ভাবনাদেয়ালের পলেস্তারা (৪৩শ অংশ)

ভাবনা: দুইশো পঁচানব্বই।

……………………………………..

গত মাসের ২০ তারিখ আমি বাসা চেঞ্জ করে নতুন বাসায় উঠেছি। এই বাসায় আমরা তিনজন মেয়ে সাবলেট হিসেবে একটা রুম ভাড়া নিতে চেয়েছিলাম। ভাড়া ৮০০০ টাকা। হঠাৎ মেয়ে দুইজন আমার ফোন রিসিভ করল না। এক সপ্তাহ ওই দুইজনের জন্য অপেক্ষা করেছি। তবু ওরা ফোন রিসিভ করেনি। (আমার ধারণা, ওদের ভাড়ায় কুলায়নি, তাই ফোন ধরেনি।)

নতুন বাসায় ওঠার আগে আমি কয়েকবার বাসার মালিক আন্টি-আঙ্কেলের সাথে কথা বলেছি। নিঃসন্দেহে তারা ভালমানুষ। যখন উনাদের সঙ্গে শেয়ার করলাম, মেয়ে দুইজন তো ফোন ধরে না, আমি এখন কী করবো? উনারা হাসিমুখেই বলেছিলেন, তুমি একলাই ওঠো। আমরা ২টা মেয়ের জন্য টু-লেট দিচ্ছি। তখন বাসায় উঠলাম। এ-ই তো।

মজার ব্যাপার হলো, বাসায় ওঠার সময় আন্টি-আঙ্কেল দুঃখীদুঃখী ভাব নিয়ে বলেছিলেন যে তাদের ২ ছেলে তাদের খরচ দেয় না। বৌ নিয়ে আলাদা থাকে। একমাত্র মেয়ে শ্বশুরবাড়িতেই থাকে। শাশুড়ি ভাল না। তাদের মেয়ে ১ বছর হলো বাপের বাড়ি আসে না। তাই বাধ্য হয়েই ওরা সাবলেট ভাড়া দিচ্ছেন। আরেক ছেলের নাম স্বপন, সে বিদেশে যাবে। আজও যেতে পারে, কালকেও যেতে পারে। সব কাগজপত্র রেডি করা আছে।

৩ দিন পর আন্টি বললেন, মা, পাশের রুমটা তো ১ হাজব্যান্ড-ওয়াইফকে ভাড়া দিয়েছি। শুনে আমার হজম করতে একটু কষ্টই হয়েছিল। অবশ্য আমি কিছুই বলিনি। কারণ বাড়িতে মাস্টার-বেডরুম সহ বেডরুম ৩টা। তো ভাবলাম, উনাদের ছেলে হয়তো ডাইনিংরুমে পাতা খাটে থাকবে। পাশের রুমে আঙ্কেল-আন্টি ঘুমাবেন। আমি এই রুমেই থাকবো। আরও ভেবেছি, ছেলে তো বিদেশেই যাবে, আমার সাথে আরেকটা মেয়ে উঠলে দুইজন মিলে ৮০০০ দিবো। অসুবিধা কী!

২৫ তারিখ ক্লাস করে এসে দেখলাম বাড়িভর্তি মানুষ। মেয়েজামাই আর ২ বছরের নাতি এসেছে বেড়াতে। আন্টি আমার লাগেজ আর বইখাতা পাশের রুমে এনে রেখেছেন। যা-ই হোক, আমি খুশি হয়েছিলাম। ভালই লাগছিল, কারণ আন্টি এতদিন পর মেয়েকে কাছে পেয়েছেন।

২৯ তারিখ রাত্রে নতুন ভাড়াটিয়া ওই স্বামী-স্ত্রী চলে এলেন। আন্টি আমাকে নিয়ে ড্রইংরুমে চলে এলেন। ওখানে খাট পাতা আছে। আমি কিছুই মনে করিনি। কারণ মেয়েজামাই তো আর ঘরজামাই না, কতদিনই বা থাকবে! চলেই তো যাবে!

এর ভিতরে আরও কিছু বিষয় জানলাম। আন্টির ছেলে ৫টা, মেয়ে ১টা। বড় ২ ছেলে বিয়ে করে বৌ নিয়ে আলাদা থাকে। এই বাড়িতে ৩ ছেলেকে নিয়ে আন্টি-আঙ্কেল থাকেন।

আমি ডাইনিংরুমে এখনো ঘুমাই। কারণ, মেয়েজামাই গত মাসের ২৫ তারিখে এসেছে। এখনও আছে। আরও কিছুদিন থাকবে।

আমি ৮০০০ টাকার মোটামুটি ৩ ভাগের এক ভাগ, মানে ২৭০০ টাকা দিয়ে উঠেছিলাম। বাসায় বর্তমান পরিস্থিতি এই যে, ৩ রুমের ১ রুম সাবলেট দেয়া, ১ রুমে মেয়েজামাই আর নাতি আছে, ১ রুমে অদূরভবিষ্যতে সম্ভাব্য বিদেশযাত্রী ছেলে আর তার আরেক ভাই আছে। বেডরুম ৩টাই এঙ্গেজড। বাকি থাকলো ড্রইংরুম। ড্রইংরুম আর ডাইনিংরুম একসাথেই। খাটে আমি আর আন্টি ঘুমাই। ফ্লোরে আঙ্কেল ঘুমায়। খাটের ২ হাত দূরে সোফায় আন্টির আরেক ছেলে ঘুমায়।

আমি একটা মেয়ে। আত্মসম্মান বলে তো ১টা ব্যাপার আছে! ও আচ্ছা, আরেকজনের কথা তো বলাই হয়নি………এই বাসায় কামলাটাইপ আরেকটা ছেলেও থাকে। ও থাকাখাওয়া বাবদ আন্টিকে ৪০০০ টাকা দেয়।

আমার বাসায় এসবের কিছুই জানে না। কারণ, আমার আম্মা খুব বদরাগী। একটু অহংকারীও। তার ইচ্ছা, আমি বিয়ে করে ঘরসংসার করি। আমি তার কথা শুনিনি। এজন্য উনি আমার ওপর চরম ক্ষিপ্ত। পরিবারের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ঢাকায় পড়তে এসেছি আমি। আড়াই বছর থাকলাম। অনেক কষ্ট করেছি। এখন এসব বিষয় বাসার লোক জানলে ওরা আমাকে হাত-পা বেঁধে বিয়ে দিয়ে দেবে। বাংলাদেশের গার্ডিয়ানদের কাছে সব সমস্যার একটাই সমাধান—বিয়ে দিয়ে দেয়া।

ও হ্যাঁ, আমার বাড়িওয়ালা আন্টি-আঙ্কেল খুব ভালমানুষ। আমি তাদের সাথেই খাই। খরচ দিই। নিঃসন্দেহে উনারা ভাল। তবে প্রবলেম এই যে, তাদের শিক্ষাদীক্ষায় কিছু ত্রুটি আছে। ২১০০০ টাকা দিয়ে উনারা ভাড়া থাকে, কিন্তু নিজেদের চালচুলা নাই। ছেলেদের উনারা পরিশ্রম করতে শেখাননি। অলস ছেলেগুলো বাড়িতে এভাবে ভাড়া খাটিয়ে-খাটিয়ে বাড়িভাড়া তুলে নিজেরা ঢাকায় থাকে। এ-ই তো। আজ আমি বাসা ছেড়ে দিয়েছি। আমি নিজেও ক্লান্ত। সামনের মাসে সেকেন্ড ইয়ার ফাইনাল একজাম।

আন্টির ভুল শিক্ষার কারণে উনারা নিজেরা ভাল নাই। কারণ, উনারা চাইলে কম টাকায় বাসাভাড়া নিতে পারে। মানইজ্জতের দোহাই দিয়ে নেয়নি। আমি আর সাবলেটের হাজব্যান্ড-ওয়াইফ আর কামলাটাইপ ছেলে, তিনজন মিলে ২৭০০+৪০০০+৭০০০=১৩৭০০ টাকা দিই। আর উনাদের বেয়াদব ছেলেরা ফ্রি থাকে টাকা না দিয়েই, আর বেলা ১২ পর্যন্ত উপুড় হয়ে ঘুমায়।

ও হ্যাঁ, রুম খালি থাক না থাক, আন্টি আমার পাশে ঘুমাতে পছন্দ করেন। কারণ উনি তো সন্তানের মা, হয়তো টাকার অভাবে ভাড়া দিয়েছে, কিন্তু আমাকে একা ঘুমাতে দিতে সাহস করেন না। কারণ উনার গুণধর ছেলেরা যদি………!

আজ সারাদিন লেখাপড়া বাদ দিয়ে রাস্তায়-রাস্তায় বাসা খুঁজেছি, যদিও পাইনি। কারণ মেয়েদের সাথে থেকেথেকে নানান বিষয়ে আমার অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে। আজকাল কাউকেই বিশ্বাস করতে পারছি না। সাবলেট কথাটা শুনলেও আতংক কাজ করে। বিয়ে আমি করবো না। হোস্টেলে আমি যাবো না। তো আমি যাবোটা কই? তা আমি নিজেও জানি না!

একটা মেয়ে যদি সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় যে সে জীবনে কখনও বিয়ে করবে না, তাকে সমাজ কেন গ্রহণ করে না? একজন মানুষ একা থাকতে চায়, এতে সমাজের কী এসে যায়? একটা মেয়ের নিরাপত্তা দিতে পারে না যে সমাজ, সে সমাজ আবার মেয়েটার একা থাকার সিদ্ধান্তে গেলগেল রব তোলে! ভণ্ডামিতে পরিপূর্ণ একটা সমাজে আমরা বাস করছি। সমাজ এমন একটা ভাব দেখায় যেন সে তার সদস্যদের সুযোগসুবিধার প্রতি খুব আন্তরিক। আসলে প্রকৃত ঘটনা ভিন্ন। সমাজ এক দায়িত্বজ্ঞানহীন অভিভাবক, যে তার কথা না শুনলে অভিমান করে, কিন্তু তার কথা শুনে কোনও সমস্যা হলে তা সমাধান করে দেয় না। এ সমাজ নানান সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়, কিন্তু এখানে বসবাস করার জন্য যে সুবিধাগুলি পাওয়া যায়, সেগুলির প্রায়ই সবকটাই………সুবিধাটা যে গ্রহণ করছে, তার কৃতিত্ব, সমাজের নয়।

আমি মহাঝামেলার মধ্যে আছি। আমি বাসা থেকে খুব কম টাকা আনি। এইমাসে ২০০০ টাকা এনেছি মাত্র। সুন্দরবন ক্যুরিয়ার সার্ভিসে খুব ছোট্ট একটা জব করি। সে জব আবার পার্মানেন্ট না। সেখান থেকে চার বা পাঁচ হাজার টাকা যা আসে, ওটা দিয়েই আমি নিজেকে খুব ভালভাবে চালাতে পারি।

আমি যে ঠিক কাজটা করছি, তা জোরালোভাবে প্রমাণ করতে চাই। আমার নিজের ভালথাকার জন্যই আমি তা করব। কিন্তু সমাজ আমাকে তা করতে দিচ্ছেই না। কেন? আমি আমার যোগ্যতায় একা চলতে চাই। আমি সমাজের কাছ থেকে আনুকূল্য চাই না, করুণা চাই না, কেবল আমাকে বাধা না দিলেই আমি খুশি।

ভাবনা: দুইশো ছিয়ানব্বই।

……………………………………..

আমি বাঁচতে চেয়েছিলাম, স্বপ্নগুলোর বাস্তবায়ন করে বাবার আদর্শ মেয়ে হতে চেয়েছিলাম…….এটাই ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অপরাধ।

বাড়ির সবার অনেক আদরের ছোট মেয়ে ছিলাম, আর এখন সে আমিই অনেক বড় বোঝা। সংগীত পরিবারে জন্ম আমার। আমার বাবা ছিলেন স্কুল শিক্ষক; উনি ছিলেন, বলা চলে, অসহায় মানুষের দেবতা। তিনি জেলা শিল্পকলা একাডেমীর গানের আর নাটকের শিক্ষক ছিলেন। উনার প্রভাববলয়ে থেকেথেকে আমরা পাঁচ ভাইবোনই প্রচণ্ড গানপাগল হয়ে উঠেছিলাম, বড় আপুনি ঢাকাতে গান করতো, তার হাজব্যান্ডের অনেক বড় গানের স্টুডিও ছিল। অনেক সুখী পরিবার ছিল আমাদের। অনেকদিন পরপর আপুনি যখন আমাদের জন্য অনেক কিছু নিয়ে বাড়িতে আসতো, তখন খুব মজা হতো; এমনই একদিন আপুনি তার বরকে নিয়ে আমাদের গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে আসল। তার দুইদিন পর হঠাৎ আব্বু ব্রেইনস্ট্রোক করে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। আমি তখন ক্লাস ফোরে। আমাদের জন্য আব্বু কিছুই রেখে যেতে পারেননি, কারণ আব্বুর বেতনের বেশিরভাগ টাকাই আব্বু অসহায় মানুষের জন্য খরচ করে ফেলতেন। যখন আমাদের সংসারের হাল ধরার মত কেউ ছিল না, তখন আপুনিই আমাদের সংসারের হাল ধরলো। পিএসসি পরীক্ষার পর আমাকে ঢাকার অনেক ভাল একটা স্কুলে ভর্তি করে দিল, এবং আমার মেজোআপুকে বিয়ে দিয়ে দিল। কিন্তু আম্মুকে ছাড়া থাকতে আমার খুব কষ্ট হতো আমার। হোস্টেলে থাকার কারণে আমার গান গাইবারও কোনও সুযোগ ছিল না। ওখানে খুব ভাল রেজাল্ট করায় ওখানকার শিক্ষকরাও আমাকে আসতে দিতে চাইতো না, কিন্তু খুব কান্নাকাটি করে ১ বছর পর আমি গ্রামে মায়ের কাছে ফিরে এলাম। এসে গুছিয়ে পড়াশোনা আর গানকরা শুরু করলাম। ধীরেধীরে দেখতেশুনতেও অনেক বেশি সুন্দরী হয়ে উঠেছিলাম, ফলে সবার নজরে পড়তাম খুব বেশি। আম্মু সারাক্ষণ আমার সাথেসাথেই থাকত, তাই আমার তখন তেমন কোনও সমস্যায় পড়তে হয়নি। হঠাৎ একদিন আম্মুও ব্রেইনস্ট্রোক করে আমাদের ছেড়ে চলে গেল।

আমি বড্ড বেশিই একা হয়ে পড়লাম। পরিবারের সবাই আমায় বোঝা ভাবতে শুরু করলো। যে আপুনি আমায় এত ভালোবাসতো, সে-ই তখন বলতে শুরু করলো, তুমি না থাকলে আমার আর কোনও টেনশনেই থাকত না। অবশ্য এর কারণও ছিল, রাস্তাঘাটে ছেলেরা খুব বিরক্ত করতো। একটা ছেলে ছিল, যার শিক্ষাগত কোনও যোগ্যতাই ছিল না, তবে অনেক অর্থকড়ির মালিক ছিল, সবাই খুব ভদ্র বলে জানতো ওকে, ও আমায় বিয়ে করার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিল, ওর পরিবারের সবাইও খুব করে চাইতো আমাকে ওদের বাড়ির বউ করতে। এদিকে আমার আপুনির আমেরিকায় যাবার সব ঠিক হয়ে গেল, কারণ আপুনির শ্বশুরবাড়ির সবাই ওখানেই থাকত।

তখন আমার বাসায় হঠাৎ সবাই ঠিক করলো আমায় বিয়ে দিয়ে দেবে। ছেলেও ঠিক করে ফেলল। তখন আমি কেবল ৮ম শ্রেণীতে পড়ি। আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না কী করবো। যেখানে তারা আমার বিয়ে ঠিক করেছিল, সেখানে আমায় আর পড়াশোনা করাবে না। আমি তখন কেবলই নবম শ্রেণীতে উঠলাম। আর এরই মধ্যে আমার বিয়ের সবকিছু ঠিকঠাক, কোনও উপায় খুঁজে না পেয়ে আমি সেই অশিক্ষিত ছেলেটাকে বললাম, আমি ওকে বিয়ে করতে রাজি, কিন্তু আমার কিছু শর্ত আছে। তখন আমি ওকে বলেছিলাম যে আমার লক্ষ্যে পৌঁছানোর পথে আমার পাশে থাকতে হবে, আমার পড়াশোনা কখনোই বন্ধ করার কথা ভাবাও যাবে না, আর আমাকে কখনোই গান বন্ধ করতে বলা যাবে না, আমায় স্বপ্ন দেখার স্বাধীনতা দিতে হবে। ও আমার সব কথা মেনে নিল। আমি ওকে বিশ্বাস করলাম, কারণ ও আমায় পাবার জন্য আত্মহত্যা-চেষ্টা করার মত পাগলামিও করেছিল। আমি সবার অমতে ওর হাত ধরে বাড়ি ছাড়লাম।

ওর বাড়িতে যাবার পর দেখলাম, ওদের বাড়িটা কুসংস্কারে পরিপূর্ণ একটা বাড়ি। ওখানে সবার একটাই কথা—এই বাড়ির বউরা পড়াশোনাই করে না, গান তো দূরে থাকুক! আমি কী করবো, বুঝতে পারছিলাম না। তখন ও বলল, তুমি টেনশন কোরো না, আমি সব ঠিক করে দেবো। এরপর আমি স্কুলে যাওয়া শুরু করলাম, কিন্ত এটা ওর বাড়ির কেউ মেনে নিতে পারতো না, ওদের ছিল অনেক বড় পরিবার, সবাই আমায় সারাক্ষণই কটু কথা শোনাতো, আর প্রচুর কাজ করাতো, কাজ করতে জানতাম না বলেও নানা বাজে কথা শুনতে হতো। ৩/৪ মাস কেটে যাবার পর ও নিজেই পাল্টে গেল, কথায়কথায় প্রচুর বকাঝকা করতো, কিছু হতে না হতেই গায়ে হাত তুলতো। আমার বাড়ির সবাই আমার সাথে তখন সব যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল। তাই কাউকে কিছুই বলতেও পারতাম না। এভাবে খুব কষ্ট করে কোনওমতে এসএসসি’তে ৩.৬৭ নিয়ে পাস করলাম।

এর মধ্যে কিছু ঘটনার কারণে আমার বাসার সবাই সব মেনে নিয়ে আমাদের গ্রহণ করে নিল। আমি বাপের বাড়িতে শ্বশুরবাড়ির কিছুই বলতাম না, ভাবতাম, একসময় সব ঠিক হয়ে যাবে। এরপর আমি গ্রামেই একটা সরকারি কলেজে ভর্তি হয়ে গেলাম, খুব ভালভাবে পড়াশোনা শুরু করলাম। কিন্তু ওর অত্যাচার দিনদিন বাড়তেই থাকলো, এবার শুধু বাসায় না, বাইরেও আমার গায়ে হাত তুলতে শুরু করল। তাই মাঝেমাঝে কলেজে গিয়েও একাএকা কান্নাকাটি করতাম। কাউকে কিছুই বলতাম না। কলেজের ইংরেজির শিক্ষকের কাছে সবার সাথে সাথে আমিও পড়া শুরু করলাম, উনি বেশ ভাল পড়াতেন। আমি কোচিং-এর সব পরীক্ষায় প্রথম হতাম বলে উনি আমায় আলাদা চোখে দেখতেন, আমার নম্রতা নাকি তাকে মুগ্ধ করতো। এরপর উনি ধীরেধীরে জানতে পারলেন, আমি ভাল গান করি, ছবি আঁকি, আর কবিতাও ভীষণ ভালোবাসি। এইসব দেখে উনি আমার সম্পর্কে আরও জানতে আগ্রহী হলেন, এবং খবর নিয়ে জানতে পারলেন, আমি একটা ছেলেকে পালিয়ে বিয়ে করেছি। তিনি খুব খেয়াল করতেন যে আমি প্রায়ই খুব বিষণ্ণ হয়ে থাকি, কিন্তু কাউকে কিছু বুঝতে দিই না। তাই উনি আমার জীবনের গল্পটা মাঝেমাঝেই আমার কাছে জানতে চাইতেন, আর আমি নানান অজুহাতে সবসময়ই এড়িয়ে যেতাম।

এমনি একদিন হঠাৎ সরাসরি জিজ্ঞেস করায় আমি উনাকে সব সত্যি কথা বলতে-বলতে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললাম। আর সব শুনে উনিও কেঁদে ফেললেন। উনি বললেন, আমি তোমার পাশে আছি, তুমি এগিয়ে যাও………সাথে এটাও বুঝিয়ে দিলেন যে, উনি আমায় খুব ভালোবেসে ফেলেছেন। আমি তখন উনাকে বলেছিলাম, যা হবার হয়ে গেছে, এখন আর কিছুই করার নেই। কিন্তু উনি বললেন, যা হবার হয়ে গেছে বলেই জীবনটাকে এভাবে করে শেষ করে দেওয়া যায় না। জীবনটাকে শেষ করে না দিয়ে আবার শুরু থেকে শুরু করো। উনি খুব ভাল কবিতা আবৃত্তি করতে এবং লিখতে পারতেন, আমাকে নিয়ে অনেক কবিতা লিখেছিলেন, অনেক নামও দিয়েছিলেন উনি আমার। উনি আমাকে একেক দিন একেক নামে ডাকতেন। আমায় বলতেন, তোমাকে আমি তোমার চোখ দিয়েই তোমায় দেখাবো। তুমি আমার মধ্যে তোমার চোখে তোমাকে খুঁজে পাবে। উনি আমায় এত ভালোবাসা দিতে শুরু করলেন যে আমি অন্যান্য শারীরিক ও মানসিক কষ্টগুলোকে আর কষ্টই মনে করতাম না। আমি আমার হাজব্যান্ডের অত্যাচারগুলো আর সহ্য করতে পারছিলাম না, ঠিক করলাম, আলাদা হয়ে যাবো, উনিও আমায় ভরসা দিলেন, অনেকঅনেক স্বপ্ন দেখালেন—একসাথে পুরোটা জীবন কাটানোর স্বপ্ন। জীবনের প্রত্যেকটা মুহূর্ত নিয়ে স্বপ্ন। আমার লক্ষ্যে পৌঁছতে সাহায্য করার স্বপ্ন। উনি আমাকে ‘মেঘ’ বলে ডাকতেন, আর আমি উনাকে ‘রৌদ্র’ বলে ডাকতাম, আর আমাদের কল্পনার সন্তানের নাম ছিল ঘনার্ক। উনি বলেছিলেন যে উনার বাবা-মা’কে রাজি করানোর দায়িত্ব উনার। শেষের দিকে মাঝেমাঝেই উনি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতেন, তখন আমি উনাকে বোঝাতাম। ধীরেধীরে উনার আর আমার ব্যাপারটা কলেজে এবং আশেপাশেও জানাজানি হয়ে গেল। উনার মাকে উনি আমাদের ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললে উনার মাও রাজি হয়ে আমাকে আগে একা একটা মেয়ে হয়ে যেতে বললেন।

এরপর আমার হাজব্যান্ড আমার সাথে আবারো খুব খারাপ ব্যবহার করায় আমি আমার বোনের বাসায় চলে আসলাম, তখন ও আমার নামে অনেক বাজেবাজে কথা আশপাশের মানুষের কাছে বলতে লাগলো। আমার বাসায়ও প্রচণ্ড চাপ দিতে শুরু করলো, আমার পড়াশোনা বন্ধ করে দিল। ও আমার আপুর বাসায় আসা শুরু করলো, আর ও আসলে শুধুই ঝগড়া হতো। ওদিকে স্যার বললেন আমি যেন ওকে ডিভোর্স দিয়ে দিই। খুব করে বলায় আমি আর দেরি না করে ডিভোর্স দিয়ে দিলাম। আর এর কিছুদিন বাদে হঠাৎ করেই স্যার আমার সাথে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দিলেন, আগের নাম্বার পাল্টে ফেললেন। আমি বুঝতেই পারছিলাম না কী হলো, তাই উনার মাকে ফোন করতেই আমাকে উনার মা বললেন, তুমি আর আমার ছেলের সাথে কখনও কোনও যোগাযোগ কোরো না। তুমি তোমার মত থাকো, ওকে ওর মত থাকতে দাও। যা হয়েছে, ভুলে যাও, ওকে বিরক্ত কোরো না। তার সাথে আমি আর কোনও যোগাযোগ করতে পারলাম না, আমার এক কাজিনের কাছে উনি জানালেন যে, আসলে আমি মানুষ হিসেবে খুব খারাপ বলে উনার আমাকে গ্রহন করা উচিৎ না। আমার আগের জায়গায়ই ফিরে যাওয়া উচিৎ। আমি এখনও বুঝতে পারছি না, আমি এমন কী খারাপ কাজটা উনার সাথে করেছি, যে কারণে উনি আমার গায়ে ‘মানুষ হিসেবে খারাপ’ তকমাটা সাঁটতে পারেন!

আমার বাসার কেউ আমায় কোনও সাপোর্ট করে না। সবাইই আমার পড়াশোনার বিপক্ষে। তবু অনেক কষ্টে আবারও কলেজে যাওয়া শুরু করেছি, ঠিকমত পড়াশোনা করার চেষ্টা করছি, জীবনটাকে আবারও গোছানোর চেষ্টা করছি। এর মধ্যে কে যেন আমার ফেসবুক আইডি থেকে ছবি নিয়ে মাথা কেটে এডিট করে কিছু বাজে ছবিতে বসিয়ে আমায় ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করছে, আমাকে নানান নম্বর থেকে কে কে যেন ক্রমাগত ফোন করে যাচ্ছে, কলেজে যাওয়ার পথে কারা যেন দূর থেকে আমায় ফলো করতে থাকে, আমার এক মামাত ভাইকে আমার নামে কী কী সব বিশ্রী কথা বলে কে যেন মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছে……..এমন হাজারো সমস্যার মধ্যে আছি। কেউ আমার কোনও কথা আর বিশ্বাস করে না। আমার দুঃখ কেউ শুনতেই চায় না! আমাকে কেউ বোঝে না। কী করবো, কোথায় যাব, সামনের দিনগুলি কেমন কাটবে, কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। আমি জীবনে একবার ভুল করেছি বলে কি আর কখনও নিজেকে শোধরানোর কোনও সুযোগই পাব না?

ভাবনা: দুইশো সাতানব্বই।

……………………………………..

জানি, কষ্টের কথা কাউকে বলতে নেই। কেউ সেটার ভাগ নিতে পারে না, উল্টো কিছু তাচ্ছিল্য কপালে জুটতে পারে। তাই আমি কাউকেই কিচ্ছু বলি না। সবকিছু নিজের মধ্যে রেখে দিই। কিন্তু মাঝেমাঝে এত কথা জমতে থাকে, যেনো নিঃশ্বাসটা বন্ধ হয়ে আসে! কিছুকিছু মানুষ আছে, যাদের কাছে মনের কথা বললে একটু হালকা হওয়া যায়। তাই এমন কোনও মানুষ পেলে হড়বড় করে কষ্টের যত কথা, বলতে থাকি, বলেবলে হাল্কা হই। জানি, আমার দুঃখের কথা শুনে কারও কোনও কাজ নেই, তবুও বলি।

আমি যাকে ভালোবাসি, তার সাথে ব্রেকআপের মাসখানেক হয়ে গেছে। সে হয়তো অনেক ভাল আছে। বন্ধুবান্ধবীদের নিয়ে ওর দিন ভালই কাটছে। সে আমাকেও বলে দিয়েছে যেন আমিও সবটা ভুলে ভালথাকার চেষ্টা করি। কত সহজেই এমন কথা ও বলে দিল! কিন্তু আমি তো আর অভিনয় করিনি, কিংবা আবেগের বশেও ওর সাথে সম্পর্কে জড়াইনি। তাহলে আমি কীকরে ভুলে যাবো? সে কত সহজেই না সবটা ভুলে আছে, অথচ আমি পারছিই না! আমার কাছে প্রতিটি দিন, প্রতিটি রাত কেমন জানি নরকের মত লাগে। আমি অনেক রাত ঘুমাই না, অনেক দিন সারাদিন কিছুই খাই না। বেশ কয়েক রাতে মরার চেষ্টা করেও মরতে পারিনি। হাতের কাছে একটা ব্লেড ধরে রেখে সারারাত বসে থেকেছি আর কেঁদেছি। এখনো তা-ই করি। শুধু আব্বু আর আম্মুর মুখটা যখন মনে পড়ে, তখন আর এই জঘন্য কাজটা করতে পারি না।

সে আমাকে কত না সহজেই বলে দিল, “তোমার সাথে আমার যায় না।” কতরাত নিজেকে প্রশ্ন করেছি, তাহলে ও এটা আগে বুঝতে পারেনি কেনো? যখন ভালোবাসলাম, তখনই বুঝতে পারলো যে আমার সাথে ওর যায় না? আমাকে সে এটাও বলেছে যে, আমাকে নাকি ও আর ফিলই করে না, ও নাকি সব স্মৃতি ভুলে গেছে! শুনে অনেক কেঁদেছি। আমার কান্নার কোনও দামই সে দেয়নি। আমি তবুও বেহায়ার মত ওকে ফেরানোর চেষ্টা করেছি। ভালোবাসলে কি মানুষ এতটাই বেহায়া হয়! এরপর একদিন বলে বসল, সে নাকি তার কোনও এক বান্ধবীর প্রতি দুর্বল! আমি আগেই সবই বুঝতে পারতাম, কিন্তু মানতে চাইতাম না। ভয় ছিল, ওকে এসব জিজ্ঞেস করলে ওকে যদি হারিয়ে ফেলি! আমি এখনো ভাবি, যে মানুষটা আমাকে পাওয়ার জন্য অতটা পাগল ছিল, সে এতটা বদলে গেলো কীকরে? তাকে আমি ভালোবাসলাম আমার প্রতি তার ভালোবাসা দেখেই। অথচ সে এখন বলে দিল যে আমার সাথে নাকি তার যায় না! তাহলে কি সেটা ভালোবাসা ছিল না? কেবল অভিনয়ই ছিল? আমি সে-ই মেয়ে যে কিনা তার প্রেমিকের মুখে তার অন্য আরেক মেয়েকে ভাললাগার গল্প শুনে আর নিজেকে সান্ত্বনা দেয় যে সে তাকে ঠিক মনের মত করে পেয়ে যাবে!

আমি কত বেহায়া, কত বোকা! এত কষ্ট পাই মানুষটার কাছ থেকে, তবু সেই মানুষটার একটু কষ্টও সহ্য করতে পারি না! উল্টো তাকে সান্ত্বনা দিই! এমন গাধা আমি, আমার কপালে তো দুঃখই আছে! প্রতিদিন ভাবি, আর ওকে বিরক্ত করবো না, আর কোনও কথা বলবো না ওর সাথে, অনেক-অনেক দূরে চলে যাবো। কিন্তু ওকে ভুলতেই পারি না কিছুতেই! মানুষ আমাকে শুধু ভুলে যেতেই বলে। সাথে এটা কেনো বলে না, কী করলে একটু শান্তি পাওয়া যাবে? কোথায় গেলে একটু শান্তিতে নিঃশ্বাস নেয়া যাবে। এভাবেই বা আর কতদিন বেঁচে থাকা যায়? কী দোষ ছিল আমার? আমি তো নিজে যেচে ওর কাছে যাইনি, সে-ই আমাকে ভালোবাসিয়েছে, তবে কেন এ যন্ত্রণা?

এটা খুবই সাদামাটা ঘটনা, আমি জানি। অনেকের সাথেই এমন ঘটে। তবে আমার সাথে যে আগে কখনও এমন হয়নি। তাই এ যন্ত্রণা আমার কাছে নতুন, অভিনব। হয়তো সামগ্রিক বিচারে এর আলাদা কোনও দাম নেই, কিন্তু ব্যক্তিগত বিচারে এর অনেক দাম আছে আমার কাছে। ঈশ্বরকে হয়তো ধন্যবাদ দেয়া যায়, কারণ অনেক দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই উনি আমাকে ওর হাত থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কেন আমাকেই এর মধ্য দিয়ে যেতে হল? কেন আমাকে এমন কিছু হারাতে হল যা আমি নিতেই চাইনি, আমাকে জোর করেই নিতে বাধ্য করা হয়েছে? আমি ওকে ভুলতে পারি না। এমন একটা মধুর সম্পর্ক ভুলে যাওয়া যায়? এখনো আমি তার জন্য অপেক্ষা করি। সে কোনওদিনই কি আমাকে বুঝবে না? সে কি আমার জন্য কষ্ট পাবে? আমাদের কোনও স্মৃতিই কি তাকে কখনও কাঁদায় না? সবাই বলে, ও আমাকে কখনও বুঝবে না, আমার জন্য ওর মনে কোনও কষ্ট নেই। আমি ওকে যতটা ফিল করি, এর কণামাত্রও ও আমাকে কখনও ফিল করে না। আমি সবই বুঝি, কিন্তু মেনে নিতে পারি না। আমি মানতে চাই না যে ও আর আমাকে চায় না। ও এটাও বলে যে সে অপরাধী, কিন্তু ওর কিছুই করার নেই, আমি যেন ওকে মাফ করে দিই, ওকে ভুলে যাই। এতই কি সহজ! প্রতিদিন আমি ওকে সব জায়গা থেকে ব্লক করে দিতে চাই, কিন্তু পারি না। আমি এই অন্ধকার জগত থেকে মুক্তি পেতে চাই। সে এখন নাকি আমার বন্ধু হয়ে থাকতে চায়! কিন্তু এও কি সম্ভব? এতো ভালোবাসা বুকের মধ্যে নিয়ে সহজ বন্ধুত্বের অভিনয় করে যাওয়া যায়? ভাবছি, ওকে শেষবারের মত কিছু কথা বলেই ব্লক করে দিবো। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না আমার ওকে শেষবারের মত কী বলা উচিত! নাকি, কিছুই বলার প্রয়োজন নেই? যে সব বোঝেই, তাকে আর কী বোঝাবো?

একটু আগে ওকে ব্লক করে দিলাম। তাই এখন মনটা কেন জানি খুবই খারাপ হয়ে আছে। আমি কি ওই জঘন্য মানুষটাকে ভুলে যেতে পারব চিরতরে? মন থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারব কখনও? আমার ভার্চুয়াল জগত থেকে ওকে নাহয় ব্লক করেছি, কিন্তু মনের জগত থেকে ওকে ব্লক করে দেবো কীকরে?

ভাবনা: দুইশো আটানব্বই।

……………………………………..

এক।

অনেকদিন আমার গল্প লিখব ভাবি, লিখিও, কিন্তু অর্ধেক লিখে আবার কেটে দিই, আর কাউকে জানাই না। এখন যে লিখছি, এখনো জানি না, আদৌ এটা রাখব কি না। কী লিখবো এরপর তা জানি না, জাস্ট মনে যা আসছে, কোনও ভাবনা ছাড়া তা-ই উল্টাপাল্টা সব লিখছি। যদি লেখাটা পড়তে-পড়তে শেষ অবধি যেতে পারেন, তবে বুঝে নেবেন, অবশেষে শেষ হলো তাহলে!

আমার মন খারাপ, এবং অতিমাত্রায় খারাপ। মা নেই। আমার বেস্টেস্ট ফ্রেন্ডটা আজ নেই আমার সাথে। এ মাসের ২ তারিখ আমাকে ফাঁকি দিয়ে মা অনেকদূরে চলে গেল। কাল আমার একজাম আছে। সাইটোলজি একজাম। কিছুই পারি না আমি। পড়ালেখায় খুব একটা খারাপ ছিলাম না। বুয়েটে একজাম দেয়ার সুযোগ হয়েছিল। অ্যাকাডেমিক রেজাল্টও অতো খারাপ ছিল না। কিন্তু আমার কিছুই হল না। ডাক্তার হবার খুব ইচ্ছে ছিল। তাও হলো না। ২০১৬ সালে এইচএসসি পাস করি। এরপর থেকে আমার জীবনটা চরমভাবে ভাঙা শুরু হয়। ভাবছিলাম, সব শেষ হোক, তবুও আমার মা’টা তো থাক আমার সাথে, ভগবান তাও করলো না। ২০১৮ চলছে এখন, আর এ একলা পথ পাড়ি দেয়া শেষ হলো না। সবাই মনে করে, আমি কত সুখে আছি, এক আমিই জানি, আমি কেমন আছি, কীকরে যে বেঁচে আছি, আর কত খেলবে ভগবান আমাকে নিয়ে? অনেক ক্লান্ত লাগছে………অনেক! অনেক উল্টাপাল্টা কথা হয়তো লিখলাম। কেনো লিখলামই, জানি না, কাউকে কোনও কিছু লিখতে খুব মন চাচ্ছিল, আমার হয়তো তেমন কেউ নাই যাকে কোনও কিছু বলে কিছুটা হালকা অনুভব করতে পারি, তাই বাধ্য হয়েই কাগজকে বলা। ভাল নেই নাই আমি, আমি আছি ভালথাকার অহেতুক অভিনয়ে।

আর লিখতে খারাপ লাগছে, সব কথা মনে পড়লে কেমন জানি ফাঁকাফাঁকা লাগে, তবু তো মনে পড়েই! আপাতত এখানেই যবনিকা।

দুই।

এ জীবনের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলি কাটিয়ে দিলাম ফাঁকি মেরে। সেই ক্লাস নাইনে এক মেয়ে বলেছিল, “তুমি কি সিগারেটের ধোঁয়া দিয়ে বৃত্ত বানাতে পারবে? অমুক তো পারে! দারুণ লাগে দেখতে!” ওকে ভালোবাসতাম, তাই ওর কথা রাখতে গিয়ে সেই থেকে শুরু ওরকম করে বৃত্ত বানানোর খেলা। ওই এক বৃত্তেই জীবনটাকে বেঁধে আজ আমি এমন একটা কেন্দ্রবিহীন বৃত্তে এসে পৌঁছেছি, যার কোনও ঠিকানা নেই, শেষ নেই।

জীবনের প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপ পেরিয়ে তৃতীয় ধাপে এসে আমি চরমভাবে ব্যর্থ এক মানুষ। কোনও কুলকিনারা খুঁজে পাচ্ছি না; সামনে, পিছনে, চারপাশে শুধু অন্ধকার দেখতে পাই। আমি এইবার বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার্থী ছিলাম, তাও আবার দ্বিতীয়বার, মানে, চান্স না পেলে আর পরীক্ষা দিতে পারব না। প্রথমবার পরীক্ষা দিয়ে কোথাও চান্স পাইনি। ভেবেছিলাম, ভাল করে পড়ে দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ব, কিন্তু দ্বিতীয়বারেও আমি ব্যর্থ, কোথাও চান্স পেলাম না। কারও সাথে দেখা করতে পারি না, কথা বলতে পারি না, এমনকি ফেসবুকেও ঢোকাও যেন আমার অপরাধ। সবার একটাই প্রশ্ন………কোথায় চান্স পেলাম?

আমি আর কী বলব! আমার কী-ই বা বলার আছে! আমার মুখে তো কোনও ভাষা নেই, যে সফল হতে পারেনি, তার আবার কীসের কথা? কিন্তু আমি তো চেষ্টার কোনও ত্রুটি করেছি বলে মনে হয় না, তবুও তো কিছু হল না! যে ফেসবুক একদিন ব্যবহার না করলে মনে হয় যেন জীবনে মজার কিছু একটা মিস করে ফেললাম, সে ফেসবুকেও আসতাম না, এমনকি বন্ধুবান্ধবদের সাথেও যোগাযোগ বন্ধ করে রেখেছিলাম, মোবাইল ইউজ করতাম না বললেই চলে, শুধু একটাই চিন্তা ছিল………আমাকে ভাল কোথাও চান্স পেতেই হবে, রাতদিন পড়াশোনা করেছি, অথচ ভাগ্য আমার সহায় হল না। মা-বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারি না, লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যায়। তাদের কত স্বপ্ন ছিল আমি জীবনে ভাল কিছু করব, আর আমি কিনা সবকিছুই ভেঙে চুরমার করে দিয়েছি! আমার আশেপাশের অনেক বন্ধুই ভার্সিটিতে চান্স পেয়েছে, যারা পড়ালেখায় আমার চেয়ে তেমন ভাল ছিল না। তবু আজ ওরা ভাল আর আমি খারাপ। আসলে যোগ্যতার চাইতে অর্জন অনেক বড় ব্যাপার। যার অর্জন নেই, তার কোনও যোগ্যতাই নেই!

আমি থাকি শহরে, আর আব্বু-আম্মু থাকে গ্রামে। তারা তো বুঝবে না, আমি এখানে কী করি—পড়ালেখা, নাকি অন্য কিছু! তারা এখন একটাই বুঝবে, আমি পড়ালেখা করি নাই, তাদের দেওয়া টাকাপয়সা সব জলে গেছে! তারা তো বুঝবে না, আমি এখানে কত কষ্ট করেছি! তারা এখন কেউ কিছু বুঝতে চাইবে না, কারণ তাদের বোঝাবার মত কিছু আমি করতে পারিনি। কথায় নয়, কাজেই জয়—এটাই বাস্তবতা। মাঝেমাঝে মনে হয়, আমি এই জীবন আর রাখব না, এত ব্যর্থতা নিয়ে জীবনকে এগিয়ে নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। আমি ব্যর্থ, আমি কিছু করতে পারিনি, এটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় বাস্তবতা। আমি আজ জলজ্যান্ত মানুষ হয়েও মৃতের মত বেঁচে আছি। আমার বাবার এমন টাকা নেই যে আমি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ব। বিজ্ঞান নিয়ে পড়া আমার জন্য আসেনি যদিও আমি বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে চাচ্ছি। বর্তমানে বিজ্ঞান এমন একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, যাদের টাকা আছে, তাদের জন্যই বিজ্ঞান! ক্লাস নাইন-টেন পড়েছি প্রাইভেট ছাড়া, যার মাশুল আমাকে এখন দিতে হচ্ছে, এইসএসসি’তেও দিতে হয়েছিল। আমার বেসিকে অনেক ঘাটতি আছে। এখনকার ক্লাসে শিক্ষক ভাল করে পড়ান না, প্রাইভেট পড়ানোর জন্য, আর প্রাইভেট পড়ার সামর্থ্য আমাদের ছিল না। টাকার অভাব থাকায় প্রথমবার বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং করেছিলাম একটি নিম্নমানের কোচিং সেন্টারে, আর দ্বিতীয়বার কোথাও কোচিং করতে পারিনি। কী করব, বাবার অতো টাকা নেই যে! নিজে যতটুকু পারা যায়, চেষ্টা করেছিলাম। যদিও প্রথমবার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছিলাম গণিতে, তবু আমার ইচ্ছা ছিল, আমি কোনও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ব। আর এখন ইচ্ছাটা অলীক হয়ে গেল, স্বপ্ন কেবল স্বপ্নই থেকে গেল।

ফেসবুকে চ্যাট সবসময় অফ রাখি, যাতে কারও কোনও প্রশ্নের মুখোমুখি হতে না হয়। কারও সাথে দেখা হলে মাথা নিচু করে পালিয়ে আসি ওই একই প্রশ্নের জন্য! আমার স্বপ্ন বাদই দিলাম, আব্বার এই ছোট্ট স্বপ্নটা পূরণ করতে পারলাম না—এই চিন্তাটা আমাকে কুড়েকুড়ে খাচ্ছে প্রতিটি মুহূর্তেই! আমি কি পারব আব্বার স্বপ্নকে পূরণ করতে? আমি আর পারছি না, আমি আর পারছি না………বারবার ব্যর্থতা আমার সামনে হাঁটার রাস্তাটাকে আস্তেআস্তে সংকীর্ণ করে দিচ্ছে। একটাই ভর্তি পরীক্ষা বাকি আছে—নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়-এ। জীবন থেকে আমি একটা জিনিস বুঝেছি………যাদের টাকাপয়সা তেমন নাই, তাদের বিজ্ঞান নিয়ে পড়া মানে সমুদ্রের ঢেউকে থামিয়ে দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করা! যতই দিন গড়িয়ে রাত আসছে, রাত পেরিয়ে দিন আসছে, আমি যেন ততই একঘরে হয়ে যাচ্ছি, আমার এমন কোনও বন্ধু নাই, যে আমার খোঁজখবর নেবে, কেমন আছি, কী করি, এসব জিজ্ঞেস করবে। সব জায়গাতেই টাকাপয়সার ব্যাপার চলে আসেই! বর্তমান পরিস্থিতিটা এমন যে, যার টাকাপয়সা বেশি, তার খোঁজ নেয়ার জন্য বন্ধুর অভাব হয় না, আর যার টাকাপয়সা কম, সে মরে গেলেও কেউ তার কোনও খোঁজ রাখে না। এইসব চিন্তায় রাত্রে ঘুমাতেও পারি না, তাই শুয়েশুয়ে কেবল কাঁদি…………

ভাবনা: দুইশো নিরানব্বই।

……………………………………..

আপনার সময়ের জন্য ধন্যবাদ। আপনি আমাকে সময় দেবেন বলেছেন, এটা আমার জন্য অনেককিছু। আপনাকে এমনি করেই বারবার বিরক্ত করে যাওয়ার ইচ্ছে আছে। আশা করছি, এতে আপনি রাগ করবেন না। হাহাহাহা………ভাল কথা, আপনাকে সেদিন স্বপ্নে দেখলাম, তাই আপনাকে টেক্সট পাঠালাম।

আপনার জন্মদিন উপলক্ষে যে কনসার্টটাতে গাইলেন, সেখানে আমি ছিলাম। অনেক নেচেছি, অনেক চিৎকার করেছি, অনেক ছবি তুলেছি। আমি আপনার প্রেমে পড়ে গেছি, এতটাই পড়েছি যে আর উঠে দাঁড়াতেই পারছি না, আমার হাতটা একটু ধরবেন, প্লিজ! মানে, হাতটা ধরে ওঠাতে বলছি আরকি! আপনি যেমন করে গান করেন, গান শুরু করার আগে যেমন করে কথা বলেন, গান গাইবার সময় যেমন করে হাত নাড়ান, হাসেন, হাঁটেন, ঘাড় বাঁকান, চোখ নাচান, চুল ঝাঁকান, শরীর দোলান, গলা কাঁপান—সব মাথায় ঢুকে গেছে! আপনার মত এমন একজন পাশে থাকলে দুটো শাড়ি আর তিনবেলা ডাল দিয়ে ভাত খেয়েও দিব্যি জীবন কাটিয়ে দেয়া যায়! জীবনে আর কিছু না পেলেও অপ্রাপ্তির কোনও কষ্ট থাকবে না! আহা, এমন করে জীবনটা কাটাতে পারতাম!

আমাকে আপনার খেয়াল করার কথা না। আমি গ্রিন কালারের স্কার্ফ পরে আপনার সামনেই লেফটে দাঁড়িয়ে ছিলাম। দেখেছেন কোনোভাবে? আপনার কথাগুলিও মুগ্ধ হয়ে শুনেছি। এতো সুন্দর করে গান, আবার বলেনও! যখন বলছিলেন সবাই নাকি জন লেননের উপর ক্রাশ খায়, বিশ্বাস করেন, আমি মনেমনে বলছিলাম, আপনি আমার সামনে থাকলে অন্য যে কেউই নস্যি! আমি সারাক্ষণই আপনার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। আপনি বেশিই অস্থির!

আপনি আমায় কেন একটুও দেখলেন না? এটা ঠিক যে আল্লাহ্‌ সবাইকেই সুন্দর করে বানিয়েছেন, তবু কেন জানি আমার ধারণা, উনি আপনাকে একটু বাড়তি সৌন্দর্য দিয়ে দিয়েছেন! এটা কি খানিকটা অন্যায় না? আপনাকে দেখলেই শুধু ভালোবাসতে ইচ্ছে হয়, আপনার গান আর কথা শুনলেই আপনার সাথে প্রেম করতে ইচ্ছে হয়। কোনও মেয়ে যদি আপনার উপর ক্রাশ না খায়, তবে সে মেয়ে মানসিকভাবে অসুস্থ!

ওঃ আমার পরিচয়টাই দেয়া হল না! আমার পরিচয়টা যদি এভাবে বলি, তুমি শেষের কবিতা’র অমিত হলেও আমি নাটোরের বনলতা সেন নই, তাহলে ঠিক হয়। আপনার কাছে ঘেঁষবারও যোগ্যতা আমার নেই। আমি যেমন আছি, তার চাইতে বেশি যোগ্য হওয়ার কোনও সাধ জীবনে কখনও হয়নি, তবে আজ মনে হচ্ছে, আহা, কোনও বুদ্ধিতে যদি নিজেকে আরও একটু যোগ্য করে ফেলতে পারতাম! তুমি আমার দেখা সে মানুষ, যার পাশে খিদেপেটে কোনও অভিযোগ ছাড়াই ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকা যায়। আর হায়, আমি কিনা সে, যার পাশে দুই সেকেন্ড বসে থাকাও দুষ্কর! তুমি তা-ই, যা আমার জীবনের আজন্ম আকাঙ্ক্ষা, আর আমি তা-ই, যা তুমি উপহার হিসেবে পেলেও ভদ্রতার বালাই ভুলে ছুঁড়ে ফেলে দেবে!

আপনার ফ্যামিলি, স্ট্যাটাস, বৈবাহিক অবস্থা, বৈভব কি দারিদ্র্য, সুস্থতা, কোনোকিছুতেই আমার কিছু এসে যায় না, আমি শুধু আপনাকেই চাই, সে যেকোনো কিছুর মূল্যেই হোক না কেন! আপনি না গেয়ে অভিনয় করলেও অনেক ভাল করতেন। আপনার কথা বলার ধরন অনেক সুন্দর, সেন্স অব হিউমার দারুণ, গানের ফাঁকেফাঁকে ওই যে গল্প করছিলেন, প্রতিবার গল্প শোনার সময়ই নতুন করে বারবার প্রেমে পড়েছি। একদিনে এতবার কীভাবে কারও প্রেমে পড়া যায়, আমি আসলেই তা জানি না, কিন্তু পড়েছি, এটাই সত্যি!

আপনার কত যে ছবি প্রিন্ট করে বাঁধাই করলাম আর রুমভর্তি করে ফেললাম, যদি আপনাকে দেখাতে পারতাম! আমার উপর সবাই মহাবিরক্ত, কেননা আমি তো আর আলাদা বাসায় থাকি না, হলে থাকি। রুমে এক লোকের অতো ছবির যন্ত্রণা কাঁহাতক কে সহ্য করবে, বলুন! আপনার কথা ভাবলেই আমার শুধু কান্না পায়। কেন আপনি আমার নন? আমি কেন এতটা অযোগ্য? কেন আমি আপনার চোখে পড়লাম না? কেন এমন কারও সাথেই দেখা হয়ে যায়, যাকে আমি হুট করে চেয়ে বসি, অথচ যে কখনওই আমার হবে না? আমি আপনার হাজার পৃথিবীর একটা পৃথিবীতেও হয়তোবা নেই, অথচ আমার হাজারটা পৃথিবী জুড়ে শুধুই আপনি আছেন! পাব না জেনেও কত যন্ত্রণা পাচ্ছি! কোনও মানে হয়, বলেন? যাকে পেলামই না, তাকেও হারিয়ে ফেলার ভয় কেন এতটা অতিষ্ঠ করে দিচ্ছে আমাকে? কেন আমি সারাক্ষণই আপনার গান শুনে যাচ্ছি, আপনার কথা ভাবতে কেন আমার ভাল লাগতে হবে?

ভুল মানুষই বারবার এমন গভীর মায়ায় বিভোর করে রাখে কেন?

ভাবনা: তিনশো।

……………………………………..

প্রতিদিন সকালে জোড়া শালিক দেখার আশায় থাকি, কিন্তু সমস্যা হল, শালিক দেখলেই ওদের ঝগড়া দেখতে মন চায়! এখনও পর্যন্ত সে দৃশ্য চোখে পড়েনি। অবশ্য, আমি সে দৃশ্য দেখার জন্য যে খুব আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে আছি, তেমনটাও নয়। ভাগ্যে থাকলে কোনও একদিন শালিক দেখার সময় হয়তো শালিকের ঝগড়াও দেখতে পাব।

আপনার সম্পর্কে জেনেছি, বেশিদিন হয়নি। আপনার মাঝারি সাইজের কিছু গদ্যপদ্য পড়ে ভাল লেগে যায়, এবং এরপর থেকেই আপনাকে নিয়মিত পড়ি। আপনার লেখার হাত খুব একটা শক্তিশালী নয়, তবে আপনার কিছু জীবনদর্শন আমার ভাল লাগে বিধায় আপনার লেখার দুর্বলতাকে ক্ষমা করে দিয়ে আপনার লেখা এখনও পড়ে যাচ্ছি। বড় দুএকটি লেখা পড়ে মনে হল, আমার অনেক সময় নষ্ট হচ্ছে, তাই মাঝে একবার আপনাকে আনফলোও করে দিয়েছিলাম। দূরের যা, দূরে রাখাই ভাল। তবে সত্যি হচ্ছে এ-ই যে সে কয়েকদিন আপনাকে মিসও করেছি। আজ হঠাৎ জানতে পারলাম, আপনাকে আমি অতো বেশি কষ্ট করা ছাড়াই প্রত্যাশিতভাবেই দেখতে পারব! ফেসবুকে আমি কখনও আপনার কোনও ছবি দেখিনি, কারণ আমি জিরোরেটে ফেসবুক চালাই। তাই, আপনি কেমন, আমার কাছে এটার অর্থ, আপনার লেখা কেমন, সেটা। আর কী লিখব, বা লেখাটা কতটুকু র‍্যাশনাল হবে, বুঝতে পারছি না। আমার প্রায়ই আপনাকে স্ব-পূজারি মনে হয়, মানে, যেটাকে নার্সিসিস্ট বলে আরকি! আমি জানি না, আমার এই চিরকুট-মার্কা লেখাটিকে আপনি কীভাবে নেবেন। আবার মনে হচ্ছে, এই লেখাটিকে আপনি আবার পাবলিকলি এক্সপ্রেস করে দেবেন নাতো? সে ভয়ে মেসেঞ্জারে আমার একটা নিকনেমও সেট করে দিয়েছি। আমি ক্যাজুয়াল টাইপের কোনও মানুষ নই, খুব ফর্মালই বলা যায় আমাকে, আমার ২৩ বছরের জীবনে এই প্রথম কাউকে এমন জাজ করছি, এবং করে যাচ্ছি!

বাস চলছে, না? শীতে কাতর? গরম পোশাক সাথে নিয়েছেন তো? আজ দুপুরে খুব জানতে ইচ্ছে করছিল, এতো রাগ কেন আপনার? কিন্তু সে কৌতূহল অতি অল্পেই সংবরণ করে নিলাম! আপনার ‘হ্যালো খুলনা!’ পোস্টে গণহারে লাইক! আমি একটা কমেন্ট করেছি, ওটাতে একটু নজর দিয়েন, নাহলে কিছু একটা মিস করবেন। যাক্‌! গাড়িতে ঘুমানোর হ্যাবিট আছে? না থাকলে একটু ঝিমিয়ে নিন আর নিঝুম রাতের আকাশে আধখাওয়া আপালের মত চাঁদ আর হিমহিম আঁধারের রূপ উপভোগ করুন। একটা আকাশের একটাই চাঁদের নিচে মানুষ কখনও পাশাপাশি চাঁদের রূপ দেখে, আবার ভিন্ন জায়গায় থেকেও সেই একই চাঁদই দেখে। সারাদিনই তো অনেক ব্যস্ত থাকেন, ঘোরাঘুরি তো হয় না অতো, খুলনায় এসে চরকির মত ঘুরবেন, কেমন? তবে হ্যাঁ, সিজন চেঞ্জের সময় তো, একটু কেয়ারফুল থাকবেন। আমি একটু এক্সাইটেড! আচ্ছা, আপনি কি চশমা পরেন? মেধাবীরা তো ওটা পরেই। যারা পড়ে না, ওদের দেখলে কখনও মেধাবী-মেধাবী লাগে না। সাথে সানগ্লাস আছে না? ব্যাগ থেকে বের করে পরে নিন, চোখে ধুলো আর রাতের ছোটছোট পোকামাকড় ঢুকে যেতে পারে! আপনি যেখানেই থাকেন না কেন, একজোড়া চোখ আপনার প্রতীক্ষায় আছে, জেনে রাখুন! আপনার ওই চোখজোড়ায় কি একবারও আমি ধরা পড়বো না? আপনি আসছেন আর আমার ইজি লাইফের বিজি রুটিনের বারোটা বেজে গেছে অলরেডি! আপনি কি আমার খুদেবার্তা দেখেন? দেখে আপনার এক্সপ্রেশন কেমন হয়? আপনি কি এখন হাসছেন? আমাকে পাগল ভাবছেন? মনেমনে আমায় একেবারে যা-তা ভাবছেন? যা ইচ্ছে, ভাবেন! ভাবার উপর কারও কোনও হাত নেই!

পোস্ট দেখলাম! কী অনুভূতি! এই ঠাণ্ডায়ও! ঘুমাচ্ছেন? নাকি জেগে আছেন? আপনি এখনও খুলনা এসে না পৌঁছালেও খুলনা থেকে আপনার দূরত্ব ক্রমেই কমছে! কিছুক্ষণ পর কুমুদিনীপাড়া নেমে যদি দেখেন কোথাও একলাএকলা শালিক ঘুরছে, তবে বুঝে নেবেন, ওই শালিক বহুকাল ধরে কেবল একজনকে বরণ করতেই এমন ঠাণ্ডায়ও ঠায় দাঁড়িয়ে আছে! এক শালিক দেখে আবার মনখারাপ করে ফেলবেন না যেন! আর যদি একটাও শালিক না থাকে, তবে বুঝে নিতে হবে কোনও না কোনও সীমাবদ্ধতার কারণে সশরীরে আসতে না পারলেও সে ঠিকই ভার্চুয়ালি আপনার জন্য অভিবাদনপত্র পাঠিয়ে দিয়েছে! মিস্টার শাওঞ্জন! স্বাগতম! আপনার ভাষায় আপনাকে শাদা ভাল্লুক বলতে ইচ্ছে করে, ভয়ে কখনও বলা হয় না। তবে, একটা কথা কী, জানেন? নিজের প্রতি একটু রহম করুন! আপনি দিনেদিনে শাদা ভাল্লুক থেকে শাদা হাতিতে পরিণত হচ্ছেন তো!

আপনার ইলেকট্রনিক ডিভাইসগুলি যে হারিয়ে যায়নি, আর এক লাইনের স্ট্যাটাস দেয়ার মত এনার্জি যে এখনও অবশিষ্ট আছে আপনার শরীরে দিনের শেষে, এটা জেনে স্বস্তি পেলাম! দিনটা শুভ হয়েছে কি না, সেটা জিজ্ঞেস না-ই বা করলাম! বেশি দূরে ঘুরছেন না, এটা ভাল। টুকিটাকি এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন, সেটা আরও ভাল। সারদাপুর থেকে ব্যাক করে তো আরও ঘুরবেন আজ! রাতে কিন্তু একটা সাউন্ড স্লিপ দিয়েন! জানেন, আমি সকালে একটা শালিক আর একটা কাক দেখেছি। শালিক আর কাক মিলে যদি সেইরকম একটা ঝগড়া করে তো কেমন হবে? গাছের পাকাফল কাক খায়। কাকের একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, কোকিলের আইডেন্টিটির একজিস্টেন্স রাখে। যারা একটু বুদ্ধিমান, ওরা কাককে বোকা ভেবে ইগ্নোর করতেই পারে! গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র—যার জীবন, তার পছন্দ! নদীর নাম মধুমতী, কাককালো তার জল, কোনও ডুবুরী……..একটা ব্যাপারে দুশ্চিন্তা হচ্ছে—সেমিনারে মাইক্রোফোন ছাড়া আপনার ইউজুয়াল ভয়েসটা কি একবারও শুনতে পাব না?

আহা! কী লিখে ফেললাম! লজ্জালজ্জা লাগছে! উমমম্‌ আমি ৬০ ঘণ্টা কোন যে ঘোরের মধ্যে আছি, সেটা কেবল আমি জানি আর আমার ঈশ্বর জানেন। আপনার আমাদের ভার্সিটিতে আসার খবর জানার আগের সময়গুলো নানান কল্পকাহিনি শুনে আর ভেবে যা গেছে, তা ভেবে ৬০ ঘণ্টার সাথে আরও কিছু অ্যাড করলাম না। আপনার রিয়েল লাইফের ব্যস্ততা প্লাস ফেসবুকের নোটিফিকেশনের ভিড়ে আমার মেসেজগুলি আদৌ আপনার চোখে পড়ে কি না, সেটা নিয়েই আমার সংশয় ছিল। আর কিছু না হোক, আপনি যে আমার মেসেজগুলি পড়ছেন, এটা জানতে পেরেই আমি ঈশ্বরের কাছে কৃতজ্ঞ। যা-ই হোক, আপনি মনে হয়, আমার লেখা মনোযোগ দিয়ে পড়েন না। আর কাক-কোকিলের ব্যাপারটা দিয়ে আমি আসলে যা বোঝাতে চেয়েছি, তা আপনি বুঝেছেন কি না, আমি সন্দিহান। যা-ই হোক, এখন নিদ্রাদেবীর উপাসনা করেন। ভাল কথা, রবীন্দ্রনাথের শ্বশুরবাড়িতে গিয়েছিলেন? না গেলেও সমস্যা নেই। উনি নিজেও বোধহয় কখনও যাননি ওখানে। খুলনার মেয়েরা কিন্তু সুন্দরী হয়! রবীন্দ্রনাথের পরিবারের লোকজন তো এমনিএমনি এখানে কনে খুঁজতে আসেননি, তাই না? ব্যানারে আপনার নামের আগে জনাব লেখা আছে কেন? আপনার নামের আগে জনাব দেখে কেন জানি হাসি পাচ্ছিল!

অনেককিছু বলার ছিল। অনেক একতরফা বকবক করলাম। কাল আমার ১৮ বছরের ছাত্রজীবনের শেষ ক্লাস। ফাইনাল একজামের বাকি ১০ দিনও নাই। ক্লাসের সবাই যখন পড়াশোনায় ব্যস্ত, তখন আমি কী করছি, সে খবর কেবল আপনি কিছুটা জানেন। আমার শতকরা ৭০ ভাগ ভাবনাই আপনিকেন্দ্রিক। আমি যে কী করছি, তা আমি চিন্তাও করতে পারছি না! এই স্টেজে বড় কোনও ধাক্কা আসলে আমি সত্যিই সামলাতে পারব না। আপনি তো জানেনই, পড়ালেখা শেষ করার পরও আরও পড়াশোনা করতে হয়। আমি কালকের সেমিনারের টিকেট একজনকে দিয়ে দিলাম। আমার আবেগের সব কথা আপনাকে না বললেই ভাল ছিল! তাহলে তো কালকে যেতে পারতাম, আপনাকেও দেখা হত। আফসোস হচ্ছে এখন!

একটা ব্যাপার মাথায় রেখেই আমি আপনার সাথে যোগাযোগ করছি। তা হল, যোগাযোগ করলেই যে কোনও স্ট্রং কমিটমেন্ট হয়ে গেল, সেটা কোনওমতেই নয়। আপনি এখন আমাকে কী ভাবছেন? আমি পার্থিব দুনিয়ার প্যাঁচগোচ কম বুঝি এবং বুঝতে চাইও না। আপনি এতটুকু বিশ্বাস রাখতে পারেন যে আমি মিচকা কথা আর অতিরঞ্জিত কথা বলি না। আমি আপনাকে বিরক্ত করেছি নিজের স্বভাবের কারণে নয়, আপনার গুণের কারণেই। আমার দেয়া যন্ত্রণা ভুলে যাবেন, কেমন?

জগদ্বিখ্যাত ভাস্কর রামকিঙ্কর বেইজের একটা কথা আপনার সাথে শেয়ার করার লোভ সামলাতে পারছি না। তাঁর জীবনে অনেক মেয়ে এসেছে, চলেও গেছে। কেউকেউ থেকে গেছে বহুকাল। অনেকে তাঁর আর্টের মডেল হয়েছে। এ সম্পর্কে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি অকপট ভঙ্গিতে উত্তর করেছিলেন, “জীবনে অনেক মেয়ে এসেছে, এটা সত্যি। কেউ এসেছে দেহ নিয়ে, কেউ এসেছে মানসিক তীব্র আকর্ষণ নিয়ে। কিন্তু ছাড়িনি কাউকে। ধরেছি, আষ্টেপৃষ্ঠে ধরেছি। হজম করে ছিবড়ে করে ছেড়েছি। হজম করার মানে জানো? ও মন্ত্রটা আমার গুরুদেবের কাছে শেখা। তাঁর থেকে জন্ম নিয়েছে আমার অনেক ছবি, মূর্তি, অনেক কল্পনা, আর অনুভব।…আমার মডেলরা আমার বহু স্কেচে, ছবিতে, মূর্তিতে, বেঁচে আছে। মডেলরা তো এভাবেই বেঁচে থাকে।” এখানেই সাধারণত্ব ও অসাধারণত্বের মধ্যে তফাতটা। সাধারণদের জীবনেও তো কত মেয়ে আসে। এতে এ জগৎসংসারের কী প্রাপ্তিটা হয়, বলুন? আপনার লেখা কোনও এক গল্পের প্লট নাহয় আমার এ পাগলামি থেকে নিয়ে নিলেন! সেখানে আমার তো কিছু ভূমিকা আছে, তাই না? আপনার জীবনে থাকতে না-ই বা পারলাম, আপনার সৃষ্টির কিছুটা ভাগীদার হয়েই নাহয় বেঁচে থাকব। ভালই হবে। অন্যরা লেখে কল্পনা থেকে, আপনি লিখবেন বাস্তব থেকে। মার্কেজ তাঁর এক সাক্ষাৎকারে দাবি করেছিলেন যে উনার নিঃসঙ্গতার একশো বছর নাকি পুরোটাই বাস্তব ঘটনানির্ভর! ভাবা যায়! আপনি খুলনা আসছেন জেনে এতদিন ধরে যে অস্বস্তির মধ্যে দিন কাটিয়েছি, আজ তার কিছুটা হলেও দূর করে দিতে পেরেছি! সত্যি ভাল লাগছে!

একটা ব্যাপার খেয়াল করেছেন? আমি একাই গর্দভের মত একটা সফল আকাশকুসুম গল্প রচনা করে গেছি, আর আপনি (সম্ভবত) নীরবে তা পড়ে গেছেন। এর কারণ হচ্ছে, এ ইটপাথরের দুনিয়ায় আমাদের দুইজনের মনের মধ্যে একটু নরম স্থানের অস্তিত্ব আছে, তা নাহলে আমি এতো লেখার ধৈর্য রাখতে পারতাম না, আপনিও এতো পড়ার ধৈর্য রাখতে পারতেন না। কিন্তু ঘটনা হল, আমি খুবই বিব্রতবোধ করছি আপনাকে এতকিছু বলার কারণে। মিনিমাম র‍্যাশনাল জাজমেন্টটাও হারিয়ে আমি কেমন করে এ কাজটা করে ফেললাম, বুঝতে পারছি না। বিশ্বাস করুন, আমি ইন্টেনশনালি কিছুই করিনি। লাইফে এ প্রথম…….ছিঃ ছিঃ ছিঃ! মুহূর্তের উত্তেজনায় আপনার এবং আমার, দুইজনের উপরই কেমন একটা অত্যাচার হয়ে গেল! এটাকে লেখকের প্রতি পাঠকের অনুভূতি-বর্ণনা হিসেবে ধরবেন, কারণ এটাই সত্যি। আপনার ম্যাচুরিটি আর এক্সপেরিয়েন্স দিয়ে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে আমি অত্যন্ত লজ্জিত ও অনুতপ্ত। আমি সবকিছুর জন্যই দুঃখিত ও ক্ষমাপ্রার্থী। কারও সামনেই নাকাল হওয়ার মত মানসিক শক্তি আমার নেই। অপরাধবোধ কাজ করছে! কী যে পাগলামি করে ফেললাম! আপনিও তো কিছু বলছেন না! যে টেনশনে আমি আছি ঠিক এই মুহূর্তে, একদিন না একদিন আপনিও এমন টেনশনে থাকবেন, যেদিন আপনি কারও কাছ থেকে অন্তত একটা শব্দ হলেও প্রত্যাশা করবেন, কিন্তু ওপাশ থেকে কিছুই আসবে না…………

ভাবনা: তিনশো এক।

……………………………………..

আমি এমন একটা মেয়ে, যার সারাটা জীবন গেছে ভুল, ভুল আর ভুল সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে গিয়ে। আমি এসএসসি পরীক্ষা দিই ২০১১ সালে। পরীক্ষায় রেজাল্টও মোটামুটি ভালই করেছিলাম। মা-বাবা অনেকটা জোর করেই আমাকে বগুড়া শহরের একটা কলেজে ভর্তি করায়। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর মা-বাবা’কে ছেড়ে বগুড়া শহরে আমার আসা হয়েছিল। সেই থেকে আমার পড়ালেখার অবস্থা খুব খারাপের দিকে যাচ্ছিল। অবশ্য এটার জন্য দায়ী ছিলাম আমি নিজেই। কলেজের বান্ধবীদের পাল্লায় পড়ে আমি একটা একটা ছেলের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ি। তারপর থেকে আমার প্রতিদিন যেত সকালে কলেজে আর বিকেলে প্রাইভেটের নাম করে ওই ছেলেকে নিয়ে ঘুরতে বের হয়ে। রাতে বাসায় ফিরে খাওয়াদাওয়া, তারপর রাতে চারপাঁচ ঘণ্টা ফোনে কথাবলা। দেখতেদেখতেই ২ বছর কেটে গেল কখন টেরই পেলাম না আমি! তার মধ্যে ওই ছেলের সাথে আমার সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গেল। একাকীত্ব কাটাতে আবারও অন্য একটা ছেলের সাথে কথাবলা শুরু করে দিলাম। টেস্ট পরীক্ষায় তিন বিষয়ে ফেইল করলাম। টেস্ট পরীক্ষার পর ০২/০৩/২০১৫ তারিখ মা’কে ডাক্তার দেখানোর জন্য বগুড়ায় নিয়ে আসি। ডাক্তার পরীক্ষানিরীক্ষা করে বললেন মায়ের লিভারে সমস্যা। এক প্রকার জোর করেই মাকে হাসপাতালে ভর্তি করাই। আবারো পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু হল মায়ের। ১০/০৩/২০১৫ তারিখ ডাক্তার জানালেন, আমার মা খাদ্যনালীর ক্যান্সারে আক্রান্ত। বাবা মাকে বগুড়া থেকে ঢাকা নিয়ে গেল চিকিৎসা করানোর জন্য। এদিকে আমার এইচএসসি পরীক্ষার দিন এগিয়ে আসছে। ডাক্তার বললেন, “উনার চিকিৎসা করে কোনও লাভ নেই। পুরো শরীর ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে আছে। উনাকে বাড়ি নিয়ে যান আপনারা।”

এর মধ্যে আবার আমার পরীক্ষা শুরু হয়েছে। ডাক্তার হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দিয়ে দিয়েছেন মা’কে নিয়ে আসার জন্য। বাড়িতে আনার পর থেকে মায়ের পেটের মধ্যে পানি চলে আসে। আবারও শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। আমার তখনও সবেমাত্র পাঁচটা পরীক্ষা শেষ হয়েছে। মা’কে হাসপাতালে ভর্তি করানোর পর সারাদিন মায়ের কাছে থাকতে হত আমাকে। বাবা সরকারী চাকরি করার কারণে মায়ের পাশে তেমন একটা থাকতে পারতো না। মা বিছানা থেকেই উঠতে পারতো না তখন। ছোটবোন দুইজনও অনেক ছোট ছিল। ওষুধ খাওয়ানো, ওষুধ কিনে আনা, মা’কে পরিষ্কার করানো, এসব কিছুই করতে পারতো না ওরা। মা আমাকে ছাড়া কিছু বুঝতেই চাইতো না সেসময়। প্রতিটি পরীক্ষা আমাকে হাসপাতাল থেকে গিয়ে দিতে হয়েছে। ১৫/০৫/২০১৫ তারিখ আমার মা আমাকে ছেড়ে এ পৃথিবী থেকে বিদায় নিল। এর পরেরদিনও আমার কম্পিউটার বিজ্ঞান পরীক্ষা ছিল। কোনও রকমে পরীক্ষাগুলো শেষ করতে হয়েছে আমাকে। তারপর থেকে পরিবারের সকল দায়িত্ব এসে পড়েছে আমার উপর। যে আমি জীবনে কোনওদিন ডিমভাজি ছাড়া আর কিছু রান্না করিনি, সেই আমি পাঁচজন মানুষের রান্না করেছি। নানানানু, দাদাদাদু, মা ২ বছরের মধ্যে মারা যান। এদের মধ্যে সবার আগে মাকে হারিয়েছি। তারপর ১ বছর পড়ালেখা বন্ধ থাকল আমার। সেকেন্ড টাইমে সরকারি আজিজুল হক কলেজে ভর্তি হয়েছে ব্যবস্থাপনা বিভাগে।

বাবা আবার বিয়ে করেছে। বাবা যে দিন বিয়ে করেছে, তার পরদিন সকালে আমি বগুড়ায় চলে আসি। কিছুদিন পর ছোট দুইবোনকেও আমার কাছে নিয়ে আসি। বাবা নতুন মায়ের বুদ্ধিতে আমাকে বিয়ে দেয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল। কোনওভাবেই তাদের আমি থামাতে পারছিলাম না। সপ্তাহে একবার করে ছেলেপক্ষকে দেখাতে শুরু করেছিল। শেষ পর্যন্ত মাথার চুল ন্যাড়া করে বিয়ে আটকাতে পেরেছিলাম আমি। এর জন্য অনেক মারও খেতে হয়েছে আমাকে। শেষ পর্যন্ত ২৭/০৪/২০১৭ তারিখ আগে যে ছেলেটার সাথে আমার সম্পর্ক ছিল, তাকে বিয়ে করেছি পরিবারের সদস্যদের অভিমত না নিয়েই।

বিয়ের দুইদিন পর থেকেই ও আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করতে শুরু করল। ফোন দিলেই গালি দেয় আমাকে। বিয়ের পর দুইবার আমাদের দেখা হয়েছিল, তাও আমি বগুড়া থেকে ঢাকায় গিয়ে দেখা করেছি। দুইবারই সে আমার গায়ে হাত তুলেছে। ফোন দিলেই মরা মা আর বাবাকে নিয়ে গালি দেয়। আমার সেকেন্ড ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা চলছে এখন। পাঁচদিন হল, ও আমার সাথে কোনও কথাই বলে না। ওর একটাই কথা, “বিয়ে হয়েছে তো কী হয়েছে? আমার দুই বন্ধু ছাড়া তো আর কেউ এটা জানে না! অনার্সলাইফে এরকম কত বিয়ে হয়!” ও আমাকে বলে আমি যাতে আমার পরিবারের ইচ্ছায় অন্য কোথাও বিয়ে করে ফেলি। এ সময়ে আমার কী করা উচিত, আমি বুঝতে পারছি না। কারও সাথে এসব শেয়ার করতেও পারছি না। এমনিতে বাড়ি যাওয়া হয় না নতুন মায়ের অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচার জন্য। বাড়ি থেকে আমাকে কোনও টাকা দেওয়া হয় না। টিউশনি করে চলতে হচ্ছে। যদি এ রকম কিছু জানতে পারে তাহলে হয়তো বাসা থেকেও তাড়িয়ে দেবে। এ ব্যাপারে কেউ কোনও পরামর্শ দিয়েও সহযোগিতা করছে না। এ অবস্থায় আমি কী করতে পারি?

আমি আমার জীবনটাকে নষ্ট করে ফেলেছি। বারবার চেয়েছি নিজেকে শেষ করতে দিতে, ফাঁস খেয়ে মরতে গিয়ে ফিরে এসেছি ছোট দুইবোনের মুখের দিকে তাকিয়ে। আমি কিছু করে ফেললে নতুন মা ওদের উপর অত্যাচার করবে। এখন তো আমার জন্য পারে না। আমি এখন না পারছি নিজের কারণে বাঁচতে, না পারছি ওদের কারণে মরতে! এতটাই অসহায় হয়ে বেঁচে আছি!