, আমিও ওকে বিশ্বাস করে মাফ করে দিই। ওর ফেসবুক পাসওয়ার্ডটা চাইলাম, ও দিল না। আমিও অবশ্য ওকে আমার পাসওয়ার্ড কখনও দিইনি। ও মাঝেমধ্যে আমার কাছে টাকা চায়, আমি এ ব্যাপারে কখনও খুব একটা প্রশ্রয় দিইনি।

এভাবেই চলছিল। হঠাৎ ফেসবুকে একটা ছেলের সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়, আমরা দেখাও করি। আস্তেআস্তে ফেসবুকেই ওর সাথে খুব ভাল একটা সম্পর্ক তৈরি হয়। আমি আমাদের এ সম্পর্ককে স্রেফ বন্ধুত্ব হিসেবে দেখলেও ওই ছেলেটা ভাবতে থাকে যে আমি ওকে ভালোবাসি। ওকে যে আমি ভালোবাসি না, এটা আমি ওকে সরাসরিই বলে দিই, কিন্তু এরপরও ও আমার সাথে সম্পর্কটা চালিয়ে যায়, আমার নানান প্রয়োজনে ও আমাকে আর্থিকভাবে সহায়তা করতে থাকে, প্রায়ই আমার বিকাশে টাকা পাঠিয়ে দেয়। ও বলে, আমাকে ভালোবেসো না, শুধু মুখে এইটুকু বলো যে তুমি আমাকে ভালোবাসো, ওতেই হবে। আমি যে অন্য একজনকে ভালোবাসি, সে কথাটা কেন জানি না, ওকে কোনওভাবেই কখনও বলতে পারি না। ও আমার পায়ে পর্যন্ত ধরে অনুরোধ করে যাতে আমি ওকে ভালোবাসি। এমনকি আমার ফোন ওয়েটিং-এ পেলে ও অনেকবেশি আপসেট হয়ে যায়। ওর ফেসবুক পাসওয়ার্ডও আমাকে দিয়েছে।

আমার কষ্টটা এখানেই যে, আমি যাকে ভালোবাসি, সে কেন আমাকে তার পার্সোনাল কোনওকিছু দিতে পারে না? আমার বয়ফ্রেন্ডের এর আগেও একটা রিলেশন ছিল, ওই মেয়ের সাথে ব্রেকাপ হওয়ার কিছুদিন পর আমার সাথে পরিচয়, কিন্তু আমার সাথে রিলেশন করার সময় ও আমাকে এটা বলেনি। আমার বয়ফ্রেন্ড আমাকে কোথাও যেতে দিতে চায় না, কিন্তু ও নিজে যেখানে খুশি সেখানে যায়, এবং কোথাও গেলে ও আমাকে খুব একটা ফোন দেয় না। অন্যদিকে আমি যাকে ফ্রেন্ড ভাবি, সে আমার সব ধরনের খোঁজখবর নেয়, কোথায় যাচ্ছে, কী করছে, সব জানায়, আমার সম্পর্কে জানতে চায়। আমি ওর ফোন খুব একটা রিসিভ করি না, কারণ আমার ওর প্রতি খুব একটা আগ্রহ নেই। তবে কখনও ও আমাকে ফোন করা বন্ধ করে দিলে আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়, ওর সাথে দুর্ব্যবহার করি। ও অন্য কারও সাথে মিশছে কি না, কথা বলছে কি না, অন্য কাউকে সময় দিচ্ছে কি না, এসব ভেবেভেবে আমি অস্থির হয়ে পড়ি। যাকে আমি চাইই না, তাকে হারানোর ভয়ে আমি অসহায়বোধ করি। যে আমাকে সময় দিলে আমার অসহ্য লাগে, সে আমাকে সময় দেয়া বন্ধ করে দিলে ওকে খুব মিস করা শুরু করে দিই।

আমার বন্ধু আমার সাথে কখনওই সেক্সুয়াল ব্যাপারে কথা বলে না, আর ওদিকে আমার বয়ফ্রেন্ড আমার সাথে কেবলই সেক্সুয়াল ব্যাপারে কথা বলতে আগ্রহী। আমার বয়ফ্রেন্ডের সাথে আমি আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে এবং অন্যান্য ব্যাপারে কথা বলতে চাই, কিন্তু ও ওসব নিয়ে কথা বলতে সময় দেয় না, সেক্স নিয়ে কথা না বললে কোনও না কোনও অজুহাতে ফোন রেখে দেয়। আমার কখনওবা মনে হয়, আমার বন্ধুটা আমার সাথে সেক্স নিয়ে কথা বলুক, কিন্তু ও নিজ থেকে কখনওই এ ব্যাপারে কোনও কথা বলে না। আমি এখনও আমার বন্ধুকে আমার রিলেশনের ব্যাপারে কিছু বলিনি। কেন বলিনি, তা আমি নিজেই জানি না। আমি এখন নিজেই কনফিউজড যে আমি আসলে কাকে ভালোবাসি! আমি যাকে ভালোবাসি, সে আমাকে আসলেই ভালোবাসে কি না, আমি বুঝতে পারছি না কেন? যে আমাকে ভালোবাসে, আমিও যদি তাকে ভালোবাসতে শুরু করি, তবে সেও কি আমার বয়ফ্রেন্ডের মত আচরণ করতে শুরু করবে? আমি আমার বন্ধুর কাছ থেকে স্রেফ সময় চাই, আর ও আমার কাছ থেকে ভালোবাসা চায়। আমি আমার বয়ফ্রেন্ডের কাছ থেকে ভালোবাসা চাই, আর ও আমার কাছ থেকে স্রেফ সময় চায়। এমন দ্বৈততা আমাকে পাগল করে দিচ্ছে! কখনও মনে হয়, এসব কিছু থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে পড়াশোনা আর নিজের ক্যারিয়ারের দিকে মন দিই, কিন্তু কোনও এক রহস্যময় কারণে মন তাতেও সায় দেয় না!

ভাবনা: দুইশো উনসত্তর।

……………………………………..

কেমন আছেন?

ভাল। আপনি?

আমিও।

আপনি কে?

নাম তো দেয়াই আছে। আর বাকিটা………আমি যে, আমি সে-ই! আপনার ওয়ালে একজনের সাথে একটা টপিক নিয়ে অনেক ঝগড়া করে ফেলেছি। কিছু মনে করেননি তো?

না।

আপনি একটু বেশিই ইয়ে। আচ্ছা, আপনি কি বিবাহিত?

(নো রেসপন্স)

আচ্ছা, আপনি কোন লেখকের বই বেশি পড়েছেন, বা কোন লেখক সম্পর্কে অপেক্ষাকৃত বেশি জানেন?

(নো রেসপন্স)

ধ্যত্‌!

বিরক্ত করবেন না।

ধ্যত্‌ কেন বললাম, জানেন? আমার এক কাজিন দেখতে আপনার মত, যাকে আমি খুবই অপছন্দ করি, কিন্তু সে আমাকে পছন্দ করে। আপনাকে যখন তার মত দেখতে লাগে, তখন খুবই মেজাজ খারাপ হয়। আচ্ছা, আপনি কি সিগ্রেট খান? আপনাকে মোবাইলে একটা টেক্সট দিয়েছিলাম। পাননি? পেলে রিপ্লাই কই?

আপনার পরিচয় দিন ঠিকভাবে।

এটা একেবারেই আজাইরা একটা কাজ। পরিচয় দিয়ে কী হবে? এই মুহূর্তে একটা প্রশ্ন মাথায় খুব কামড়াচ্ছে। করব? করে ফেলি, কেমন? আপনি সিগ্রেট না খেয়ে কীভাবে থাকেন? ছেলেরা এক্সাইটেড হলেই সিগ্রেট খায়, দেখেছি। আচ্ছা, সিগ্রেট খেলে কি এক্সাইটমেন্ট কমে? তাহলে একটা খেয়ে দেখতাম আরকি!

পরিচয় না দিলে বিরক্ত করবেন না, প্লিজ! বাই!

ওকে বাই। খুব যে বিরক্ত হচ্ছেন, তা তো মনে হয় না। হলে তো অনেক আগেই আমাকে ব্লক করে দিতেন! সে রাস্তা তো আপনার হাতেই! আর………ও হ্যাঁ, আমি মানুষ। অ্যালিয়েনরা ফেসবুকিং শিখেছে কি না, আমি শিওর নই।

আপনি কী করেন? আপনার নাম কী? কোথায় থাকেন?

শুধু আপনার পোস্টের সাথে কথা বলতে পারলে ভাল ছিল। আপনার সাথে শারীরিক সম্পর্ক, আর লেখার সাথে মানসিক। মানে, আপনার শরীর আকর্ষণ করে আমার শরীরকে, আর লেখা আকর্ষণ করে মনকে। অবশ্য, শরীরের প্রতি আকর্ষণটাও অনেকটা মনের উপরই নির্ভরশীল। এটা সত্য, আপনি দেখতে সুন্দর নন। তবে যারা আপনাকে ভালোবাসবে, তাদের কাছে হয়তো ঠিকই সুন্দর লাগবে। দৈহিক সৌন্দর্য থেকে ভালোবাসা আসে না, বরং ভালোবাসা থেকেই দৈহিক সৌন্দর্য আসে। আর ভালোবাসাটা আসে মূলত মানসিক সৌন্দর্য কিংবা একসাথে থাকার অভ্যস্ততা থেকে। ব্যাপারগুলি চেতনানির্ভর। যা-ই হোক, আমার নাম তো দেয়া আছে, আর আমি খাই, ঘুমাই, পড়ালেখা করি, হাগুমুতু করি, কাজ করি, অন্যকে বিরক্ত করি। যেটা জানার, আপনার কোনওই প্রয়োজন নেই, সেটা অকারণে জানতে চান কেন?

বাআআআল। বাই।

জনাব, আমিও কি একটা বাল বলতে পারি? বাই! আপনাকে অসুন্দর বললাম বলে মনে হয় ভাল লাগল না। এ-ই তো? ঠিক আছে, আপনি সুন্দর! নায়কের মত বলতে হবে? কিন্তু কোন নায়কের মত বলব? ঠিক আছে যান, আপনি নায়ক ছুপ্পারুস্তমের মত সুন্দর!

প্লিজ ডোন্ট ডিস্টার্ব!

ওকে ছো ছরি। বাই।

(নো রেসপন্স)

ওহ্‌ সরি! একটা কথা বলার জন্য আবার দৌড়ে এসেছি। আপনাকে আজকে দেখেছি রাস্তায়। দুজন হেঁটে যাচ্ছিল। ওদের মধ্যে শিংওয়ালাটা আপনি। আপনার গলায় দড়ি ছিল—আত্মহত্যার দড়ি নয়, সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার দড়ি।

(নো রেসপন্স)

জানি, আপনার কাছ থেকে আর কোনও রেসপন্স আসবে না। ঠিক আছে, আমি নিজেই একটা সম্ভাব্য কথোপকথন দাঁড় করাই:

ভালোবাসি। আর কিছু চান?

না। ধুউর্‌ ছাই! দূরে গিয়ে মরো! আজাইরা এত্তু ভালোবাসা দিয়া আমি কী করিব? ব্ল্যাকলেভেলের সাথে মিশাইয়া খাইব? বালুবাসা-টালুবাসা এইগুলা সব ভুয়া, অনলি শরীর ইজ রিয়েল। মানসিক প্রেমে ভণ্ডামি থাকতে পারে, তবে দৈহিক প্রেমে কখনও কোনও ভণ্ডামি থাকে না। একগাদা মদন পাবলিক খালি আজাইরা ভালোবাসে………যত্তসব! যারা আমাদের ভালোবাসে, তাদের জন্য আমরা কী বালটা করছি? আর আমরা যাদের ভালোবাসি, তারা আমাদের জন্য কী বালটা করছে? বড়জোর পাঁচজনের হয়তো কিছু ভালোবাসা জোটে, বাকি সব তো মহাসাগরে ভাসে। ফালতু যত্তসব ভালোবাসার নাটক! সক্কালসক্কাল শরাবের মুডটাই নষ্ট হয়ে গেল! অ্যানিওয়ে, গুড মর্নিং!

“সাঁতারু ও জলকন্যা”র কোন দিকটা ভাল লাগে? একই জিনিসের বিভিন্ন দিক বিভিন্ন মানুষের ভাল লাগে, তাই বললাম!

আরে, কোন দিক ভাল লাগে মানে? দেখতে বার্নিকেট হলেই কী, আর ক্যাটরিনা হলেই কী? (বার্নিকেট অসুন্দর হলেও উনাকে আমার ভাল লাগে, চমৎকার মহিলা, খুবই আন্তরিকভাবে কথা বলেন।)

আপনি কি বলতে চাচ্ছেন যে আমি বেশি সুন্দর না? শোনেন জনাব, আমি লুতুপুতু প্রেম, পুতুপুতু ভালোবাসার মতো সুন্দর নই, কিন্তু *** করার মত সুন্দর। আপনার সাথে আমার মিল আছে, আমি সুন্দর না, কিন্তু সেক্সি। এবং, আপনার মত খানিকটা বিরক্তিকরও!………ওঃ, এসব কথা তো আবার আপনার ভাল লাগে না। ঠিক আছে যান, আপনি টেস্টি, অ্যাজ লাইক অ্যাজ অ্যা পিস অব ললিপপ! আপনি একটু বেশিই সেক্সি! (জানি, আপনার আমাকে হয়তো খারাপ মনে হচ্ছে। পৃথিবীতে অত কোটিকোটি মানুষ, একজন খারাপ মনে করলে, আমার কী আর এমন হবে? এটা নিয়ে পরোয়া করার কিছু নেই।)

(নো রেসপন্স)

আপনাকে ভালোবাসলে এটা শিওর যে, মাথায় উকুন হবে। বিশ্বাস হয় না? যারা আপনাকে ভালোবাসে, তাদের জিজ্ঞেস করে দেখুন, তাদের মাথায় চুলের চেয়ে উকুন বেশি কি না!

(নো রেসপন্স)

আপনার লেখাটা পড়লাম। ‘শুভ্র’ কে আসলে? আপনি নিজে? আচ্ছা, আপনার রুমটা এমন এলোমেলো কেন? আপনার নিয়মমালায় রুম গুছিয়ে রাখার নিয়ম নেই কেন!?

(নো রেসপন্স)

কী লিখলেন এটা? Hey Man! U believe in love!? So funny……

“We have imagined for the mighty dead;

All lovely tales that we have heard or read:

An endless fountain of immortal drink,

Pouring unto us from the heaven’s brink.”

(নো রেসপন্স)

আপনার দাঁত নেই? আপনি কথা বলতে পারেন না? আপনাকে কী কী যেন জিজ্ঞেস করেছিলাম! ভুলেই গেছি!

(নো রেসপন্স)

রিপ্লাই দেবেন না? ঠিক আছে, অনেক বেহায়াপনা হয়ে গেল, আর না! শেষ সত্যটা বলে যাই………ভালোবাসা প্রতারণার নামান্তর মাত্র! আপনি ঠিকই বলেন, এক সেক্সেই কেবল কপটতা থাকে না—ওটা যখন হয়, তখন দুজনই জানে, কী হচ্ছে, এবং ওটাই আসলে হচ্ছে! কিন্তু ভালোবাসা যখন হয়, তখন দুজনই কিংবা একজন বিশ্বাস করে, যা হচ্ছে, তা ভালোবাসা, অথচ, প্রকৃত ঘটনা ভিন্ন! Sex for sex’s sake-এ কোনও কপটতা থাকে না, কিন্তু Sex for love’s sake মাত্রই কপটতা! তাই মনের টানে নয়, শরীরের টানে শরীর এলে কোনও বিপদ কিংবা বিপত্তির আশংকা থাকে না।

ভাবনা: দুইশো সত্তর।

……………………………………..

কী অবস্থা?

এইতো ভালই! কিছু অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি।

কত কঠিন করে বল তুমি! কিছু বুঝি নাতো! You can do anything you want! আমি জানি!

হুম বলসে তোমাকে! আমরা কাউকে পছন্দ করলে ধরেই নিই, সে বিশ্বজয় করে ফেলতে পারবে! কোনও মানে নেই এর! এক ছেলে বছরের পর বছর পরীক্ষায় ফেল করে যায় অক্লান্তভাবে, ওর গার্ডিয়ান তবু বিশ্বাস করতে ভালোবাসে, উনার ছেলে ব্যাপক প্রতিভাবান!

আরে নাহ্‌! তুমি চাইলেই পারবে! You’ve that rare quality! সত্যি বলছি! তুমি প্যারিস জয় করেই ফিরবে!

শোনো, এখানে সব তো ভীষণ কম্পিটিটিভ! অতো সহজ না!

দেইখো তুমি, আমি যা বললাম, তা-ই সত্যি হবে!

হাহাহাহা………আমি এতো স্ট্রেস নিতে পারব না! দেশে ফিরে বিসিএস দিব! ওইটাই বেটার! এতো প্যারাময় জীবন ভাল লাগে না!

You’ve chosen to be chased. ওসব বলে লাভ আছে? But, you can fit yourself there like a princess, I believe!

এতো পড়ালেখা করে আল্টিমেটলি কী করব, সেটাই তো জানি না, সো, খুবই কনফিউজড আমি! আমার কাজিন অক্সফোর্ড গ্র্যাজুয়েট, এখন বাচ্চা পালে আর ভাত রাঁধে! কী লাভ হল অতো পড়াশোনা করে?

Trust me, you can face competition!

এখানে জব কিংবা সেটল্‌ করার ইচ্ছা নাই এক ফোঁটাও! তবু কেন আমি এতো কষ্ট করে যাচ্ছি? কীসের মোহে এখানে পড়ে আছি?

শোনো ম্যাডাম, life is like this. No one knows why they’re doing this and that. But, they do, go on doing. Life is all about going on doing something we’ve no idea about!

হুম এটাও ট্রু!

তুমি অভিনব কিছু করছ না! তোমার আগের জেনারেশন যা করে গেছে, তুমিও তা-ই করে যাচ্ছ; মজার ব্যাপার হল, তোমার পরের জেনারেশনও তা-ই করে যাবে। উদাহরণ দিয়ে বলি। আমরা টাকা জমাই। অনেক টাকা জমাই। কিন্তু কেন যে জমাই, তা নিজেরাও জানি না। আমাদের আগের জেনারেশন টাকা জমাত, তাদের দেখাদেখি আমরাও টাকা জমাই; আমাদের পরের জেনারেশনও জমাবে। সে টাকা খরচ করা যায় না, তার আগেই আমরা টুক করে মরে যাই। জীবনকে উপভোগ করার জন্য টাকা জমাতে থাকি, আর সে টাকা উপভোগ করাটা আর হয়ে ওঠে না, এর আগেই সব শেষ! তবু টাকা জমানোর ব্যাপারটা আমাদের আনন্দ দেয়। আমরা সংখ্যা দেখে সুখ পাই। সে সংখ্যার আদৌ কোনও অর্থ আছে কি না, সেটাই কখনও ভেবে দেখি না! আমাদের যত ভাবনা, দুশ্চিন্তা, পরিশ্রম—সঞ্চয়অংকের ডানের শূন্য বাড়ানোর দিকে! জীবনে টাকার শূন্য যত বাড়ে, জীবন তত বেশি শূন্য হয়ে পড়ে! বুঝলে?

কিছুই বুঝি নাই! বড় সহজ কথা বললে তো, অতো সহজ কথা এতো সহজে বোঝা যায় নাকি?

বুঝতে না পারার তো কিছু দেখি না! লাইফটাই একটা ফালতু জিনিস! এ জীবনের কোনও অর্থ নেই, কোনও মহত্ত্ব নেই। ম্যাকবেথের কথাই ঠিক: Life … is a tale/ Told by an idiot, full of sound and fury,/ Signifying nothing. আর শোনো, আমি কিন্তু খেপে আছি তোমার উপর!

কেন?

মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং! বোঝো না?

ওহ্‌ আই সি! আমি তোমার মেসেজের রিপ্লাই দিতে দেরি করেছি বলে? তুমি ভেবেছ, ইচ্ছে করে করেছি? হঠাৎ রেগে যাও কেন? সেদিন অতোগুলি কথা না শোনালে হত না? বহুত পুরান কাহিনি, বাট ইউ নৌ, এখনও মনের দাগটা টাটকা! মেয়েদের মনে দাগ পড়লে সহজে ওঠে না। মনের কোনও সার্ফএক্সেল হয় না যে!

আরে নাহ্‌! ওসব কিছু না! বাদ দাও! আর শোনো, Don’t change your heart even if it costs material failure. You’ve a beautiful heart, princess! জিতে যাওয়া বলে কিছু নেই, এটা মানুষ বানাইসে। মনে রাইখো, বুচ্চো?

ধন্যবাদ মোটিভেশনাল স্পিকার! হারজিতের ব্যাপার না। আমার মনে হচ্ছে, মিনিংলেস কাজের পিছনে আমি ছুটে চলেছি ক্রমাগত! এর কোনও মানে নাই। যা-ই হোক, দোয়া কইরো আমার জন্য।

Don’t tag me like that. তোমার কাছ থেকে ওইটা এক্সপেক্ট করি নাই।

আমি কিন্তু ফান করে বলি নাই। I meant it. আমি আসলেই ইন্সপায়ারড হয়েছি, ফ্রাস্ট্রেটিং লাগে এখানে কাজ করতে-করতে, সো, আই রিয়েলি লাইকড ইয়োর অ্যাডভাইস্‌! অ্যাই, তুমি আবার মাইন্ড করলে নাকি? আমি কিন্তু আসলেই মন থেকে বলেছি! সারক্যাস্টিক্যালি বলি নাই। অ্যানিওয়ে, তুমি অফেন্ডেড ফিল করে থাকলে আমি সরি। বাট আই হোপ দ্যাট ইউ নৌ মি বেটার টু আন্ডারস্ট্যান্ড যে, I wouldn’t say anything hurtful to anyone.

আসলে, I don’t like to be tagged. I never mean to be so easily judged. আর কিছু বিটার এক্সপেরিয়েন্সের পর আমি আরও বিরক্ত!

তোমার অনেক কথাই আমার লাইফে হুবহু মিলে গেছে! I better listened to you earlier. হারিয়ে, ঠেকে আর ধাক্কা খেয়ে শিখেছি। তুমি মানুষ না, জ্বিন। বুচ্চো?

আর তুমি আমার চোখে অনেকিছু! তুমিও আমাকে ট্যাগ করলে নিতে পারব না। সিরিয়াসলি!

যাক্‌! বাঁচা গেল! ভাবলাম, তুমি মিসআন্ডারস্ট্যান্ড করছ আমাকে! অ্যানিওয়ে, জ্বিনের ভবিষ্যতের জন্য দোয়া কইরো।

সুন্দর ভবিষ্যৎ কী জিনিস? জ্বিনের শান্তিময় ভবিষ্যৎ হোক।

হুম শান্তিময় is the perfect word. একদম ঠিক! I need peace!

I know your heart. You need ONLY that. Succes is just a byproduct.

ভাবনা: দুইশো একাত্তর।

……………………………………..

আমরা ৪ ভাইবোন। ২ ভাই, ২ বোন। আমি বিবিএ থার্ড ইয়ারে, অ্যাকাউন্টিং ডিপার্টমেন্টে। বড় আপু মাস্টার্স পরীক্ষা দেবে। এক ভাই জন্ম থেকেই অটিস্টিক, আরেক ভাই প্রতিবন্ধী; ওরা কথাও বলতে পারে না ঠিকমতো, কানেও শোনে না। বাবা আমার ভাইদের মানুষ করার জন্য শহরে নিয়ে আসে। বড় ভাইয়া টেকনিকাল থেকে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং আর ছোটভাই বাউবি থেকে এইচএসসি কমপ্লিট করেছে। তাদের প্রতিবন্ধকতার জন্য সবাইই ওদের অবমূল্যায়ন করে। বড় ভাইয়া এক জায়গায় জব করত, ওইখানে মেন্টালি অনেক টর্চার করে, তাই ও জব ছেড়ে দিয়েছে। বড় আপু সারাদিনই টিউশনি করে, আর আমি মাকে নিয়ে বাসায় থাকি।

আমার জীবনযুদ্ধ শুরু হয় ২০১৪ সালের জুলাইয়ে বাবার মৃত্যুর পর। এর আগে কলেজে আমার ডিপার্টমেন্টের একটা ছেলের সাথে রিলেশন হয়। সেই রিলেশনের পঞ্চম দিনে বাবা মারা যায়। আমাদের সম্পর্কটা ভালই চলছিল। আমাদের দুই পরিবারই আমাদের ব্যাপারটা জানে। কিন্তু এরই মাঝে ওর কিছু আচরণের কারণে এই সম্পর্কে অনেক ব্যাঘাত ঘটে। ও বিভিন্নভাবে আমাদের পরিবারকে অপমান করত, তাচ্ছিল্য করত, বেয়াদবের মত আচরণ করত আমার পরিবারের সদস্যদের সাথে। একসময় আমার পরিবার ওর ব্যাপারে আমাকে আর অগ্রসর হতে নিষেধ করে দেয়। এসবের জন্য আমি মানসিকভাবে মুষড়ে পড়ি। তবে আমি সবচাইতে বেশি আঘাত পাই যখন জানতে পারি, আমার সাথে রিলেশনে থাকা অবস্থায়ই অন্য একটা মেয়ের সাথেও ওর রিলেশন চলছে। যা-ই হোক, আমার পরিবারের সহযোগিতায় আর নিজের চেষ্টায় আমি এই ধাক্কাটা কোনওমতে সামলে উঠি।

বাবা মারা যাওয়ার পর পরিবারে অনেক সমস্যা দেখা দেয়। আমাদের কোনও ইনকাম সোর্স না থাকায় আমরা অনেক কষ্টের মধ্যে পড়ে যাই। বাবা আমাদের জন্য অনেককিছুই রেখে গেছেন, কিন্তু কোনওকিছুই গুছিয়ে রেখে যেতে পারেননি। বড় আপু অনেক কষ্ট করে বাবার বিজনেস থেকে যা পাওয়ার, সেগুলির কিছুকিছু যোগাড় করে আমাদের অনেক ধারদেনা শোধ করে। সব ঝড়ই ওকে সামলাতে হয়েছে, কারণ আমার বড় দুই ভাইয়া তো থেকেও নাই।

ওই ছেলের সাথে ব্রেকাপের পর আমার কলেজের এক সিনিয়রের সাথে আমার এ ব্যাপারে কথা হয়। সে সিনিয়র আমাকে আগে থেকেই পছন্দ করতেন। বিভিন্নভাবে উনি আমাকে নানান কাজে হেল্পও করতেন। আমার ব্যাপারে সবই জানতেন উনি। একসময় উনি আমাকে প্রপোজও করেন। আমি উনাকে তখনই বলেছিলাম যে আমার লাইফটা সহজ নয়। তা সত্ত্বেও উনি রাজি হন। আমাদের রিলেশন হল।

আমি দ্বিতীয় রিলেশনেও কখনও ভাল ছিলাম না। রিলেশনের আগে উনি একরকম, রিলেশনের পর উনার আরেক চেহারা দেখলাম। আমাদের ঝগড়াই বেশি হত। আমার সবকিছুতেই উনি দোষ খুঁজে পেতেন। আমি ভাল না, আমার ফ্যামিলি ভাল না, আমার কিছুই ভাল না, এসব বলতেন, অথচ আমি উনাকে আগেই সব বলেছিলাম। সম্প্রতি কিছু ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে আমাদের চরম ঝামেলা হয়, এবং উনি এখন আমাকে পুরোপুরিই ইগ্নোর করেন। আমি নিজ থেকে কথা বলার চেষ্টা করলে উনি ইগো দেখান। এখন আমাকে সবকিছু থেকে ব্লক করে দিয়ে একাএকাই জীবন কাটাচ্ছেন। কিন্তু উনি আমাকে একবারও বলছেন না, উনি আমার সাথে সম্পর্ক রাখতে চান, কি চান না।

গত বছর আমার আগের বয়ফ্রেন্ডের সাথে ঠিক এ সময়ে যা হয়েছে, উনার সাথেও এ বছর একই সময়ে তেমনই হচ্ছে। আমি কিছুতেই এটা মেনে নিতে পারছি না। আমি তো উনার জীবনে আসতে চাইনি, উনি নিজেই অনেকটা জোর করে আমার জীবনে এসেছেন সব জেনেবুঝেই। তা সত্ত্বেও কেন উনি আমার সাথে এমন করছেন? আমার মনে হচ্ছে, উনি যা করছেন, ইচ্ছে করেই করছেন। আমি এখন যত চেষ্টাই করি না কেন, উনি আমাকে ইগ্নোর করবেনই! আমি কল করলে রিসিভ না করে ফোনটা অফ করে রাখবেন। আর ফেসবুক, ভাইবার, হোয়াটস্‌অ্যাপ, ইমো সবজায়গাতেই তো আমি ব্লকড্‌! আমার প্রায়ই মনে হয়, আমাদের মধ্যে যে ঝামেলাটা, উনি চাইলেই সব ঠিক করে ফেলে আমাদের সম্পর্কটা স্বাভাবিক করে ফেলতে পারতেন, আমি সেটাই করতে চাইছি, কিন্তু উনি কোনও এক অদ্ভুত কারণে তা করতে চাইছেন না। আমি এটা মেনে নিতে পারছি না, কারণ আমি একই ভুল দ্বিতীয়বার করেছি। প্রেমের পরিণতি কি সবসময়ই কষ্ট? উনি খুব ভাল করেই জানেন, আমি চলার পথে কেবলই ধাক্কা খাচ্ছি, জীবনের একমাত্র অবলম্বন হিসেবে সব ইগো, লজ্জা, জেদ ভুলে গিয়ে উনার কাছেই ছুটে যেতে চাইছি, উনাকে আঁকড়ে ধরতে চাইছি, কিন্তু উনি উনার কাছে ঘেঁষার সকল পথই বন্ধ করে দিয়েছেন।

আমার পরিবারের অবস্থা খুবই শোচনীয়। বড় ভাইয়া আগের জব ছেড়ে আরেকটা জবে ঢুকেছেন, কিন্তু নতুন জবে আগের জবের চাইতেও বেশি কষ্ট। ভাইয়া ভয়ে আর জব সুইচ করছেন না। ছোট ভাইয়া অসুস্থ হওয়ায় কোনও চাকরি করেন না। আপুর টিউশনি আগের চাইতে কমে গেছে। আত্মীয়স্বজন হেল্প করার নামে হেয় করে, বাবার যেটুকু প্রপার্টি আছে, সেটুকুও নিয়ে ফেলার ষড়যন্ত্র করে। পরিবারে বাবা না থাকলে কোনও ছায়াই আর থাকে না।

আমাকে নিয়ে বরাবরই সবার অনেক স্বপ্ন। আমার বড় দুই ভাই যা করতে পারেননি শারীরিক অক্ষমতার কারণে, আমার মায়ের স্বপ্ন, আমি যেন সে অভাবটুকু পূরণ করে দিই। আমার অনেক ইচ্ছে, অনেক দূর যাব। অন্তত এমন কিছু আমাকে করতেই হবে, যা করলে আমি মাকে খুশি হতে দেখবো, আমার ভাইবোনদের কষ্ট সার্থক হবে। আমার খুব ইচ্ছে আমার পরিবারকে হেল্প করার। দিনদিন খুব খারাপ অবস্থায় যাচ্ছে সবকিছু। মায়ের সবসময়ই চিন্তা, মেয়ের বিয়ে কীভাবে হবে, উনার অসহায় ছেলেদের কে দেখবে!

আমি সামনে এগিয়ে যাওয়ার কোনও পথই দেখছি না। চোখ মেললেই কেবল দুঃখ, কষ্ট আর হতাশা দেখতে পাই। যুদ্ধ করে যাচ্ছি প্রতিদিনই, আর বারবারই হেরে যাচ্ছি। নিজের মনের অবস্থাটা যদি একটু ভাল থাকত, তবে ফ্যামিলিকে একটু হলেও ভাল রাখতে পারতাম। কিন্তু তা আর পারছি কই? প্রায়ই মনে হয়, লাইফে সেকেন্ড চান্সটা না নিলেই ভাল হত। ব্যর্থ প্রেম জীবনকে একেবারেই ধ্বংস করে দেয়। পরিবারের কষ্ট আর নিজের বাজে অবস্থা দেখলে মনে নানান নেতিবাচক ভাবনা আসে। আমি হেরে যাচ্ছি প্রতি মুহূর্তেই। উনার কাছ থেকে এতো বড় আঘাত পাব, কখনও ভাবতে পারিনি। প্রেমে অন্ধ হয়ে নিজের লক্ষ্য থেকে অনেক দূরে সরে গেছি আমি!

যে পরিবার আমার জন্য এতো কষ্ট করেছে, আমি সে পরিবারকে হয়তো কিছুই দিতে পারব না একই ভুল দ্বিতীয়বার করার কারণে, জীবনটাকে নিয়ে খামখেয়ালিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার কারণে, পরিবারের অন্য কারও কথা না ভেবে ক্ষণিক সুখের মোহে ভুল স্রোতে গা ভাসিয়ে দেয়ার কারণে। পরিবারকে ফাঁকি দিতে গিয়ে আমার গোটা জীবনটাই একটা ফাঁকি হয়ে গেল!

ভাবনা: দুইশো বাহাত্তর।

……………………………………..

আমি ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছি। বগুড়ায় থাকি। আমার জীবনটা সবসময় কেটেছে নানান নাটকীয়তায়। আমার আব্বু আর আম্মু পরস্পরকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল। আমার আম্মু অনেক ভাল স্টুডেন্ট ছিল। আম্মু যখন ক্লাস টেনে, তখন পালিয়ে যায় আব্বুর সাথে। এরপর আম্মু আর আব্বু সংসার শুরু করে। এর মধ্যে আম্মুর প্রাইমারি স্কুলে একটা জব হল। আর আব্বু ছিল বেকার। আম্মু বাইরে চাকরি করত, আর আব্বু বাসায় আমাকে দেখাশুনা করত আর রান্নাবান্না করত। আমি ছিলাম আব্বুর রাজকন্যা। ছোটবেলা থেকে আব্বুর আদরেই বড় হয়েছি। নিজে না খেয়ে আমাকে খাওয়াত, সবসময়ই আমাকে বুক পেতে আগলে রাখত। আমি সুখেই বড় হচ্ছিলাম।

কিন্তু হায়, আমার কপালে সুখ সইল না। আমার বয়স যখন ৫, তখন আমার আম্মু অন্য একজনকে বিয়ে করে আমাকে আর আমার আব্বুকে ছেড়ে চলে গেল। আম্মু ওই লোককে বিয়ে করে ফেললে আমার আব্বু পাগলের মত হয়ে গিয়েছিল। তখন আমি কিছুই বুঝতাম না, কিন্তু সবকিছুই কেমন জানি ফাঁকাফাঁকা লাগছিল।

আমি মনে হয়, আমি এ পৃথিবীর একমাত্র মেয়ে, যে বাবা আর মা, দুইজনের বিয়েতেই দাওয়াত খেয়েছে। হ্যাঁ, আব্বুও বিয়ে করল। আমার নানুবাড়ি আর দাদুবাড়ি পাশাপাশি ছিল। আমি দুজনেরই বিয়ে দেখলাম, দাওয়াত খেলাম। আশ্চর্য, তাই না?

আমি তখন ৫ বছরের একটা মেয়ে। যে সময়ে আমার বাবা-মা’র আদরে পরিপূর্ণ থাকার কথা, সে সময়ে আমি একটা টোকাইয়ের মত থেকেছি। আমি আমার ফুপুর সাথে থাকতাম তখন। আমি আগে একটা কেজি স্কুলে পড়তাম, পরে একটা সরকারি প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হই। আমি দেখতাম, সবার বাবা-মা আছে, আর আমার বাবা-মা থেকেও কেউ নেই। সবার সাথে স্কুলে বাবা-মা আসত, আমার সাথে আসত না।

তো যখন সবাই সবার জায়গায় স্থির হল, তখন আমার মামা আমার জীবনে ঈশ্বরের আশীর্বাদ হয়ে এল আর আমাকে তার পদতলে জায়গা দিল। আমার আব্বু-আম্মু ছিল আমার নানা-নানি, আর আমার দেবতা ছিল আমার মামা। এই যে আমি এখনও বেঁচে আছি, তাও আমার মামারই জন্য।

আমি যখন প্রাইমারি স্কুলে ক্লাস ফাইভে পড়ি, তখন একদিন শুনলাম, আমার আব্বু আর নেই। আব্বু ঘুমের মধ্যে হার্ট অ্যাটাক করে মারা গেছে। আব্বুকে হারিয়ে ফেললাম। আগে জানতাম, আব্বু থেকেও নেই, তবু কখনওবা মনে হত, বেঁচে তো আছে! এটা ভেবে এক ধরনের শক্তি অনুভব করতাম মনের ভেতরে। তখন থেকে জানলাম, আব্বু আমার সামনেও নেই, অন্য কোনও জায়গায়ও নেই। আমি আমার আব্বুকে শেষদেখাও দেখতে পারিনি।

লোকে আমায় সবসময়ই বলতো, তোর তো দুই বাবা, দুই মা। এটা শোনার পর অনেক খারাপ লাগত। যা-ই হোক, আব্বু আমাকে ছেড়ে চলে গেল চিরতরে। আব্বু যে দ্বিতীয় বিয়েটা করেছিল, সে ঘরের একটা ছেলে আছে। এখন ওর বয়স ৬ বছর হবে হয়তো। আমি যদি সে বাড়িতে আশ্রয় নিতে চাই, সে ভয়ে আব্বুর দ্বিতীয় স্ত্রী কখনওই আমার সাথে কোনও যোগাযোগ করেনি।

সবাইকে অবাক করে দিয়ে আমি ক্লাস ফাইভে সেই অজ পাড়াগাঁ থেকে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পাই। এর সকল অবদান আমার নানা-নানি আর আমার মামার। তারপর আমি ক্লাস সিক্সে হাই স্কুলে ভর্তি হই। আমি সেই ছোটবেলা থেকে ভীষণ বোকা, আশেপাশে কী ঘটছে, তেমন কিছুই বুঝতাম না। বোকা বলেই এতদূর আসতে পেরেছি হয়তো, নাহলে অনেক আগেই পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যেত। জীবনে সবকিছু না বোঝার গুরুত্ব অনেক। যা-ই হোক, আমার হাই স্কুলটা ছিল নানুবাড়ি থেকে প্রায় ২ কিলোমিটার দূরে। হেঁটে স্কুলে যেতাম। ওই রাস্তায় কোনও রিকশা কিংবা ভ্যান চলত না।

আমি দেখতে খুব একটা সুন্দরী না, কিন্তু গ্রামের রাস্তায় চলতে গেলে যা হয়—বখাটেদের প্রধান টার্গেট ছিলাম আমি। প্রতিদিনই স্কুলে যাওয়ার পথে শয়তান টাইপের ছেলেগুলি প্রেম নিবেদন করত। কিন্তু ওই যে বললাম, আমি বোকা ছিলাম! প্রেমট্রেম কিছু বুঝতাম না অতো। ওদের অ্যাভয়েড করে চলতাম। আমি এখনও ভাবি, আমার মত অতি নিরীহ সাধারণ চেহারার মেয়েও এমন উৎপাতের শিকার হয়েছে! আসলে বখাটেদের যেকোনও মেয়ে হলেই চলে।

আমি গ্রামে যখন ছিলাম, তখন বলতে গেলে পড়তামই না। শুধু রাতের বেলা দুএক ঘণ্টা পড়তাম। তাও কীভাবে জানি সব পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়েছি সবসময়ই। ক্লাস সিক্স থেকে ক্লাস টেন পর্যন্ত সব ক্লাসেই প্রথম হয়েছি। জেএসসি’তে আবারও ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেলাম। এসএসসি’তে গোল্ডেন এপ্লাস এলো। কিন্তু আমি জানি, আমি এসবের যোগ্য নই।

আমার গল্পের বই পড়তে খুব ভাল লাগত। ক্লাস সিক্স থেকেই অনেক বই পড়তে চাইতাম, কিন্তু কখনও সুযোগই পাইনি। ধারেকাছে কোনও লাইব্রেরি ছিল না যেখান থেকে বই ধার করে পড়তে পারি। বইকেনার সামর্থ্য তো ছিলই না! বাস্তব জগত সম্পর্কে আমার কোনও জ্ঞানই ছিল না। কিন্তু আমি যখন যেখানে যা পেতাম হাতের কাছে, তা-ই পড়ে ফেলার চেষ্টা করতাম।

আমি যখন ক্লাস নাইনে পড়তাম, তখন একদিন একদল ছেলে রাস্তায় বসে ছিল। ওরা আমাকে কোনও কারণ ছাড়াই উত্যক্ত করে। আমি পালিয়ে আসতে চাইলে জোর করে আমার কাপড় খুলে নেয়ার চেষ্টা করে। হয়তো আমি সেদিনই রেইপড হতাম, কিন্তু আমার চিৎকারে একটু দূরের খেত থেকে ৪-৫জন মুরুব্বি দৌড়ে এলে সেদিনের মত বেঁচে যাই। আল্লাহ্‌ আমাকে বাঁচিয়ে দিলেন।

সেদিনের পর থেকে আমার মাথায় একটুএকটু বুদ্ধি জন্মে। সব কথাই আমি নানা-নানিকে বলতাম না। বললে হয়তো আমাকে আর স্কুলে যেতে দিত না, আমার পড়াশোনাও বন্ধ হয়ে যেত! গ্রামের বখাটে ছেলেদের অত্যাচার সহ্য করে মেয়েরা যে কত কষ্ট করে স্কুলে যায়, তা কেউ ভাবতেও পারবে না। সমাজের ওইসব কীটদের ব্রাশ ফায়ার করে মেরে ফেললে এ দেশে নারীশিক্ষার হার অনেক বেড়ে যেত।

আমার আম্মু ওইসময় বগুড়া সদরে থাকত। কখনও-কখনও আমার খোঁজখবর নিত। আমার নানা-নানিকে বলে আম্মু আমাকে বগুড়ায় নিয়ে যায়। শর্ত ছিল, মায়ের নতুন ঘরের সন্তানের, মানে আমার সৎভাইয়ের দেখাশোনা করতে হবে। আমি ১২ বৎসর পর আম্মুর কাছে যাই। এবং সে বাসায় একটা কাজের মেয়ের চাইতে বেশি সুযোগ কিংবা সুবিধা আমি কখনওই ভোগ করতে পারিনি। আমার নতুন বাবা আমাকে ইচ্ছে হলেই মারধর করেন, এমনকি আমি যে ছোটভাইয়ের দেখাশোনা করছি, সেও আমাকে বাবা-মায়ের সামনেই মারতে আসে!

এভাবেই বেঁচে আছি। ইন্টারে কেমন রেজাল্ট হবে, জানি না। বেঁচেথাকা খুব আনন্দের কিছু নয়, তবে আমার মত যাদের জীবনে বেঁচেথাকাই সবকিছু, তাদের জন্য বেঁচেথাকার অর্থই হল, কোনও না কোনও আলোর রাস্তায় নিজেকে পৌঁছে দেয়ার যাত্রা। সে স্বপ্নেই দিন ফুরোচ্ছি। দেখা যাক, কতটুকু কী হয়……………

ভাবনা: দুইশো তিয়াত্তর।

……………………………………..

প্রায় দেড় বছর ধরে একটা কষ্টের চক্রে ঘুরপাক খাচ্ছি। জীবনের কিছু স্মৃতি কিছুতেই ভুলতে পারছি না। পড়তে বসলেই সে স্মৃতিগুলি ভাবনায় চলে আসে। আমি বারবারই ব্যর্থ হচ্ছি, উঠে দাঁড়াতে পারছি না। আমাকে দিয়ে কিছুই হচ্ছে না, আমার প্রতিটি দিনই কেবল অনিশ্চয়তায় কাটে। আমাকে অনেক কাঁদতে হয়। আমি জানি, প্রচণ্ড কান্না করার কষ্টটা কেমন! যাদের অনেক কাঁদতে হয় না, তারা এ কষ্টটা কখনওই বুঝতে পারবে না।

আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। এক ভাই, এক বোন। আমি বড়। বাবা সৌদি আরবে অনেক কষ্ট করে আয় করে। মা হোমমেকার। এসএসসি’তে পেয়েছি ৪.০৬, সায়েন্স থেকে; এইচএসসি’তে ৩.৮০, কমার্স থেকে। এখন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত একটা বেসরকারি কলেজে ইকনমিক্সে থার্ড ইয়ারে পড়ছি। এসএসসি আর এইচএসসি’তে ঠিকমতো পড়াশোনা না করায় তেমন ভাল রেজাল্ট করতে পারিনি। কোনও সরকারি কলেজে পড়ার সুযোগ পাইনি। বাবা-মায়ের কষ্টটা ওই বয়সে অতো বুঝতামও না।

৩ বছর আগে এক ছেলের সাথে রিলেশন হয়। দিনগুলি খুব ভাল যাচ্ছিল। এতো সুখে ছিলাম যে মনে হচ্ছিল, আমি সারাজীবনেও কখনও এতটা ভাল অনুভব করিনি। ও আমাকে এতটাই আগলে রাখত যে ওর ভালোবাসার দাম দিতে আমি ওর জন্য সবকিছুই করতে প্রস্তুত ছিলাম। ওর জন্য পৃথিবীর সব সুখ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করে নিলাম। একমাত্র সে-ই ছিল আমার ধ্যান, জ্ঞান, বোধ, আমার পৃথিবী। শুধু ওকেই সময় দিতাম আর নিজের কাজ যতটুকু পারি, করতাম।

পরিচয়ের শুরুতে ওদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভাল ছিল না। হঠাৎ ওদের পারিবারিক ব্যবসার উন্নতির কারণে ওদের আর্থিক অবস্থা ভাল হতে লাগল। একসময় ওরা অনেক ধনী হয়ে গেল। তখন ও প্রায়ই বলতো, ওর ফ্যামিলির সাথে আমাকে মানিয়েগুছিয়ে চলতে হবে। আমাকে আরও কোয়ালিফাইড হতে হবে।

ওর মধ্যে কিছু পরিবর্তন দেখতে পেলাম। ক্রমেই ও কেমন জানি খুব অহংকারী আর রাগী হয়ে যাচ্ছিল। সম্পর্কের ২ বছর পর ও নানান তুচ্ছ বিষয়কে কেন্দ্র করে আমার সাথে দূরত্ব সৃষ্টি করতে থাকে। যখনই আমি সে দূরত্ব কমাতে চেষ্টা করতাম, ও আমাকে বলতো, তুমি আগে কোয়ালিফাইড হও, এখন তোমার ক্যারিয়ার গড়ার সময়। তুমি কিছু একটা করে দেখাতে না পারলে আমার ফ্যামিলি তোমাকে কিছুতেই মেনে নেবে না। আমি তোমাকে বিয়ে করব, কিন্তু এর আগে এখন আর প্রেম নয়।

এমনি করে আমাকে মিথ্যে আশ্বাস দিয়েদিয়ে ও আরও একটা বছর কাটাল। আর আমার সাথে যোগাযোগ করা কমিয়ে দিতে লাগল। ধীরেধীরে নানান অজুহাতে সম্পর্ক খারাপ করতে লাগল। আমি ওর এ আকস্মিক পরিবর্তন ধরতে পারছিলাম, কিন্তু দুই বছরের ভাল স্মৃতি, আবেগ, টান এসবের জন্যই ওকে ছেড়ে দেয়ার কথা ভাবতে পারতাম না।

একসময় সে আমায় বুঝিয়ে দিল যে আমি ওর ফ্যামিলিতে মানানসই নই, আমার আরও স্মার্ট আর সুশ্রী হওয়া দরকার ছিল। দুই বছর আমাকে সময় দিয়ে ও অনেক ভুল করেছে, ওর পুরো সময়টাই বাজে খরচ হয়েছে। ও আর পেছনে ফিরে তাকাতে চায় না। আমাকে ছাড়াই ও এখন বাঁচতে চায়। ও এখন আমার চাইতে অনেক বেটার কাউকে পেয়ে গেছে। ওর এবং ওর পরিবারের জন্য আমি একেবারেই বেমানান।

ওর কথাগুলি শুনে আমার সে মুহূর্তে বেঁচেথাকাই অসম্ভব মনে হয়েছিল। তখন আমার একটা সত্তা বারবারই বলে যাচ্ছিল, “তুই বেঁচে থেকে কী-ই বা করবি? তোর সব স্বপ্ন তো ভেঙেই গেছে! তোর জীবনের বাকি দিনগুলির প্রতিটি মুহূর্তেই ওর সাথে কাটানো সময়ের স্মৃতির ঝড় তাড়া করেকরে তোকে শেষ করে দেবে!” আরেকটা সত্তা বলল, “আল্লাহ্‌র কথা স্মরণ কর! উনি বলেছেন, হে আমার বান্দারা! তোমরা আমাকে ডাকো, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেবো। যারা নিজেদের উপর জুলুম করেছ, তারা আল্লাহ্‌র রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না।”

আমি বেঁচে রইলাম। আব্বু-আম্মুর প্রতি আমি অনেক কৃতজ্ঞ। আমার এমন ভুলকে তারা হাসিমুখে গ্রহণ করে নিয়েছিল। আমি যখন ভেঙে পড়ি, তখন আম্মু অনেক সাপোর্ট দিয়েছে।

আমি বেঁচে আছি, সত্যি, কিন্তু এতো অপমান আর সুখস্মৃতি থেকে বঞ্চনা, বাবা-মায়ের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থতা, বুকভরা এমন অনেক আফসোস নিয়ে বেঁচেথাকা খুব কঠিন। গত দেড় বছর ধরে কেবল কেঁদেই যাচ্ছি। পড়াশোনা করার চেষ্টা করি, কিন্তু বারবারই ভেঙে পড়ি। সেকেন্ড ইয়ারে সেকেন্ড ক্লাস পেয়েছি, থার্ড ইয়ারও প্রায় শেষ, কিন্তু কিচ্ছু পড়াশোনা হয় না।

ওকে ছেড়ে আমি কত কষ্টে বেঁচে আছি, অথচ আমাকে ছেড়ে বাঁচতে ওর একটুকুও কষ্ট হয় না। ভালোবেসেছি বলেই এতটা যন্ত্রণা নিয়ে দিন কাটাচ্ছি। ও কি আমায় ভালোবাসেনি তবে? একটুও? কখনও কি পুরনো স্মৃতি মনে করে ওর একটুও খারাপ লাগে না? একটুও মায়া হয় না আমার জন্য? ওর জীবনে নতুন যে এসেছে, সে মেয়ে কি তবে ওকে ভালোবাসা দিয়ে এতটাই আচ্ছন্ন করে রেখেছে যে আমার কথা ওর কিছুই আর মনে পড়ে না? কেন ওর মত করে হাতবদলের ভালোবাসাটা বাসতে শিখে নিলাম না কখনও?