ভাবনাদেয়ালের পলেস্তারা (৪০শ অংশ)

ভাবনা: দুইশো চুয়াত্তর।

……………………………………..

আমি যে আপনাকে চিনি, এটা ভাবতেই খুব ভাল লাগে। শুভ কামনা।

বেশ অনেক দিন থেকেই ভাবছি, আপনাকে টেক্সট দিব, আপনার সাথে কেন জানি না আমার অনেক কথা শেয়ার করতে ইচ্ছে করে। মনে হয়, আপনাকে আমার সব না-বলা কথাগুলো সহজেই বলা যায়। ভারি আপন মনে হয়, খুব বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে। ভাবছেন, আমি আসলে কে? আমাকে পরিচিত কেউ তো মনে হচ্ছে না!………হুম্‌ ঠিকই ধরেছেন, আমি অপরিচিত একজন, যার সাথে আপনার ফেসবুকে অ্যাড নেই, যে আপনার কোনও লেখায় কমেন্ট করে না। সাগ্নিক, আপনি আমার চেয়ে মেধা আর বয়স দুটোতেই বড়, কিন্তু তবুও আমি আপনাকে স্যার অথবা দাদা কোনওটাই বলছি না। কারণ ঈশ্বরকেও তো আমরা কোনও সম্মোধন করি না। সাগ্নিক আমার কাছে তা-ই। আপনার সাথে আমার কথাবলাটা অনেকটা মাঝরাতে ঈশ্বরের কাছে কনফেস করার মত। সূচনা তো অনেক হলো, এবার মূল বিষয়ে আসি।

প্রথমে কেবল বন্ধুত্ব থাকলেও ৫ বছর পর সেটা প্রেমে রূপ নেয়। ভালোবাসা নামক নাটকটি চলে আরও ৬ বছর; এর মাঝে অনেক সুখকর স্মৃতি, অনেক বেদনাদায়ক স্মৃতিও তৈরি হয়, কখনওবা তা ঝগড়া কিংবা মারামারির পর্যায়েও চলে যায়, তবু ভালোবাসাটা কোথাও থেকেই যায়। বন্ধুত্ব এবং প্রেম সব মিলিয়ে যখন একটি সম্পর্কের বয়স ১১ বছর, তখনি ছেলেটা হটাৎ পাল্টে যেতে থাকে। একের পর এক মেয়েঘটিত জটিলতায় বাজেভাবে জড়াতে থাকে। আমার কাছে যখন ধরা পড়ে যায়, তখন পুরো ব্যাপারটি খুব কৌশলে লুকিয়ে যায়। আমি ভাবি, হয়ত আমারই বোঝার ভুল। এভাবেই চলতে থাকে। কিছু দিন পর আবার একই ঘটনা, আমার কাছে ধরা পড়ার পর আমি সাদমা নামের সেই মেয়েটির সাথে দেখা করি। সব শুনে বুঝলাম, মেয়েটির কোনও দোষ নেই, আমার গুণধর মানুষটি তাকে পটানোর চেষ্টা করছে ক্রমাগত। অনেক কষ্ট পেয়ে সরে যেতে চাইলাম।

ওমা! উনি আবার কাকুতিমিনতি করে সব ভুল স্বীকার করে আমায় ফিরিয়ে আনলেন! আর……..আমিও গলে গেলাম। মেয়েরা গলে যায়ই! বরফ গলতেও আরও একটু সময় নেয়! প্রেম আবারও চলছে, হঠাৎ আবারও আবিষ্কার করলাম তার দোনামনা। সন্দেহ হলো। হুম্‌ ঠিক তা-ই! আবার সেই সাদমা-প্রীতি চলছে, ওই মেয়েকে পাবার জন্য উনি মরিয়া, আমি এবার ডিটারমাইন্ড হয়ে গেলাম, তার সাথে আর নয়। সে ভাল থাকুক তার মত করে, শুধু অনুরোধ করলাম আমার সাথে কোনও রকম যোগাযোগ না করার।

কিন্তু ঠিক দুইদিন পরপরই ও আমার সাথে কন্টাক্ট করে। আমি কষ্ট পাই, নিজেকে খুব ছোট মনে হয়, জানেন! আজ সাদমার সাথে কথা হলো, জানলাম, ওই মেয়েকে উনি ১৫টা নম্বর থেকে সমানে টেক্সট করেন, ফোন দেন! মেয়েটা রীতিমত বিরক্ত হয়ে কথাগুলো আমায় বলে! আমি স্তব্ধ হয়ে যাই, কী বলব, কী ভাবব, বুঝে উঠতে পারি না। সাদমাকে আর আমার বন্ধু কাঁকনকে ও বলে, আমি নাকি সাইকো, আমি নাকি পাগল হয়ে গেছি।

আজ ওর সাথে আমার শেষকথা হলো, আজ ও স্বীকার করলো, ও আসলে কখনও ভালোবাসেনি আমায়, শুধু নাকি করুণা করে এসেছিল। শুনে কিছুই বলতে পারলাম না। শুধুই ওর দিকে তাকিয়েছিলাম।

আমি ওর সামনে থেকে চলে এসেছি সারাজীবনের জন্য। আর যা-ই হোক, কারও করুণা নিয়ে বাঁচতে চাই না। ওকে অনেক ধন্যবাদ, আজ ১১টি বছর পরে হলেও ও স্বীকার করলো চরম সত্যটা। শুধু এজন্যই ওকে ক্ষমা করে দিলাম। ভাল থাকুক ও………ভীষণ ভাল।

সাগ্নিক, বাসায় এসে মনে হলো, আমার দমবন্ধ করে মরে যাওয়া উচিত। চেষ্টাও করেছিলাম। হঠাৎ মনে হলো, কথাগুলো কাউকে বলা উচিত, আমার কনফেস করা উচিত, আর তাই আপনাকে লিখতে বসে গেলাম। আমার খুব দমবন্ধ লাগে। মনের দেয়াল থেকে একশকোটি হাত বের হচ্ছে, হাতগুলো আমার গলাটাকে চেপে ধরছে, আমি নিঃশ্বাস নিতে চাই, কিন্তু পারি না, আমার কেবলই গলা শুকিয়ে যায়। আজ বাবাকে খুব মনে পড়ছে। বাবা বেঁচে থাকলে বাবাকে বলতাম, তার শক্ত দুটো হাত দিয়ে আমায় একটু চেপে ধরতে। মায়ের সাথে আমার সখ্য খুব কম, মা আমার থেকে অনেক দূরে থাকেন। তবু আজ মনে হচ্ছে, মাকে যদি একটু জড়িয়ে ধরতে পারতাম, যদি একটু প্রাণখুলে কাঁদতে পারতাম! জড়িয়ে কাঁদতে পারার মত কাউকে না পাওয়ার চাইতে বড় কষ্ট এ পৃথিবীতে আর হয় না। লোকে অসহায় হয়ে গেলে কেবলই আশ্রয় খোঁজে। সাগ্নিক, আমার খুব ভয় হয়, জানেন………সারা পৃথিবীটা অন্ধকার লাগছে, মনে হচ্ছে, আমি দেখতে পাচ্ছি না কিছু, কিংবা একটু পর আমি কিছুই আর দেখতে পাব না। আচ্ছা, আমি বাঁচব তো? আমার খুব বাঁচতে ইচ্ছে করছে…….ভীষণ! ভীষণ!

আচ্ছা, আমার এই লেখা কি আপনি পড়বেন? আদৌ কি দেখবেন? যখন দেখবেন, তখন আমি বেঁচে থাকবো তো?

রাতে ঘুম হয়নি। ভোরের দিকে একটু ঝিমুনির মতন হলো। সারারাত নিজেকে পাহারা দিয়েছি। মৃত্যুর ভয়ে জেগে থাকা। বেঁচে যেন থাকি, সে পাহারা দেয়া। সকালে উঠে মনে হলো, আমি সাকসেসফুল, কী দারুণভাবে আমি বেঁচে আছি! এ-ই তো আমার জন্য অনেক কিছু!

সকালের গতানুগতিক কাজ শেষে আমি অফিসে চলে যাই। বাসায় অত ভোরে পিসি অন করি না কখনও, কিন্তু কী আশ্চর্য, আজ আমি নেট অন করে আপনার টেক্সট পেলাম। আপনি লিখেছেন! সেটা পড়ে অবাক হলাম এ ভেবে যে ঈশ্বররাও উত্তর দিতে জানে! সাগ্নিক, আত্রেয়ী আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। “Get a life! Don’t waste your time anymore on the wrong person! OK? আপনাকে এই মুহূর্তে সামনে পেলে…………” কথাগুলি মাথায় বাজছে। বেজেই যাবে। কতক্ষণ বাজবে, জানি না। তবে অনেকক্ষণ তো নিশ্চয়ই! ভাল কথা, কী করতেন সামনে পেলে, বলেননি কিন্তু! আচ্ছা, কী-ই বা করতেন এমন! ঠাটিয়ে একটা চড় দিতেন, এ-ই তো? এই ইনকমপ্লিট লাইনটা ভেবেই অনেকটা সময় কাটিয়ে দিলাম……ব্যাপারটা মন্দ লাগেনি একদম! কেমন আছেন? খুব ভাল, খুব মন্দ, নাকি মোটামুটি? শুনেছি, ঈশ্বর প্রায়ই মোটামুটি থাকেন। কত লোকে কত সিলি কারণে বেচারাকে জ্বালায়, বলুনতো!

তুলে আছাড় মারতেন? হাহাহা………ভেবেই আনন্দ হচ্ছে। আমাকে দেখেননি তো কখনও, তাই……হাসি আর থামবে না বোধহয়! আজকের দিনের শ্রেষ্ঠ বিনোদনটি আপনি দিয়ে দিলেন!

সাগ্নিক, যখন আমার মন খুব বেশি খারাপ লাগে, তখন কেন জানি না তোমার কথা আমার খুব বেশি মনে পড়ে। কেমন আছ তুমি? জানো, আজ বেশ অনেকটা সময় তোমার সাথে কথা হলো, কত কিছু যে জানলাম, তুমি যখন আমার সাথে কথা বলছিলে, আমি মুগ্ধ হয়ে তোমায় দেখছিলাম। বারবারই মনে হচ্ছিল, তোমায় তো আমার কখনও এমন করে দেখাই হয়নি। প্রিয় মানুষকে আমরা ঠিকভাবে দেখি কখনও? তুমি বড্ড বেশি ভাল, অন্যরকম, সুন্দরতম ব্যতিক্রম……….রেগে যাচ্ছ? আরে পাগল, এইগুলো তো সত্যি নয়, মিথ্যে করে বানানো গল্প। এইগুলো সবই আমার কল্পনা। আমার পাগলামির এক চিলতে নমুনা মাত্র!

জানেন, কিছু ভাল লাগে না, এজন্য এমন উদ্ভট কল্পনায় নিজের আয়নায় নিজেকে দেখি। যতক্ষণ এসব ভাবি, ততক্ষণ একটা ঘোরের মধ্য দিয়ে সময়টা কেটে যায়। আমি কি আদৌ আর স্বাভাবিক হতে পারব? আমার খুব খুব খুব ভয় লাগে।

ভাবনা: দুইশো পঁচাত্তর।

……………………………………..

এখন যা বলছি, কখনওই খুব কাছের মানুষ ছাড়া কাউকে তা বলা হয়নি। কীভাবে সব লিখে ফেলা যায়, বুঝতে পারছি না। এটা নিয়ে একটু উৎকণ্ঠাও কাজ করছে।

আমি ছোট থেকেই ভীষণ ভাল স্টুডেন্ট ছিলাম, তাই পড়ালেখার বাইরে কোনও দুনিয়াতেই কখনও ছিলাম না। এসএসসি দেয়ার পর আমি দাদাবাড়িতে ঘুরতে যাই, তখন আমার সাথে একটা ছেলের পরিচয় হয়, যে ছিল আমার কাজিনের দূর সম্পর্কের দেবর। ওকে শুধু একটু কাছ থেকে দেখা আর ওর সাথে কিছুটা সময় কাটানো হয়েছিল। এরপর আমি বাসায় চলে আসি আর আমার এসএসসি’র রেজাল্ট দেয়। আমি অপ্রত্যাশিতভাবে সো-কল্ড জিপিএ ফাইভ পেলাম না, তার চাইতে একটু কম আসে।

আমার বাবা-মা তখন রাগ করে আমার সাথে দুই সপ্তাহ কথা বলেনি। আমার মনে হয়, বাবা-মা’কে আর কষ্ট দেবো না, আমাকে দিয়ে আর লেখাপড়া হবে না। আমি তখন ওই ভাইয়াটাকে ফোন করি আর বলি, ভাইয়া, আপনি আমাকে নিয়ে যান, আমি আর লেখাপড়া করব না।………সে আসতে রাজি হয়, এর কিছুদিন পর চলেও আসে, আর আমিও তার সাথে চলে যাই। তখন জানতাম না যে, ওই যাওয়া মানেই ওকে বিয়ে করে ওর সাথে সংসার পাততে হবে আমাকে!

It was an accident! আর আমার হাজব্যান্ডের বয়সও তখন অনেক কম ছিল, সে সেসময় কেবল এইচএসসি দিয়েছিল। ওর পরিচয় বলতে, ও ছিল গ্রামের একেবারেই সাধারণ একটা ছেলে। এইতো কিছুদিন আগে অনার্স কমপ্লিট করল ন্যাশনাল থেকে, এখন একটা জব করে BARI’তে, তাও চাকরিটা স্থায়ী না। ওকে আমি কখনওই খারাপ বলতে পারব না, কেননা তার নলেজের পরিসীমা অনেক ক্ষুদ্র। কোন কাজটা কীভাবে, কখন, কেন করতে হবে, এসব সে ভাল বোঝে না। মোট কথা, আমার সাথে তার মানসিক ব্যবধান আকাশ-পাতাল।

আর ওদের বাড়িতে থাকার সময় এক বছরের মধ্যেই আমার একটা মেয়ে হয়। আমার বাপের বাড়ি ওদের থেকে অনেক বেশি প্রতিষ্ঠিত। তাই তারা কখনওই পারবে না আমাদের এ বিয়ে মেনে নিতে। কিন্তু এখন বাবা-মা অন্য উপায় না দেখে একটু মেইন্টেইন করে চলে আরকি! আমি বাবার বাসায় আসি, আবারও লেখাপড়া শুরু করি।

ঢাকা ভার্সিটিতে চান্স পাই, মেরিট পজিশনে থেকে অনেক ভাল রেজাল্ট নিয়ে এমএ কমপ্লিট করেছি। এখন আমার একটাই টার্গেট, এবং তা হল, আমার ফ্যামিলিকে দেখতে হবে। তার জন্য আমার একটা ভাল জব দরকার।

আমার লাইফটা ওর সাথে গত ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে কেবল কম্প্রোমাইজ করেই চলেছি। আমাদের সন্তানের দিকে তাকালেই মনে হয়, আমি কখনওই অন্য কিছু করার চিন্তাও করতে পারব না!

তবে মাঝেমাঝে খুব নিরাশ হয়ে পড়ি, ভীষণ কষ্ট লাগে। কিন্তু সবাই জানে, আমি খুব ভাল আছি, ভালভাবে চলছি। কখনও-কখনও টিকে থাকাই আমার জন্য কঠিন হয়ে যায়।

আমি অনেক সংগ্রাম করে আজকের এই পর্যন্ত এসেছি। সুন্দরভাবে বাঁচতে চাইলে একটা ভাল চাকরি আমাকে পেতেই হবে! এটা বুঝি। কিন্তু জীবনের যে সমস্যাগুলি আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে, সেগুলিকে আমি কীকরে দূর করব? কাউকেই বুঝতে দিই না যে কতটা কষ্টের মধ্যে আমি বেঁচে আছি! আমি অনেক ফ্রেন্ডলি একটা মেয়ে, তাই অনেক ফ্রেন্ড আমার। আমি খুব হাসি। সবাই আমাকে অন্যভাবে চিনে। কারও মন খারাপ হলে, কেউ কোনও ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে আমি কাউন্সেলিং করি। সবার কাছেই আমি একজন হাসিখুশি, দুঃখহীন মানুষ। কেবল আমিই জানি, আমি যে কীসের মধ্য দিয়ে জীবনটা পার করছি! আইয়ুব বাচ্চুর গানটা প্রায়ই শুনি: নিজ ভুবনে চির দুঃখী, আসলে কেউ সুখী নয়………

ভাবনা: দুইশো ছিয়াত্তর।

……………………………………..

এক।

এই প্রশ্নটা, অনেক মানুষকেই জিজ্ঞেস করে, উত্তর মোটামুটি একই পেয়েছি………আমার বিসিএস ক্যাডার হওয়ার সকল স্বপ্ন এখানেই শেষ!………খুব কষ্ট করে বাবা-মা প্রাইভেটে পড়িয়েছে, ভেবেছিলাম, অ্যাডমিশন টেস্টে বাবা-মা’র স্বপ্ন পূরণ করতে না পারলেও বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে ওদের স্বপ্নটা পূরণ করার সর্বোচ্চ চেষ্টাটা করব। কিন্তু কী হতে কী হয়ে গেল………৭ বছরের একটা রিলেশন মিথ্যে হয়ে গেল! ছেলেটার কাছে কোনও দামই মেয়েটা পায়নি। ছেলেটার বিয়ে হয়ে গেল ১১ মার্চ ২০১৬। নিয়তি কত নিষ্ঠুর! মেয়েটা এখন আর কোনওকিছুতেই অবাক হয় না। ওর কেন জানি বারবারই মনে হয়, মানুষের দ্বারা সবই করা সম্ভব! ৭ বছর মিশেও সে মানুষটার জীবনসঙ্গী হতে পারল না শুধু তার বাহ্যিক সৌন্দর্য কম আর সামাজিক অবস্থানটা শক্ত নয় বলে, অথচ একদিনের দেখায় একটা মানুষ সারাজীবনের জন্য সঙ্গী হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে ফেলল কেবল ফেসবুকের জোরে!

শুধুই চুপচাপ দেখে গেছি। ওকে একটাও প্রশ্ন কখনও করিনি। নীরব দর্শক হয়েই বেঁচে আছি। ২০ মার্চ আমার পরীক্ষা, কিন্তু আমি কিছুই পড়তে পারছি না, আগে যা পড়েছি, সবই ভুলে গেছি! আমি ওর ব্যাপারটা কিছুতেই মাথা থেকে এক মুহূর্তের জন্যও বের করতে পারছি না। আমি জানি না আমি কীকরে এ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাব! আমি আর পারছি না! আমি যে কীসের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, তা আমি কোনওভাবেই লিখে বোঝাতে পারব না। প্রায়ই এমন হয় যে কোনওকিছুর ব্যাপারেই আমি কোনও আগ্রহবোধ করি না।

কত বোকা আমি! ওর প্রত্যেকটা কথাই বিশ্বাস করতাম! ওকে পাগলের মত ভালোবাসতাম! নিজের জীবনের চাইতে বেশি দাম দিতাম ওকে। পরশু একজাম, অথচ কিছুই পড়া হচ্ছে না। খুব কষ্ট হচ্ছে, কান্না পাচ্ছে। আম্মুকে জড়িয়ে ধরে তার কাছে ক্ষমা চাইতে ইচ্ছে করছে। মনে হচ্ছে, আম্মুকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে পারলে অতীতের সব পাপ মুছে যেত, আর একটু হাল্কা লাগত। কিন্তু তা কিছুতেই করা যাবে না। কারণ আম্মু এমনিতেই আমাদের নিয়ে খুব টেনশনে থাকে। আমি আমার কথা কারও সাথে শেয়ার করতে ভয় পাই। কেন জানি মনে হয়, যদি কেউ আমাকে করুণা দেখায়! এমনকি আমার বন্ধুদের অনেকেও আমার ব্যাপারটা জানে না। নিজেকে ক্ষমা করতে পারি না। শুধু মনে হয়, আমি আমার ফ্যামিলিকে এতো ঠকালাম!

আজকে একজাম দিলাম। পরীক্ষার হলেও সে আমার মাথার মধ্যে যেন আটকে ছিল! মাঝেমাঝে মনে হচ্ছে, আমি পাগল হয়ে যাব! সাতসাতটি বছর! লাইফের কত খারাপলাগাকে মেনে নিয়েছি কেবল ওর ভাললাগার জন্য। নিজের কত ভাললাগাকে ভুলে গেছি কেবল ওর ভাল লাগত না বলে! ওর সাথে শেষ কথা হয়েছে গত ফেব্রুয়ারির ১৫ তারিখ। আর কখনওই ওর সাথে কথা বলতে পারব না—এটা মেনে নেয়া খুব কষ্টের!

তবু মেনে নিতে হবে। জীবন তো আর কারও জন্য থেমে থাকে না! জীবনে সবই মানিয়ে নেয়া যায়!

দুই।

প্রথমেই বলে নিই, সব দোষ আমারই। ২০০৮-এ চবি’তে বাবার ইচ্ছায় ভর্তি হলাম Genetic Engineering and Biotechnology বিভাগে। কেমনে-কেমনে জানি এক মেয়ের প্রেমে পড়ে গেলাম! ১ম বর্ষে ১ম হলাম। এরপর থেকেই আমি প্রেমে সিরিয়াস হয়ে উঠলাম। বলা যায়, একধরনের মোহ। পড়াশোনার চেয়ে একসময় প্রেমই আমার কাছে বড় হয়ে উঠল। কারণ শিক্ষকরা খুব বলতেন আর বাইরে যাবার স্বপ্ন এমনভাবে দেখাতেন যে, মনে হতে লাগল, রেজাল্ট ভাল, পাবলিকেশন আছে, আমার পক্ষে বাইরে যাওয়া তো কোনও ব্যাপারই না! কিন্তু বাস্তবে হল তার উল্টো। আমি যখন অনার্স পাস করলাম, তখন প্রেমিকা বলল, চলো, বিয়ে করে ফেলি। তুমি বাসায় কথা বলো। তখন আমার মা আর বোন, দুইজনই অসুস্থ। ওই অবস্থায় বাসায় বিয়ের কথা বলার মত পরিবেশ ছিল না।

আমি তার কাছ থেকে দেড় বছর সময় চেয়ে নিলাম, আর বললাম যে এর মধ্যেই কিছু একটা করব। অনেক স্কলারশিপের জন্য ট্রাই করলাম, একটাও হল না। প্রবলেম ছিল আমার আইএএলটিএস স্কোর। ইংলিশে আমি দুর্বল। আমার কখনওই বিসিএস কিংবা সরকারি চাকরির প্রতি ঝোঁক ছিল না। কারণ, আমার পক্ষে সাধারণ জ্ঞান, বাংলা এসব মুখস্থ রাখা কিছুতেই সম্ভব নয়! স্কলারশিপ হচ্ছে না দেখেই বিসিএস পরীক্ষা দেয়ার প্রতি ঝুঁকলাম। কিন্তু মানসিক চাপের কারণে তাও হল না। চাপ বলতে, আমার বেঁধেদেয়া দেড় বছরের মধ্যে বাকি আছে মাত্র তিনমাস। এর মধ্যে আমি আমার ভালোবাসার মানুষটার কাছে আস্তেআস্তে বেইমান হতে লাগলাম, কারণ তার ধারণা, আমি ওকে বিয়ে করব না, আর আমি যে চেষ্টাগুলি করছি, তার সবই আইওয়াশ। ওর মুখে শোনা ‘বেইমান’ শব্দটা আমার আত্মসম্মানে আঘাত করে বসল। বাধ্য হয়ে আমি প্রাইভেট জবের দিকে ঝুঁকলাম। অনেক চেষ্টার পর এক বছরের মাথায় একটা ফার্মা কোম্পানিতে মাইক্রোবায়োলিজিস্টের জব পেলাম। আমার প্রেমিকা খুব খুশি! আমার প্রেমের ব্যাপারটা আমার মা, বাবা সবাই জানত। তারা কোনোদিন এটা নিয়ে কথাও বলেনি।

যা-ই হোক, চাকরিতে ঢুকেই ধাক্কা খেলাম। প্রচণ্ড কাজের চাপ, তার মধ্যে আমার সিনিয়র মাইক্রোবায়োলিজিস্ট যে আছে, সে আমাকে ভয় পায়। সে মনে করে, আমার কারণে তার চাকরি ও জনপ্রিয়তা দুইই হুমকির মুখে পড়বে! সে আমাকে তাড়ানোর জন্য উঠে পড়ে লাগল, আর আমিও চাকরি বাঁচানোর ভয়ে সারাজীবন যা করি নাই, তা-ই করে বসলাম—পলিটিক্স করা শুরু করলাম, নোংরা অফিস পলিটিক্স। একজনের কথা আরেকজনকে বলে দেয়া, আরও কত কী! ওদিকে আমার প্রেমিকা তার বাসায় রাজি করাতে পারছিল না। এর মধ্যে আমার প্রেমিকার বিসিএস হয়ে গেল, এবং তার বাবা নিজ থেকেই বিয়ের ব্যাপারে রাজি হলেন। আমাদের দুই পরিবার একসাথে বসল। সে আমাকে বলল, তুমি আমাকে বিয়ে করার পর ক্যারিয়ার গড়তে যা ইচ্ছে, করো, শুধু আমাকে বিয়েটা করে ফেলো, প্লিজ। ওকে আমি বোঝাই, আমি যে চাকরি করি, সে চাকরিতে আমার ভাল কোনও ফিউচার নেই। অফিসে অনেক প্রবলেম। আমাকে অনেক উদ্বিগ্ন দেখে সে বলল, তুমি এ চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে অন্যকিছু করো। আমি বললাম, তোমার বাসায় যদি কিছু বলে? তাছাড়া আমার কোনও জমানো টাকা নেই। টাকা ছাড়া বিয়ে করলে বিপদে পড়ে যাব। সে বলল, তুমি ভেবো না, আমি তোমাকে সাপোর্ট দিব। এর মধ্যে সে জানায়, আমার পোস্টিং ঢাকার ওদিকটায় হতে পারে। আমি বললাম, কেন। কুমিল্লায় হলে প্রবলেম কী? সে বলে, না, তুমি চাকরি ছেড়ে আমার সাথে ঢাকায় গিয়ে থাকবে। এর কয়েকমাস পর গেজেট হল, তখন আমি ওকে বললাম, আচ্ছা, আমি তাহলে এখন চাকরিটা ছেড়ে দিই।

দেখি, দৃশ্যপট পুরোই বদলে গেছে! সে আমায় বলে, তুমি এক কাজ করো, চাকরিটা ছেড়ে দাও, কিন্তু এই মুহূর্তে ঢাকায় এসো না, কুমিল্লাতেই থাকো। তার সাথে আরও কিছু কথা বলার পর আমি বুঝতে পারলাম, সে আসলে ঢাকায় তার ফ্যামিলির সাথে থাকার জন্য এই কথাগুলি বলছে। প্রচণ্ড রাগ হল আমার! কিন্তু কিছুই করার নাই। স্ত্রী যখন স্বামীর চাইতে বড় চাকরি করে আর স্বামীকে ডমিনেট করার চেষ্টা করে, তখন স্বামী খুব অসহায় হয়ে পড়ে।

যা-ই হোক, আমরা বিয়ে করলাম। বিয়ের পর আমার বাবা-মা আমাকে ভুল বুঝতে থাকল। তারা ভাবতে শুরু করল, তাদের ছেলে পর হয়ে গেছে। বিয়ের পর আমি শ্বশুরবাড়িতে গেছি মাত্র দুই থেকে তিনবার। এটাতেই আমার মা একদিন বলে বসল, তুই তো এখন আর আমাদের ছেলে নাই, ওদের হয়ে গেছিস। মায়ের কথা শুনে আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম! এরকম আরও অনেক কথাই আমাকে শুনতে হল যা কখনও আমার কল্পনায়ও আসেনি। ওদিকে আমার বউও আমাকে পাত্তা দেয় না। ফোন করলে ব্যস্ততা দেখায়। এমনও হয়, দুইদিনেও আমাদের কোনও কথা হয় না। আমি রাগ করলে বলে, আমি তো আর তোমার মতন বেকার না, আমি সরকারি দায়িত্ব পালন করি, আমাকে নানান গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। অথচ, আমি কিন্তু আসলে বেকারও না, আমি তিনটা টিউশনি করি। আমার এই মানসিক কষ্টের সময় আমার ফ্যামিলিও আমার পাশে নেই। ওরা বলে, তুই বিয়ে করেছিস, নিজে নিজের মত করে ভাল আছিস। তোর বউয়ের দেখাও তো আমরা কখনও পাই না।

আমি দিনদিন একা হয়ে যাচ্ছি। মাঝেমাঝে কষ্ট এতো বেড়ে যায় যে আমার আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করে। বহু কষ্টে আবার নিজেকে সামলাই। আমি চাকরি ছাড়ার পর বিসিএস পরীক্ষার ফরম পূরণ করেও একজাম দিতে যাইনি। কারণ, মনখারাপ থাকে বলে আমার পড়াশোনাই করতে ইচ্ছে করে না। আমার কোনও প্রিপারেশন নেই। আমি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বাইরে-বাইরে ঘুরি। বাসায় ফিরে ঘুমিয়ে পড়ি। আমার কাছে কোনও জমানো টাকা নেই। আমার এ অবস্থা নিয়ে আমার স্ত্রীর কোনও মাথাব্যথাই নেই। ওর ধারণা, আমাকে দিয়ে কিছু হবে না। যা ওর মুখে আসে, আমার মুখের উপর তা-ই বলে দেয়। আমি ওকে বোঝাই যে আমি নাহয় দেশের বাইরে চলে যাই, ওখানে কিছু একটা করার চেষ্টা করি। কিন্তু ও আমার বাইরে-যাওয়াটা পছন্দ করে না। আমার নিজেকে ঘরজামাই মনে হয়। জীবনটা একটা পোষা ময়না পাখির জীবন হয়ে গেছে!

ভাবনা: দুইশো সাতাত্তর।

……………………………………..

এক।

দোস্তো, আজকে বাসায় আসতেসি।

তো! কার বাপের কী!

কয়েকদিন থাকব।

তো, আমরা কী করতাম যে?

অনেকদিন পর চট্টগ্রামে আসতেসি।

আল্লাহ্! সত্যি? তুমি তো চট্টগ্রামবাসীকে উদ্ধার করে ফেলসো যে! এখন কী হবে?

এমন করতেসিস কেন?

কেন? বেশি বড় ছেলিভ্রিঠি হয়ে গ্যাসো? কিসু বলা যাবে না?

হলে হইসি। কোনও সমেইস্যা?

উরি বাপ্রে! ভাআআআআব!!

আমি মায়ের কাছে আসতেসি। বাসা থেকে বেরই হব না এবার! খাব, ঘুমাব আর মুভি দেখব! যা ব্যাটা, ভাগ!

তুমি বের না হলে তো আমরা মরে যাব যে! হায়াল্লা!

তোরা সব শালা হারামি! কথা নাই তোদের সাথে।

কথা বলার দরকারও নাই, দাওয়াত খাইলেই হবে। শালা সেলিব্রিটির বাচ্চা, খাসি জবাই দিচ্ছি, বাসায় আসিস।

তোর শালী আসবে তো?

ওই শালা! আমার শালীকে কী দরকার?

আমরা তো ভাইবোন। জানস না?

কোন জন্মের?

জন্মজন্মান্তরের!

আমার বাসার ত্রিসীমানার মধ্যেও তোকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করলাম।

কোরবানির পরে?

আজীবনের জন্য।

তোর শালী আজীবন তোর বাসায় থাকবে কেন? কাহিনি কী?

চুপ থাক শালা!

ক্যান? পোড়ায়?

ওহে মূর্খ বালক! সরকার কি তোমাকে শকটে উপবিষ্ট হইয়া প্রাতঃকালীন সেলফি খিঁচাইবার নিমিত্তে শকটখানি বরাদ্দ দিয়াছিলেন? তুমি কি কেবল সরকারী অন্নধ্বংস করিবার অভিপ্রায় লইয়াই এইখানে আসিয়াছ? ফেসবুকীয় লাইক ধুইয়া জলপান করিতে-করিতে কে কখন কোথায় স্বর্গদ্বারের সন্ধানলাভ করিয়াছিল? তোমার অবয়ব কদর্য হইতে পারে, তাহা পরমপিতার দুর্জ্ঞেয় ইশারামাত্র। কিন্তু উহা শান্তিপ্রিয় ফেসবুকবাসীগণের সমক্ষে বারংবার উপস্থাপন করিয়া ভীতিসঞ্চারণপূর্বক তাহাদিগের সুখনিদ্রাভঙ্গের বিন্দুমাত্রও অধিকার কি তোমার আছে? বিসিএস ক্যাডার হইয়া তুমি কি সপ্তদ্বীপা বসুন্ধরা ভূরাদিচতুর্দশভুবনানা খরিদ করিয়া লইয়াছ? অবিলম্বে এইহেন অহেতুক কালক্ষেপণকারী আত্মরতি বিসর্জন কর, স্বীয়কর্মে মনোনিবেশ কর। অপরের ঈর্ষার উদ্রেক করিয়ো না। সুখে থাক, সুখে থাকিতে দাও।

দুই।

সমুদ্র……

কী? অবাক হলে তোমাকে সমুদ্র বলে ডাকছি, তাই? অনেক দিন থেকেই তোমাকে এই নামটা ধরে ডাকবো ভাবছিলাম। জানো তো, তোমার যে নামটাতে তোমাকে সবাই চেনে, ওটাতে ডাকতে আমার একটুও ভাল লাগে না। ওটার মধ্যে কেমন যেন একটা সর্বজনীন ব্যাপার আছে। মনে হয়, এ তো সবার! কিন্তু যখন তোমাকে সমুদ্র বলে ডাকবো, তখন না ওটাতে একান্ত আপন একটা ব্যাপার থাকবে, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা মেশানো এ ডাক শুধুই আমার। বুঝেছো?

জানি তো, আমার প্রতি তোমার অনেক রাগ। কী করি বলতো, আর সবার মত তো আমি না। তুমি যেভাবে সবার ভালোবাসা পেয়ে বড় হয়েছো, আমি তো সেভাবে হইনি। এই ‘ভালোবাসা’ শব্দটাতে না আমার অনেক ভয়! মনে হয়, সামনে আছে ঠিকই, তবে ধরতে চাইলেই হারিয়ে যাবে। জানো, আমি না যেকোনও সিচুয়েশনে যেকোনও কিছু খুব সহজেই মেনে নিতে পারি, তা সে যত কষ্টেরই হোক না কেন! এটা আমার একটা গুণ কি না জানি না। আমার জীবনের সব চাইতে মূল্যবান যে মানুষটা, যার জন্য হয়তো আজ এতোটা আসতে পেরেছি, সে প্রায়ই একটা কথা বলে……আয়োজন করে কখনও সুখী হওয়া যায় না, অমন করে কেউ সুখী হতে পারে না, সুখী যারা হয়, ওরা এমনিই হয়। দুঃখী থাকা ও সুখী হওয়া, দুইই মানুষের অভ্যেস। তাইতো নিজেকে সুখী করার আয়োজনে আমি কখনও ব্যস্ত হইনি।

উফফ্ তখন থেকে বকবক করছি! তোমাকে কেন আজ লিখতে ইচ্ছা হলো, জানো? কাল রাতে একটা স্বপ্ন দেখেছি। খুব সুন্দর একটা স্বপ্ন। লজ্জা লাগছে তো বলতে………তবুও বলি।

দেখলাম, আমি ভীষণ রেগে আছি। রাগ ভাঙাতে তুমি আমার জন্য একটা উপহার নিয়ে এসেছো। খুলে দেখলাম, একটা শাড়ি, লাল টুকটুকে একটা শাড়ি। হঠাৎ রাগটা কমে গেল আমার, খুব আনন্দ হচ্ছিল। তখন হঠাৎ মনে হলো, তুমি লাল শাড়ি কেন কিনলে, তোমার তো নীল পছন্দ! এটা তোমাকে বলতেই তুমি আমাকে বললে, আমার যে লাল পছন্দ, তাই তুমি লাল শাড়ি এনেছো। তারপর তুমি আরও কী বললে জানো? বললে, এই শাড়িটা, শাঁখা, সিঁদুর, আর নূপুর পড়ে তুমি সারা বাড়ি ঘুরে বেড়াবে, আর আমি তোমাকে শুধু দেখবো। ইসস্‌ কী যে লজ্জা পাচ্ছিলাম আমি, চোখে জল চলে এসেছিল। এতোটা সুখী নিজেকে এর আগে কখনও মনে হয়নি। মনে হচ্ছিল, জীবনের সবচাইতে সুন্দর আর মূল্যবান মুহূর্ত এটা।

তখনই স্বপ্নটা ভেঙে গেল! খুব কষ্ট হচ্ছিল, জানো? কেন এটা স্বপ্ন হলো, আর যদি শুধু স্বপ্নই হবে, তবে দেখলামই বা কেন এমন স্বপ্ন? ভীষণ রাগ হচ্ছে, জানো তো?

সকাল থেকে একটুও শান্তি পাচ্ছিলাম না, জানো? না জানি কী সব লিখে ফেললাম! আচ্ছা, এটাকে কি প্রেমপত্র মনে হচ্ছে তোমার? এমাঃ! এটা আমি কী করলাম! প্রেমপত্র লিখে ফেললাম তো! ভীষণ লজ্জা লাগছে!

জানি তো, তুমি হাসছো! একদম হাসবে না বলে দিচ্ছি! কী ভাবছ বলতো? আমি কে, সেটা ভাবছ? এটা তো বলব না! যদি পারো বুঝে নিয়ো। আর সাবধানে থেকো………ভাল থেকো।

ভাবনা: দুইশো আটাত্তর।

……………………………………..

একজন মানুষের বাড়িভর্তি বই—আমার মত বুকিশের মাথা খারাপ হবার জন্যে এটুকুই যথেষ্ট। তার উপর আবার চেহারা সুন্দর, তারও উপর আবার ব্রিলিয়ান্ট, সেন্স অফ হিউমারও ভাল। সনাতন ধর্মাবলম্বী না হলে আপনাকে উঠায় নিয়ে আসতাম, নেহায়েত কপালগুণে বেঁচে গেলেন আরকি! এটা নিয়ে আবার স্ট্যাটাস দিয়েন না যেন! কে নাকি বিয়ে খাবার দাওয়াত দিয়েছে আপনাকে, তার বিয়েটা খেয়ে আসুন, মশাই! নিজের বিয়েতে দাওয়াত দিয়েন, খুলনা কখনও ঘোরা হয় নি।

হুমায়ূন আহমেদের ‘কবি’ পড়তে হয় প্রচণ্ড জ্বর নিয়ে। একশ চার কিংবা পাঁচ ডিগ্রি জ্বরে যখন আশেপাশের সবকিছু ধোঁয়াটে স্বপ্নের মত হয়ে যায়, তখনই ‘কবি’ পড়ার শ্রেষ্ঠ সময়। অল্পঅল্প করে অনেকটা সময় নিয়ে শেষ করতে হবে বইটা। গভীর রাতে যেদিন অকারণেই ঘুম আসবে না, সেদিনের জন্যে ‘মেঘ বলেছে যাবো যাবো’, অলস দুপুরের জন্যে ‘মধ্যাহ্ন’ কিংবা ‘অন্ধকারের গান’, আর জোছনারাতে ‘তোমাকেই’।

কেমন আছেন? আপনার পোস্টে হুমায়ূন আহমেদের বইয়ের কথা জানতে চাইলেন, তাই বললাম। আমার নাম ইন্দু, ব্রাক ইউনিভার্সিটিতে পড়ি, বিবিএ’তে। আপনাকে বিরক্ত করে থাকলে আই অ্যাম নট সরি। আপনাকে একেবারেই না চিনে, আপনি কে, সেটা না জেনেই ফ্যান হয়ে গেছি, তার একটাই কারণ, সেটা হচ্ছে, আপনার বাড়িভর্তি বই। আমি ধরে নিয়েছিলাম, এত মেসেজের ভিড়ে আমারটা আপনার চোখেই পড়বে না, তাই অনেকটা নিশ্চিন্তেই লিখছিলাম। আপনার রিপ্লাই দেখে আনইজি ফিল করছি! অনেকটা ছোটবেলায় লুকিয়ে চকলেট খেতে গিয়ে ধরা পড়ে যাবার মত বিব্রত অবস্থায় আছি!

ভালই লিখতে পারেন আপনি! ভুল হল একটু। মানে, ভালই না, ভাল।

শুভ দুপুর। নাকি, সকাল? আমি তো জানতাম, ছেলেরা সফটমুভি দেখতে পছন্দ করে না! মুভি দেখে কোনও ছেলে কাঁদতে চাইবে, এতটা কখনও ভাবিনি! আমার এক ফ্রেন্ড আছে, সে আমার দেখা একমাত্র মেয়ে, যে কিনা প্রচুর পরিমাণে বিশ্বযুদ্ধের মুভি দেখে হিটলারে প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে! আপনিও ওই মেয়ের মত, মানে, স্বভাবে উল্টো! You guys are truely unpredictable! আপনাদের ওইখানে কি বৃষ্টি হচ্ছে? বৃষ্টির দিনে রোমান্টিক মুভি দেখে কাঁদতে হয়, যেমন Roman Holiday, Or Daisy। আপনাকে বিরক্ত করছি নাতো? মানে, অনেক ইম্পর্টেন্ট মেসেজের মাঝখানে ঢুকে যাওয়াটা তো ঠিক না!

পোস্ট দেখলাম। উফফ্‌! এইভাবে তো হবে না! খালি আম্মু, আম্মু! আম্মু ফেইসবুকে নাই তো, নিজেরটাও নাই, বউয়েরটাও নাই! অফলাইনে, অফলাইনে বলতে হবে আম্মুদের। আপনার না সলিডলিই কপাল খারাপ! আমি আপনার গ্যাং-এ থাকলে কবেই আপনার জন্য মেয়ে উঠায়ে নিয়ে আসতাম! আপনার জুনিয়রগুলো কোন কাজের নাহ্‌! খালি দাদা, দাদা করে আর ক্লিওপেট্রা খোঁজে, আরেহ্‌ এতদিন ধরে খুঁজলে তো দুধের শিশু চাঁদের বুড়ি হয়ে চরকা কাটার দিন চলে আসবে! কিচ্ছু বোঝে না পোলাপান! নাকি তারা বৌদি খুঁজতে গিয়ে নিজের জন্যে বউ খুঁজে নিয়ে আসে? এইসব ব্যাপারে অন্যের উপর ভরসা করা একদম ঠিক না! দ্য গ্রেট খান কী বলেছেন, শোনেননি? বলেছেন, নিজের ঢোল নিজেকেই পেটাতে হয়, অন্যকে দিলে হয় গায়েব করে ফেলবে, নয়তো ফাটায়ে ফেলবে! বুঝলেন কিছু? সময় গেলে কিন্তু সাধনটাধন হবে না বলে দিচ্ছি!

খুলনায় কি মেয়ের আকাল পড়েছে? ফলোয়ারগুলোও তো দেখি একেকজন সেই মাত্রার পাগল, আই মিন আপনার জন্য! একজনকে তো অ্যাট-লিষ্ট পছন্দ করেন! অনেক জ্ঞান দিয়ে ফেললাম। আমি বাই ডিফল্ট ভাল থাকি তো, তাই সবাইকে ভালথাকার বুদ্ধি দিয়ে বেড়াই। রাত-বিরাতে আপনার দুঃখ দেখে অবশ্য একটু খারাপ লাগল।

এক ধরনের মেয়ে আছে, ওদের হুমায়ূন আহমেদ বলতেন, ‘মায়াবতী’। খুঁজে দেখতে পারেন। একবার খুঁজে পেলে সারাজীবনই মায়া নিয়ে কেটে যাবে!

বেশিরভাগ মানুষের জীবন কেটে যায় ভালোবাসার খোঁজে, কিন্তু সৌভাগ্যবানের জীবন কাটে কাছের মানুষদের ভালোবাসতে-বাসতে আর ভালোবাসা পেতে-পেতে! প্রিয়জনদের সঙ্গ ঘিরে রাখুক আজীবন, অসহ্য সুখ উপচে পড়ুক হৃদয়উঠোনে। ১০০ বছর পরও যদি বেঁচে থাকেন, তখনও যেন জীবনটাকে রঙিনই মনে হয়। হ্যাপি লিভিং……হ্যাপি বার্থডে………

ভাবনা: দুইশো উনআশি।

……………………………………..

আজ মনের ভেতরে নানান প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে! কেন জানি খুব অচেনা লাগছে সবকিছু। আমি ছোটবেলা থেকে জীবনকে দেখেছি খুব সাধারণের মধ্যে অসাধারণভাবে। অনেক অভিজ্ঞতার ছোঁয়া পেয়েছি। বড্ড একাএকা বড় হয়েছি। ছোটবেলায় বন্ধু বলতে কেবল আমার মা-ই ছিল। আমি নিজের জগতে বাঁচতাম। খেলাধুলায় দুরন্ত ছিলাম। সাথে চেষ্টা ছিল কবিতা আবৃত্তি করার। একলা কাটে জীবনের ১৪টা বছর। হুম্‌ আমার কোনেও ভাইবোন নেই। আমি যখন এই জগতের সাথে পরিচিত হই, তখন সবকিছু আরও অচেনা হতে থাকে। তখন আমার কাছের বন্ধুও আমার থেকে দূরে। আমি যখনই বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিই, তখনই কেন জানি স্বাভাবিক সম্পর্কটা আর থাকে না। আমার জীবনের পুঁজি বলতে সততা এবং আত্মসম্মানবোধ। এগুলোকে অবলম্বন করেই আমি চলি। আপনাকে যা দেখেছি, তাতে মনে হয়েছে, মানুষকে বুঝার ক্ষমতা আপনার অসীম। আপনাকে ভাল বন্ধু হিসেবে পাওয়ার ইচ্ছা ছিল। জানি না তা কোনওদিন হয়ে উঠবে কি না।

আপনি যা বললেন, তা যদি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে আপনার কাছে আমার জানার আছে, কেন আমাকে দেখে এমন মনে হল? আমার কোথাও কোনও ভুল আছে? আমাকে লোকে যেভাবে অ্যাপ্রোচ করে, সেভাবে করার মত কিছু তো করি না আমি! তবুও কেন? কেন আমার জীবনে এমনটা ঘটছে বারবার? বলতে গিয়েও অনেক কিছুই বলা হল না। আজকে আপনার মত একজন জ্ঞানী মানুষ আমাকে সাহায্য করতে পারেন অনেকদিনের অজানা কিছু প্রশ্নের উত্তর দিয়ে। বন্ধু, তোমার দিকে চেয়ে রইলাম যদি আমার দিকে বাড়িয়ে দাও হাত, সে আশায়……..

আপনি আমার ফোন ধরছেন না কেন? আমি আবারও বলছি, আমি কোনও মিথ্যে বলিনি আপনাকে। আমি একইসাথে ইমোশনাল ও প্র্যাক্টিক্যাল। আমি আপনার সাথে কখনওই যোগাযোগ করার সাহস করতাম না, কিন্তু বিভিন্ন দিক থেকে আমার মনে হয়েছে, ঈশ্বর আমাকে আপনার সাথে কথা বলার সুযোগ করে দিয়েছেন। আজ আপনি আমার সাথে যে দুর্ব্যবহারটা করলেন, তারপরও বলছি, আপনার সাথে আমার কোনও না কোনওভাবে যোগাযোগ হয়েই যাবে। সে যোগাযোগের পর আপনি আমার কাছ থেকে দূরে সরে যাবেন। ওরা বলে, revenge is a dish best served cold! আপনার সাথেও এমন হবে। পরবর্তীতে মিলিয়ে নেবেন।

এক্সকিউজ মি, স্যার! মোস্ট প্রব্যাবলি আই ক্যান্ট গেট দ্য রাইট পয়েন্ট। আসলে আপনার ফেসবুক আইডি থেকে যতটুকু আইডিয়া করতে পেরেছিলাম, তার বেসিসে প্র্যাক্টিক্যালি ভাববার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু ব্যাপারটা হয়তো ঠিকভাবে বুঝতে পারিনি, তাই আপনার কাছে বোকা হয়ে গেলাম! অ্যাজ আই সেইড, আই রেসপেক্ট ইয়োর উইশ অব বিইং অ্যা ‘স্বপ্নের ফেরিওয়ালা’, অ্যান্ড আই হোপ, ইউ ক্যান আন্ডারস্ট্যান্ড, আই অ্যাম অ্যা ওয়েলউইশার টু ইউ!

বিবিএ’তে আমার সিজিপিএ ৩.৮৪, এইটথ্‌ সেমিস্টারে আমার রেজাল্ট ৩.৬ থেকে ৪-এর মাঝামাঝি ছিল। বুঝতেই পারছেন, রেজাল্ট নিয়ে টেনশন করার মানুষ আমি না। ক্লাসে অ্যাটেন্টিভ থাকি আর একজামের আগে যখন যতটুকু পড়তে ইচ্ছে করে, তা পড়েই পরীক্ষা দিই। পড়াটা আমার পছন্দের কাজ, কিন্তু একজাম দেয়াটা খুবই বিরক্তকর। এখন কথা হল, মিনিমাম একটা রেজাল্ট না থাকলে বিভিন্ন অপ্রীতিকর প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। তাই আমি রেজাল্ট ভাল করার পক্ষে। তাছাড়া, খারাপ রেজাল্টের ধাক্কা সবাই সামলাতে পারে না। কী দরকার, অতো রিস্ক নেয়ার?

আমি তো আপনার মত সরল মানুষ নই, তাই জীবনের নানান ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে ভীষণ সংশয়ে পড়ে যাই, আর তখন একজাম দিতে ইচ্ছে করে না। ছলাকলায় পূর্ণ না হলে নাকি নারীজন্ম সার্থক হয় না! আমি তাই আমাকে সার্থক করতেই এমন ছলনার মধ্যে ডুবে থাকি! হাহাহাহা……… আমি তো একেবারে সরল শব্দগুলি বুঝতে গেলেও অযাচিতভাবে প্যাঁচ লাগিয়ে ফেলি! কখনওবা একেবারে সহজ কথায়ও কেমন জানি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাই, মনে হতে থাকে যে, আমাকে আবারও জন্ম নিয়ে ছোটবেলা থেকে বড়বেলার দিকে যাত্রা শুরু করতে হবে খুব সহজ একটা মন নিয়ে! আপনার আচরণ মিনিংলেস ও সিম্পল। মিনিংফুল কমপ্লিকেটেড কোনও কিছুর চাইতে মিনিংলেস সিম্পল কিছুই বেটার! আমি যতই প্যাঁচানো কিংবা ঘোরানো চিন্তাভাবনা করি না কেন, আমি চাই যে আমার ভাবনাগুলিকে কেউ অন্যভাবে না নিক। আমি এমন কারও সাথে বাঁচতে চাই, যার সাথে কথা বলার সময় আমি অতো না ভেবেটেবেই কথা বলতে পারব। আমার কাছে পার্থিব দুনিয়ার প্যাঁচের চাইতে আমার মনের প্যাঁচ বেশি দামি। ভালোবাসা অন্ধ এবং সত্য……সাথে, অসভ্যও। শেক্সপিয়ারের টোয়েলফথ্‌ নাইট-এ যেমনি আছে, Journeys end in lovers meeting,/ Every wise man’s son doth know. তেমনি আমার মনে হয়, আমার ভালোবাসার সেই মানুষটির সাথে দেখা হওয়ার আগ পর্যন্ত আমার এ যাত্রা চলতেই থাকবে।

কী করছেন? প্রতি রাতেই কি এতো সময় ধরে ফেসবুকে থাকেন? আমি স্টুডেন্ট হিসেবে কিন্তু ভালই ছিলাম, রেজাল্টের যে হাল হয়েছে, তা আপনাকে ফলো করতে গিয়েই হয়েছে, মানে ফেল্টুস ডাক্তারকে ফলো করতে গিয়ে আমি ফেল্টুস স্টুডেন্ট হয়ে যাচ্ছি! যা-ই হোক, শুভ সকাল। আপনি কি আমাকে সাইকো ভাবেন? ভাবলে ভাবেন, দ্য চয়েজ ইজ ইয়োরস্‌! আমি সাইকো হলে আপনি আপনাকে যা-ই ভাবেন না কেন, আমি সাইকোই থাকব, আর সাইকো না হলে আপনার ভাবনা আমাকে সাইকো বানিয়ে দেবে না। আমি সাফার করব আমি যা, তার জন্য, আপনি আমাকে যা ভাবেন, তার জন্য নয়। তাহসানের প্রেমাতাল গানটা শুনে দেখুন। আপনি কথায়কথায় নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে যে মিনিংলেস ভাইবটা দেন, তার সাথে এ গানের থিমটার অনেক মিল আছে। বিন্দু আমি তুমি আমায় ঘিরে, বৃত্তের ভেতর শুধু তুমি আছো…….গানটা মগজের বুদ্ধিতে দিয়ে নয়, হৃদয়ের ইঙ্গিতে বুঝতে হয়।

ভাবনা: দুইশো আশি।

……………………………………..

আমার গল্পটা বলার মত কি না, জানি না। তবে এইটুকু জানি, আমার জীবনের কাহিনি গল্পলেখার রসদ জোটাতে পারে, হোক না তা খুব সামান্য, তবুও! কিন্তু আমার অস্বস্তিটা অন্য জায়গায়। আমি ঠিক জানি না আমার গল্পের শেষটা কোথায় হলে জুতসই হয়, মানে কোথায় গিয়ে আমি ইস্তফা নিয়ে নিলে গল্পটা আর কিছু হোক না হোক, স্রেফ গল্প হয়েও দিব্যি বাঁচতে পারবে।

আচ্ছা, শুরু করে দিই। ধরে নিই, গল্পের মেয়েটির নাম কুহু। খুবই সাদামাটা, দেখতে অতো খারাপ না। লেখাপড়ায় মোটামুটি। (জানি গল্পের নায়িকাকে লেখাপড়ায় ভাল বানাতে হয়, কিন্তু কী করব, বলুন, লেখক হলেও একটু হলেও সততা এখনও আমার মধ্যে কাজ করে।) ওদের ফ্যামিলি ভাল। বাবা প্রাইমারি স্কুলের হেডটিচার। ওরা দুই ভাই, দুই বোন। কুহু দ্বিতীয়। ভাইবোনের মধ্যে কুহুই দেখতে সবচেয়ে ভাল। প্রায় সবাইই ওকে সুন্দর বলে।

ঈশ্বর সবাইকেই কিছু একটা কম দিয়ে দেন। কুহুর একটা শারীরিক সমস্যা আছে—ওর এক হাত পোলিও-আক্রান্ত। এ সমস্যা নিয়েই মেয়েটি বিএসএস, এমএসএস কমপ্লিট করে। পড়াশোনা চলাকালীন অনেক নাগরই তার জীবনে আসতে চেয়েছে, সেটা সত্যি করেই হোক, আর মিথ্যে করেই হোক। মেয়েটি তার শারীরিক সমস্যার কারণে সবকিছুই এড়িয়ে চলে। মানুষের মধ্যে কোনও না কোনও খুঁত থাকা ভাল, এতে নিজেকে সংযত রাখা যায়। প্রায় নিখুঁত মানুষই প্রায় ধ্বংসের পথে হাঁটে।

একটা সময় আসে, যখন কুহু সবাইকে এমন করে এড়িয়ে চলাটা আর মেনে নিতে পারে না। বড্ড একাএকা ফিল করত ও। প্রায় রাতই সে এ ভেবে কান্না করে কাটিয়ে দেয় যে, কী হবে তার এ জীবন দিয়ে?

মেয়েটি সবই বুঝত। তবুও তার মনকে কিছুতেই বোঝাতে পারতো না। হয়তো তখন তার আশেপাশের পরিবেশ তাকে এমন হতে বাধ্য করতো। তার মাঝেই জীবন এগোতে থাকে।

হঠাৎ তার লাইফে একটা পরিবর্তন আসতে শুরু করলো। মেয়েটিকে ২০০৭-এ তার বাবা একটা মোবাইল ফোন দেয়। সিমটা তার আরও বছরখানেক আগে কেনা ছিল। সেই সুবাদে তার নাম্বারটা আগে থেকেই অনেকে জানতো। সে অবশ্য একটুএকটু ফাজলামোও করেছিল সিমটা দিয়ে তার কাজিনদের বুদ্ধিতে। যখন সে ফোন ইউজ করা কন্টিনিউ করতে থাকলো, তখন ২০০৭-এর মাঝামাঝি সময়ে একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন আসে।

কুহু ফোন ধরল। ওপাশ থেকে একটা ছেলে খুবই ফাজলামো টাইপের কথা বলল। তা শুনে মেয়েটি যেভাবে পারে, ছেলেটিকে সেভাবে বকলো। এমন বকা, যে বকা জন্মেও সে কাউকে কখনও দেয়নি। ওইদিকে ছেলেটি মেয়েটির সব জেনেবুঝেই ফোন করেছিল। মেয়েটা কই থাকে, কেমন, ফ্যামিলি কী, সমস্যা কী, সবই! কারণ ছেলেটি ছিল মেয়েটির দূর সম্পর্কের এক মামার বন্ধু। তার উদ্দেশ্য, মেয়েটিকে প্রেমে ফেলা। ওটা ছিল এক ধরনের বাজিজেতা—ওই মামার সাথে। স্বাভাবিকভাবেই মেয়েপটানোর যত পন্থা আছে, তার সবকটাই সে কাজে লাগাল। ওদিকে সেসময় মেয়েটার ছিল হাহাকার টাইপের সময়। কাজেই প্রিয় পাঠক, বুঝতেই পারছেন, মেয়েটি একসময় গলে গেল। কিন্তু সে এমন কাউকে চাইল না যার সাথে সে প্রেম করতে পারে, সে কেবল এমন একজনকে তার জীবনে জায়গা দিল, যার সাথে সে তার সকল দুঃখের কথা শেয়ার করতে পারে। যার কাছে জীবনের সবকিছুই বলা যায়, শান্তি পাওয়া যায়, এমন কাউকে পেয়ে মেয়েটি অনেক খুশি হল।

মেয়েরা ভাবে এক, হয় আরেক। ব্যস্‌! এমনি করে ক্রমেই হয়ে গেল প্রেম। কিন্তু একটা সমস্যা রয়ে গেল—মেয়েটি তার দুটো দুর্বল দিকের কথা ছেলেটিকে বলেনি। হাতের সমস্যা, তার বাজে রেজাল্টের কথা। সাথে কিছু মিথ্যেও বলেছিল। কারণ, মেয়েটির মধ্যে এক ধরনের হারানোর ভয় কাজ করতো সবসময়। সে ভাবত, এই বুঝি ছেলেটি ওকে ছেড়ে চলে যাবে! কারণ ছেলেটা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। তাও আবার ইংরেজিতে। স্বাভাবিকভাবেই আরও ভাল একটা মেয়ে তার প্রাপ্য। অন্তত কুহু ওরকম করেই ভাবত।

তাদের প্রেম চলে খুব ভালভাবেই। কিন্তু দেখা হয় বছরে এক বার কি দুই বার, কারণ মেয়েটি থাকে সিলেটে আর ছেলেটি ঢাকায়। হয় ছেলে সিলেটে আসে, নয়তো মেয়েটি ঢাকায় যায়। এ নিয়ে মেয়েটি খুব কান্না করতো, দেখা করতে চাইতো, কথা বলতে চাইতো। কিন্তু সে ছেলে মেয়েটির এমন সব আবদার প্রায় সময়ই এড়িয়ে যেতো। আজ পর্যন্ত কোনও বিশেষ দিনে ওদের কখনও দেখা হয়নি। এমনকি, মেয়েটির জন্মদিনেও ছেলেটি ওকে কখনও উইশ করেনি, অন্য দিনের কথা তো বাদই! এইসব নিয়ে রীতিমত ঝগড়া চলত ওদের মধ্যে।

এইভাবেই ফুরোতে থাকে দিন। মেয়েটি সবকিছু মেনে নেয়। কারণ ছেলেটি তার সব থেকে দুর্বল দিকটাই মেনে নিয়েছে। তার একটা হাত যে পোলিও-আক্রান্ত, এই কথাটা কুহু ওদের সম্পর্কের দুই মাস পরে ছেলেটিকে বলেছিল। এটা শুনে ছেলেটি খুব হেসেছিল সেদিন। বলল, আমি তো সবই জানি। আমি অপেক্ষায় ছিলাম, তুমি কবে নিজ থেকে বলো এই কথাটা। তখন তো মেয়েটি কান্না করতে-করতে শেষ। এমন মানুষও আছে, যে তাকে এতটা ভালোবাসে? তখন মেয়েটি প্রতিজ্ঞা করে, যে করেই হোক, এই ছেলেকে সে সুখে রাখবেই! তার জীবন দিয়ে হলেও ছেলেটির মুখে হাসি সে ধরে রাখবে।

তাই সে সবসময় নিজেকে ছোট করে রাখতো। ছেলেটির সকল খারাপ আচরণও নীরবে সহ্য করতো। তার একটাই ভাবনা, যে ছেলে তার এতো বড় একটা সমস্যা মেনে নিয়েছে, তার সব সমস্যা সে কেন মেনে নিতে পারবে না? তাই সে যা-ই বলে, কুহু তা-ই করে। এইভাবেই এগোয় তাদের প্রেম কাহিনি।

এইদিকে ছেলেটাও তাকে ভালোবাসে ভীষণভাবে। দিন যায়, বছর যায়; যেতেযেতে ২০১৬ এলো। তারা এখনও বিয়ে করেনি। এদিকে তাদের জীবনে সমস্যা বাড়ছেই। মেয়েটির পরিবার আর বংশের প্রায় সবাইই জেনে গেছে যে তার একটা ছেলের সাথে সম্পর্ক আছে। আর ওদিকে ছেলেটি এখনও বলতেই পারলো না যে সে একটা মেয়েকে ভালোবাসে। গত বছরই মেয়েটি বাসায় জানাতে বাধ্য হয়েছে যে, তার পছন্দের কেউ আছে। কারণ পরিবার তাকে বিয়ে দিয়ে দিতে উঠেপড়ে লেগেছিল। ছেলেও তাদের রীতিমত পছন্দ করা হয়ে গেছে। ওদিকে মেয়েটি যে ছেলেকে ভালোবাসে, তার তরফ থেকে কোনও সাড়াই নেই। প্রায় নয় বছরের সম্পর্ক ওদের। এখানে মেয়েটি না পারছে সহ্য করতে, না পারছে ওকে ছাড়তে। মেয়ের ফ্যামিলি মেয়েকে নিয়ে প্রায় মরমর অবস্থা।

ছেলে তার মার কাছে কিছু হয়তো বলেছিল মেয়েটির কথা। মেয়ের হাতের অবস্থা শুনে উনি এখন অন্য দশটা মা যা করতেন, তা-ই করেছেন, মানে, বিয়েতে তার অমতের কথা ছেলেকে জানিয়ে দিয়েছেন। যখনই ছেলে কুহুর কথা তুলতে যায়, তখনই মা অসুস্থ হয়ে পড়েন। এ এক ট্র্যাডিশনাল ধাঁচের মেলোড্রামা! এদিকে মেয়ে এখন ২৯ হল। এমন মেয়েকে নিয়ে মেয়ের ফ্যামিলি যে কী হালে আছে, তা সহজেই অনুমেয়। আর ছেলের ফ্যামিলি এ সম্পর্কের কোনও গন্তব্য দেখিয়ে দিতে পারছে না।

মেয়েটি এখন আর কিছুই বলে না, কেবল কাঁদে।

আরও কত কাহিনি রয়ে গেল। প্রিয় পাঠক, কী হবে মেয়েটির অতো কষ্টের গল্প শুনে? কুহুদের গল্প কখনওই অল্প হয় না। তবু ওদের অল্পেই আন্দাজ করে নিতে হয়। ছেলেটি কুহুকে কিছু সময়ের জন্য বাসায় নিয়ে রাখতে পারে, কিন্তু সারাজীবনের জন্য বাসায় তুলতে পারে না। এটা ভাবলে কুহুর নিজেকে খুব ছোট লাগে, কিন্তু এ জীবন থেকে অন্য কোনও জীবনে যাওয়ার কোনও পথও সে খুঁজে পায় না। খাঁচায় যে পাখির বাস, সে পাখির পৃথিবীটাই খাঁচাকে ঘিরে। কখনও খাঁচার দরোজা খুলে দিলেও কী যেন হারানোর ভয়ে সে পাখি খাঁচা ছেড়ে যায় না!

আচ্ছা, আমি যদি কুহু হই, একটু সময় হবে আমার জন্য? এই যে এতো কিছু লিখে ফেললাম, সে দাবিতে, অন্তত? ছোট্ট করে একটা আটপৌরে গল্প হবে, গল্প? আমার মনের ভেতরে ঢুকে আমাকে বোঝার একটু সময় হবে কারও? আমার জীবনে যা ঘটে আসছে, ঘটে চলেছে, তার একটা সাধারণ গল্প হবে কারও কলমে? আর কতদিন এমন ঘটবে, আমাকে আর কত প্রতীক্ষায় থাকতে হবে, আর কতটা কাঁদলে পরে হৃদয় থেকে সুখের হাসি তৃপ্তিভরে আসে, তার কোনও খোঁজ আমি জানি না। আমার গল্পটা কেউ শেষ করে দিন না, মশাই………আমি যে পারছি না গল্পের শেষে পৌঁছে যেতে! কী এক গোলকধাঁধার মধ্যে বেঁচে আছি……..বেরুনোর রাস্তা জানি না, শুধু জানি, এক অন্ধকার সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে হেঁটে চলেছি, যার কোনও দিকেই কোনও আলো নেই।