ভাবনাদেয়ালের পলেস্তারা (১ম অংশ)

ভাবনা: এক।

…………………………

মেনে নেয়াটা ভীষণ কষ্টের, যখন অপরাধীকে দেখতে হয়—অসীম ক্ষমায়। কিছু কিছু অপরাধীকে শাস্তি দেয়া যায় না—তার জীবনের সাথে জড়িয়ে থাকা কিছু নিরপরাধ মানুষের জন্য। কখনো কখনো, আমারই ভীষণ প্রিয় মানুষ সে অপরাধীরকে অন্ধের মতো করে ভালোবাসে, বিশ্বাস করে, ওর সাথেই জীবনটা কাটিয়ে দেয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকে। প্রিয় মানুষ অমন নির্বোধ হলে, নির্লিপ্ত, নিঃস্পৃহ হয়ে থাকা সহজ নয়। কিন্তু, কিছুই তো করতে পারি না। ওকে বোঝাতে গেলে বরং, নিজেকেই ওর কাছে অপরাধী হয়ে যেতে হয়। তবু, মন চুপ করে থাকতে দেয় না, ঝামেলাকে নিমন্ত্রণ করে আনতে চায়—ইসস্! বেয়াড়া মনটাকে ধরে এক মার লাগাতে পারতাম! প্রিয় মানুষটা আমাকে যতো দূরে সরায়, আমি ততো আরো কাছে সরে আসি। নিজের এমন নির্লজ্জতায় বিস্মিত হই, তবু মানুষটার উপর একটুও রাগ আসে না। ওর ধারণা, ও না বুঝেই সুখে আছে। ও, ওর মতো করে সুখে থাকলে আমার কী? আমি তো জানি, ওর এ সুখেথাকা কতটা ক্ষণস্থায়ী। এমন অবুঝকে, ভুলে যেতে পারলে, অপরিচিত বানিয়ে ফেলতে পারলে, বেঁচে যেতাম। সে তো আর হয় না। ভুলেযাওয়া ব্যাপারটা—কেবল তখনই ভাল লাগে, যখন নতুন বইগুলো পড়া শেষ হয়ে যায় আর পুরোনো কোনো পড়াবই হাতে নিলে, মনে পড়ে না বইয়ের গল্পটা! যে গল্প মনেই নেই, সে গল্প তো নতুনই। মনে নেই, তাই মনে নেয়ার জন্য, একটা বই তো পড়ে ফেলা যায়ই। জীবনের কিছু ঘটনা আর স্মৃতিকে ভুলেযাওয়া গল্পের মতো করে আবার গ্রহণ করতে পারলে ভাল হতো। কাউকে-কাউকে, দেখলে, আগের সবকিছু আর মনে না এলে, বড় ভাল হতো—নতুন বইয়ের মতো করে কাছে টেনে নিতে না পারি, অন্তত, নিজের কাছ থেকেই দূরে সরে যেতে হতো না ভয়ে, কিংবা ঘৃণায়। জীবন কান্নাময়—এর মধ্যে পুরোনো কান্নাগুলোকে ভুলে গিয়ে, নতুন কান্না, আর নতুন হয়ে ওঠা দুএকটা পুরোনো কান্না—এই দুই নিয়ে জীবনটা কেটে গেলে কেমন হতো? মেয়েদের কাছে অকেজো চুলের কাঁটাটা যেমনি রয়ে যায়, তেমনি একগুঁয়ে স্মৃতির স্তূপ জমে থাকে ব্রেইনের রহস্যময় খোপটাতে। কিছুই ভুলতে পারি না, সব মনে থেকে যায়। এই থেকে যাওয়া, বারবার চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠা, পুরনোকে আঁকড়ে ধরে রাখার কী এক অসীম তৃষ্ণা—বেঁচেথাকার নিপুণ অভিনয়ে জীবনকে টেনেহিঁচড়ে সামনের দিকে নিয়ে যায়। এমন জীবন সত্যিই কি সামনে এগোয়?

ভাবনা: দুই।

…………………………

কেউ-কেউ, তার সন্তানকে মেরে ফেলে। কেন? যাকে এতো কষ্ট করে পৃথিবীতে আনল, তাকেই মেরে ফেলল? এটা কীভাবে সম্ভব? এও হয়? হ্যাঁ, হয়—দুটো কারণে। এক। সে সন্তানটি যদি হয় সমাজের চোখে অবৈধ—হাসিমুখেই মারে, এমনকি ভ্রূণহত্যা করতেও অতোটা নিষ্ঠুর হতে হয় না, মাথায় বুদ্ধি থাকলেই চলে। দুই। যদি সে মানসিকভাবে সুস্থ না থাকে—ওরকমটা লোকে কেন করে, কী করে, এ সবই ব্যাখ্যাতীত। ধরুন, এক লেখক, সারাদিন অনেক যন্ত্রণা মেনে নিয়ে যা যা লিখলেন, রাতে, ঘুমাতে যাওয়ার আগে, তার সবকিছুই নষ্ট করে ফেললেন। এটা উনি কেন করলেন? লেখার সৃষ্টি তো সন্তান জন্ম দেয়ার মতোই একটা ব্যাপার। সন্তানের দাবিদার যেমনি একমাত্র পিতামাতা, তেমনি লেখার দাবিদার একমাত্র লেখক। একেবারে নিজের বলতে কিছু থাকলে দুটো জিনিসই আছে পৃথিবীতে—নিজের সন্তান আর নিজের সৃষ্টি। এর কোনোটিকেই হস্তান্তর বা হত্যা করা সম্ভব নয়। অনেক লেখকের কথাই আমরা জানি, যারা তাদের পাণ্ডুলিপি স্বেচ্ছায় ধ্বংস করে ফেলেছেন। ওদের মানসিক অবস্থা সেসময় পুরোপুরি সুস্থ ছিল বলে জানা যায় না। আচ্ছা, অবৈধ বলে নয়, মানসিক অস্থিতিশীলতার কারণেও নয়, স্রেফ মনের ভুলে যদি কেউ তার সন্তানকে বা সৃষ্টিকে ধ্বংস করে দেয়, তখন সেটা কীভাবে মেনে নেয়া সম্ভব? সুস্থ মাথায়, সম্পূর্ণই নিজের ইচ্ছেতেও ভুল হয়ে যায়। যে ভুলের দায় শুধুই নিজের, সে ভুলের আত্মগ্লানি আর অন্তর্দহন যে কত তীব্র হতে পারে, সেটা সে নিজে ছাড়া আর কেউই ভাবতেও পারবে না। অমন ভুলের মাশুল গুনতে মানুষ নিজেকে শেষ পর্যন্ত করে দিতে পারে। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত, যেকোনো ধরনের শাস্তি নিতে সে মানসিকভাবে পুরোপুরিই প্রস্তুত থাকে। নিজেকে স্বেচ্ছায় কষ্টে রাখার চাইতে বড় জেদ আর নেই। এই একটা জেদেই মানুষের দ্বিতীয় জন্ম হয়ে যায়। এ যেন কঠিন কঠোর ইবাদতে মানুষের নতুন রূপে শুদ্ধ হওয়া। গত ১০দিন ধরে যা যা লিখেছি, আজকে কেন জানি না, জাস্ট একটা ডিলিট বাটন চেপে হারিয়ে ফেলেছি। আর কিছু নয়, স্রেফ একটা ডিলিট বাটনে অসতর্ক চাপ—অসংখ্য অসাধারণ মুহূর্তকে পুরোপুরি অর্থহীন করে দিতে পারে। কেউ বুঝতে পারবে না, আমি কী অবস্থায় আছি। এটা সহ্য করাটা যে কতটা কঠিন, তা, সৃষ্টিতে নেই, শুধুই উপভোগে আছেন—এমন কারো, কষ্টকল্পনাতেও আসবে না। এক লেখা, একইভাবে, দুইবার লেখা সম্ভব নয়। সন্তানকে হত্যা করে ফেলার পর আর পুনর্জীবন দেয়া যায় না, কোনো সৃষ্টিকে নষ্ট করে ফেলার পর আর, হুবহু সেটাই ফিরিয়ে আনা যায় না। লেখাকে মেরে ফেলা, সন্তানকে মেরে ফেলা—অনেকটা একইরকমের কষ্ট দেয়। আমি আমার নিজের কাছে শপথ করেছি, সামনের ৫ দিন, প্রতিদিনই গড়ে ৩-৪ ঘণ্টা করে ঘুমিয়ে বাকি সময়টা লিখব। এটা আমার নিজেকে দেয়া শাস্তি। আমি এটা করবোই। স্রেফ মরে না গেলেই হলো। ক্ষমাপর্ব শুরু হবে শাস্তিপর্বের সমাপ্তিতে।

ভাবনা: তিন।

…………………………

ছেলেরা, অনেক মেয়েও—কেউ-কেউ একা, কেউ কেউ দুকা, কেউ কেউ অনেকা…….কেউ কেউ ‘অসংজ্ঞায়িত’। মেসেঞ্জারে, কেউ যখন বারবার বলে, সেলফি দাও সেলফি দাও, তখন আমি ভাবি, একজন মানুষের মন, আসলে, কাকে বারবার দেখতে চায়? এমন কাউকে, যার গুরুত্ব তার কাছে আছে, যে তার কাছে বিশেষ কেউ, যাকে তার দেখতে ভাল লাগে। এমনই তো হওয়ার কথা, না? তবে, চিনি না, জানি না, ওরকম কেউ যদি সেলফির জন্য জ্বালায়, এর অর্থ আমি কী বুঝে নেবো? প্রোফাইল ভর্তি ছবি থাকতেও, সেলফি সেলফি করে। অন্ধকারে, অনেক রোমান্টিক ঢঙে হেসে, সেলফি তুলে পাঠিয়ে দিই? যদি, ও শুধু আমাকেই দেখতে চায়, তবে, ওর মনের চোখ দিয়েই নাহয় দেখে নিক! মনের চোখ দিয়ে দেখতে পারলে কেউ কি সেলফির জন্য অমন মাথাখারাপ করতো? যে কখনোই মনের চোখে ভাসে না, তাকে বারবার ছবিতে দেখতে ইচ্ছে করে, এটাও বিশ্বাস করতে হবে? ও কি আমাকেই দেখতে চায়, নাকি, আমার বিশেষ কিছু দেখতে চায়, যা, সে এখন মুখে ফুটে চাইতে না পারলেও, একদিন ফস্ করে চেয়ে ফেলবে? এমন একদিন কোনো এক মুহূর্তে, যখন আমি আর ‘না’ বলতে পারবো না? পাক না পাক, ওদের এ সেলফি চাওয়াতেই আনন্দ! অবশ্য, কেউ-কেউ দিয়েও শান্তি পায়। ওদের কাছ থেকেই চাক্ না ওরা, আমি কেন!? যখন কেউ সেলফি চায়, চেয়েই যায়, কিন্তু পায় না, তখন সে, কেবলই, দেখতে ইচ্ছে করছে, অথচ পারছে না বলে জেদ করে, তা নয়, বরং ওর মধ্যে এক ধরনের ইগো কাজ করে, যে ইগোটা, ‘না’ শুনলেই দুম্ করে জেগে ওঠে। আর ইগো জাগলেই তো বুদ্ধি পালায়। কিন্তু, সত্যি বলতে কী, আমি মানুষটা কিছুতেই এমন নই, যার সাথে ইগোতে জিততেই হবে। আমার মতো এমন গাছের মতন মানুষের সাথেও ইগোর খেলায় যে নামে, সে বড় বোকা। কেউ-কেউ চাওয়ার সময় বলে বসে, তোমাকে ভাল লাগে, দেখতে ইচ্ছে করে, তাইতো, সেলফি দেখতে চাইছি। আমি বলি, খুবই ভাল কথা। দুএকটা কারণ জানতে পারি, পছন্দ করার? ওরা কী কী সব বলা শুরু করে। ভাবে, কথার প্যাঁচেই বুঝি জীবনটা প্যাঁচায়। ভাগ্যিস, আমি কম বুঝি! নাহলে, ওসব বোঝার চেষ্টা করতাম। আর, বুঝলেই, বিশ্বাস করে বসতাম! আমি আগে ভীষণ বোকা ছিলাম। বোকার অনেক ধরন আছে, একরকম বলছি…….আমি, নিজের মতো করে, মানুষের সাথে মিশে যেতাম। বুঝতাম না—ভালোবাসা দেয়া ও নেয়া, দুটোই অন্যায় ও যন্ত্রণার। ভালোবাসলে, আটকে যেতে হয়। আটকে থাকাটাই তো কষ্টের! হৃদয় ভালোবাসুক, স্পর্শ করুক সবকিছুই, স্পর্শ নিকও, শুধু, কোনোকিছুতেই আটকে না যাক—এ-ই তো আনন্দের! আটকে গেলে, অদৃশ্য সব দায়বদ্ধতার সৃষ্টি হয়, ভালোবাসার আনন্দ নষ্ট হয়ে যায়। তবে, নিজেকে আটকে যেতে না দেয়াটা অতো সহজ নয়। তাই, এখন শিখে গেছি—কীভাবে থাকলে মানুষ ভালোবাসবে না, অপছন্দ করবে—সেভাবেই থাকি। আমি এমনভাবে থাকি, নিজেকে প্রকাশ করি, যে, আমাকে দেখে মনে প্রেম আসার কোনোই কারণ নেই। আয়না দেখে-দেখে, ভারি যত্ন করে, নিজেকে, সবসময়ই, প্রেমে না পড়ার মতো করে রাখি। এরপরও যদি, কেউ বলে, আপনার প্রেমে পড়ে গেছি, আমি মনেমনে মিষ্টি হেসে বলি, ওটা তো প্রেম নয়, কাম—এ বড় সহজ হিসেব, তুমিও বোঝো, তবে বুঝতে চাইছ না। এমনভাবে বলি, যাতে ‘কাম’টা ঠোঁটের ভেতরেই আটকে থাকে। ছেলেরা, ‘কাম’ শব্দটা, স্রেফ শুনলে পর্যন্ত কামার্ত হয়ে যায়! যেসব ছেলেকে, অনেক মেয়েই ভালোবাসা দেয়, ওদেরকে ধরে ধরে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে, জনাব, মানুষের এতো ভালোবাসা সহ্য করেন কীভাবে? আপনার কষ্ট হয় না? ওই হৃদয়ে এতো জায়গা এলো কীভাবে? অমন বিশাল হৃদয় আপনাকে দিনদিন ক্ষুদ্র করে দিচ্ছে নাতো? হৃদয়ে জায়গা পাচ্ছে যে বেচারি, সে জেনেশুনেই জায়গা নিচ্ছে তো যে, সে ওই হৃদয়ে ওই মুহূর্তে একমাত্র নয়, অন্যতম মাত্র?

ভাবনা: চার।

…………………………

একদিন। খুব কাছের এক বন্ধু, অন্তত, আমি তা-ই ভাবতাম, ফোন করল। হঠাৎ! ও তো কখনোই ফোন দেয় না! কী কাজে, তবে?

ক্রিং ক্রিং ক্রিং…….

হ্যালো! কীরে, কেমন আছিস?

এইতো, আছি। তোর কী অবস্থা?

আছি ভালোই। তবে, মা একটু অসুস্থ, আজকে চেকআপ করাতে…….

(কথা শেষ করতে দিল না……..)

আচ্ছা, তোকে যেটা বলেছিলাম, সেটা কবে করবি?

কী বলেছিলি?

………………………………. (ও অবলীলায় মনে করিয়ে দিল।)

তুই কী, বলতো!? বিয়ের আগে নানান মেয়ের সাথে এতকিছু করেছিস। এখন ঘরে বউ আছে, মোরওভার, শি ইজ এক্সপেক্টিং! কোথায় তুই ওকে সময় দিবি, তা না…….বিবেকটা কি চিবিয়ে খেয়েছিস রে ভাই!? পাপ আর মৃত্যু বলে কি কিছু নেই ভাবিস? প্লিজ এগুলো করা ছেড়ে দে!

আরে ধুউউররর্ ফালতু!…….রাখি…….

(খট্)

সত্যি, এমনও হয়। সেক্স করতে রাজি না থাকলে, একটা কথাও বলা যায় না! আমার মা মরে গেল, কী বেঁচে রইলো, ওতে কারো কিছু এসে যায় না। এমনকি, সামান্য ভদ্রতাটুকু দেখিয়েও কিছু জিজ্ঞেস করার সময় নেই। আমি তো বেঁচে আছি, তার উপর, সেক্স করার সকল ক্ষমতা নিয়ে বেঁচে আছি। ওর বউ আছে, বউ অসুস্থ, ওদের সন্তান পৃথিবীর আলো দেখার অপেক্ষায়—বউয়ের সাথে সেক্স করা যাচ্ছে না, সেটা আর কতদিন চুপচাপ মেনে নিয়ে বাঁচবে ও? হায়, বউয়ের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম, শুধু নিজের বউতেই হয়ে যায় কজন পুরুষের? তবু, অনাগত সন্তানের কথাও কি মাথায় আনা যায় না? মন মানে, কাম তো মানে না—তবে, এর নামই কি পুরুষমানুষ? হায়! ভাবছি, জীবনে কখনও এমন দিন না এসে যায়, যখন নিঃশ্বাস নেয়ার আগে শুনতে হবে—সেক্স করবি কিনা বল, নয়তো নিঃশ্বাস নেয়া যাবে না। সেক্সের দামে নিঃশ্বাস কিনতে হওয়ার দিন এসে যাবে একদিন। দম আটকে মরে গেলেও কিচ্ছুটি এসে যায় না, লাশ হয়ে যাওয়ার আগে হলেও—সেক্স করতে হবে! আমার এক অতি সুন্দরী বান্ধবী, ওর একটা পা নেই, কিন্তু খুব কায়দা করে স্টিলের পা দিয়ে চলে, ভীষণ সুন্দর রুচির মানুষ সে, জীবনকে উপভোগ করে, ওর ভাবনাগুলোও চমৎকার, পরিপাটি হয়ে থাকে, অসাধারণ সব ছবি আপলোড দেয়—তার সাথে পরিচয়ের চারদিনের মাথায়, এক ছেলে ওকে বলে, ‘ভালোবাসি’, ষষ্ঠ দিনে বলে, ‘চলো শুই’, ও রাজি না হলে, সপ্তম দিনে—ওকে ব্লক করে দেয়, ওদের ‘ব্রেকাপ’ হয়ে যায়। প্রেম দূরে থাক, দেখা না হতেই বিচ্ছেদ! সেক্স করতে না দিলে, কত সহজেই ‘পুরুষের ভালোবাসা’ ফুরিয়ে যায়! যে মেয়ের পা নেই, তার সাথেও শোয়া যায়, কিন্তু তাকে ভালোবাসা যায় না। পৃথিবীর সবচাইতে সস্তা আর হাল্কা শব্দ—ব্রেকাপ। এক প্রেমের কথা জানি, প্রেম-ব্রেকাপ মিলিয়ে দুই বছর হতে চলল—পরিচয়ের বয়স একমাস, শারীরিক সম্পর্কের বয়স পাঁচমাস, আর বাকি সময়টা ব্রেকাপের। এমনকি, ব্রেকাপ হয়ে গেছে বহু আগেই, অথচ শরীরের দাবিটা এখনো মিটিয়ে চলেছে দুজনই, আড়ালে নিভৃতে, এমনও জানি। ওরকম কেন, জানতে চাইলে আমার বান্ধবীটি বলে, একটাসময় ভালোবাসতাম যে! যা করছি, ভালোবেসেই তো করছি, না? ভালোবাসাটাকে ছুতো বানানো যে কত সহজ! কপটতা সবসময়ই গ্রহণযোগ্য, জনপ্রিয়। ভাবি, বেচারি বারাঙ্গনা আমাদের চোখে অস্পৃশ্য অচ্ছুৎ ব্রাত্য হল, শুধু ‘ভালোবাসি’ বলল না বলে!

ভাবনা: পাঁচ।

…………………………

ঘুম ব্যাপারটাই এমন—এমন মানুষের মেসেজের টোনে ঘুমটা ভাঙে, যার মেসেজ আমি চাইই না—এমন মানুষের ফোনে ঘুমটা ভাঙে, যার নামটা মনে এলেও আমার গা জ্বলতে শুরু করে। যার মেসেজ চাই, যার ফোন চাই, সারাদিনই, মোবাইল-স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে চোখ ব্যথা করে ফেললেও, ওর কাছ থেকে ভুল করেও কিছুই আসে না। ওর কাছ থেকে, হঠাৎ একদিন, ফোন আসে—শুধু ওই মুহূর্তেই, আমি মোবাইলের কাছে থাকি না। পরে কলব্যাক করতে-করতে মরে গেলেও, ওকে আর পাই না। কিছু-কিছু মানুষ এতোটাই নির্লজ্জ, এভারেস্ট যারা জয় করে, ওদের প্রতি আমার প্রায়ই চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে ইচ্ছে করে, পারলে ওসব মানুষের নির্লজ্জতার পর্বতটা ডিঙিয়ে দেখান দেখি, আপনি কেমন বাহাদুর! কিছু লোকের, টানা বিরক্ত করে যাওয়ার প্রতিভা এমনই অসীম, মাঝে-মাঝে মনে হয়, মেসেঞ্জারে, গলাটিপে ধরার ফিচারটা চালু করার কথা সামনে থেকে ভাবতে বাধ্য হবে ফেসবুক টিম! স্মার্টফোনে, ওদেরকে গালাগালি করার নয়, হাইকমোডের ভেতরে ওদের মাথাটা চেপে ধরে ক্রমাগত ফ্লাশ করার ব্যবস্থা থাকত! জোর করে ভালোবাসা আদায় করতে চাওয়া মানুষগুলোর জন্য বড় মায়া হয়—ভালোবাসাকে, যাদু করে দুইপাঁচ টাকার নোটে রূপান্তরিত করে ফেলতে পারলে, ওদের কাউকেই আর খালিহাতে ফিরিয়ে দিতে হতো না। সবাই যে, ভিক্ষুককে, টাকা নেই বলে ভিক্ষা দিতে পারে না, তা কিন্তু নয়—অনেকেই, স্রেফ ভাংতি নেই বলেও ভিক্ষা দিতে পারে না। তেমনি, সবাই যে, হৃদয় নেই বলে ভালোবাসা দিতে পারে না, তা নয়—অনেকেই, সস্তা হৃদয় নেই বলেও ভালোবাসা দিতে পারে না। যার হৃদয় সস্তা, সে অন্য সবার হৃদয়কেও সস্তা মনে করে। বিরক্তিকর মানুষ আর রাস্তার ভিক্ষুকের মধ্যে একটাই পার্থক্য—কিছু-কিছু ভিক্ষুকের আত্মসম্মানবোধ থাকে, ‘মাফ করেন’ বলার পরও নির্লজ্জের মতো সামনে দাঁড়িয়ে থাকে না।

ভাবনা: ছয়।

…………………………

জনসমুদ্রে, অসংখ্য মানুষের ভিড়ে—হয়তো, কখনো-কখনো নিঃশ্বাস নেয়াটাও কষ্টকর। কিন্তু তবুও, প্রতিটা মানুষ কী ভীষন একা! কেউ জেনে একা, কেউ বা না জেনে একা। এমন অনেক মানুষ আছে, যার খোঁজ নেয়ার কেউ একজন আছে, সেই কেউ একজনের একটা ফোনের প্রতীক্ষায় তার প্রতিটি মুহূর্ত কাটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফোনের স্ক্রিনের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে, অথচ ভুল করেও সেই কেউ একজন কখনো মানুষটার কোনো খোঁজ নেয় না। সেও একা, বড়ো বেশিই একা! আবার, কেউ-কেউ শখ করেও একা থেকে দেখে, কেমন লাগে। বাড়িওয়ালা আংকেল প্রায় পাঁচ মাস পর দেশের বাইরে থেকে এলেন। আচ্ছা, এতদিন, দুজন দুজনকে ছাড়া থাকা যায়!? বুঝলাম, ছেলেমেয়ে অনেক বড় হয়ে গেছে, আগের মতো ফিলিংস্ই হয়তো নেই, তবু…….তাই বলে, পাঁচ মাস! এমনও নয় যে, টাকার অভাবে দেশে আসতে পারেননি। দূরে থাকলে, ভালোবাসা কতটা ভাল থাকে? যাকে ভালোবাসি, তাকে দেখতে ইচ্ছে করে না? আমার তো মনে হয়, প্রিয় মানুষের সাথে সিসি ক্যামেরা জুড়ে দিতে পারলে, কী যে ভাল হতো! এবং, এটাই উচিৎ! সব মানুষেরই, প্রিয় মানুষকে সবসময় দেখতে নিশ্চয়ই ভীষণ ইচ্ছে করে। আমি নাকি অনুভূতি-টনুভূতিশূন্য। আর এই আমারই মাঝে-মাঝে মাথায় আসে, ওর চুলের সাথে স্কচটেপ দিয়ে একটা সিসি ক্যামেরা আটকে দিই। তবে, বাথরুমে যাওয়ার সময়, ক্যামেরা অফ্ রাখলেও চলবে! হাহ্ হাহ্ হাহ্! তবু মানুষ, কাছে থাকার সুযোগ থাকলেও দূরে থাকে, স্রেফ তার-যোগাযোগ বজায় রেখেই ধরে নেয়, অনেক ভালোবাসা দেখানো হচ্ছে নিয়মিত। শুধুই তারে-তারে যে ভালোবাসার পরিচর্যা চলতে থাকে, তা কতদিন পর্যন্ত বিশ্বস্তভাবে হৃদয়কে ছুঁয়ে থাকে? মন যেমনই থাকুক, তবু, ফোনে কেউ ‘কেমন আছ’ জিজ্ঞেস করলে, ‘ভাল আছি’-ই তো বলতে হয়। ‘ভাল আছি’র চাইতে বড়ো মিথ্যে আর হয় না। লোকে এই মিথ্যেটাই শুনতে চায়। এই যে একটুও না ভেবেই দুমদাম বলে দিই, ‘ভাল আছি’, যেন জানতামই আমাকে অমন প্রশ্ন করা হবে, তাই আগে থেকেই উত্তরটা রেডি, নিজের ভালোথাকার খবর নয় ওটা, যে জিজ্ঞেস করছে, সে যেন ওটা শুনে ভাল থাকে। এই ব্যাপারটা এমনকিছু, যা সবাইই বোঝে, অথচ না বোঝার অভিনয়েই নিজে দিব্যি ভাল থাকতে চায়। মানুষ যে অন্যকারো জন্যও আজীবন ভাল থাকে, সেটা মানতে পারি না। সত্যিকারের ভালোবাসা নিঃস্বার্থ—কিন্তু কতদিন পর্যন্ত? কতটুকু পর্যন্ত? ভালোবাসা—একেবারে কিছুই কি চায় না সে? আমি এসব ভাবি, আর মাথা হ্যাং হয়ে বসে থাকে। মনের ভেতরে একটা রিস্টার্ট বাটন বানিয়ে নিয়েছি। ওটা দুম্ করে চেপে দিই আর নিজেকে বোঝাই, দিনের শেষে, সবাইই নিজের জন্যই বাঁচে। এটাই অন্যের জন্য ভালোবাসা জিইয়ে রাখার একমাত্র বুদ্ধি। ভালোথাকা, ভালোরাখা, ভালোবাসা—নিজে বাঁচলেই তো ওসব, তাই না?

ভাবনা: সাত।

…………………………

আচ্ছা, আপনার যে চেকআপ করানোর কথা ছিল—করিয়েছেন? না করে থাকলে, দ্রুত করে ফেলুন। পরে দেখা যাবে, এতই দেরি হয়ে গেছে যে, আপনার নিজেরটা আর নিজে করতে পারছেন না, আপনার ভাই, বন্ধু বা অন্যকাউকে, আপনাকে নিয়ে দৌড়াতে হচ্ছে। ভীষণ রকমের অসুস্থ হয়ে পড়লে, এতোটাই যে, আরেকজনের ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর নির্ভর করে চলতে হচ্ছে—সেই আরেকজন, যতই কাছের মানুষ হোক না কেন, আস্তে আস্তে, অসুস্থ মানুষটার প্রতি বাৎসল্য কমিয়ে ফেলে। এ এক নিষ্ঠুর সত্য। আপনি নিশ্চয়ই চান না, সেটা আপনার জীবনে ঘটুক। আমিও ভেবেছিলাম, আজ ডাক্তার দেখাব। মারাত্মক সব রোগের লক্ষণ নিয়ে কী সুখেই না ঘুরে বেড়াচ্ছি! কখনো, বাসায় মরে পড়ে থাকলেও কেউ কিছুই বুঝবে না। মা কিছুক্ষণ ডাকাডাকি করে ভাববে, ঘুমিয়ে পড়েছি! জানেন, নিজের সব নিজেকেই করতে হয়! কেউ করে দেবে না। মাস্টারডেট করতে করতে এমন অবস্থা হয়েছে যে, কিছুদিন আগে, হাতের একটা সার্জারিও করিয়েছি একা! গিয়ে, যা হল, সে কাহিনী আরেকদিন। ডাক্তারের কাছে যেতেও ইচ্ছে করে না কিছু কারণে…….৫০% হল ভয়ে—টেস্টে, কী না কী ধরা পড়ে! শরীরে যা-ই আছে, থাক না! ওরা তো আর এখুনিই মেরে ফেলছে না আমাকে। ওদের সম্পর্কে আমি না জানি, ওতেই আমার শান্তি।…….২০% হল টাকার মায়ায়—সত্যি বলছি, ডাক্তারের কাছে অনেক টাকা নিয়ে গেলেও, একেবারে ফকির করে ছেড়ে দেয়, এমনকি সামান্য জ্বর হলেও! দেখা যায়, এই একটু ভাইরাস-জ্বর হল, আর ডাক্তার সাহেব কী এক অসীম দরদ আর দায়িত্বে ক্যান্সারের টেস্ট ধরিয়ে দিলেন! লাগে টাকা দেবে রোগীসেন, উনার কীসের টেনশন?…….১০% হল—অলসতার কারণে। ডাক্তারের চেম্বারে? ও আচ্ছা, হ্যাঁ হ্যাঁ! কালকে যাবো, আজকে বরং একটু ঘুমাই।…….১০% হল—অসুস্থতার অজুহাতে। ডাক্তারের কাছে যাবার সময় হলেই, কেমন জানি শরীরটা এত খারাপ লাগতে থাকে যে, মনে হয়, যেতেই পারব না।……৫%— ডাক্তার পছন্দ না হওয়া। সত্যি বলছি! ডাক্তারকে মানুষ হিসেবে মন থেকে ভাল না লাগলে, সবকিছুই ওলটপালট বলে ফেলি চেম্বারে গিয়ে। বাকিটা—অস্বস্তিতে। সবসময়ই আমি একা-একা ডাক্তার দেখাই, কারোর সামনে আমি আমার রোগের কথা বলতে পারি না, কেমন একটা অস্বস্তিতে থাকি। অবশ্য, ডাক্তার নিজেও একজন ‘কেউ’—তবে, সেটা মাথায় আসে না। ডাক্তারের কাছে গিয়ে, কখনো-কখনো, এমনসব কথাও বলে দিতে হয়, সেটা পরে মনে পড়লেও, লজ্জায় চোখ ঢেকে ফেলি! রাস্তাঘাটে চলার সময়, কোনো পুরুষ ডাক্তারকে দেখলে, উনাকে দেখতে, সেই ডাক্তারটার মতো লাগে, যাকে নিঃসংকোচে বলে দিয়েছি আমার সব গোপন কথা। কী লজ্জা কী লজ্জা!