ভাবনাদেয়ালের পলেস্তারা (৪৬শ অংশ)

ভাবনা: তিনশো ষোলো।

……………………………………..

এক।

: মনে যা ছিল, সব লিখে দিচ্ছি। পছন্দ না হলে আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন, কেমন? আমাকে সরাসরি গালাগালি করতে ভয় পেতে হবে না। আমি এটা আপনার অভদ্রতার প্রমাণ হিসেবে কখনও কারও সামনে হাজির করব না। আমি হিপোক্রিসি সহ্য করতে পারি না, তাই আমাকে পছন্দ না হলেও আমার সামনে মিউমিউ করতেই হবে না। আপনি যদি আমাকে বিয়ে করেন, আর বিয়ের পর হুমায়ূন ভাইয়ের মত অন্য কাউকে ভালোবেসেও ফেলেন, তাও আপনাকে বাঁধন ছাড়াই রাখব, ছেড়ে দেবো। তোমায় হৃদমাঝারে রাখব, তবু ধরে রাখব না। শুধু একসাথে একাধিক মেনে নিতে পারব না। আমি অতি সাদামাটা, প্রেমে আনাড়ি। এ জীবনে প্রথম আপনার সাথে এমন করছি। ভাল যে আপনার আগে আর কাউকেই কখনও লাগেনি, এটা বললে বড্ড কপটতা হয়ে যাবে, এটা আপনিও বোঝেন। কিন্তু এতটা পাগল আর কারও জন্য কখনও হইনি। আর তার চেয়েও বড় কথা, আমার তীব্র ভাললাগাও বরাবর অপ্রকাশিত থেকে গেলেও এই প্রথমবারের মত কারও কাছে তারই প্রতি ভাললাগাটা প্রকাশ করছি এমন দুরন্ত সাহস দেখিয়ে! (তাল্লি হপ্পে! তালিয়াআআআ……) যা-ই হোক, কেন জানি মনে হয়, আপনাকেও প্রতিদিনই আমাকে নতুন করে আপনার প্রেমে ফেলতেই হবে আমার সত্যিকারের ভালোবাসাটা পেতে। আমি যা অনুভব করি, বলে দিয়েছি। এটা অভিনয় নয়, ছলনা নয়, অতিরঞ্জন নয়।

: আপনি কে?

: আপনি জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কে? নিশ্চয়ই এরপর জিজ্ঞেস করবেন, কী দরকার? আমার মুখস্থ হয়ে গেছে!

আমি কে? উত্তর হল: আমি কালো, মোটা, বেঁটে, দেখতে বাংলার পাঁচের মতন একজন নারী। আমি একজন থার্ডক্লাস মানুষ। আমি আপনার ব্লকলিস্টের অতি পরিচিত এক মুখ। নাহ্‌, ভুল হল! এক মুখ না, চব্বিশ মুখ! যদি আপনার মনে হয়, আমার এই ২৫তম আইডিটিকেও ব্লক করে দেবেন, তবে আমি আপনাকে একটা পরামর্শ দিতে পারি—আমার ডজনখানেক ভুয়া আইডি’কে আপনার সামনে একদিন হাজির করব, আপনি সেদিন খুব কম সময়েই সবকটাকে আপনার স্বপ্নরাজ্যের বাসিন্দা করে ফেলতে পারবেন। এতে আপনার স্বর্গলাভের পথটাও আরও প্রশস্ত হবে খুব অল্প শ্রমেই!

: ও আচ্ছা। নট ইন্টারেস্টেড। থ্যাংকস। বাই।

: আঁধারঘরের আলো। সাঁঝবাতির রূপকথা। আইডি দুটোও ব্লক করে দিন।

: ওকে।

: “একটা গোপন কথা ছিল বলবার……….” “মা করছে রান্না, খেলাধুলা আর না……….” এই দুটো আমার খুব প্রিয়। আপনার ভাল লাগে? আজ আপনার কোনও আলোকচিত্র তুলেননি? একটা আপলোড করেন না! প্রাইভেসি প্রবলেম থাকলে নাহয় আমার কাছে ইনবক্সেই আপনার আলোকচিত্রের প্রদর্শন করেন!

স্টকহোম সিনড্রোম নিয়ে আপনার পোস্টটার কিছু পয়েন্ট নিয়ে আমার প্রবল আপত্তি আছে। বিস্তারিত বলতে পারলে ভাল হত। আপনি যদি কোনও কনসেপ্ট নিয়ে লেখেন, তবে সেখানে আপনার নিজের উদ্ভাবিত পয়েন্ট ঢুকাতে পারেন না। আপনার লেখাটিকে মূলানুগ রাখতে পারেন না পারেন, এতটা ডিস্টরশন তো করতে পারেন না, তাই না? মশাই, ‘হাইওয়ে’ মুভিটার কথা মনে করিয়ে দিলেন! আপনি যদি ওই পোস্টের মাধ্যমে আমাকে কিছু বোঝাতে চান তো বলছি, শুনুন, আমি এ ব্যাপারে অনেকবেশিই সচেতন। আমার এক ফ্রেন্ড মা হয়েছিল, কিন্তু সে এরকম কিছুই অনুভব করতে পারেনি! আমার ক্যারিয়ার নিয়ে খুব বেশি ডিমান্ড নেই, কিন্তু আমাকে মোটামুটি টাইপের হলেও কিছু একটা করতেই হবে, কারণ আমার জীবনটা শুধুই আমার না। অনেক দায়িত্ব আমার কাঁধে! আমি যেমনি অনেকবেশি মা এবং বউ হিসেবে বাঁচতে চাই, ঠিক তেমনি একজন মানুষ হিসেবেও আমার কর্তব্য কিছুটা পূরণ করতে চাই। আমার রিসার্চ-বেইজড জব খুব পছন্দ, যাতে বাইরে সময় কম দিতে হয়।

আরেকটা ব্যাপার ভেবে দেখুন তো! একটা সময় পর স্বামী আর সন্তান নিজেদের জীবন নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়বে, তখন একটা মেয়ে কেবলই ঘর সামলেই সময় কাটাতে পারে? তখন তো আর কেউ ভাববে না যে এই বেচারি তো তার জীবনের সুবর্ণ সময়টাই আমাদের দিয়ে দিল, এখন ওকে একটু সময় দিই! অবশ্য, এমন করে ভাবাও সম্ভবও নয়। তখন? অতএব, সময় থাকতেই আমার ব্যবস্থা তো আমাকেই করে রাখতে হবে, নাকি? আর আমার আপনাকে নিয়ে নিউক্লিয়ার ফ্যামিলিতে থাকার কোনও ইচ্ছেই নেই। আমি আমার জীবন থেকে জানি, নিউক্লিয়ার ফ্যামিলিতে থাকাটা যে কতটা পেইনফুল! ভাববেন না যে যৌথ পরিবার নিয়ে আমি জানি না। জয়েন্ট ফ্যামিলির সমস্যাগুলি সম্পর্কেও আমি জানি। বাংলাদেশের লোকজনের মধ্যে কিন্তু এখন আর আগের মত সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব নেই। গ্রামে গিয়ে দেখুন না! কোনও সামাজিক কাজে আপনাকে সহযোগিতা করার মত লোকই খুঁজে পাবেন না! জনাব, আপনি ইচ্ছে করেই স্ট্যাটাসটাতে বেশি মাত্রায় কন্ট্রোভার্সি ঢুকিয়ে দিয়েছেন, না? আপনি নিজে তো কনজারভেটিভ নন। তবে? সমালোচিত হতে খুব ভাল লাগে? দাম বাড়ে?

দুই।

চট্টগ্রাম মেডিক্যালের মাথাটার ওখানেই একটা দোতলা বাড়িতে আমরা থাকতাম। আশেপাশে অনেক ধরনের ঘাস ছিল। শুভ্র মেঘের মত সাদাসাদা গরু চরে বেড়াত সেখানে। পাশেই ছিল একটা শিউলিফুলের গাছ। ভোরবেলায় গাছের নিচে শিউলির একটা শ্বেতচাদর ছড়িয়ে থাকত। আমরা গিয়ে গাছ ঝাঁকিয়ে আরও কিছু মাতালঘ্রাণের শিউলি ঝরাতাম। ছাদে উঠে যেতাম, গাছ থেকে জাম পেড়ে খেতাম। একেক জনের মুখ কেমন যে রঙিন হয়ে যেত! টিনের চালে উঠে কামরাঙ্গা পাড়তাম। গুলতি দিয়ে পাখি শিকার করতে চাইতাম। গাছে চড়ে পাখির বাসা থেকে তুলতুলে ছানাগুলিকে আলতো করে ধরে আবার নেমে যেতাম। মা দেখলে বেত নিয়ে দৌড়ে আসত, আমরা পালিয়ে যেতাম। পাহাড় বেয়ে একদম উপরে ফরেস্ট্রির পানির টাংকির কাছে চলে যেতাম। দুপুরবেলায় খাটে শুলে মাথার পাশে যে রাস্তা দেখা দেখা যেত, সে রাস্তা ধরে কাজিনরা মিলে দৌড় প্রতিযোগিতা করতাম। এক বুনো ষাঁড় ছিল। সে কী রাগ ওর! শিং উঁচিয়ে তেড়ে আসত আর আমাদের লাউখেত নষ্ট করে ফেলত। রাতে ঝিঁঝিঁ পোকার অবিশ্রান্ত ডাক শুনতে পেতাম। আগুনে-পোকাগুলির পিছু নিতাম। ওরা কেমন করে যেন পালাত। আশেপাশেই নেচেনেচে উড়ত, তবু যেন ধরা যেত না। কখনও ওদের বোতলে ঢুকিয়ে খাটের নিচে রেখে দিতাম। বোতলগুলি মিটমিট করে জ্বলত যেন! কী যে সুন্দর লাগত দেখতে! নিষ্ঠুরভাবে শামুকের শরীরে লবণ ঢেলে দিতাম। আমের আঁটি যেখানে-সেখানে ফেলে দিয়ে দেখতাম কিছু হয় কি না। ওগুলির মধ্যে আবার কয়েকটি থেকে সুন্দর বাদামি পাতা বের হত। আমের কচিপাতা দিয়ে বাঁশি বাজাতাম। দুপুরবেলায় ঢিল ছুঁড়ে আম পাড়ার যে আনন্দ, তা আর কোথায় পাওয়া যাবে? পাশেই এক পুকুর ছিল। ওটার পানিতে মাটির চ্যাপ্টা চাড়া কায়দা করে ছুঁড়ে মারতাম, আর চাড়াটা কেমন যেন লাফিয়েলাফিয়ে পানি পার হত! একটা ফলের বাগান ছিল। ওখানে আমরা সবাই মিলে রাজাপ্রজা খেলতাম। বাঁশ, কাঠ, লতা এসবকে দড়ি দিয়ে বেঁধে তলোয়ার, বন্দুক বানাতাম। সেসময়ের একেকটা দুপুর কেমন যে নেশাধরা ছিল!

ওখানটায় এখন গেলে পুরনো দিনগুলি যেন স্মৃতির ঘরে ঘুরেফিরে আসতে থাকে একএক করে। ও আচ্ছা, বলা হয়নি, ওই জায়গার একটা নাম দিয়েছি আমি—নেভার সে গুডবাই!

ভাবনা: তিনশো সতেরো।

……………………………………..

আমি কিছুদিন আগে প্রায় বেশ কয়েকবার সুইসাইড অ্যাটেম্পট নিয়েছিলাম। সেই ভয়ংকর সময়টার কথা আর না-ই বা বলি! এই সুইসাইড অ্যাটেম্পট নেয়ার আগ পর্যন্ত আমি অনেকবেশি বাস্তববাদী ছিলাম। সবাই এমনই থাকে বোধহয়। জীবনটাকে অনেক বেশি ভালোবাসতাম। অনেক কিছু করার স্বপ্ন দেখতাম। কোনও কিছুতেই হার মানতে চাইতাম না। সত্যি বলতে কী, বারবার হেরে গিয়েও কখনো হারটাকে মেনে নিতাম না। আমি বিশ্বাস করতাম, যারা হেরে যায়, তারা হারিয়ে যায় না। যারা হেরে যায় ও থেমে যায়, তারাই হারিয়ে যায়। আমি নিজের কাছে শপথ নিয়েছিলাম, যতই ঝড় আসুক না কেন, আমি কিছুতেই হার মেনে নেবো না। যতক্ষণ এ দেহে প্রাণ আছে, ততক্ষণই নিজের সাথে লড়াই করে যাব। এমন অনেক শপথের কোলাহলে জীবন পূর্ণ ছিল। মানুষ কত যে স্বপ্ন দেখে বাঁচে!

আমাদের সমাজে কোনও ছেলে বা মেয়ে যদি আত্মহত্যার চেষ্টা করে কিংবা আত্মহত্যা করেই ফেলে, তখন আমরা আর আমাদের সমাজ ওই ছেলে বা মেয়েটাকে বোকা, আহাম্মক, জীবনের প্রতি দয়ামায়াহীন এসব অভিধা দিয়েই যেন মুক্ত হয়ে যাই খুব স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে। আরও বলতে থাকি, ছিঃ! কী স্বার্থপর! বাবা-মা’র কথা একবারও চিন্তা করল না! এমন করে হার মেনে নিল! এরকম নানান ধরনের বাস্তববাদী বা দার্শনিক কথাবার্তা বলেই যেন আমরা দায়মুক্ত! খুব বেশি হলে আমরা সেই ছেলে বা মেয়েটার জন্য ‘আহা!’ শব্দটির মাধ্যমে আমাদের সহানুভূতিটুকু প্রকাশ করি। এর বেশিকিছু কেউ করে না। কেউ কিন্তু শখ করে আত্মহত্যা করতে চায় না। যখন মানুষ বেঁচেথাকার কোনও অর্থ বা উদ্দেশ্য খুঁজে পায় না, তখনই সে নিজেকে শেষ করে দিতে চায়। তখন সে শুধু তার ভেতরের তীব্র যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে চায়। অন্য কিছু বা অন্য কারও কথা তার মাথায় থাকে না। লোকে যতটা দর্শন বা তত্ত্ব নিয়ে বাঁচে, ততোধিক, যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে মরতে চায়। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ওই কষ্টের অনুভূতি আর ভাবনা থেকে সে মুক্তি পেতে চায়।

পৃথিবীতে কত বড়বড় অপরাধের শাস্তি হয়, কিন্তু কারও স্বপ্ন ভেঙে দেয়ার মত অপরাধ কিংবা কারও সকল অনুভূতিগুলো কেড়ে নেয়ার মত নিষ্ঠুরতা কিংবা অনেক বেশি বিশ্বাসের জন্ম দিয়ে তা খুন করার কিংবা প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা কাঁচের চুড়ির চাইতেও সহজে ভেঙে ফেলার মত স্বেচ্ছাচারিতার কোনও শাস্তি নেই কেন? কারও সকল স্বপ্ন ভেঙে দিয়ে তার সমস্ত অনুভূতিকে ভোঁতা করে দেয়াকে আমার কাছে মানুষহত্যার সমতুল্য অপরাধ বলে মনে হয়। যার স্বপ্নই নেই, সে আবার বাঁচে কীভাবে? অমন করে বাঁচার চাইতে মৃত্যুও শ্রেয়। কখনওবা স্বপ্ন কেড়ে নিলেও মানুষ বাঁচতে পারে, কিন্তু কেউ যদি অনুভূতিটুকুই কেড়ে নেয়, তখন দেহটা কোনওমতে বেঁচে থাকলেও আত্মাটা পুরোপুরিই মরে যায়। অনুভূতি কেড়ে নেওয়ার কোনও শাস্তি আমাদের আইনে নেই কেন? অবশ্য, থাকলেও কী-ই বা এসে যেত? হারানো অনুভূতি তো আর ফেরৎ পাওয়া যেত না! মাঝেমাঝে ভাবি, এই যে আইনে মৃত্যুদণ্ডের বিধান আছে, সেটা কেন আছে? অন্য কোনও নিষ্ঠুর বিকল্প নেই, তাই? খুনির মৃত্যুদণ্ড হলে তো আর খুন হয়ে যাওয়া ব্যক্তিটিকে ফিরে পাওয়া যায় না। তবু, এর প্রয়োজন আছে। খারাপ লোকের জীবনের মায়া সবচাইতে বেশি হয়। আর অন্য এক খারাপ লোককে ফাঁসিতে ঝুলতে শুনে অন্য খারাপ লোকগুলি যদি একটু সংশোধিত হয় আরকি! এই দর্শনেই তো আইন চলে, না?

বেঁচে থাকতে হয়? খুবই ভাল কথা। মানছি। তবু আর কতকালই বা নিজের সাথে অভিনয় করে থাকা যায়? কান্না গিলে বাঁচা আর কত? আত্মহত্যা কোরো না, বললেই আত্মহত্যার হার কমে যাবে না। এর জন্য প্রয়োজন সময়মত কাউন্সেলিং, সামাজিক পুনর্গঠন।

আমার অনেক ইচ্ছে আছে, বাংলাদেশে কোনও আত্মহত্যা প্রতিরোধমূলক সংগঠন থাকলে সেখানে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করব। হেমলক সোসাইটি মুভিটাতে পরমব্রতকে দেখে এমন অনুপ্রাণিত হয়েছি।

WHO-এর রিপোর্ট অনুসারে, বাংলাদেশ এ প্রতিবছর বিশ হাজার লোক আত্মহত্যা করে, অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ৫৫ জন আত্মহত্যা করে। এই রিপোর্টে আরও বলা হয়, আরও অন্তত ৬৫ লক্ষ বাংলাদেশি আত্মহত্যাপ্রবণ। যারা আত্মহত্যা করেছে, তাদের বেশিরভাগেরই কোনও না কোনও মানসিক সমস্যা ছিল। মানসিক সমস্যা বাড়লে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ে। কেউ আত্মহত্যা করে ফেলার পর আমরা তা নিয়ে ভাবতে শুরু করি। আত্মহত্যা করার আগে আমরা কোথায় থাকি?

আত্মহত্যাটা আসলে কী? এই যে এতএত লোক আত্মহত্যা করছে, এটা কি এক ধরনের নীরব গণহত্যা নয়? রাষ্ট্র কি এর দায় এড়াতে পারে? রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার নানান জটিলতা আর ভুল নীতির ফলে যে আত্মহত্যার ঘটনাগুলি ঘটছে, সেগুলির খুনি কি রাষ্ট্র নয়? চাকরি পেল না বলে যে বেকার যুবকটি আত্মহত্যার পথ বেছে নিল, সে মৃত্যুর দায় কার? ২০১০ সালের ডিসেম্বরে যে তিউনিশিয়ান যুবক বেকারত্বের কারণে গায়ে আগুন লাগাল, তার দায় কি রাষ্ট্র এড়াতে পেরেছে? কেন আমরা এখনও এসব নিয়ে ভাবছি না? এক দেশ তখনই উন্নত হয়, যখন তার নাগরিকরা কাজের জিনিস নিয়ে ভাবে। খারাপ লোকের জন্য খারাপ সরকার থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। আমাদের চিন্তাভাবনার উন্নয়ন ছাড়া আমাদের কোনও ধরনের উন্নয়ন কখনওই সম্ভব নয়। আমরা যে কত বাজে জিনিস নিয়ে ব্যস্ত, ভাবাই যায় না! মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তিই হল, মানুষ সস্তা কাজে আনন্দ পায়। যে যত বেশি এই প্রবৃত্তিকে দূরে রাখতে পারে সময়ের প্রয়োজনে, সে তত বেশি এগিয়ে যায়।

একটা সত্য ঘটনা নিয়ে বলছি। ধরে নিলাম, ওর নাম ছিল নন্দিনী। ওর বাবা খুব ছোটোখাটো একটা ব্যবসা করেন, মা গৃহিণী। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। চেহারা দেখতে ভাল নয় বলে ওকে ওর পরিবারে এবং পরিবারের বাইরে নানান কথা শুনতে হতো। “তুই কী করবি রে? তোকে তো কেউ বিয়েই করবে না। বড় হয়ে চাকরির পরীক্ষা দিতে গেলেও তো তাড়িয়ে দেবে। মানুষ এতো কালোও হয়! তোর পড়াশোনা করে কী লাভ? আহারে, তোর বাবার কথা ভাবলেও খারাপ লাগে। বেচারা তোকে বিয়ে দেবে কীকরে? এতো খাস কেন? কমকম খা। হাতির মতো হচ্ছিস, সে খেয়াল আছে?” মেয়েটি আত্মহত্যা করেছিল। সেসময় ওর বয়স ছিল মাত্র ১৪। প্রেমে ব্যর্থ হয়ে নয়, পরীক্ষায় ভাল করতে পারেনি বলে নয়………সে যেমনই আছে, সমাজ তাকে তেমন করে নিতে পারছে না বলে ক্ষোভে, দুঃখে, অভিমানে সে মৃত্যুর পথ বেছে নেয়। ওই বয়সের একটা মেয়ে যত না যুক্তি বা বুদ্ধিতে চলে, তার চাইতে অনেক বেশি আবেগে চলে। ওর মৃত্যুর আগে ওর আবেগের জায়গাতে ক্রমাগত আঘাত করা হয়েছে। কেউ কখনও ওর আবেগ কিংবা অনুভূতির কোনও দাম দেয়নি। সমাজ যে কতটা নির্দয় হতে পারে, তার একটা ছোটো উদাহরণ নন্দিনী। এ দেশের টিভিতে ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি মেখে মেয়েদের আত্মবিশ্বাসী আর অধিক গ্রহণীয় হয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখানো হয়। মানে, যারা দেখতে কালো, দৈহিকভাবে অসুন্দর, তারা অন্যদের চাইতে কম গ্রহণীয়—এমন প্রোপ্যাগান্ডা রাষ্ট্রীয় প্রশ্রয়েই ছড়ানো হচ্ছে। যখন এসব কারণে গণচৈতন্য ফর্সা চামড়ার গুণগানে মাতোয়ারা হয়ে যায়, আর তার বলি হতে হয় কোনও এক দুঃখিনী নন্দিনীকে, আত্মহত্যার এমন বাণিজ্যিক প্রণোদনার দায় রাষ্ট্র কীকরে এড়াতে পারে?

মেঘাকে বাদল খুব বিরক্ত করে, জোর করে মেঘার সাথে প্রেম করতে চায়। এসএসসি’তে পড়ার সময় দুই বছর ধরে মেঘা বাদলের এই বখাটেপনা সহ্য করেছে। বাদলের অত্যাচারে মেঘার জীবনটাই অতিষ্ঠ হয়ে গেছে। বাদলের বাবা এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তি বিধায় কেউ ওকে তেমন কিছু বলার সাহস করত না। এই সুযোগটা বাদল খুব ভালভাবেই কাজে লাগিয়েছে, ধরাকে সরাজ্ঞান করেছে। মেঘা পড়াশোনায় খুব ভাল না হলে খুব যে খারাপ, তাও নয়। বলাই বাহুল্য, বাদল দুই বছর বখাটেজীবনের সকল সুখ নিয়েছে, বইয়ের সাথে তার কোনও যোগাযোগ কখনওই ছিল না। এসএসসি পরীক্ষা এলো। প্রশ্নফাঁসের কল্যাণে বাদল প্রশ্ন পেয়ে পরীক্ষা দিল, বাবার জোরে হলের পরিবেশও ছিল তার অনুকূলে। ফলাফল—এপ্লাস। ওদিকে মেঘা সম্পূর্ণই নিজের মেধার জোরে পরীক্ষা দিয়ে পেল এ। ভাল রেজাল্টের দাপটে বাদল মেঘার সামনে গিয়ে ওর খারাপ রেজাল্টের জন্য ওকে তীব্র অপমান করে এলো। ওর আরও দুজন বন্ধু সহ মেঘাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে ইচ্ছেমত লাঞ্ছিত করল। লজ্জায়, ক্ষোভে, দুঃখে, অভিমানে মেঘা ঘরের সিলিংফ্যানের সাথে ঝুলে আত্মহত্যা করল। প্রশ্ন হল, এ কি মৃত্যু? নাকি খুন? রাষ্ট্র কি এর দায় এড়াতে পারে?

ভাবনা: তিনশো আঠারো।

……………………………………..

আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। বাবা ছোটখাটো ব্যবসা করে। বাবা-মায়ের বড় মেয়ে আমি। আমার ছোট দুই ভাই। এক ভাই ক্লাস ফোরে, আরেক ভাই এইটে। আজ থেকে ৫ বছর আগে আমি সেভেনে। আমার বাবা-মা সেসময় আমার বিয়ে ঠিক করে এক লোকের সাথে যিনি আমার বাবার চাইতেও দশ বছরের বড় ছিলেন। ওই লোকের দুই মেয়ে ছিল। বড় মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে, তার একটা বাচ্চাও আছে। ছোট মেয়ে সেসময় ক্লাস ফাইভে। উনি তিন বিয়ে করেন, কিন্তু তিন স্ত্রীই অন্য লোকের হাত ধরে পালিয়ে যায়। এমন একটা লোকের সাথে বিয়ের ব্যাপারটা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারিনি। লোকটা তখন সৌদি আরবে ছিলেন। উনি বিদেশেই থাকতেন, মাঝেমধ্যে ছুটিতে দেশে আসতেন। বিয়ে ঠিক হওয়ার পর সে লোকের বড় ভাই আমাদের বাসায় এসে আমার আঙুলে আংটি পরিয়ে দিয়ে যান এঙ্গেজমেন্টের টোকেন হিসেবে। তারপর থেকেই সে লোক রোজ রাতে কল করতেন। সৌদি আরবে যখন রাত ৯টা, তখন আমাদের এখানে রাত ১২টা। উনি কোন একটা কন্সট্রাকশন ফার্মে ম্যানেজারের চাকরি করতেন, উনার ওইসময়ে অফিস ছুটি হত। আমি বাধ্য হয়ে রাত ১২টায় উনার সাথে কথা বলার জন্য ঘুম থেকে উঠতাম। উনার সাথে কথা না বললে আমাকে বাবা-মা খুব বকত। লোকটা আমার শরীর নিয়ে অনেক বাজেভাবে কথা বলতেন, ওই বয়সে আমি সেসব কথার অনেককিছুই বুঝতাম না, কিন্তু উনি যে ভাষা ব্যবহার করে কথাগুলি বলতেন, আমি তা শুনলে সহ্য করতে পারতাম না। উনার কথা কেবল শুনে যেতাম আর খুব কাঁদতাম। অনেক বেশি কাঁদতাম, চোখের জলে বালিশ ভিজে যেত। একদিন মাকে বললাম যে ওই লোক আমার সাথে খুব বিশ্রীবিশ্রী কথা বলেন, ওসব শুনে আমি সহ্য করতে পারি না, আমার ভীষণ কান্না পায়, আমি উনার সাথে আর কখনও কথা বলব না। এটা বলার জন্য মা আমার চুলের মুঠি ধরে আমাকে খুব মেরেছিল। সেদিন কত যে বুকফাটা কষ্টে হাউমাউ করে কেঁদেছি, কেবল উপরওয়ালাই তার সাক্ষী। আমাকে মা স্কুলে যেতে দিত না, ঘরে আটকে রাখত, আর ওই লোক বারবার কল করতেন, আর মুখে যত নোংরা কথা আসে, সবই বলতেন।

আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না। একদিন মিথ্যে বলে বাসা থেকে কোনওমতে বের হয়ে স্কুলে গিয়ে বান্ধবীদের জড়িয়ে ধরে অনেক কাঁদলাম, সব কথা খুলে বললাম। তখন আমাদের স্কুল টিচারের কাছে ওরা সবাই মিলে আমার ব্যাপারটা বলল। উনি বললেন, আচ্ছা, তোমরা ক্লাসে যাও, আমরা দেখছি, কী করা যায়। স্কুল আওয়ার শেষে উনি আমাকে হেডস্যারের বাসায় নিয়ে যান। আমি ভয়ে কাঁপছিলাম। নিজ থেকে কিছু বলার সাহস পাচ্ছিলাম না।

স্যারের বাসায় কতক্ষণ ছিলাম, জানি না। অনেকক্ষণ পর স্যার আমাকে ডেকে বললেন, “তোমাদের বাসায় মানবাধিকার সংগঠন থেকে কর্মকর্তা পাঠানো হয়েছিল। কিছুক্ষণ পর তোমাদের এলাকার চেয়ারম্যান আর তোমার বাবা-মা আসবেন তোমাকে নিতে। আর কোনও ভয় নেই।” এসব শুনে আমার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল, যেন আমি কিছু বলার সকল ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছি। এটা কী হল! আমার কল্পনারও বাইরে ছিল এসব! এরপর আমাকে বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। বাসায় আসার পর দেখি, আমাকে দেখার জন্য আমাদের বাসায় এলাকার লোকজন ভিড় করে আছে। খুব কান্না পাচ্ছিল তখন। নিজেকে কাঠের শোপিস মনে হচ্ছিল। ওই লোকগুলিকে দেখে নিজের মনে ক্ষোভ জন্ম নিচ্ছিল। এতদিন কোথায় ছিল এইসব মানুষ? যখন একা বদ্ধ ঘরে কেঁদে মরেছি, তখন ওদের এই স্রোত কোথায় ছিল? বাসায় এসে জানতে পারলাম, আমাদের বাসায় নাকি প্রায় ১০-১২ জন অফিসার এসেছিলেন। উনারা আমার বাবা-মা’কে এলাকার সবার সামনে অপমান করে গেছেন। এটা শুনে সব থেকে বেশি কেঁদেছিলাম। আমি ভাবতেও পারিনি যে আমার এমন কাজের জন্য উনারা আমার বাবা-মা’কে এসে অপমান করবেন। আর যা-ই হোক, আমি কীকরে আমার বাবা-মা’কে অসম্মান করতে পারি? আমি আসলেই এটা আগে বুঝতে পারিনি। ওদিকে বাবা-মা’ও আমাকে ভুল বুঝল। ওরা ভাবল, আমি ইচ্ছে করেই ওদের অপমান করতে বাড়িতে লোক পাঠিয়ে দিয়েছি। আমি কিছুতেই ওদের সত্যটা বোঝাতে পারলাম না। তাই আজ এই ৫-৬টা বছর ধরে আমি আমার বাবা-মায়ের চোখে কাঁটা হয়েই বেঁচে আছি। আর ধৈর্যে কুলাচ্ছে না। এবার কিছু একটা করতে চাই। বাবা-মায়ের মুখে হাসি দেখতে চাই। ওরা যেন সবাইকে গর্ব করে বলতে পারে, এটা আমার মেয়ে! কিন্তু কীভাবে তা করব আমি?

ওই লোকের সাথে আমার বিয়ে ঠিক করার প্রধান কারণ ছিল, এক জায়গায় ব্যবসার কাজে বাবার হাজার পঞ্চাশেক টাকা ঋণ হয়েছিল, উনি বলেছিলেন, আমাকে উনার সাথে বিয়ে দিলে বাবার ওই টাকাটা শোধ করে দেবেন। লোকটা আমার নামে অনেক সম্পত্তি লিখে দিতে চেয়েছিলেন। সাথে আমার বাবাকেও আরও কিছু নগদ টাকার লোভ দেখিয়েছিলেন। বাবার আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভাল ছিল না। অন্য কিছু জায়গায়ও বাবার কিছু দেনাও জমে যায়। তাই বাবা-মা এ বিয়েতে রাজি হয়েছিল।

বাবা-মা আমাকে অনেক দূরে সরিয়ে দিয়েছে। আমি আমার অধিকার নিয়ে বাবা-মা’কে কিছু বলতে গেলে ওরা বলতো, আমি ওদের সাথে অন্যায় করেছি, তাই তাদের কোনও কিছুতেই আমার কোনও অধিকার নেই। আমার বাবা-মা’র সাথে যা হয়েছে, তা হয়েছে সম্পূর্ণই আমার অজান্তে। আর তা-ই যদি আমার অন্যায় হয়, আমার সাথে জেনেবুঝে সজ্ঞানে যা করা হয়েছে, তা কী ছিল তবে? অন্যায় আমার সাথেও হয়েছে। আমি ভিক্টিম, তাই আমি জানি, আমি কীসের মধ্য দিয়ে গেছি। আর কেউ তা বুঝতে পারবে না। এমনকি ভাবতেও পারবে না আমার যন্ত্রণার মাত্রাটা। যার কষ্ট, সে-ই কেবল জানে, বোঝে, বাকিরা বড়জোর অনুমান করতে পারে। আমি আমার বাবা-মা’কে ক্ষমা করে দিয়েছি। তারা আমাদের এলাকায় অপমানিত হয়েছে, সেটা ন্যায্য হোক, আর অন্যায্যই হোক, আমি চাই তাদের হারানো সম্মানটুকু ফিরিয়ে দিতে, আর কিছু না। আমার জন্য তারা যা হারিয়েছে, তার যতটুকু সম্ভব, আমি ফিরিয়ে দিতে চাই। এ জীবনে আমার আর কিছুই চাওয়ার নেই।

সে লোকটা দেশে এলে আমার সাথে দেখা হয়। টাকার অভাবে আমার পড়ালেখা প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ক্লাস এইটের জেএসসি পরীক্ষার ফরম ফিলাপের সময় ৪ হাজার টাকার দরকার হয়েছিল। সে টাকাটা আমি কোনওভাবেই যোগাড় করতে পারছিলাম না। আমি উনার কাছে সাহায্য ভিক্ষা চাই ছোটবোন হিসেবে। উনি আমাকে বলেছিলেন, আমি যদি উনার কাছে আমার দেহ বিক্রি করি, তাহলে উনি আমাকে ফরম ফিলাপ করার টাকা দেবেন। এরপর বান্ধবীদের কাছ থেকে হেল্প নিয়েছি, আব্বুকে না জানিয়ে আম্মুও একটু হেল্প করেছিল, আর বাকিটা আমার স্কুল মাফ করে দেয়। ক্লাস এইটে জেএসসি পরীক্ষায় এপ্লাস পেলেও টাকার অভাবে সায়েন্সে পড়তে পারিনি, নাইনে আর্টসে ভর্তি হয়েছি। খুব কষ্টে এরকম নানান প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করে-করে আমি গ্রাম থেকে ৪.৩৮ নিয়ে এসএসসি পাস করে ঢাকায় চলে আসি। আমাদের এলাকার এক মেয়ের সাথে একই কলেজে ভর্তি হই। আমরা একই সাথেই থাকি। ওর বাবা প্রথম কয়েকমাস আমাকে আর্থিকভাবে সহায়তা করেন। এরপর আমি দুইটা টিউশনি যোগাড় করে কোনওমতে নিজের থাকাখাওয়া আর পড়াশোনার খরচ চালিয়ে নিচ্ছি।

জানি না, আমি এখন কেমন আছি, কী করছি, কেন করছি। কতদিন এমন করে নিজের অস্তিত্বকে টেনেহিঁচড়ে সামনের দিকে নিয়ে যেতে পারব, তাও বুঝতে পারছি না। বাবা-মা কোনও খরচ পাঠায় না। আমি ফোন করলে কথা হয়, নাহলে তাও হয় না। ওরা আমার উপর এখনও রেগে আছে। এলাকায় ওদের কোনও সম্মান নেই। আমার জন্যই ওদের সব গেছে। আমাদের পরিবারটা এলাকায় খুবই দরিদ্র, অবহেলিত, উপেক্ষিত। আমাকে কেউ ভালোবাসে না, কেউ আমার সাথে ভাল করে দুটো কথা বলে না। আমি অনেক গরীব, অনেক অসহায়, অনেক নিগৃহীত। চোখ মেললে আলো দেখি না, সামনে কেবলই অন্ধকার। টিউশনি চলে গেলে কীভাবে পড়াশোনা করব, জানি না। সবাই এ বয়সে কত শখ আহ্লাদ মেটায়, আর আমি বেঁচে থাকতে হলে ন্যূনতম যা প্রয়োজন, তা মেটাতেই হিমশিম খাচ্ছি। আমার জীবনের হাল আমারই হাতে। আমার ফ্রেন্ডদের পাশে ওদের বাবা-মা আছেন, আত্মীয়স্বজন আছেন। ওরা হারবে না, হারাবে না। ওরা হারিয়ে গেলে ওদের টেনে তোলার কত মানুষ আছে! ওরা হারিয়ে গেলে যে ওদের পরিবারটাও সাথে হারিয়ে যাবে! সে নির্ভরতা ওরা অনুভব করতে পারে, সে নিরাপত্তা ওদের আছে। আর আমি হারিয়ে গেলে আমিই কেবল হারিয়ে যাব। আর কেউ হারাবে না। আমি হেরে গেলে একমাত্র আমিই হেরে যাব। আর আমি জিতলে আমার বাবা-মা’ও আমার সাথে জিতে যাবে, সমাজের চোখের তাদের হৃত গৌরব আবারও ফিরে আসবে।

আমার কথা: যারা আজকে তোমায় অবহেলা করছে, তাদের কিছু করে দেখাতে পারাটাই জীবন। এমন একদিন আসবে, যেদিন তোমার সম্মান এতোটাই বেশি হয়ে যাবে যে তুমি ওদের এই অবহেলা ফিরিয়ে দেয়ার সময়টুকুও পাবে না। হয়তোবা, ওদের পুরনো আচরণের কথা মনে করার চাইতে করার মতো আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ এসে জমা হবে তোমার সামনে। তোমার ব্যস্ততা বেড়ে যাবে, নিজের জন্য, পরিবারের জন্য, সম্প্রদায়ের জন্য, সমাজের জন্য করার মত অনেক কাজ চোখের সামনে এসে যাবে। নিজেকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চাইতে মধুর প্রতিশোধ আর হয় না। উত্তর মুখে দিতে হয় না, জীবনই উত্তরটা দিয়ে দেয়। যে যার কর্মফল অনুযায়ী জবাব পেয়ে যায় সময়মত। এর জন্য ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হয়।

ভাবনা: তিনশো উনিশ।

……………………………………..

তুমি একসময় অনেক কষ্ট করেছ, না? অতো বলতে হয় না, লোকের নজর লেগে যায়! কিছু বোঝে না বোকাটা! যারা ওপরে ওঠে, সবাইই অমন করে। আচ্ছা, তুমি নেটে সবসময়ই আছো, অথচ তুমি আমার টেক্সটের উত্তর দিচ্ছ না। আমি জানি, তুমি আমার সাথে কোনও কন্টাক্ট রাখতে চাও না। আবার তুমি ওটা সরাসরি বলতেও পারছ না। কেন এমন কর? তুমি তো বলেছিলে, আমি তোমার ভাল বন্ধু। ওটা হয়ত তোমার অনেক ‘বলতে হয় বলে বলা’ কথাগুলির একটা, তাই না? ভাল। আমিও ভাবছি, তোমার সাথে আর কখনও কোনও ধরনের যোগাযোগ রাখব না।

তোমার কোনও পোস্ট এ প্রথম আমার খুব ভাল লাগল। সবচাইতে ভাল লেগেছে এই কথাটা— পোড়া রুটি কাউকে কষ্ট দেয় না, কিন্তু দুর্ব্যবহার দেয়। এটা পড়ার পর থেকেই কেমন জানি অস্বস্তি লাগছে। আমি মনে হয়, একটা অন্যায় করে ফেলেছি। আমি সত্যিই আমার দুর্ব্যবহারের জন্য দুঃখিত ও অনুতপ্ত। তুমি নিজগুণে আমায় ক্ষমা করে দিয়ো, কেমন? আর তোমার বাবার প্রতি রইল আমার অনেক দোয়া আর ভালোবাসা।

তোমার সাথে কথা বলা দরকার। খুব জরুরি! হয় তুমি আমার নাম্বার আনব্লক করো, কিংবা এখানেই রেসপন্স করো। খুবই আর্জেন্ট! তোমার কাছে ক্ষমা চাওয়াটা খুব জরুরি। প্রমিজ করছি, তারপর থেকে আর তোমাকে জ্বালাব না। কখনওই না! সত্যি বলছি। প্লিজ উত্তর দাও। তোমার মোবাইল দেখছি বন্ধ। মোবাইল বন্ধ করে রাখার দরকারই বা কী?

হয়ত তুমি কিছুই বলবে না। আমিও আর জেগে থাকতে পারছি না। আমি কিন্তু তোমাকে প্রচুর ভুলভাল বলেছি। আমার সব কথাই ধরে বসে থেকো না যেন! কী বিশ্রী ব্যাপার, বলো তো! এর চাইতেও বিশ্রী ব্যাপার হল, আমি তোমার প্রেমে পড়ে গেছি! তোমার মত পাবলিক ফিগারদের প্রতি সাধারণ কোনও মেয়ের ফিলিংস আসাটাও অন্যায়। জানি। কিন্তু কী করব, বলো, হৃদয় তো আর জানে না! আসলে আমি তোমার লেখা পড়তাম। সুন্দর গল্প লিখ তুমি। কিন্তু শেষ লেখাটা পড়ার পর থেকেই প্রচণ্ড অনুশোচনা শুরু হল। তুমি নিশ্চয়ই কষ্ট পেয়েছ, নইলে অমন করে লিখতে না। এরপর থেকে কলের পর কল করেই যাচ্ছি। মোবাইল টোটালি অফ তোমার! গড! কেন যে এই তীব্র অনুশোচনার কথা মাথায় থাকে না যখন অন্যায় করি তখন! অন্যায় করার সুখ এড়িয়ে যাওয়া সত্যিই খুব কঠিন!

এই পচা ছেলে! তুমি আছো? অবশ্যই আছো! ফেসবুক আর তুমি একে অন্যের পরিপূরক। কাল মেজাজ খারাপ করে ফেসবুক থেকে তোমার সব টেক্সট মুছে দিয়েছি। সরি। একটা উপকার অবশ্য হয়েছে, আমার দিক থেকে একদম নতুন মানুষের মত তোমার সাথে কথা বলতে পারছি। আগের কোনও চ্যাট রেফারেন্স নেই! মজার না? এখন আমি চাইলেই তোমাকে এই ভার্চুয়াল জগতে ততটা সিরিয়াসলি নাও নিতে পারি! তুমি এখন আর আমার কেউ নও। তোমার সাথে আর আমার মুখের বা মুখোশের কোনও সম্পর্কই নেই। এখন তুমি আমার এক্কাদোক্কার সাথী। পুরোই পিউর! তুমি আমাকে অনেক বড় শিক্ষা দিয়েছ। তোমার লেখা বা কথা, কোনওটা থেকেই নয়, তোমার আচরণ থেকেই আমি যে শিক্ষা নিয়েছি, তা হল, ভার্চুয়াল জগতের সাথে বাস্তবের জগত কখনও মেশাতে হয় না। দুই জগত দুই রকমের। এক করে ফেললেই মহা গণ্ডগোল! তুমি আবার আমার কথায় কিছু মনেটনে কোরো না কিন্তু! কোনও উত্তর দেয়ারও দরকার নেই। আসলে প্রচণ্ড মাথাব্যথা করছে। কোনও কারণ ছাড়াই এমনি বকরবকর করছি।

তুমি কিছু করনি, তোমার কোনও দোষ নেই, তুমি না আমার ডার্লিং, আমার সুইটহার্ট, আমার আদুরে সোনা, তুমি কি কিছু করতে পারো, বলো? কিন্তু তুমি আসলে অনেক কিছুই করেছ। তুমি আমার অন্তরের শান্তি কেড়ে নিয়েছ, আমার মনোজগতে বিশাল জায়গা করে নিয়েছ, আমাকে একজন ঈর্ষান্বিত নারীতে পরিণত করেছ। ভালোবাসা একটা বোকাবোকা টাইপ মেয়েকেও হিংসুটে মেয়ে বানিয়ে দেয়! আসলে ভুলটা আমারই। আমি তোমাকে অন্য দশজনের মতই ভেবেছিলাম। কী করব, বলো! তোমার মত আইটেম, চিড়িয়া তো আগে কখনও পাইনি। আগে পাইলে নাহয় একটু খেলাধুলা করা যেত, প্র্যাকটিসটা থাকত, তোমাকেও ভাল করে ট্যাকল্‌ করতে পারতাম। আমার জীবনে যারা এসেছে বা আসতে চেয়েছে, তারা ভালোবাসা বা প্রায়-ভালোবাসার জন্যই এসেছে, কেউই কামের মোহে আসেনি। যারা ওটা চায়, তারা তো আমায় দেখলেই বুঝে ফেলে, আমার কোনও কিছুই যে ওরকম নয়! আমি ওদের কিছু দেয়ার মত নই। তুমি কেন বোঝোনি, পচা ছেলে?

তুমি যখন আমায় মেসেজ পাঠাতে, ফোন নাম্বার চাইতে, দেখা করতে চাইতে, তখন আমি তো খুশিতে আটখানা! ভেবেছি, আমার প্রতি তোমার স্পেশাল কোনও ফিলিংস আছে। তোমার মনে আছে, আমি কিন্তু প্রথমে রাজি ছিলাম না। এরপর যখন নক্ষত্রবাড়ি গেলাম তোমাকে নিয়ে, তখন তোমার আচরণে আমার মনে হয়েছিল, তুমি আসলেই আমায় চাও। কিন্তু এরপর সিলেট থেকে ফেরার পর থেকে পুরোই কনফিউজড হয়ে পড়েছিলাম। ধীরেধীরে বুঝলাম, আমার ধারণায় গোড়া থেকেই গলদ ছিল। আমি কিন্তু জানতাম না যে তোমার এতো ফলোয়ার। ভেবেছিলাম, বড়জোর হাজার দেড়েক হবে। পরে দেখলাম, তুমি রীতিমত রেড সিগন্যাল লাগানো বান্দা!

আমি তোমাকে দোষ দিচ্ছি না। এতো চয়েজ থাকলে যে কারওরই মাথা আওলা হয়ে যায়! আমারও চারপাশে এতো ছেলে ঘিরে থাকলে নিজেকে কুইন এলিজাবেথ মনে হত। এটা বোঝার পর থেকে আমি তোমাকে হাল্কাভাবে নেয়ার চেষ্টা করেছি, এখনও করছি। কিন্তু সমস্যাটা অন্য জায়গায়। তোমাকে যতই হাল্কাভাবে নেয়ার চেষ্টা করছি, ততই তোমার প্রতি আমার প্রেম বেড়ে যাচ্ছে। তোমার সামান্য অবহেলা বা সন্দেহজনক কিছুও আমার সামনে তিনগুণ আকারে এসে হাজির হচ্ছে, ফলে আমার খারাপলাগাও তিনগুণ হয়ে যাচ্ছে। আমি আবারও সন্দেহ বাতিকগ্রস্ত হয়ে পড়ছি। আমি খুব ভাল করেই জানি, এর কোনও মানেই নেই। আমি তোমাকে তোমার বাইরের মানুষ রেজভী আখন্দ হিসেবে নয়, তোমার ভেতরের মানুষ রেজভী হিসেবেই সবসময় জেনেছি ও চিনেছি। তুমি কখনওই আমার কাছে রেজভী আখন্দ ছিলে না, কেবলই রেজভী ছিলে। এটাই প্রবলেম।

এখন থেকে আমি তোমাকে রেজভী নয়, রেজভী আখন্দ হিসেবেই ট্রিট করব। তোমার লেখায় ওয়াও, আহ্‌, আহা, উহ্‌ লিখেলিখে খুব সুন্দরসুন্দর কমেন্ট করব। আমিও তোমার একটা ফ্যান হয়ে যাব—খুবই শক্ত ফ্যান, যার পাঙ্খা কারেন্ট চলে গেলেও কক্ষনো বন্ধ হবে না! তোমাকে আর কখনও নিজের মত করে ভাবব না। আজ এই পর্যন্তই। অনেক বকরবকপকরপক করে ফেললাম। টাটা।

কত যে তোমায় ভালোবাসি, প্রিয়, জানলে না তা তুমি কখনও।

তোমার অলস অঙ্গচালন জাগায় মায়া মনোশরীরে………

ওষ্ঠে আমায় করো চুম্বন, পোড়াও তোমার প্রেম-অনলে,

হোক তা রাতে কিংবা ভোরে—ডুবাও আমায় যেমন খুশি

তোমার গভীর নেশার ঘোরে।

এই যে লেখক সাহেব! বললেন নাতো আমার ইনস্ট্যান্ট পদ্যটা কেমন হল! সবসময় নিজের লেখা নিয়ে থাকলে হবে? আমার মত ক্ষুদ্র মানবীও তো দ্য গ্রেট রেজভী আখন্দের দাক্ষিণ্য, সমালোচনা আশা করতেই পারে!

ভাবনা: তিনশো বিশ।

……………………………………..

এক।

মা মাঝেমধ্যেই বাবাকে মন্ত্র নেওয়ার কথা বললে তার উত্তরে বাবাকে একটা কথাই বলতে শুনেছি—আমি নাস্তিক নই, তবে যতদিন আমার বাবা-মা বেঁচে আছেন, আমি তাদের নামই করতে চাই।

তখন কথাটা শুধু শুনতাম। এখন উপলব্ধি করতে পারি।

আরও একটা কথা বাবা বেশ বুক ফুলিয়ে বলত: আমার ছেলেমেয়েরা তো দেখছে তার বাবার আদর্শকে…..তারাও নিশ্চয় এ পথে চলার চেষ্টা করবে।

কাউকে কোনও কিছু না বলেই বাবা অকালেই হঠাৎ চলে গেলো না-ফেরার দেশে। তখন আমার অনার্স ৩য় বর্ষের ফাইনাল চলছে, আর ছোট ভাইটার এইচএসসি’র টেস্ট। তারপর ঝড়ের বেগে বছরটা পার হয়ে গেল। মা তার ছোট্ট একটা চাকরি আর বাবার অল্প কিছু পেনশনের (বাবার চাকরির বয়স ২৫ বছর হয়নি, তাই হাফ-পেনশন) টাকা দিয়ে সব ঋণ-দেনা শোধ করে ভাড়াবাসায় থেকে দুটো ছেলেমেয়েকে শহরে রেখে পড়ানোর আরেক সংগ্রাম শুরু করল। কিন্তু আজ আমার মনে হচ্ছে, যে মানুষটা কখনো একা থাকতে পারতো না, যে কখনো একদিন বাজারে গিয়ে নিজের একটা শাড়ি পর্যন্ত কিনেনি, বেতন পেলে সোজা এসে বাবার কাছে দিয়েছে, আজ আমি তার সন্তান হয়ে কী করছি? নিজের ক্যারিয়ার, নিজের ভবিষ্যতের ভাবনা ভেবে শহরে পড়ে আছি! কী স্বার্থপর আমি! ইদানিং মাঝেমাঝে ভাবছি, একছুটে চলে যাই মার কাছে! মা’ও যদি হঠাৎ চলে যায়, আর কখনো নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না।

এই তীব্র মানসিক যন্ত্রণার নামই বোধহয় জীবিকার কাছে জীবনের নির্মম পরাজয়ের বেদনা। এ থেকে মুক্তির কি কোনও উপায়ই নেই?

দুই।

কারও-কারও কান আছে, মাথা আছে। ওরা কথা শোনে, বোঝে।

কারও-কারও শুধুই কান আছে। তাই, ওরা কানকথা শোনে।

চাকরির অন্যতম গোল্ডেন রুল: বসের সাথে অভিমান করা যাবে না। সব অভিমান জমিয়ে রাখতে হবে প্রেমিকার জন্য।

ঝাড়ি অবিনাশিতাবাদ সূত্র মেনে চলে। ঝাড়ির কোনও সৃষ্টি নাই। ঝাড়ির কোনও বিনাশ নাই। ঝাড়ি এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় রূপান্তরিত হয় মাত্র।

ঝাড়ি বিভব শক্তির সূত্রও মেনে চলে। ঝাড়িতে সঞ্চিত বিভব শক্তি, ঝাড়ি যে উচ্চতা থেকে পতিত হয়, তার সমানুপাতিক। এক্ষেত্রে ঝাড়িদাতা এবং ঝাড়িহজমকারীর ওজন কিংবা গ্র্যাভিটি কোনও ভূমিকা রাখে না।

মনে রাখবেন, আপনি অফিসে ঝাড়ি খাওয়ার জন্য আপনার পরিবার দায়ী নয়। তাই আসুন, ঝাড়ি খাই, ঝাড়ি দিই। শান্তিতে চাকরি করি, সংসার করি।

জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ।

অফিসে বস্, বাসায় বউ।

হে ধরণী! দ্বিধা হও, আমি গাছে উঠি!

. . . . . . . ডেডিকেটেড টু দ্য ম্যারেড্ ফ্রেন্ডস্

তিন।

একটা জরিপে দেখা গেছে, নার্সদের মতে, মৃত্যুশয্যায় যে ৫টি অনুশোচনা মানুষ সবচে’ বেশি করে থাকে:

১. ইস্! যদি নিজের জন্যে আরও একটুখানি বাঁচতাম—শুধু অন্যদের জন্যে না বেঁচে!

২. এতোটা পরিশ্রম না করলেই তো পারতাম!

৩. নিজের অনুভূতিগুলোকে যদি নিজের মধ্যে অতটা লুকিয়ে না রাখতাম!

৪. বন্ধুদের সাথে যদি আর একটু সময় কাটাতাম!

৫. যা যা করতে ভাল লাগতো, আরও একটু বেশি বেশি করতাম!

আসুন, আরও একটুখানি বেঁচে বাঁচি—আফসোস ছাড়া……মৃত্যুর আগেই!

চার।

মান্না দে৷ কণ্ঠের জাদুকর৷ বাঙালির বড়ো আদরের ধন৷ বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু৷ ভাল-লাগা এবং ভাল-না-লাগা অনেক মুহূর্ত কাটিয়েছি তাঁর নিবিড় সান্নিধ্যে৷ তাঁর গানে শান্তি খুঁজেছি কতোকতো বার! তিনি শিখিয়েছিলেন, ইট, ড্রিন্ক এ্যান্ড বি মেরি, এর বাইরেও জীবন আছে—সহজ আনন্দের জীবন, সরল সত্যের জীবন, সুন্দর মুহূর্তের রোমন্থনের জীবন; দিয়েছিলেন জগতের আনন্দযজ্ঞে সুরের নিমন্ত্রণ৷ আমার শিখরস্পর্শী অনর্থক অহমিকাগুলো তাঁর বিশালত্বে চূর্ণবিচূর্ণ হয় প্রতিনিয়তই৷

প্রতিদিনের এই পুরনো বেঁচেথাকায় যেটুকু ফাঁক থেকে যায়, তা পূর্ণ করে দেয়ার মানুষটি আজ চলে গেছেন না-ফেরার দেশে৷ কিছুকিছু মানুষকে চিরকাল বেঁচে থাকতে চিরকাল বাঁচতে হয় না৷ সঙ্গীতে তাঁর অনন্য অমূল্য উপহার কিংবদন্তীতুল্য শ্রেষ্ঠত্বে বেঁচে থাকবে চিরকাল৷ সেই নিভৃত দেশে ভাল থেকো হে মহান শিল্পী৷ তোমার সকল শব্দ অন্য সব শব্দ যখন ঘুমিয়ে পড়ে নিস্তব্ধ নিশ্চিন্তে, তখনও ছড়িয়ে পড়বে সমস্ত মন-প্রাণ-হৃদয় জুড়ে; সবসময়ই৷

পাঁচ।

দিনগুলো কেমন কাটছে?

দিনগুলো? ও আচ্ছা! এইতো, কেটে যাচ্ছে…….কেটে যায়৷

খুব বিজি নাকি ইদানীং?

আরে নাহ্! বিজি কেউ থাকে নাকি সত্যিসত্যি? ব্যস্ত থাকার অভিনয়ই তো করে বেশি৷ একটু ঠিকমতো বেঁচে থাকার মতো সময় তো থাকেই!

ছয়।

যখন আপনি আপনার বসের সামনে আপনার কোনও কলিগকে সামনাসামনি বড়বড় কথা শোনান কিংবা উনার আড়ালে গীবত করেন, তখন আপনি প্রায়ই ভুলে যান, আপনি যতই বসের আস্থাভাজন হোন না কেনো, শেষ পর্যন্ত আপনার বস বস-ই থাকবেন, কিন্তু আপনার কলিগ আপনার কাছ থেকে দূরে সরে যাবেন। এসব ক্ষেত্রে সাধারণত বুদ্ধিমান বস মনেমনে আপনার সম্পর্কে খুব একটা ভাল ধারণা পোষণ করেন না। এই ধরনের ছেলেমানুষি আপনার জন্য অভিনব হতে পারে, উনার জন্য নয়। উনি এতে অভ্যস্ত বলেই উনি বস। নিজে বড় হয়েও তো বড় হওয়া যায়, অন্যকে ছোট করে বড় হয় তো দুর্বলচিত্তের মানুষরা।

সাত।

ইদানীং মাঝেমাঝে অনেক স্মার্টলি চিন্তাভাবনা করেও বলদের মতো কাজ করে ফেলি। খেয়াল করে দেখলাম, চেহারাতেও একটা বলদবলদ ফ্লেভার চলে আসছে আস্তেআস্তে। বলদের মতো কাজ করে ফেলাটা ভয়ানক রকমের অস্বস্তিকর। সারাদিনে, এমনকি কয়েকদিনেও এই অস্বস্তি সহজে কাটে না। লোকজনকে বলদ ভাবা কমাতে হবে। জেনুইন বলদ সম্প্রদায়ভুক্তদেরকেও আর বলদ ভাবা যাবে না। প্রত্যেকেই বোধহয়, কোনও না কোনওভাবে একটু-আধটু বলদবলদ টাইপের। কেউকেউ একটু বেশি বলদ, কেউকেউ কম। সময়েসময়ে সবাই-ই বলদ!

ভাবনা: তিনশো একুশ।

……………………………………..

আমার গল্পের শুরুটা এমন………এক ছেলের সাথে আমার রিলেশন হল। সে ছেলের কিডনিতে সমস্যা, বাবা তার সাথে কোনও কথাই বলে না, ছোটো থেকে খালার কাছে মানুষ। এসব শুনেশুনে তার প্রতি আমার এক ধরনের সহানুভূতি জন্মে, যা থেকে একসময় তার প্রতি এক ধরনের প্রেমের অনুভূতি তৈরি হয়। তার জীবনে আমি ছাড়াও আরও অনেকেই আছে। কখনও আমার কাছে ধরা পড়লেই মাফ চায়, আমার মাথা ছুঁয়ে শপথ করে, আর এমন হবে না। আমি ক্ষমা করে দিই। আবারও ধরা খায়। আবারও আমি মহত্ত্ব দেখাই। একে বলে মেয়েমানুষের বেহায়াপনার মহাদুষ্টচক্র! এ থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কী? মেয়েরা কিন্তু বোঝে সবই! কিন্তু ওই যে………বেহায়া!

যা ঘটছে, তা তো বলেই দিলাম! এখন একটু ভেঙেটেঙে বলি। প্রেমের বয়স তখন ৩ মাস, হঠাৎ করেই ও বলল, আর রিলেশন রাখবে না। এবং, সেটা কোনও কারণ ছাড়াই! আমরা ক্লাসমেট। একই ডিপার্টমেন্টে পড়ি। সামনে সেকেন্ড ইয়ার ফাইনাল। ওর কথা শুনে পাগলের মত হয়ে গেলাম। ওর বন্ধুদের ফোন করেকরে কাঁদতাম, ও ফোন ধরত না, তাই। ওরা অনেকেই খুব বিরক্ত হত। কিন্তু আমি কী করব! আমি তখন খুবই একা। অ্যাডমিশন টেস্টে একটাও পাবলিক ভার্সিটিতে পড়তে না পেরে বন্ধুবান্ধবদের কারও সাথেই লজ্জায় কোনও যোগাযোগ করতাম না। ওদের বেশিরভাগই পড়ে পাবলিক ভার্সিটিতে। কোথাও চান্স না পেয়ে কাঁদতে-কাঁদতে ঘুমাতাম, ঘুম ভেঙে গেলে আবারও কাঁদতাম, এরপর আবারও ঘুমিয়ে পড়তাম। এরই মধ্যে ওর সাথে পরিচয়, এরপর প্রেম। ওর ওপর ভীষণ ডিপেন্ডেন্ট হয়ে গিয়েছিলাম। সে-ই মানুষটি বলে কিনা কোনও কারণ ছাড়াই এভাবে চলে যাবে! মেনে নেয়া যায়? কী ভীষণ কষ্ট! পাগলের মত দিনরাত কাঁদতাম। খেতে পারতাম না। ঘুমের মধ্যেও কাঁদতাম। ও সবই জানতো। সত্যি বলতে কী, ওকে এসব জানানোর একটা চেষ্টা আমিই করেছিলাম, এই আশায়, জেনে যদি ফিরে আসে!

এইভাবেই সেকেন্ড ইয়ার পরীক্ষা চলে এলো। পড়তে পারতাম না। পড়তে বসলেই মনে হতো, পরীক্ষার হলে তো ওর সাথে দেখা হবে! তখন কী হবে? আমি তো ওকে দেখলে ঠিক থাকতে পারব না। প্রথম পরীক্ষার দিন দেখা হলো। ও আমার সামনে এসে বললো ভালভাবে পরীক্ষা দিতে। তার আগের প্রায় ২০ মিনিট কিছুই লিখতে পারিনি। সে ভালভাবে পরীক্ষা দিতে বলার পর লিখতে পারছিলাম। ভাবলাম, সব বুঝি ঠিক হয়ে গেল! সে ছিল আমার একমাত্র সান্ত্বনা—তা যে এতটাই, আগে কখনও বুঝিনি। পরের পরীক্ষাগুলোর দিনে অপেক্ষায় থাকতাম। সে বুঝি আবারও আসবে। এসে বলবে, লিখ!………না, সে আর আসেনি।

পরীক্ষার মাঝে আমার আব্বা স্ট্রোক করে। আমরা ৩ বোন। আমি বড়। যে সংসারে ভাই নেই, সে সংসারের বাবা না থাকলে যে কী হবে, এমন দুশ্চিন্তার মধ্যে দিনগুলি কাটতে থাকল। এক আঘাতের উপর আরেক আঘাত পেলে মানুষ কিছুটা শক্ত হয়। আমিও হলাম। সামলে নিই নিজেকে। ওর চিন্তা মাথা থেকে কিছুটা দূরে সরিয়ে দিই। এ সময় নিজ প্রয়োজনেই পুরনো বন্ধুবান্ধবদের সাথে যোগাযোগ ঠিক করে ফেলি। এক বড় ভাই, যার কাছে অ্যাডমিশন কোচিং করতাম, তিনি খুব বুঝিয়েছিলেন এ বিষয়ে। থার্ড ইয়ারের ক্লাস শুরু হলে আবার ও কথা বলতে আসে। মাফ চায়। আমার বান্ধবীদের বলে, আমি যেন ওর সাথে একটু কথা বলি। ও ভুল করেছে, ও খুব অনুতপ্ত। আমার সামনে এসেও কথা বলতে চাইত। আমি কোনও উত্তর দিতাম না। ভয় পেতাম—ওকে নয়, নিজেকে। মনে হতো, একবার ওর সাথে কথা বলা শুরু করলে আমি আর সরে আসতে পারব না। অনেকদিন অনেক ভুলস্বীকার আর প্রতিজ্ঞার পরে ওকে ক্ষমা করি।

ভেবেছিলাম, সে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। কিন্তু কিছু মানুষ যে সব বুঝেও সারাজীবন ধরে ভুল করতেই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, তা তো জানতাম না।

বাসা থেকে বিয়ের জন্য খুব বলছিল। কিন্তু বাসায় কীভাবে ওর কথা বলব! ও বলল, ম্যানেজ করো। কেঁদেকেটে কোনওমতে ম্যানেজ করলামও। বাবার খুব আদরের মেয়ে তো, তাই সবকিছুই মেনে নিল। বাবা-মায়ের বিয়ের ১৬ বছর পর প্রথম সন্তানটাই যে আমি! আমি চাইলে অসাধ্যও সাধন করে ফেলবে আমার জন্য! অবশ্য, আমার চাওয়া বরাবরই কম। ওর কথা তো আর সরাসরি বলতে পারিনি, আমি শুধু বলেছিলাম, আমি এখন বিয়ে করব না, আমি পড়াশোনা করব। আমাকে খুব ভালোবাসে বলে আমার কথায় বাবা-মা রাজি হয়ে গেল। আর আমি কিনা ওর ভালোবাসার জন্য বাবা-মায়ের ভালোবাসাকে উপেক্ষা করে যাচ্ছি! আমাকে বাবা-মা এতো বিশ্বাস করে, আর আমি ওর সাথে প্রেম করে বেড়াই, পড়াশোনা একদমই করি না। আমার জন্য বাবা-মায়ের অনেক টেনশন। বোনদের ভবিষ্যৎ, বাবা-মায়ের স্বপ্নপূরণ…….এই সবকিছুর চেয়েও আমি ওকেই আমার নিশ্চিত ভবিষ্যৎ ভেবেছিলাম।

বাবাও এর মধ্যে একটু সুস্থ হয়ে উঠলো। মাঝেমাঝে ওর সাথে ঘুরতে যেতাম ক্লাস ফাঁকি দিয়ে। এমনি একদিন ঘুরতে গিয়ে হঠাৎ ওর ফোনে আবিষ্কার করলাম, ও অনেক মেয়েকেই প্রোপোজ করে, এমনকি আগের দিনই আমাদেরই এক ক্লাসমেটকে প্রোপোজ করেছে। ওর হাতটা তখন আমার হাতের মধ্যেই ছিল। আমি হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে কাঁদতে শুরু করি। সেসময় নিজেকে খুব অসহায় লাগছিল। ও তখন খুব করে বোঝায় যে ওটা আসলে জাস্ট ফান ছিল। একই ক্লাসে দুইটা প্রেম করবে, কেউ জানবে না? ও কি বোকা নাকি? ইত্যাদি, ইত্যাদি। কাঁদতে-কাঁদতে আমি একসময় ওর কথা মেনে নিই। আমাকে বিশ্বাস করানোর জন্য ও আমাকে ওর ফেসবুকের পাসওয়ার্ড দিয়ে দেয়। আমি চাইনি, নিজে থেকেই জোর করে দেয়। আমি ভাবি, হয়তো আমারই ভুল! ভালোবাসার মানুষকে এত অবিশ্বাস করলে চলে?

একদিন হঠাৎ ওর ফেসবুকে লগইন করি। দেখি ঠিকই দিয়েছে পাসওয়ার্ড। আমি নিশ্চিত হই। আবার অনুতপ্তও হই ওকে অবিশ্বাস করার জন্য আর ওকে না জানিয়ে সেদিন ওর আইডি’তে ঢোকার জন্য। এদিকে সে যে আমাকে পাসওয়ার্ড দিয়েছে, সেটা দেখি সে বেমালুম ভুলে বসে আছে। হয়তো সেদিন ঘোরের মধ্যেই দিয়েছিল, পরে আর মনে নেই। আরেকদিন। সেদিন আমার মনটা খুব খারাপ লাগছিল। ওর সাথে অনেকক্ষণ কথা বললাম। মন একটু ভাল হল। এরপর ঘুমাবে বলে ও ফোন রেখে দিল। এর ঘণ্টাখানেক পর ঘুম আসছিল না বলে সময় কাটাতে ফেসবুকে এসে ওর আইডিতে গেলাম কী মনে করে জানি। ঢুকেই দেখি, সে কিছুক্ষণ আগেই অ্যাক্টিভ ছিল। অথচ, ওর ঘুমানোর কথা আরও এক ঘণ্টা আগেই। ওর ইনবক্সে দেখলাম, আমাদেরই এক ক্লাসমেট আর তার বোনের সাথে চ্যাটিং। দুজনকেই ও বোন বলতো। তাদের সাথে কী নিয়ে কী জানি হয়েছে, সেখানে দেখি আমার প্রসঙ্গ এসেছে। ওই মেয়েদের ধারণা, আমি ওকে ওদের নিয়ে সন্দেহ করি। সে অবশ্য ওদের কথার প্রতিবাদ করে বলেছিল, আমি তাদের নিয়ে ওকে সন্দেহ করি না। তবে তারপর যা বলেছিল, তা পড়ে আমি অবাক হয়ে বারবার পড়ছিলাম। সে লিখেছিল, আমাকে সে আসলে ভালোবাসে না। শুধু আমার পাগলামির জন্য আমার সাথে ভালোবাসার অভিনয় করছে। এই কথাগুলোই ওখানে এতবার এতভাবে ঘুরেফিরে লেখা হয়েছিল যে নিজেকে নর্দমার কীটের চেয়েও ছোট মনে হচ্ছিল।

তখন আমাদের ইনকোর্স পরীক্ষা চলছিল। আমি পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগে ওই মেয়েকে বললাম, পরীক্ষার পর একটু দেরি করতে। পরীক্ষা শেষে ওই মেয়ে আর আমার বয়ফ্রেন্ডকে নিয়ে বসলাম। দেখালাম মেসেজগুলির স্ক্রিনশট। জিজ্ঞেস করলাম, এসবের কী দরকার ছিল? আমি তো নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছিলাম। আমার জীবনে আবারও আসার কী দরকার ছিল? কেন বারবার আমার সাথে এত মিথ্যাচার? ও কোনও উত্তরই দিতে পারেনি সেদিন। মেয়েটা কিছুক্ষণ থেকে এরপর ‘কাজ আছে’ বলে চলে যায়।

আমি ওর ফরম-ফিলাপের টাকা দিতে চেয়েছিলাম। এ ঘটনার পরেও টাকা দিই। ও আমাকে বারবার বোঝাতে চেষ্টা করে, আমি যা দেখেছি, তা ভুল। ওই মেয়েটার, যাকে সে বোন বলে, রাগ ভাঙানোর জন্যই ওসব বলেছে। অথচ পরদিন ডিপার্টমেন্টে ওই মেয়েটাই আমাকে ডেকে বলে, ও নাকি সত্যিই আমাকে ভালোবাসে না। আমি খুব কান্নাকাটি করি বলে জাস্ট অভিনয় করে যাচ্ছে।

এর আগেই ওর আমাকে বলা কিডনির সমস্যা ও পরিবারের সমস্যাজনিত কথাগুলো যে সবই মিথ্যে, তা জানতে পারি। ওর পরিবারে কিছু সমস্যা আছে, তবে সেগুলি অন্য সমস্যা। ও কখনওই ওর নিজের বা পরিবারের সম্পর্কে সত্যগুলি আমাকে জানায়নি। কথায়কথায় একের পর এক মিথ্যা বলত। প্রচুর সিগারেট খেত। অনেকবার আমার মাথা ছুঁয়ে ‘আর সিগারেট খাব না’ বলে প্রমিজ করার পরও খায়। সুযোগ পেলে মদও গেলে। কখনও-কখনও ড্রাগও নেয়। আগে এসব জানতাম না। পরে সব জানতে পারি। সব মিলিয়ে আমি আবারও প্রচণ্ড ডিপ্রেসড্‌ হয়ে পড়ি। কী হচ্ছে আমার সাথে, কেন হচ্ছে, কিছুই বুঝতে পারি না। হয়ত কখনও বোঝার চেষ্টাও করতাম না, অন্ধ আবেগের দাস হয়ে সারা দুনিয়ার কথা, নিজের মনের কথা ভুলে শুধু ওর কথাই বিশ্বাস করতে চাইতাম। তবে কিছু ঘটনার কারণে ওর প্রতি সন্দেহ জন্ম নেয়, এবং ওর ব্যাপারে বিভিন্ন সোর্স থেকে খোঁজখবর নিতে থাকি। আমি আবারও ওর কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিই।

এর মধ্যে থার্ড ইয়ারের পরীক্ষা শেষ হয়। ও আবারও আমাকে বোঝাতে থাকে। আমিও আবার ‘বুঝতে’ থাকি। ওর বার্থডের আগের দিন ওকে একটা শার্ট গিফট করি। ওর বন্ধুদের ডেকে রাত ১২টায় ওকে সারপ্রাইজ দেয়ার প্ল্যান করি। ওর বাসায় কেক পাঠানোর ব্যবস্থা করি। ১১টায় ও ফোন করে বলে, ও খুব টায়ার্ড, ঘুমাবে। আমার খুব মন খারাপ হল। ঘুমালে তো ফোনই ধরে না ও। উইশ করব কীকরে আমি? এত প্ল্যান করলাম! আগেরবার যখন আমি ওর কাছ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিই, তখন সে ফেসবুকের পাসওয়ার্ড চেঞ্জ করে ফেলে। কিন্তু আমার মেসেঞ্জারে ওর ওই আইডিটা লগইন করা ছিল। আমার আইডি লগআউট করে ওরটাতে ঢুকে দেখি, এক মেয়ের সাথে ওর তুমুল প্রেম চলছে। চোখের সামনে দেখছিলাম, আমাকে ঘুমানোর কথা বলে ওর সাথে চ্যাটিং করছে। তারই লাইভ প্রেমের স্ক্রিনশট তাকে তৎক্ষণাৎ পাঠালাম। আমার মাথা কাজ করছিল না। সে আমাকে ফোন করে কী কী যেন বলে ফোন অফ করে দিল। আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না যেন। বারবার ফোন করছিলাম জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানোর জন্য। কী যে হচ্ছিল আমার!………এখনও কী যে হচ্ছে!

সে ঘটনার পর নিজেকে শক্ত রাখতে খুব চেষ্টা করেছিলাম। ছিলামও, ৬ মাস। প্রতিদিন শ’খানেক ফোনকল আর মেসেজ দিত। বোঝাতে চাইত, ওটা একটা অ্যাক্সিডেন্ট ছিল। ওর সব টেক্সট আর কল ইজিব্লকে জমা হত। খুব ইচ্ছে করত কথা বলতে। কিন্তু তবুও বলতাম না। শেষে ও ওর মাকে ফোন করে অনেক কান্নাকাটি করাতে ওর মা-বাবা আমাকে ফোন দিয়ে খুব অনুরোধ করলেন উনাদের ছেলের সাথে কথা বলতে। আমি উনাদের বললাম, সে তো আরেকজনকে পছন্দ করে। উনারা তা বিশ্বাস করলেন না। হাজার হোক নিজের ছেলে তো! মা-বাবার কাছে সন্তানের সাতখুনও মাফ! আর এ তো সামান্য প্রেম! আমাকে উনারা খুব অনুরোধ করলেন ওর সাথে কথাবলার জন্য। আমি আবারও হার মানলাম—নিজের কাছে।

হয়ত আবারও এমন করে যাবে, আসবে, যাবে, আসবে………নয়ত একেবারেই চলে যাবে। এর শেষ কোথায়?

তার কিছু চাওয়া পূরণ করি না বলেই হয়ত সে অন্য জায়গায় ছোটে। আমি শুধুই মানসিক সম্পর্ক চাই, কিন্তু তার আবার কিছু বোনাসও চাই, মানে শরীরঘেঁষা সম্পর্কও তার চাই। সমীকরণ হয়ত এজন্যই মেলে না। আমি ওকে বিয়ে করতে চাই। ও যে কী চায়, আমি সেটাই বুঝতে পারি না।

কখনওবা ভাবি, হয়ত আমাদের বিয়েটা হবে না। কিন্তু মন তবু বিশ্বাস করতে চায় না। তবে এটা ঠিক, ও আমাকে ছেড়ে যাবেও না। তাতে যে সবাই ওকেই দোষ দেবে! বরং ও এমন পরিস্থিতি তৈরি করবে, যেন আমিই ওকে ছেড়ে চলে যাই। কিন্তু আমি তো যেতে চাই না। ও অন্য কাউকে সত্যিসত্যি ভালো বেসে ফেললে আমি খুশিই হব। নিজে কাউকে ভালোবেসে কষ্ট পেলে তখন অন্তত আমার কষ্টটুকু বুঝবে!

প্রিয় পাঠক, আপনি হয়ত বলবেন, সবই জানি, তো কিছু বুঝতে পারছি না, এটা বলছি কেন? আসলে মানুষ যখন নিজের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলে, তখনই হয়ত সে অন্যের কাছে সমাধান চায়। কিংবা, নিজের তৈরি সমাধানটা যখন তার মেনে নিতে কষ্ট হয়, তখন সে অন্যকে খোঁচায়। আমি খুব অর্ন্তমুখী স্বভাবের বলে কাউকে নিজের কষ্টের কথা বলতে পারি না। সবাই বরং ওদের যত কষ্ট, আমার কাছে এসে বলে। মনে করে, আমি খুব সুখী। আমি অবশ্য দেখাইও তা-ই! এতো কথা হঠাৎ কেন বলে ফেললাম, জানি না। হয়ত কিছু শুনতে চেয়েছিলাম, কিছু শক্তি চেয়েছিলাম। জানি, কেউ কোনও পরামর্শ দিয়ে আমার কনফিউশন কমিয়ে দেবে না। এ পৃথিবীতে নিজের লড়াইটা একা নিজেকেই লড়তে হয়!

ওর সাথে আমি আর কথা বলি না। এরপরও ও একদিন আমাকে অপমান করে ছোট্ট একটা বিষয় নিয়ে। যখনতখন মানুষের কাছে আমাকে ছোট করার অধিকার তো আমি কাউকে দিইনি। তবুও ও এটা করেই। সুযোগ পেলেই আমাকে লোকের কাছে ছোটো করে। ওকে ভালোবাসি বলে আমাকে অপমান করার সুযোগ দিই। আমার নীরব সম্মতি না থাকলে কারও বাপের সাধ্য নেই আমাকে অপমান করার! ভালোবাসা খুব বিশ্রীভাবেই সবকিছু সহ্য করিয়ে নেয়!

ভাবনা: তিনশো বাইশ।

……………………………………..

আসলে আমি একটা রিলেশনে ইনভল্ভড প্রায় ৫ বছর ধরে। আমার বয়ফ্রেন্ড মেরিন অফিসার। আমাদের পরিচয় হয় ফোনে কথা বলতে-বলতে। ও আমার নাম্বারটা পেয়েছিল আমার ফ্রেন্ডের কাছ থেকে। আমি এটা আগে জানতাম না। ও আগে থেকেই আমার সম্পর্কে মোটামুটি জানত, মানে, আমি কোথায় থাকি, কী করি, আমার ফ্যামিলি কেমন, এইসব। আমার ফ্রেন্ডের কাছ থেকেই এতকিছু জানতে পেরেছিল। ও ছিল আমার ফ্রেন্ডের বড় ভাইয়ের ফ্রেন্ড। আমি এসবের কিছুই জানতাম না। কিছুদিন আগে ওর সাথে কথাপ্রসঙ্গে জানতে পেরেছি। প্রথমে আমরা ফ্রেন্ড ছিলাম ছয় মাসের মত, এরপর আমরা রিলেশনে জড়াই। ও আমাকে প্রপোজ করে, ওর প্রতি কিছুটা দুর্বলতা থেকে আমি ওর প্রপোজাল অ্যাক্সেপ্ট করি। যখন আমাদের রিলেশনটা শুরু হয়, তখন আমি অনার্সে পড়ছি, ইংরেজিতে, ফিফথ সেমিস্টারে। সময়টা ২০১১। ও তখন মেরিন একাডেমী থেকে মাত্র পাস করে ক্যাডেটশিপ করতে জাহাজে যাওয়ার অপেক্ষায়।

ও অনেক বেশি রাগী আর জেদি। ও যেটা বলে, সেটাই রাইট, বাকি সব ভুল—এটাই ছিল ওর একমাত্র নীতি। প্রথম থেকেই আমাকে প্রচণ্ড ডোমিনেট করতো। আমি তখন ব্যাপারগুলি এতটা বুঝতাম না, তাই ওর কথামতই চলতাম। এভাবে চলতে-চলতে যখন সম্পর্কটাকে অনেক বেশি বোঝা মনে হল, তখন আমাদের রিলেশনের বয়স প্রায় ১ বছর, ও তখন জাহাজে, আমি অনেকটা বাধ্য হয়েই ওকে বললাম, আমি মনে হয় তোমার মত করে সবকিছু করতে পারছি না, আর পারবোও না হয়ত, তাই আমাদের এ পথচলার সমাপ্তি হলেই ভাল হয়। তখন ও জাহাজ থেকেই ফোন করে কান্নাকাটি করা শুরু করে, আমাকে নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করে, ইমেইলে জানায়, এটা শুনে ও অসুস্থ হয়ে গেছে। যে ফ্রেন্ডের কাছ থেকে আমার নাম্বার পেয়েছিল, ওকেও জানায়। এমনকি ওর জাহাজ থেকে ওর এক কলিগও আমাকে ইমেইল করে বলে, ভাবি, আপনি এমন করলে তো হাসানকে বাঁচানো যাবে না। সেসময় আমার বয়ফ্রেন্ড প্রমিজ করে যে, ও আর কখনওই আমাকে কোনও ব্যাপারেই চাপ দেবে না, কিংবা ডোমিনেট করবে না। ও আমাকে অনেক ভালোবাসে, আমাকে ছাড়া ও বাঁচবে না। ইত্যাদি, ইত্যাদি। আমি যদিও ওকে বারবার বলছিলাম যে ওর সাথে একসাথে থাকা আমার পক্ষে কষ্টকর, তবু আমার মনে ওর প্রতি অনেক মায়া কাজ করায় আমি রিলেশনটা রাখব না, রাখব না ভেবেও আবার রিলেশনে ফিরে যাই।

আমাদের রিলেশনটা কখনও ভাল যেত, কখনওবা মন্দ—এভাবেই চলছিল। কিন্তু ও অবচেতনভাবেই যা করতো, তা হল, আমার বেশি কেয়ার নেয়ার নাম করে অনেক বেশি ডোমিনেট করতে শুরু করল আবারও। আমার উপর অনেক মানসিক বোঝা চাপিয়ে দিত। ওকে এ ব্যাপারটা বোঝানোর চেষ্টা করেছি অনেকবার, ও প্রতিবারই উল্টো রাগ দেখাত আমার সাথে। আসলে ওর সাহস আর রাগ, দুইই মাত্রাতিরিক্ত। ওর সাথে আমি কখনওই রাগ করতে পারতাম না, যা রাগ আর জেদ, সবসময়ই ও করতো। রেগে গেলে আমাকেই নরম করে কথা বলেবলে ওর রাগ ভাঙাতে হয়—একদম সবসময়ই! এসব করতে গিয়ে আমাকে অনেক কষ্ট পেতে হয়। আমার ভার্সিটির কোনও ছেলে ক্লাসমেটের সাথে কথাবলা নিষেধ ছিল, যদিও আমি এমনিতেই কারও সাথেই তেমন কথা বলতাম না নেহায়েত প্রয়োজন ছাড়া। ওর কথা ছিল, প্রয়োজন হলেও কোনও ছেলের সাথে কথা বলা যাবে না। আমার এক ফ্রেন্ডের কাছ থেকে সবসময়ই খোঁজখবর নিত, আমি কী করি, কার-কার সাথে কথা বলি। আমার সে ফ্রেন্ড আমার সম্পর্কে যতটুকু জানতে পারতো, ওকে সবই জানাত।

আমি যদিও অনেক বেশি ভাল স্টুডেন্ট নই, তবু আমি আমার মত করে চেষ্টা করি রেজাল্ট ভাল করার। আমি পড়াশোনা নিয়েই আমার ক্লাসমেটদের সাথে কথা বলতাম। একজাম, ক্লাস, এসব নিয়েই সবসময় বিজি থাকতাম। আমি আমার পরিবারে সবার ছোটো। আমার দুই ভাইই আমার বড়। বড় ভাইয়া আর ভাবি দুইজনই ব্যাংকার, আর ছোটো ভাইয়া ইঞ্জিনিয়ার, ভাবি ডাক্তার, দুইজনই অস্ট্রেলিয়ায় থাকে। আমি পড়াশোনায় মনোযোগী হওয়ায় আর আমার কোনও খারাপ রেকর্ড না থাকায় আমার পরিবারের সবাই আর আত্মীয়স্বজনরা আমায় খুব পছন্দ করতো। আমার কোনও ব্যাপারে আমার পরিবার কখনওই আমাকে কোনও জোর করতো না। ওরা সবাই বিশ্বাস করে, আমি যা করব, তা ভাল কিছুই হবে, এবং আমি নিজেও সবসময় সে বিশ্বাসের মর্যাদা রেখে চলার চেষ্টা করেছি।

আর ওদিকে আমার বয়ফ্রেন্ডের আমাকে নিয়ে অতিভাবনা। আমাকে ফ্রেন্ডদের সাথে গল্প করতে দিতে নাকি ওর ভাল লাগে না, আমার পিকনিকে যাওয়া নিষেধ, এমনকি আমার অনার্স লাইফের র‍্যাগ-ডে’টা, যা অমন সুন্দর আর শালীনভাবে সম্পন্ন হল, ও আমাকে সেখানেও যেতে দেয়নি। আমি ওর সব কথায়ই নিজেকে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছি এই ভয়ে যে যদি ও আবার রেগে যায়! আমার মাঝেমাঝে মনে হত, ও ইচ্ছে করেই এসব করে! ও জানত, আমার ফ্যামিলি আমাকে কোনও কাজে বাধা দেয় না, আর আমিও বাধা দিতে পারে, এমন কোনও কাজ করতাম না……..তবুও, যা করলে কোনও সমস্যা হবে না, তাও সে আমাকে করতে দিত না। ওর দর্শন ছিল, মেয়েদের এতো স্বাধীনতা ভোগ করতে দেয়ার কী দরকার? স্বাধীনতা পেলে নাকি মেয়েরা খারাপ হয়ে যায়! আমার ফ্রেন্ডরাও আমাকে আলাদা নজরে দেখে, ভাল মেয়ে হিসেবেই জানে। অথচ, এইতো সেদিন ও আমাকে আমার এক ফ্রেন্ডের বিয়েতে যেতে দেয়নি। ও নাকি এসব পছন্দ করে না। আমাকে থ্রেট দেয়, বিয়েতে গেলে ওর সাথে আমার অশান্তি হবে।

আমি ওর সাথে রিলেশনে জড়িয়েছিলাম ওকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম বলেই, যদিও আমি জানতাম যে, আমার ফ্যামিলি এসব পছন্দ করে না, কারণ এসব জিনিস কেবল কষ্টই দেয়, আর জীবনে এসব প্রেম-ভালোবাসা টিকেও না। আমি জীবনে যা পেয়েছি, তা চাওয়ার আগেই পেয়েছি। আর কিছু না পেলে কখনওই তা পাওয়ার জন্য জেদ কিংবা রাগ করিনি। কিন্তু কেবল এই রিলেশনটার জন্যই আমি পরিবারের সবার বিরুদ্ধে চলে গেছি, সবাইকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। ও সবসময়ই জাহাজে-জাহাজে থাকবে, এটা আমার পরিবার পছন্দ করেনি। তাছাড়া ওর পারিবারিক অবস্থান, আর্থিক অবস্থা, শিক্ষাদীক্ষা, কোনওকিছুই আমাদের ফ্যামিলির সাথে যায় না বিধায় কেউই ওকে মেনে নিতে প্রথমে রাজিই ছিল না। আমি অনেক যুদ্ধ করে আমার পরিবারকে ওর ব্যাপারে রাজি করিয়েছি।

সব ঠিক আছে, কিন্তু আমি কিছু ব্যাপার নিয়ে খুব ভয় পাচ্ছি। ও আমাকে কখনও কোনও চাকরি করতে দেবে না, যদিও আগে বলেছিল, শিক্ষকতা করতে দেবে, আর এখন বলছে, তাও নাকি করতে দেবে না। আমার পরিবারে আব্বু আর ভাইয়ারা চায়, আমি বিসিএস, ব্যাংক, টিচিং কিংবা যেকোনও ভাল চাকরি করি। এটা শুনে ও বলে, চাকরি করতে হলে তো তোমাকে বাইরে যেতে হবে, আর বাইরের দুনিয়ার সাথে মিশেমিশে তুমি নোংরা হয়ে যাবে। বাইরে বের হলে তো তোমাকে লোকজনের গায়ে ধাক্কা মেরে চলতে হবে, পাবলিক ট্রান্সপোর্টে চরলে কত লোকের শরীর তোমার শরীরে লাগবে—আমাকে চাকরি করতে না দেয়ার পেছনে এরকম আরও হাজারো অদ্ভুত যুক্তি সে দাঁড় করিয়ে ফেলে সহজেই। আমি চাই চাকরি করতে, কারণ এতদূর পড়াশোনা করলাম, তাও একটা প্রমিনেন্ট প্রাইভেট ভার্সিটি থেকে, অনার্স কমপ্লিট করতে কত টাকা খরচ করেছি, আর আমার নিজের কোনও পরিচয়ই থাকবে না? আমি স্বাবলম্বী না হয়ে সারাজীবনই পরমুখাপেক্ষী হয়ে থাকব? আমার পরিবারের মানুষের জন্য আমি কিছুই করব না? আমার কোনও স্বপ্নই আমি পূরণ করতে পারব না?

আমি যদিও বোরকা পরে চলাফেরা করি, তবু নিকটাত্মীয়দের বাসায় কিংবা পারিবারিক অনুষ্ঠানগুলিতে ফুলস্লিভের সালওয়ার-কামিজ আর হিজাব পরে সুন্দর আর মার্জিতভাবে যাওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু ও খুব কড়াভাবেই জানিয়ে দিয়েছে, বোরকা ছাড়া একেবারে কোথাও যাওয়া যাবে না। আগে যদিও রাগের পাশাপাশি আমার জন্য অনেক ভালোবাসাও দেখাত, ইদানিং কেবল কঠোরতাই দেখায়। ও আমাকে জব করতে দেবে না, বাড়ি থেকে বের হতে দেবে না, কারও সামনে আসতে দেবে না, এসব কথা বারাবার বলতে থাকলে আমি বলি, আমার পরিবার তো আমাকে এতটা শাসন কখনওই করেনি, কই, আমি তো কখনও বখে যাইনি, জীবনে কোনও খারাপ কাজও করিনি, তবে তুমি কেন এরকম করছ? আমার উপর বিশ্বাস রাখতে পারো, আমি আগে যা করিনি, এখনও তা করব না। এসব শুনে ও বলে, আমি নাকি খারাপ ফ্রেন্ডদের সাথে মিশেমিশে বেশি কথা বলতে শিখে যাচ্ছি আর খারাপ হয়ে যাচ্ছি। আমি নাকি ওদের খারাপ দিকগুলি ফলো করছি।

ও আমাকে শাসিয়েছে এই বলে যে, আমি যদি চাকরি করি, তবে ও আমাকে ছেড়ে দেবে, যদি ওর কথামত না চলি, তাহলে এখন ও আমাকে ছেড়ে দিলেও ওর তেমন কোনও কষ্টই হবে না। আগে নাকি ওর বেশি মায়া লাগত আমার জন্য, এখন আর লাগে না। ইদানিং আমার সাথে রাগ করলে জেদের বশে আমাকে তুইতোকারি করা শুরু করে, অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে, আর আমার পরিবার ও আত্মীয়স্বজন নিয়েও অনেক বাজে কথা বলতে থাকে। তখন আমার খুব খারাপ লাগতে থাকে।………আবার ভালর সময় এই একই মানুষটাই খুব ভাল।

আম্মুর সাথে এসব ব্যাপার কিছুটা শেয়ার করতে শুরু করেছি, কারণ নিজে একাএকা আর নিতে পারছি না। তাছাড়া ফোনে আমার কথাবলার ধরন দেখলে আম্মুও কিছুটা আঁচ করতে পারে আমাদের ব্যাপারটা। আম্মু আমাকে প্রায়ই বলে, এখনও সময় আছে, ফিরে আসো, নইলে তোমার লাইফটা একদম কয়লা হয়ে যাবে। তোমাকে ও কাঠের পুতুল বানিয়ে রাখতে চায়। ও যেভাবে চাইবে, তোমাকে সেভাবেই নাচতে হবে। বিয়ের পর তো তোমার শ্বশুরবাড়ির লোকজনও এই অত্যাচারে ওর সাথে জয়েন করবে। আম্মু আরও বলে, আমরা সবাই মিলে তোমাকে কত বুঝিয়েছি, তখন তো আমাদের কোনও কথাই শোনোনি, আগে কত ভালভাল প্রপোজাল এসেছে আর আমরা কেবল ফিরিয়ে দিয়েছি, গত দুইটা বছর তুমি নষ্ট করেছ হেলায়—এর আগের সময়ের কথা বাদই দিলাম, তখন নাহয় তুমি পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত ছিলে। আমরা যেখানেই তোমাকে বিয়ে দিই না কেন, সবকিছু দেখেশুনেই দেবো, বিয়ের আগেই সব কথা ভেঙে নেবো, তোমার ভাল ছাড়া খারাপ কিছুই আমরা কখনও চাইব না, আমরা আমাদের সাধ্যমত চেষ্টা করব, আর বাকিটা তোমার ভাগ্য।

যদিও আমি খুব ভাল করেই বুঝতে পারছি, ওর কথার হেরফের হলে ও আমাকে যেকোনও সময়ই ছেড়ে চলে যাবে—এটা সে নিজেই প্রায়ই বলে, তবু চোখ বন্ধ করে এতদিনের মায়া, ভালোবাসা, অভ্যস্ততা ত্যাগ করে ফেলাটা খুবই কষ্টকর। আমাদের এ দীর্ঘ যাত্রায় অনেক খারাপ সময় ছিল, মানছি; কিন্তু কিছু তো ভাল সময়ও কেটেছে আমাদের দুজনের। তার মানে, ও যে সবসময়ই খারাপ, তা তো নয়!

আমার মাস্টার্সও এই ডিসেম্বরে শেষ হয়ে যাবে। আমার বয়ফ্রেন্ড এখন জাহাজে, আর কিছুদিনের মধ্যেই সে দেশে আসবে। তখন হয়ত আমাদের একটা ডিসিশনে আসতেই হবে। যদি ওকে বিয়ে করতে চাই, তাহলে ওর সব পছন্দ মেনে নিয়েই ওকে বিয়ে করতে হবে; নইলে ওর অন্য ভাবনা আছে।

ও যখন রুড বিহেভ করে, বকা দেয়, তখন আমি ওকে কিছুই বলি না, জাস্ট চুপ করে ওর সব কথা শুনে যাই। কারণ, ও যা-ই বলুক না কেন, সেটা জায়েজ আছে। কিন্তু একই কথাটাই আমি বললে তো মহাবিপদ হয়ে যাবে! আমি কিছু মুখ থেকে বের করলেই ও সাথেসাথেই সেটা মাথায় গেঁথে ফেলে। পরবর্তীতে সেটা বলেবলে আমাকে আঘাত করে। ওই সময় আমি মনেমনে বলি, নাহ্‌, আর থাকা যাবেই না, থাকলে তো বিপদ বাড়তেই থাকবে। আমার সাথে আমার পরিবারও অপমানিত হবে। ওকে বিয়ে না করে বরং আমার ফ্যামিলি দেখেশুনে যেখানে বিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, সেখানে বিয়ে করলেই ভাল হবে। এসব মাথায় আনি। কিন্তু ও একটু ভাল ব্যবহার করলেই কিংবা কোনও কাপল ভালোবাসার কথা বা গান শুনলেই আমার কেবল ওর কথা মনে পড়ে আর ওর কাছে একছুটে চলে যেতে ইচ্ছে করে। ওর জন্য আমার মায়া লাগে, কান্না চলে আসে। কী যে অসহায় অবস্থার মধ্যে বেঁচে আছি, বলে বোঝানো যাবে না। পড়াশোনাটা অতিকষ্টে ঠিক রেখেছি, বাকি সবকিছুই আল্লাহ্‌র ওয়াস্তে কেটে যাচ্ছে। জীবনের এই দোটানায় পড়ে আমার ভেতরটা ছিঁড়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে!