ভাবনাদেয়ালের পলেস্তারা (৮ম অংশ)

ভাবনা: পঞ্চাশ।

……………………..

একটা শব্দের প্রয়োগকৌশলের উপর তার মানেটা নির্ভর করে। একই শব্দ ভিন্ন-ভিন্ন অর্থে হাজির হয় একই শরীরকাঠামোয়। বিষয়টা কেমন? শব্দ আর শরীর দুইই কখনো-কখনো কেবল দ্ব্যর্থকই নয়, বহুর্থকও বটে। এর রঙটা একেক জায়গায়, একেক ভাবনায় একেক রকমের। এই যে লোকে বলে, ‘আচ্ছা’—এই শব্দটাই কতভাবেই তো বলা যায়, তাই না? “আচ্ছা, এই কথা? আচ্ছা, আমিও সেখানে যাবো। ওকে আচ্ছামতো বকে দিয়ো তো।” এমন আরো কত কী! যে বলে সেই জানে। আর একই শরীরের ব্যবহারে কেউ মন খুঁজে পায়, কেউ না দেহ, কেউ বা কিছুই না, নিছকই অভ্যস্ততা। একই শরীর নানান জনের কাছে নানান পরিস্থিতিতে নানান অর্থে ধরা দেয়।

এসব কথা কেন মাথায় আসছে? সবকিছুরই সীমাবদ্ধতা আছে। ধারণাগত কিংবা প্রায়োগিক—সে শব্দই হোক কিংবা শরীর। কারো-কারো ঠোঁটে কিংবা কলমে শব্দরা অবিরত খেলা করে এমনভাবেই যেন এর কোনো শেষ নেই। দারুণ স্বচ্ছন্দ, সপ্রতিভ, স্বতঃস্ফূর্ত। কিছু-কিছু শরীরও অমনই সহজ স্রোতে ভেসে যায় আমৃত্যু। আবার কারো-কারো সবকিছুর প্রয়োগই যেন অতি সংক্ষিপ্ত সীমিত সংযত, কী শব্দে, কী শরীরী ব্যাকরণে। এটা ওদের অপারগতা; প্রায়ই স্বনির্ধারিত স্বআরোপিত। মহত্ত্বের মোহে নয়, বাঁচার প্রয়োজনে যাকে ভেসে যেতে হয় ইচ্ছেসমুদ্রের প্রবল জোয়ারে, সে কীকরে কেবল ভাটার টানে নিজেকে আটকে রেখে বাঁচে? অমন ভাটা যে অবধারিতভাবেই তার মৃত্যু ডেকে আনে।

ইদানিং বিছানাটাকে বড্ড আপন লাগে। কাছের মানুষ বলতে যা বোঝায়, আমার তা বরাবরই কম। যারা আছে, তাদের সবার কাছেতো আর সবসময় যাওয়াও যায় না! এমনকি কাউকে ফোন করার সময় কী এক অসীম সংকোচ এসে ভর করে মনে, ফোন করাটাও উচিত কী অনুচিত, তা ভাবতে-ভাবতে আর ফোন করাই হয়ে ওঠে না। ফোন করার অভ্যেস আমার এমনিতেই কম, তার উপর যদি দুএকজন মানুষ, যাদেরকে ফোন করা যায় নিঃসংকোচে, তাদের বেলায়ও সংকোচ এসে আমাকে দূরে সরিয়ে দেয়, তাহলে তো আর ফোন করারই কেউ নেই। হাতের কাছের ফোনটার সাথেও আমার দূরত্ব হাজার মাইলের। সে ফোনের কনট্যাক্টলিস্টের সবাইই আমার একই রকমের অচেনা হয়েই থেকে যায়। কিন্তু আমার বিছানা আমার সবচাইতে আপনজন, ওতে যখন খুশি যেমন খুশি আমার অবাধ বিচরণ, স্বচ্ছন্দ আশ্রয়। ইদানিং যেটুকু সময় বাইরে থাকি, তা বাদে প্রায় সবটা সময়ই ওই আশ্রয়েই কাটে। যে আমি’টা আমাকে চালিয়ে নিত সময়ে-অসময়ে, ও কোথায় যেন হারিয়ে গেছে! নাকি বদলে গেছে অনেক? আমি ওকে আর পাই না আগের মত করে, তাই লেপতোশক-মুড়ি দিয়ে আমিও হারাই একটু-একটু করে সময়কে ফাঁকি দিয়ে। এই হারানো, সময়ের স্রোতের বিপরীতে চলা, নিজেকে আড়াল করে রাখার অভিনয়, এসবকিছুই তো নিজেকে ক্রমশ শেষ করে দেয়ার আয়োজন ছাড়া আর কিছু নয়। জানি, হয়তো এটাকেই বিষণ্ণতা বলে, আরো বেশি করে অনুভব করতে পারি, এটা এক ধরনের খুন, আত্মহত্যার চাইতেও তীব্র এ খুনের যন্ত্রণা। আমি ভাবি, যে জীবনে আমার শরীরটাকে রেখে দিয়েছি, সে জীবন অন্য কারো দূরে থাক, আমারই বা কী কাজে লাগবে? আমার থাকা না থাকায় কার কী এসে যায়? আমি কী করলাম কী করলাম না, এসবের কী-ই বা অর্থ আছে? এমনই নিরর্থক জীবনযাপন আমার! যে জীবনের কোন মূল্যায়নই নেই, সে জীবনে নিজেকে লুকিয়ে রাখার চাইতে জীবনটাকে শেষ করে দেয়াই কি ভাল নয়? আমি নাহয় এভাবেই হারিয়ে যাব, তাতে আমার একটুও আপত্তি নেই, কিন্তু আমার ভাবনাগুলো অন্তত লিখে রেখে যাই। অনেককিছুই লিখতে ইচ্ছে করে, কিন্তু পারি না, শুধুই সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসে, কেবলই ঝাপসা হয়! এভাবেই আমার সময়গুলি কেটে যায়, আমিই পার করে দিই। আমার আবেগ আর ভালোলাগাগুলিকে বড্ডো যত্নে থাকে, এতোটাই যে, আমার ভালোথাকাটাকে আমি বিকিয়ে দিই ওদের ভালোথাকার দামে। জীবনে যা কিছুতে বাধা এসেছে, সেসবকিছুর অনেককিছুই ছেড়ে দিয়েছি আলগোছে কত! সামনে বেড়েছি প্রতিনিয়ত। যা আটকে রাখে, তাকে ছেড়ে দেয়াই নিয়ম বলে জেনেছি সবসময়ই। সকল বাধাকে প্রতিহত করে আগলে রেখেছি ওই ভালোটুকু, হাত ছেড়েছি কত বন্ধুর, আজ সবাইকে মনেও পড়ে না। যে মানুষটার কোনো শত্রু ছিল না কখনোই, তার নিন্দে করার মানুষ জুটে গেছে আজ। ছিঁড়ে গেছে বিশ্বাসেঘেরা সম্পর্কের সুতো, হেঁয়ালিতে খুলে গেছে বন্ধন যত। সবই ওই ভালোলাগার পরিচর্যায়, অন্য কিছু নয়। অথচ, দিনের শেষে শূন্য আমি, চারিদিকে শুনি পূর্ণতার শঙ্খধ্বনি। এগিয়ে গেছে সবাই—সময় আর সম্পর্করাও এগোয় সাথে। ধূসর চাদরে এক মুঠো উষ্ণতা মুড়িয়ে, আমিই কেবল থেকে যাই একা নিঃসঙ্গ অনাশ্রয়।

ভালোলাগার দূরদ্বীপে স্বেচ্ছা-নির্বাসনকে ভালোলাগার ঘরে বসবাস ভেবে হাসিমুখে জীবনটা ভুলে-ভুলে কাটিয়ে দিলাম!

ভাবনা: একান্ন।

……………………..

ক্লাস সেভেন থেকেই, বাসার সব ধরনের খরচের দায়িত্ব আমার ছিল, মানে, কোন খাতে কত টাকা খরচ হবে, কীভাবে খরচ হবে, কেন খরচ হবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি সবার ছোটো, কিন্তু দাপট দেখাতাম সবচেয়ে বেশি! বরাবরই, আমি “ঠিক”-এর সাথে থাকার চেষ্টা করি এবং মানুষজনকেও টেনেহিঁচড়ে এ পথে নিয়ে আসতে চাই। অন্যায়ের মধ্যে আমি কখনোই স্বস্তিতে থাকতে পারি না। যদি কখনো এমন হয় যে, কোনটা ঠিক, বুঝতে না পারি, তাহলে সেখান থেকে নিজেই সরে আসি বা অপেক্ষা করি। বাসার সব খরচ আমি খুব হিসেব করে করতাম, কাউকেই অকারণে খরচ করতে দিতাম না একদমই। যদিও, কখনো-কখনো নানান বাহানায় আমি অনেক খরচ করে ফেলি, কিন্তু ফ্যামিলিতে আমার “কিপ্টা” হিসেবে বিশেষ সুখ্যাতি আছে। বাসার অন্য সবার তুলনায়, আমি সবচেয়ে কম খরচ করি। শপিং-এ গেলে মার সাথে খুব ঝগড়া হয়! ঝগড়াটা অন্যদের বিপরীত—মা বলতে থাকে এটা কিন্‌, ওটা কিন্‌, সেটা কিন্‌! আমি বলতে থাকি, না না না…..! দোকানের লোকগুলো হাঁ করে তাকিয়ে আমাদের মা-মেয়ের কাণ্ড দেখে।

তবে, এত কিপ্টেমি করেও তেমন কোনো লাভ হত না। মাস শেষ হবার অনেক আগেই টাকা প্রায় শেষ সীমানায় চলে আসত। কীভাবে মাস চলবে, সে চিন্তায় পড়ে যেতাম আর বাসার সবাইকে সমানে ঝাড়ি দিতাম—ওরা অযথা টাকা খরচ করছে বলেই তো সব টাকা শেষ হয়ে যাচ্ছে। তখন এই চিন্তা দূর করতে একটা কাজ করতাম। স্কুলে পড়াটা, ভীষণ কষ্টের; তখন স্কুলে পড়ি, তাই পরীক্ষা লেগেই থাকত। বুদ্ধি করে, নেক্সট পরীক্ষার আর কতদিন আছে সেটা ভাবতাম, তাহলেই সময়টা খুব কম মনে হত। মানে, মনে করুন, মাস শেষ হতে আর দশদিন বাকি আছে, পরীক্ষার বাকি বারদিন আছে। যখনই মনে হত, মাস শেষ হতে তো আরও দঅঅঅশ দিন!—এই সামান্য টাকায় এতদিন কীভাবে চলবে?……তখনই পরীক্ষার কথা ভাবতাম! তখন এই দশদিনকে দুইদিন মনে হত! আবার যখন পরীক্ষার চিন্তা করতাম—মাত্র বার দিন! কীভাবে সব পড়া শেষ করব!?……তখনই মাসখরচের টাকার কথা ভাবতাম, আর অমনিই সময়টা বেড়ে যেত—তখন এই বার দিনকে বাইশ দিন মনে হত। ব্যস্‌ হয়ে যেত! মনে সাহস থাকলে পরীক্ষার পড়া পড়তে সুবিধে হয়। হাহাহা…….এখন আর পরীক্ষা নেই। মাসশেষের আগে টাকা শেষ হয়ে গেলে দিনকে কমিয়ে আনার আর কোনো ছুতো খুঁজে পাই না! টাকা শেষ মানে, টাকা শেষই। জীবনের সবচাইতে কষ্টের অনুভূতিগুলির একটি হল, এই ‘টাকা শেষ’ অনুভূতি। হয় না খেয়ে থাক, নতুবা, টাকা যোগাড় কর—এর মাঝামাঝি আর কিছুই করার নেই।……….এমন কেউ তো আর নেই যে আমাকে জিজ্ঞেস করবে, আমি কেমন আছি, তাই ওটা নিজেই জিজ্ঞেস করি নিজেকে। “কেমন আছ?” “সুস্থতার দিক থেকে নিজেকে OK মনে হচ্ছে না, আর ড্রেসআপের দিক থেকে……থাক, পরে বলবো!”

ভাবনা: বায়ান্ন।

……………………..

একটা উপাদেয় কবিতাণু—গ্রীষ্মের।

বড্ড গরমে—

স্নানে……..

আজ, খরচও হয়েছে জল—

ঢের বেশি…….

হে প্রকৃতি! ডোন্ট মাইন্ড প্লিজ!

আই অ্যাম রিয়েলি সরি……!!

প্রমিজ করছি—

কোনো এক শৈত্যে, দুপুরে…….

শোধ করে দেবো জল……..

পরপর দুইদিন স্নান না করে…..!!

পছন্দ হয়নি? অক্কে, ঠিক আছে, নিয়মিত স্নান করবেন, মনে করে—ওতেই, শুধু চলবেই না, দৌড়াবে! নিজের জন্য না হোক, আপনার বন্ধুদের জন্য হলেও, স্নানটা যেন ঠিক থাকে, কেমন? ইস্‌! অ্যাত্তো ঢং কেন্ ? নাক ফোলাবেন না বলছি—একদম ধরে এনে, বোতলে ভরে ফেলবো! বোতলভূত হয়ে যাবেন। রাগ করলেন? রাগ ভাঙাতে কী লাগবে? সামনে তো নেই আপনি, যে, ধরেটরে রাগ ভাঙাবো। কবিতায় চলবে তো? ওকে, এই নিন, আরেকটা—দিচ্ছি, তবে এটা কি আদৌ কবিতা, নাকি গদ্য, সে তর্কে যাওয়ার চাইতে, যা-ই হোক, কিছু একটা লিখে দেয়াটা সহজ…….নাহ্‌, লিখব না, মানে, লিখেছি, তবে দিচ্ছি না। এমনি-এমনিই রাগ চলে যাবে আপনার। কেননা, রেগে যদি ওঠেনও, আমি জানি, সে রাগে কণামাত্রও অনুরাগ নেই। যে রাগে অনুরাগ থাকে না, সে রাগের বৈধতা আর স্থায়িত্ব—দুইই খুব কম।

খুব ইচ্ছে করে—প্রিয় মনের তপ্ত নিঃশ্বাস ছুঁয়ে দেখি। একটা প্রার্থনা………মানুষের প্রতি মানুষের সত্যিকারের ভালোবাসা—মানুষ, সত্যি করেই বুঝুক, বুঝতে পারুক। মিথ্যে ভালোবাসা—মিথ্যে করেই বুঝুক, বুঝতে পারুক। ভালোবাসা, মন হয়ে শরীরে আসুক, শরীর হয়ে মিথ্যে মনে নয়। ভালোবাসায়, স্পর্শ থাকবেই—তবে, সে স্পর্শের অভ্যেসটা, আগে মনের হোক। মানুষ মানুষকে ভালোবেসে নিজে ভাল থাকুক, ভালোবাসার মানুষকেও ভাল রাখুক। সাথে, ভালোবাসা নিজেও, ভাল থাকুক। প্রার্থনা শেষ। তালিইইইইই………

ভাবনা: তেপান্ন।

……………………..

জীবনটা অনেকবেশি জটিল—এতোটাই যে, ‘জটিল’—এই নিরীহ শব্দটার পক্ষে এই জটিলতার ভার বহন করা আর সম্ভব হচ্ছে না—নতুন শব্দের প্রয়োজন। এতো সহজ তিন বর্ণের শব্দে বাংলা শব্দটা কে যে বানিয়েছে! আরও জটিল কায়দায় ‘জটিল’-এর নির্মাণ হওয়া উচিত ছিল। এই রাত সাড়ে চারটায় জীবনের জটিলতা নিয়ে ভাবতে-ভাবতে নিজেকেই বড় জটিল মনে হচ্ছে। নিশ্চয়ই, ফোনটা মেসেঞ্জারের ক্রিংক্রিং-এ বেজে উঠবে না, কেউ আমাকে টেক্সট পাঠায় না—তবুও, ক্ষুধার্ত চোখজোড়া কেন ফোনেই আটকে থাকে সারাক্ষণই, সেটার ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই। প্রিয় মনটাকে, অশান্ত করে রাখতেই ভাল লাগে কখনো-কখনো। রাখি, প্রিয় মানুষটিকে তা জানাই, জ্বালাই। যখন তখন মনের কথা জানানোর ইচ্ছেটা যদি অভদ্রতা হয়—তবে আমি অভদ্রই। কী-ই বা আর করা যাবে? কখনো মনে হয়—পৃথিবীতে, ভালোবাসাটাই একমাত্র মিথ্যে। আবার, কখনো মনে হয়—পৃথিবীর সবকিছুই মিথ্যে, এক ভালোবাসাটা ছাড়া। যদিও আমি এসব বিশ্বাস করি না এবং খুব ভাল করেই জানি, এসব বিশ্বাস করা পাপ, তবুও, ভেতরটায় কী এক আশংকা, একটা মোচড় দেয়…..ওই পৃথিবী আর ভালোবাসার যুগলবন্দি ভয়টাকেই ভেতরে-ভেতরে লালন করি কিনা! প্রায়ই মনে হয়, জীবনটা কতগুলো অফটপিকের সমষ্টি, আর কিছুই নয়। জীবনের কোনো মাহাত্ম্যই নেই, জীবনের সকল মাহাত্ম্যই আরোপিত। জীবনের মানে, বেঁচে থাকা—ভালোবাসাপূর্ণতায়ই হোক, আর ভালোবাসাহীনতায়ই হোক। যাকিছু জীবনের আলোচনা বহির্ভূত, তাকিছুই জীবনের সবচাইতে অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ। আমরা যা-ই ভাবি না কেন, তার কোনোকিছুর মতোই জীবন নয়, জীবন স্রেফ জীবনের মতো।…….আর লিখতে ইচ্ছে করছে না, মনটা কেমন একটা হয়ে আছে!

ভাবনা: চুয়ান্ন।

……………………..

“এক্সকিউজ মি, একটা ছবি তুলে দেয়া যাবে?” “Oh sure! Why not?” যেহেতু, হাসি ছাড়া থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, তাই আমি একগাল হাসি দিয়ে সম্পূর্ণ অপরিচিত এক ছেলের দিকে তাকিয়ে, নানান রঙঢঙে পোজ দিয়ে যাচ্ছি। আর সে ছবি তুলেই যাচ্ছে, একের পর এক…..ক্লিক্‌ ক্লিক্‌ ক্লিক্‌!! পাশেথাকা তার গার্লফ্রেন্ড আমার দিকে কটমট চোখে তাকাচ্ছে। আমি সেদিকে তাকাচ্ছি, কিন্তু দেখছি না। ওর চোখ বলছে, “কেন বাপু? দুনিয়াতে কি আর কোনো ছেলে নেই? আমার ওকেই কেন তোমার লাগবে?” আহা সরলা বোকাসোকা প্রেমিকা! কীকরে মেয়েটাকে বোঝাই, “তোমাদের ওকেই যে আমার চাই! আর কাউকে দিয়েই আমার যে চলবে না, শুধু তোমার ওকেই আমার লাগবে।” যেহেতু, আমি বিশেষ দিবসগুলোতে সাধারণত একা-একাই ঘুরে থাকি, তাই একগাদা ছেলেবন্ধু নিয়ে একসাথে ঘুরছে—এমন কোনো ছেলেকে ছবি তুলে দেয়ার কথা বলা যায় না। ব্যাপারটা একইসাথে এম্ব্যারাসিং এবং রিস্কি। দুইতিনজন বন্ধু একসাথে আছে—তাদেরও, না, কারণ, ওদের কাছে আমাকে দেখতে দুনিয়ার সবচাইতে অসুন্দর মেয়েটির মতো লাগলেও—ওরা, আর কিছু না হোক, স্রেফ মজা করার জন্য হলেও, আমার পিছু নিতে পারে! মেয়েদের পশ্চাতদেশ অনুসরণের মোহ বড় মোহ, অনেক ছেলেই তা ছাড়তে পারে না। ড্যাশিং টাইপ ছেলেও চলবে না, যদি ভাব দেখায়! ভাব সহ্য করার মেয়ে আমি নই, প্রয়োজন হলে, সারাজীবনেও, একটাও ছবি তুলবো না। আলাভোলা টাইপ ছেলে……যদি ক্যামেরা নিয়ে দৌড় দেয়! তখন? ও মাগো!

যাক্‌গে! এবার আপুদের পালা। অনেকগুলো মেয়ে একসাথে—আপু একটা ছবি তুলে দেবেন, প্লিজ? ওরা পরস্পরের দিকে এমনভাবে তাকাতে শুরু করবে যেন, দশজনের মধ্যে ঠিক কে ছবিটা তুলে দেবে, এটা তাদের কাছে একটা কঠিন গোলকধাঁধাঁর মতো। ওই ধাঁধাঁ এ জন্মে আর সলভ্‌ হবার নয়! দুইতিনজন সাধারন মেয়ে—আপু একটা ছবি, প্লিজ?….OK….. ক্লিক্‌ ক্লিক্‌!! ছবিতে আমি আছি, সাথে, অন্য কারোর হাত, পা বা মাথাও ফ্রি! এবার, আন্টি টাইপ কেউ। ক্লিক্‌ ক্লিক্‌….আমি আছি, আমার ছবি ঠিকই আছে, কিন্তু যে জিনিসটার সাথে ছবি তুলতে চাচ্ছি—শুধু সেটাই নেই! এবার স্টাইলিশ বা ফ্যাশনেবল কোনো আপু। One click, plz!? Yehhh…..ক্লিক্‌ ক্লিক্‌……. সে এমন ঢংমং করে ছবি তুলে যাচ্ছে, যেন—ক্যামেরার উল্টোদিকে আমি না, কোন সুদর্শন যুবক দাঁড়িয়ে! সে যুবকটাকে ঢং দেখাতে না পারলে, একমাসের পেটের ভাত, একটাও হজম হবে না—পেটের ভেতর ঠিক একইরকম গোটা-গোটা থেকে যাবে। ব্যাপক যন্ত্রণা! উফ্‌ উফ্‌ উফ্‌……!! তাই, কাপল ইজ দ্য বেস্ট! তবে, কাপলদের মধ্যে, ছেলেটাই, মেয়েটা না কিন্তু! মেয়েটা, প্রায়ই এলাঝেলা করে ছবি তুলে দেয়! এক মেয়ে আরেক মেয়ের সুন্দর ছবি তুলতে জানে না, বা চায় না। ক্যামেরায় চোখ রেখে, যে-ই মাত্র দেখে, উল্টোদিকের মেয়েটাকে দারুণ দেখাচ্ছে, তখন ইচ্ছে করেই, ক্যামেরাটাকে একটু বাঁকিয়ে ধরেটরে ঝটপট কয়েকটা দায়সারা ক্লিক্‌ মেরে দেয়। আর ছেলেটা, (আহা কত গুডবয় একটা ছেলে!) খুব যত্ন করে, মনের মাধুরী মিশিয়ে ছবি তুলে দেয়! যদি দুর্ভাগ্যক্রমে তার গার্লফ্রেন্ড দেখতে (এমনকি) আমার চেয়েও অসুন্দর হয়—তবেই সেরেছে! বেচারা যে শখ করে আমার দিকে দ্বিতীয়বার তাকাবে—সে উপায়ও নেই! সাথে গার্লফ্রেন্ড আছে কিনা! ছেলেটা মনের ভেতরে-ভেতরে রাগে ফুঁসতে থাকে। সব ছেলেই, গার্লফ্রেন্ড কিংবা বউকে সাথে নিয়ে ঘুরতে বের হলে, বড়ই অসহায়বোধ করে। একেবারে সাধুপুরুষ সেজেটেজে, পৃথিবীর সব সুন্দরীর দিকেই এক ধরনের মেকি ‘দুচ্ছাই অসহ্য’ দৃষ্টি ফেলে-ফেলে, গৃহপালিত জন্তুর মতো সন্তর্পণে পথ মাপতে হয় তাকে। হাহাহাহা……..এটা লিখে ফেলতে পেরে, ভীষণ খুশি-খুশি লাগছে। মনে হচ্ছে, এটা লেখার জন্য আমাকে কয়েকটা নোবেল প্রাইজ দিয়ে দেয়াই যায়! খুশিতে, আমার মাথার চুল আঁচড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। ভাল কথা, জানেন, সমগ্র নারীজাতির মধ্যে আমিই একমাত্র সদস্যা, যে কখনো চুল আঁচড়ায় না! মজার না ব্যাপারটা?

ভাবনা: পঞ্চান্ন।

……………………..

এএএএইইই শোনো না! তাত্তাড়ি আসো। তাত্তাড়ি তাত্তাড়ি!

কী, বলো! কাজ করতেসি…….

আহ্‌! আসো তো!

বল না, কী? কিছু লাগবে? গোসলে যাবার আগে সবকিছু মনে করে নিয়ে যেতে পারো না? আমি না থাকলে কী করতা? বিয়ের আগে বাথরুম থেকে কাকে চিল্লাতা?

কী হলো? এতো পকপক কর কেন? কিচ্ছু লাগবে নারে ভাই, তুমি আসো না!

কী? কী সমস্যা? এতো জ্বালাও কেন? কী হইসে?

কিছু না। ওমম্‌ এটা লাগায়ে দাও!

ইসস্‌! একদিনও কি নিজে লাগাতে পারো না!? পারবো না আমি। সাড়া শরীর ফেটে যাক্‌! ফেটে রক্ত পড়ুক! খুব ভাল হবে।

পারতাম তো! তুমিই তো অভ্যাস খারাপ করে ফেলসো! (আহ্লাদে!) লোশনটা লাগায়ে দাও না বাবুইসোনা!

হুমম্‌, ভুল করসি। তোমাকে আদর দিয়ে-দিয়ে পঙ্গু বানায়ে ফেলসি।

নাও, এখন ভুলের মাশুল দাও!

সারাজীবনই মাশুল দিতে হবে!?

যদি বেঁচে থাকি…….

(শক্ত করে জড়িয়ে ধরে পুরো কথাটা মুখ থেকে বের হওয়ার আগেই মুখটা চেপে ধরে) অ্যাইইইই চুপপপ্‌! কী বলতেসো এইগুলা? ওইভাবে বলসি বলে, তুমি কি কষ্ট পাইসো?

হুমম্‌…….

আহারে আমার বাবুটা! আর বলবো না, আর কক্ষনো বলবো না। একদম প্রমিজ! ‘যদি বেঁচে থাকি’ মানে কী, বাবু? কী বল এইগুলা? আমাকে ফেলে কই যাবে তুমি? হুমম্‌? ওইখানে কে তোমাকে লোশন লাগায়ে দিবে? তুমি চলে গেলে আমি কাকে লোশন লাগায়ে দিব? কার সাথে ঝগড়া করবো?

………………………………………………..

পর্দার অন্তরালে: পরস্পরকে জড়িয়ে চুমুতে-চুমুতে আর সুখঅশ্রুর লোনাজলে দুজনের সমুদ্রস্নান…….তারপর…….আবার স্নান!

(আহহহ্‌! প্রিয় মানুষকে ঘিরে মিথ্যে সুখকল্পনা…….হায় কিছু না পেয়েও যে আমার মতো কত মানুষ সব পাওয়ার সুখে ভাসতে জানে!)

ভাবনা: ছাপান্ন।

……………………..

ভালোবাসার তিনটা পর্যায় হয়……

প্রথমদিকে, ভালোবাসাটা উড়ু-উড়ু হয়; আসছে, কিন্তু থাকছে না টাইপের…..এই ভালোবাসার জন্য—খুব একটা কিছু ছাড় দেয়া যায় না…..

একসময়, ভালোবাসাটা—গভীর হতে শুরু করে…। এই ভালোবাসার জন্য পৃথিবীর সব পুরনো আর বিশ্বস্ত কিছু পর্যন্ত ছেড়ে দিতে ইচ্ছে হয়……. ধর্ম, সমাজ, সংসার সবকিছু……সবই……

কখনো এসে, ভালোবাসাটা— অতি গভীর হয়ে যায়……তখন, ভালোবাসার জন্য—কিছু ‘ছেড়ে দেয়ার’ ব্যাপারটাকেই তুচ্ছ মনে হয়!……তখন ভালোবাসা এমন একটা পর্যায়ে স্থান নেয়—যখন ভালোবাসা নিজেই অন্য সবকিছুকে ছাড় দিয়ে দেয়……নিজের জন্য অন্য কোনকিছুকে ছাড় দেয়ার—অপশনটাই আর রাখে না……

এই তৃতীয় প্রকার ভালোবাসাটা বিরল— অনেকেই এটা উপলদ্ধি করতে পারে না….কেউ-কেউ ভুল বোঝে……আবার অন্যদিকে, কিছু নির্দয় হিপোক্রিট এর সুযোগটাও গ্রহণ করে……একেবারে রিক্ত নিঃস্ব করে দিয়ে হাসিমুখে চলে যায়……..