ভাবনাদেয়ালের পলেস্তারা (৪৪শ অংশ)

ভাবনা: তিনশো দুই।

……………………………………..

আমি এইচএসসি পরীক্ষার্থী, আর্টস থেকে। ইদানিং বেশি মানসিক সমস্যায় ভুগছি। অনেক ছোটবেলা থেকে আমি পুলিশ অফিসার হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম। কখনও ভাল ছাত্র ছিলাম না, কোনওমতে টেনেটুনে পাস করতাম। ঢাকা ভার্সিটি নিয়ে প্রথম শুনতে পাই আমি যখন ক্লাস টেনে তখন, আমাকে এক ভাইয়া বাসায় এসে পড়াতেন, উনার কাছ থেকেই। সেই থেকেই স্বপ্ন দেখতাম ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ার। এসএসসি’তে এপ্লাস পাওয়ার জন্য পড়াশোনা করতে থাকলাম। আমার আশা, স্বপ্ন সবই ওলটপালট হয়ে যায়, যখন আমি এসএসসি’তে ৩.৯৪ পেলাম। চারপাশের পরিস্থিতি আমার প্রতিকূলে যেতে থাকে। চেনা আত্মীয়স্বজনের ব্যবহারও কেমন যেন পাল্টে যেতে থাকে। জীবনে দুই সময়ে প্রকৃত শুভাকাঙ্ক্ষী চেনা যায়: রেজাল্ট খারাপ করলে, অসুস্থ হলে। আমার নিকট আত্নীয়রা আমাকে অনেক কথা শোনাতে লাগল। আমি পড়াশোনা করিনি, ঘোরাঘুরি করেছি, আর্টসের স্টুডেন্টের এর চাইতে ভাল আর কী হবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। তার সাথে আমার বাবা-মা’র ব্যবহারেও অনেক পরিবর্তন দেখতে পাই। আমার বাবা-মা আমাকে খোঁচা দিয়ে কথা বলত, কখনও ভাতের খোঁটাও শুনতে হয়েছে। দুজনই বলত, পাশের বাসার অমুকের ছেলে, তমুকের মেয়ে এপ্লাস পেয়েছে, আর তুমি এটা কী করলে? রেজাল্ট খারাপ করলে বাবা-মা’ও অচেনা হয়ে যায়।

আমি এসএসসি দিই ঢাকা বোর্ড থেকে। পরীক্ষার পর বাবা বদলি হয়ে যায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। এসএসসি পরীক্ষা শেষ হওয়ার দুইদিন পরেই আমরাও ওখানে চলে যাই বাবার সাথে। কুমিল্লা বোর্ডের আন্ডারে এইচএসসি পড়া শুরু করি। আমি ছোটবেলা থেকেই ঢাকায় বড় হয়েছি, হঠাৎ করে বাবার ট্রান্সফার হওয়ার কারণে নতুন জায়গায় এসে ওখানকার কিছুই চিনতাম না। আমার এসএসসি’র রেজাল্ট নিয়ে আমাকে বিভিন্ন কথা শুনিয়ে কষ্টদেয়া আমার পরিবারের সদস্যদের নিত্যদিনের কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এমনিতেই রেজাল্টের পর আমি মানসিকভাবে একেবারেই ভেঙে পড়ি, তার উপর দুটো দয়াভরা কথা শোনার জন্যও কাউকে কখনও পাশে পেতাম না। পড়াশোনা করতে ইচ্ছে করত না। মনে হত, পড়াশোনা করেও বা কী হবে? দিনের শেষে তো গালাগালি শুনেই বিছানায় যেতে হবে। প্রতিদিন একই রুটিন—বকা খাও, আর কাঁদো………আমি যেমনই থাকি, এতে কারও কিছু এসে যায় না। আমি কষ্ট পাচ্ছি কি ভাল আছি, এটা নিয়ে কেউ কেয়ার করে না। জীবন আমার কাছে অনেক কঠিন মনে হত থাকল। একটা খারাপ রেজাল্ট জীবনকে বড্ড কঠিন করে দেয়। সারা রাতদিন নিজেনিজে কান্না করতাম।

বাবা-মা আমাকে বলেছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজে ভর্তি হতে। কিন্তু আমার ঢাকায় পড়ার ইচ্ছে ছিল। ঢাকা নটরডেম কলেজে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে চান্স পেলাম না। ফলে মানসিকভাবে আরও ভেঙে পড়ি। তখন বাবা-মা’কে বোঝালাম যে ঢাকায় ভাল একটা কলেজে ভর্তি করিয়ে দিলে আমি এইচএসসি’তে অনেক ভাল করতে পারব। কিন্তু বাবা সরাসরি জানিয়ে দিলেন যে উনি আমাকে ঢাকায় রেখে পড়াতে পারবেন না, আর সাথে এও বললেন আমি যেন ওদের কথামত ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজে ভর্তি হয়ে যাই। ওখানে ভর্তি না হলে নাকি বাবা আমার পড়াশোনার জন্য একটাকাও দেবেন না! আরও বললেন, এরকম গোঁয়ার্তুমি করলে আমি যেন বাসা থেকে বের হয়ে যাই। তখন আমিও রাগের মাথায় বাসা থেকে ৩ হাজার টাকা নিয়ে বের হয়ে যাই। তারপর অনেক কষ্ট করে বাবা আমাকে খুঁজে ৭ দিন পর বাসায় নিয়ে আসেন। বাসায় নিয়ে আসার পর বলেন, আমি যেন ঢাকায় না, কুমিল্লাতে ভর্তি হই। মনে চাপাকষ্ট নিয়ে অনলাইনে গিয়ে ইন্টারে ভর্তি হওয়ার জন্য কুমিল্লা বোর্ডের অধীনে ইস্পাহানী কলেজের ফরম ফিলআপ করি। রেজাল্ট একটু খারাপ হওয়া সত্ত্বেও বাবার আর্মি কোটা থাকার কারণে ফার্স্ট চয়েজে ইস্পাহানী পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ, কুমিল্লা’তে চান্স পেয়ে গেলাম।

ফার্স্ট ইয়ার থেকেই খুব সিরিয়াসলি পড়াশোনা শুরু করে দিই। ফার্স্ট ইয়ারে রেজাল্ট ভালই আসে। ফার্স্ট ইয়ারের ফাইনাল পরীক্ষায় আর্টস ডিপার্টমেন্টে ৯ম হই। আমি তখন মেসে থাকতাম। মেসের পরিবেশ আমার কাছে প্রথমপ্রথম ভাল লাগত না। আমি ছোটবেলা থেকেই ক্যান্টনমেন্টে মানুষ। মেসে গিয়ে এক রুমে ৩ জন থাকা, মেসের খাওয়াদাওয়া, পরিবেশ……কিছুই ভাল লাগত না। পরে অবশ্য সবকিছু ঠিক হয়ে গিয়েছিল। কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হয়ে ক্লাসের স্যারদের মুখে ঢাকা ভার্সিটি সম্পর্কে অনুপ্রেরণা পেয়ে দ্বিগুণ আগ্রহে পড়াশোনা শুরু করলাম। পড়াশোনার মধ্যেই খুব ভাল কাটল ফার্স্ট ইয়ারটা। এরপর যখন সেকেন্ড ইয়ারে উঠলাম, তখন কেন জানি আমার আর কুমিল্লা ভাল লাগত না। পড়াশোনায় চরমভাবে ভাটা পড়ল। প্রিটেস্টে ফেল করলাম। আগে যে মেসে থাকতাম, সে মেস পাল্টে অন্য মেসে চলে গেলাম। নতুন মেসে গিয়ে মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল। আগের মেসটা পাল্টানোর সময় বাসা থেকে অনেক বাধা দিয়েছিল, কিন্তু আমি শুনিনি। আমি নিজেই কোনওমতে বাসায় ম্যানেজ করে মেস পাল্টে ফেলেছি। তারপর নতুন মেসেও যখন আর মন টিকছিল না, বাসায় কোনও কিছু না জানিয়ে আরেকটা হোস্টেলে চলে গেলাম। যখন এ কথা বাসায় জানতে পারল, তখন আমাকে প্রচুর বকাঝকা করল। তারপর আমি আমার ভুল বুঝতে পেরে বাবা-মা’র কাছে মাফ চেয়ে নিই। টেস্ট পরীক্ষা দিলাম, রেজাল্ট এলো ৩.১৭। এরপর প্রচণ্ড অসুস্থতার কারণে বাসায় চলে আসলাম। ৪০ দিন কিছুই পড়তে পারিনি।

এখন আমার একটাই টেনশন—এইচএসসি’তে আদৌ পাস করতে পারব কি না! এর আগে আমি এইচএসসি’তে এপ্লাস পাওয়া নিয়ে টেনশন করতাম, আর এখন ভাবছি, পাস করতে পারব তো? ওদিকে বাবা বলেছেন, এইচএসসি’র পর আমাকে বাসা থেকে কোনও টাকা দেবেন না। আমাকে কোচিং করতেও দেবেন না অ্যাডমিশন টেস্টের জন্য। আমাকে পুলিশের কনস্টেবল পদে চাকরি নিয়ে দেবে। আমার সেই ছোটবেলা থেকে ঢাবি’তে পড়ার কত স্বপ্ন! আমার সেই স্বপ্ন কি এভাবে শেষ হয়ে যাবে? আমি চাই পুলিশ অফিসার হতে, আর আমার বাবা চায়, আমি যেন পুলিশের কনস্টেবল হই। আমার জীবন এমন কেন হয়ে যাচ্ছে? আমি তো এমন জীবন চাইনি! আমি তো চেয়েছিলাম ঢাবি’র ল’তে ভর্তি হয়ে ওখান থেকে পাস করে বিসিএস দিয়ে পুলিশের বড় অফিসার হতে!

আমার এইচএসসি পরীক্ষার আর কিছু দিন বাকি, কিন্তু আমি এক মিনিটও পড়াশোনা করি না। পড়াশোনা করতে মনও চায় না। আমি কী করব?

পুনশ্চ। সামনের ঝামেলা শেষ করতে হয় পরের ঝামেলা নিয়ে ভাববার আগেই! আগে তো বিয়ে করতে হবে, তার আগেই যদি টেনশন করা শুরু করে দিই আমার ছেলে আমার কথা শুনবে কি শুনবে না, তাহলে তো আর কিছু হল না! আগে এইচএসসি সামলাও, বাকিটা পরে দেখা যাবে!

আমার নিজের গল্পটা বলি। এইচএসসি পরীক্ষার সাড়ে তিনমাস আগে, মানে টেস্টের পর আমার সিভিয়ার লেভেলের টাইফয়েড হয়। সারতে প্রায় দুই-আড়াইমাস লেগে যায়। যা পড়েছিলাম, প্রায় সবকিছুই ভুলে যাই। স্টুডেন্ট হিসেবে ভালই ছিলাম। সবাই ভাবত, আমি হয়তো এইচএসি’তে বোর্ডস্ট্যান্ড করব। জানিয়ে রাখি, বোর্ডস্ট্যান্ড হল, প্রত্যেক শিক্ষাবোর্ডে সায়েন্স/ আর্টস/ কমার্স থেকে মোট প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে মেধাতালিকার প্রথম ২০টা স্থানকে বোর্ডস্ট্যান্ড করেছে হিসেবে ধরা হত। জিপিএ সিস্টেম চালু হওয়ার আগে এভাবেই চলত। আমাদের সময়ে কিন্তু কোনও বিষয়ে ৮০ পাওয়া আর ৯৯ পাওয়ার মধ্যে পার্থক্য ছিল। যা-ই হোক, আমি আগের পড়াগুলি এতটাই ভুলে যাই যে পরীক্ষা দিলে আমি আদৌ পাস করব কি না, এটা নিয়েই সন্দিহান ছিলাম। সবাই বলছিল, পরীক্ষা ড্রপ দিতে। কারণ আমি আগে যা পড়েছি, তার প্রায় কিছুই মনে ছিল না। আমারও একসময় মনে হল, আচ্ছা, এবার না দিয়ে পরেরবার পরীক্ষা দিই, যাতে রেজাল্ট ভাল করতে পারি। আবার ওদিকে আমরা যে বার পরীক্ষা দিই, তার পরের বার থেকে জিপিএ সিস্টেম চালু হবে, এটাও আমাকে কনফিউজড করে দিচ্ছিল এ ভেবে যে আমি তাহলে কোন পদ্ধতিতে পরীক্ষা দেবো! অবশেষে আমার মা-বাবা বলল, আমি যেন পরীক্ষা দিয়ে দিই। ভাগ্যে যা আছে, তা-ই হবে। আমাদের সময় কেউ টোটাল অন্তত ৭৫০ মার্কস পেলে সে স্টার মার্কস পেয়েছে, এমন ধরা হত। অন্তত ৬০০ পেলে ফার্স্ট ডিভিশন, তারও নিচে সেকেন্ড আর থার্ড ডিভিশন। মা-বাবা বলল, আমি ফার্স্ট ডিভিশন পেলেও কোনও সমস্যা নেই, তাও যেন ইয়ারড্রপ না দিই। পরীক্ষা দিলাম, স্টার মার্কস পেলাম। আমাদের সময়ে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে স্টার মার্কস পেয়েছিলাম খুব সম্ভবত আমরা ৭৪ জন।

আসলে জীবন কীভাবে যেন প্রাপ্যটা দিয়েই দেয়! আসলে সবকিছু ঈশ্বরের খাতায় লেখা হয়ে যায় তো! সে সময় নাহয় পড়াশোনা করতে পারিনি অসুস্থতার কারণে, কিন্তু আগে তো আর ফাঁকি দিইনি! ইন্টারের সময়ে অমানুষিক খেটে পড়াশোনা করেছি। পরীক্ষা না দেয়ার বুদ্ধিটা খুব একটা ভাল বুদ্ধি নয়। ভাল প্রস্তুতি নিলেই যেমনি পরীক্ষা ভাল হয়ে যায় না, তেমনি খারাপ প্রস্তুতি নিলেই পরীক্ষা খারাপ হয়ে যায় না। তবে একটা ব্যাপার বলতে খুব ইচ্ছে করছে। আমাদের সময়ে আমরা যতটা বুক-স্মার্ট ছিলাম, এ সময়ের স্টুডেন্টরা ততটাই টেক-স্মার্ট। আমাদের কাছে বই যত বড় সম্পদ ছিল, এ জেনারেশনের ছেলেমেয়েদের কাছে স্মার্টফোন তার চাইতেও অনেক বড় সম্পদ। এ বয়সের একটা স্টুডেন্টকে স্মার্টফোন পুরোপুরিই ধ্বংস করে দিতে পারে! বর্তমান সময়ের ছেলেমেয়েরা ভার্চুয়াল জগতে যতটা হিরো, অ্যাকাডেমিক জগতে তার চাইতেও অনেক বড় জিরো! তাই পরীক্ষা দিলেই ভাল রেজাল্ট করে ফেলার মত রসদ কতটা তাদের মাথায় আছে, সে বিষয়ে আমি সন্দিহান।

আমার লাইফের আরেকটা মহাট্র্যাজেডির গল্প বলি। আমি যেহেতু সায়ন্সে পড়েছি, সেহেতু আমার দায়িত্ব ছিল ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হওয়া। অন্তত আমার বাবা-মা এটাই বিশ্বাস করত। বায়োলজি ভয় পেতাম আর ডাক্তারি পড়ার কোনও ইচ্ছে ছিল না বলে ইন্টারে ইচ্ছে করেই বায়োলজি না নিয়ে পরিসংখ্যান নিই। পরবর্তীতে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়ার নেশা চাপে। খুব খুব খুব বেশি ইচ্ছে ছিল ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়ার। সে সময়ে তন্নিষ্ঠ চিত্তে ইংরেজি ভাষা আর সাহিত্য পড়াটা আমার কাছে মহত্তম প্রার্থনার মতন ছিল। এইচএসসি’তে চট্টগ্রাম বোর্ডে ইংরেজিতে হাইয়েস্ট মার্কসটা আমার ছিল। চট্টগ্রাম কলেজে পড়ার সময় আমার চাইতে বেশি ইংরেজি শব্দ জানত, আমাদের ব্যাচের এমন কাউকে আমি চিনতাম না। ভাষা নিয়ে খেলতে আমি ভীষণ পছন্দ করতাম। দুর্বোধ্য শব্দ আর অচেনা ব্যাকরণ দিয়ে খাতায় ভাষার হোলি খেলতে ভালোবাসতাম। ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে যারা অনার্স পড়েন, তাদের সিলেবাসে যে বইগুলি আছে, সেগুলির বেশ কয়েকটি আমি পড়ে ফেলেছিলাম রামজি লাল আর ডক্টর এস সেন-এর গাইডবই থেকে। দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে পড়ার স্বপ্ন দেখতাম। আমাকে যাতে সাহিত্য নিয়ে পড়ার সুযোগ দেয়, এজন্য বাসায় অনেক কান্নাকাটিও করলাম। হাঙ্গার স্ট্রাইক করা থেকে শুরু করে অনেক চেষ্টাই করেছিলাম। তবুও বাসায় আমার কোনও কথাই শুনল না। বাসা থেকে যে রাগ করে বের হয়ে যাওয়া যায়, সে বুদ্ধিটাই মাথায় কখনও আসেনি। খুবই বোকা আর ভীতু টাইপের একটা ছেলে ছিলাম সে সময়। মনেমনে অনেক রাগ করতাম, ভীষণ অভিমান হত, কান্না গিলে মনের মধ্যে ফোঁপাতাম, কিন্তু মা-বাবা, শিক্ষক কিংবা কোনও গুরুজনের মুখের উপর কখনও একটা শব্দও উচ্চারণ করেছি বলে মনে পড়ে না। ইন্টার-লাইফে বাসায় নিজের পছন্দ কিংবা অপছন্দ নিয়ে বড়জোর ক্ষীণস্বরে বলা যায়, কিন্তু তা ততটা প্রতিষ্ঠা করা যায় না। আর্থিক স্বাধীনতা না থাকলে তো মতামতের স্বাধীনতা থাকে না, তাই ওরকম হওয়াটাই স্বাভাবিক।

যা-ই হোক, ফিজিক্স-কেমিস্ট্রি-ম্যাথস্‌-এ গড়ে ০.০৬ নম্বর কম থাকার কারণে বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ পেলাম না। (দরকার ছিল গড়ে ৭২.৬৬, আমার ছিল গড়ে ৭২.৬০। ০.০৬ নম্বর কম পাওয়ার কষ্ট যে কী, তা আমি জীবন থেকে উপলব্ধি করেছি।) বুয়েট ছাড়াও বিআইটি, ঢাবি এবং ইন্সটিটিউট অব লেদার টেকনোলোজি থেকে ভর্তি পরীক্ষার ফরম কিনেছিলাম। আমি কোচিং করেছিলাম ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাডমিশন টেস্টের জন্য। আমাদের সময়ে তখনও চুয়েট, কুয়েট, রুয়েট বিশ্ববিদ্যালয় হয়নি, তিনটিকেই একসাথে বিআইটি (বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব টেকনোলোজি) বলা হত। বিআইটি আর বুয়েট বাদে অন্যান্য পাবলিক ভার্সিটির ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নের প্যাটার্ন ছিল মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার মত। আমার সে প্যাটার্ন সম্পর্কে কোনও ধারণাই ছিল না। আমি বরাবরই একমুখী টাইপের মানুষ। যা আমার দরকার নেই, কিংবা যা আমার ভাল লাগে না, তা নিয়ে আমি কখনওই মাথা ঘামাই না। ফলে আমি এক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাডমিশন টেস্ট বাদে আর কোনও কিছু নিয়েই কখনও ভাবিনি। এখনও মনে আছে, সেসময় বাবার ইচ্ছেই ছিল না আমাকে ঢাকায় পরীক্ষা দিতে নিয়ে যাওয়ার। বাবা বলতো, তুই বুয়েটে পরীক্ষা দিতে পারিসনি তো কী হয়েছে? দেখিস, তুই চুয়েটে চার ডিপার্টমেন্টের কোনও না কোনওটাতে টিকে যাবিই! (বাবার এই আশীর্বাদ সত্য হয়েছিল।) তবু অনেকটা জোর করেই বাবার সাথে ঢাকায় গিয়েছিলাম ভার্সিটিতে পরীক্ষা দিতে। শুনেছিলাম, ঢাকা ভার্সিটি অনেক বড়! তাই ওটা দেখারও একটা শখ ছিল। (এর আগে আমি ঢাকায় গিয়েছিলাম মাত্র দুইবার।) যাওয়ার আগের দিন আমার এক বন্ধুর কাছ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার একটা গাইডবই ঘণ্টা খানেকের জন্য ধার করে এনে প্রশ্নের ধরন সম্পর্কে জেনে নিই। ন্যূনতম প্রস্তুতি ছাড়াই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় ক-ইউনিটে পরীক্ষা দিই ও ১২০তম হই। আমার ফার্স্ট চয়েজ কম্পিউটার সায়েন্স ছিল, ওটাই ছিল আমাদের সময়ে যেকোনো ভার্সিটির সবচাইতে কাঙ্ক্ষিত সাবজেক্ট। আমি সিএসই’তে চান্স পাইনি, যারা মেরিটলিস্টে প্রথম দিকে ছিল, ওরা সিএসই নিয়ে ফেলেছিল, আমি আমার সেকেন্ড চয়েজ অ্যাপ্লাইড ফিজিক্সে চান্স পেয়েছিলাম। ওদিকে লেদারে কোনও প্রস্তুতি ছাড়া ষষ্ঠ হয়েছিলাম। চুয়েটে মেধাতালিকায় ২য় হলাম এবং বাসার ইচ্ছেয় ওখানেই সিএসই’তে ভর্তি হই।

ভর্তি হওয়ার পর থেকে শুরু করে শেষ অবধি সাহিত্যে পড়তে না পারার বেদনায় কেটে গেল পুরো অনার্স লাইফটা। আমার বন্ধুদের মধ্যে যারা ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়ত, ওদেরকে দেখলে খুব ঈর্ষা হত, মনের গভীরে এক ধরনের কান্না কাজ করত। ইংরেজি-জ্ঞানের দিক থেকে ওরা কেউই আমার ধারেকাছেও ছিল না, কিন্তু হায়, ওরা ইংরেজিতে পড়তে পারল আর আমি পারলাম না! এখনও আফসোস হয়, আহা, ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে একবার হলেও পড়তে পারতাম! ইংরেজিতে পড়তে পারলে জীবনটা কতই না সুন্দর হত! কিছুই পারলাম না এ জীবনে!

আহা জীবন! কী চাইলাম আর কী পেলাম!

ভাবনা: তিনশো তিন।

……………………………………..

আমি ঠিক কোনও সমস্যায় নেই, কিন্তু আবার অনেক বড় একটা সমস্যায় আছি। যেহেতু আমার ব্যাপারটা কেউ জানে না, সেহেতু কারও সাথে আলাপ করেও কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না। আসলে পরিচিত কারও সাথে দেখা করা যায়, আলাপও করা যায়, কিন্তু উনাকে অনেক কথাই বলা যায় না, সে উনি যতই পরিচিত হন না কেন! অথচ একজন অপরিচিত মানুষকে সবকিছুই বলা যায়, তার কাছ থেকে পরামর্শ চাওয়া যায়।

আমার একজনের সাথে সম্পর্ক আছে। আজ সম্পর্কের ২২৬ দিন হল। আমাদের সম্পর্কের সবচাইতে বড় বাধা হল, আমি হিন্দু আর ও মুসলিম। প্রথমপ্রথম এ নিয়ে আমাদের মধ্যে অনেক কথা হত। আমরা ভাবতাম, এ সম্পর্কের তো কোনও সুন্দর পরিণতি নেই, তাই ব্রেকাপ করে ফেলাই ভাল। কিন্তু প্রতিবারই দেখা যেত, যত যা-ই কথা হোক না কেন, প্রতিবারই আমরা নিজেদেরকেই নানান আশ্বাসে ভুলিয়ে রাখতাম। আমি কাঁদতে থাকতাম আর বলতাম, এখন যেমন চলছে, তেমন চলুক, পরে সব ঠিক হয়ে যাবে। আজও এমন করেই চলছে।

আমাদের ব্যাপারটা নিয়ে ওর মা আগে থেকে কিছুটা সন্দেহ করতেন। চার-পাঁচ দিন আগে ওর মা ওকে সরাসরিই জিজ্ঞেস করে ফেললেন আমাদের মধ্যে কিছু আছে কি না? ও ভয় পেয়ে মাকে জানিয়েছে যে আমাদের মধ্যে এখন আর কিছু নেই। আমরা কেবলই ফ্রেন্ড। এরপর থেকে সে ক্রমাগত চাপ দিচ্ছে ব্রেকাপ করে ফেলার জন্য। আমরা দুইদিন আগে দেখা করি। দেখা হওয়ার পর অনেক কান্নাকাটি করি আমি। ওকে বোঝাই যে আমরা তো দুইজনই জানি যে অনেক প্রবলেম হবে, কিন্তু কিছু সময় যাক, সব ঠিক হয়ে যাবে। এভাবে অনেকক্ষণ বোঝানোর পর ও বলে, আচ্ছা, ঠিক আছে, সম্পর্ক চলুক। দেখি, কী হয়! সেদিন রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে ও আমার কাঁধে হাত রেখে বলে, যা-ই হোক, একটা রিস্ক নিলাম। ঘটনা হল, ও যে আমার কাঁধে হাত রেখেছে, এটা ওর কাকা এক দোকান থেকে দেখে ফেলেছেন। কাকা আবার সেটা ওর বাবা-মা’কে গিয়ে বলে দিয়েছেন। ওর মা আমার ছবি কাকাকে দেখিয়ে নিশ্চিত হয়ে নিয়েছেন যে আমিই সেই মেয়ে, যাকে কাকা দেখেছেন।

এরপর থেকে আবারও ‘ব্রেকাপ, ব্রেকাপ’ ঘ্যানরঘ্যান শুরু হয়ে গেছে। আমি ওকে বললাম, আমি তোমার জন্য সবকিছুই ছেড়ে দিতে রাজি আছি, তবু আমাকে ছেড়ে যেয়ো না। প্রয়োজনে আমি ধর্মান্তরিত হতেও রাজি, শুধু তুমি আমার পাশে থাকো। কিন্তু ও বলে, আমার পরিবারের অমতে আমাকে এমন করে বাসায় নিয়ে বিয়ে দিতে ওর পরিবার কখনওই রাজি হবে না। আমি তখন ওকে আবারও বলি, আমরা একটু তাড়াহুড়ো করে ফেলছি না? আমরা আরও সময় নিই। দেখবে, সব ঠিক হয়ে যাবে। তখন ও বলল, আমাদের এ সম্পর্কের তো কোনও ভবিষ্যৎ নেই, এর পেছনে বৃথাই সময় নষ্ট করে কী লাভ হবে? তাই এখনই ব্রেকাপ হয়ে যাওয়া ভাল। পরের কষ্টের চাইতে আগের কষ্টই বেটার। পরে তো এটাই করতে হবে আমাদের! তখন তুমি আরও বেশি কষ্ট পাবে! ইত্যাদি, ইত্যাদি! আর এখন ও নিজেনিজে সবাইকে বলে বেড়াচ্ছে যে আমাদের নাকি ব্রেকাপ হয়ে গেছে, আমাদের মধ্যে নাকি আর কোনও সম্পর্ক নেই। অথচ, আমি তো এই ব্রেকাপ এখনও মেনে নিইনি। তাহলে ব্রেকাপ হল কীকরে?

ওকে ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ। আমার কাছে পুরো পৃথিবী একদিকে, আর ও অন্যদিকে। ও আমার হয়ে গেলে আমি যেকোনো কিছু করতে প্রস্তুত আছি। সে-ই আমার সব! ওকে ছেড়ে আমি কখনওই বেঁচে থাকতে পারব না। কী করব, কিছুই বুঝতে পারছি না। ওকেও কোনোভাবেই বোঝাতে পারছি না। ও আমার ফোনও ঠিকমতো ধরে না এখন। আমি বুঝতে পারছি না কী করলে ও ঠিক হয়ে যাবে। ও তো এমন নয়, তবে কেন ও এমন করছে? আমি তো আমার দিক থেকে সব রকমের চেষ্টা করছি। ও কেন একটুও চেষ্টা করছে না? ও একটা ছেলে হয়েও ওর পরিবারকে এতটা ভয় করছে কেন? আমি তো ওর জন্য আমার পরিবার, সমাজ, দেশ সবই ছাড়তে রাজি। তবে ও কেন রাজি নয়?

আর সহ্য করতে না পেরে আমার দাদাকে অনেক ভয়েভয়ে এ ব্যাপারটা বলেছি। দাদার সাথে আমার সম্পর্কটা খুব সহজ, একেবারে বন্ধুর মত। কিন্তু দাদাও আমার পক্ষে কোনও কথা বলছে না। আমাদের এ সম্পর্ক নাকি ভেঙে যাবেই যাবে! মাঝখান থেকে ওর এবং আমার, দুইজনেরই ক্যারিয়ার নষ্ট হয়ে যাবে। কিছু সময় বাজে কাজে খরচ হবে, আর এর সাথে কষ্ট বাড়বে। বাস্তব জগতে এক্ষেত্রে আবেগের দাম খুব সামান্যই। এ ধরনের সম্পর্ক নাকি খুব কালেভদ্রে টিকে, তাও টিকে, যদি দুইজনই সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে মরিয়া হয়ে ওঠে, তবেই।

আমি ওকে আত্মহত্যা করার হুমকিও দিয়ে দেখেছি, ওতেও কোনও কাজ হয়নি। আমি শুধু ভাবি, ওকে ছেড়ে বেঁচে থেকে কী লাভ? আবার ভাবি, আমি যদি মরেও যাই, তাও তো ওর তাতে কিছু এসে যাবে না। তাহলে আমার মরেই বা কী লাভ? ভুল মানুষের প্রেমে পড়ে পুরো জীবনটাই একটা ভুল জীবন হয়ে গেল!

ভাবনা: তিনশো চার।

……………………………………..

আপনার ‘চিতায় বসবাস’ পড়ে চোখের জলে ভাসছি। কিছুতেই সামলাতে পারছি না নিজেকে। কেন, জানেন? এ গল্প শতকরা ৯৯ ভাগই আমার নিজের জীবনের গল্প। আমিও মেয়েটার মতই, একদিন সুদিন আসবে, সে আশায় দিন গুনছি আর নিজেকে ক্রমাগত ধ্বংস করে দিচ্ছি। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে মেনে নিতে।

আপনার অনুপ্রেরণামূলক লেখাগুলি পড়ি আর মনে হতে থাকে, অমৃতসুধা কি এর চেয়েও অমৃত হয়? বড় ভাল লাগে লেখাগুলি পড়লে! নিজের জীবনটাকে গুছিয়ে নেয়ার প্রেরণা পাই, বাঁচার শক্তি পাই। আপনার লেখাগুলি পড়ি আর মনে হতে থাকে, এ জীবনে অমর হওয়ার চাইতে বেঁচে থাকাটা অনেক বেশি জরুরি। কিছু লোক অমর হওয়ার সাধনায় রত, আর আমাদের মত ভাগ্যবিড়ম্বিত মানুষের তো বেঁচে থাকতেই বড় কষ্ট হয়! জীবনে বাঁচতে হলে অনুপ্রেরণার চাইতে মনোবল বেশি দরকার। বাঁচা, কাজ করা, ভাবা এগুলি সবই অভ্যাসের ব্যাপার, এখানে অনুপ্রেরণার ভূমিকা খুব সামান্যই। হেসেখেলে বাঁচতে প্রাচুর্য লাগে না, একটা শীতল ছায়াবীথিতল লাগে।

আপনার কাছে একটা বিনীত অনুরোধ আছে। আপনি প্লিজ সেইসব মেয়েদের নিয়ে একটা লেখা লিখুন, যারা খাটো, শ্যামবর্ণ, কালো, অসুন্দর বলে প্রতিনিয়ত চোখের জলে ভাসছে। তাদের যোগ্যতা, গুণ সবকিছুই গায়ের কালোরঙে ঢাকা পড়ে যায়। প্রায় সব পুরুষই অবচেতন মনে হলেও চায়, তার বউ সুন্দরী হোক। এই সমাজের মানুষ সুন্দর মানে কিন্তু লম্বা আর ফর্সাই বোঝে। সুন্দরের আসল সংজ্ঞা তো এটা নয়! তবু সমাজ এমনটাই ভাবে। অনেক শিক্ষিত বড় সার্টিফিকেটওয়ালা মানুষও সুন্দর বলতে ফর্সা চামড়াকেই বোঝে। মেধা আর মননের সৌন্দর্যের দিকে খেয়াল খুব মানুষেরই আছে। মনের সৌন্দর্যকে যে জাতি যত বেশি দাম দেয়, সে জাতি তত বেশি উন্নত। তবে এসব বলেই বা কী হবে? আমাদের শিক্ষার হার বেড়ে যাবে, আমাদের অর্থবিত্তও হয়তো একসময় অনেক হবে, তবু এমন মানসিকতা কখনওই বদলাবে না।

হ্যাঁ, এ সমাজেও বিভিন্ন কারণে তথাকথিত অসুন্দরকে হয়তো কেউকেউ বিয়ে করে। অর্থ, সম্পত্তি, প্রতিষ্ঠা এসব কারণে এমন হতে দেখা যায়। কথা হচ্ছে, বিয়ে করে তো করে, কিন্তু ওই মেয়েটাকে নানান খোঁটা শুনতে-শুনতেই বাকিটা জীবন পার করতে দিতে হয়। মেয়েরাও তো দেখি মেয়েদের শত্রু! নিজের ছেলে কিংবা ভাইকে বিয়ে করাতে গেলে আবার সমাজ-সংজ্ঞায়িত সুন্দরীই খোঁজে! অনেক সুধীজন বলেন, পাত্তা না দিলেই তো হয়! কিন্তু কী করা যাবে! সমাজ আর পরিবারের কারণে বিয়ে তো করতেই হয়! আর বিয়ে করতে গেলে ওই সমস্যার মুখোমুখি হতেই হয়! বিয়ের আগে অনেকের মনমানসিকতাও তো বোঝা যায় না। একটা পরিবারে দুই বোনের একজন ফর্সা আর আরেকজন কালো হলে তো আর কথাই নেই। প্রতিটি ক্ষণেই তাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে তার গায়ের রঙটা দেখিয়ে দেবে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, এমনকি কোনও-কোনও ক্ষেত্রে মা-বাবাও! আপনিই বলুন, কী করবে এইসব মেয়েরা। হয়তো বলবেন, প্রতিষ্ঠিত হয়ে দেখিয়ে দেবে! হোক না! তাতে কী! সে-ই তো একই কথা, বাসা থেকে তো বিয়ে দিয়ে দেবেই! তখন তো আরও ঝামেলা! ধনী কিংবা প্রভাবশালী ব্যক্তির মেয়ে হলে কোনও সমস্যা নেই। আর সুন্দরী হলে তো সাতখুন মাফ!

এ তো গেল সমাজের চিত্র। এবার নিজের কথা বলি। আমি খাটো, শ্যামলা এসব নিয়ে কখনো মাথাব্যথা ছিল না। আমার পরিবারও এসব নিয়ে আমাকে কখনো ছোট করেনি। তাই জগতের এই নিষ্ঠুরতা আগে ওভাবে করে আমায় স্পর্শ করেনি। আমিই বরং অন্যদের বোঝাতাম যে ভালমানুষ হও, যোগ্য হও, গায়ের রঙে কী এসে যায়? যদি তুমি বিদ্যা ও মননে বড় হয়ে উঠতে পারো, তবে কেউ আর তোমায় ছোট করবে না। কিন্তু আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত হল আমার নিজের জীবন দ্বারাই। আমাকে একজন দেখেশুনেই পছন্দ করে। অথচ কয়েক মাস যেতে না যেতেই বিভিন্ন কথায়, আকারেইঙ্গিতে তার মানসিকতার পরিচয় দিয়ে দিচ্ছে। এই ড্রেসটা, ওই জুতাটা লম্বা মেয়েদের জন্য, এরকম আরও অনেক কথা। অথচ প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে, আমার চেয়ে খাটো মেয়েরা ওইসব দিব্যি পরছে! আমাকে কথা শোনানোর জন্যই ওইসব বলা, আর কিছু নয়। আমার গুণ, যোগ্যতা, ভাল মানসিকতা, আন্তরিকতা, ভালোবাসা, স্বার্থহীনতা সবকিছুই হার মেনে যায় আমার উচ্চতার কাছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ও আমায় ছেড়েও যেতে চায় না। আমিও পারি না ওকে ছেড়ে থাকতে। বিভিন্ন কারণে আজ অভিমানে সাময়িকভাবে দূরে সরে আছি। কিন্তু আবার ভাবি, ও যা করছে, অন্য ছেলেও তো তা-ই করবে। ও যেমন করে ভাবে, অন্য কেউও তো তেমন করেই ভাববে। এ যে পুরুষসমাজের সর্বজনীন মানসিকতা! আমি তো আমার চোখের সামনেই এমন হতে দেখেছি! সবারই একই কাহিনি!

জানি, এই সমাজটা কখনও বদলাবে না। তবু আপনি কিছু লিখুন। কারণ আমার বিশ্বাস, যারা আপনার একনিষ্ঠ পাঠক এবং আপনাকে পছন্দ করে, তারা কিছুটা হলেও নিজেদের মানসিকতা বদলাবে। আশেপাশে যারা আছে, তাদের মধ্যে কপটতা এতো বেশি যে ওদের কোন কথাটা নেবো, আর কোন কথাটা নেবো না, সেটাই বুঝতে পারি না। কখনও-কখনও এ পৃথিবীর উপর আমার ঘেন্না ধরে যায়। আপনাকে দেখে কিছুটা আশা জাগে মনে। আপনার লেখা পড়ে প্রতিদিনের যন্ত্রণা কাটিয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখি। আমার জীবনে সত্যিকারের অনুপ্রেরণা পাই তিনজন ব্যক্তির কাছ থেকে—আমার আব্বু, আমার আম্মু, আর আপনি। তাই, অপেক্ষায় নয়, প্রতীক্ষায় থাকলাম আপনার লেখার জন্য।

আঁধার রাতের জোনাকির আলোর মত আলো ছড়িয়ে বাঁচুন, এই শুভ কামনা রইল।

ওঃ আর একটা ব্যাপার বলতে ভুলে গেছি। উচ্চশিক্ষিত হয়েও অনেক ছেলেই কম বয়সী মেয়ে বিয়ে করতে চায়! আমাদের ভার্সিটির একজন শিক্ষক পিএইচডি করছেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। যথেষ্ট শিক্ষিত ও মার্জিত। উনি বিয়ে করছেন ৩৭ বছর বয়সে, তখন উনার স্ত্রীর বয়স ১৬, মাত্র এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। ভাবি ছিলেন দেখতে খুবই সুন্দরী এবং গ্রামের সাধারণ পরিবারের মেয়ে। স্যারের সাথে ভাবির আন্ডারস্ট্যান্ডিংটা হচ্ছে কীভাবে, আমি বুঝতে পারছি না। অনেক চিন্তা করেও আমি স্যারের এমন কাজ করার কোনও অর্থ খুঁজে বের করতে পারিনি। আমার প্রশ্ন হল, এমন করে সবাই যদি ‘কচি মেয়ে’ বিয়ে করতে চায়, তবে যেসব মেয়ে উচ্চশিক্ষিত হচ্ছে, তারা কী করবে? প্রতিটি ক্ষণেই কী কী যে কথা শুনতে হয় তাদের! শিক্ষিত মানুষের অভাব নেই। কিন্তু সুশিক্ষিত মানুষের বড় অভাব! ভাল কথা, সেই স্যার কিন্তু বেশ নারীবাদী মানুষ! ফেসবুকে, বিভিন্ন সভায় নারীবাদের তুফান তুলে দেন! কিন্তু নিজের স্ত্রীকে এসএসসি’র পর আর পড়াশোনা করাননি। উনি মুখে যা বলেন, তা নিজেই মানেন না। বাহ্যিকভাবে উনি যা দেখান, উনার ভেতরটা তেমন না। উনি যা লেখেন, তা বিশ্বাস করেন না। বেশিরভাগ নারীবাদীর মতই উনার চরিত্র—কপট। তবে হ্যাঁ, উনি খুব ভাল পড়ান, খুব ভাল লেখেন, খুব ভাল কথা বলেন। এমন মানুষের অতটা বৈপরীত্য ভাল লাগে না।

ভাবনা: তিনশো পাঁচ।

……………………………………..

এক।

২০১১ সাল থেকে একটা মেয়েকে ভালোবাসি। ২০১৩’তে মেয়েটার বিয়ে হয়। বিয়ের দুইমাস পর তার সংসারটা ভেঙে যায়। আমাকে ওর জীবনে ফিরে আসতে বলে। বলে, আমি বুঝতে পারিনি, আমাকে ক্ষমা কর। আমি তেমন কিছু না বলে ওকে মেনে নিলাম। শুধু এটুকু বললাম যে, সামনে আর কখনও এমন ভুল কোরো না।

২০১৪-এর ডিসেম্বরে মেয়েটা অন্য একটা ছেলের প্রেমে পড়ে। জানুয়ারিতে ওরা কাজি অফিসে গিয়ে বিয়ে করে, এবং এর পাঁচ সপ্তাহ পর ছেলেটা ওকে ছেড়ে চলে যায়। মেয়েটা আবারও আমাকে সরি বলে। আমিও সব রাগ-অভিমান ভুলে ওকে গ্রহণ করে নিই। তারপর কিছুদিন সব ঠিকঠাক চলল। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরের ১০ তারিখ মেয়েটার বাসা থেকেই ওকে বিয়ে দিয়ে দেয়। সে বিয়ে ১৪ দিন স্থায়ী হয়। সে হাজব্যান্ড ওকে ডিভোর্স দিয়ে দিলে মেয়েটা আবার বাপের বাড়িতে ফিরে আসে। ওর বাসায় আমার কথা আগে থেকেই কিছুটা জানত। বাসার সবার ধারণা হল, আমাকে ভালোবাসে বলেই মেয়েটার এই বিয়েটা টিকল না। আমার সাথে মেয়েটাকে মিশতে ওরা নিষেধ করে দিল।

তখন ও আমাকে বলে যে, ওকে আমি বিয়ে না ও আত্মহত্যা করবে। আমি তখন অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে। ও আমাকে অনেকটা জোর করেই ওকে বিয়ে করতে বাধ্য করল। এরপর আমি ওকে আমার মেসে নিয়ে আসি। আমি টিউশনি আরও একটা বাড়ালাম, সাথে একটা ছোটখাটো পার্টটাইম জবেও জয়েন করলাম। ওর সকল খরচ চালাতে গিয়ে আমি রাতদিন পরিশ্রম করা শুরু করে দিলাম। আমার পড়াশোনা শিকেয় উঠল। অনার্সে এক বছর ড্রপ দিলাম। তারপর মেয়েটা আমাকে বলল, তোমার বয়স কম, তাই বুঝতে পারছ না। ভাল করে পড়াশোনা কর। যদি ঠিকমতো পড়াশোনা না কর আর জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে না পারো, তবে আমাকে কখনওই তোমার ঘরে তুলতে পারবে না। আমি যে ওকে আমার মেসে রেখেছি, এটা আমার বাসায় কেউ জানত না। আমি ওকে এটা বলে বোঝাই যে আমরা নিজেদের মত করে সব ঠিক করে ফেলব। শুধু ও যেন আমার পাশে থাকে। তখন আমি হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে পড়াশোনার পাশাপাশি আমাদের খরচ চালানোর ব্যবস্থা করার সব চেষ্টাই করতে লাগলাম। ওর বিভিন্ন আবদার পূরণ করার চেষ্টা করতাম, নিজে না খেয়ে হলেও ওকে খাওয়াতাম।

তারপর………গত ২৮ এপ্রিল ২০১৭ তারিখ সে অন্য এক ছেলের হাত ধরে পালিয়ে গেল। সে ছেলের সাথে নাকি তার প্রায় সাত মাসের সম্পর্ক। আমি বাসা থেকে বেরিয়ে গেলেই ওরা ফোনে গল্প করত, কখনও-কখনও বাইরে গিয়ে দেখা করত।

আমি নিজেকে কোনোভাবেই বোঝাতে পারছি না। আজ ও আমাকে ফোন করে বলেছে, আমি যেন ওকে ক্ষমা করে দিই। ওর কথা ভুলে যাই, নিজের ক্যারিয়ারের প্রতি মনোযোগী হই, আর পড়াশোনা শেষ করে যেন অন্য কোনও মেয়েকে বিয়ে করে সুখী হই। আমি অনেক কান্নাকাটি করি আর ওকে ফিরে আসতে বলি। আমার কান্না শুনে সে আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, তুমি অনেক ভাল একটা ছেলে। তোমার মত ছেলেই হয় না। আমি তোমাকে সারাজীবনই ভালোবেসে যাব, কিন্তু কখনওই তোমার সামনে যাব না।

এটাই ছিল ওর শেষ কথা। ওইটুকু বলেই ফোনটা কেটে ও আমাকে ব্লক করে দেয়। আমি একথা কাউকে বলিনি। এসব শুনলে হয়তো ওকে সবাই খারাপ ভাববে, তাই বলিনি। মানুষকে বিশ্বাস করার শাস্তি এতটা ভয়াবহ হতে পারে, আমি কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবিনি।

(এমন কিউট টাইপের পবিত্র গরু, নিষ্পাপ বলদ, আদুরে গর্দভ আর কয়টা পাওয়া যাবে? কেউ খুঁজে পেলে আমাকে একটা মিসড্‌ কল দিয়েন, আমি নিজ দায়িত্বে কল করে জেনে নেবো!)

দুই।

একটা ছেলের সাথে আমার দুই বছর ধরে সম্পর্ক। আমি ওকে যেমন করে ভাবি, সে আমায় তেমন করে ভাবতে চায় না। সে আমার প্রতি কেমন জানি উদাসীন। তবে সে আমায় বিয়ে করতে চায়। আমার প্রতি তার সেরকম কোনও ভালোবাসার টান নেই। আমাদের মধ্যে যা আছে, তা আমার দিক থেকে যতটা ভালোবাসা, ওর দিক থেকে ঠিক ততটাই অভ্যস্ততা।

আমাদের সম্পর্কের দুই বছর পার হওয়ার কিছুদিন পর অন্য একজনের সাথে আমার ফেসবুকে পরিচয় হয়। উনি আমাদের এলাকায় একটা ব্যাংকে চাকরি করেন। উনি আমাকে খুবই ভালোবাসেন। আমার প্রেমিকের চেয়েও উনি আমার বেশি যত্ন নেন। আমার প্রতি উনার টান অনেক বেশি। সবসময়ই আমার খোঁজখবর রাখেন। আমার মান-অভিমান উনি খুব ভাল বুঝতে পারেন। আমার মনের কথা ধরতে পারেন। কথা বলতে-বলতে উনার সাথে আমার ভালোবাসার একটা সম্পর্ক হয়ে গেছে। আমরা দুজন দুজনকে খুব পছন্দ করি। কিন্তু উনি বিবাহিত। তবু উনি আমাকে অনেক সময় দেন। উনার বউয়ের সাথে নাকি উনার ভালোবাসার কোনও সম্পর্ক নেই। যা আছে, তা স্রেফ দায়বদ্ধতা। উনার বউও বিয়ের আগে একজনকে ভালোবাসত আর তাদের মধ্যে শারিরীক সম্পর্কও ছিল। এখন উনি আমার রিলেশন নিয়ে জানার পরও আমাকে ভালোবাসতে চান। বলেন যে, আমি যা চাই, তা-ই হবে। আমি যদি আগেরজনকে বিয়েও করি, তবু উনি আমাকে ভালোবাসবেন। আর যদি উনাকে বিয়ে করতে চাই, তাতেও তিনি রাজি।

এখন আমার সমস্যা হল, আমি আমার আগের মানুষটাকে ছাড়তে পারব না। আবার উনাকেও বিয়ে করতে পারব না, কারণ উনি তো বিবাহিত। তবে আমার আগের মানুষটার চেয়ে উনাকে বেশি ভাল লাগে। কারণ, আগের মানুষটি আমাকে আমার মত করে ভালোবাসে না, আমাকে সময় দেয় না, আমার খোঁজখবর রাখে না, আমাকে বোঝেই না! আমি এখন বুঝতে পারছি না, আমি যদি আগের মানুষটিকেই বিয়ে করে ব্যাংকার লোকটিকেও গোপনে ভালোবাসি, বর্তমানের সম্পর্কটা ঠিক রাখি, তবে কি তা খুব নোংরামি হবে?

তিন।

আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য আইনে মাস্টার্স করেছি। আমার বন্ধুরা অনেকেই এর মধ্যে সহকারী জজ হয়েছে, কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছে। আমার আগ্রহ ছিল সিভিল সার্ভিসে। কিন্তু মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মানোর কারণে আমাকে সে স্বপ্ন অচিরেই ছাড়তে হয়েছে। আমি এখন চট্টগ্রাম জজ কোর্টে একজন সিনিয়রের আন্ডারে কাজ শিখি। আমার একজন আত্মীয় সেটা ঠিক করে দিয়েছেন। এখন কোনও বেতন পাই না। উনি বলেছেন, ৬ মাস পরে থেকে আমাকে বেতন দেয়া হবে। সমস্যা হল, আমি এ কাজে এসে নিজের স্বাভাবিক আচরণ থেকে দিনদিন দূরে সরে যাচ্ছি। আমাকে প্রতি মুহূর্তে সাইকোলজিকাল টেষ্ট দিতে হয় তাদের কাছে। আমি সারাদিন খেটে কোর্ট থেকে ফেরার পর বিসিএস পরীক্ষার জন্য কিছুই পড়তে পারি না। আমি প্রচণ্ড মানসিক যন্ত্রণায় পড়েছি। আমার সব বন্ধুরা যখন বিসিএস পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন আমি সারাদিন সিনিয়রের পেছনপেছন অনিচ্ছা সত্ত্বেও জ্বি স্যার, জ্বি স্যার করেকরে ছুটে বেড়াচ্ছি। ওই আত্মীয়ের কাছে আমার পরিবারের প্রেস্টিজ চলে যাবে বলে এখান থেকে সরেও আসতে পারছি না। এর মধ্যে সাইক্রিয়াটিস্টও দেখিয়েছি। আমি কী করব, কীভাবে করব, কিছুই বুঝতে পারছি না।

প্রতিটি মানুষের জীবনের লক্ষ্যগুলো হয়তো প্রথম শ্রেণী, দ্বিতীয় শ্রেণী, তৃতীয় শ্রেণী এভাবে করে বিভিন্ন পর্যায়ে সাজানো থাকে। অর্থাৎ, প্রথম শ্রেণীর লক্ষ্যে পৌঁছাতে না পারলে দ্বিতীয় শ্রেণীর দিকে ছুটতে হয়। দ্বিতীয়টা ফসকে গেলে তৃতীয়টার দিকে ছুটতে হয়। এভাবেই মানুষ তার জীবন বা ক্যারিয়ারের পর্যায়ক্রমিক কোনও এক লক্ষ্যে স্থির হয়। কিন্তু যখন কেউ প্রথম সারির ইচ্ছাকেই অবদমন করে দ্বিতীয় বা তৃতীয় সারির ইচ্ছাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, আদতে যৌক্তিকভাবে সে কতটুকু সফল হয়?

এ প্রশ্নের কোনও উত্তর আমি খুঁজে পাচ্ছি না।

ভাবনা: তিনশো ছয়।

……………………………………..

আমার স্কুললাইফটা অনেক অনেক অনেক ভাল ছিল। আফসোস ছিল না কোনও। দিনগুলি সুন্দর ছিল। এসএসসি’তে বৃত্তিসহ গোল্ডেন এপ্লাস পাই। এ অর্জনটা অনেক বড় ছিল আমার কাছে। যদিও জানতাম, এটাই শেষ নয়, সামনে আরও কঠিন থেকে কঠিনতর বাধা পার হতে হবে, তবুও অনেক খুশি হয়েছিলাম।

হাসিমুখে বাধা পেরুবো—এইচএসসি’তে এমন স্বপ্ন আর পূরণ হল না। রেজাল্ট আসল এ গ্রেড। বাবা-মা’র অনেক ইচ্ছে ছিল আমাকে মেডিক্যালে পড়ানোর, আমারও ইচ্ছে ছিল, কিন্তু তাও হল না। শুধু মেডিক্যালের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলাম ভার্সিটিতে পড়ার ইচ্ছে ছিল না বলে। মেডিক্যালে হল না, তখন খুব অল্প সময়ে ভার্সিটির জন্য কিছুটা প্রস্তুতি নিয়েছিলাম, কিন্তু অতো অল্প প্রস্তুতি নিয়ে তো আর প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা যায় না! মেডিক্যালে আর ঢাকা ভার্সিটিতে সেকেন্ড টাইম পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ বন্ধ করে দেয়া হল। তখন আমার চারদিকে কেবল হতাশা আর হতাশা। মারাত্মক রকমের হতাশার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম। কলেজলাইফে বেশ কয়েকটি ভুল সিদ্ধান্ত নেয়া আর নিজের বেস্টটা ঢেলে দিতে না পারাই ছিল আমার আফসোসের মূল কারণ।

হ্যাঁ, পরিবারের সাপোর্ট পেয়েছি সবসময়ই। সেকেন্ড টাইমে আমি অন্যান্য ভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষা দিতে পারতাম, কিন্তু কেমন জানি একটা ক্ষোভ জন্মেছিল মনের ভেতর। মনে হচ্ছিল, লাভ কী সেকেন্ড টাইমে পরীক্ষা দিয়ে? আমাকে দিয়ে তো আর কিছু হবে না! পরে বুঝলাম, এটাও ছিল আমার মস্ত বড় একটা ভুল সিদ্ধান্ত। একটা মানুষ কীকরে এতবার এতো বড়বড় ভুল করে যেতে পারে? মা-বাবা তারপরও আমাকে নিয়ে বড় স্বপ্ন দেখে। মেডিক্যালে হয়নি তো কী হয়েছে? সবাই তো আর ডাক্তার হবে না! এমন তো নয় যে কেবল ডাক্তারদের জীবনই সফল! এমন নানান কথা বলে আমাকে অনুপ্রেরণা যোগাতো। এদিক থেকে আমি অনেক লাকি। আমি মিডলক্লাস ফ্যামিলির বড় মেয়ে। আমরা দুই বোন। কোনও কূলকিনারা না পেয়ে একটা প্রাইভেট ভার্সিটিতে ভর্তি হলাম ইংলিশে। ইচ্ছে ছিল না ইংলিশে পড়ার—তাও প্রাইভেট ভার্সিটিতে! তবে প্রাইভেট ভার্সিটিতে এই সাবজেক্টে পড়ার খরচটা ছিল আমাদের সাধ্যের মধ্যে। এখান থেকেও চেষ্টা করলে ভাল কিছু করা যাবে, এই আশা নিয়ে পড়াশোনা শুরু করলাম। হতাশা তখনও আমার নিত্য সহচর। বাবা-মা’র কাছ থেকে কেবল নিয়েই গেলাম, কিছুই দিতে পারলাম না তাদের। তারপরও ওরা আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে। অনুপ্রাণিতও করে। মাত্র দুটো টিউশনি ছাড়া আর তেমন কিছু করার সুযোগ আমি পাইনি। ইচ্ছে ছিল, কিন্তু নানান কারণে আর কিছুই করা হয়ে ওঠেনি।

আমাকে বাবার অনেক টাকা খরচ করে পড়তে হচ্ছে, এই অপরাধবোধটা কাজ করত সবসময়। তারপরও ধৈর্য ধরতাম সবসময়। ফার্স্ট আর সেকেন্ড সেমিস্টার ভালই গেল। থার্ড সেমিস্টারের মিডটার্ম একজামের কিছুদিন আগে একটা ঘটনায় জীবনটা পুরো তছনছ হয়ে গেল। সবকিছু একদম শেষ! মাটির সাথে মিশে গেল সকল আশাভরসা।

একটা রোড অ্যাক্সিডেন্টে আমার সব স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গেল! গত বছরের পহেলা জুলাইয়ে মিডটার্ম একজামের কিছুদিন আগে রোড অ্যাক্সিডেন্টে আমি আমার ডানহাতটা হারাই। ডাক্তাররা বলেছিলেন যে আমার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। আমার শরীর থেকে অনেক রক্ত বের হয়ে গিয়েছিল। হাসপাতালের দিনগুলি কখনও ভোলার নয়। এই অঘটনটির কষ্টও কখনও শেষ হবার নয়। কোনও বাবা-মা’ই তো তাদের আদরের সন্তানের এমন পরিণতি দেখার ক্ষমতা রাখেন না। মায়ের চোখের জল এখনও শেষ হয়নি। আল্লাহ্‌র রহমতে বাবা-মা’র দোয়ায় এখন মোটামুটি সুস্থ আছি। মাঝেমাঝে মনে হয়, তখন কেন মরে গেলাম না? এই যে বেঁচে আছি, কী লাভ হচ্ছে? মৃত্যু থেকে ফিরে আসার পরও প্রায়ই সুইসাইড করার ভূত চাপে মাথায়। অঙ্গহানির কষ্ট সহ্য করা খুব কঠিন! কিন্তু আমার কলিজার টুকরা ফ্যামিলির জন্য হলেও আমাকে বেঁচে থাকতেই হবে। অবাক করার মত বিষয় হল, তারা আমাকে এখনও অনুপ্রাণিত করে! আহা, আমি কত লাকি! তাদের চোখে এখনও আমাকে নিয়ে কত স্বপ্ন! তাদের স্বপ্ন পূরণের স্বপ্ন আমি আবারও দেখতে শুরু করেছি।

আপনজনরা কাছে থাকলেও অনেকেই আবার দূরে চলেও গেছে। সেই অনেকের মধ্যে কেউকেউ আছে, যাদের আমি আমার ওই দুর্ঘটনার আগে আপন ভাবতাম। এরকম একটা বিপদে আপনজন কীকরে দূরে চলে যায়, তা আমার স্বল্প জ্ঞানে ধরে না। ওরা বাইরের মানুষ হলে তেমন কিছু হত না। ওদের অনেকেই আমাদের পরিবারের মানুষ। আমি এমন কথাও আমার খুব কাছের মানুষকে বলতে শুনেছি, “এই প্রতিবন্ধী মেয়েকে আমাদের আর কী কাজে লাগবে? ওর পেছনে টাকা নষ্ট করার কী মানে?” হয়তো এটাই স্বাভাবিক, এটাই পৃথিবীর নিষ্ঠুর নিয়ম। দুর্ঘটনার পর আমি মানুষ চিনতে শিখেছি। কারা মুখোশ পরে ছিল এতদিন, বুঝতে শিখেছি। স্বার্থপর যে মানুষগুলি কেবল সুমসয়ের সাথী, দুঃসময়ে যাদের খুঁজেও পাওয়া যাবে না, তাদের চিনেছি। এমন মানুষকেও আমি আগে আপন ভাবতাম, যাদের হয়তো মানুষ বলাটাও ভুল!

আমি এখন বেঁচে আছি কেবল আমার বাবা-মা’র স্বপ্ন পূরণ করার জন্য। শুধু তাদের জন্যই এখনও স্বপ্ন দেখি, ভাল কিছু করার আশা মনে জাগে। শুভাকাঙ্ক্ষী অনেকেই হয়, কিন্তু বাবা-মায়ের মতন আপন আর কেউ হয় না।

আপনার গল্পের নায়কের মত কোটা না নিয়ে যুদ্ধ করার মত সাহস আমার নেই। জীবনটা নরক হয়ে গেল। কোথাও যদি একটু শান্তি মিলত! আমি আপনাকে চিনি একমাস হল। প্রথম দেখি ইউটিউবে, এরপর ফেসবুকে। আপনার কথা শুনে ও লেখা পড়ে আমি অনেক, অনেক, এবং অনেক সাহস পেয়েছি। আগে মনে হত, আমাকে দিয়ে আর কিছু হবে না, এখন মনে হয়, হবে। আমিও পারব। আমি হেরে যাব না। একটা মানুষ যতক্ষণ বেঁচে আছে, ততক্ষণ সে কিছুতেই পরাজিত নয়। যারা আমার কাছ থেকে আমার এই সীমাবদ্ধতার কারণে দূরে সরে গেছে, আমি তাদের বুঝিয়ে দিতে চাই যে দূরে সরে যাবার মত কিছু এখনও হয়নি। আমি এমন কেউ নই, যাকে দূরে ঠেলে দিতেই হবে।

আপনাকে আমার গল্পটা বললাম একটু হাল্কা হওয়ার জন্য। দুঃখ শেয়ার করলে নিজেকে অনেক ভারমুক্ত লাগে। পরিশ্রম করার মত মানসিক শক্তিটা এখনও তৈরি করে নিতে পারিনি। তবে এটা বুঝি যে কিছু পেতে চাইলে তো কিছু দিতেই হবে। হয়তো আমাকে আলাদাভাবে দেয়ার সময় আপনার হাতে নেই, তাই একটাই অনুরোধ আপনার কাছে………আমাদের মত হারিয়ে যাওয়া মানুষের জন্য কথাবলা আর লেখালেখি কখনওই বন্ধ করবেন না। নজরুলের একটা কথা মনে পড়ছে—যে চাঁদ সাগরে জোয়ার আনে, সে হয়ত তাহার শক্তি সম্পর্কে আজও না ওয়াকিফ।…………আপনি হয়তো নিজেও জানেন না, আপনি কত মানুষকে বাঁচতে শেখাচ্ছেন। যারা বাঁচছে আপনার হাত ধরে, তারা আপনার এ কাজের জন্য আপনাকে চিরকাল কৃতজ্ঞতাভরে মনে রাখবে।

ভাবনা: তিনশো সাত।

……………………………………..

এক।

আমি ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে, সায়েন্সে। সামনে এইচএসসি। আপনাকে চিনি সুইসাইড নোট নিয়ে আপনার একটা লেখা থেকে। আমি আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম একসময়। আপনার সে লেখা পড়ে আবারও বাঁচার চেষ্টা করে যাচ্ছি।

আমি অনেক মানসিক অশান্তিতে আছি। কোনও কিছুতেই শান্তি পাচ্ছি না। পড়াশোনাতেও মন বসছে না। ফ্যামিলির সবার সাথেই না চাইতেও উচ্চস্বরে কথাবলা হয়ে যাচ্ছে। একটা ছেলের সাথে সম্পর্ক আছে। প্রায় ২ বছর হল। মাঝখানে কিছুদিন ছিল না। আমি আগে পড়াশোনায় খুব ভাল ছিলাম। এখন যে খারাপ, তা অবশ্য না। কিন্তু আগের মত ভাল নেই। তখন পরীক্ষায় ১ নম্বর কম পেলেই অনেক কান্নাকাটি করতাম, এখন ১০ নম্বর কম পেলেও কিছুই মনে হয় না। সময়ের সাথেসাথে মনে হচ্ছে, অনেক খারাপ হয়ে গেছি আমি। আমি আবারও আগের মতই সবকিছু চাই। কিন্তু সমস্যা হল, আমি ওকে এতো ভালোবেসে ফেলেছি যে, ওকে ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারি না। আর ও আমার সাথে শুধুই ঝগড়া করে। অনেক তুচ্ছ বিষয় নিয়েও ঝগড়া করে। আগে সবকিছুই অনেক ভাল লাগত। ঝগড়া করতেও খারাপ লাগত না। কিন্তু এখন আর ভাল লাগে না। একেক সময় মনে হয়, সে অনেক ভাল, তার চাইতে ভাল আর কোনও ছেলেই নেই! তার চাইতে ভাল আর হয়ই না! আবার ঝগড়া হলে মনে হয়, সে অতি খারাপ একটা ছেলে। সে আমাকে মানসিকভাবে অনেক টর্চার করে, কিন্তু আমি সত্যিই তাকে ভালোবাসি। আমি ওকে ভাল হতে বলি, সে আমার কথা শোনেও, কিন্তু বেশিদিন ভাল থাকে না, আবারও আমার সাথে ঝগড়া করা শুরু করে দেয়। তখন ওকে অসহ্য লাগে। ওর রাগ অনেক বেশি। হুট করেই রেগে যায়। আমার আম্মু একটুএকটু জানে ওর কথা। ও কমার্সে পড়ে, এটাই আম্মুর অপছন্দ। আম্মু চায়, তার জামাতা ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হোক। অনেক সমস্যার মধ্যে আছি। আমি চাই, সে অনেক ভাল করে পড়াশোনা করুক, অনেক ভাল কিছু করুক, জীবনে অনেক বড় হোক। ও ভাল কিছু করতে না পারলে আমিও ভাল কিছু করতে চাই না। ভাল থাকলে দুজন একসাথে ভাল থাকব, খারাপ থাকলে দুজন একসাথেই খারাপ থাকব। এটাই আমার চাওয়া।

আমার কথা: যে সকল টিনএইজড্‌ মেয়েরা বিশ্বাস করে, সে যার সাথে প্রেম করছে, তার সাথেই তার বিয়ে হবে, আসুন, সে সকল গাধীদের জন্য আমরা দুই মিনিট নীরবতা পালন করি।

পড়ালেখার নাম নাই, চুলের প্রেম করে! আবার বলে, কেন যে দিনদিন গাধা হয়ে যাচ্ছি, নিজেই বুঝি না! আরে ভাই, শোনো! তোমাদের বয়সে যে প্রেম করে, সে হয় আগে থেকেই বলদ, কিংবা প্রেম করার পর বলদ হয়ে যায়! এমন প্রেম কখন কবে কোথায় আলোর মুখ দেখেছে? এমন ছেলেমেয়েদের বাপ-মা কি মইরা গেসে? ধইরা দুই কানে দুই থাবড় দেয় না ক্যান? হয় কথা শুনবে, হয়তো ঘাড় করে বের করে দেয়া হবে। সিম্পল! প্রেম করতে হলে যেদিন নিজের পায়ে নিজে দাঁড়াতে পারবে, সেদিন করুক। বাপের খায়, বাপের পরে, বাপের টাকায় প্রেমও করতে দিতে হবে? ঘর থেকে লাত্থি মেরে বের করে দিলে কী হয়? রাস্তাঘাটে ঘুরুক আর ডাস্টবিনে পচে মরুক।

দুই।

ওর আর আমার বয়স একই। ও পড়ে খুলনা ভার্সিটিতে আর আমি আজম খান কমার্স কলেজে। আমাদের রিলেশনের প্রথম দুই বছর অনেক ভালই কেটেছে। এরপর দেখলাম, হঠাৎ করেই ও আমার ফ্রেন্ড-সার্কেল সহ্যই করতে পারছে না! আমার দুইজন বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল—একটা ছেলে, একটা মেয়ে। আমরা এতটাই ঘনিষ্ঠ ছিলাম যে ক্লাস বা কোচিং-এর কেউ দেখলে ভাবত, ওই ছেলে ফ্রেন্ডের সাথে হয়তো আমার অ্যাফেয়ার আছে। এমনকি কোচিং-এর স্যারদের ধারণাও তা-ই ছিল। আমার বয়ফ্রেন্ড কোনও এক ভাবে এই কথাটা জানতে পারে। ও ভাবে, আমার সাথে হয়তো আমার ওই ছেলে ফ্রেন্ডটির কোনও রিলেশন আছে, নইলে আমরা এতো ঘনিষ্ঠভাবে মিশি কেন? সে আমাকে অনেক নিষেধ করেছে মিশতে, কিন্তু আমরা তো ভাল বন্ধু ছিলাম, আর ওই ছেলেটা ছিল আমার বেস্ট ফ্রেন্ড, তাই মেশা ছাড়তে পারিনি। এরপর থেকে ও আমাকে কারও সাথেই মিশতে দিত না, এমনকি আমার ওই মেয়ে ফ্রেন্ডের সাথেও না। আর আমার মুখে কোনও ছেলের নাম শুনলেও খেপে যেত। সবসময়ই আমাকে কেবল সন্দেহ করত।

ও এমনভাবে সিনক্রিয়েট করত যে, কেউ ভয়েই আমার সাথে কথা বলতে চাইত না। যারাই আমার সাথে মিশতে চাইত, ও সবার সাথেই বাজে ব্যবহার করত। এরপর আমি ভাবলাম, আমার জন্য কেন সবাই এমন খতরনাক পরিস্থিতি সহ্য করবে! তাই একসময় আমিও কারও সাথে মেশা বন্ধ করে দিই। ও নিজের ক্লাস না করে আমাকে প্রতিদিন ক্লাসে নিয়ে যেত, আমার ছুটি হলে ক্লাস থেকে নিয়ে আসত।

এমনি করে ২০১৪ কাটল। আমি এসব আর সহ্য করতে পারছিলাম না। মনে হল, আমারও তো একটা জীবন আছে। সে লাইফে আমার কিছুটা স্বাধীনতা দরকার। আমি কেন ওর মত করে নিজের জীবন কাটাব? আমি আবারও আগের মত আমার বন্ধুদের সাথে মেশা শুরু করলাম। ও আবারও আগের মত সিনক্রিয়েট করতে লাগল। আমাকে কোথাও যেতে দিত না, তারপরও সব সহ্য করতাম, কারণ আমি ওকে অনেক ভালোবাসতাম। ও আমার কারও সাথে মেশা পছন্দ করে না, আমাকে একা কিংবা অন্য কারও সাথে কোথাও যেতে দেয় না, কোথাও গেলে ওর সাথেই যেতে হবে, এটাই নিয়ম। এভাবে চলতে-চলতে আমি পুরোই সাইকো হয়ে যাচ্ছি! আমার যে দুজন বেস্ট ফ্রেন্ড, ওদের মধ্যে সম্প্রতি রিলেশন হয়েছে। ওকে এটা বলতেই ও ফোঁস করে উঠল এই বলে যে, ওই ছেলে তোমার সাথে ঢলাঢলি করার ধান্দায় এমন অ্যাক্টিং করছে! এটা শুনে আমি বুঝতে পারছিলাম না, এমন একটা কথা শোনার পর কী বলতে হয়!

ওদিকে পরিবারেও অনেক সমস্যা হচ্ছে। বড় যখন হয়ে গেছি, তখন তো বিয়ের প্রস্তাব আসবেই, স্বাভাবিক। কিন্তু এক্ষেত্রে ও আর কী-ই বা করবে! ও তো এখনও পড়াই কমপ্লিট করতে পারেনি। তাও সবকিছুই সহ্য করতাম, এবং এখনও করে যাচ্ছি। মেয়েরা আর কিছু পারুক না পারুক, এটা কাজ খুব পারে, তা হল, ওরা সত্যিকারের ভালোবাসতে পারে। একবার যাকে ওরকম করে ভালোবেসে ফেলে, তার সকল অন্যায় অত্যাচারকেও মেনে নেয়।

মাঝখানে ও সেশন জ্যামে আটকে গেল। এখন আমার বিবিএ কমপ্লিট, অথচ ও অনেক পিছিয়ে গেছে। এসব ঝামেলার কারণে ওর ক্রোধের পরিমাণ দিনদিন আরও বাড়ছে। অযোগ্যদের এতো রাগ থাকতে নেই, কিন্তু কে বোঝাবে ওকে এ কথা? আমার কোনও ফ্রেন্ড ওকে সহ্য করতে পারে না। এমনকি আমার কাজিনরাও না। আগে দেখা হলে আমার মোবাইল ফোনটা কেড়ে নিয়ে আমি কার-কার সাথে চ্যাট করি, এসব নিয়েও ঝগড়া করত। সেটা একটা সময়ে থেমে গেছে। কোথাও গেলে ও আমাকে আমার ফ্রেন্ড সার্কেল নিয়ে বকবেই! আমার ফ্রেন্ডরা খারাপ, ওরা জীবনে কিছু করতে পারবে না, এরমকম আরও অনেক কথা! এসব সহ্য করতে-করতে আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি। ওকে ছাড়তেও পারছি না, আবার রাখতেও খুব কষ্ট হচ্ছে। ওদিকে ফ্যামিলি থেকে চাপ দিচ্ছে বিয়ে করে ফেলতে। কী যে করব, নিজেই বুঝতে পারছি না।

ইদানিং খুব ডিপ্রেশনের মধ্যে থাকি। যত নেগেটিভিটি আছে, সবই যেন আমার সাথেই হয়! কিছুই বুঝি না কেন এমন হচ্ছে! মানসিক চাপের ফলে দিনদিন আমার রেজাল্টও খারাপ হচ্ছে। আমাদের রিলেশনটা অনেকটা টম অ্যান্ড জেরি টাইপের হয়ে গেছে—সারাদিনই আমাদের ঝগড়া হয়, কিন্তু কেউ কাউকে ছাড়তে পারি না।

আমি দেখেছি, সম্পর্ক জিনিসটা এমন যে………বাঁধলেই পালায়! শেকল পরানোর মানেই হল, বন্ধন খোলার রাস্তা বানানো। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ আর বিশ্বাসের জোরেই সম্পর্ক টিকে থাকে। যদি এমন করে শ্বাসরুদ্ধ অবস্থায় সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়, তবে সে সম্পর্কে স্বাভাবিকতাটা আর কীভাবে থাকে? আর যাকে বিশ্বাসই করতে পারি না, তার সাথে পথচলার কী মানে? জোর করে কি আর হৃদয় বাঁধা যায় কখনও?

ভাবনা: তিনশো আট।

……………………………………..

আমি রেবা। খুব সাধারণ একটা মেয়ে। রবীন্দ্রনাথের ‘সাধারণ মেয়ে’ কবিতার ওই মেয়েটি আমি। ভাববেন না, আমি আপনাকে ইম্প্রেস করার চেষ্টা করছি। আমার একটা ইচ্ছে আছে; তা হল, আমি আপনার ওই দিকগুলি সম্পর্কে জানতে চাই, যা আপনি সবার সামনে প্রেজেন্ট করেন না। কী আর লিখব! বেশি লিখলে তো আমাকে অ্যাগ্রেসিভ ভাববেন আর অমনিই আমার প্রতি আপনার সকল আগ্রহের অকালমৃত্যু ঘটবে। এরপর হয়তো আপনাকে হারিয়েই ফেলব।

একটা মজার জিনিস শেয়ার না করে থাকতে পারলাম না। আমাদের ক্যাম্পাসে নতুন এক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। সে পরিবেশের নাম বিসিএস পরিবেশ। সবাই গণহারে বিসিএস পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেয়ার পেছনে উঠেপড়ে লেগেছে, আর এটা দেখে আমার খুব রাগ হচ্ছে। আপনার বিভিন্ন লেখা প্রিন্ট করে কিংবা পেপার থেকে আপনার গাইডলাইন কেটে নিয়ে চোখের সামনে রেখে সে অনুযায়ী পড়তে-পড়তে সবাই জীবন, যৌবন সবই হাসিমুখে শেষ করে দিচ্ছে। আমাদের ক্যাম্পাসে…………আপনি এলেন, বললেন, হয়ে গেল! শুভ্র দেবের গানের লাইন মাথায় বাজছে…………আমি হ্যামিলনের সেই বাঁশিওয়ালা, বাজাবো বাঁশি সুরেসুরে……তোমাকে আসতেই হবে!

আজ সকালে ডিপার্টমেন্টে যাওয়ার পথে মেঘ ভেবে কুয়াশার সাথে বন্ধুত্ব করলাম। খারাপ লাগছিল না। একলা রাস্তায় আমি, কুয়াশা আর হেডফোনে কিছু রোম্যান্টিক গান। ফাঁকা রাস্তায় হাওয়ায় দুলে নেচে নিলাম কয়েকবার………বারবারই মনে হচ্ছিল, কেউ আবার দেখে ফেলল নাতো!

সকালে মজা করার শাস্তি এখন পাচ্ছি—কাশি, মাথাব্যথা, জ্বর। ওষুধ খেতে ইচ্ছে করছে না। ওষুধ খেয়ে সুস্থ হয়ে গেলে রুমমেটের যত্ন আর ভালোবাসা কমে যাবে।

রাজ কাপুরের ‘আওরাত’ দেখলাম। পেয়ার হুয়া ইকরার হুয়া হে………পেয়ার ছে ফির কিউ ডারতাহে দিল………আহা, মধু! কেন জানি না, ফিল্মটা দেখার সময় কেবলই মনে হচ্ছিল, আহা, আমার যদি লম্বা চুল থাকত আর আমি যদি তা ছেড়ে থাকতাম সবসময়!

আজকাল খুব ফাঁকিবাজ হয়ে গেছি। পড়তে ইচ্ছে করে না একটুও। ডিপার্টমেন্টের রেজাল্টটা একটু ভাল করেটরে মাকে থামিয়ে রেখেছি, নইলে কত্ত আগে কানে ধরে শ্বশুরবাড়িতে পাঠিয়ে দিত! মায়েদের কাছে মেয়েদের বিয়ের পিঁড়িতে বসাই সবকিছু! সবসময়ই মনের মধ্যে একটা অ্যালার্ম ক্লক বাজতেই থাকে—এই রেবা! পড়া! নয়তো বিয়া! আমি যে বিয়ে করতে চাই না, মাকে তা কিছুতেই বোঝাতে পারি না। তাই বিয়ের হাত থেকে বাঁচার জন্যই পড়াশোনা করি। বিবাহবিরুদ্ধ অভিযান—এটাই আমার পড়াশোনার প্রধান মোটিভেশন! আমার সকল পড়াশোনাই বিবাহ-প্রতিরোধক পড়াশোনা! পড়লে মা বিয়ে না করার জন্য ধমকও দেয় না। আমাকে কেউ ধমক দিয়ে কথা বললেই আমি কেমন জানি খুব কষ্ট পাই! আর কষ্ট পেলে আমার একটুও ভাল লাগে না, কিছুই ভাল লাগে না।

দুই বছর আগে রোড অ্যাক্সিডেন্টে আমার কোমর আর ডানহাতে ফ্র্যাকচার হয়। তাই আমাকে সাবধানে থাকতে হয়। আমি আবার নাচতে খুবই পছন্দ করি। রুমে কেউ না থাকলেই নাচতে থাকি। এইতো একটু আগেও অনেকক্ষণ ধরে নাচলাম ঝুম বালিকা, ঝুম বালিকা, ঝুমাঝুমাঝুম গানটার সাথে। কোমরে খুব ব্যথা করছে, তারপরও আমি খুব খুশি নাচতে পেরে। সত্যি খুব আনন্দ হচ্ছে। কোমর ব্যথা না করলে আরও নাচতাম।

আজকের সকালটা বেশ বোরিং! আজ তুঁতবাগান দিয়ে ডিপার্টমেন্টে যাওয়া হল না। গেইট থেকে একদৌড়ে ক্লাসে যাওয়া হল না। আজ দিব্যা আর তুলিকে ফ্লাইইং কিস দেয়া হল না। মৌকে চোখমারা হল না। সেক্সি কিলার পউষিকে জড়িয়ে ধরা হল না। আজ ‘তেলা-বান্টি’কে দেখে প্যারডি গাওয়া হল না। নকিবকে ফুল দেয়া হল না। সাদিয়াকে ওর নতুন বয়ফ্রেন্ড নিয়ে জ্বালানো হল না। জুঁইয়ের লিপস্টিক ঠোঁটের নিচে লেপটে দেয়া হল না। জাভেদ স্যারকে দেখে ভেংচিকাটা হল না। মাসুমমামার বাগান থেকে গাঁদা চুরি করে খোঁপায় গোঁজা হল না। আজ নির্ঝরের সাথে পকরপকর করা হল না। ক্যাম্পাসের রিকশাগুলির টুংটাং শোনা হল না। রবিকাকার দোকানে সরের চা খাওয়া হল না। আজ কিছুই হল না! না, না, না! আজ আর কিছুই করা হল না! আজকের দিনটাই মাটি! একদিন ক্যাম্পাসে না গেলে কত কী যে মিস হয়ে যায়!

এইমাত্র মায়ের সাথে রাগারাগি হল। কারও সাথেই খারাপ ব্যবহার করতে চাই না আমি। কাউকে উঁচু গলায় কোনও কথা বললে পর্যন্ত পরে আমার শুধুই খারাপ লাগতে থাকে। ধ্যত্‌! আমি খুবই খারাপ একটা মেয়ে! কিচ্ছু ভাল লাগছে না আমার! মায়ের জন্য কান্না পাচ্ছে, কিন্তু মাকে ফোন করে সরি বলতেও ইচ্ছে করছে না! ধ্যত্তেরিক্কা!

আচ্ছা, আপনি এই মুহূর্তে বাংলাদেশের কোন প্রান্তে বসে আমার এসব পাগলামি এনজয় করছেন? দিনেদিনে আপনার ফলোয়ার বেড়ে যাচ্ছে। আজ হয়েছে ১২৫৫৭। খেয়াল করেছেন না? আপনার যন্ত্রণা ও বিপদ, দুইই বেড়ে যাবে! তবুও………নট ব্যাড! আপনাকে হিংসে করতে ইচ্ছে করছে খুউব! করতে পারি কি?

আপনি আমাকে আর কক্ষনো হ্যাঁ/আচ্ছা/হুম এসব উত্তর দেবেন নাতো! একটু বড় করে উত্তর দিলে কী হয়? খুব ক্ষতি হয়ে যায় আপনার?

জানেন, বাবাকে মনে পড়ছে খুউব। বোতলের ভেতরে প্রজাপতিগুলি ভীষণ ছটফট করছে! কিন্তু আমি নিরুপায়, কিছুই করতে পারছি না, ওদের নিয়ে যে ইনসেক্ট-বক্স তৈরি করতে হবে! ওরাও কষ্ট পাচ্ছে, সাথে আমিও কষ্ট পাচ্ছি! আমাকে দেখে ঈশ্বরও কষ্ট পাচ্ছেন, সাথে আমিও। বাবা, ভাল আছ তো? তোমাকে অনেক ভালোবাসতাম, বাবা! কখনও বলা হয়নি। বাবা, তুমি ভাল থেকো, কেমন? বাবা, জানো, মা তোমার কথা বলতেবলতে কেমন যেন কেঁদে ফেলে! তখন মায়ের সাথে আর রাগ করে থাকা যায় না। কেন এই দুই পাগলিকে ছেড়ে চলে গেলে, বাবা?

কেমন আছেন? আপনার লেখা পড়ে মনে হচ্ছে, আপনার মন বেশ বিচলিত! আচ্ছা, আপনি কি আমাকে ভুলে গেছেন? নাকি, আমায় আর মনে পড়ছে না?

র‍্যালি থেকে রুমে ফিরে প্রজাপতিগুলোকে ছেড়ে দিলাম। অবশ্য, বেশিরভাগই মরে গেছে। যতক্ষণ না ওদের ছেড়ে দিচ্ছিলাম, ততক্ষণই নিজেকে কেমন জানি পাকবাহিনীর সেনা মনে হচ্ছিল। আমি খুব খুশি হয়ে আমার গ্রুপ পার্টনারকে এ খবরটা দিলাম। আর শুনেই তো বেচারি ফায়ার হয়ে গেছে! আমাকে অনেক বকাঝকা করল। বিকেলের একজামে মার্কস কম আসবে, তবু আমার কোনও আফসোস নেই, বরং বেশ শান্তিশান্তি লাগছে।

একটা মজার কথা শেয়ার করি, কেমন? আজ বিকেলে…………না, বলব না! আপনি তো আমায় মেবি ভুলেই গেছেন! আমি যদি এখন আপনার উপর রাগ ও অভিমান, দুটোই করে বসি, তখন কী হবে?

আচ্ছা, বলেই ফেলি! আমি আবার বেশিক্ষণ কারও উপর রাগ ধরে রাখতে পারি না। বেশি সময় রাগ ধরে রাখলে নিজেই কষ্ট পাই। মজার কথাটা হচ্ছে, আমার হলে জলপাই আচারের ধুম পড়েছে। বিশেষ করে, আমার ফ্লোরে। মেয়েরা তাদের বয়ফ্রেন্ড কিংবা হাজব্যান্ডের জন্য ধুমায়ে আচার বানাচ্ছে আর আমাকে দিয়ে চেখে দেখাচ্ছে। আমি নাকি স্বাদ ভাল বলতে পারি! আচার খেতেখেতে আমার রীতিমত পেটখারাপ হওয়ার উপক্রম! আমার বারান্দার টেবিলে সিলভি আপুর আচার—দৌড়ে গিয়ে তিন চামচ খেয়ে নিলাম! তবে আমি একাই খাইনি, সাথে সিলভি আপু বাদে সবাই খেয়েছে মতামত দেয়ার নাম করে! পরে জানা গেল, ওই বয়াম আপু রেখেছে ভাইয়াকে দেয়ার জন্য! এরপর যা হয় আরকি! আমরা কেউই স্বীকার করিনি, কারণ আমরা সবাই অপরাধী ছিলাম। বেচারি এতো কষ্ট করে আচার বানিয়ে যার জন্য রাখল, তাকেই খাওয়াতে পারল না! তবে হ্যাঁ, আচারটা আসলেই অনেক টেস্টি ছিল!