ভাবনাদেয়ালের পলেস্তারা (৬ষ্ঠ অংশ)

ভাবনা: ছত্রিশ।

……………………..

সবসময় ভাবতাম, যে কিনা জীবনভর আমার নিঃশ্বাস ছুঁয়ে থাকবে, তাকে অবশ্যই মনের মতো হওয়া চাই, যে আমাকে বুঝবে, যাকে আমি বুঝতে পারবো, আমার চোখে পড়েথাকা একটা চুলের একটু বেঁকে থাকার মানেটাও সে বুঝতে পারবে, তার কপালেপড়া একটা ভাঁজের অর্থও আমি বুঝতে পারবো খুব ভালোভাবে, আমার ভালোথাকার চিন্তাটুকুও আমি আর করবো না, করবে ও, ওরটাও আমি করবো, ও আমার সমস্তটাকে এতোটাই স্পর্শ করে থাকবে যে, পাশেথাকা ও, আর হাজারমাইল দূরেথাকা ও-এর মধ্যে কোনো পার্থক্যই থাকবে না, অনুভূতিতে সে থাকবে, থেকে যাবে সবসময় একইরকম, আমার চোখের কোণায় জল জমুক না জমুক, আমি কষ্টে থাকলে ও ঠিক বুঝে নেবে, (মনখারাপের খোঁজ চোখের জল দিয়েই জানান দিতে হবে না যাকে, সেই তো প্রকৃত ভালোবাসার মানুষ!) ওর আনন্দটুকু বোঝাতে ওকে হাসতে হবে না, আমি ওর চোখের দিকে তাকিয়েই বুঝে নেবো, কখনো একুশতলা বিল্ডিংয়ের ছাদের ওপর থেকে লাফ দিতে বললে দ্বিতীয়বার না ভেবেই লাফ দেবো, কারণ আমি নিশ্চিতভাবে জানবো, নিচে এমন কোনো ব্যবস্থা আছে যাতে লাফ দিলেও আমার কোনোকিছুই না হয়, সে আমার মুখে বিষ ঢেলে দিলেও, চেতন অবস্থার শেষ মুহূর্ত পর্যন্তও ঠিক বিশ্বাস করতে পারবো, তার কাছে আমার জন্য এই বিষটাই ছিল পৃথিবীর সবচাইতে ভাল অপশনটি, খেয়ে নেবো আর তার মুখটি জীবনের শেষ মুহূর্তটিতে মনে এনে নিশ্চিন্তে ওই পারে চলে যাবো…….

কিন্তু এই যে এতো-এতো আশা, এতো প্রত্যাশা, এর সব কিন্তু সেই মানুষটা ‘মনের মতো’ হওয়ার জন্য আর তাকে আমার সবটুকু দিয়ে ভালোবাসার জন্য। জানি, আমি তাকে চাইছি আমার নিজের মতো করে, তার মতো করে তাকে গ্রহণ করার স্বপ্ন আমি দেখছি না, এও এক ধরনের স্বার্থপরতা, কিন্তু আর কিছু যে মাথায় আনতে পারি না, আমার কী দোষ? আমি কী করবো? ভালোবাসায় অনেক কষ্ট, মায়া, বড় যন্ত্রণা! ভালোবাসা মনের ভেতর অনেক ধরনের চাহিদার সৃষ্টি করে, সময়ে-সময়ে ওগুলো পূরণ না হলে মনের ভেতরে ক্ষতের সৃষ্টি হয়, ভালোবাসা নিজের ভেতরের আমি’টাকে অনেকগুলি আমি’তে ভাগ করে দেয়, সেই আমিগুলি নিজেদের মধ্যে সারাক্ষণ ‘কার চাহিদাটা আগে চোখের সামনে চলে আসবে’ এই দ্বন্দ্বে লিপ্ত, জীবনের বাস্তবতায়, পরিস্থিতির চাপে কিংবা নিজের দোষে অথবা কেবলই খামখেয়ালিপনায়, মনের মানুষটা বদলে গেলে প্রচণ্ড যন্ত্রণা ওই ক্ষতটিকে আরো ছড়িয়ে দেয়…….যত প্রত্যাশা তত কষ্ট, যত ভালোবাসা তত যন্ত্রণা! খুব নাটকীয় শোনাচ্ছে, না? জীবনটা নাটক ছাড়া আর কী?

তাই প্রায়ই ভাবি, যেচে-যেচে, জীবনে এত কষ্ট বাড়িয়ে কী লাভ? এই তো নিজের সাথে নিজে বাঁচি এতোগুলি বছর ধরে, বেশ ভাল আছি তো!

এতো ভেবেটেবে কী হয়? হোক না জীবনসঙ্গী এমন কেউ, যার কিছুই আমার ভাল লাগে না, আমার কোনোকিছুই যার ভাল লাগে না! ছোট্ট একটা জীবন, ঝগড়াটগড়া করে কাটিয়ে দেয়া যাবে না? নাকি, একসময় আমি কিংবা ও সম্পর্কটা শেষ করে দেয়ার কথা ভাবতে শুরু করে দেবো?

যাকে ভালোবাসা যায় না, যার কাছ থেকে ভালোবাসা পাওয়ার আকুলতা থাকবে না, তার সাথে কীভাবে কেটে যায় জীবনটা? আশেপাশে কত জনকেই তো দেখছি ওরকম ভাবে জীবন কাটাতে! নাহয় অদেখাই থেকে যাক আমার চিন্তার পৃথিবীর বাইরের পৃথিবীটা, যে পৃথিবী রং বদলালেও কষ্ট পাবো না! আমি নেই যে পৃথিবীতে তার বদলে যাওয়ায় বা একই থেকে যাওয়ায় আমার কী এসে যায়? অজানা স্বপ্নের রঙিন পথটা একদিন আঁধারে আচ্ছন্ন হয়ে যেতে পারে, এমন আতংকের চাইতে জানা পৃথিবীর আঁধারের পথে আলোর প্রদীপ হাতে হাঁটাই তো ভালো, আলোটা নাহয় আমিই জ্বেলে নেবো!

ভাবনা: সাইত্রিশ।

……………………..

এখন, ভালোবাসার আগে প্রেম আসে, তারও আগে এসে যায় শরীর—এরই নাম, আধুনিক ভালোবাসা। ভালোবাসার টানে শরীরকে নয়, শরীরের টানে ভালোবাসাকে টানতে গিয়ে, ভালোবাসাটাই হারিয়ে যায়। মানুষ-মানুষীরা এখন, In love এ থাকে না, In a relationship এ থাকে; ওরা আরও খুশি হয়, It’s complicated সম্পর্কে জড়িয়ে থাকলে, কারণ, এটাতে, ভালোবাসাকে পূর্ণতায় বা পরিণতিতে নিয়ে যাওয়ার কোনো দায় থাকে না বললেই চলে। যাকগে, এসব ভেবেটেবে কোনো লাভ নেই। যদিও, কোনো এক দুর্জ্ঞেয়, রহস্যময় কারণে, অজানা অচেনা মানুষদের, যাদের কোনোকিছুতেই আমার কিছুই এসে যায় না, তাদেরও এসব কাজ অবলীলায় করে যাওয়াটা দেখে আমি রাতের পর রাত নিভৃতে কাঁদি। ভাবি, এক মুহূর্তের একটু উত্তেজনার কাছে, চিরন্তন সুখকে বারবার বিসর্জন দিতে, কারো কোথাও একটুও দ্বিধা নেই। এমন একটা পৃথিবীতে, আমার মতো মানুষদের বেঁচে থাকার ইচ্ছে না-থাকাটা স্বাভাবিক, থাকাটাই বরং অস্বাভাবিক। জানি, ভাল করেই বুঝতে পারি, আমি আমার পৃথিবীতে আমার মতো করে বাঁচি, ওরা ওদের পৃথিবীতে ওদের মতো করেই বাঁচে। একটা পৃথিবীর সাথে অন্যটির কোনো দ্বন্দ্ব নেই। দ্বন্দ্ব যা আছে, তার পুরোটাই, আমার মনে-মনে। আমি এসব ভেবে কষ্ট পাই, কাঁদি, কিন্তু কিছুই তো আর করার নেই। শুধু এইটুকুই চাই সৃষ্টিকর্তার কাছে, কেউই যেন ভুল মানুষটিকে, না জেনে, না বুঝে বিশ্বাস করে কষ্ট না পায়। যে মানুষ বিশ্বাস ভেঙে, ফেলে রেখে চলে যায়, সে আসলে বিশ্বাস করার যোগ্যই ছিল না। সেই ভুল বিশ্বাসটুকু মনে অনর্থক লালন করে কেউ যেন পরে কষ্ট না পায়। যে চলে গেছে, সে এমনিতেই সারাজীবন থাকত না, জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে ছেড়ে চলে যেত। অলীক সুখ কষ্ট ছাড়া আর কী-ই বা দেয়? তেমন সুখের আয়ু যতো কম হয়, ততোই তো ভাল। ভুল মানুষের সাথে জন্মহওয়া কোনো সুখস্মৃতিই কাউকে না কাঁদাক। প্রতারণা আর মিথ্যের সাথে সঙ্গমের স্থায়িত্ব বাড়তে না দেয়াই ভাল। যে বিশ্বাস আসে অভ্যস্ততা থেকে, ভালোবাসা থেকে নয়—সে বিশ্বাস কখনোই কষ্ট দেয় না। এমন বিশ্বাসের টিকে থাকুক না থাকুক, এতে কারো কিছু এসে যায় না। যাদের মধ্যে এ বিশ্বাসের বসতি, তারাও এ বিশ্বাস নিয়ে কোনো সংশয়ে থাকে না। তারা খুব ভাল করেই জানে, বোঝে, মানে কী হচ্ছে, কী হচ্ছে না। কিন্তু ভালোবাসা যে বিশ্বাসের জন্ম দেয়, সে বিশ্বাসে একবার বাঁচতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ার পর কেউই দিনের পর দিন সে বিশ্বাসের বদ্ধ ঘরে দম আটকে না মরুক। মৃত্যুর চাইতেও ভয়াবহ, বীভৎস সে মৃত্যুর আয়োজন।

ভাবনা: আটত্রিশ।

……………………..

আমি সত্যিই চাই না, পৃথিবীর ভালোমানুষগুলি কোনো অন্যায় করুক—করতে দিতে ইচ্ছে করে না—দরকার হয়, রাক্ষসীর মতো হিংস্র হয়ে মেরে ফেলতে পারবো ওদেরকে। আমার ইচ্ছেগুলি, আমার চাইতেও ভয়ংকর হয়ে ওঠে, সময়ে-সময়ে! আমার মনটাকে যদি ওদের শরীরে সেট করে দেয়া যেত, তবে ওরা বুঝতে পারত, কিছু নিরীহ সহজসরল মানুষের সাথে ওরা কতটা অন্যায় কাজ করেই যাচ্ছে। যারা অন্যায় করে, ওরা কি একটুও বুঝতে পারে, ওদের সাথে একই অন্যায়টা করা হলে ওদের কেমন লাগত? ওদের জীবনের সাথে জড়িয়েথাকা মানুষগুলির কী অবস্থা হতো? আর যদি সেই অন্যায়কারী যদি হয় এমন কোনো ভালোমানুষ যে না বুঝেই অমন অন্যায় কাজটা করছে, তবে সেটা ভাবতেও ভীষণ কষ্ট লাগে। আমি নগন্য কেউ হতে পারি, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, এসব নিয়ে আমার ভাবনাগুলি, কষ্টগুলি, কিছুতেই নগণ্য নয়। কত মানুষ কতভাবে ভাবে, জীবন কাটায়। কেউ বা কষ্টে নির্বাক, কেউ বা আনন্দে আত্মহারা, আর আমার মতো কারো-কারো অপরাধ—সে কেন ওই ব্যাপারগুলিকে সহজভাবে মেনে নিতে পারে না! সে অপরাধে, শরীরের দাবির কাছে, অসুস্থ কল্পনার ফানুসের ওড়াওড়িতে, প্রায়ই, সবরকমের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা হেরে যায়—হারে বলেই, জিতে যায়। একমাত্র হারলেই যে জিতটা, সে জিতের অভিন্নপ্রাণ বন্ধু বেদনা, যন্ত্রণা, একাকিত্ব, হতাশা, বিষণ্ণতা, নিরাশা। দূরে যাওয়ার চাইতেও, দূরে সরে যাওয়াটা মেনে নেয়া বেশি কঠিন। একাকি প্রহরের পর প্রহর, নির্ঘুম রাত, অস্থির সকাল—ক্লান্ত, অসহায়, কষ্টমাখা ক্লেদ আর লোনাজলে ভেজা…….এতকিছুর পরও, সকাল হলেই, সেই হেরে জিতেযাওয়া মানুষটির, ওই ভুল মানুষটিকেও পুরোনো অভ্যস্ততায় বলতে ইচ্ছে করে, শুভ সকাল……..তবুও—ভাল থেকো। এমনও হয়ে যায়, কখনো-কখনো, তার চোখজোড়া, পরম বিস্ময়ে, তার হাতের বেপরোয়া আঙুলগুলিকে টাইপ করতে দেখে, ওই পাঁচপাঁচটি শব্দশরীর! এরপর, সেন্ড বাটনটার সাথে তার ভেতরের দ্বৈতসত্তার যুদ্ধ চলে।

ভাবনা: ঊনচল্লিশ।

……………………..

চলেই তো যাচ্ছেন, না?—যান তবে। হায়, কী সহজ এই ভাবলেশহীন চলে যাওয়া! আরও সহজ, কাউকে কষ্ট দিয়ে, বোধশূন্যভাবে চলে যাওয়া। আমার কী দোষ ছিল, বলবেন? যে মানুষটি বেঁচেই আছে বিন্দু-বিন্দু কষ্ট জমে গড়া একটা মন নিয়ে, সে মানুষটিকে কষ্ট দিয়ে জিততে চাইলেন, মশাই? আপনাকে বীরপুরুষ ভাবতাম! আমার কষ্টগুলো যদি আপনার বাসের সাথে বেঁধে দিই!—তবে এতোটাই ভারি হয়ে যাবে যে, আপনার বাসটা, শতাব্দীর পর শতাব্দী, সেই একই জায়গায় আটকে থাকবে। আচ্ছা, ওরকম অন্যায় না করলেই কি নয়? অমন অন্যায় ছাড়া যারা বাঁচে, তাদের বাঁচাটা কি ভীষণ ভুল? জানি, হয়তো আপনি বলবেন, হ্যাঁ, আপনি সেই অন্যায়ে অভ্যস্ত; নয়তো বলবেন, আমি যা ধারনা করছি, তা ভুল। কিছুই তো বলেন না, আমি নিজে-নিজেই ইচ্ছেমত ভেবে নিই। আপনি এভাবে চুপ করে থাকতে পারেন না, কিছু তো বলুন। তবে একটা কথা, আপনি যেমন করে বলেন, সেটা আমি শুনবো না। হতে পারে, সেটা আপনার নিজস্ব স্টাইল, কিন্তু আমার শোনার স্টাইলটাও তো ভিন্ন হতে পারে—সেটাও আপনার মাথায় রাখা উচিত। আমি আপনার কথা যতটা না শুনতে চেয়েছি, আপনি তার চাইতে অনেকবেশি আমাকে তা শোনাতে চেয়েছেন—আজকে হুট করে সেকথা ভুলে গেলে তো চলবে না, মশাই! সরাসরি কথা বলা, আর রূঢ়ভাবে কথা বলা কিন্তু এক নয়। এটা আপনি নিশ্চয়ই জানেন, বোঝেন। আপনি সরাসরি কথা বলতে পছন্দ করেন—আমি জানি। তবে, আপনি যা জানেন না, তা হল, আপনি সরাসরি কথার ছদ্মবেশে রূঢ় হয়ে যান কারো-কারো সাথে। আমি সেই ‘কারো-কারো’ বিশেষ তালিকায় কোনো দৃশ্যমান বা বোধগম্য কারণ ছাড়াই পড়ে গেছি বলেই আমার এতো কথা বলা। হতে পারে, আপনার কাছে, আমি অতি নগণ্য একজন—আমাকে আপনি কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নন—আমি মেসেজ না পাঠালে, ফোন না করলে আপনার কিছুই এসে যাবে না। আমার ক্ষেত্রেও কিন্তু, সেরকমই। কাউকেই, অতোটা কেয়ার না করে বাঁচতে আমিও জানি। এটা শিখতে আমার অনেকদিন সময় লেগেছে ঠিকই, তবে, শিখেছি। অতো কষ্ট করে সে বিদ্যেটা রপ্ত করার পর, যখন বছরের পর বছর, সে বিদ্যে চর্চা করে দিব্যি বেঁচে আছি নিজের মতো করে, তখন, কেউ যদি হঠাৎই এসে তা ভুলিয়ে দেয় সুকৌশলে, এমনভাবেই যে, আমি ক্রমেই অভ্যস্ত হয়ে পড়ি নতুন সেই কৌশলটিতে, তবে কেন, একদিন, সে-ই আবার চাইবে, ওই যাদুকৌশল আমার উপর আর কাজ না করুক? এও কীকরে হয়? আমার মনে প্রায়ই আসে, আপনার ফোন থেকে আর টেক্সট না এলে আমার একেবারেই চলবে না, আপনাকে মেসেজ না দিয়ে থাকাটা অসম্ভব, আপনি এবং আপনার দৃশ্যমান ও অদৃশ্য সকল অস্তিত্ব আর অনস্তিত্ব—আমার জীবনে অনেক ভালোবাসায় আর মমতায় আদরযত্ন করে রাখা হয়ে গেছে। আপনি আমার জীবনে থাকবেন না—সেটা হতেই পারে না, যদিও, মাত্র কদিন আগেও, আপনি ছাড়াই আমার চমৎকার একটা জীবন ছিল, সে জীবনের সাক্ষী তো আমি নিজেই, এমনকি, আপনি নিজেও। যদি, এখন যেমন আছি, সেটার কথা লিখি, তবে বলবো, আমি আপনার সাথেই থাকব—কারণ, আমার কাছে, ‘এক’-এর মূল্যও অনেক—যদি সেই ‘এক’টা হন আপনি, যাকে আমার বাদ দিতে হবে। সরাসরিই বলছি আপনাকে, আপনার স্টাইল ফলো করে—আমি পারব না, সরি! কোনো এক মেসেজে, অনেকদিন আগে, (জানি, আপনার মনেও নেই সেই মেসেজের কথা) একবার বলেছিলাম আপনাকে এই কথাটা……জীবনে কেবল ভাল থাকতে চেয়েছি বলে যতটা অপদস্থ, অপমানিত হয়েছি, জানি না, সত্যিকারের খুব খারাপ কেউ, যে ওরকম নিগ্রহ আসলেই ডিজার্ভ করে, এতোটা অপমানিত হয়েছে কিনা। আমার চারপাশটা আমাকে এটা ভাবতে বাধ্য করে, যে যত বেশি খারাপ, তার সম্মান তত বেশি—কিচ্ছু করার নেই, পৃথিবীটা এরকমই হয়ে গেছে, চুপচাপ মেনে নাও! কাউকে কিছুতেই বোঝাতে পারি না, আমার একদমই ভাল লাগে না এসব। আমিও কিন্তু ভাল থাকতে চাই, তবে সে ভালোথাকাটা অন্য সবার ভালোথাকা নয়—আমার ভালোথাকা না থাকার একটা ব্যক্তিগত ব্যাকরণ আছে, আমি তার বাইরে কিছুতেই যাবো না। আপনার ব্যাকরণ আমার ব্যাকরণ এক নয়, তাও জানি। তবে এটা জানি না, কেন আপনি আমার ব্যাকরণে নিজেকে মানিয়ে নেবেন, এমন কথা দিয়েছিলেন। যে কথাটা রাখবেন না বা রাখতে পারবেন না, সে কথাটাও দিয়ে ফেলা, এটা কোন ধরনের ব্যক্তিত্ব? আপনি কেন ধরে নিয়েছিলেন, সবাইই আপনার মতো অন্য মানুষকে অবিশ্বাস করে বাঁচে?……রাত বাড়ছে…..সাথে, অদ্ভুত এক নীরবতা। জানেন স্যার, নীরবতাও কিন্তু চুপিচুপি কথা বলে……কখনো শুনেছেন সে কথা? দেখুনই না, একদিন একটু গল্প করে ওর সাথে! নৈঃশব্দ্যের আন্তরিক আলাপ যে কতটা মোহগ্রস্ত করে রাখে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত, সে খোঁজ পেয়েছেন কখনো? লোকে, কখনো-কখনো, একা আছে ভেবে কষ্ট পায়। আর আমি প্রায়ই, একা নেই ভেবে কষ্ট পাই। একা থাকার চাইতে একা হয়ে যাওয়ার কষ্ট অনেক বেশি। মানুষ হঠাৎ একা হয়ে গেলে আর একা থাকতে পারে না। আমি যে আবার একা হয়ে যাওয়ার জন্য আমার একাকিত্বকে বিদায় বলিনি! তাই, ভারি কষ্ট হয়—একা আছি বলে নয়, একা থাকতে পারছি না বলে! এক কষ্টেরই মানুষভেদে কত রূপ!

ভাবনা: চল্লিশ।

……………………..

একটা মেয়েকে দেখলাম, ড্রেসের চেয়েও লম্বা চুল তার। অমন চুল দেখলেই চুলাচুলি করতে ইচ্ছে করে—আমার যে অমন সুন্দর লম্বা চুল নেই, তাই! থাকগা! লাগবে না! আমার অতো চুল দিয়ে কী হবে? আমাকে তো আর কাউকে মুগ্ধ করে দেয়ার খেলায় নামতে হয় না কখনো, সে দায়ও নেই, আর তাছাড়া, আঙুরফলকে মিষ্টি বলবোই বা কেন? হিহিহিহি……….আমার কথা শুনে সবাই ভাবে, আমি বদ। কথা ঠিকই আছে, তবে, আমি খারাপ বদ না কিন্তু, ভাল বদ………. খারাপ বদ যে কী ভয়ংকর, আমি দেখেছি। খারাপ মানুষগুলোর মিথ্যে নোংরা ষড়যন্ত্রের মুখোশ একটা না একটা সময় ঠিকই খসে পড়ে, কিন্তু ততদিনে, ভাল মানুষগুলোর জীবন থেকে অনেকটা ভাল সময় যন্ত্রণায় কেটে যায়, সে সময়টা আর ফিরে আসে না। যন্ত্রণার কখনোই কোনো পূর্বাভাস থাকে না, পূর্বভাষও না—এটাই যন্ত্রণার সবচাইতে যন্ত্রণাময় দিক। যন্ত্রণার একমাত্র নিয়ম—যন্ত্রণা, বিনা নোটিসেই শুরু হয়ে যায়, আর বাড়তেই থাকে, কেবলই বাড়তে থাকে। যন্ত্রণা এড়িয়ে চলার কোনো পূর্বপ্রস্তুতিই নেয়া যায় না, যন্ত্রণা এসে পড়লে, শুধুই ভোগ করে যেতে হয়। এর মধ্যেও ভাল থাকতে হয়, ভালোথাকার অভিনয় করে যেতে জানতে হয়। আমার কাছে মনে হয়, এমনি-এমনি ভালোথাকা যায় না, ভালোথাকার জন্য চর্চা করতে হয়। আমি নিজে যদি জানি, আমি ভণ্ড, সারা পৃথিবী আমায় সাধু ভেবে আমায় ধুয়ে জল খেলেও কোনো লাভ নেই, কিন্তু আমি যদি জানি আমি সাধু, সারা পৃথিবী আমায় খারাপ বললেও আমার কিছুই এসে যাবে না। সত্য বড়ই নির্মম, কিন্তু মধুর চেয়েও অনেক মধুর—একবার সত্যতে অভ্যস্ত হয়ে গেলে, সে অভ্যস্ততা ব্যক্তিকে শক্তিশালী করে। জীবনটা অনেকসময়ই, যেটাকে অনেক বড় করে দেখায়, সত্যিকার অর্থে, তার প্রকৃত ব্যাপ্তি, অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে রেখে বুঝতে পারার মতো একটা ব্যাপার হয়।……..এবার থামি, উফফফ্‌! কীসব যে বকে চলেছি! থামলাম। একটা গান শোনাই…….উমমম্‌ না……..আবৃত্তি করি?……..করছি তবে……. “মনে করো, যেন বিদেশ ঘুরে মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে………” বাবা তো নেই, তাই, মা-ই সব! মাকে নিয়েই ঘুরে বেড়াই, মায়ের সাথে অভিমান করে গাল ফুলাই, এক মাকেই ভালোবাসি। আমার সকল স্বপ্ন আর দুঃস্বপ্ন—দুটোই মাকে ঘিরে। অথচ, এই মাও, কখনো-কখনো, কেমন জানি নিষ্ঠুর হয়ে যায়। সেদিন বাজার করতে গিয়ে বাসার মেইন দরোজার আর নিচের গেইটের চাবি হারিয়ে ফেললাম। গত সাত বছরে আমি যে চাবিটা কোনোদিনই হারাইনি, সেটা আমার কোনো ক্রেডিট ছিল না, কিন্তু, মনের ভুলে একদিন যে-ই হারিয়ে ফেলেছি, অমনিই সেটা ডিসক্রেডিট হয়ে গেল!—হায়! জীবনটা এমনই! এক মুহূর্তের ভুলও, হাজার মুহূর্তের কৃতিত্বকে একেবারে ম্লান করে দেয়।……..আপনার একটা ছবি দেখলাম এইমাত্র! আহা আহা! কী ঢং! পুরুষমানুষের ঢং দেখলে গা জ্বলে যায়! খুব সুন্দর খুব সুন্দর! মরি মরি! একটা বিশ্রী রকমের সুন্দর উইপোকা কোথাকার….! আমার মাথাটা খেয়ে একাকার করে দিল! এখন এই পোকায়খাওয়া বাতিল মাথা লইয়া জাতি কী করিবে? এমন অপূর্ব লাবণ্য কোন ক্রিমে আসে গো? চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে—ওরে, তোরা কে কোথায় আছিস—আমারে কেউ একটু ধর! ধইরা, মরুভূমির জলে চুবাইয়া মার! এই দুর্বল চর্মচক্ষে এতো সৌন্দর্য ক্যামনে সহ্য করি? ক্যামনে ক্যামনে ক্যামনে???

ভাবনা: একচল্লিশ।

……………………..

একদিন দুপুরে। কবরস্থানের পাশের রাস্তা ধরে বাজারে যাচ্ছি। হঠাৎ মনে হল—কেমন হতো, যদি ‘মৃত্যু’টা প্রমাণিত সত্য না হতো? আমরা শুধু এইটুকুই জানতাম যে, একদিন মরতে হবে—কিন্তু তার কোনো প্রমাণ থাকতো না, এটা কেবল বিশ্বাসের উপর নির্ভর করতো। আমাদের সামনে মৃত্যুর কোনো দলিল নেই, কিন্তু আমাদের হৃদয়ে মৃত্যুর অস্তিত্বের ব্যাপারে এক ধরনের গভীর বিশ্বাস আছে—এমনকিছু একটা। এই যেমন, আমরা বিশ্বাস করি, পাপ করলে মানুষকে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে, পরকাল বলে একটা অধ্যায় আছে, জান্নাত আছে, জাহান্নাম আছে, মৃত্যুর পর আবার মানুষকে পুনরায় জাগানো হবে, ভোগ করতে হবে অসীম সুখ কিংবা তীব্র যন্ত্রণা—বেঁচে থাকার সকল কায়দাকানুনের নির্ভুল নিরাবেগ মাশুল গুনতে হবে……এসবকিছু, কেউ ইচ্ছে করলে বিশ্বাস করে, ইচ্ছে না করলে কেউ-কেউ বা করে না। বিশ্বাস নিয়েও বাঁচা যায়, অবিশ্বাস নিয়েও বাঁচা যায়। কিন্তু মৃত্যু নিয়ে তো কোনোই দ্বিধা নেই। আমি মৃত্যুকে বিশ্বাস করি—একথা কেউ বলে না, কারণ, মৃত্যু বাস্তব ও নিশ্চিত। যা যত বেশি নিশ্চিত, তা মানুষের মনের মধ্যে তত কম ভয় জাগায়। বাঘে খেয়ে ফেলবে, এটাই যদি নিয়তি হতো, তবে বাঘকে ভয় করতো কয়জন? সে কারণে, মৃত্যুর পরবর্তী জীবন নিয়ে মানুষ যতটা উদ্বিগ্ন, মৃত্যু নিয়ে ততোধিক নিঃশঙ্ক। প্রতিদিন চোখের সামনে হাজার-হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে—এই দর্শন-অভ্যস্ততা আমাদের অনেকবেশি নিষ্ঠুর করে ফেলেছে বলে আমরা তা সহজে হজমও করে ফেলছি….আমাদের মধ্যে এই নিষ্ঠুরতার জন্মের জন্য শুকরিয়া আদায় করা উচিৎ……কারণ, আমার দূরের আত্মীয়দের মৃত্যুও যদি আমাকে আমার বাবার মৃত্যুর মতোই কষ্ট দিত, তবে বেঁচে থাকাটা আমার পক্ষে, নিশ্চয়ই পুরোপুরি অসম্ভব হতো।……জাগতিক জিনিসের মানুষের প্রতি এত লোভ, এত হানাহানি, এত অন্যায়, এত কূটকৌশল…..আরো, কত-কত কিছু…..আমরা কিন্তু চোখের সামনেই দেখতে পাই। আরো দেখি, মানুষ একেবারেই নিঃস্ব হয়ে আসে, আবার, ওরকম নিঃস্ব হয়েই চলে যায়…..এক বিন্দু কিছুও সাথে নেয়ার ক্ষমতা নেই কারো। যদি এমন হতো, মানুষের যা অর্জন—পার্থিব বা অপার্থিব, চলে যাওয়ার সময় সাথে করে, পুরোটা না হোক, কিছু হলেও সাথে নেয়ার সুযোগ থাকত!……তবে এই পৃথিবীটা কেমন হতো, কেমন অস্থির সময়ের মধ্য দিয়ে যেতাম আমরা, নতুন-নতুন আরো কত মানুষ বেপরোয়া জীবনের লিস্টে এসে যেত—ভাবতেই গা শিউরে উঠছে! মানুষে-মানুষে প্রেম, ভালোবাসা, সৌহার্দ্য, আন্তরিকতা, সম্পর্ক—সবকিছুই একে-একে ভেঙে পড়ত।……বাড়ত শুধুই দীর্ঘশ্বাস!! আচ্ছা, দীর্ঘশ্বাস জিনিসটা—-আসলে, ঠিক কতটা দীর্ঘ……? মানুষের জীবনের সীমানার চাইতেও কি বিস্তৃত হয়ে যায় মানুষের দীর্ঘশ্বাস, কখনো-কখনো?

ভাবনা: বিয়াল্লিশ।

……………………..

ভালোবাসা মানে—নেশাধরানো মায়াবী সন্ধ্যায়, নীরব নিস্তব্ধ রাস্তায়, চুপচাপ একাকি হাঁটার সময়ও……চারপায়ের শব্দ শুনতে পাওয়া…….আমি, আর কল্পনায়, আমার মা হেঁটে যাচ্ছি; কোথায়, জানি না। মায়ের পায়ের শব্দ আমার মুখস্থ। বাবারটা মুখস্থ করার সুযোগ উনিই আমায় দেননি, এর আগেই হারিয়ে গেছেন আমার জীবন থেকে। বাবা যখন আমাকে ছেড়ে চলে যান, পায়ের শব্দ কীকরে হৃদয়ে সারাজীবনের জন্য গেঁথে যায়, সেটা বোঝার বয়স হয়নি তখনো পর্যন্ত। এই মা’কে ঘিরেই আমার প্রতি মুহূর্তের বেঁচেথাকা। নইলে, কত আগেই, পৃথিবীটাকে………..আচ্ছা, একটু ভাবুনতো, পৃথিবীর নির্মম নির্দয়তার বিরুদ্ধে প্রাণপণ যুদ্ধ করে বাঁচে যে ইচ্ছেগুলো, তারা তাদের নিজস্ব কিছু স্বকীয়তা নিয়ে পৃথিবীতে আর টিকে থাকতে পারবে না, এমন আশঙ্কা প্রতিনিয়তই আমার বিদ্ধ করে—এই ভয়ে, সেগুলোকে কখনো মন থেকে বের হতে দিই না, প্রাণ গেলেও না; অন্যের মাঝে দেয়ার তো প্রশ্নই আসে না, এমনকি, কখনোসখনো, নিজের সামনেও নিজেকে মেলে ধরি না, এমন একটা জীবনে মানুষ কতদিন নির্বিঘ্নে বেঁচে থাকতে পারে? আমি আমার মধ্য থেকে বের হয়ে পড়ি প্রায়ই। আমি স্বাচ্ছন্দ্যে রাস্তায় হেঁটে যাই আমাকে ছাড়া, দূর থেকে জনসমুদ্র দেখি, সে সমুদ্রে আমি ডুবে যাই, কিন্তু নিজেকে ডুবতে দিই না……মানুষ আসে, মানুষ যায়……… তারাও হয়তো নিজেদের দিকে তাকিয়ে ভুল করেও ততটা দেখে না, যতটা আমি দেখি। ওদের আয়না ওদের ঘর ছেড়ে আমার ঘরে এসে পড়ে, এখানেই থেকে যায় অনন্তকাল। ওদের ভেতরটা দেখতে পেলে, নিজের ভেতরটার সাথে মিলিয়ে নিই, দেখি, দুটোই, কমবেশি, একই। বস্তুত, পৃথিবীর সব মানুষেরই মন-আয়নাতে একই চেহারা ভাসে। ইচ্ছে হলে, সাগরপাড়ের ধূলিকণাও গুনি। অবাক হয়ে ভাবি, জীবনসাগরেও ঢেউ আসে—একের পর এক ঢেউ আসে…….সেই একই পুরোনো চিরন্তন ঢেউই—আরও আশ্চর্য, অনেকটা একইরকম করেই আসে; ছন্দ একই, তাল একই, লয় একই! তবুও, সৃষ্টির আদিকাল থেকে আজ অবধি যত ঢেউ উঠেছে—তার প্রত্যেকটা যে একের থেকে অন্যটা ভিন্ন—এ রহস্য, যে যত ভাল বোঝে, সে তত কষ্ট পায়। একই চেহারার ভিন্ন মানুষকে গ্রহণ করতে ভীষণ কষ্ট হয়! রহস্যের উন্মোচন, রহস্যের অবগুণ্ঠনের চেয়েও বেশি যন্ত্রণা দেয়। এসবকিছু ভাবতে-ভাবতে, নিজেই নিজেকে চারদেয়ালে শক্ত করে আটকে রাখি। স্বীকার করছি, কষ্টের অমোঘ আমন্ত্রণে ধরা দিই কমই। অথচ, সেই কমটাতেও চারদেয়ালের ঘরে জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। সেই ঘরে স্বআরোপিত ঘোরে ‘এভাবেই বেশ ভাল আছি’ বিশ্বাস করে থেকে যাই স্বাচ্ছন্দ্যে, সেই বদ্ধঘরে ছোট-ছোট জানালা আছে, জানালা দিয়ে আলো এসে পড়ে ঘরের মেঝেতে, সে আলো আর বেরোতে পারে না, ঘরের মধ্যেই দমআটকে হাঁসফাঁস করতে থাকে। জানালা দিয়ে বাইরে একটা রঙিন জগৎ দেখা যায়। মাঝে-মাঝে, ইচ্ছে হলে, জানালায় চোখ রাখি, বাইরে চোখ চলে যায়, সাথে মনও যেতে চায়, মনকে বাঁধতে চাই, কিন্তু পারি না—হায়, ওখানে যাবার অনুমতি আমার ভেতরের আমি’টা আমাকে কখনোই দেয় না……..এমনই নির্দয়ভাবে সত্যকে ধারণ করে চলে সে! দ্বন্দ্বের শুরু হয় ঠিক তখনই, এলোমেলো হয়ে যেতে থাকে সবকিছু। সে দ্বন্দ্ব, কখনোই সরে না জীবন থেকে, খুব চেষ্টা করি সরাতে, পারি না। কোনোরকমে বেঁচেবর্তে থাকতে অসহায় এই আমি নিজেই, প্রায়ই, সে দ্বন্দ্ব থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়ার নিপুণ অভিনয় করে যাই।