ভাবনাদেয়ালের পলেস্তারা (৯৮তি অংশ)

ভাবনা: ছয়শো আশি

………………………………………………………

এক। কোথাও-কোথাও, মানুষ আর মেয়ে, এই দুইয়ের মধ্যে অনেক পার্থক্য থাকে। একটা মেয়ের মনে যা-ই আসুক, প্রতিবাদ আর আধুনিকতার ঝড় উঠুক; সব সত্ত্বেও, ওটা মাথায় রেখে চললে অনেক উটকো ঝামেলা কিংবা বড়ো বিপদ থেকে নিজেকে অনেক সময় বাঁচানো যায়।

দুই। শোনো মেয়ে, মোবাইলে পাপ থাকে না, পাপ থাকে মনে।

তিন। তুই শালা গরীব, তোর ভালো সিজিপিএ নাই!

তুই শালা গরীবের গরীব, তোর ভালো সিজিপিএ ছাড়া আর কিছুই নাই!!

চৌধুরী সাহেব…কিছু না, বুঝে নেন!

চুয়েটে পাইসিলাম ২.৭৪। আমারে তো রাস্তার কুত্তায়ও গোনার কথা না…অথচ আমার সিজিপিএ-র কথা দ্যাশের পাবলিক মাথার কলিজায় সেট কইরা রাইখা দিসে!

(হেটাররা বলবে, আমি আত্মপ্রচারণা করতেসি। আমি বলব, সহমত, ভাই!)

চার। এ-দেয়ালের নাম দিলাম: কৃতজ্ঞতা-দেয়াল।

আসেন ভাই, সবাই মিলে কৃতজ্ঞ হই, ধন্যবাদ জানাই।

ভার্সিটি থেকে পাস করে বের হতে কার-কার হেল্প সবচাইতে বেশি কাজে লেগেছে বলে আপনার এই মুহূর্তে মনে আসছে? তাঁর/ তাঁদের নাম লিখে ট্যাগ করুন, ধন্যবাদ বলুন। শুরুটা আমিই করছি।

আমার মাথায় তিনটি নাম সব সময়ই থাকে, থাকবে:

Abu Sayed Mohammad Khan E Alam (এ-জীবনে কোনও মেয়েকেও ততটা জ্বালাই নাই, যতটা জ্বালাইসি আমার এ-বন্ধুকে। একটা ঘটনা বলি। সেশনাল পরীক্ষার দিন। দুপুরে পরীক্ষা। আমার রোল নম্বর ০২০৪০০২, সোহেলের ০২০৪০০৩। ওর সব রিপোর্ট আমার কাছে। আমি লেখা শুরুই করেছি আগের দিন মধ্যরাত থেকে। লিখছিই তো লিখছি, লেখা আর শেষই হয় না। আমি হলে থাকতাম না, শহরে বাসায় থাকতাম। সোহেল ১২.০০টার পর থেকে টানা ফোন করেই যাচ্ছে, আমি তখনও লিখছি। যখন ২.০০টা বাজল, তখনও আমি বাসা থেকে বের হইনি। সোহেল ছিল পুরাই প্যাথেটিক টাইপের ভদ্রলোক! আমাকে ফোন করে বলে, দোস্তো, ২.৩০টায় তো পরীক্ষা, তোকে আর আমাকে তো সবার আগে ডাকবে। তুই একটু কষ্ট করে রওয়ানা হলে ভালো হয়, আমি স্যারকে ম্যানেজ করব, আমরা সবার শেষে পরীক্ষা দিব। আমি তখন কী বলেছিলাম, জানেন? আমার উত্তর ছিল: দোস্তো, বাদ দে, এবার নাহয় পরীক্ষাটা না দিই, পরের একসময় দিয়ে দিব। আমার এখনও লেখা শেষ হয় নাই।…শুনে সোহেল চ-বর্গীয় কোনও ধ্বনির সাহায্য নিয়ে গালাগালি করতে শুরু করল, এবং আমি, অনেকটা ভয়ে, যে কয়েকটা লিখে শেষ করেছিলাম, সে কয়েকটা নিয়েই সিএনজি করে চুয়েটের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে গেলাম।…এরকম ঘটনা অনেক আছে!)

Supankar Banik (এমন একটাও পরীক্ষা নাই, যে-পরীক্ষার আগের রাতে বা একদিন আগের রাতে আমি সুপংকরের বাসায় যাই নাই। আমার নিজের কোচিং সেন্টার ছিল। প্রতিদিনই রাত ৯.৩০টার দিকে ব্যাচ শেষ হতো। এরপর ওর বাসায় গিয়ে জেনে নিতাম, সিলেবাসে কী কী আছে। জানার পর বুঝতাম, আমার পক্ষে দুইএকরাতে ওইসব পড়া সম্ভব নয়। তারপর সুপংকরকে বলতাম সাজেশনস দিতে। ও দিত। এরপর বলতাম, আমাকে এইগুলা বুঝায়ে দাও। ও তাও দিত। কখনোই মাথা গরম করত না। কীভাবে পারত, সত্যিই জানি না! আমি হলে থাপ্পড় বসায়ে দিতাম, বাসা থেকে তাড়ায়ে দিতাম। আমাকে পড়াত, নিজেও পড়ত। আমি নিজেকে খুব করে বোঝানোর চেষ্টা করতাম, মনে করি, সুপংকর যা বোঝাচ্ছে, আমি তার সবই বুঝতে পারছি! ওই যে অঙ্কের খাতিরে ধরে নেয় না…মনে করি, পিতার বয়স x, ওরকম আর কী! প্রত্যেক সেমিস্টারেই সুপংকরকে এভাবে বিরক্ত করে গেছি! আমি সত্যিই মিলাতে পারি না, কী করে আমাকে ও দিনের পর দিন সহ্য করেছে! এমন সুপারকুল মানুষ জগতে বেশি নাই।)

Mahamudul Hasan (আমার ফোর্থ ইয়ারের ফাইনাল প্রজেক্ট-পেপারটা যার পেপার থেকে ‘এডিট করে’ বানানো, সে-ই শর্মাই হলেন—রাব্বি, দ্য গ্রেট! আমার প্রজেক্ট নিয়ে সাফার-করার গল্প অনেকেই জানেন! রাব্বি পাশে এসে না-দাঁড়ালে আরও কষ্ট পেতে হতো! রাব্বির মতো এতটা চমৎকার মানসিকতা আমি খুব কম মানুষের মধ্যে দেখেছি। বিন্দুমাত্রও কোনও টেনশন মাথায় না এনে যেকোনো কিছুকেই ফেস করতে পারে যারা, রাব্বি তেমনই একটা মানুষ! আমরা চট্টগ্রাম কলেজে একসাথে পড়েছি, চুয়েটে এসে ও পড়েছে ট্রিপল ই-তে, আমি সিএসই-তে।)

আমার আত্মসম্মানবোধ ছিল অতিমাত্রায় তীব্র! সুপংকর আর সোহেল কখনোই এক মুহূর্তের জন্যও আমাকে হেয় করে, ছোট করে একটা কথাও বলে নাই। অথচ আমাকে ছোট করে কথাবলা ছিল খুবই সহজ। আমি প্রোগ্রামিং জানতাম না। ক্লাসের যেকোনো অ্যাসাইনমেন্ট কেউ না-দিলেও ওরা হাসিমুখেই দিয়ে দিত। (শুধু বলত, ভেতরে সেন্টেন্সে কিছু চেঞ্জ করে দিস। সুপংকর বলত…দিয়ো। মজার ব্যাপার, ও আমাকে এখনও ‘তুমি’ করেই বলে!) আমি কিছু পারতাম না বলে আমাকে কেউ গ্রুপে নিত না। এই দুইটা মানুষ কেন জানি না, আমাকে নিত, সত্যি বলছি, কোনও কারণ ছাড়াই নিত। (আমার কাছ থেকে কোনও আউটপুট পাবে না জেনেও নিত!) আর একজনের কথা বলি, যার মধ্যে কোনও ঈর্ষা বা বিরক্তি ছিল না আমার ব্যাপারে। সে হচ্ছে Om Prakash Chowdhury, আমাকে মন থেকে ভালোবাসে যে কয়েকটা মানুষ, সে তাদের একজন।…অবশ্য, আমার যা রেজাল্ট, তাতে আমাকে ঈর্ষা করার কিছু নাই। ক্লাসের সবচাইতে বাজে ছাত্রটিকে সবাই হয় স্নেহ করে, নতুবা তাচ্ছিল্য করে। তাকে ঈর্ষা করারই-বা কী আছে?

যে-ছেলেটা পড়াশোনা করে না, টিউশনি করে সময় কাটায়, ক্লাসে কোনও ক্লাসনোট ঠিকমতো তোলে না, পরীক্ষায় পাস করতে পারে না, যাকে ক্লাসের ভেতরে-বাইরে কেউ পাত্তাই দেয় না, যাকে মুখের উপর কথা শুনিয়ে দিতে আরাম লাগে, যে সব সময়ই মুখটা ছোট করে থাকে, সংকুচিত হয়ে থাকে, নিজেকে লুকিয়ে রাখে, স্যারদের রুমের সামনে যেতেও যে কুণ্ঠায় গুটিয়ে থাকে, গোল চত্বরের কুকুরগুলিরও তার চাইতে বেশি সম্মান থাকে বোধহয়, যার সাথে বন্ধুত্ব না-রাখলেও চলে…তেমন একটা ছেলেকে কোনও কারণ ছাড়াই এই দুই জন মানুষ (সাথে আরও তিন-চারজন) সহ্য করে গেছে চার বছরেরও বেশি সময় ধরে! সবাই মুখ ফিরিয়ে নিলেও এই দুইটা মানুষ ছিল সেই খারাপ ছাত্রটির জন্য। নিজ থেকেই এসে পাশে দাঁড়িয়েছে, বকাঝকা করে পড়তে বসিয়েছে…অন্তত পরীক্ষার আগের রাতে হলেও! বন্ধুত্ব তো বোধ করি একেই বলে, তাই না?

তোদের ভালোবাসি। সব যুক্তির ঊর্ধ্বে তোদের ভালোবাসি, ভালোবাসব। তোরা পাশে না-থাকলে পাস করতে আরও কষ্ট হতো। ভালো থাকিস তোরা!

আরও কেউ-কেউ আছে। সময় করে ওদের নিয়েও লিখব।

ভাবনা: ছয়শো একাশি

………………………………………………………

সেলুনে গেলে চুলকাটা শেষ হবার পর মাথার পেছনে আয়না ধরে জিজ্ঞেস করে, স্যার, দেখেন তো পেছনে কাটা ঠিক আছে কি না!

আমি কখনোই এ ব্যাপারে কোনো মতামত দিই না। সব সময়ই বলি, আপনি নিজে একবার চেক করে নেন। আমি দেখে বুঝব না। আপনি খুশি হলে আমিও খুশি।

কেন ওরকম বলি?

আমার দেখা চমৎকার একটি মুভি ‘শব্দ’। মুভির প্রধান চরিত্রের নাম তারক। তারক একজন সাউন্ড আর্টিস্ট। তাঁর কাজ সিনেমার জন্য নানান ধরনের শব্দ তৈরি করা। তিনি তাঁর কাজের প্রতি ভীষণ নিবেদিতপ্রাণ। সারাক্ষণ‌ই তাঁর মাথায় শব্দ সৃষ্টির আইডিয়া গিজগিজ করছে। কোনো নতুন শব্দ, যা হয়তো আশেপাশের কেউ খেয়াল করেনি, তারকের কান এড়াতে পারে না। কখনোই পারে না। প্রতিটি শব্দ‌ই তারকের কাছে একেকটি রত্নের মতো। টাকাপয়সার ব্যাপারে তারক বরাবরই নিস্পৃহ। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে শব্দতৈরির ক্ষেত্রে তারকের সমতুল্য আর কেউ নেই। জাগতিক অনেক বিষয়ের প্রতি নির্মোহ তারক কিছুটা খ্যাপাটে—অনেক জিনিয়াস‌ই এমন হয়ে থাকেন।

একদিন। অর্ধেক শেষ-হ‌ওয়া চায়ের কাপটি টেবিলে রাখতে গিয়ে তারক চমকে ওঠে! এ কী হলো! আধখাওয়া চায়ের কাপ টেবিলে রাখার শব্দ এরকম হয়! এমন একটা ভুল হয়ে গেছে! হায় হায়! এখন?

হ্যাঁ, কিছু দিন আগে একটা মুভির জন্য তারক শব্দ তৈরি করে দিয়েছে। মুভিটা ফাইনাল এডিটিংয়েও চলে গেছে। সে মুভির একটা দৃশ্যে টেবিলে চায়ের কাপটি রাখার শব্দ তৈরি করার সময় তারক শব্দটি তৈরি করেছে চায়ের খালি কাপ দিয়ে। অথচ সেই দৃশ্যে চা-খাওয়া তখন‌ও শেষ হয়নি। চায়ের খালি কাপ এবং আধখাওয়া কাপ টেবিলে রাখার শব্দ ভিন্ন রকমের।

তারক দৌড়ে গেল ডিরেক্টরের কাছে। একটা ভুল হয়ে গেছে। আমার বানানো শব্দটা ঠিক হয়নি। দৃশ্যটা আধখাওয়া চায়ের কাপের, কিন্তু আমি সেখানে দিয়েছি খালি চায়ের কাপের শব্দ। আমি ওই শব্দটা আবার তৈরি করে দিতে চাই।

খেপেছ, তারক? মুভির সব কাজ প্রায় শেষ! এখন আবার নতুন করে ওই শব্দটা ঢোকানো সম্ভব নয়। বাদ দাও! যা হয়েছে, তা-ই! আর তা ছাড়া ওইটুকু কেউ ধরতেই পারবে না! কেউ কখনো ভেবেছে নাকি এত সূক্ষ্মভাবে? খালি আর আধখাওয়া কাপের শব্দ যে দুরকম, এটাই তো কেউ জানে না! কিচ্ছু হবে না। বদলানোর দরকার নেই। ওই শব্দেই হয়ে যাবে!

ঠিক আছে, মানলাম। হয়তো কেউ বুঝতেই পারবে না। কিন্তু আমি তো বুঝেছি, জানি, ওখানে একটা ভুল আছে। তারক কেন এ ভুলটা করবে?

…তারক কেন এ ভুলটা করবে?—আমার শোনা সেরা ডায়লগগুলির একটি। একজন মানুষ কোন লেভেলের কনফিডেন্ট এবং ডেডিকেটেড হলে এমন কথা বলে ফেলতে পারে! তারক নিজেও জানেন, এমন অতি সূক্ষ্ম পার্থক্য কার‌ও মাথায়ই আসবে না। তিনি এও জানেন, সব কিছুর পরও এটা ভুল, এবং এ ভুলটা অন্য দশজন সাউন্ড আর্টিস্ট করলেও তারক এটা করতে পারে না। সবাই তারক হয় না বলেই তারক তারক হতে পেরেছে। নিজেকে এমন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়া, নিজেকে পারফেকশনের দায়ে বেঁধে ফেলা, নিজের কাজটি সবার আগে নিজের চোখে নিখুঁত করে তোলা, সেরা জিনিসটা চিনতে পারা—অনেক বড় কিছু। সবাই তা পারে না, অনেক দক্ষতা ও আত্মবিশ্বাস লাগে। সেখানে পৌঁছতে হলে অসীম সাধনার দরকার।

চুলকাটার প্রসঙ্গে ফিরে আসি। চুলকাটায় কোনো খুঁত আছে কি নেই, তা যিনি কেটেছেন, তিনি যতটা বুঝতে পারবেন, আমি তার সিকিভাগও বুঝতে পারব না। তাই কাজটা তাঁর নিজের মনের মতো হয়েছে কি না, সেটা জরুরি। যদি তা হয়ে থাকে, তবে সেখানে আমার দেখার কিছু নেই। সূক্ষ্ম কোনো ভুল আমি ধরতেই পারব না। আর যদি এমন হয়, তিনি কোনো খুঁত আছে বুঝেও আমি ধরতে পারব না জেনে আমাকে খুশি করে দিয়ে নিজেও খুশি হয়ে গেছেন, তবে থাকুক না ওরকমই! নিজেকে ফাঁকি দিয়েই যদি কেউ জীবন কাটিয়ে দিতে চায় তো দিক না! সবাই তো আর গ্রেটনেসের মজা বুঝবে না। এমন‌ও হয়, চুলটা যেভাবে কাটা হলো, সেটা হয়তো আমার ভালো লাগল না, তবে তার চাইতে ভালোভাবে করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে তাকে কিছু না-বলে পরেরবার অন্য সেলুনে যাওয়াটাই বেটার। মিডিওকারদের মনে কষ্ট দিতে হয় না।

(চুয়েটে আছি, ঘুরছি, মজা করছি। এই লেখা আরও বড় করব। পরে। আপাতত এইটুকুই।)

ভাবনা: ছয়শো বিরাশি

………………………………………………………

জেমসের গান শুনে বাসায় ফিরছি। চেঁচিয়েছি ইচ্ছেমতো, লাফিয়েছি ইচ্ছেমতো, হাত-পা ছুঁড়েছি ইচ্ছেমতো। গলা ভেঙে গেছে, শরীর ব্যথা করছে, তাও খুব খুশি! আশেপাশে ছিল বন্ধুরা, সুপারকুউল জুনিয়র ভাইবোনরা। ওদের ভালোবাসা দেখে অবাক হয়ে গেছি। আমার ধারণা ছিল, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে যারা পড়ে, ওরা আমাকে তেমন একটা পাত্তাটাত্তা দেয় না। ভুল জানতাম। আমার ভার্সিটিতে আমি এখন আর অপাঙ্ক্তেয় ন‌ই।

And, our day ended with James!

কিছু অবজারভেশন বলি।

একজন জেমস গান, গাওয়ান; নাচেন, নাচান। কাজটা সহজ নয়। অনেক দিনের সাধনায় একজন জেমস হ‌ওয়া যায়। উনি যখন গানের লাইন কিছু অংশ গাইলেন, আমরা চেঁচিয়ে বাকিটুকু গাইলাম। এসব গান রক্তে মিশে গেছে, চেঁচিয়ে না-গাইলে শান্তি লাগে না। রক্তে এমনিএমনিই মিশে না, এর জন্য আগে নিজের রক্ত ঝরাতে হয়।

ফ্যান যে কতটা ক্রেজি হতে পারে, এইসব আর্টিস্টকে কাছ থেকে (‘স্টেজের সামনে দাঁড়িয়ে’ অর্থে) না-দেখলে বোঝা সম্ভব নয়। উনি যদি গিটার হাতে দাঁড়িয়েও থাকেন, কিংবা মুখে উয়া ওয়া রেপাপ্পা রেরেপাপ্পা জাতীয় শব্দও করতে থাকেন, তাও আমাদের ভালো লাগে, আমরা গানটা চেঁচিয়ে করতে থাকি। কার‌ও কার‌ও উপস্থিতিই যথেষ্ট। একজন জেমস আমাদের সামনে আছেন, এইটুকু অনুভূতিও আমাদের আনন্দ দেয়।

হি ইজ প্রফেশনাল। হান্ড্রেড পার্সেন্ট প্রফেশনাল। উনি জানেন কী করতে হবে, উনি জানেন কী করতে হবে না। কখন শুরু করতে হবে, কখন থামতে হবে, উনি খুব ভালো করে বোঝেন। কী বলতে হয়, কতটুকু বলতে হয়, কখন বলতে হয়, উনার করায়ত্তে। উনি জানেন, আমরা উনাকে ভালোবাসি। উনি বোঝেন, একটা গোটা জেনারেশন উনার গান শুনে বড় হয়েছে, আর একটা জেনারেশন বড় হচ্ছে। সামনের কথা সামনের সময় বলে দেবে। যা-ই কিছু ঘটুক, উনার কিছু গান শেষ পর্যন্ত থেকে যাবে। যাবেই! সম্ভবত এটা উনি নিজেও জানেন।

এমন গ্রেটনেস আমাদের মুগ্ধ করে, বিস্মিত করে। আমাদের ভাবতে ভালো লাগে, আমরা জেমসের সময়ে জন্মেছি, বড় হয়েছি। একজন জেমস স্টেজে উঠবেন জানলে আমরা শুধুই তাঁর জন্য অপেক্ষা করে থাকতে পারি। কল্পনাতীত শ্রম ও অধ্যবসায় ছাড়া একজন জেমস তৈরি হয় না। সাথে কিছু মানুষের উপেক্ষা, মন্দকথা, কটূক্তিকে বুড়ো আঙুল দেখানোর অভ্যাস। সে-দলে কিছু মানুষ আছেন, যাঁদের কথা আমরা মানি, কিন্তু যাঁদের কথা মানার সত্যিই কিছু নেই। ওঁরা কারা, ভাবুন, পেয়ে যাবেন, বুঝে যাবেন। মানার কিছু আছে কি নেই, সময়‌ই বলে দেবে।

জুনিয়রদের বলছি, যারা গাইতে পার, ছবি তুলতে পার, আঁকতে পার, লিখতে পার, কিংবা অন্য যা-ই কিছু পার, যা তোমার বন্ধুরা পারে না, সত্যি বলছি, এর চাইতে বড় রত্ন, বড় সুযোগ আর হয় না। It’s a gift from God. Honour it! চর্চা করো, করেই যাও, যত কষ্টই হোক, সে-উপহার কখনোই ছেড়ো না। দেখবে, একদিন তুমিও….

বিশ্বাস হলো না তো? খোঁজ নিয়ে দেখো, জেমসের জীবনে আজকের দিনটা আসবে, হয়তো এটা তাঁর নিজের‌ই একসময় মনে হয়নি। তুমি একজন জেমস না-ই বা হলে, তাও তো এমন কেউ হয়ে উঠতে পার, যাকে দেখিয়ে অনেকেই বলবে, আহা, ওরকম হতে পারতাম! কোন‌ও এক বাবা তাঁর সন্তানটিকে বলবেন, দ্যাখ্, ওঁর মতো হতে হবে।

পড়াশোনা করছ, করো; পৃথিবীতে কিছু ঝামেলা এড়িয়ে বেঁচে থাকার জন্য একটা সার্টিফিকেট লাগে। তবে বেঁচে-থাকার সময়টাতে অন্তত কিছু মানুষের চোখে আলাদা হয়ে থাকার জন্য আরও বাড়তি কিছু লাগে, যা তোমাকে পৃথিবীর কোনও ভার্সিটি দিতে পারবে না, নিজেকেই অর্জন করে নিতে হবে…নিজেকে কষ্ট দিয়ে, ক্রমাগত আঘাত সহ্য করে, নিজের প্যাশনের প্রেমে পড়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে।

এত কথা কেন বললাম, জানো? যে মানুষ তাঁর ভালোবাসার কাজটিকে ততটাই ভালোভাবে করতে পারেন, যতটা অন্য কেউ পারে না, আমি সে মানুষটিকে ভালোবাসি, শ্রদ্ধা করি। এমন মানুষকে আমি আর্টিস্টের আসনে বসাই। আর্টিস্ট হয়ে ওঠো…পারবে। শুধুই ভালো রেজাল্ট করতে আমরা পৃথিবীতে আসিনি।

ভাবনা: ছয়শো তিরাশি

………………………………………………………

: আন্টি, আপনার তো অনেক বয়স হয়েছে, এখনও রান্না করে যাচ্ছেন, সবাইকে শেখাচ্ছেন। এবার একটু বিশ্রাম নেন। অনেক দিন করলেন তো! আর কত?

: না, বাবা…যতদিন পর্যন্ত এ এলাকায় আমার চেয়ে ভালো রান্না করে এমন কাউকে না পাচ্ছি, ততদিন পর্যন্ত আমাকে রান্না করে যেতেই হবে। ওরকম কাউকে পেলে তবেই তোমার আন্টির ছুটি!

২০০৪ সালের কথা। আমি সে-সময় পৃথিবীসুদ্ধ লোকের পোলাপানকে পড়িয়ে শিক্ষিত করে ফেলার মহান দায়িত্বে নিয়োজিত! চট্টগ্রামের জিইসি’র মোড়ের ওদিকটায় এক স্টুডেন্টকে পড়াতাম। ওর নাম হৃদয়। ওর মা অসাধারণ রান্না করতেন। এ জীবনে আমি যত হাতের রান্না খেয়েছি, সেগুলির মধ্যে আন্টির হাতটাই সেরা। রান্নাকরার কাজটাকে উনি শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। হৃদয়ের বাসা ছিল একমাত্র বাসা, যেখানে আমি, যা নাস্তা দিত, তার পুরোটাই নির্লজ্জভাবে চেটেপুটে খেয়ে ফেলতাম। অনেক দিনই পড়ানো শেষ করে ডিনার করে এসেছি। (এ জীবনে বিনা দাওয়াতে যে দুইএকটি বাসায় খেয়েছি, হৃদয়ের বাসা সেগুলির একটি।) আন্টি নাস্তায় মামুলি বেগুনি ভেজে দিলেও খেয়ে মনে হত, এর চাইতে ভালো বেগুনি বানানো সম্ভব নয়।

আন্টির বয়স হয়ে গিয়েছিল, অসুস্থ ছিলেন, শরীরও ছিল দুর্বল। ওই ভাঙাচোরা শরীর নিয়েই ঘরের সব রান্না নিজেই করতেন, কখনও নিজের হাতে করতে না-পারলেও রান্নাঘরে একটা মোড়ায় বসে হৃদয়ের ভাবিদের রান্নায় নানান নির্দেশনা দিতেন। এলাকায় কারও বাসায় কোনও অনুষ্ঠান নামলে সে-রান্নাঘরে আন্টির উপস্থিতি ছিল অনেকটাই অপরিহার্য! কেউ রান্না শিখতে চাইলে অনেক আগ্রহ নিয়ে রান্না শেখাতেন। আন্টি এসব করতেন মনের দাবিতে, কোনও অর্থের বিনিময়ে নয়। (ওই এলাকায় হৃদয়রা ছিল সম্ভবত সবচাইতে ধনী।) আন্টি আমাকে নিজের ছেলের মতোই দেখতেন, এতটাই স্নেহ করতেন যে বাসায় ভালো কিছু রান্না করলে সেদিন আমার পড়ানোর দিন না-থাকলেও ফোন করে আসতে বলতেন। আমিও যেতাম, নিঃস্বার্থ ভালোবাসার ডাক উপেক্ষা করার মতো মানসিক শক্তি আমার নেই।

আন্টি ছিলেন নিরক্ষর। কখনও স্কুলেই যাননি। তারপরও, আমার চোখে, আজও তিনি একজন মহান শিল্পী, সব সময়ই এমনই শ্রদ্ধেয় থেকে যাবেন। তিনি রান্না করতে ও অন্যকে তাঁর রান্না খাওয়াতে ভীষণ ভালোবাসতেন। রান্না করতে-করতে কখনও ক্লান্ত হতেন না; ভালোবাসার কাজে মানুষের ক্লান্তি আসে না। তিনি যতটা ভালো রাঁধতে জানতেন, যতটা আত্মবিশ্বাস নিয়ে রান্না করতেন, যতটা তৃপ্তি নিয়ে অন্যকে রান্না শেখাতেন, ততটা করতে গেলে নিছকই শেফ নয়, আর্টিস্ট হতে হয়। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আর্টগুলির একটি হলো রান্নাকরা। যাঁদের হাতের রান্না ভালো, আমি তাঁদের ভালোবাসি, সম্মান করি।

ভেবে দেখুন, একজন মানুষ তাঁর কাজটি কতটা ভালোভাবে করতে পারলে বলে ফেলতে পারেন, আমার চেয়ে ভালোভাবে কাজটা আর কেউ করতে পারে না! একজন চিত্রকর যে-মুহূর্তে আঁকেন, সে-মুহূর্তে তাঁর মনে হবে, এ পৃথিবীতে আমার চাইতে ভালো আঁকতে আর কেউ পারে না। একজন ফটোগ্রাফার যে-মুহূর্তে ক্যামেরায় ক্লিক করেন, সে-মুহূর্তে তাঁর মনে হবে, এ পৃথিবীতে আমার চাইতে ভালো ছবি আর কেউ তুলতে পারে না। একজন কবি যে-মুহূর্তে একটি কবিতা লিখছেন, সে-মুহূর্তে তাঁর মনে হবে, এ পৃথিবীর সেরা কবিতাটি আমি এখন লিখছি। একজন গায়ক যে-মুহূর্তে গান গাইছেন, সে-মুহূর্তে তাঁর মনে হবে, এ পৃথিবীতে আমার চাইতে ভালো আর্টিস্টের জন্ম এখনও হয়নি।…এর নাম নিজেকেই বেঁধেফেলা, চ্যালেঞ্জ ছুঁড়েদেওয়া—নিজেকে সেরা করে উপস্থাপন করার, নিজের কাজটা নিখুঁত করে তোলার, নিন্দুকের চোখেও অনিন্দ্য হয়ে থাকার।

…এমন কিছু ভাবনা এবং তার নিরলস চর্চা, হোক না তা এক খ্যাপাটে লোকের পাগলামিই, মানুষকে অন্য মানুষ করে তোলে। এতটাই অন্য যে, সবাই তাঁকে দেখে সমীহ করে, তাঁকে মুখে অপছন্দ করলেও মনে-মনে মেনে নিতে বাধ্য হয়: হি ইজ অ্যা জিনিয়াস! যাঁরা ওরকমই আর্টিস্ট, মনের অবচেতনেই তাঁরা কিছু কোড ফলো করেন। আপাতত একটা বলছি। অনেক বছর ধরে তাঁরা প্রতিদিনই, ভালোবাসার কাজটি আগের দিনের চেয়ে একটু হলেও ভালোভাবে করেন। যে-করেই হোক, করেনই! হয়তো পাঁচ মিনিট বেশি সময় দেন, হয়তো আরও একটু বেশি মনোযোগ দেন, হয়তো নিজেকে আগের দিনের চেয়ে একটু হলেও বেশি কষ্ট দেন। প্রতিদিনই এটা হতে থাকে। প্রতিদিনই…আরও একটু বেশি!

এ প্রসঙ্গে চুয়েটের এক স্যারের কথা মনে পড়ছে। সিএসই ডিপার্টমেন্টের আশফাক স্যার। উনি যখন ক্লাসে পড়াতেন, তখন এতটাই আত্মবিশ্বাস আর সে-বিষয়ে দখল নিয়ে পড়াতেন যে, ক্লাস করতে ভালো লাগত। আমরা বুঝতে পারতাম, স্যার যা পড়াচ্ছেন, তা তাঁর চাইতে ভালোভাবে পড়াতে পারবেন, এমন কেউ হয়তোবা আছেন, তবে আমাদের এমন একটি চাওয়াও নেই, যা পূরণ করাটা স্যারের আয়ত্তের বাইরে। ক্লাসে এক মিনিটও দেরি করে আসতেন না, খুবই সহজ ও সাবলীলভাবে বিষয়টি উপস্থাপন করতেন। উনার পড়ানোর স্টাইল, কথাবলার ও তাকানোর ধরন, ব্যক্তিত্ব, মার্জিত আচরণ দেখলে মুগ্ধ হতে হতো। যা পড়াচ্ছেন, তার পুরো কনসেপ্টটা উনার মাথায় আছে অত্যন্ত পরিষ্কারভাবেই। ক্যুইজ, ক্লাস-টেস্ট, ফাইনাল একজামের প্রশ্ন করতেন সহজ, খাতায় মার্কসও দিতেন অকৃপণভাবে। অসাধারণ শিক্ষক যাঁরা, তাঁদেরকে, প্রশ্ন কঠিন করে, স্টুডেন্টদের মার্কস কম দিয়ে অসাধারণ হয়ে থাকতে হয় না। পড়ানোর বাইরেও অনেক কিছু থাকে, যা শিক্ষকদের স্মরণীয় করে রাখে। স্যার ছিলেন দেখতেও খুব সুদর্শন, অনেক মেয়েরই ক্রাশ। স্যারকে ঈর্ষা করতাম না, ভালোবাসতাম। যাঁরা গ্রেট, তাঁদের আমি ঈর্ষা করতে পারি না, ভালোবেসে ফেলি! আমি স্যারের নাম দিয়েছিলাম: মিস্টার নেভার-বিহাইন্ড!…আর একজন স্যারের কথা বলে ফেলি: সাইফ স্যার। মাত্র কিছু দিন পেয়েছিলাম স্যারকে, তবু তাঁর কথা আমাদের মনে আছে। উনিই প্রথম ব্যক্তি, যাঁর ক্লাস করে আমাদের মনে হয়েছিল, আমরাও পারব! (বাকি স্যারদের কথা অন্য কোনও লেখায় লিখব।)

যা-ই হোক, উপরের অনুচ্ছেদের আগের অনুচ্ছেদে ফিরে আসি।…ক্রমাগত এমন চর্চায়, একসময় তাঁরা হয়ে ওঠেন অনন্য। এতটাই অনন্য যে, ওঁরা বলে ফেলতে পারেন…আমি জানি, আপনি আমার চেয়ে ভালোভাবে এটা করতে পারবেন না। আপনি আমাকে ঘৃণা করতে পারবেন, ঈর্ষা করতে পারবেন, হয়তো আমার ঘাড় থেকে পিতৃদত্ত মাথাটাও একপলকেই নামিয়ে দিতে পারবেন, কিন্তু আপনি কখনওই ‘আমি’ হতে পারবেন না।

তাঁরা—

শাহরুখ খানের মতো করে বলতে পারেন: আই অ্যাম দ্য বেস্ট!

মোহাম্মদ আলীর মতো চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে পারেন: আই অ্যাম দ্য গ্রেটেস্ট!

রোনালদোর মতো পরোয়া না-করেই নিজেকে বলে দেন: ইয়োর লাভ মেকস মি স্ট্রং, ইয়োর হেট মেকস মি আনস্টপেবল!

ভাবছেন, এইসব দম্ভ? অহংকার? মনেমনে বলেছেন, অহংকার পতনের মূল…ব্লা ব্লা ব্লা! নিজেকে প্রশ্ন করে দেখুন তো, একজন বিরাট কোহলি যেমন করে ড্যাম কেয়ার ভঙ্গিতে কথা বলতে পারেন, আপনি কি পারবেন অমন করে কথা বলতে? কী আছে আপনার অমন করে কথা বলার জন্য? ইউ ডিজার্ভ নট টু বি অ্যারোগ্যান্ট! বোঝার সুবিধে হবার জন্য বলছি: ওঁদের ওই দিকটা অহংকার নয়, আত্মবিশ্বাস কিংবা সত্যউপলব্ধি! আপনার আমার ওরকম কিছুর সাথে কখনও পরিচয় ঘটেনি বলেই আমাদের কাছে তা অহংকারের মতো শোনায়। যাঁকে অহংকার মানায়, তাঁকে পতিত হতে হয় না। অহংকার নয়, বরং অনর্জিত অহংকারই পতনের মূল! তিনি জানেন, কী করে নিজেকে ওই বেস্ট জায়গায় রেখে দিতে হয় দিনের পর দিন।

বলি কী, স্রোতের বিপরীতে চলা বলে আসলে কিছু নেই। একেক নদীর স্রোত একেক দিকে। একেকটা মানুষ একেকটা নদী। ফলে এক নদীর স্রোতের দিকের সাথে আর এক নদীর স্রোত মিলবে না, এটাই তো স্বাভাবিক, তাই না? আপনি স্রোতের বিপরীতে চলছেন না, আপনি আসলে আপনার নিজস্ব স্রোতের দিকেই চলছেন। সে-স্রোতটা ওঁদের কাছে অচেনা বলেই ওঁরা ওটাকে ‘স্রোতের বিপরীতে’ নাম দিয়ে নিজের মস্তিষ্ককে ছুটি দিয়ে দিচ্ছেন। চলুন না একটু সেই স্রোতেই! বড় নদীর নিজস্ব স্রোত থাকে, ছোট নদীর কাছে তা বরাবরই অভিনব, ভীতিকর…কখনওবা, পরিত্যাজ্য। সেখানেই মজাটা! যে-রাস্তায় লোকের হাঁটাচলা কম, সে-রাস্তায় দৌড়েও আরাম। যে-রাস্তায় লোকের হাঁটাচলা বেশি, সে-রাস্তায় তো হেঁটেও আরাম নেই!

গুরু শাহরুখ খানের আর একটা কথা দিয়ে শেষ করছি:

Love me or hate me………..but you cannot ignore me.

(আমি নিজেও কিন্তু সত্যিসত্যি জানি, যাঁরা আমাকে অপছন্দ করেন, মুখেমুখে পাত্তা দেন না, সুশান্তস-হেটার্স-ক্লাব-এর সম্মানিত সিনিয়র সভ্য, তাঁরাও লুকিয়েটুকিয়ে আমার অন্তত কিছু লেখা পড়েন, কিছু কথা শোনেন…আমার ওয়ালে আসেন। আমি তাঁদের প্রতি আমৃত্যু কৃতজ্ঞ থাকব। তাঁরা না-থাকলে আমি নিজেকে প্রতিদিন পোড়াতে পারতাম না। আমি পারফেকশনের দিকে ঝুঁকতে ভালোবাসি যতটা পারফেকশন পছন্দ করার কারণে, তার চেয়ে অনেক বেশি আমার সম্মানিত হেটারদের জন্য কিছু অসুবিধে তৈরি করে দিতে—তাঁরা আমাকে নিয়ে যা-ই বলুন না কেন, আমার কাজের শুদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারবেন না। (আমাকে নিয়ে বাজে কথা তো উনারা বলবেনই, নাহয় যে চাকরি থাকবে না!)

একটা কথা বলি, ভাই! ওরা আপনাকে সহ্য করতে পারে না কেন, জানেন? কারণ ওরা আপনার মতো হতে পারেনি। চেষ্টা করেছিল, কিন্তু পারেনি। একটু মানিয়ে নিন, বস! লাথিটা ওদের নয়, নিজেকেই মারুন, আর এগিয়ে যান—প্রতিদিনই, একটু-একটু করে। ওরা পারবে না, ওই জায়গাতেই থেকে যাবে…এ বিষয়ে নিশ্চিত ও নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন!)

ভাবনা: ছয়শো চুরাশি

………………………………………………………

এক। জীবনটা যতক্ষণ নিজের অর্থে চলছে, ততক্ষণ নিজের শর্তেই চালানো ভালো। তা না হলে, একটা সময় জীবনে অনেক দুঃখ পেতে হয়। আর যদি পরের অর্থে চলে, তবে সেখানে ‘নিজের শর্ত’ বলে আদৌ কিছু থাকে বলে আমার মনে হয় না, থাকলেও তা থাকে স্রেফ গায়ের জোরে, গোঁয়ার্তুমির জোরে, নির্লজ্জতার জোরে—‘দূরবীন’ উপন্যাসের ধ্রুব চরিত্রটির যেমন ছিল।

দুই। ব্যবসায় কমিটমেন্ট

———————————-

কিছু ব্যবসায়ী দামে ঠকান, কিন্তু জিনিসে ঠকান না। আমার কাছে ওঁদের গ্রহণযোগ্য মনে হয়। নাহয় কায়দা করে মুনাফা বেশি করেছেন, কিন্তু জিনিস ঠিক দিয়েছেন। হয়তো আমার হাতে সময় কম ছিল, দরদাম করার ইচ্ছে কম ছিল, জিনিসটা সত্যিই আমার খুব দরকার ছিল বা পছন্দ হয়েছে, জিনিসটার কোয়ালিটি আমার কাছে ভালো লেগেছে, জিনিসটা অন্য কোথাও পাওয়া যাচ্ছিল না, কিংবা পয়সা উদ্বৃত্ত ছিল বলে আমি ওঁদের কাছ থেকে বাড়তি দাম দিয়ে জিনিসটা কিনেছি। এখানে আমারও একটা দায় বা দোষ, যা-ই বলেন না কেন, আছে। আপনি আমার কাছ থেকে আরও কিছু টাকা বাড়তি রাখুন, কিন্তু জিনিস খারাপ দেবেন না। আমার হাতে সত্যিই সময় নেই অতটা পেইন নেওয়ার। কেন নেব? আমি তো ওটা আপনার কাছ থেকে ফ্রিতে নিইনি! আপনি যেহেতু আমার কাছ থেকে পয়সা নিয়েছেন, আমার প্রত্যাশাপূরণের দায়টা আপনার কাঁধেই পড়ে। দুনিয়ায় একমাত্র ফ্রি জিনিসেরই কোনও দাম নাই। বহু বছর ধরে একদামের দোকান থেকে জিনিস কিনি সময় বাঁচাতে, ঝামেলা এড়াতে। কাউকে কোনও সেবা দেওয়ার জন্য টাকা নেওয়ার সময় এমন একটাও কমিটমেন্ট করবেন না, যা রাখা আপনার পক্ষে সম্ভব নয়। আপনার সীমাবদ্ধতা আপনি আগেই জানিয়ে দিন, এতে আপনার প্রতি আমার যে সম্মান ও বিশ্বাস, তা নষ্ট হবে না। আমি একটা কথাই বুঝি: আপনি কী দাম নিলেন, সেটার চাইতে গুরুত্বপূর্ণ আপনি আমাকে কী পণ্য বা সেবা দিলেন।

কিছু ব্যবসায়ী দামেও ঠকান, জিনিসেও ঠকান। আমার কাছে মনে হয়, কিছু লোক তো ভিক্ষে করেও বেঁচে আছেন। ওঁদের দলে ওই ব্যবসায়ীরা ঢুকে পড়লে আমরা ভোক্তারা বেঁচে যেতাম। ব্যবসা অনেক মহৎ একটি কাজ। কাজটা খুব কঠিন, আমি করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি। ভাবুন তো, আপনি একটি পণ্য বা সেবা সরবরাহ করছেন, যা অনেক মানুষের জীবনযাপনকে সহজ করে দিচ্ছে। এই কাজটা কয়জন করতে পারে? মানুষের উপকার করার সুযোগ আপনি পেয়েছেন, আর সেটাকে এমনভাবে নষ্ট করছেন? আপনার নিজের প্রতি সম্মানবোধ থাকলে আপনি ভোক্তাকে খারাপ পণ্য বা সেবা দিতে পারতেন ন্যায্য দাম নিয়েও? ছিঃ!

মাত্র ৫ দিন আগে চট্টগ্রামের আখতারুজ্জামান সেন্টারের চারতলায় অবস্থিত একটা দোকান থেকে পাওয়ার ব্যাংক কিনলাম। আমার এসআইয়ের হাতে টাকা দেওয়ার সময় বারবার বলে দিয়েছিলাম, ভালো জিনিস আনবেন, দাম যা-ই হোক। আমার কাছে প্রোডাক্টের কোয়ালিটিটাই জরুরি। উনি প্রোডাক্ট নিয়ে এলেন, সেটিতে ৬ মাসের ওয়ারেন্টিযুক্ত স্টিকার-লাগানো। মাত্র দুইদিন ব্যবহারের পর দেখলাম, পাওয়ার ব্যাংকে চার্জ হচ্ছে না ঠিকমতো। সারারাত চার্জে ফেলে রাখলেও মাত্র এক দাগ চার্জ হয়। আজকে যখন ওটা দোকানে ফেরত পাঠালাম, তখন দোকানদার বললেন, আমি নাকি পাওয়ার ব্যাংকে চার্জ দিতে জানি না, ওটার ক্ষমতা বেশি আর আমার চার্জারের ক্ষমতা কম ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি সাধারণত কখনওই চার্জার ব্যবহার করে ফোনে চার্জ দিই না, সবসময়ই পাওয়ার ব্যাংক ব্যবহার করি। অনেক বছর ধরেই। এখন আমাকেই যদি কেউ সহজ পদ্ধতিতে পাওয়ার ব্যাংক ব্যবহারবিধি শেখাতে চান, তা হলে তো সমস্যা! আমি উনাকে অনুরোধ করলাম, দরকার হলে আপনি আরও পাঁচশো টাকা বেশি রাখুন, কিন্তু আমাকে দুই নাম্বার জিনিস দেবেন না। উনি তাও বললেন, আমার চার্জারে সমস্যা! আমরা শালার এতটাই ইতর হয়ে গেছি যে ভুলটা স্বীকার করে সরি বলতেও ভুলে গেছি! এই যে কিছু লোক ভুজুংভাজুং বলে লোকের পকেট থেকে টাকা নিয়ে ফেলে, ওদের লজ্জাও করে না? ওদের সাথে রাস্তার চোরছ্যাঁচড়ার তফাতটা কোথায়?

আরেকটা ঘটনা বলি। বহু বছর ধরে আমি প্রায়ই অনলাইনে বই কিনি, আবার বিভিন্ন দোকান থেকে ফোনে অর্ডার করেও কিনি। (অনলাইন শপ ‘রকমারি’ থেকে বইকেনার তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে আমার একটা লেখা আছে, অনেকেই পড়েছেন হয়তো।) গত বুধবার ঢাকার আজিজ সুপার মার্কেটের ‘তক্ষশীলা’, ‘সন্ধিপাঠ’ ও ‘প্রথমা’ থেকে কলকাতার বেশ কিছু বই কিনলাম। বইগুলি সুন্দরবন ক্যুরিয়ার সার্ভিস-এর মাধ্যমে হোম ডেলিভারির পেমেন্ট করে পাঠানো হয়। ডেলিভারির ঠিকানা দেওয়া হয় আমার অফিসের ঠিকানা। বইগুলি এসে পৌঁছানোর কথা বৃহস্পতিবার সকালে। এল না। এদিকে মহামান্যরা ফোন করলেও ধরেন না! দুপুর ২.০০টার দিকে আমি ওদের আগ্রাবাদ অফিসে আমার সিপাইকে পাঠালাম। ম্যানেজার সাহেব জানালেন, বইগুলি সেদিন রাত ৮.৩০টার দিকে ওদের অফিসে পৌঁছাবে। জ্যামের কারণে পথে দেরি হচ্ছে। সাথে এও কথা দিলেন, যেহেতু শুক্র- ও শনিবার অফিস বন্ধ, রোববার সকালের মধ্যেই ওরা অফিসে এসে বই দিয়ে যাবে। রোববার এল, বই আর এল না। দুপুর ১.৩০টার দিকে ওদের অফিসে আমার সিপাইকে আবারও পাঠালাম। বই এসেছে বৃহস্পতিবার রাতেই, কিন্তু ওরা ডেলিভারি করতে ভুলে গেছে। পয়সা পকেটে ঢুকে গেছে, আর যে কাজে পয়সাটা পকেটে ঢুকল, সে-কাজটাই করতে ভুলে গেছে! বাহ্‌! হোয়াট অ্যান একজাম্পল অব প্রফেশনালিজম! এখানেই ইতরামির শেষ নয়! আমার সিপাইকে পেয়ে ওরা বলল, আপনি এসেছেন, ভালোই হয়েছে, এই কার্টনটা নিয়ে যান। আমার সিপাই রাজি না হলে ওরা তার সাথে দুর্ব্যবহার করতে শুরু করে। উল্লেখ্য, সে কার্টনের ওজন অনেক অনেক বেশি, যা একজনের পক্ষে বয়ে-আনা দুঃসাধ্য। তার চাইতে বড় কথা, যেটা আমি বাসায় বসে ডেলিভারি পাওয়ার কথা, সেটা কেন আমাকেই বয়ে নিয়ে আসতে হবে? ওরা কেন হোম ডেলিভারির কথা বলে দায়িত্বটা নিল? মূর্খরা কি ‘হোম ডেলিভারি’র অর্থই বোঝে না নাকি? নাকি লোকজনকে এভাবে হয়রানি করেই ক্যুরিয়ার ব্যবসা চলছে? প্রাপ্য সেবা তো পেলামই না, উল্টো জানলাম, সেই ‘হোম ডেলিভারি’র কার্টন নাকি আমাদেরকেই বয়ে নিয়ে যেতে হবে! একে তো ওরা ওদের দায়িত্বপালন করেনি, তার উপর জোর করে আমাদেরকেই ওটা গছিয়ে দিতে চাইছে! বাব্বাহ্‌! হোম ডেলিভারি করতে না-পারলে ওরা কেন আমাদের কাছ থেকে সেটার জন্য টাকা নিয়ে কমিটমেন্ট দেয়? আমাদের দুর্ভাগ্য, এরকম কিছু দায়িত্বজ্ঞানহীন ইতর টাইপের ফালতু লোকের হাতে আমরা জিম্মি হয়ে আছি! এ দুর্ভাগা দেশে আপনি টাকা দিয়েও প্রাপ্য সেবাটি পাবেন না।

আবারও বলছি, আপনি আমাকে প্রয়োজনে দামে ঠকান, তবু জিনিসে ঠকাবেন না, সেবার নামে হয়রানি করবেন না। ভোক্তা/ গ্রাহক হিসেবে আপনার কাছ থেকে এইটুকু তো আমার প্রাপ্য। আমি ঝামেলা থেকে বাঁচতে পয়সা বেশি খরচ করতে রাজি আছি, কিন্তু ঠকতে রাজি নই। আপনি আমাকে ঠিকঠাক পণ্য বা সেবা সরবরাহ করতে না-পারলে আগেই বলে দিন, আমি জেনেবুঝে সিদ্ধান্ত নিতে চাই। কিন্তু আমার কাছ থেকে কৌশলে টাকাটা নিয়ে ফেলে আমাকে অহেতুক ঝামেলায় ফেলে দেবেন, এমন মানসিকতা ধারণ করে অনুগ্রহ করে ব্যবসা করবেন না; ভিক্ষা করেও সম্মান নিয়ে বাঁচা যায়, অন্তত আপনাকে ভিক্ষা দেওয়ার সময় তার বিনিময়ে আমার কোনও প্রত্যাশা থাকবে না।

ব্যবসা মহৎ বৃত্তি। এখানে কমিটমেন্টের মূল্য সবচাইতে বেশি। যদি ওটা আপনার মধ্যে না-থাকে, তবে ব্যবসা আপনার জন্য নয়। আমি নিজেও ব্যবসা করতাম একসময়। কখনও কখনও ভোক্তাকে দামে ঠকিয়েছি, কিন্তু পণ্যে বা সেবায়…পূর্ণ সততা নিয়ে বুকে হাত রেখে বলতে পারি—কখনওই না! স্বেচ্ছায় কমিটমেন্ট ফেইল করার একটাও রেকর্ড আমার সারাজীবনে নেই। আমার কাছে কমিটমেন্টের দাম সবচাইতে বেশি। আমি যা আপনাকে দিতে পারব না, আমি যা আপনার জন্য করতে পারব না, তেমন কোনও প্রতিশ্রুতি আমি আপনাকে জীবন থাকতে দেব না। কমিটমেন্ট ভাঙার চাইতে ভিক্ষে করে খাওয়া ভালো। অন্যের চোখে সম্মান নিয়ে বেঁচে-থাকার চাইতে বড় সৌভাগ্য আর হয় না। আমার এক বন্ধুর কথা মনে পড়ছে। সে আমাকে বলত, বন্ধু, দুনিয়ার সবাই যদি তোর মতো হতো, তবে অন্তত টাকা রাখতে কোনও ব্যাংকের দরকার হতো না, তোর মতন কারও কাছে টাকাটা রাখা যেত।…এটি আমার সারাজীবনের সেরা সার্টিফিকেটগুলির একটি। আমার কাছ থেকে এক পয়সাও পায়, পৃথিবীতে এমন একজন মানুষও নেই। আমি যদি এই মুহূর্তেই মারা যাই, আমাকে গালি দেওয়ার জন্য একজনও পাওনাদার পাবেন না। যাঁরা কমিটমেন্ট রাখতে পারেন না, তাঁদের ব্যবসায় নামাই উচিত নয়। টাকাপয়সা ফাজলামো করার জিনিস নয়। যে কমিটমেন্ট রাখতে পারবেন না, তা দিয়ে টাকা নেওয়ার চাইতে বরং দান বা সাহায্য হিসেবে টাকাটা নেওয়া ভালো।

যে গোয়ালা দাম বেশি নিয়ে দুধটা খাঁটি দেয়, সে গোয়ালাই ভালো। যে গোয়ালা দাম কম নিয়ে দুধটা ভেজাল দেয়, সে গোয়ালা করুণার পাত্র। আপনি বলেই দেখুন না, আপনার পণ্যের/ সেবার দামটা বেশি, কিন্তু কোয়ালিটি ভালো, দেখবেন, আপনার ভোক্তা/ গ্রাহক কমবে না, বরং বাড়বে। আপনার পণ্য/ সেবা সব শ্রেণীর জন্য নয়। ভালো জিনিস কিনতে ভালো টাকা লাগবে, এটাই স্বাভাবিক। যাঁদের পকেটে ওই জিনিস কেনার পয়সা নেই, তাঁরা অন্য কোথাও থেকে কিনবেন, কিন্তু কেনার পর কেউ আপনাকে গালাগালি করবেন না। লোকের গালি না-খেয়ে ব্যবসা করার চাইতে গৌরবের আর কী আছে?

তবে সুখের কথা, অনেক ব্যবসায়ীই ভালো, কমিটমেন্ট ঠিক রাখেন। আপনার জানামতে এমন কিছু ব্যবসায়ীর কথা এই পোস্টের কমেন্টে জানাতে পারেন। আমরা ওঁদের ধন্যবাদ জানাতে চাই। ভালো মানুষ নিশ্চয়ই শ্রদ্ধার যোগ্য।

ভাবনা: ছয়শো পঁচাশি

………………………………………………………

এক। : আমার মন পুড়ছে তোমার জন্য।

: আমার ঠোঁট ফাটছে শীতের জন্য।

(কথোপকথন সমাপ্ত।)

দুই। পরিবারের কর্তা বা উপার্জনকারী (উপার্জনক্ষম নয়) ব্যক্তিটি হঠাৎ মারা গেলে পরিবারের সদস্যদের মাথায় একবারও কি আসে না, আহা, আমাদের দুধেল গাইটা/ ভারবাহী গাধাটা মারা গেল!

তিন। যার প্রার্থনা করার কোনও মানুষ নেই, সে বড়ো দুর্ভাগা।

আমরা কখনও জানতেই পারি না, পৃথিবীর কোথায় কে আমাদের জন্য প্রার্থনা করছে, আমাদের সবসময়ই শুভকামনায় রাখছে। এমন‌ও হতে দেখেছি, কেউ এমন একজন মানুষের জন্য প্রার্থনা করছেন, চাইছেন–সেই মানুষটা ভালো থাকুক, তার অসুখবিসুখ না হোক, সে তার পরিবার ও বন্ধুদের নিয়ে আনন্দে বাঁচুক, তার জীবনে কোনো দুঃখ না থাকুক, চলার পথে ঝড় এলে যেন মানুষটা সামলে নিতে পারে, বেঁচে-থাকাটাকে তার কাছে সুন্দর মনে হোক–এরকম আরও অনেক কিছু…আর সে মানুষটা কখনও জানল‌ই না যে কেউ তাকে প্রতিক্ষণেই এত ভালোবাসছে!

না জানল‌ই-বা! কী এসে যায়? কাউকে ভালোবাসলে তাকে জানাতেই হবে? না জানালে ভালোবাসা ফুরিয়ে যায় কখনও? মানুষটির জন্য পাগলামি কমে যেতে পারে, অস্থিরতার প্রকাশ‌ও সময়ের সাথে সাথে ফিকে হয় হয়তো, তবু সত্যিকারের ভালোবাসা বেঁচে থাকে, শেষ অবধি টিকে থাকে। সেই মানুষটির সাথে হয়তো দেখাও হয়, কথাও হয়, তবু কখন‌ওই বলা হয় না–ভালোবাসি, এমন ভালোবাসার কি মূল্য নেই? ভালোবেসে ফেললে বলে দেওয়া যায়… সত্যিই যায়? তবু, যে ভালোবাসে, সে কি আনন্দ পায় না? কাউকে ভালোবাসলে তার জন্য প্রার্থনা মন থেকেই চলে আসে। আর প্রার্থনার অর্থ‌ই তো হলো হৃদয়ের ঈশ্বরের সাথে একান্ত আলাপন। এই আলাপন, এই সংযোগসাধন, এই নিভৃতযাপন মানুষের মনের শক্তিকে অনেক বাড়িয়ে দেয়। ভালোবাসা ধ্যানের মতো, স্বস্তির মতো, আশ্রয়ের মতো।

আমরা যতক্ষণ প্রার্থনা করি, ততক্ষণ আমাদের সাথে ঈশ্বরের গল্প হয়। সে-গল্পে প্রায়ই নিজের অজান্তেই অনেক প্রশ্নের উত্তর মেলে, অনেক অনুভূতির পরিশুদ্ধি ঘটে, অসীম শক্তি এসে ভর করে মনে, জীবনের অনেক নতুন দিক খুলে যায়। আমরা যে-সকল রহস্যের কূলকিনারা করতে পারি না হাজার চেষ্টাতেও, সেগুলির সহজসরল ব্যাখ্যা প্রার্থনার সময় কোথা থেকে যেন চলে আসে। এই যে আনন্দের পথে আশ্চর্য যাত্রা, তার চেয়ে বড় সৌভাগ্য আর হয় না।

যাঁরা আর্টিস্ট, তাঁরা যখন সৃষ্টি করেন, তখন তাঁরা হয়তো কোন‌ও প্রিয় মানুষ, ভাবনা বা অস্তিত্বকে মনের মধ্যে গেঁথে রেখে দেন। এতে অনেক সুবিধে হয়, সৃষ্টির কাজটি সহজ ও সাবলীল হয়ে ওঠে। জগতের সকল মহৎ সৃষ্টিই প্রার্থনার এক-একটি ফসল। যে-মানুষটি আপনার জুতোজোড়া চকচকে করে দিচ্ছেন, তাঁর কথা ভাবুন তো! তিনি যখন কাজটি করছেন, তখন হয়তো তাঁর মনে ভাসছে তাঁর প্রিয়জনের মুখটি, যাঁর জন্য তাঁর জীবিকার আজকের এই আয়োজন। যখন‌ই তাঁর মন সেই ছবি আঁকছে, তখনই তাঁর কাজটা হয়ে উঠছে প্রার্থনার কাছাকাছি কোন‌ও কিছু। কাজের মান বাড়ছে, আপনার খুশি বাড়ছে। জুতোর চেহারাবদলের সাথে সাথে আপনার চেহারাও বদলে যাচ্ছে। আপনার আনন্দ, আপনার আত্মবিশ্বাস, আপনার সৌন্দর্য আপনার আশেপাশের সবাইকে স্পর্শ করছে। এই যে নতুন এক মানুষ সৃষ্টি হলো, সে নিশ্চয়ই ওই গরীব মানুষটির অবদান। এখানেই তিনি আর্টিস্ট। এই আর্টের সৃষ্টিপ্রক্রিয়াই হলো প্রার্থনা।

প্রার্থনায় মানুষের দায়বদ্ধতা তৈরি হয়। শিল্পীর তুলি তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকে, লেখকের কলমটি তাঁর সাথে কথা বলে, গায়কের হারমোনিয়াম তাঁর কাছে কী যেন চায়, নরসুন্দরের কাঁচি তাঁকে শাসন করে, ফটোগ্রাফারের লেন্স তাঁর কাছে কিছু দাবি রাখে…ওরা বলে যায়, আমাকে ভালোবাসো! ভয় পেয়ো না, তোমার এই প্রার্থনায় আমি তোমার সাথে আছি। সত্যিই, প্রত্যেক আর্টিস্ট‌ই প্রেমে পড়েন–শিল্পসৃষ্টির উপকরণের, তাঁর কাজের, তাঁর নিজের শিল্পীসত্তার, আর্টের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতার। তা থেকেই আসে প্রার্থনা ও আন্তরিকতা।

তাই বলছি, চোখে হাসি ও মনে স্বস্তি নিয়ে বাঁচতে হলে জীবনে এমন কাউকে প্রয়োজন, যাঁর জন্য প্রার্থনা আপনিই চলে আসে, যাঁর কথা ভেবে নিজেকে ভালো রাখতে ইচ্ছে করে। যাঁকে বলে ফেলা যায় না–ভালোবাসি, অথচ প্রতি মুহূর্তের যাপনে সেই মানুষটিই থেকে যায়… শেষ পর্যন্ত…যা-ই ঘটুক না কেন!

ভাবনা: ছয়শো ছিয়াশি

………………………………………………………

স্বস্তিতে বাঁচতে চায় না যারা, তাদেরই সাথে বাঁচা

————————————————————–

এক ধরনের মানুষ আছে যারা ঝামেলা আর ঝগড়াঝাঁটি করতে পছন্দ করে। ওরা বেশিদিন ঝগড়া না-করে, ঝামেলা না-বাধিয়ে বাঁচতে পারে না। ওদের চারপাশের মানুষ যদি ওদের সাথে এমন কিছু নাও করে, যার কারণে ঝামেলা তৈরি হতে পারে, তাও ওরা নিজেরাই তেমন কিছুই করে বসে কিংবা তেমন কোনও খারাপ আচরণ করে, যেমন করলে রাগারাগি হয়, ঝগড়া হয়। দরকার হলে ওরা পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করবে, তাও করবেই। ওদের ব্যক্তিগত অভিধানে ‘শান্তিতে বাঁচা’ বা ‘স্বস্তিতে বাঁচা’ বলে কিছু নেই। ওরা একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর ঝামেলা তৈরি করার একটা ইস্যু খোঁজে। ইস্যু না পেলে ইস্যু তৈরি করে, কখনওবা পুরনো কোনও ইস্যুকে উসকে দিয়ে ঝামেলা পাকিয়ে থাকে। কারও মাথা ফাটাতে না-পারলে নিজের মাথা ফাটায়, ঝামেলাকে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে আসে—এরকমই কিছু একটা করে আরকি! ঝামেলা বড়সড় করতে পারলেই ওদের শান্তি। ওরা বরং স্বস্তিতে থাকতেই অস্বস্তি অনুভব করে। কারও না কারও, একটা যা হোক, ক্ষতি করে তবেই ওরা শান্ত হয়। অন্যকে কষ্ট পেতে দেখলে ওরা আনন্দ পায়। এই আনন্দই ওরা চায়। এর জন্য দরকার হলে নিজের সময় নষ্ট করে, কখনও শ্রম ও অর্থের বিনিময়ে হলেও ওরা অন্যের ক্ষতি করার চেষ্টা করে। ওদের টার্গেট থাকে প্রায়ই এমন সব মানুষ, যারা ওদের চেয়ে সামাজিক, মেধাগত ও আর্থিক অবস্থানে এগিয়ে। কখনওবা, ওদের সমসাময়িক কারও পা টেনে ধরে রাখে, যাতে সে সামনের দিকে এগোতে না পারে। অনেক চেষ্টা করেও বা তেমন চেষ্টা করেনি বলে নিজেরা কোথাও পৌঁছতে পারছে না, তাই অন্যকেও সেখানে পোঁছতে দেবে না, এমন একটা ভাবনা ওদের মাথায় অবিরাম কাজ করে। বড় অবস্থানের সবাইকেই ওরা তেমন কোনও কারণ ছাড়াই ঘৃণা করতে পারে। ওরা যেন ঘৃণাকরার অসীম ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছে! এমনও হয়, ওরা ঘৃণা করার যুক্তি হিসেবে উদ্ভট কিছু কারণ তৈরি করে, এবং সে-ঘৃণাটা সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিরলসভাবে সময় ব্যয় করতে ভালোবাসে। ওরা লুজার প্রকৃতির মানুষ, ওদের বন্ধুবান্ধবও বেশি। জগতে লুজাররা সব সময়ই দলে ভারী।

আরেক ধরনের মানুষ আছে, যারা অল্পতেই রেগেমেগে ভাংচুর শুরু করে দেয়, সামান্য একটা বিষয়কে অযথাই টেনে-টেনে বড় করে ফেলে। লাগামহীন অসংগত ভাষা আর কথার রাজ্যে প্রায়ই ভেসে যায় ইচ্ছে করেই। ওরা আসলে দুর্বল চিত্তের মানুষ। নিজের দুর্বলতা ঢাকতে চিৎকার-চ্যাঁচামেচি শুরু করে। এটা অনেক পুরনো ও অব্যর্থ টেকনিক। সবল মানুষের মুখের চেয়ে মস্তিষ্কের ক্ষমতা সাধারণত বেশি। অতএব, ওদের ওরকম হাঙ্গামা দেখলে সবল মানুষরা চুপ হয়ে যায়, দূরে সরে থাকে। তখন ওই দুর্বল মানুষগুলি ভাবে, এতেই ওদের জয়! এমন সহজলব্ধ সাফল্যকে ধরে রাখতে ওরা পরবর্তী সময়েও এরকম ভাংচুর আর হইচইয়ের রাস্তাই অনুসরণ করে। নগদ লাভের আশায় নিজেদের অথর্ব ও ইতর করে রাখতেও ওদের কোনও আপত্তি নেই। ওরা নিজেদের এমন একটা পর্যায়ে নামিয়ে ফেলতে পারে, সেখানেই থেকে যেতে পারে অনন্তকাল—যা ভাবতেও ঘেন্না হয়। ওদের চ্যাঁচামেচি শুনে বাকিরা চুপ করে আছে, সন্ত্রস্ত আর তটস্থ হয়ে আছে, এটা দেখে ওরা এক ধরনের আনন্দ পায়। যদি এমন কেউ হয় কাছের মানুষ, যাকে ফেলেও দেওয়া যায় না, আবার সহ্যও করা যায় না, তবে এমন পরিস্থিতিতে বাঁচতে হওয়ার চেয়ে বড় অসহায়ত্ব আর হয় না। ওদের প্রতি ক্রোধ ও করুণা জন্মে, কিন্তু দাঁতে দাঁত চেপে নীরবে মেনে-নেওয়া ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর কিছু না কিছু ভাংচুর করতে না পারলে ওদের হাত চুলকায় হয়তো! নির্মম বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে আমরা কিছু মানুষের হাত ভেঙে দিতে পারি না বলে ওরা ধরেই নেয়, ওদের হাতের শক্তি বুঝি অনেক বেশি! কখনওবা, ওরা ভেবে বসে থাকে, আজ যে-করেই হোক, নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করেই ছাড়বে, নয়তো পৃথিবীসুদ্ধ ভেঙেচুরে তছনছ করে দেবে। ওদের এমন ক্রোধের হাত থেকে বাঁচতে সবাই ওদের জিতিয়ে দিয়ে শান্ত রাখে। এটা মেনে নেওয়া যে কী যন্ত্রণার, একমাত্র ভুক্তভোগীই তা জানে। ওরা ভাবে, ওরাই সর্বজ্ঞানী, ওদের সিদ্ধান্তই ঠিক, এবং ওদের সিদ্ধান্তই গোটা পৃথিবীর মানুষ মেনে চলতে বাধ্য! ওরা ‘যত মত, তত পথ’ নীতিতে চলে না। ওদের বিশ্বাস: একটাই মত, একটাই পথ। সে-মত ওদের, সে-পথ ওদের। সবাইকে সে-মতে, সে-পথে চলতেই হবে! যারা চলবে না, ওরা খারাপ, ওদের সব কিছুই ভুল। এই অসুস্থ লোকগুলি যদি দেখে, কেউ একজন তাকে মানছে না, তবে ধরে নেয়, সেটা অবশ্যই ওই লোকটারই ভুল এবং সেই মুহূর্তেই গিয়ে সে অপরাধে তাকে পিটিয়ে আসা দরকার, এমনকী, মেরেও ফেলা যায়! ওরা এরকম করেই ভাবে! ওদের চোখে, একমাত্র ওরাই ঠিক, বাকিরা সবাই ভুল। ওরাই সব বোঝে, বাকিরা ঘাস চিবোয়। অন্য মতের প্রতি বিন্দুমাত্রও সহনশীলতা নেই ওদের!

আরেকটি অতি-ভয়াবহ জিনিস হচ্ছে সন্দেহ, সব সময় ছোটো-বড় সব বিষয়েই নিরর্থক সন্দেহ করে কেউ-কেউ। অন্যকে সন্দেহ করে বেঁচে-থাকাই ওদের একমাত্র কাজ। ওরা সারাক্ষণই লোকের খুঁত খুঁজতে থাকে, দড়ি দেখলেও সাপ ভাবে, কাউকে ঘুমাতে দেখলে মৃত ভাবে। কেউ গলা পরিষ্কার করতে কাশলেও ভাবে, নিশ্চয়ই এর পেছনে কোনও না কোনও কারণ আছে। ওদের দিকে তাকাতেও লোকে ভয় করে, কী না কী ভেবে বসে! ওদের সামনে সবাই অনেকটা ভয়েই থাকে, স্বাভাবিক হয়ে থাকতে পারে না। ওদের সাথে সহজভাবে চলা সম্ভব নয়। প্রায়ই অভিনয় করে চলতে হয়, অস্বস্তি নিয়েই বাঁচতে হয়, একেবারেই নির্দোষ কাজটিও সাবলীল মনে করা যায় না। ওদের সাথে চললে অহেতুকই নিজের মধ্যে অপরাধবোধ তৈরি হয়ে যায়। ওরা একজনের সম্পর্কে অন্যজনকে নেতিবাচকভাবে বলে। যদি কেউ ওদের সন্দেহের তালিকায় থাকে, তবে তার সম্পর্কে ভালো কথা বলে যারা, তাদের ওরা পছন্দ করে না। ওদের মতোই খুঁত খুঁজে-খুঁজে ও সন্দেহ করে বাঁচে যারা, তাদের সাথেই ওদের বন্ধুত্ব সবচাইতে বেশি। এই ধরনের মানুষ ভেবেই নেয়, পৃথিবীসুদ্ধ সবাই সুযোগ পেলেই চরিত্রহীন। শুধু সে নিজেই চরিত্রবান, নিজের সব কিছুই ভালো। এ পৃথিবীতে মাত্র একটুকরাই নিখুঁত মানুষ তৈরি করা হয়েছে, সে-মানুষটি সে নিজে। অবিশ্বাস্য রকমের দুর্ব্যবহার করতে জানে ওরা। ওরা কখনওই নিজেদের পিঠের দাগটা দেখে না, কেবল অন্যের পিঠের দাগ খুঁজে বেড়ায়। ওরা ভাবে, বিভিন্ন উপায়ে অন্যকে ধোঁকা দেওয়া যায়, এবং ওরা নিজেরা বাদে পৃথিবীর সবাই-ই ধোঁকাবাজ কিসিমের। অবশ্য, অন্যকে ধোঁকা দেওয়ার সে-উপায়গুলি কেবল ওরাই ভালো জানে! ওরা মানুষকে জোর করে বেঁধে রাখতে পছন্দ করে। ওরা মানতেই চায় না যে, কাউকে আসলে জোর করে বেঁধে রাখা যায় না। যদি যায়ও, তার পক্ষে সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ হয়ে বেঁচে-থাকা সম্ভব নয়। এমনি করে কাউকে দিনের পর দিন অস্বস্তি ও কষ্ট নিয়ে বাঁচতে বাধ্য করা এক ধরনের পাপ। এই পাপে ওদের কোনও আপত্তিই নেই! চোখের শাসনে, মুখের বাজে কথায়, উদ্ধত আচরণে, যে-কোনও উপায়ে ঝামেলা বাধিয়ে বা লোক জড়ো করে অন্যকে অপদস্থ করতে ওরা ওস্তাদ। ভদ্র ও নির্ঝঞ্ঝাট গোছের লোকজনই ওদের খপ্পরে বেশি পড়ে। মানসম্মানের ভয়ে, ঝামেলা এড়াতে ওদের কাছে সবাই কাবু হয়ে থাকে। ওদের সাথে কথাবলার সময়, যা নিয়ে মিথ্যেবলার কিছুই নেই, তা নিয়েও মুখে মিথ্যে চলে আসে, অনেক বাড়তি ও এলোমেলো কথা ঠোঁটে খেলা করে। তখন ওদের সন্দেহ আরও বেড়ে যায়। এ এক ভয়ংকর রোগ—রোগী ও রোগীর আশেপাশের সবাই এ রোগের যন্ত্রণাভোগ করে! ওরা হয়তো ভাবে, বেঁধে-রাখাই নিয়ম অথবা এভাবেই মানুষ ভালো থাকে। এবং বেঁধে রাখার জন্য যেখানে-যেখানে কলকাঠি নাড়া দরকার, যে-সকল কৌশল খাটাতে হয়, টার্গেটকে যতটা মানসিক নির্যাতন করতে হয়, এবং আরও যা-যা করতে হয়, তার সব কিছুই ওরা করে থাকে। এর জন্য যতটা নিচে নামতে হয়, ততটা বা তার চেয়ে বেশি নামতেও ওরা তৈরি থাকে। প্রয়োজনে অন্যদের ব্যাপারে বানিয়ে-বানিয়ে মিথ্যে বলতে ও তা ছড়াতে ওদের বিবেকে একটুও বাধে না। কিছু মানুষ সন্দেহ করে বাঁচে, আর কিছু মানুষকে সন্দেহ সহ্য করে বাঁচতে হয়। দুই ধরনের মানুষই সত্যি খুব দুঃখী। প্রায় সময়ই ওদের মরে যেতে ইচ্ছে করে, কিন্তু কিছু পিছুটানের কারণে ওরা মরতেও পারে না!

এই তিনটি অভ্যাসই যখন মাত্রার বাইরে চলে যায়, তখন আর একে স্বাভাবিক বলা চলে না। তখন এটি হয়ে যায় ফোবিয়া অথবা রোগ। যে-কোনও মাত্রাতিরিক্ত জিনিসই ফোবিয়া। যখন কোনও কিছু ফোবিয়ার পর্যায়ে চলে যায়, তখন এর নিরাময় হওয়া দরকার। সে-জন্য তাদের চিকিৎসকের পরামর্শ (কাউন্সেলিং) প্রয়োজন। আমি যতটা বুঝতে পারি, একজন সুস্থ আর একজন অসুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ কখনও একসাথে মিলিয়ে চলতে পারে না। যদি চলতেই হয়, সেক্ষেত্রে অসুস্থ মানুষটির চিকিৎসা করা দরকার, নয়তো সুস্থ মানুষটির অসুস্থ হয়ে যেতে হবে। একজন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ চাইলেও পৃথিবীর সব অসুস্থ মস্তিষ্কের মানুষকে এড়িয়ে চলতে পারে না। সমাজের, অভ্যাসের, সংস্কারের, পরিবারের, সম্পর্কের চাপে আর দায়ে আটকা পড়ে, যত কষ্টই হোক, কোনওভাবেই কেবলই নিজের পছন্দে—আমি কার-কার সাথে চলব না—তা ঠিক করা যায় না। অগত্যা নিজের অস্তিত্বের প্রতি ক্ষোভ আর ধিক্কার জিইয়ে রেখে বাঁচতে হয়। এছাড়া আর উপায়ই-বা কী! দুজন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ অথবা দুজন অসুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ একসাথে থাকতে পারে, কিন্তু একজন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ আর একজন অসুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ কখনও একসাথে থাকতে পারে কি? এটা সম্ভব আদৌ? তবু অনেক জীবনই এমন অবস্থার মধ্যেও টিকে থাকে কোনওমতে। সমাজের সামনে চক্ষুলজ্জার কারণে হোক; পারিবারিক ঝামেলা এড়াতে হোক; কোনও একটা বন্ধন বা অভ্যাস ভেঙে ফেললে তখন কী হবে, এমন কোনও ভাবনা থেকে ‘অনিশ্চয়তা ঠেকাতে’ হোক; কিংবা চলছে, চলুক না, দেখাই যাক না…কী হয়, এমন কোনও আয়েশ বা আলসেমির ফলে হোক—অনেক সম্পর্কই এভাবে টিকে আছে। এক পক্ষ কষ্ট পেয়েই যাচ্ছে, আর এক পক্ষ কষ্ট দিয়েই যাচ্ছে। সবাই দেখছে, ওরা হাসছে, ওরা ভালো আছে। আসলে ওরা ভালো নেই। এটা ওরা কারও সাথে শেয়ার করতেও পারে না, ফলে কষ্ট আর চাপাকান্না আরও বাড়তে থাকে। ওদের মধ্যকার সম্পর্কটা সুস্থ নয়, ওটা টিকে আছে স্রেফ কিছু অভ্যাস, কিছু যাপন, কিছু ভয়ের কারণে। পাশাপাশি থেকে যে দূরত্বটা ওরা তৈরি করে রেখেছে, তা ওদের ভালো থাকতে দিচ্ছে না। এটা ক্যানসারের মতো, দিনের পর দিন বেড়েই চলে। এ ক্যানসারের কোনও কেমোথেরাপি হয় না, কেননা এর প্রতিকারের জন্য কেউ খুব একটা চেষ্টাই করে না। পাছে জানাজানি হয়, আরও কিছু ঝামেলা তৈরি হয়, নতুন জীবন না-জানি কেমন নয়—এরকম হাজারো সংশয় ও পিছুটানের কারণে দুজন মানুষ একটা অস্বস্তিকর সম্পর্ককে বয়ে নিয়ে মৃত্যুর দিকে পরস্পরের হাত ধরে হাঁটতে থাকে।