ভাববার সময়, ভাবানোর সময়

 
আমি শায়লা। চট্টগ্রামের পটিয়ায় আমার গ্রামের বাড়ি। আমরা তিন বোন, এক ভাই। আমি সবার বড়। আমাদের গ্রামের বাড়িটা টিনের চালের ঘর। সামনে ছোট উঠোন, বাড়ির পেছনে নারকেলগাছ আর কলাগাছসহ নানান গাছের সারি।


আমাদের পাশাপাশি দুটো পাড়া। একটার নাম পশ্চিমপাড়া, আরেকটা পূর্বপাড়া। আমরা পশ্চিমপাড়ায় থাকি। আমাদের পাশাপাশি দুটো গ্রাম। পাশের গ্রামের নাম গোলাইগ্রাম।


অনেকদিন আগের কথা। বাবা তখন তাগড়া জোয়ান। উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া দারিদ্র্যের ভাগস্বরূপ বাবাও হয়েছেন খানদানি গরীব। বাবা রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। গোলাইগ্রামের এক বাড়ির রাজমিস্ত্রির সব কাজ বাবাই করতেন। যে বাড়িতে তিনি কাজ করতেন, তার ঠিক পাশে আর এক বাড়িতে থাকত রুমানা নামের এক মেয়ে।


বাবা কাজের সূত্রে নিয়মিত গোলাইগ্রামে যেতেন। বাবার পয়সা বেশি ছিল না, মানুষটা গরীব ছিলেন, কিন্তু ছিলেন ভীষণ রকমের হাসিখুশি, প্রাণচঞ্চল এবং দিলখোলা। আর ছিলেন অনেক নরম মনের। নিজের হাতে কখনও একটা তেলাপোকা স্বেচ্ছায় মেরেছেন, এমন রেকর্ড বাবার নেই। অপ্রয়োজনে একটা ইঁদুরও কখনও মেরে ফেলতেন না। পায়ের তলায় ভুলেও যদি পিঁপড়া পিষে মরে, এ ভয়ে বাবা খুব সতর্ক হয়ে পা ফেলতেন। এতটাই দয়ার শরীর ছিল তাঁর।


দারিদ্র্য বাবাকে যতই ছিন্নবিচ্ছিন্ন করুক না কেন, বাবার মুখের হাসি কখনও ফুরোত না। সদা হাস্যোজ্জ্বল দিলখোলা দয়ালু বাবাকে দেখে প্রেমে পড়ে যায় রুমানা নামের মেয়েটি। সেই মেয়েটি ছিল মোটামুটি বিত্তবান পরিবারের মেয়ে। শুরু হয় দুজনের প্রেমকাহিনি। কোনও একভাবে রুমানার পরিবার ব্যাপারটা জেনে যায়। এক হতদরিদ্র রাজমিস্ত্রি ছেলেটির হাতে রুমানাকে তুলে দেয়া হবে না কিছুতেই। কিন্তু প্রেম তো এত কিছু মানে না, এত কিছুর ধার ধারে না।


একদিন কোনও এক সন্ধ্যায় রুমানাকে নিয়ে সোজা কাজিঅফিসে গিয়ে বিয়ে করে ফেললেন বাবা। শত ঝড়ঝাপটা পেরিয়ে দালানঘর ছুড়ে ফেলে রুমানা চলে আসে টিনের চালার কোনও এক অভাবী ঘরে, এক দিনমজুরের বউ হয়ে। সেই ধনীর দুলালি রুমানাই আমার মা। ভালোবেসে বিয়ে করেছেন দিনমজুর, দরিদ্র, খেটেখাওয়া, সাদামনের একজন মানুষ আমার বাবাকে। ঘরে অভাব থাকলেও ভালোবাসার তেমন ঘাটতি ছিল না। এ যেন সত্যজিৎ রায়ের অপুর সংসার-এর এক গ্রাম্যমঞ্চায়ন।


পরের বছর দুজনের ঘর আলো করে আমি এলাম। এভাবেই ধীরে ধীরে আমার আরও দুই বোন, এক ভাই জন্ম নিল। সংসার বড় হওয়ার সাথে সাথে আমাদের অভাবের পাল্লাটাও ভারী হতে থাকল। বাবা ভালো মানুষ, তবে দরিদ্র না হওয়ার জন্য এইটুকু অজুহাত যথেষ্ট নয়। বাবা আর পেরে উঠছেন না, খরচ কুলাতে হিমশিম খাচ্ছেন। সংসারে খরচ ক্রমেই বাড়ছে। ক্ষুধার্ত মুখগুলোর খিদেও বেড়ে চলছে।


দরিদ্রঘরের মেয়েরা ধনী স্বামীর ঘরে এলে কেমন জানি বাস্তবজ্ঞানবর্জিত, অহংকারী ও বেয়াদব প্রকৃতির হয়ে ওঠে। অন্যদিকে, ধনীঘরের মেয়েরা দরিদ্র স্বামীর ঘরে এলে অনেক বাস্তবজ্ঞানসম্পন্ন, বিনয়ী ও অমায়িক হয়ে ওঠে। এটা আমি প্রায়ই হতে দেখেছি।


যা-ই হোক, আমার মা সেলাইয়ের কাজ শুরু করলেন। তিনি চাইছেন, আমরা সবাই যেন পড়াশোনা করি। সেই সুবাদে আমার এক কাজিনের বাসায় থেকে পড়াশোনা করতে আমাকে পাঠানো হলো শহরে। কাজিনের বাসায় আসার পর থেকে আমি অনেকটা বন্দিমানুষের মতো হয়ে গেলাম। অনেকটা খাঁচায়-বাঁধা টিয়াপাখির মতন। পাখা আছে, কিন্তু ঠিক ওড়া যাবে না।


ছাত্রী হিসেবে আমি মাঝামাঝি ধরনের। কখনও কোনও সাবজেক্টে এপ্লাস পেয়েছি, এরকম একটাও রেকর্ড আমার পুরো শিক্ষাজীবনে নেই। তাতে আমার তেমন কোনও আক্ষেপ নেই, স্রেফ পাস করতে পারলেই আমি অনেক অনেক খুশি! আমি ভালো রেজাল্টকরার মানুষ ছিলাম না, আমি ছিলাম কেবলই পাসকরার মানুষ।


কোনওমতে ইন্টার পাস করে চট্টগ্রাম কলেজে অনার্সে ভর্তি হলাম। পড়াশুনা করি সেই কাজিনেরই বাসায় থেকে। আমার কাজিন বিবাহিত। তার দুইটা সন্তান আছে। স্বামী দেশের বাইরে থাকেন।


এভাবেই চলছিল আমার বন্দিজীবন। ঘর থেকে বের হই, কলেজে যাই, ঘরে ফিরে আসি। শপিংয়ে-যাওয়া বা আড্ডা-ঘোরাঘুরি এসব আমার কখনও করা হয়নি। আমার ফ্রেন্ডসার্কেলটাও খুব ছোট। আমার কেন জানি কখনওই আহামরি কোনও বন্ধুবান্ধব ছিল না। হয়তো আমি তেমন বন্ধুবৎসলও না।


বাবা-মা’র সাথে কথাবলার জন্য আমার একটা নোকিয়া এগারোশো মডেলের মোবাইল সেট ছিল। এখনকার ছেলেমেয়েদের মতো অত দামি মোবাইলফোন আমার ছিল না। এভাবেই আমার দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল।


২০১০। একদিন সন্ধে। ভরা পূর্ণিমারাত। চাঁদের আলো যেন পৃথিবী ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমি সে জ্যোৎস্নায় ডুবে ডুবে যাচ্ছি। বাসার ছাদে বসে জ্যোৎস্নাবিলাস করছি। হঠাৎ আমার ফোনে একটা জিপি-নাম্বার থেকে কল এল। রিসিভ করতেই ওপার থেকে একটা ছেলে মৃদুকণ্ঠে বলে উঠল, ‘এটা কি প্রীতির নাম্বার?’ আমি ‘না’ বলে ‘রংনাম্বার’---এই উত্তরটা দিয়ে লাইনটা কেটে দিলাম।


পরক্ষণেই আবার ওই নাম্বার থেকে কল এল। এবার আমি রেগে যেতেই ছেলেটা কেমন নরম কণ্ঠে কথা বলে উঠল। ‘ম্যাম, আমি প্রীতিকে চাইছি না, আমি আপনাকেই খুঁজছিলাম। আপনি ঠিক এই মুহূর্তে জ্যোৎস্নাবিলাস করছেন, আর উদাস হয়ে মনে মনে অনেক কিছুই ভাবছেন। হয়তো কাউকে খুঁজছেন খুব গোপনে। কী? অবাক হয়েছেন খুব?’ শুনে আসলেই কিছুটা অবাক হলাম।


আমি হতভম্ব হয়ে ছেলেটাকে বকে যাচ্ছি। বারবারই বলছি, ‘আপনি লাইন কেটে দিন। আপনি যাকে ফোন করেছেন, সে আমি না।’ আমার কথা শুনে সে মৃদু হাসল। ওই হাসিতে একধরনের রহস্য ছিল। কেমন জানি আদুরে আদুরে ছেলেটার কথাবার্তাগুলো। অবাক হয়ে খেয়াল করলাম, ছেলেটার কথাগুলো শুনতে আমার বেশ ভালোই লাগছে। আমি বিরক্তির স্বরে বকে গেলেও লাইনটা কিন্তু কাটছি না। ছেলেটার এমন কাব্য কাব্য কথাগুলো শুনতে আমার বেশ লাগছে। এই প্রথম আমি কোনও পুরুষের সাথে এতটা সময় ধরে কথা বলছি ফোনে। এটা আমার জীবনের প্রথম-অভিজ্ঞতা।


ওদিকে ছেলেটাও আমার বকাগুলোকে কেমন জানি কানে নিচ্ছে না। আমি যা-ই বলি না কেন, সে অনেক ধৈর্য নিয়ে কিছুই গায়ে না মেখে আমার সাথে খুবই ভদ্র ও মিষ্টিস্বরে কথা চালিয়ে যাচ্ছে। সেবার প্রায় আধাঘণ্টা কথা হয়েছে দুজনের। নানান কথার ভিড়ে পরিচয়পর্বটি শেষ হলো। তার নাম রাফি। চট্টগ্রামেই থাকে। সরকারি কমার্স কলেজে অনার্স ফাইনালইয়ারে পড়ে। আমি খুবই সরল ধরনের মেয়ে ছিলাম। ওর ব্যবহারে, কথাবার্তায় ওকে অনেক ভালো লেগে গেল।


পরের দিন সন্ধেবেলা। মন কেমন জানি করছে। আমি আবারও ছাদে গেলাম। জ্যোৎস্নায় ভরে গেছে ছাদের একচিলতে উঠোন। আমি চাঁদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে যেন জ্যোৎস্না গিলছি আর সেই ছেলেটির কথাই ভাবছি মনে মনে। ভাবছি, আহা, সে যদি ফোন করত! অপেক্ষা করছিলাম আর মৃদু মৃদু হাসছিলাম।


খানিক বাদে সত্যি সত্যি তার ফোন এল। আমি তো অবাক! ফোন রিসিভ করতেই ছেলেটা ওপার থেকে বলে উঠল, ‘কী ম্যাম! জ্যোৎস্নাবিলাস চলছে নিশ্চয়ই?’ বলেই কেমন মায়াভরা কণ্ঠে হেসে উঠল। আমি একটুও রাগ দেখালাম না, যেন ওর প্রেমেই পড়ে গেলাম। তার সাথে কথা বলতে খুব ভালো লাগছিল।


এভাবে আমাদের কথা চলতে লাগল। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত আমাদের কথোপকথন চলছিল। আমি নিয়মিত তার খোঁজ নিই, সেও নিয়ম করে আমার খোঁজ নেয়। এভাবে দুজনের মধ্যে এক ধরনের নির্ভরতার সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেল। সকালে থেকে আমি কী কী করছি, সে কী কী করছে, সারাটা দিন কীভাবে গেল, সারাদিন কে কী করলাম, কী করলাম না, কী দেখলাম, কী দেখলাম না। সবই গল্প হতো। সকাল থেকে শুরু করে রাত অবধি আমাদের দুজনের প্রেমালাপ - আড্ডা - খুনসুটি চলত।


কোনও একটা সময় জানতে পারলাম, রাফি আসলে আমাকে আগে থেকেই চিনত এবং আমার কাজিনের পূর্বপরিচিত। এভাবেই কথা চলতে চলতে একটা পর্যায়ে আমরা দুজনেই দুজনের প্রেমে পড়ে গেলাম। দুজন দুজনের জন্য অনেকটা পাগল হয়ে গেলাম। আমার দিনগুলো বেশ ভালোই কাটছিল। পৃথিবীটাকে আমার কাছে একটুকরো চাঁদের মতন মনে হচ্ছিল। আমি প্রেমে পড়েছি, এই অনুভূতিটা পৃথিবীর সবচেয়ে আনন্দের অনুভূতি। প্রেমে পড়তে পারাটা একটা বিশাল সৌভাগ্য। এই সৌভাগ্যটা আমি অর্জন করতে পেরেছি। এটাই পরমআনন্দ।


রাফি আমার চেয়ে আড়াই বছরের সিনিয়র ছিল। দিন মাস বছর পেরিয়ে আমাদের এই প্রেম, আমাদের এই ভালোবাসা, আমাদের এই সম্পর্ক চলতে চলতে দুই বছরের গোড়ায় চলে গেল। আশ্চর্যের ব্যাপার, এই দুই বছরে আমাদের প্রতিদিন টেক্সটিং আর ফোনে গল্প ছাড়া কখনও সামনাসামনি দেখা হয়নি। আমি মোবাইলেই ওই প্রান্তের কণ্ঠটির ভালোবাসায় পড়ে গেছি। আমার কাছে ও দেখতে কেমন, সেটা কখনও তেমন একটা গুরুত্বপূর্ণ কিছু হয়ে দাঁড়ায়নি।


একসময় আমার কাজিন রাফি সম্পর্কে জেনে যায়। তখন কোনও একটা অজ্ঞাত কারণে আমার কাজিন আমাকে রাফির সাথে কথা বলতে নিষেধ করে। সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দিতে বলে। দুই বছরের অভ্যস্ততা থেকে বেরিয়ে যাওয়া অতটা সহজ ব্যাপার নয়। দুই দুইটা বছর! এই দুই বছরে ওই কণ্ঠের সাথে একসাথে কেটেছে অনেক অনেক ঘণ্টা, ‌মিনিট, সেকেন্ড। চাইলেও এত সহজে ভোলা যায় না।


আমার কাজিন অনেকটা জোর করেই রাফির সাথে আমার সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। আমার বাবা-মা’কে ফোন করে আমার সম্পর্কে অনেক কথা বলে। এর পর আমার হাত থেকে মোবাইলফোন নিয়ে ফেলে। যোগাযোগটা যেহেতু ছিল ফোনকেন্দ্রিক, অতএব শুরু হলো বিচ্ছেদপর্ব।


যোগাযোগ বন্ধ করলেও আমি রাফিকে ভুলে যেতে পারিনি। রাফিও আমাকে ভুলে যায়নি। সে নিয়মিত আমার খোঁজখবর নিতে থাকে, যদিও আমি তার কোনও খোঁজ নেওয়ার উপায় পাইনি, সে সুযোগটা আমার হয়নি।


এভাবে বিচ্ছিন্নতায় প্রায় ৬ মাস কেটে গেল। তাকে ছাড়া সময়গুলো ভীষণ রুক্ষ, বিষণ্ণ, নীরস।


তখন আমার এক বান্ধবীর মাধ্যমে আমি ফেসবুক খুলি। ফেসবুক কীভাবে চালাতে হয়, সে আমাকে শিখিয়ে দেয়। রাফির ফেসবুক ছিল, সেটা আমি আগে থেকেই জানতাম। রাফির পুরো নাম বিভিন্নভাবে লিখে সার্চ করে আমি তাকে খুঁজতে থাকি। অনেক রাফিই আসে, কিন্তু ঠিক চিনে উঠতে পারছিলাম না, আমি যে তাকে কখনও দেখিইনি।


এভাবে কেটে গেছে অনেক দিন। আমি তাকে খুঁজে চলেছি হন্যে হয়ে। একদিন আমার ফেসবুকের ইনবক্সে একটা মেসেজ আসে। ওপেন করেই দেখি, রাফি আহমেদ নামের একজন একটা ‘হ্যালো’ পাঠিয়েছে। ওই আইডির সাথে চ্যাটিং করে বুঝলাম, সে-ই আমার রাফি! আমি তো খুশিতে আত্মহারা! দীর্ঘদিনের বিচ্ছেদের পর রাফির সাথে আমার আবার যোগাযোগ হয়। রাফির সেট হারিয়ে গিয়েছিল, সে তার নতুন নাম্বারটি আমাকে দিল। আমিও আমারটা দিলাম। আগের মতো আমরা আবার কথোপকথন শুরু করি। সে অনেক অনেক কথা! দীর্ঘবিচ্ছেদের পর আমরা এবার দুজন সামনাসামনি দেখা করার সিদ্ধান্ত নিলাম। তার অনুরোধেই আমার কলেজে তার সাথে দেখা হওয়ার সিদ্ধান্ত হলো। কলেজের গেটের সামনে সে নীলরঙের শার্ট পরে দাঁড়াবে।


আমি ভীষণ উদগ্রীব হয়ে আছি। দুই বছর যে মানুষটির সাথে তাকে না দেখেই আমি প্রেম করেছি, দুই দুইটা বছর যে মানুষকে আমি কোনও প্রকার অবয়ব ছাড়াই ভালোবেসে গেছি, তার সাথে আমার দেখা হবে। প্রথমপ্রেমের প্রথমদেখা। সে এক স্বর্গীয় অনুভূতি! অকারণ অস্থিরতা, অদ্ভুত লজ্জা, কেমন একটা জানি ভয় ভয়।


সেদিনের সকালটা হলো। আমি ওর পছন্দের নীলজামা পরেছি। ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপস্টিক দিয়েছি। একপাশে করে চুলে বেণি করেছি। ছোট্ট করে একটা টিপ বসিয়েছি কপালের ঠিক মাঝ বরাবর। কালোটিপ রাফির খুব প্রিয়। আজ আমাদের দেখা হবে। কলেজে গেলাম। ক্লাস থেকে বের হয়ে গেটে এসে দাঁড়িয়েছি। এদিক ওদিক উৎসুক দৃষ্টিতে তাকাচ্ছি। হঠাৎ খেয়াল করলাম, কলেজের সামনে বড় জারুলগাছটার নিচে সে দাঁড়িয়ে। পরনে নীলশার্ট, কালোজিনসের প্যান্ট। চুলগুলো বাতাসে উড়ছে।


কাঁপা কাঁপা পা ফেলে ধীরে ধীরে আমি তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেছে। কাঁপছিলাম অনবরত। মাথা নিচু করে আছি। তার চোখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না লজ্জায়, দ্বিধায়। কুণ্ঠাভেঙে মাথা উঁচু করে আড়চোখে একটু করে তাকালাম তার দিকে।


সে দেখতে খানিকটা খাটো। মাঝারি গড়নের ছিমছাম শরীর। চোখে হালকা পাওয়ারের চশমা। মেঘবর্ণ গায়ের রং। দেখতে একেবারেই সাদামাটা ধরনের, কিন্তু আমার কাছে মনে হচ্ছে, সে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মানুষ। দেখতে অতটা আহামরি না হলেও দুই বছরের বেশি সময়ের তীব্র ভালোবাসার কাছে তার খর্বকায় শারীরিক গঠনটা নগণ্য হয়ে রইল।


এভাবে কিছু সময় কাটল। হঠাৎ সে মাথা উঠিয়ে আমার দিকে কেমন আদরের চোখে তাকিয়ে মৃদু একটা হাসি দিল। তখন মনে হচ্ছিল যেন আমরা যুগ যুগ ধরে চিনি দুজন দুজনকে। অনেক অনেক কাল আগে থেকেই আমাদের এই পরিচয়। আমরা অনেকদিনের পরিচিত।


অবশ্য আমি তাকে আজকে প্রথম দেখলেও সে আমাকে অনেক আগেই দেখেছে। আমাকে তার আগে থেকেই ভালো লাগত।


সেদিনের পর থেকে আমাদের প্রেম যেন আবার শুরু। আমার কাছ থেকে সে দেড় বছর সময় চাইল। এই দেড় বছরে সে নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে আমাকে বিয়ে করবে। এর পর থেকে নিয়মিতই আমরা দেখা করতাম। আমাদের দূরত্বটা ফেসবুক অনেক কমিয়ে দিল। একসাথে ঘুরতে যেতাম, ফুচকা খেতাম এবং বৃষ্টিতে ভিজতাম। কখনও কখনও ফুচকার দোকানের সামনে বসে ফুচকার প্লেট একহাতে রেখে আর একহাতে আমার হাত ধরে আমার চোখের দিকে সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকিয়ে থাকত। ওই চাহনিতে ভরাপ্রেম ছিল, অদ্ভুত একধরনের শক্তি ছিল।


দেখা হওয়ার পর আমাদের সম্পর্কটা আরও শক্ত হয়ে গেল। আমি পড়াশোনায় মন দিলাম। সেও তখন বিভিন্ন জায়গায় অ্যাপ্লাই করতে লাগল। আমরা ঠিক করলাম, আমাদের দুজনের যেকোনও একজনের একটা চাকরি হয়ে গেলেই হয়। তখন আমরা দুজন মিলে একটা ঘর বেঁধে ফেলব। হোক সেটা টিনের চালের, খড়ের কিংবা কোনও চিলেকোঠায় নাহয় দুজন মিলে থেকে যাব। দুজন একসাথে থাকার স্বপ্নদেখা শুরু হলো। আমার সারাদিনই তাকে ভাবতে ভাবতেই কেটে যেত। আহা, কত চড়াই-উতরাই, বাধাবিপত্তি পেরিয়ে আমরা দুজন এক হলাম! সকালটা শুরু হতো তাকে দিয়ে, বিকেলটা গড়াত তাকে নিয়ে, সন্ধে ঘনিয়ে রাত নামত তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে দেখতেই। তাকে ঘিরে সংসারের স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম। আমাদের একটা সংসার হবে, দুটো ছানাপোনা থাকবে আমাদের ঘরে। ভালোবাসায় ঠাসা থাকবে আমাদের সংসার। আমি স্বপ্নে যেন বিভোর হয়ে যাচ্ছিলাম।


দিন গড়াচ্ছে, মাস ফুরোচ্ছে।


হঠাৎ ধীরে ধীরে তার মধ্যে পরিবর্তন লক্ষ করলাম। আগের মতো সে আর দেখা করতে আসতে চায় না। আগের মতো বারবার ফোন করে না। আগের মতো মেসেজ পাঠায় না। আমি তার এই আকস্মিক উদাসীনতায় ভীষণ রকম কষ্ট পাচ্ছিলাম। তার প্রতি ভালোবাসা আর স্বপ্নের স্তূপ আমার দিন দিন বেড়েই চলছিল। অপরদিকে, আমার প্রতি তার আগ্রহ, ভালোবাসা, যত্ন সবকিছুই কেমন জানি কমতে লাগল। আমি যতই তাকে কাছে টানতে চাই, সে ততই যেন দ্বিগুণ বেগে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চায়। আমি যতই তাকে আমার করে পেতে চাই, ততই সে আমার কাছ থেকে পালিয়ে পালিয়ে বেড়ায়।


আমার গোটা পৃথিবীটা ওলটপালট হয়ে গেল। তার অবহেলায় আমি প্রতিদিনই ভেঙে পড়ছিলাম। সে বাদে আমার অন্য কাউকে ভালোই লাগছিল না, ভালোবাসা তো অনেক অনেক দূরের কথা। ভালোবাসার মানুষের অবহেলা সহ্য করার ক্ষমতা ঈশ্বর কাউকে দেননি।


দিন চলে যায়, সময় এগোয়। তার জন্য মনটা আমার যতই আনচান করছিল, আমার প্রতি তার অনাগ্রহ ততই বেড়ে যাচ্ছিল। সকাল থেকে ভোররাত অবধি যে মানুষটার সাথে আমার দিনে কমপক্ষে ৩০ থেকে ৪০ বার কথা হতো, সেই মানুষটি সারাদিন একটিবারও কল করার প্রয়োজন মনে করে না। যার মেসেজ দিয়ে আমার সকাল শুরু হতো, সকাল পেরিয়ে দুপুর বিকেল সন্ধ্যা নেমে গেলেও সে মানুষটির কাছ থেকে আর একটিও মেসেজ আসে না।


আমি ওকে ফোন করলেই আমাকে নানান ব্যস্ততা দেখায়, আমি মেসেজ পাঠালে সে মেসেজ সব সময়ই আনসিন থেকে যায়। বুঝলাম, তার জীবনে হয়তো আমার গুরুত্ব ফুরিয়ে এসেছে, কিন্তু আমার জীবনে তার গুরুত্ব ক্রমেই বেড়ে চলছে। আমাকে যে হারে সে অবহেলা করে যাচ্ছিল, তার দ্বিগুণ হারে তার প্রতি আমার আগ্রহ বেড়ে চলছিল। আমি তাকে ছেড়ে বাঁচতেই পারছিলাম না আর! কী এক বিচ্ছিরি অবস্থা!


সেশনজ্যামের ধাক্কা সামলে আমার অনার্স শেষ হলো। আমি বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষা দিতে লাগলাম। পাশাপাশি মাস্টার্সটাও শেষ করে ফেললাম। আর এদিকে দিন দিন একাকিত্বে ডুবে যাচ্ছিলাম। এভাবে একসময় পড়ে গেলাম চরম ডিপ্রেশনে।


দরিদ্র পরিবারে জন্ম বলে আমাকে টিউশনি করে চলতে হয়েছে। এমনকি রাফির অনেক খরচও আমি দিয়েছি বিভিন্ন সময়ে। আমার কাছে রাফির খরচকে কখনওই আলাদা কিছু মনে হয়নি। ওর খরচ মানেই তো আমাদের খরচ। আমি পরিবারের সবার বড় বলে আমার দায়িত্বটাও বড়। শুধু প্রেম ভালোবাসা নিয়ে পড়ে থাকলে আমার মতো গরীবঘরের মেয়েদের চলে না।


ইতোমধ্যে কাজিনের বাসা থেকে বের হয়ে আমি একটা ব্যাচেলর বাসায় গিয়ে উঠেছি। একরুমে তিনজন। ঠাসাঠাসি করে থাকি। ডিপ্রেশন কমাতে আর নিজের ব্যস্ততা বাড়াতে আগে তিনটা টিউশনি থাকলেও আমি আরও দুইটা টিউশনি নিয়েছি। মোট পাঁচটা টিউশনি। সারাদিন পড়াই। আমি পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষের ছেলেমেয়েকে মানুষ করে দেবো! নিজের জন্য খরচ করার পর বাকি যে টাকাটা বেঁচে যেত, সেটা বাবাকে পাঠিয়ে দিতাম। বাবা একটু ভালো থাকুক। অনেক করলেন তো আমাদের জন্য, এখনও করে যাচ্ছেন। কিছুই তো করতে পারি না ওঁদের জন্য।


যতই ব্যস্ততা বাড়ুক না কেন, তাকে ভুলে যেতে পারছি না। মেনে নিতে পারছি না তার এমন ব্যবহার। আমার কী দোষ ছিল? ভেবেই বের করতে পারছি না কী ভুল করেছিলাম আমি! মাঝে মাঝে ইচ্ছে হতো, আত্মহত্যা করি। কী হবে চলে গেলে! কিন্তু অসহায় বাবা আর মায়ের চেহারা যখন চোখে ভাসে, তখন আর ঠিক সাহসে কুলাতে পারি না। ওই মানুষগুলোর কী দোষ? কেন ওঁদের কাঁদাব? আসলে কী, সুইসাইড করতে দুঃখকষ্টের চেয়েও অনেক অনেক বেশি সাহসের দরকার পড়ে। দুঃখটা আমার ঢের বেশি থাকলেও সাহসটা ঠিক ছিল না বোধহয়। তাই আত্মহত্যা-করাও হয়ে ওঠেনি।


রাফির কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে যতই চেষ্টা করি না কেন, মনটা আমার কিছুতেই মানতে চায় না। আসলে সম্পর্ক যত পুরনো হয়, ভালোবাসা কম হোক বা বেশি হোক, কিছু অভ্যস্ততা তৈরি হতে থাকেই। আর সেগুলি তো হারিয়ে যায় না, থেকেই যায়। মানুষ তো অভ্যাসেরই দাস। হয়তো সে আমার অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল বলেই আমার মনটা তাকে বারবার চাইছিল।


একদিন। তাকে খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিল। আর কিছু নয়, দূর থেকে দেখলেও চলবে। ৩৭ বার ফোন করার পর সে ধরল। কলটা ধরেই খুব ব্যস্ততা দেখিয়ে বলল, আমি তোমাকে একটু পরে ফোন করছি, কেমন? সেই একটু পরটা আর এল না। দুইদিন চলে গেল, সে আর কলব্যাক করে না। এদিকে আমি বোকার মতো সত্যি সত্যি তার ফোনের অপেক্ষা করে আছি। আমি আবার ফোন করলাম। দেখি, সে অনবরত ওয়েটিং-এ। যতবারই তাকে কল করি, ততবারই সে ওয়েটিং-এ। আমার কলটা দেখেও তোয়াক্কাই করছে না যেন!


টানা ২১ বার কল করার পর তাকে পাই। নানান ব্যস্ততা, নানান অজুহাত দেখিয়ে আমার উপর ভীষণ বিরক্ত হয়। আমি তাকে বলি, একবার দেখা করবে? তোমাকে একটু দেখব। পাঁচ মিনিট হলেও চলবে। পাঁচ মিনিট মানেই পাঁচ মিনিটই, চার মিনিট ষাট সেকেন্ড। তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। তুমি কোথায় আছ, বলো? আমি আসি? একটু দেখি তোমাকে?


সে আমার সাথে দেখা করতে পারবে না। সাফ সাফ জানিয়ে দিল। সে অনেক ব্যস্ত। আমাকে দেবার মতো পাঁচ মিনিট দূরে থাক, পাঁচ সেকেন্ড সময়ও তার হাতে নেই। সে বলে ফেলল খুব নির্বিকারভাবে। আমি দেখলাম, রাফি এখন বলে ফেলতে পারে। অনেক কথাই বলে ফেলতে শিখে নিয়েছে রাফি। আগে এমন পারত না। মানুষ অনেক কিছুই শিখে ফেলতে পারে। তবে আমি কেন পারছি না?


সেদিন রাতে খুব কেঁদেছিলাম। অসহায় লাগছিল। পৃথিবীটাকে টুকরো টুকরো আর ভাঙাচোরা মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, পায়ের নিচে আমার কোনও ঠাঁই নেই। যে সংসার গড়ার আগেই ভেঙে গেল, সে সংসারটার জন্য কান্না পাচ্ছিল। চোখের সামনে শুধুই অন্ধকার দেখছিলাম।


পরের দিন খুব বৃষ্টি হলো। ছাদে উঠে ইচ্ছেমতো ভিজলাম। আমার খুব সহজেই ঠান্ডা লেগে যায়। আমার বৃষ্টিতে ভেজা বারণ। মনে হলো, আমার ঠান্ডা লাগলে লাগুক, জ্বর আসে তো আসুক! বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে শপথ নিচ্ছিলাম, বেঁচে থাকলে তার সাথে আর কখনও দেখা করব না। বৃষ্টির জলধারায় আমার সব স্মৃতি ধুয়ে যাক। আজকের পর থেকে আমি হয়ে উঠব এক অন্য মানুষ।


সেদিন এত বেশি ভিজেছিলাম যে আমার প্রচণ্ড জ্বর চলে এল রাতে। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। আমার কাজিন আমাকে নিতে এল। ওর বাসায় নিয়ে গিয়ে আমার অনেক সেবাযত্ন করল। রাফিও আমার অসুস্থতার খবর জানতে পেরেছিল। অথচ একবারও আমায় ফোন করেনি। আমাকে দেখতে চাইল না। একটা মেসেজও পাঠায়নি। আমার কোনও খোঁজ তার আজ দরকার নেই। আমি মরে গেলেও ওর কিছু এসে যায় না। মানুষ কীভাবে এমন বদলে যায়? অসুস্থতা আমাকে যতটা কষ্ট দিচ্ছিল, রাফির ব্যবহার আমাকে তার চেয়ে শতগুণ বেশি কষ্ট দিচ্ছিল।


চার দিন জ্বরে ভুগে কোনওমতে সেরে উঠলাম। এদিকে বিভিন্ন জায়গায় পরীক্ষা দিয়েই যাচ্ছিলাম।


আমার কাজিনের কাছ থেকে জানতে পারলাম, একটা কোম্পানিতে রাফির চাকরি হয়েছে। স্যালারি মোটামুটি ভালোই। আমি কেন জানি আশা করে ছিলাম, হয়তো সে আমায় ফোন করে খবরটা জানাবে। আমাদের সেই লালনীল সংসারটার কথা বলবে। প্রচণ্ড কষ্ট পেলাম। যে মানুষটার জীবনের প্রতিটি জায়গায় আমি মিশে ছিলাম, সে মানুষটি তার জীবনের এত বড় একটা শুভখবর আমাকে জানালই না! আরও কী কী জানি মাথায় আসছিল!…অথচ তখন আমি পুরোপুরি সুস্থ। জ্বরের ঘোরে না থেকেও কারও মাথায় এমন অদ্ভুত ভাবনা আসে কীকরে? মেয়েদের আসে। মেয়েরা কবরে নামার ঠিক আগমুহূর্তেও বেঁচেথাকার আরও একটু বোকা বোকা স্বপ্ন দেখে ফেলতে পারে!


নিজেকে খুব ক্ষুদ্র মনে হতে লাগল। রাফি আমার কাজিনকে বলল, আমার নাকি কোনও যোগ্যতাই নেই তার স্ত্রী হবার! ওর কথা শুনে আমার নিজেরও নিজেকে ভয়ংকর রকমের অযোগ্য মনে হতে শুরু করল।


মনে হলো, তাই তো! আমি রাফির যোগ্যই না! যদি তা-ই হতাম, তা হলে তো রাফি আমাকে এভাবে ছেড়ে যেতে পারত না। একটাসময়, পার্থিব হিসেবে, সে নিজেই আমার যোগ্য ছিল না, আমি তাকে নিজের কাছে যোগ্য বানিয়ে রেখেছি দিনের পর দিন। তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছি। অথচ একটা চাকরিতে জয়েন করার পর সে আমাকে কত সহজেই অযোগ্য ভেবে নিল। মানুষ সব পারে!


সব ইগো ঝেড়ে ফেলে তাকে ফোন করলাম। একটা অভিনন্দন অন্তত দিই! আমার মধ্যে লজ্জা, দ্বিধা কাজ করছিল না, কেবলই একধরনের দুরন্ত সাহস কাজ করছিল। ২৬ বার ফোন দিলাম, একবারের জন্যও সে ফোন ধরেনি। তার পর আমার নাম্বারটা সে ব্লক করে দিল।


তার পর থেকে রাফির সাথে যোগাযোগ আমার বন্ধ হয়ে গেছে। সে তো ফোন করেই না, এদিকে আমার নাম্বারটা ব্লক করে রাখা, আমি অন্য নাম্বার থেকে ফোন করলে আমার কণ্ঠস্বর চিনতে পেরে সেটিও সাথে সাথেই ব্লক করে দেয়।


আমি দিনরাত পড়াশোনা করতে শুরু করলাম। একটা চাকরি আমার লাগবেই। রীতিমতো হন্যে হয়ে আমি চাকরি খুঁজছি। বিভিন্ন সরকারি ব্যাংকে পরীক্ষা দিচ্ছি। হচ্ছে না। বিসিএস দিলাম দুইবার। ভাইভা পর্যন্ত যাই, আর হয় না। কোথাও কিচ্ছু হচ্ছে না আমার। আমার জীবনটা এখনও হাওয়ায় দুলছে। টিউশনি চলছে। ওটা করেই বেঁচে আছি। এদিকে দিন দিন আমার ডিপ্রেশনও বাড়ছে। বয়স ২৭ পেরোল।


১৪ এপ্রিল ২০১৭। জানতে পারলাম, সেদিন রাফির বিয়ে। সে আমার কাজিনকে ফোন করে বিয়ের দাওয়াত দিল। সাথে কথার ছলে এটাও বলে দিল, তার পরিবার নাকি আমার মতো দরিদ্র কোনও পরিবারের মেয়েকে মেনে নেবে না। চেহারাই তো আর সবকিছু নয়, ফ্যামিলিও লাগে। আমার ফ্যামিলির সাথে ওর ফ্যামিলি ঠিক যায় না। আরও অনেককিছুই বলল। সে তার এক কলিগকে বিয়ে করতে যাচ্ছে। মেয়ের বাবার ভালোই টাকাপয়সা আছে। বিয়ের পর রাফিকে ওরা দেখে রাখবে।


আমি এতদিন পর জানতে পারলাম, আমার বাবার দারিদ্র্যই আমাকে ছেড়ে যাওয়ার একমাত্র কারণ! অথচ আমার পারিবারিক অবস্থা সম্পর্কে তার আগে থেকেই জানা ছিল। আমি তো তার কাছে কিছুই লুকোইনি। কিছু ছেলে থাকে, যাদের ‘দেখে রাখতে’ হলে শুধু মেয়েকে নয়, সাথে মেয়ের বাবাকেও দরকার হয়।


ভয়ানক কষ্ট আর অপমানে আমি মাটিতে মিশে গেলাম। আমার যে দারিদ্র্যকে সব সময়ই আমার শক্তি ভেবেছি, সে দারিদ্র্যই আমার সবচাইতে প্রিয়মানুষটির চোখে আমার অযোগ্যতা!


অনেক অনেক কাঁদলাম সেই রাতে। রাতের আঁধারকে বুকের মধ্যে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরার ব্যর্থবাসনা মনের মধ্যে রেখে রেখে বালিশে মুখ চেপে কাঁদলাম। সে কান্নায় ভালোবাসা হারানোর ব্যথা ছিল, তার চাইতে বেশি ছিল অপমানিত হওয়ার কষ্ট, একধরনের প্রতারিত হবার যন্ত্রণা। আমার রবকে স্মরণ করলাম। স্রষ্টার কাছে দুইহাত তুলে সাহায্য চাইলাম। বিনাঅপরাধে এতটা শাস্তি মেনে নেওয়া যায় না!


এভাবে কাটল আরও কিছু দিন।


একদিন রোববার। আকাশভরা জ্যোৎস্না। প্রথম যেদিন রাফির সাথে কথা হয়েছিল, ঠিক সেদিনের মতোই আলো চারিদিকে। চাঁদ গলে গলে আলো এসে ঝরছে আমার সারাউঠোনে। আকাশের সারাটা বুকজুড়ে অগুনতি তারার মেলা বসেছে। সামনের একটা বাড়ির বারান্দায় স্বামী-স্ত্রী আর ওদের ছোট শিশুটি। ওরা তিন জন খুনসুটিতে মেতেছে। আমার মনটা হু হু করে কেঁদে উঠল। রাফি আমার জীবনে থাকলে হয়তো এমন একটা ঘর আমাদেরও হতো। আমার সাধের সংসারটা ভেঙেচুরে দিয়ে রাফি অন্য কারও সাথে দিব্যি সংসার করে যাচ্ছে। আহা জীবন! আহা জীবন! আহারে ভালোবাসা! আমার কথা কি তার সত্যিই একবারও মনে পড়ে না? এত বছরের ভালোবাসা তার মনে একটুও দাগ কাটে না? এতটা নিষ্ঠুর হতে মানুষ কীভাবে পারে?


আমার ভেতরটা জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, কেউ বুঝি তাজা অ্যাসিড আমার বুকে ঢেলে দিয়ে গেছে, আর আমি ক্রমশই পুড়ে যাচ্ছি! রাফির কথা পাগলের মতো ভাবছি। তাকে আজ এত মনে পড়ছে কেন? কিছু না ভেবেই মোবাইলটা হাতে নিয়ে ওর নাম্বারে ফোন করলাম। ফোনটা গেল! তার মানে, সে আমাকে আনব্লক করে দিয়েছে! আহা আহা! ও সাথে সাথেই ফোনটা ধরল! আমি কেমন ঝরঝর করে কেঁদে ফেললাম। সাক্ষী ছিল সেই পূর্ণিমারাত, সেই ছাদটি, আর সেই জ্বলন্ত চাঁদ! চোখের সামনে পড়ে ছিল একটা সংসারের বিকট দুঃস্বপ্ন!


আমি শিশুর মতো করে কাঁদছি! চিৎকার করে করে কাঁদছি। আমার বুকে অনেক কান্না জমে আছে। কাঁদতে কাঁদতে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে আমার। আজ আমার কিছুই নেই। আমার সবকিছু হারিয়ে গেছে। আমি শেষ হয়ে গেছি। আমার মাথার উপর পুরো আকাশটা ভেঙে পড়ছে!


রাফি কিছুই বলছে না। কিছু সময় চুপচাপ থেকে হেসে হেসে বলল, শায়লা, সরি। তোমার নাম্বারটা ছিল না, তাই চিনতে পারিনি। ভালো থেকো, আর আমাকে কখনও ফোন কোরো না।


এইটুকু বলেই কলটা কেটে আমার নাম্বার আবারও ব্লক করে দিল। আমি আর তাকে পেলাম না। আমি কীভাবে রাফির হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করব? আমার কেন কোনও রাগ হচ্ছে না? আমার মধ্যে একটুও লজ্জা কাজ করছে না কেন? ভালোবাসলে মানুষ এতটাই নির্লজ্জ হয়ে যায় বুঝি?


সেই রাতে অনেকগুলো ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে ছিলাম।


এভাবে আরও কিছুদিন। আমি ঠিকঠাকমতো খাই না, ঘুমাই না, নিতান্ত প্রয়োজন না হলে বাইরে যাই না। আমি শুধুই পড়ি আর কাঁদি। আমার পৃথিবীটা আগে থেকে ছোট ছিল, ওটা আরও ছোট হয়ে গেল।


সামনে বিসিএস পরীক্ষার রেজাল্ট বের হবে। তানিয়াকে আগেই রোলনাম্বার দিয়ে রেখেছি। বলেছি, রেজাল্ট দিলে যেন সে আমারটা দেখে নেয়।


একদিন। মনটা ভালো নেই। জানালার গ্রিল ধরে বিষণ্ণচোখে বাইরে তাকিয়ে আছি। হঠাৎ! তানিয়ার ফোন! ধরলাম। সে চিৎকার করে আমাকে জানাল, একটু আগে রেজাল্ট বের হয়েছে। আমি অ্যাডমিনে একশোবারোতম হয়েছি! সে হয়েছে ছিয়ানব্বইতম!


তাড়াতাড়ি নেটে বসে গেলাম। পিএসসি’র ওয়েবসাইট থেকে রেজাল্টের পিডিএফ ফাইলটা নামালাম। চেক করে দেখি, সত্যি সত্যিই আমার রোলনাম্বারটা ওখানে আছে! নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। এমনও হয়! আমার মতো একটা মানুষও চাকরি পায়! একজন অযোগ্য মানুষের চাকরি হয়েছে! আনন্দে, খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেলাম। আমার পৃথিবীটা সম্পূর্ণ পাল্টে গেল একমুহূর্তেই! আজ থেকে আমি অন্যকেউ।


যে রাফি হাবিব গ্রুপ-এ মাঝারিগোছের একটা চাকরি পেয়ে আমায় সস্তাটিস্যুর মতো সহজেই ছুড়ে ফেলে দিল, কেবল আমি গরীবঘরের মেয়ে বলে, আমার বাবা সামান্য দিনমজুর বলে, সে আজ এসে দেখুক, আল্লাহ্‌ আমায় এ কী দিয়েছেন! আজ শুধুই আমার দিন! আজ থেকে আমি আর তুচ্ছ কেউ নই, আজ থেকে দেবার মতো আমারও একটা পরিচয় আছে!


ভাবতে ভাবতে আমার সব দুঃখকষ্ট কোথায় যেন নিমিষেই উড়ে গেল। একটা রেজাল্ট, একটা চাকরি! এই দুই মিলে আমার জীবনটাই বদলে দিল যেন! নিজের মধ্যে অদ্ভুত রকমের শক্তি অনুভব করলাম। পৃথিবীটাকে আজ আমার হাতের মুঠোয় মনে হচ্ছে। অনেক অনেক বছর পর আজ আমি খুশিতে বারবার চিৎকার করে কেঁদে উঠছি! আমার বুকভেঙে অশ্রু ফেটে পড়ছে! এই কান্না আনন্দের, এই কান্না বিজয়ের, এই কান্না হোঁচট খেয়ে পড়ার পর উঠে দাঁড়ানোর খুশির।


বাবা-মা’কে ফোন করলাম। খবরটা শুনে বাবা-মা দুজনেই হু হু করে কেঁদে উঠলেন। তাদের সাথে আমিও কেঁদে চলেছি। জীবনে এই প্রথম বাবা-মাসহ আমি উৎসব করে কাঁদছি। কাঁদতে আমার ভীষণ ভালো লাগছে। ইচ্ছে করছে, কয়েক যুগ ধরে এই কান্নাটা চলতে থাকুক! যতই কাঁদছি, বুকের ভেতরের জমাটবাঁধা ব্যথার পাথরগুলি একটা একটা করে বেরিয়ে পড়ছে। মনে হচ্ছে, বুকের মধ্যে কিছু পাথর থাকা ভালো। খুব ভারী ভারী পাথর। কিছু পাথর থাকলে সেগুলিকে বের করে দিতে ইচ্ছে করে। না থাকলে সে ইচ্ছেটা আসত কি আদৌ?


এ খবর উল্কার মতো ছড়িয়ে পড়ল আমার আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব সবার কাছে। সামান্য দিনমজুরের মেয়ে একটা রেজাল্টের জোরে একতুড়িতেই হয়ে গেল উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। এদিকে আমার মোবাইলে অসংখ্য ফোন, মেসেজ আসছে। এমন অনেক মানুষ ফোন করছে, যাদের আমি ফোন করলে আমার নাম্বারটা চিনতে পারত বলেই ফোনটা ধরত না! পৃথিবীটা মুহূর্তেই কেমন বদলে গেল! যে আমি নিজের কষ্ট ভাগ করে নেবার জন্য ফোন করে কাউকেই পেতাম না, সে-ই আমার ফোনে রীতিমতো কলের ঝড় বয়ে যাচ্ছে! আমার ফোনটা ধরার সময় যাদের একসময় হতো না, তাদের ফোন ধরার সময় এখন আমার হচ্ছে না। আমি কাউকে কিছু ফেরত দিচ্ছি না, তবু সবাই সবকিছুই ফেরত পেয়ে যাচ্ছে! আল্লাহ্‌ কাকে কখন কীভাবে পরিপূর্ণ করে দেন, তার খোঁজ কেউ জানে না। আহা, জীবন কত কী যে দেখায়!


আমি সেদিনই গ্রামে গেলাম। আজ তো আমার ঈদ! দুই দিন পেরিয়ে গেল আনন্দে আনন্দে। আমাকে অভিনন্দন জানানোর জন্য চারপাশ থেকে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব দলবেঁধে আমাদের ভাঙাঘরে আসছে। আমার মা বারবার আনন্দে কেঁদে ফেলছেন। আমার অশিক্ষিত বাবা আমার রেজাল্টের প্রিন্টেড হার্ডকপিতে আমার রোলনাম্বারটা সবাইকে ডেকে ডেকে দেখাচ্ছেন। সামান্য একটা সংখ্যা, আজকে সেটিও কত দামি!


হঠাৎ দেখি, রাফির নাম্বার থেকে কল আসছে। তার ফোন ধরার সময় আমার হচ্ছে না। আজ আমার ব্যস্তথাকার দিন। রাফি আজ শায়লাকে টানা ১৫ বার ফোন করল! আবারও ফোন এল। আমি তাকিয়ে আছি মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে। ধরছি না। ভাবছি, একসময় এমন অস্থির হয়ে আমি তাকে অবিরাম ফোন করতেই থাকতাম, আর সে ঠিক এমনি করেই অবহেলায় ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকত। আজকের এই পুনরাবৃত্ত ইনকামিং কলটা আমাকে একধরনের আনন্দ দিচ্ছে। ২৩টা মিসড কল। আমি ফোন ধরিনি। আচ্ছা, রাফি কেন বুঝতে পারল না যে শায়লা ফোন ধরবে না?


আজকে সময় এসেছে মুখোমুখি হবার। আজকে সময় এসেছে অমীমাংসিত অনেক প্রশ্নের উত্তর দেবার। আজকে সময় এসেছে আমার সব দুঃখে প্রলেপ মাখবার। আজকে সময় এসেছে…আমাকে যারা সস্তা ভেবে টিস্যুপেপারের মতো ছুড়ে ফেলে দিয়েছে দিনের পর দিন, ওদের সমুচিত জবাব দেবার।


আমি কাউকেই কিছু বলিনি। আমাকে কিছুই বলতে হয়নি। তবু ওরা সবাই জবাব পেয়ে গেছে। এ এক জাদু, এ এক চরমউত্তর!


এভাবে অনেক দিন কেটে গেল। আমি মন দিয়ে চাকরি করছি। দিন দিন দায়িত্ব আর ব্যস্ততা বাড়ছে। সময় আমাকে অনেক বেশি ব্যস্ত করে ফেলেছে। রাফিকে তেমন মনে পড়ে না। তাকে মনেপড়ার সময়ই আমার হয় না। রেজাল্টের পর ওর সাথে আমার আর কখনওই কথা হয়নি। আজ আমার সামনে কথাবলার অনেক মানুষ। শায়লা পারভিন সুমি, সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। সে আজ সত্যিই খুব ব্যস্ত। তার কোনও দুঃখ নেই। ব্যস্ত মানুষের দুঃখ থাকতে নেই।


রাফি আমাকে কখনও কখনও ফোন করে। কেন করে, জানি না।
আমি রাফির নাম্বার ব্লক করে দিইনি। কেন দিইনি, আমি জানি।


সেদিন। আমার কাজিনের এক বন্ধুর বিয়েতে গিয়েছি। উনি বারবার অনুরোধ করে বলেছেন আমি যেন অবশ্যই অবশ্যই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকি। আমি মানুষের ভালোবাসার দাম আজও দিতে জানি। কেউ আমায় সম্মান দেখালে আমিও তাকে সম্মান দেখাতে শিখেছি। ব্যস্ততার মধ্যেও ডিসি স্যারের পারমিশন নিয়ে বিয়েতে অ্যাটেন্ড করতে গিয়েছি। বেশ জমকালো অনুষ্ঠান। চেয়ার নিয়ে অনুষ্ঠানের এক কোনায় বসে আছি। সবার সাথে গল্প করছি। হঠাৎ সামনে দেখি, রাফি তার স্ত্রীকে নিয়ে। আমার দিকে অবাকদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি একনজর তাকিয়ে উপহাসের হাসি ছুড়ে মেরে অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়ালাম।


দেখলাম, রাফি তার স্ত্রীকে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য হাসিমুখে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। আমি তড়িঘড়ি করে হাতের ঘড়িতে সময় দেখলাম, রাফিকে খেয়াল করতে না পারার ভান করে সেখান থেকে খুব দ্রুত বেরিয়ে এলাম। আমার চলেযাবার পথের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রাফি হয়তো অনেক কথাই ভেবে চলেছে। সে কী ভাবছে, তা নিয়ে ভাববার সময় এখন আর আমার নেই।


আজ রাফির ভাববার সময়, আর আমার ভাবানোর সময়।