ভাবনাদেয়ালের পলেস্তারা (৪৫শ অংশ)

ভাবনা: তিনশো নয়।

……………………………………..

এক।

একজন হোমিও ডাক্তার দেখাতাম। আমাদের বাসার প্রায় সবাই চিকিৎসা নিত উনার কাছে। উনি ডাক্তার হিসেবে বেশ ভাল ছিলেন। এলাকায় বেশ নামযশ ছিল। আমি নিজেও ভাল কিছু উপকার পেয়েছিলাম। টানা প্রায় ২ বছর ধৈর্য ধরে উনার ওষুধ খাই। উনি বয়সে আমার বাবার চেয়েও বড়, উনাকে আঙ্কেল ডাকতাম। এতো বয়স্ক লোক, তার উপর ডাক্তার, তাই উনি আমাকে শারীরিক কোনও ব্যাপারে কখনও প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে প্রথমপ্রথম বিব্রতবোধ করলেও পরে আর করতাম না। হঠাৎ করেই উনার মধ্যে কিছু পরিবর্তন দেখি। উনি আমার ফেসবুকের ছবি প্রিন্ট করে আনতেন, লাঞ্চটাইমে কল করে গল্প করতে চাইতেন, আমি হাই, হ্যালো করার পর আর কথা খুঁজে পেতাম না, তাই নিজেই ফোন কেটে দিতাম। এরপরও উনি ফোন করে যেতেন, আমি রিসিভ করতাম না। তবে ফোনে কখনও বাজে কোনও কথা বলেননি। একদিন উনি আমাকে নিয়ে মেডিসিন কিনতে যেতে চাইলেন। বললেন, এই মেডিসিন নাকি নকল বের হয়েছে, আসলটা কম পাওয়া যায়, আমি না চিনে কিনলে দোকানদার আমাকে ঠকাবে, তাই উনি উনার পরিচিত দোকান থেকে কিনে দেবেন। আমি কী মনে করে যেন সেদিন উনাকে পাশ কাটিয়ে চলে এসেছিলাম।

আরেকদিন পেপারকাটিং দেখিয়ে ব্রেস্ট ক্যান্সারের এক ভয়াবহ কাহিনি শুনিয়ে আমার মনের মধ্যে ভয় ঢুকিয়ে দিলেন। ব্রেস্ট ক্যান্সার থেকে বাঁচতে আমাকে ব্লু-ফিল্ম দেখার পরামর্শ দিলেন। ব্যাপারটা বাসায় বলতে পারছিলাম না, কোনও বান্ধবীর সাথেও শেয়ার করতে পারছিলাম না। উনি আমাকে বললেন, এসব দেখলে নাকি শরীরের ভেতর থেকে কিছু হরমোন নিঃসৃত হয়, যার ফলে আর ব্রেস্ট ক্যান্সার হয় না। এটাই নাকি মেডিসিন। উনাকে খুব বিশ্বাস করতাম বলে আমি কাউকে না জানিয়ে উনার কথায় লুকিয়েলুকিয়ে ওসব দেখতে শুরু করলাম। আমার সাথে দেখা হলে উনি জিজ্ঞেস করতেন, আমি ওসব দেখছি কি না, দেখলে কেমন অনুভব করি, ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি কৌশলে এড়িয়ে যেতাম। উনার চেম্বারে গেলে প্রেশারমাপার ধরনে, বুকে আর পিঠে স্টেথোস্কোপ বসানোর কায়দায় টের পেতাম যে উনি আমার শরীরে হাত দেয়ার চেষ্টা করছেন। তবে উনাকে তেমন সন্দেহ করতাম না বলে কখনও কিছু মনে করিনি। একসময় উনি আমাকে বললেন, আমি যেন উনার চেম্বারে আসার সময় কোনও আন্ডারগার্মেন্টস না পড়ি, ওটা পড়লে হার্টবিটের সাউন্ড খুব আস্তে শোনা যায়, উনার সমস্যা হয়। সেই কথা মেনে পরেরবার ছোটবোনকে সাথে নিয়ে উনার চেম্বারে যাই। কিন্তু যখনই উনি হার্টের সাউন্ড মাপবেন, ঠিক সেসময় আমার ছোটবোনকে ওয়েটিং-রুমে অপেক্ষা করতে বললেন। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন যে বুকে ব্যথা হয় কি না, স্তনে কোনও গুটি আছে কি না। উত্তরে আমি ‘না’ বললে উনি বলেন, কী বল! মনে তো হয়, আছে। এটা থাকলে তো দ্রুত চিকিৎসা নিতে হবে! বলেই আমার বুকে হাত দিয়ে চেক করে দেখতে চাইলেন। আমি নিজেনিজে চেক করব বলে উনার হাত সরিয়ে অনেকটা দৌড়ে বাসায় চলে আসি। আমি উনার কাছে যেতাম মূলত অ্যালার্জির চিকিৎসা নিতে, কিন্তু উনার আগ্রহ অন্য দিকে দেখায় আর কখনও উনার কাছে যাইনি। পরবর্তীতে অনেকের কাছে শুনেছি, উনি এমন ব্যবহার করার কারণে অনেকেই উনার কাছ থেকে চিকিৎসা নেয়া বন্ধ করে দিয়েছে।

দুই।

আমি নিশু। আমার যখন ২১, তখন দাঁতের সমস্যার কারণে ৪-৫ দিন পরপর ডাক্তারের কাছে যেতে হত। এরপর ডাক্তার বলেছিলেন যে আমার দাঁতে রুটক্যানেল করে ক্যাপ বসাবেন, আমাকে সপ্তাহের সাতদিনই যেতে হবে। প্রথম দিন মায়ের সাথে গিয়েছিলাম। দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিন মা ব্যস্ত থাকায় ছোটবোনকে সাথে নিয়ে গিয়েছিলাম। দ্বিতীয় দিন ডাক্তার দাঁত দেখার ছলে আমার বুকের উপর রুমাল রেখে সেখানে হাত দিয়েছিলেন, আমি বুঝতে পারিনি তখন, পরে বুঝেছি ব্যাপারটা। তৃতীয় দিন একই কাজ করলে শিওর হয়ে যাই এবং বাসায় এসে মাকে বলি ব্যাপারটা। মা বললেন, ট্রিটমেন্ট তো মাঝপথে, এখন তো ডাক্তার চেঞ্জ করা যাবে না। এরপর বাকি প্রতিদিনই মা আমার সাথে গিয়ে ডাক্তারের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। সে ডাক্তার সদর হাসপাতালে চাকরি করতেন, বিসিএস ক্যাডার। আমাদের পাড়ার এক মেয়ের জন্য উনার বাসা থেকে প্রস্তাব পাঠানো হলে আমি নিজে গিয়ে সে মেয়েকে সব ঘটনা বলে দিই, এবং বিয়েটা আর হয়নি।

ভাবনা: তিনশো দশ।

……………………………………..

তখন আমরা বাড্ডায় এক ভাড়াবাসায় থাকতাম। চার তলায়। ওই বিল্ডিঙে এক বুড়ো কেয়ারটেকার ছিলেন। উনি যখনই কোনও কাজে আমাদের বাসায় আসতেন, আমাকে কাছে ডেকে জোর করে কোলে নিতেন। আম্মু তখন হয়ত উনার জন্য নাস্তা আনতে গেছে, কিংবা ভাড়ার টাকা আনতে ভেতরে গেছে! আমাকে কোলে বসিয়েই এটাওটা কথার ফাঁকে জাপটাজাপটি করতেন। বুকে, হিপে, ভ্যাজাইনায় সমানে টিপতেন, খামচাতেন। আমি তখন একেবারেই ছোট। শরীরে কোনও পরিবর্তনই আসেনি তখনও। কীরকম যে অস্বস্তি লাগতো, বলে বোঝানো যাবে না! উনার দাঁড়িওয়ালা মুখটা আমার গালের সাথে ঘষতেন। কী ঘিন্না! ভয়াবহ ব্যাপারটা তখন শুরু হল, যখন আমার স্কুল ডে-শিফটে গেলো! স্কুল থেকে সাড়ে তিনটার সময় বাসায় ফিরতাম! পুরো বিল্ডিং সুনসান! উনি সিঁড়িতে ঘাপলা মেরে বসে থাকতেন। আমি আসামাত্রই কাছে টেনে নিয়ে নোংরামি শুরু করতেন। “দাদুভাই, কাউরে কইয়েন না……..চুপ থাকেন………ভাল্লাগবো!” উনি লুঙ্গি পরতেন! আমি স্কুলে উঠে কেবল সালোয়ার-কামিজ পরতে শুরু করেছি! অন্ধকার সিঁড়িতে বেশি সুবিধা করতে পারতেন না! আমি একথা লজ্জায় কাউকে বলতেও পারতাম না! উনাকে দেখতাম আর অমনিই ভয়ে শিউরে উঠতাম! ঠিকমতো পড়াশোনাও করতে পারতাম না। ক্লাসটেস্টে প্রায়ই খারাপ করে আব্বুর ভয়াবহ বকার উপরই থাকতে হত! বাসায় থাকলে ফিতা ছাড়া প্যান্ট ভুলেও কখনও পরতাম না! আম্মু যখন ছাদে কাপড় তুলতে পাঠাতো, তখন অবস্থাটা আরও ভয়াবহ হত। উনি কীভাবে যেন টের পেয়ে যেতেন যে আমি ছাদে যাচ্ছি! ব্যস্‌, শুরু হত অত্যাচার!

শেষে নামাজপড়া শুরু করলাম! ফজরও বাদ দিতাম না! একসময় কী করলাম, স্কুল থেকে ফিরে বাসায় যেতাম না! সিঁড়িতে ব্যাগ রেখে কাছেই ছোট মাঠের ছাউনিতে চলে যেতাম! খুব ক্ষুধা লাগতো! এরপর তৃষ্ণা……..ফ্লাস্কের পানিও শেষ হয়ে যেত! কী যে কষ্ট হত! ক্লাবের ছেলেরা মাঠে ক্রিকেট খেলত! প্রচণ্ড গরমে ঘেমে বসেবসে ক্রিকেট দেখতাম! ক্রিকেটের অনেক কিছু শিখতাম! একসময় নেশা হয়ে গেল! কিন্তু নিয়মিত দেরি করে ফেরায় শুরু হল আম্মুর বকাঝকা! একবার স্কুল থেকে ফিরে খুব হিসু পেল! সাথে বড় বাথরুমও! বাসায় যেতেই হবে! কী করব আমি! বাধ্য হয়ে সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে উপরে উঠছি, আর অমনিই উনি এতদিন পর আমাকে পেয়ে যে-ই জাপটে ধরেছেন, তখনই আমি ছাড়াতে গিয়েই হিসু করে দিলাম! আমি কাঁদছি, গোঙাচ্ছি। দেখি, উনি দাঁত কেলিয়ে হাসছেন! ভেজা, নোংরা পায়জামা নিয়ে সিঁড়ি নষ্ট করে বাসায় ফিরলাম! আম্মুকে বললাম, আমার পেট খারাপ! বিল্ডিঙের সবাই এটা জেনে গেল, আর আমাকে নিয়ে সে কী টিটকারি! এত বড় মেয়ে……এই তুই নাকি! হাহাহাহা………এসবের পর আমি হঠাৎ খুব অসুস্থ হয়ে পড়ি। স্কুলে যেতাম না! যা-ই খাই, বমি করে দিই। ক্লাস সেভেনে কোনওভাবে পাস করলাম!

সবচেয়ে বীভৎস ঘটনাটি ঘটলো একদিন! সেদিন আমি………ক্ষমা করবেন, আমি সত্যিই সেদিনের ঘটনাটি লিখতে পারব না। আমি যে যৌন সহিংসতার বর্ণনা দিলাম, তার প্রতিটি বর্ণ সত্য, কিছুই আমার কল্পনাপ্রসূত নয়—কল্পনায় এতটা নিষ্ঠুর ও অবিবেচক হওয়া যায় না। এ লেখা কোনও ফিকশন নয়, এটা আমার জীবনেরই একটা অংশ। এটি কেন লিখলাম? যাতে আপনি আপনার কাছের শিশুটিকে এমন মানুষরূপী পশুদের হাত থেকে রক্ষা করতে পারেন। ওদের হাত থেকে আপনি নিজেও নিরাপদ নন। ওদের কাছে বয়স মুখ্য নয়, শরীরই মুখ্য।

তবে সৃষ্টিকর্তার উপর কখনওই কোনও ব্যাপারে আমার রাগ হয় না! ওই ঘটনাগুলোর জন্যও না! He does everything for a reason! ওই কেয়ারটেকার চাচার জন্যই আমার ক্রিকেটের প্রতি নেশা হয়েছে! সবচেয়ে ভাল লাগে রাস্তায় দাঁড়িয়ে গলির ক্রিকেট দেখতে! ছোটবেলার সময়টা মনে পড়ে। ওই ছোট্ট অসহায় মেয়েটির জন্য খুব কষ্ট হয়। সেসময় কখনও-কখনও লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করত। মরিনি তো! বেঁচেই আছি! মানুষ বেঁচে থাকে। একবুক কষ্টের স্মৃতি নিয়েও দিব্যি বেঁচে থাকে। তখন ভিলেন মনে হয় স্মৃতিকেই, সেই কষ্টের ঘটনাটিকে নয়।

ভাবনা: তিনশো এগারো।

……………………………………..

আমি এখন ক্লাস টেনে। জীবনে অনেকবার যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছি।

প্রথমবার নির্যাতিত হই ক্লাস ফোরে পড়ার সময়। আম্মু আমাকে এক মাদ্রাসায় পাঠান আরবি পড়তে। আমি সেখানে কুরআন শরীফ পড়তে যেতাম। প্রতিদিন সকালে ফজরের নামাজের পরপর পড়তে যেতাম। মাদ্রাসায় দুইজন হুজুর ছিলেন। সবাই উনাদের বড় হুজুর আর ছোট হুজুর বলে ডাকতো। বড় হুজুর আমাকে খুব আদর করতেন। ছোট হুজুরও আদর করতেন। আমি খুব মন দিয়ে পড়াশোনা করতাম। সব পড়া ঠিকমতো দিতে পারতাম। প্রতিদিনই ঠিকঠাক চলতাম। বড় হুজুরের কাছেই পড়া দিতাম সাধারণত। ছোট হুজুর এমনিতেই সবার দেখাশোনা করতেন, সবাই ঠিকমতো পড়ছে কি না, তদারকি করতেন। কখনও বড় হুজুর গ্রামে গেলে ছোট হুজুরের কাছে পড়া দিতে হতো।

একদিন বড় হুজুর গ্রামের বাড়িতে গেছেন। আমি সবসময় অনেক ভোরে উঠে সবার আগে মাদ্রাসায় যেতাম। গেইটটাও আমিই খুলতাম মসজিদ থেকে চাবি এনে। ওই দিনও সবার আগে গেলাম, কিন্তু সেই দিন ছোট হুজুর আমার হাতে চাবিটা দিলেন না। উনি নিজেই আমাকে নিয়ে মাদ্রাসায় গেলেন, গেইট খুলে দিলেন। আমি আর উনি এক সাথে ঢুকতে লাগলাম, হঠাৎ করেই উনি আমার কাঁধের উপর হাত রাখলেন। আমি চমকে গেলাম! তারপরই তিনি আমার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় হাত দিতে লাগলেন। আমাকে কাছে টেনে নিয়ে এক কোণায় বসিয়ে জড়িয়ে ধরে জাপটাজাপটি শুরু করলেন। আমি ভয়ে কিছু বলতে পারছিলাম। উনি আমাকে কয়েকবার করে বললেন, কাউকে কিছু বলবে না। বললে বেত দিয়ে পিটিয়ে পিঠের ছাল তুলে ফেলব আর এখান থেকে বের করে দেবো।

এর কিছুক্ষণ পরই আমার এক বান্ধবী আসল। উনি আমার শরীর থেকে হাত সরিয়ে নিলেন। আমি তখনও বুঝতে পারিনি, কেন উনি আমার সাথে এমন করছেন। বড় হুজুর সাতদিন গ্রামে ছিলেন, ওই সাতদিনই উনি আমার সাথে এমন করেছেন। আবার বিভিন্ন রকমের ভয় দেখাতেন যাতে কাউকেই এসব না বলি। আমি কাউকে ভয়ে কিছু বলতে পারতাম না, আবার এদিকে মাদ্রাসায় না গেলে আম্মু খুব বকত। বড় হুজুর খুব ভাল ছিলেন, কিন্তু ছোট হুজুর সুযোগ পেলেই আমার সাথে এমন করতেন।

একসময় আর সহ্য করতে না পেরে আম্মুকে বললাম, আমি আর যাব না আরবি পড়তে। আম্মুকে নানান কথা বলে অনেক কষ্টে রাজি করাই। এরপর আম্মু আমাদের বাসায়ই হুজুর রেখে দেয়। উনিও ঠিক তেমনটাই করতেন। কিন্তু আমি কাউকে কিছু বলতে পারতাম না। মনে করতাম, হয়তো আরবি পড়তে ভুল হচ্ছে, তাই উনি আমাকে শাস্তি দিচ্ছেন।

এভাবে কয়দিন গেল। তারপর বুঝলাম, না, কই, আম্মু তো আমাকে এভাবে কোনওদিন শাস্তি দেয়নি! হঠাৎ টিভিতে একটা প্রোগাম দেখি এমন কিছু বিষয়ের উপর। তারপরই বুঝলাম, উনি আমার সাথে অন্যায় করছেন। এরপর থেকে উনি আমাকে ধরতে গেলেই আমি জোর করে সরে যেতাম। একটুএকটু রাগ দেখাতাম উনার উপর।

আমি আবারও আম্মুকে বলি, আম্মু, এই হুজুরকে ভাল লাগে না। আমি উনার কাছে আর আরবি শিখব না। এসব শুনলে আম্মু আমাকে বকা দিত। আম্মু তো ভাবতো, আমি পড়া ফাঁকি দিতে চাই, তাই বানিয়ে-বানিয়ে আম্মুকে এসব বলছি। কিন্তু আমি আম্মুকে কিছুতেই বোঝাতে পারতাম না, হুজুর আমার সাথে কী আচরণ করেন! একদিন আমার শরীরে হাত দেয়ার সময় আম্মু একটু দেখে ফেলে। সেদিনই আম্মু উনাকে ওই দিনের পর থেকে আর আমাকে আরবি পড়াতে নিষেধ করে দেয়। কিন্তু আম্মুও এর কোনও প্রতিবাদ করতে পারেনি, কারণ এটা হলে নাকি সমাজ আমাকেই খারাপ বলবে।

ফোরে আমাকে অংক করানোর জন্য বাসায় একজন স্যার রাখা হয়। স্যার বেশ ভাল অংক বোঝাতেন। অংক করার ফাঁকে উনি প্রায়ই আমার শরীরে হাত দিতেন। টেবিলের নিচে উনার পা দিয়ে আমার পায়ে চিমটি কাটতেন। রাগ হতো খুব। এভাবে এক মাস সহ্য করলাম। উনার এসব দিনদিন বেড়েই যাচ্ছে দেখে একদিন আম্মুকে সব বললাম, কিন্তু আম্মু বিশ্বাস করল না। কারণ, আম্মুর সামনে স্যার অনেক ভাল ব্যবহার করতেন। আমাকে দেখিয়ে বলতেন, আমি নাকি দেখতে উনার বোনের মত। আমিই উনার আপন বোন! আম্মু আমার কথা না, উনার কথাই বিশ্বাস করতো। কিন্তু আমি এসব সহ্য করতে পারতাম না, আর মনে হত, স্যার বোধহয় আম্মুকে কোনও মন্ত্রবলে বশ করে রেখেছেন। একদিন জোর দিয়েই বললাম, এই স্যারের কাছে যদি পড়তেই হয়, তাহলে পড়াশোনাই ছেড়ে দেবো। আব্বুর কাছে সবকিছুই কোনও লজ্জা না পেয়ে খুলে বললাম। তারপর আব্বু উনাকে তাড়িয়ে দিল।

আম্মু আমাকে নিষেধ করে দিয়েছিল যাতে এসব কথা কোনও বান্ধবী বা এলাকার কাউকে না বলি। বললে নাকি আমি খারাপ হয়ে যাব সবার কাছে!

এইতো কালকের ঘটনা! মার্কেটে গেছি শপিং করতে। ফুটপাত দিয়ে হাঁটছি। হঠাৎ মধ্যবয়সি এক লোক আমাকে ধাক্কা দিলেন ইচ্ছে করেই। আম্মুও দেখেছিল যে উনি আমার শরীরে হাত দিয়েছেন। কিন্তু কিছুই বলেননি উনাকে এ ভয়ে যে, প্রতিবাদ করলে হয়তো আমাদের সমাজ আমাকেই দোষী করে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেবে! তাই নিশ্চুপ থেকেই আমরা দুইজন অতি দ্রুত সেই স্থান ত্যাগ করি। আমাদের এমন অসহায়ত্বে আমার চোখের কোণায় পানি এসে গিয়েছিল।

কী দোষ করেছি আমি যে ওই পুরুষ মানুষগুলো এমন করবে আমার সাথে? সমাজ বলে, পোশাকের কারণে নাকি মেয়েরা লাঞ্ছনার শিকার হচ্ছে! কিন্তু আমি তো বোরকা পরেই চলাফেরা করি, গতকালও আমার পোশাক ছিল বোরকা। কই? আমি তো পুরুষের হাত থেকে নিজেকে নিরাপদ রাখতে পারলাম না!

এই কথাগুলো কাউকেই বলা যায় না। কারও কাছে বললে হয়তো আমাকেই ফাঁসিকাষ্ঠে টেনে নিয়ে যাবে এই সমাজের মানুষ! কোথায় আমরা নিরাপদ? আমরা কি মানুষ না? আমাদের কি বাঁচার অধিকার নেই? কেন এ সমাজ আমাদের মানুষ না ভেবে মেয়েমানুষ করে রেখেছে? ভোগ করতে সুবিধে হওয়ার জন্য? কেন আমাদের ভয়ে কুঁচকে থাকতে হয়? কেন আমরা প্রতিবাদ করতে পারি না? আমার সত্যি হাত কাঁপছে। মেয়ে হিসেবে জন্ম নেয়ার জন্য নিজের উপরই রাগ আর ঘৃণা জন্মাচ্ছে। এমন কেন লাগছে, জানি না। আমাদের সমাজ থেকে সেদিনই এসব অপরাধ দূর হবে, যেদিন আমরা মন থেকে বিশ্বাস করতে পারব, মেয়ে আর ছেলে আলাদা কোনও সত্তা নয়। মেয়েদের মেয়ে নয়, মানুষ হিসেবে দেখার অভ্যেস গড়ে তুলতে হবে। মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গির উন্নয়ন ছাড়া এটি কখনওই সম্ভব নয়।

ভাবনা: তিনশো বারো।

……………………………………..

এক।

আমার এক ফুপা, আর এক দুলাভাই যে অতি জঘন্য মানুষ ছিলেন, এটা বুঝতে পারি বড় হওয়ার পর। ছোটবেলায় দেখতাম, যখন উনারা আমাদের এখানে বেড়াতে আসতেন, আমার চাচতো বোন, নিজের বোন, যারা তখন মাধ্যমিকে পড়ে, মানে সবেমাত্র কৈশোরে পা দিয়েছে, তাদের একটু বেশিই আদর করতেন, তারা কাছে না যেতে চাইলেও নানান অজুহাতে কাছে ডাকতেন। এক রকম জোর করেই কোলের উপর বসাতেন। পেছন থেকে দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে রাখতেন, যেন পড়ে না যায়—ভাবখানা এমনই করতেন! আসলে তো উনাদের মতলব ছিল খারাপ। একটু ছোঁয়া, শরীরের বিভিন্ন জায়গায় হাত দেয়া, এই টাইপের মতলব। যখন আপুরা বড় হয়ে গেল, ওদের ডাকলেও ওরা আর কাছে যেত না। আমরা আরও কয়েকজন ততদিনে একটু বড় হয়েছি। বেড়াতে আসলে এবার আমাদের কোলে ওঠানোর পালা। এভাবেই চলেছে। আবার উনাদের বাসায় বেড়াতে গেলেও একই অবস্থা!

এখন আমার মেয়ে হয়েছে। যদিও মেয়েটা অনেক ছোট, তবুও আমি ওকে উনাদের কারও কোলে যেতে দিই না। বলি, বাবুনি কোলে উঠতে পছন্দ করে না। আমি বড় হওয়ার পর আমার মা-বোনের সাথেও বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করেছি, কিন্তু কী আর করা! আর যে দুলাভাইয়ের কথা লিখেছিলাম, উনি এমন যে, শালীদের ডেকে বলতেন, আসো, সবাই মিলে শুয়েশুয়ে গল্প করি। আর সেই ফাঁকে বিভিন্ন ছুতোয় শরীরের নানান জায়গায় ছোঁয়া, আর একটু সুযোগ পেলেই চুমু দেয়া, ইত্যাদি চলত।

এমন ঘটনা আমাদের সমাজে অহরহই ঘটছে। কেউ মুখ খোলে না সাহস করে। যে মেয়েরা এসবের প্রতিবাদ করে, ওরা মোট নির্যাতিতার শতকরা ১ ভাগও নয়। আমাদের বাবা, ভাই, পতিদেবই এসব বিকৃত কামনার মানুষদের মধ্যে আছেন। আমার মেয়েকে এখন থেকে শেখাই, শরীরের এই জায়গাগুলোতে কাউকে হাত দিতে দেবে না, কারও কোলে বসবে না, কথা বলতে হলে একটু দূরে সরে পাশে বসে কথা বলবে। কেউ কিছু করতে জোর করলে, তোমার গায়ে হাত দিলে, সাথেসাথেই আমাকে বলবে। মামণিকে সব কিছু বলতে হয়। ভাল করে গুছিয়ে লিখতে পারছি না। এসব সহ্য করা এতো সহজ নয়। লিখতে গিয়ে বারবার চোখ ভিজে যাচ্ছে। আসলে এইসব বিষয়ে মেয়েরা খুবই অসহায়।

আমার এক বান্ধবী ওর জীবনে এ পর্যন্ত ছয়বার রেইপড হয়েছে। পশুগুলোর চারজনই ওর রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়। এসব ভাবলে বেদনায় মনটা নীল হয়ে যায়।

দুই।

আমার জীবনে খুবই মর্মান্তিক একটা ঘটনা ঘটে ২০১৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর।

ছেলেটা সৌদি আরবে থাকে, ক্লাস এইট পাস। আর আমি ইংলিশে বিএ অনার্স ও মাস্টার্স কমপ্লিট করেছি। আমি তখন বাসায় গিয়ে টিউশনি করি। ওই ছেলের ভাগ্নি আমার প্রতিবেশী, আমার কাছে প্রাইভেট পড়তো। ওই ছেলে বিয়ে করবে বলে পাত্রী খুঁজছিল। কীভাবে যেন আমার কথা জানতে পারে! ওর ভাগ্নির সাথে আমার বাসায় একদিন হুট করে বেড়াতে আসে। ওই ছেলে সেদিনই আমাকে প্রথম দেখে, এবং পরবর্তীতে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। আমি ও আমার পরিবার কেউই রাজি হইনি, কারন ওর শিক্ষাগত যোগ্যতা ও ফিজিক্যাল ফিটনেস, কোনওটাই আমার সাথে মানানসই ছিল না। আর এদিকে আমার বাবার স্বপ্ন ছিল, আমাকে এমএ পাস করাবে, তারপর বিয়ে দেবে। কিন্তু সেই ছেলে ছিল নাছোড়বান্দা, সে আমাকে বিয়ে করবেই! ও আমাকে বিভিন্নভাবে টাকাপয়সা ও গহনার লোভ দেখাতো, তারপরও আমি রাজি হইনি। এরপর শুরু হলো ফোনে উত্যক্ত করা। ওর ভাগ্নির কাছ থেকে আমার নাম্বার নিয়ে আমাকে প্রতিদিন উত্যক্ত করতো আর ভয় দেখাতো যে আমাকে তুলে নিয়ে যাবে। আমি ওকে সুন্দরভাবে ভদ্র ভাষায় বোঝাতাম যে আমার বয়ফ্রেন্ড আছে, তার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। ও বলতো, যেখানেই আমার বিয়ে হোক না কেন, ও আমাকে তুলে নিয়ে আসবে।

এরপর এলো সেই ভয়াল দিনটি। ও হঠাৎ একদিন লোকজন নিয়ে এসে আমার বাড়িতে হামলা করে। আমার মা ও বোনকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে আমাকে তুলে নিয়ে যায়। সেদিন আমার আশেপাশে আত্মীয়স্বজন কেউ ছিল না, আর আমার বাড়িটাও বেশ ফাঁকা জায়গায়। প্রায় দশ কিলোমিটার যাওয়ার পর আমার চিৎকার চেঁচামেচিতে লোক জানাজানি হয়ে গেলে সবাই মিলে গাড়িটা আটকায় আর আমাকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করে। আল্লাহ্‌র অশেষ রহমতে আমি সসম্মানে বেঁচে ফিরে আসি। এরপর আমি থানায় গিয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মামলা করি। তারপরও সে আমার পিছু ছাড়েনি। ফেসবুকে, ইমোতে আমাকে মেসেজে পাঠিয়ে বিভিন্নভাবে শাসায়, আমাকে ও আমার ছোটভাইকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। আমি এলাকার বড়ভাইদের বিষয়টা জানাই, কিন্তু তারা কোনও সমাধান দিতে পারে না, সবাই যার-যার রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করতেই ব্যস্ত। অবশেষে আমি এএসপি এবং ওসি স্যারকে অবগত করি বিষয়টা। উনারা ওই ছেলের বোন ও বোনজামাইকে ডেকে আনান আর বলে দেন, যাতে উনারা ওই ছেলেকে সতর্ক করে দেয়।

বর্তমানে ওই ছেলে সৌদিতেই আছে। তবে ওর মনে এখনও আমার অনিষ্ট করার চিন্তা আছে, আমি নিশ্চিত। ও ভবিষ্যতে আমার ক্ষতি করতে পারে বলে আমার ধারণা। আমি এখনও পথেঘাটে নিরাপদ না। ওর লোকজন সারাক্ষণই আমাকে নজরদারিতে রাখে। সবচাইতে কষ্টের ব্যাপার যেটা, সেটা হল, এ ঘটনার পর থেকে আমিই খারাপ হয়ে গেছি সবার কাছে। সবাই আমার দিকেই আঙুল তুলে কথা বলে, এই ঘটনার জন্য আমাকেই দায়ী করে।

কেমন একটা কপট সমাজে মেয়েদের বাঁচতে হয়!

ভাবনা: তিনশো তেরো।

……………………………………..

আমি আমার জীবনের কিছু দুর্বিষহ ঘটনার কথা বলছি।

তখন আমি সম্ভবত ক্লাস থ্রি কি ফোরে, যখন আমাকে জীবনে প্রথম খুব খারাপ কিছুর সম্মুখীন হতে হয়েছে। আমার বাড়ির পাশের এক লোক, যিনি সম্পর্কে আমার কাকা হন, তিনি একদিন আমাকে ডেকে উনার বাসায় নিয়ে আমার গলায় ছুরি ধরে ভয় দেখিয়ে আমাকে রেপ করেন। এরপর উনি আবারও আমাকে ভয় দেখিয়ে আরও কয়েকদিন এটা করেছেন। প্রিয় পাঠক, বিশ্বাস করুন, আমি যখন এটা লিখছি, আমার সারাশরীর কাঁপছে, নিজের প্রতি নিজেরই চরম ঘৃণা হচ্ছে। তবু লিখতে হবে। কিছু কথা লিখতে হয় যাতে পরবর্তীতে আর কাউকে তা লিখতে না হয়।

এরপর যে ছেলে আমার সাথে ওই ঘৃণিত কাজটি করেছে, সে আমারই আপন ফুফাতো ভাই। আমাকে ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে ভয় দেখিয়ে এটা করেছে। এরপর আরও দুইজনের কাছে আমি এরকম হ্যারাসমেন্টের শিকার হয়েছি। আমার এক খালাতো ভাই আমাকে খুব পছন্দ করতো, একই সাথে আমার এলাকার একজনও আমাকে খুব পছন্দ করতো, কিন্তু এদের কাউকেই আমার ভাল লাগতো না। দুর্ভাগ্যবশত এলাকার ওই ছেলের সাথে আমি কথা বলতে শুরু করি, তখন মনে হয়, আমি সেভেনে। আমার এক কাকি আমার ব্রেইনওয়াশ করে আমাকে তার সাথে কথা বলতে রাজি করায়। এটা নিয়ে আবার আমার ওই ফুফাতো ভাই বাসায় অনেক ঝামেলা করে, কারণ সেও আমাকে পছন্দ করতো। আমার জীবনে এই সময়গুলো খুব খারাপ গেছে। খুব খারাপ! কেউ কল্পনাও করতে পারবে না, আমি যে কী মানসিক অবস্থার মধ্য দিয়ে গেছি! বাড়ির কেউ আমার সাথে কথা বলতো না, খুব খারাপ ব্যবহার করতো, বাড়ি থেকে এক পা’ও বের হতে দিতো না, আরও অনেক মানসিক নির্যাতন করতো। আমার পড়ালেখা তো প্রায় বন্ধই করে দিয়েছিল! আমি তখন সবেমাত্র ক্লাস সেভেনে! ভাবা যায়! আমি অন্য বাচ্চাদের মত অতটা অগ্রসরও ছিলাম না। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আগেই এইসব কিছু একের পর এক হচ্ছিল আমার সাথে।

যখন এরকম খারাপ সময় যাচ্ছে, তখন সেই খালাতো ভাইয়ের সাথে কথা হত। সে আমার ফুপিকে ফোন করে আমাকে চাইতো, আর খুব ইমোশনালি কথা বলতো। কত দিন কথা বলতাম, আবার কথাবলা বাদ দিতাম। আমার ভাল লাগতো না ওর সাথে কথা বলতে। যা-ই হোক, এভাবে একবার কথাবলা বাদ দেয়ার অনেকদিন পর আবারও ওর সাথে কথা বলি। ওকে ভালো মনে হয় বাসতাম না, কিন্তু ওই মুহূর্তে আমার মেন্টাল সাপোর্টের খুব দরকার ছিল। তাই ওর সাথে কথা বলতাম। যা-ই হোক, তার সাথে যখন কথাবলা শুরু করলাম, তখন বোধহয় আমি ক্লাস নাইনে। ওইসময় আমার নানুবাড়ির এক প্রোগ্রামে সে আমাকে অনেক রাতে দেখা করতে বলে, আমিও রাজি হই। এরপর সে আমাকে বাড়ির পেছনে এক জায়গায় নিয়ে আমার প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও আমার সাথে জোর করে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন করে। আমার ছবি তুলে রাখে এবং বলে, আমি কাউকে কিছু বললে ও ছবিগুলো ফাঁস করে দেবে। এরপর সে ছবিগুলো ফাঁস করার ভয় দেখিয়ে মাঝেমাঝেই ওরকম করতো। প্রচণ্ড ভয়ে ওকে কিছু বলতে পারতাম না। ওকে আমার বাসার কেও পছন্দ করতো না। ও যদি আমার বাসার কাউকে ওই ছবিগুলো দেখায়, ওরা তো আমাকে মেরেই ফেলবে! সে ভয়ে আমি ওকে কিছু বলতাম না।

এ রকম বাজে পরিস্থিতির মধ্যে চলতে-চলতে একসময় আমার এইচএসসি একজাম চলে আসে। আমার একটুও ভাল লাগতো না কোনও কিছু। সে মানুষ হিসেবে খুব একটা খারাপ ছিল না, কিন্তু সে ছিল প্রচণ্ড মাত্রায় যৌন প্রবৃত্তিতাড়িত। আর আমি তো তখন কিচ্ছু বুঝি না টাইপের ছিলাম, সে আমাকে যেদিকে চালায়, আমি সেদিকে চলি। ওর কাজগুলি আমি পছন্দ করতাম না, কিন্তু ওকে খারাপও লাগত না অতটা। আমার এখন এসে মনে হয়, আমার মধ্যে হয়তো সেসময় কিছুটা স্টকহোম সিনড্রোম ডেভেলাপ করেছিল।

জীবনের চরম ভুলটা করি এরপর। যখন এরকম অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে আছি, এইচএসসি’র প্র্যাক্টিক্যাল একজামের সময় আমার কলেজের এক ছেলের সাথে পরিচয় হয়। সে খুব ভাল ছিল। ওর সাথে কথা বলতে থাকি, রাতেই বেশি কথা বলতাম আমরা। ওর সাথে কথা বলার পর অনেক শান্তি লাগতো, মনে হতো, এই ছেলেটাই আমার জন্য পারফেক্ট! সে একেবারেই আমার মনের মত। কথা বলতে-বলতে কখন যে ওর প্রেমে পড়ে যাই, তা নিজেও বলতে পারি না! ওর মধ্যে অদ্ভুত এক মোহনীয় শক্তি ছিল। ওর সাথে কথা বললে আমার পাগল-পাগল লাগত। আর সব থেকে বড় কথা হচ্ছে, ও আমার মত খুব রবীন্দ্রভক্ত ছিল। এইভাবে চলতে-চলতে আমাদের এইচএসসি একজাম শেষ হয়ে গেল। কোচিং করার জন্য ঢাকায় গেলাম। যেদিন ও বাসা থেকে ঢাকায় গেল, সেদিন আমি ওকে ভালোবাসি বলেছিলাম। সেও আমাকে বলে, ভালোবাসি। এইভাবে ভালই চলছিল সবকিছু। ওর কাছে একটু শান্তি খুঁজে পেয়েছিলাম।

এরপর আসলো আরেক ঝড়। এইচএসসি-এর রেজাল্ট বের হল, কেমিস্ট্রিতে ফেইল করলাম। উঃ! কী যে সময়! আমি তখন ঢাকায় কোচিং করছি। আমাদের কোচিং-এর ১৭ জন স্টুডেন্ট এরকম রেজাল্ট খারাপ করে, যাদের সবাই এসএসসি’তে এপ্লাস পেয়েছিল। এইচএসসি’তে ওরা অন্যান্য বিষয়গুলোতে এপ্লাস পেয়েছে, শুধু কেমিস্ট্রিতে ফেল।

আমি পাগলের মত হয়ে গিয়েছিলাম। আব্বু কথা বলতো না, আম্মু কান্না করতো সবসময়, আশেপাশের লোকজন নানান কথা বলতো, আর আমি তো আমিই! সারাদিনই কান্না করতাম, অনেক ভেঙে পড়েছিলাম, অনেক! সেই সময়ে ওই ছেলে আমাকে মেন্টালি অনেক সাপোর্ট দিয়েছে। সম্ভবত ওর জন্যই আমি টিকে ছিলাম। খুব ভালোবাসতাম ওকে, খালাতো ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করতাম না, আর শুধু আল্লাহ্‌কে ডাকতাম। আমি জানতাম, আমি অনেক বড় একটা ভুল করে ফেলেছি, এর শাস্তি তো আমাকে পেতেই হবে। আল্লাহ্‌কে বলতাম, উনি যেন ওকে আমার কাছে থেকে কখনও আলাদা না করে। ওকে আমি পাগলের মতো ভালোবাসতাম। ও ছিল আমার সব, একদম সব! ও আমার মধ্যে অনেক পরিবর্তনও এনে দিয়েছিল, অদ্ভুত সুন্দর একটা রিলেশন ছিল আমাদের। বিশ্বাস, আস্থা, ভরসা, যা-ই বলি না কেন, সবই ছিল অটুট! ওকে আমি আমার মা-বাবার সমতুল্য মনে করতাম। এ সম্মান ও নিজেই ওর কাজের মাধ্যমে আমার কাছ থেকে অর্জন করেছিল। আমি এটা বিশ্বাস করতাম যে, পৃথিবীতে অন্য সবাই আমাকে ভুল বুঝলেও, ছেড়ে গেলেও……মা, বাবা আর সে, এই তিনজন মানুষ কোনওদিনই আমাকে ছেড়ে যাবে না। আমি বলে বোঝাতে পারবো না, ও যে আমার কাছে কী ছিল! আমার ফেসবুক পাসওয়ার্ডও জানতো সে। কারণ, আমার মনে হতো, আমার জীবনে এমন কিছুই নেই, যেখানে ও থাকতে পারবে না। আমার পেছনের ঘটনাগুলো নিয়ে আমি সবসময়ই ভয়ে থাকতাম। খুব ভয়ে থাকতাম—ওকে হারানোর ভয়। আমার কর্মফলের ভয় আমাকে সারাক্ষণই তাড়িয়ে বেড়াত। ও আমার জীবনে আসার পর আমি অনেক বদলে গিয়েছিলাম। আমি সেসময় আমার জীবনের তিনজন পুরুষ—আমার আব্বু, আমার ভাইয়া, আর সে—এর বাইরে আর কোনও পুরুষের সাথে খুব দরকার ছাড়া কখনও কথা বলতাম না। আর মনে হয়, সেও আমাকে খুব ভালোবাসতো। অনেক করেছে সে আমার জন্য। অনেক!

সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল। আমি দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দেয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত, এমন সময়ে হঠাৎ কোনও কারণ ছাড়াই সে আমার সাথে একদিন কথাবলা বন্ধ করে দেয়। এরপর আমি পাগলের মত হয়ে যাই। এখনও ওরকমই আছি। আমার সবই অন্ধকার লাগে। জীবনের আর কোনও মানেই নেই আমার কাছে। আমার সব শেষ। আমি কাউকেই দোষ দিই না, সব দোষ আমার। আমি বিশ্বাস করি, আমি যেটাকে সবচাইতে বেশি ভয় করতাম—আমার কর্মফল, সেটাই আমি এখন পাচ্ছি। বাকিটা জীবন এই কর্মফল ভোগ করতে-করতেই কাটবে।

এটা সত্যি যে আমি আমার অতীতের অনেককিছুই ওকে কখনও বলিনি। অনেকবারই বলতে চেয়েছি, কিন্তু পারিনি। পারিনি ভয়ে—ওকে হারানোর ভয়ে। ও দুঃখ পাবে, এই ভয়ে। যদিও বলা উচিৎ ছিল, তবু বলতে পারিনি। তবে ওকে বলতাম সবই………হয়তো আরও কিছুদিন পর, এমনটাই ভেবে রেখেছিলাম। অনেক চেষ্টা করে প্রায় মাস দুয়েক পরে ওর সাথে যোগাযোগ করতে সমর্থ হই। ও আমাকে বলে, তুমি আমার আগে, তোমার কতটুকু কাকে, কেমন করে, কী দিয়েছ, সবই জানতে পেরেছি আমি। তোমার সাথে থাকা আর সম্ভব না। ও চাইতো, আমি ওর কাছে একদম স্বচ্ছ থাকি। আমি ওকে সবই বলেছিলাম, শুধু কিছু অংশ বাদে। ওই যে বললাম, হারিয়ে ফেলার ভয়, সে ভয়েই বলিনি। মানছি, দোষটা আমারই। হয়তোবা ওকে সবকিছু খুলে বললেই ভাল হতো, কিন্তু বলার সাহসটা কখনও হয়ে ওঠেনি।

এখন আমার জীবনের সব সময়ই কঠিন সময়, খারাপ সময়। সামনে অনার্স ফাইনাল ইয়ারের একজাম শুরু হবে। কিছুই পড়িনি। কীভাবে যে পরীক্ষা দেবো, তা-ই জানি না। যার জীবনই কাটছে না, তার আবার পরীক্ষা কীসের!

আমাদের রিলেশনটা ছিল ৩ বছরের। খুব খারাপ লাগছে এটা বলতে, খুব নিচু মনে হচ্ছে নিজেকে, তবুও বলছি, হুম্‌ আমি জানি, আর মানিও, দুনিয়ার সব থেকে খারাপ মেয়ে আমি এখন, সবাই আমাকে তা-ই ভাবে, আমার আর উচিৎ নয় সত্য বলা, তবুও বলছি, ওর সাথে আমার শারিরীক সম্পর্ক ছিল। আমি তো কখনওই ভাবিনি, ও আমাকে এভাবে করে ছেড়ে চলে যাবে! অত্যধিক বিশ্বাস করতাম যে!

আমি আগে জ্যোৎস্না খুব পছন্দ করতাম, বৃষ্টি পছন্দ করতাম। এখন বৃষ্টি নামলে জানালাদরোজা বন্ধ করে রাখি। আমার ঘরে চাঁদ এলে নিজেকে চট্‌ করে লুকিয়ে ফেলি, আলো আর ভাল লাগে না, শুধু অন্ধকারে বসে থাকি, কিছুই দেখি না আর, কোনও গান শুনি না, মুভি দেখি না, শুধু বই পড়ি। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সারাজীবন একাই থাকব। আর কোনও পুরুষ আমার জীবনে আসুক, এটা একদমই চাই না আমি। একদম না!

ভাবনা: তিনশো চৌদ্দ।

……………………………………..

আমি আমার এক বন্ধুকে ভীষণ ভালোবাসি। আমাদের পরিচয় প্রায় ৪ বছর ধরে। আমাদের মধ্যে যা আছে, তা হল বন্ধুত্ব, কিন্তু এর চেয়ে বেশি। সে আসলে কখনও আমাদের সম্পর্কের কোনও নাম দিতে চায়নি। তবু ওকে আমি ভালোবাসি। আমি ভীষণ অভ্যস্ত হয়ে গেছি ওর মধ্যে। ওকে ছাড়া মরে যাবো। কোনওমতেই ওকে ভুলতে পারি না। আমার জীবনে ও একবার আসে, আবার চলে যায়। শুরুতে আমি ওকে নিয়ে এতটা ভাবিনি। কিন্তু ও আমাকে স্বপ্ন দেখিয়েছে, তাই পরে ভেবেছি। আমি ওকে বলিনি যে আমাকে ওর ভালোবাসতে হবে। শুধু বলেছিলাম কখনও যেন ও আমায় ছেড়ে না যায়। যদি ছেড়ে যাওয়ার ইচ্ছেই থাকে, তাহলে ও এমন কেন করল?

আমার আর সহ্য হচ্ছে না। আমি এখানে স্থির হয়ে গেছি। নিজেকে গুছিয়ে নেবার চেষ্টা করতাম, যদি না নিজেকে ওর কাছে বিলিয়ে না দিতাম। ওকে ভীষণ ভালোবাসি। কিন্তু ওর এমন অবহেলা আর সহ্য হচ্ছে না আমার। আমি তো একাই থাকবো আজীবন! কিন্তু ওকে শেষবারের মত একটা মেসেজ দিতে চাই। আমি কিছু ভাবতে পারছি না। কোনও কিছু ভাবতেও কষ্ট হচ্ছে। আমি ওকে কী লিখে পাঠাবো? আমি আর কী-ই বা করতে পারি?

মাঝেমাঝে আমি রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাঁটতে থাকি, কিন্তু মরি না……..একেবারে আমার সামনে এসেও ট্রাক ব্রেক চেপে ফেলে! কিন্তু কেন এমন হচ্ছে?

আমাদের মধ্যে কোনও শারীরিক সম্পর্ক হয়নি কখনও। তবে ও আমাকে বলত আমার নগ্ন ছবি তুলে ওকে পাঠাতে। আমি ভাবতাম, হয়তো ও আমাকে পরীক্ষা করছে। বলতাম, আমরা তো শুধু বন্ধু, তাহলে কেন? ও বলত, হ্যাঁ, আমি এরকম খারাপ। গত সেপ্টেম্বরে ও আমাকে বলেছিল যে ও আমার সাথে দেখা করতে আসবে। আর আসলেই আমাকে ওর সাথে ঘনিষ্ঠ হতে হবে। আমি রাজি হয়েছিলাম। খুব বিশ্বাস করতাম ওকে। আমার বিশ্বাস ছিল, সে আমার অমর্যাদা করবে না। এরপর কয়েকবার আমাদের সেক্সুয়াল চ্যাটও হয়েছিল। ফোনে ওরকম কথাও হয়েছিল। ওসব আমি কখনও করতে চাইনি, ওর জোরাজুরিতেই করেছিলাম। কারণ, আমরা তো শুধুই বন্ধু, যদিও আমি ওকে অনেক ভালোবাসি। এরপর ও বলেছিল, আমি সেদিনই তোমার হাতটা ধরবো, যেদিন আমি নিশ্চিত হবো, ওই হাত আর কখনও ছাড়তে হবে না। ওর এই কথাটা শুনে আমি ওকে আমার অমন পিক দিয়েছিলাম। তখন সম্পর্কটা অনেক সুন্দর ছিল।

হঠাৎ একদিন ও জিজ্ঞেস করল, কখন তোমার বিয়ে হবে? আমি উত্তরে বলেছি, তোমার কি মনে হয়, তুমি আমাকে স্পর্শ করলে আর কাউকে আমি বিয়ে করব? এরপর থেকে ওর কী যেন হয়ে যায়! দেশের বাইরে যাবে বলে কন্টাক্ট অফ করতে চাইলো, কিন্তু ফেইক অ্যাকাউন্ট থেকে নক দিত। যখন তা জানলাম, সেটা থেকেও আমাকে ব্লক করে দিল। পরে আমি অনেক কান্নাকাটি করলে আবার কিছুদিন কথা হল। আবারও ব্লকড্‌। আবারও আসে, চলেও যায়। ৪ মাস কথা বন্ধ রেখে হঠাৎ একদিন কল দিলো। সে আবারও পিক চেয়েছিল। আমি দিলাম। আমি ওর সব কথা রাখি। হ্যাঁ, আমি দিয়েছি। ও যা চায়, আমি তা-ই দিয়ে দিই। ওর তো উচিত, আমাকে ওর উপর এতটা অভ্যস্ত করে ফেলার পর আমার পাশে থাকা। অ্যাট লিস্ট সে একটা সরি তো বলতে পারে। হ্যাঁ, একবার সরি বলেছিল। যখন বলেছি, আগে কেন ভাবোনি? কেন এমন করে এলে? কেনই বা চলে যাচ্ছ? তখন সে বলল, তো কী হয়েছে? নাউ হোয়াট?

আমি সব ভুলে আবারও শুধু বন্ধু হয়ে থাকতে চেয়েছি। ওকে ছাড়া দম বন্ধ হয়ে আসে। তবু ও চলে যায়। আমাকে না বলেই চলে যায়। ওর বউকে নিয়ে কী করবে, ওর ছেলেমেয়ে কেমন হবে, এসব আমাকে বলতে আসে। বলে, বন্ধুকে তো এসব বলাই যায়। কষ্ট হলেও আমি সহ্য করি। কিছু বললে যে স্বার্থপর ভাববে! ওকে ছাড়া থাকতে পারছি না। আবার ওর এমন আসাযাওয়া আর অবহেলাও সহ্য হচ্ছে না।

ও সবকিছুই অস্বীকার করে। কাল তো আমার এক বান্ধবীকে বলল, যূথী বন্ধু হিসেবে আজীবনই থাকবে।……ও আমাকে বন্ধু হিসেবেই বেশি প্রাধান্য দেয়। যখন আমার ফ্রেন্ড ওকে লিখল, যূথী তো সারাক্ষণই আপনার কথা বলে! ও বলল, যূথী কেন আমার কথা বলে, বুঝলাম না!……তাহলে কি আমি ওর কাছে শুধু একটা খারাপ মেয়ের মত? ওর ৫টা নাম্বার অফ করে দিয়েছে। আমাকে বন্ধ সিম অন করে কল করেছিল। মানে, ও আমাকে ওর প্রতি অভ্যস্ত করে ফেলে নিজেই আবার আমার সব অস্তিত্ব শেষ করে দিয়ে নতুন শুরু করতে চায়। ভাল। খুব ভাল! করুক, যা ইচ্ছে করুক!…….ও সুখী হোক। কিন্তু আমার সাথে কন্টাক্ট রেখেও তো ও সুখী হতে পারে………এভাবে চলে যাওয়া কি খুব জরুরী?

আমি আম্মুর আদর্শ ভেঙেছি। আম্মু আমাকে জিজ্ঞেস করে আমার কী হয়েছে। আম্মুকে কিছুই বলতে পারি না। আমি কাউকেই কিছু বলতে পারি না। কী-ই বা বলব? ভুল করে ফেলেছি, আর আমাকেই ভুগতে হবে আজীবন। ভুলের মাশুল কড়ায়গণ্ডায় বুঝিয়ে দেয়ার আগ পর্যন্ত আমার কোনও ছাড় নেই। গত সেপ্টেম্বরে কয়েকবার সুইসাইড করতেও চেয়েছি। আজও করতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু আপনার পোস্টটা চোখে পড়ল।

সে আইডি অন করেছে। কী করব আমি? একটা আলাদিনের চেরাগ পেলে ওকে ওখানে আটকে রাখতাম। আসলে আমারই দোষ সব। আমি কি ওকে বিদায় বলব? ওটা করতে কষ্ট হবে। ওকে ধরে রাখতে পারি না, আবার ছেড়ে দিতেও পারি না। জানি, সে আমার নয়, তবু ওকে আমার ভেবেই বেঁচে আছি। কী মানে এর? কিছু কি বলব ওকে, যদিও………নাকি এমনটাই চুপ থাকবো আর দেখব……সে আর কী করে! নাকি ওকে কিছু বলব না? না, থাক্‌! কিছুই বলব না ওকে। আমি যেমনই থাকি, ও ভাল থাক। ওকে বেশি কিছু বললে পরে আমার নিজেরই ভীষণ খারাপ লাগে।

অনেক ভেবেছি……আমি তো ওকে ভালোবাসি, তাহলে আমার মনের মধ্যে এত ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে কেন? আসলে নিজের উপরই রাগ হচ্ছে। ওকে কিছু বলে আমিও শান্তি পাবো না। আমি এই ব্যাপারটাকে এতো বড় করে দেখছি কেন? এতো ভাববার কী আছে? হয়তোবা ওর আচরণ আমার একটু সেল্ফ-রেসপেক্টে লেগেছে, তাই মাঝেমাঝে মনটাকে একটু ভাবাই।

আমি আসলে স্বার্থপর হয়ে গেছি। আমি ওর সেই সমস্যাটাই বুঝতে চাইছি না, যেটা ও আমাকে বলছে না। ও কেন আমার মত বানাবে নিজেকে? ওকে তো ওর লাইফ গুছাতে হবে, তাই না? ওকে বিরক্ত করার আমি কে?

আমি আর সুইসাইড করতে চাইবো না। থাক ও ওর মত করে! ও আমার জীবনে না থাকলেও তো আমি ওকে ভুলে যাবো না কখনওই। সবসময় ওকে মনে রাখবো। আর এরকমই থাকবো।

এখন থেকে আমি মন দিয়ে পড়াশোনা করব। যেদিন অনেক বড় অফিসার হয়ে যাবো, সেদিন ওকে সারপ্রাইজ দেবো। ও যেখানেই থাকুক না কেন, খুঁজে বের করবই ওকে! হয়তো সেদিন ওর সাথে ওর বউ আর ছেলেমেয়ে থাকবে। ওর বউয়ের প্রতি হিংসা হলেও পিচ্চিগুলোর প্রতি হবে না। ওদের চকোলেট কিনে দেবো আর কোলে নিয়ে অনেক আদর করব।

সেকেন্ডের ব্যবধানেও অনেক কিছু বদলে যায়………আমি কেন সব আশাই হারিয়ে ফেলছি?

অনেকদিন নিজের মধ্যে সব পুষে রেখে সবকিছুই খুব পাগলপাগল লাগছিল। আর আজকে একটু বেশিই লাগছিল। লিখতে পেরে নিজেকে পালকের মত হাল্কা লাগছে। মনে হচ্ছে, নিমিষেই উড়ে যেতে পারব। সাদা পৃষ্ঠাও কেমন বাঁচিয়ে দেয়! ভীষণ ভাল লাগছে এখন। যাই, ঘুমুবো……..

ভাল কথা। আমার তিনটা নিয়ম আছে। এই নিয়মগুলি ওর আর আমার, মানে আমাদের বানানো। এক। ওকে ছাড়া আর কাউকে আমি কখনওই মেসেজে পিক দিই না। দুই। আর কাউকে সকালে আর রাতে শুভ সকাল আর শুভ রাত্রি বলি না। তিন। বিশেষ দিনে ওর আগে কেউ উইশ করলে ওকে আমি ব্লক করে দিই। (তাই সে ভয়ে আগেভাগেই উইশ করে ফেলত।)

আসলে অনেক ভাল ও। দোষ আমারও ছিল।

এবার সত্যিই ঘুম পাচ্ছে। পৃথিবীর সবাই ভাল থাকুক।

ভাবনা: তিনশো পনেরো।

……………………………………..

আপনার লেখা পড়ার পর অনেকসময় খুব উৎসাহ এবং জেদ কাজ করে, আবার অনেক সময় নিজেকে এই দুনিয়ার সব থেকে অকর্মা এবং আশাহত মনে হয়। তারপরও আমি আপনার লেখাগুলো পড়ি বেশ আগ্রহ নিয়েই। যদি আপনার মত মানুষের সংস্পর্শে এসে জীবনে ভাল কিছু শিখতে পারি, সেটাই তো অনেক!

কিন্তু আমার জীবনটা যেভাবে চলছে, এইভাবে আর কত দিন চলবে, যখন এটা ভাবি, তখন আপনার উপরও আমার অনেক হিংসা হয়, সত্যি! নিজেকে তো কিছুই দিতে পারিনি কোনওদিনই, উল্টো বাবা-মা’কে সবসময় কষ্ট দিয়ে চলেছি। আমি আমার কথাগুলো আজ পর্যন্ত কারো সাথে শেয়ার করতে পারিনি, এমনকি আমার সবচাইতে প্রিয় বন্ধু আমার মাকেও বলিনি। আমি জানি না, আপনি আমার এই লেখাটা আদৌ পড়বেন কি না। তারপরও আজকে অনেকটা বাধ্য হয়েই আমি আপনাকে বলবই আমার না-বলা কথা! তবে একটাই অনুরোধ, আমার কথাগুলি আপনার মধ্যেই রাখবেন।

পরিবারে ছোট থেকেই মা-বাবা’কে চাকরি করতে দেখেদেখে বড় হয়েছি। খুব বেশি সময় পাইনি মা-বাবা’র কাছে থেকে, যে কারণে অনেক কিছু থেকেই বঞ্চিত হয়েছি, যেটা বড় হয়ে বুঝতে পেরেছি। তারপরও আমি এই ব্যাপারটার জন্য কোনওদিন মনখারাপ করিনি। আমি দেখতাম এবং জানতাম, আমার মা-বাবা আমার জন্য/আমাদের পরিবারের জন্য অনেক কষ্ট সহ্য করছেন। তাদের কষ্ট দেখেদেখে আমি বড় হয়েছি। তাদের কষ্ট কমানোর ইচ্ছে ছোট থেকেই ছিল। তাই অনেক স্বপ্ন ছিল, অন্তত নিজের জন্য কিছু করতে না পারলেও মা-বাবা’র জন্য অনেক কিছুই করব, যে করেই হোক! জেদটা এখনো আছে, কিন্তু এখন আমি বাস্তবের কাছে পরাজিত। আমার বাবা-মা কেউই বড়লোকের সন্তান ছিলেন না। তাঁরাও কষ্ট করে (এখনো করে যাচ্ছেন) পড়াশোনা করে একজন (মা) সরকারী প্রাইমারী স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা হয়েছেন এবং আরেক একজন (বাবা) কলেজের প্রদর্শক হয়েছেন। এই ছোট চাকরি দিয়েই তাঁরা আমাদের (আমার এবং আমার ছোটবোনের) জন্য অনেক কিছু করেছেন। তাঁদের ঋণ আমার গায়ের চামড়া দিয়ে জুতো সেলাই করে দিলেও শোধ করা যাবে না, এটা কেউ না জানলেও আমি জানি।

ছোট থেকেই মোটামুটি ভাল স্টুডেন্ট ছিলাম। ক্লাসে বরাবরই রোল নাম্বার ১ বা ২-এর ভেতরেই থাকত। ক্লাস ফাইভে আর এইটে বৃত্তি পাওয়ার খুব সম্ভাবনা থাকলেও আমি আমার বাবা-মা এবং শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের হতাশ করেছি ২ বারই। এর জন্য আমাকে অনেক কথা শুনতে হয়েছে আমার শিক্ষকদের কাছে এবং তৎকালীন সময়ের আমাদের থানার সহকারী শিক্ষা অফিসারের কাছে থেকে বকাও খেয়েছেন আমার মা-বাবা। যা-ই হোক, হতাশ না হয়ে পড়াশোনা করে গেছি বারবারই। ক্লাস নাইনে এসে প্রথম সমস্যায় পড়ি আমার বাবার একটা সিদ্ধান্তে। আমার ইচ্ছে ছিল মানবিক বিভাগে পড়ে ভবিষ্যতে প্রশাসনের কোনও চাকরি করা, কিন্তু বাবা-মা ২ জনই আমাকে জোর করে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি করিয়ে দেন অনেকটা স্যারদের বুদ্ধিতেও। স্যাররা চাইতেন, আমি যেহেতু ক্লাসের ফার্স্টবয়, সেহেতু বিজ্ঞান বিভাগ নিলেই ভাল হবে। যা-ই হোক, নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিজ্ঞান নিয়েই পড়াশোনা করে এসএসসি’তে ৪.৩৮ পেয়ে পাস করি। যদিও আমি পাস করি, তবুও বলব, আমি ক্লাস নাইনের পর থেকে আমার স্বাভাবিক পড়াশোনা করার জন্য সত্যিকার অর্থে আর কখনও মন বসাতে পারিনি গ্রাজুয়েশন শেষ হওয়া পর্যন্ত। হয়ত এসএসসি’তে মানবিক নিলে পারতাম। কেন যে আমাদের ইচ্ছেগুলোর কোনও মূল্যই দেন না আমাদের অভিভাবকরা! মনের ঘরে কি আর জোর চলে! হায়, কে কবে বুঝেছে এ কথা?

এইচএসসি’তেও বিজ্ঞান থেকে খারাপ রেজাল্ট করে পাস করলাম ৪.২০ নিয়ে। বাবা চাইতেন, ছেলে ডাক্তার হবে। মা চাইতেন, ছেলে প্রকৌশলী হবে। ছেলে ছোট থেকেই চাইত, সে প্রশাসনের কেউ হবে। আমাদের বাবা-মায়েরা কেন আমাদের স্বপ্নদেখার স্বাধীনতাও কেড়ে নেন? জন্ম দিলেই কি সন্তানের সকল সাধ ও স্বপ্নের সত্ত্বও চলে আসে? এ নিয়ে বাসায় আবারও মনোমালিন্য হল। শেষমেশ মা’কে খুশি করতে গিয়ে আমি কোথাও ভর্তি পরীক্ষা না দিয়ে সরাসরি একটা বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ভর্তি হয়ে যাই।

যদিও আমি ইউনিভার্সিটি ভর্তি কোচিং-এ ১ মাসের মত ক্লাস করেছি যাতে আমি মানবিকের কোনও বিষয় নিয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারি, কিন্তু হায়, বিধিবাম! কোথাও চান্স পেলাম না। চিন্তা করে দেখলাম, মা যেহেতু বলছেন এবং আমি নিজেও অংকে একটু ভাল, সেহেতু ইঞ্জিনিয়ারিং তো পড়াই যায়! বাবাকে সাথে নিয়ে ঢাকার আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ভর্তি হয়ে গেলাম। সব স্বপ্ন মাটি করে দিয়ে পড়াশোনা শুরু করলাম। রেজাল্ট খুব একটা ভাল করতে পারিনি। ৩.০৭ নিয়ে গ্রাজুয়েশন শেষ করেছি, যেখানে আমার বন্ধুরা অনেক বেশি পয়েন্ট পেয়েছে।

ঢাকায় যাওয়ার পর আমার মা বেশ কয়েকবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। আমি ২য় বর্ষে পড়ার সময় মা আমাকে ডেকে আমার বিয়ের কথা বলেন অনেক বার। আমি তখন রাজি ছিলাম না। আমার পছন্দের কেউ আছে কি না, মা তা শুনতে চান। আমি বললাম, আমার সাথে একজনের সম্পর্ক আছে। তখন মা সব শুনে সে মেয়ের সাথে কথা বললেন। সেসময় ২ পরিবারের সম্মতিতে আমার বিয়ে হয়, যদিও আমার বাবা প্রথমে এ বিয়েতে রাজি ছিলেন না। মা আমাকে বিয়ে করাতে চেয়েছেন ২টা কারণে। এক। আল্লাহ্‌ না করুক, উনি যদি তাঁর মেয়েজামাইকে দেখে যেতে না পারেন, এই ভয়ে। দুই। সব থেকে বড় কারণ, সেসময় মা’কে সেবা করার জন্য কাউকে দরকার ছিল। যা-ই হোক, বিয়ে করার ফলে যে আমার পড়াশোনার কোনও ক্ষতি হয়েছে, সেটা আমি কখনওই বলব না। আমি ঢাকায় থেকেছি এবং আমার বউ আমার মায়ের সাথে থেকেছে।

পড়াশোনা শেষ করেছি অনেক আশা নিয়ে। ভাবতাম, বের হলে একটা চাকরি করব। কিন্তু স্বপ্ন আমার এখনো একটাও পূরণ হল না, চাকরি পাওয়ার স্বপ্ন এখনও অধরাই হয়ে গেছে। ভেবেছিলাম, নিজের যোগ্যতা দিয়েই চাকরি পাব। পাইনি এখনো। অনেক জায়গায় ভাইভা দিয়েছি। ২ জায়গায় ছাড়া সব জায়গায়ই ভাইভা ভাল হয়েছিল, কিন্তু কেউ ডাকেনি। বন্ধুরা অনেকেই জব করছে নানান রেফারেন্স দিয়ে। বন্ধুদের আমার জন্য কিছু করতে বললে বলে যে তারাই তো নতুন, তাই আমার জন্য কিছু করতে পারবে না। এই ভাবেই কেটে যায় ৬-৭ মাস।

এরপর সিদ্ধান্ত নিলাম, সরকারী চাকরির জন্য পড়াশোনা করে সরকারী কোথাও জয়েন করব। এ চিন্তা থেকে বইপত্র কিনে পড়তেও শুরু করি। কী পড়বো, কীভাবে পড়বো, এইসবই বুঝে উঠতে পারিনি এখনো। শুধু নিজের মত করে পড়ে যাই। কিছু চাকরিতে আবেদন করে রেখেছি। এই মাসের শেষের দিকে হয়তো দুটোতে পরীক্ষা হবে। প্রস্তুতি ভাল হয়নি, এইটুকু বুঝি। এটা যখনই মাথায় আসে, তখনই মনে হয়, আমি তো কোনওদিকেই কোনও সুবিধা করতে পারছি না। কী করব এখন, আদৌ আমাকে দিয়ে কিছু হবে কি না, এসব আর কিছুই বুঝতে পারি না। এখন আর ভাল করে পড়তেও ইচ্ছে হয় না, কেবলই হতাশা কাজ করে।

হতাশা কাজ করে, যখন মনে হয়, যতই আমি মায়ের ইচ্ছেয় বিয়ে করি না কেন, যতই আমার বাসা থেকে কিছু না বলুক, তবু আমার ভেতরে কাজ করে—আমি তো বিয়ে করেছি, আমার তো অন্তত একটা জব করা উচিত এখন! তাছাড়া ছোটবোনের কত কিছুর জন্য আবদার আছে! একটাও মেটাতে পারি না। বাবা সামনের বছর অবসরে যাবেন। মা বলেন, বাবারে, তুই একটা জব পেলে আমি চাকরিটা ছেড়ে দিব, শরীরে আর পারি না, খুব কষ্ট হয়। এইসব কিছু যখন চোখের সামনে ভেসে উঠে, বিশ্বাস করুন, তখন মনে হয়, নিজেকে শেষ করে দিই! তখন আপনাদের মত বড়বড় মানুষদের কথা শুনলে নিজেকে আশাহত মনে হয়। নিজেকে কিছু দিতে পারি না পারি, অন্তত মা-বাবা’কে কিছু না কিছু দিতেই হবে, এইটা নিশ্চিত জানি, কিন্তু আমি যে কিছুই পারি না! আমি চেষ্টা করেও পারি না। আর কত দিন এমন করে কাটবে? ধীরেধীরে যেন আমি তলিয়েই যাচ্ছি। কী করব, কিছুই জানি না। আমার মামা/চাচা টাইপের এমন কেউ নেই যিনি আমাকে হেল্প করবেন। আরও অনেক কিছুই বলার ছিল, কিন্তু সব কিছু বলতে পারলাম না। লিখছি আর টপটপ করে চোখের জল পড়ছে কিবোর্ডের উপর।

আমার এই মুহূর্তে একটা জবের খুব খুব খুব দরকার। প্রকৌশলীর জবই করব, এমন কোনও চিন্তা নেই, যেকোনও একটা জব হলেই হল, যেটা দিয়ে অন্তত আমার বাবার মুখে একটু হলেও হাসি ফুটবে। উনি যেন আর চিন্তা না করেন, তাঁর অবসরের পর কী হবে এই পরিবারের! প্লিজ আমাকে একটু হেল্প করুন। আপনি যা করতে বলবেন, আমি তা-ই করতে রাজি! আমি চাই, আপাতত যেকোনও একটা জায়গায় জব শুরু করে সরকারী চাকরির জন্য পড়ব। আমি জানি, আমি হার্ডওয়ার্ক করলে সফল হব, এবং আমি এটাও বিশ্বাস করি, আমি হার্ডওয়ার্ক করতে পারব। আমার শুধু সঠিক দিক-নির্দেশনা লাগবে। আমি দুরূহতম রাস্তায়ও হাঁটতে প্রুস্তুত আছি, কিন্তু ও রাস্তাটাই যে চিনি না!

এই কথাগুলো আর কেউ জানে না। আপনাকে বলতে পেরে একটু হালকা লাগছে। কষ্ট শেয়ার করলে কষ্ট হয়তো কমে না, কিন্তু এক ধরনের শান্তি লাগে।