ভুলঘরের মানুষের ডায়েরি

 
আমার মাঝে মাঝেই মনে হয়, আমি সত্যিই একটা ভুল জায়গায় জন্ম নিয়ে ফেলেছি। না আমি সবার সাথে মানিয়ে চলতে পারছি, না অন্য কেউ আমার সাথে মানিয়ে চলতে পারছে। আমার বাসার কাউকেই আমি অপছন্দ করি না কিংবা তাদের একাধিক বিষয় আমার মতের সাথে না মিললেও আমি কখনওই, আমার কোনও মতামত, আমার কোনও দর্শন কারও উপর চাপিয়ে দিইনি অথবা আমার জীবনদর্শন সম্পর্কে ওদের আমি কখনও অবহিতও করিনি। ওরা ওদের মতো করেই সব সময় চলে, চলে আসছে। আমি সব সময় সর্বোচ্চ চেষ্টাটা করে যাচ্ছি আমার জায়গা থেকে ওদের বুঝে চলার। ওদের জন্য আমার পক্ষে যা যা করণীয়, তার সব কিছুই আমি সব সময় করে গেছি। আমি সব সময় ওদের সব কিছুকেই উদারমনে গ্রহণ করেছি। কিন্তু ছোট থেকেই একটা জিনিস খেয়াল করছি, আমার কোনও কিছুই ওদের মানসিকতার সাথে যায় না। আমি যা-কিছুই করি না কেন, সব কিছুতেই ওদের সমস্যা। আমার সব কিছুই ওদের কাছে ভীষণ উগ্র। সরলতা কখনও উগ্রতা হতে পারে, সে আমার কখনও জানা ছিল না।


ছোট থেকেই আমি বাইরে বাইরে মানুষ। আমি আসলে হাঁস-মুরগির মতো ছিলাম কিছুটা, কেবল খাবারের সময় হলেই ঘরে আসতাম, নয়তো সারাক্ষণই বাইরে। আমি ক্লাস সেভেন পর্যন্ত বাসার সামনের পুকুরে গোসল করতাম। গোসলে নামলে আমি কখনওই নিম্নে চার ঘণ্টার আগে উঠতাম না। দুপুরে বাসা থেকে কোনও রকমে কয়েকটা ভাত খেয়ে আবার চোরের মতো ঘর থেকে বেরিয়ে পড়তাম। সন্ধ্যায় একগাদা ধুলোময়লা-জড়ানো কাপড়ে বাসায় ফিরতাম। তারপর এই নিয়ে প্রত্যেকদিন আপুর হাতে কিল আর চড় খেতাম, সেই সাথে চুল ধরে ঝাঁকুনি। আমার মাথার সব চুল আপুর এমন অমানবিক নির্যাতনের ফলেই শেষ হয়ে গেছে। ছোট থেকেই আমার চুল ছেলেদের মতো করে কেটে রাখা হতো, কখনও বড়ো হতে দেওয়া হতো না। বড়ো করতে চাইলে আপুর কাছে বাজে বাজে কথা শুনতে হতো। আসলে আমি অন্য কারও কথা জানি না, কিন্তু বাসায় সবার ছোট হবার ফলে আমাকে বড়োদের কাছ থেকে আদর আর স্নেহের নামে অনেক ধরনের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। এজন্যই আমি এখন বলি, আমি আসলে ভুল জায়গায় এসে পড়ে গেছি।


ছোটবেলাতেও আমি যা চাইতাম, যেভাবে চলতে চাইতাম, সেভাবে কেউ চলতে দিত না। বড়ো হবার পর ছোট থেকে তারা যেভাবে চলতে শিখিয়েছে, সেভাবে চলতে চাইলে এখন তাদেরই অপছন্দ হয়, আর তার ফলে, নানা ধরনের কটুকথা আমাকে শুনতে হয়। আমার চুলগুলো চাইলেও এখন বড়ো করতে আমি আর পারি না, কারণ আমার চুলের স্বাভাবিকভাবে বড়ো হবার যে ক্ষমতা, সেটা অনেক আগেই বার বার কেটে দেওয়ার ফলে নষ্ট হয়ে গেছে, যার কারণে আমি এখন চুল বড়ো করতে চাইলেও একটা পর্যায় পর্যন্ত এসে সেটা নিজে নিজেই মাঝখান থেকে ভেঙে পড়ে যায়। আমি প্রচুর ফল, সবজি খাই, আমার ঘুমের কোনও সমস্যা নেই, শারীরিক কোনও সমস্যা নেই, এমনকি এই চুলের জন্য আমি এখনও ডাক্তার দেখাই, নিয়মিত ওষুধ খাই, কিন্তু কোনও লাভই হয় না। অথচ বাসার সবাইসহ বাইরের সবাইও এটার জন্য আমার উপর আঙুল তোলে। আমি কি জানি না লম্বা মেয়েদের যে ছোটচুলে ভালো দেখায় না? ওরা কয়জন জানে, এই চুলের জন্য আমি আজকে কতগুলো বছর ওষুধ খেয়ে যাচ্ছি? আমি এর দোষ কার উপর চাপাব? নিজের উপর? কেন তখন বেয়াদবি করে হলেও আমার নিজের মতো চলিনি, এমন কিছু ভাবব আমি? আমি এখনও মনের বিরুদ্ধে গিয়ে হলেও তাদের অজস্র কথা মেনে নেই। আমাকে আসলে এই জিনিসগুলো ভীষণ কষ্ট দিচ্ছে। মাঝে মাঝেই মনে হয়, দম বন্ধ করে একটা অন্ধকার ঘরে পড়ে আছি।


আমার আসলে এখানে জন্মানোই ঠিক হয়নি! আমি নিজেও তাদের সাথে ভালো নেই, আবার আমি তাদেরকেও ভালো রাখতে পারি না মনের বিরূদ্ধে গিয়েও। আজকে এসব বলার কারণ, সকাল থেকেই আমার খুব বিরক্ত লাগছে। আমি ওদের জন্য সব কাজ করে দিয়ে তারপর আমার নিজের কাজে বসি। আমি রান্না করি, ওদের কাপড় পরিষ্কার করি, ঘর পরিষ্কার করি। সব কাজ শেষে আমি আমার কাজে বসি, কিন্তু তাতেও ওদের সমস্যা। আমাকে পড়ার টেবিলে দেখলেই বোধহয় ওদের কিছুতেই সহ্য হয় না। সারাক্ষণই আমার পেছনে সব কিছু নিয়েই পড়ে থাকলে,…আমিও তো মানুষ, আমি কতক্ষণ চুপ করে সহ্য করে যাব? ভোর থেকে শুরু করে নয়টা পর্যন্ত বাবা টানা কোরানশরিফ পড়তে থাকেন। এত জোরে জোরে গলা ফাটিয়ে এতই উৎকটভাবে আওয়াজ করে পড়েন যে সেটা যে একটা পবিত্রগ্রন্থ, সেটাই আমি ভুলে যাই। এভাবে কোরানশরিফ পড়াটা আসলেই ঠিক নয়। শুধু আমি নই, বাসার অনেকেই এটা নিয়ে বিরক্ত ওঁর উপর। আমি বাবাকে অনেকবারই বলেছি, সুর করে একটু দরদ দিয়ে পড়তে, কিন্তু উনি আমার কোনও কথাই শুনবেন না। কোনও একটা বিচিত্র কারণে উনি এই স্টাইলেই কোরান পড়েন।


আমার বাসার সবার গুরুদায়িত্ব আমাকে ঠিক করা, অর্থাৎ যত সমস্যা, তার সবই আমার মাঝে, আর তারা সবাই মিলেমিশে জোর করে হলেও আমাকে শুধরে দেবার গুরুদায়িত্ব নিয়ে এসেছেন, অথচ ঘরের কাজ করার বেলায় কারওই সে হিসেব মনে থাকে না। কাজের বেলায় সবাই হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলেও, পাওয়ার বেলায় ওরা যার যার ভাগ বুঝে নিয়ে যায়, আর আমার তাদের এসব চেহারা দেখেও চুপচাপ তাদেরকে শ্রদ্ধা করে চলতে হবে। আমি বুঝি সবই, আমি তাদের সাথে অযথা কথা বলি না কেন, এটাও তাদের আর একটা বড়ো সমস্যা। তারা কেউ আসলে এটা মেনে নিতেই পারে না। কিন্তু আমি তাদের সাথে কী নিয়ে কথা বলব? তাদের সাথে কথা বলতে বসলেই তারা অমুক তমুকের নামে, তাদের সন্তানের নামে, দেশের নানান ইস্যু নিয়ে সমালোচনা শুরু করে দেয়। আমার বাবার ভাষ্যমতে, দেশের সরকার, সাধারণ মানুষ, অন্যান্য ধর্মাবলম্বী, এমনকি বড়ো বড়ো আলেম-ওলামাসহ (যাঁরা ধর্মের সঠিক ব্যাখ্যা দেন, সত্য কথাগুলি বলেন) সবাই নাফরমান না কী যেন বলে! এদের আসলে মতিভ্রষ্ট হয়ে গেছে এবং এদের সকলকে গুরুতরভাবে পিটিয়ে ঠিক করতে হবে। সারাবিশ্বে এখন ভয়াবহ পরিস্থিতি এদের কারণেই।


সেই সকাল থেকে উনি এমন বিকটকণ্ঠে ভুল উচ্চারণে কোরানশরিফ পড়েন যে বাসায় দ্বিতীয় কোনও ব্যক্তির পক্ষে, চাইলেও, দু’রাকাতও নামাজপড়া সম্ভব হয় না। উনি ভাষণ দেওয়ার মতো করে জোরে জোরে পড়েন, কারণ তাঁর উপর গুরুদায়িত্ব পড়েছে সবাইকে ধরেবেঁধে পিটিয়ে এভাবে কানের মধ্যে ঢুকিয়ে ঢুকিয়ে কথাগুলো শুনিয়ে দেওয়ার। তাঁকে আমি কখনও কোরানশরিফ পড়া নিয়ে কোনও অভিযোগ করিনি, তার একমাত্র কারণ, এটি একটি ধর্মগ্রন্থ, এটা নিয়ে আমার কোনও কিছুই বলা মানায় না। কিন্তু আমি কয়েকবারই তাঁকে একটু আস্তে আস্তে সুর করে পড়তে বলেছি, কারণ আশেপাশের মানুষেরও অনেক সমস্যা হয়, বিশেষ করে যারা একটু রাত করে ঘুমাতে যায়। তাঁকে আবার সে কথা বোঝালেও সমস্যা, ওরা রাত করে কেন ঘুমাতে যাবে? কে রাত করে ঘুমাবে, আর কে জলদি ঘুমাবে, এটা যেন আমার বাবার ইচ্ছেয় আর মর্জিতে চলতে হবে! আর আমি ছাড়া বাসার আর কেউ এসব বলারও সাহস পায় না, কারণ আশেপাশের মানুষ জানে যে তাঁকে এসব বলে কোনও লাভ নেই, বললেই বরং উনি আরও বেশি করে সেটা করবেন। আমি আভিযোগ করলে আমার কানের কাছে এসে আরও জোরে জোরে পড়তে থাকেন আর বলতে থাকেন, আমি নাফরমান হয়ে গেছি, ইহুদিদের কালচার দেখতে দেখতে আমি হেন হয়ে গেছি, তেন হয়ে গেছি, আরও হাবিজাবি নানান কথা।


আমি আল্লাহ্‌র উপর বিশ্বাস করি, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি, কিন্তু বাবার এসব বাড়াবাড়ি আমাকে আমার স্রষ্টার কাছে থেকেও কেমন যেন দূরে সরিয়ে নিচ্ছে। আগে নামাজ পড়তে বসলেই বলতেন, আমি যেন ওঁকে দেখিয়ে নামাজ পড়ি ওঁকে খুশি করার জন্য। উনি বাসায় আসার আগেই নামাজ শেষ করে ফেললে উনি বলতে থাকেন, আমরা কেউ নামাজ পড়ি না, আমরা সব ইহুদির দল, আরও বাজে বাজে কথা। তাঁর চোখে, অন্য ধর্মের মানুষ মানেই খারাপ মানুষ, ওরা সবাই জাহান্নামি কাজকর্ম করে। জীবনটাকে, মোট কথা, জাহান্নামের চেয়েও বেশি বাজে মনে হয় মাঝে মাঝে। বাবা এমন এক স্রষ্টা নিয়ে রোজ বসে থাকেন, যিনি এক ওয়াক্তের নামাজ না পড়লেই কিংবা দেরি করে পড়লেই সত্তরহাজার আগুনের জ্বলন্তবেত দিয়ে পিটিয়ে ছারখার করে দিবেন, সুতরাং যেহেতু এই জীবনে লক্ষ লক্ষ রাকাত নামাজ বাদ দিয়ে ফেলেছি, সেহেতু নিশ্চিতভাবেই, মৃত্যুর পরের জীবনটাও কেবল কঠোর শাস্তি পেয়েই কাটিয়ে দিতে হবে! আমি বলি, এই জীবনেই কি শান্তিতে আছি খুব?! তারপর কোরানশরিফ পড়া শেষ হলে বাবার মোবাইলে ফুল ভলিউমে শুরু হবে দুনিয়ার যত টোটকা-ফোটকা ধর্মব্যবসায়ী মোল্লা-হুজুরের ওয়াজের সিরিজ। সারাদিন সেই ঘ্যানর ঘ্যানর চলতেই থাকবে। যদি কেবল সাউন্ডটা একটু কমিয়ে শুনতে বলি, তা হলেই শুরু হয়ে যায় আর এক দফায় বয়ানপ্রদান।


আমার মন নাকি সম্পূর্ণই পচে গেছে, এসব কথা আমার কানে যাবে না। আমি ইহুদিদের কালচার ধরেছি। এরপর সাউন্ড তো কমবেই না, উল্টা আরও কিছুটা বাড়বে। বাবার কাছে একটা ব্লুটুথ ওয়্যারলেস সাউন্ডবক্স আছে, তখন উনি ওটা অন করবেন। আমাদের মানুষ হতে হবে, আমরা সবাই নাকি শয়তান হয়ে যাচ্ছি। আসলে ওইসব ভুলবয়ান প্রদানকারী হুজুররা তাঁদের ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারার মূল কারণই আমার বাবার মতো মানুষরা। যেখানে ব্যবসার উপযোগী পরিবেশ ও গ্রাহক থাকবে, সেখানেই ব্যবসা জমে উঠবে। অনুকূল পরিস্থিতি ও নিরাপত্তা পেলে কোন ব্যবসাটা এ জগতে বিকশিত হয় না? এই পৃথিবীতে সবাইই চেষ্টা করে নিজের যতদূর দৌড়, সেটাকে কাজে লাগিয়ে আর্থিক ও সামাজিক শক্ত অবস্থান তৈরি করতে। এক্ষেত্রে হুজুরদের কোনও দোষ আমি দেখি না। ওঁরা প্রশ্রয় ও আশ্রয় না পেলে বাড়তে পারতেন কি? যা-ই হোক, সারাদিন যখন এসব চলতেই থাকে, তখন সিদ্ধান্ত নিই, রাতে পড়ব সবাই ঘুমিয়ে যাবার পর। কিন্তু সেই রাতেও সমস্যা। বেশি রাত পর্যন্ত জেগে থাকলে স্বাভাবিকভাবেই সকালে উঠতে পারি না। সকাল সাতটার ভেতর নাস্তা রেডি করে দিই প্রতিদিন, অথচ একদিন কোনও কারণে নাস্তা বানাতে নয়টা বেজে গেলে সেদিনও কেউ কথা শোনাতে ছাড়ে না। বাইরের মানুষের কাছ থেকে কোনও ব্যাপারে ছাড় না পেলে আমার আর খারাপ লাগে না, কেননা আমার ঘরের মানুষই তো আমাকে একইঞ্চি পরিমাণও ছাড় দেয় না! যাকে ঘরের মানুষই বুঝতে পারে না, তাকে বাইরের মানুষ বুঝবে কী করে?


সেদিন আমাকে শুনতে হয়, না জানি সারারাত জেগে জেগে কী সব উল্টাপাল্টা ভিডিও নিশ্চয়ই দেখি, এজন্যই সকালে উঠতে পারি না। অথচ প্রতিদিন যে সব কাজ সবার জন্য করে দিচ্ছি, তার সব কিছুই একদিনেই কীভাবে যেন সব ভুল হয়ে যায়। যে যেভাবে পারে, আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করতে থাকে। আপুর কাছে, চাচুদের কাছে ফোনে নালিশ চলে যায়। আমি সারারাত জেগে থাকি আর সকালে নাস্তা বানাই না, সারারাত আমার রুমের লাইটের আলোয় তাদের ঘুম হয় না, আরও হাজার হাজার অভিযোগ তখন উঠে আসে। আর সেই সাথে অবধারিতভাবে এটাও উঠে আসে যে এই কারণেই আমি সংসার করতে চাই না। আমি নাকি এজন্যই বিয়ে করতে চাইছি না, ওসব পড়াশোনা-টোনা সব মিথ্যে অজুহাত। আর তারপর তারাও একে একে আমাকে ফোন করতে থাকে আমার বেয়াদবির হালহকিকত শোনার জন্য, আমি বাবা-মার যত্ন কেন নিচ্ছি না, আমি সারাদিন কী ছাইপাঁশ নিয়ে নিজের রুমে পড়ে থাকি, আমি কারও সাথে ভালো করে কথা বলি না, এরকম হাজারো মুখস্থকথাবার্তা চলতেই থাকে। আমি ওদের কথা শুনে ভাবতে থাকি, আমি তাদের যত্ন না করলে আর কে করে? আমার ভাই-বোন, চাচা, ফুপু কেউ তো বাবা-মাকে একবেলাও দেখে না, বরং অসুস্থ হলে ফোনে ফোনে খোঁজ নিয়ে দায়িত্ব শেষ করে দেয়। আবার অজুহাত দেখায়, আমরা আপনাদের দেখতে এলে তো বাড়তি কাজের চাপ পড়বে, মেয়েটা একা একা এত কাজ কীভাবে সামলাবে? তার থেকে বরং আপনারা আগে সুস্থ হন, তারপর আমরা এসে দেখে যাব।


কেন? এসে নিজেরা রান্না করে খেলে কী হয়? নিজের ভাইয়ের বাসাতেই রান্না করে খেতে ওদের এত সমস্যা! ইচ্ছা থাকলে তো একদিনের জন্য এসেও দেখে যাওয়া যায়, বাইরে একবেলা খেয়েও থাকা যায়, তাদের কারও তো টাকার সমস্যা নেই। আমি কি এসব বুঝি না কেন আসে না ওরা? কারণ এখানে এলে হাসপাতালে থাকতে হতে পারে। এখানে এলে বাবা-মা সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত যদি তারা যেতে না পারে, তাদের ঘাড়ে যদি বাড়তি দায়িত্ব পড়ে যায়! হা হা হা! তারা নিজেদের মনে করে বিশ্ববুদ্ধিমান, আর বাকিরা সবাই ঘাস খায়! আমি সবই বুঝি কেন ওরা আসে না। আমরা সব মনে আছে। মা যেদিন স্ট্রোক করলেন, আমি সেদিন ঢাকায় ছিলাম। যখন আমি মার অসুস্থতার খবর শুনি, তখন রাত ১১টা। আমি একা একটা মেয়ে কীভাবে অত রাতে যশোরে রওনা হই? আমার ফুপ্পির নিজের প্রাইভেটকার আছে, তিনি চাইলেই আমার ফুপাতো ভাইদের কাউকে দিয়ে গাড়িতে করে আমাকে তখনই যশোর পাঠিয়ে দিতে পারতেন, কারণ মাকে হাসপাতালে ভর্তি করানোর মতো বাসায় কেউ ছিল না। আমার আপু, ভাইয়া সবাই তখন যার যার সংসার নিয়ে ঢাকা থাকে। আমি বেকার, আমার কোনও কাজ নেই, তাই আমাকেই যেতে হবে। আমি যশোরে ছুটে গেলাম পরদিন ভোরেই, আমার আত্মীয়স্বজন কারও সাহায্য না নিয়েই।


আমার ছোট খালু কোনও রকমে মাকে হার্টফাউন্ডেশনে ভর্তি করিয়ে দিয়ে গেলেন, কিন্তু সারারাত আমার দুইটা বন্ধু ছাড়া আর কেউই ছিল না মার পাশে। আমার বাবা হাসপাতালের সামান্য আনুষ্ঠানিকতাগুলোও বোঝেন না। বাবা মাকে সম্পূর্ণ একা হাসপাতালে ফেলে রেখে বাসায় এসে ঘুমালেন। যদি রাতে ওষুধ লাগত, তা হলে কে কিনে এনে দিত মাকে? আমার দুই ডাক্তার বন্ধুর কাছে আমি আজও কৃতজ্ঞ। কই, আমাদের তো অনেক অনেক আত্মীয়, কেউ তো সেদিন এল না শুধু রাতটা মার কাছে থাকার জন্য! ওদের আমার চেনা হয়ে গেছে। আমার মনে আছে, আমি পরদিন ভোর ৬টায় একা একা বাসা থেকে বের হয়ে উত্তরা থেকে সাতটা-দশের বাসেই রওনা হই। ঢাকা থেকে সোজা হাসপাতালে আসি মা কী অবস্থায় আছে দেখার জন্য। এসে দেখি, মা নরমাল একটা বেডে কোনওরকমে ভর্তি হয়ে আছেন। মার মুখ বেঁকে গেছে। মাকে গতরাতেই আইসিইউতে ভর্তি করার প্রয়োজন ছিল, কিন্তু বাবা বসে আছেন আমি কখন আসব, তারপর যা করার আমিই করব। বাবার টাকার কোনও সমস্যা ছিল না, মনের সমস্যা ছিল। আইসিইউ’তে একদিনের শুধু বেডভাড়াই ছিল তিনহাজার টাকা, আর বাবা আমার ধমক না শোনা পর্যন্ত সেটা করার প্রয়োজন মনে করেননি, বরং সারারাত একটা অসুস্থ মানুষকে বাবা অযথাই কষ্ট দিয়েছেন, যদিও নিজে বাসায় আরামে ঘুমিয়ে ছিলেন।


আমার বন্ধুরা কিছুটা বলেছিল আমাকে, পুরোপুরি বলেনি, কেননা আমি ঢাকার বাইরে, আর চাইলেও সেই রাতে আসতে পারছি না বিধায় আমাকে ওরা দুশ্চিন্তায় ফেলতে চায়নি। ওরা কেবল বলেছিল, রাতটা এভাবে কাটানো যাবে, কিন্তু সকালে জরুরিভাবে আইসিইউতে না নিলে বড়ো কোনও সমস্যা হতে পারে। তারপর টানা পাঁচদিন আমি ঘুমাইনি একটুও। আইসিইউতে রোগীর সাথে সব সময় একজনকে থাকতে হয়, যখন তখন ওষুধ লাগতে পারে বা অন্য কিছু করতে হতে পারে, তাই। আমি গোসল করতেও বাসায় যেতে পারিনি। ওইদিন আমার আত্মীয়স্বজনের প্রকৃত চেহারা চেনা হয়ে গেছে। বিপদে না পড়লে কে আপন, কে পর, তা কোনওভাবেই জানা যায় না। আমি সারাজীবনই আমার সব আত্মীয়ের বিপদে সব সময় পাশে থেকেছি, সেদিন ওরকম কঠিন একটা মুহূর্তে কেউ আমার পাশে ছিল না। টানা পাঁচদিন ঘুমাতে না পেরে আমি পাগলের মতো হয়ে যাচ্ছিলাম। এদিকে এমন ক্রিটিক্যাল একটা পেশেন্ট একা রেখে যাওয়াও যায় না। একটা মানুষকেও পাশে পাইনি তখন, এমনকি আমার বাবাকেও না। আমি সারাজীবনই আমার বাবাকে শুধু মুখে মুখে ওস্তাদি করতে দেখেছি।


দিনটা ছিল ঈদের চার দিন আগের। আমি ঢাকায় শপিং করতে গিয়েছিলাম। ওই সময় আমার বন্ধুবান্ধব সবাই বাড়িতে চলে গিয়েছিল, যারা শহরে থাকলে হয়তো অন্তত চার-পাঁচ ঘণ্টা হলেও মার পাশে থাকতে পারত। এসব যখন আমার মনে পড়ে, তখন আমি কারও সঙ্গে মিষ্টি করে কথা বলতে আর পারি না, কারণ আমি জানি, আমার চেনা হয়ে গেছে কে কী করতে পারে, অথবা কেন করে। ওই কটা দিন আমার মামি ছাড়া আর কেউ একবেলার খাবার বাবাকে দেয়নি। আমি বাইরে খেয়ে ছিলাম। মাকে হাসপাতাল থেকে খাবার দিচ্ছিল। বাবা রোজার ভেতর নানুবাড়ি গিয়ে গিয়ে খেয়ে এসেছে, অথচ পাশেই আমার সেজোচাচার বাড়ি! তিনি কি পারেননি তাঁর আপন ভাইকে মাত্র কয়েকটা দিন ভাত খাওয়াতে! কেউ আমাকে একটা ফোন পর্যন্ত করেনি, যদি আমি ওদের আসতে বলি, কিংবা ওদের কাছ থেকে কোনও ধরনের হেল্প চেয়ে বসি, সে ভয়ে! বিপদে পড়লেই মানুষ চেনা যায়।


আমি কী করে ওদের সাথে মিষ্টিসুরে কথা বলব? আমি কী করে তাদের সাথে গল্প করব? তারা সারাক্ষণই আমার সামনে, আমার পেছনে আমাকে নিয়ে যা-তা বলে যাবে, তারপরও আমার কাছে মিষ্টি ব্যবহার তারা কী করে আশা করে? আমি তো তাদের সাথে খারাপ আচরণ করি না। আমি আমার মতো থাকি। আমার কারও সাথে মেলে না, আমি সবার থেকে দূরে থাকি। সবাইকে তাদের মতো চলতে দিই। আজকে ৫ মাস হয়ে গেল, আমার চাচু আমাদের বাসায় চলে এসেছেন ঢাকা থেকে। তিনি তাঁর পরিবারসহ নিচের তলায় থাকেন। আমার পক্ষে যতটুকু যখন সম্ভব, আমি তাঁর খোঁজ নিই। নিজে তাঁর বাসায় যেতে পারি না, কারণ আমার সারাদিন অনেক ধরনের কাজ থাকে, কাজ শেষ হলে তারপর আর আমার এদিক সেদিক যেতে ইচ্ছে হয় না। তা ছাড়া আমার সময়ও থাকে না দিনশেষে। রাতে আমি অনেকটা ঢুলতে ঢুলতে ঘুমাতে যাই। সে চাচুও এখানে আসার দু’মাসের মাথায় আমার অন্যান্য চাচা আর ফুপুদের জানিয়ে দিয়েছেন, আমি অনেক ভাব দেখাই, কারও সাথে কথা বলি না। এক সপ্তাহে একদিনও আমার চেহারা দেখা যায় না। আমি বইপত্র কিনে আমার সব টাকা নষ্ট করি, কিন্তু অন্য কাউকে কিছু দিই না!


খুবই অবাক হয়েছি এগুলো শুনে। সে চাচু কিন্তু অনার্স-মাস্টার্স পাসকরা শিক্ষিত মানুষ। আমাকে দোষ দেওয়ার কিছুই না পেয়ে অবশেষে আমার বইপত্রের পেছনেই সবার চোখ আটকাল! আমার আর কী করার আছে, আমি সত্যিই জানি না। তারপর তাঁরা দুই ভাই একসাথে বসে আমার বদনাম শুরু করে দেয়, আমি সারাক্ষণ রুমের ভেতর থাকি, আর আল্লাহ্‌মাবুদ জানেন, আমি এত পড়াশোনা দিয়ে কী করব! এই তো কিছুদিন আগে আমার বাবার এক মামি গ্রাম থেকে আমাদের বাসায় এসেছেন ডাক্তার দেখাতে। এসব গ্রামের মানুষ যেমন হয় আরকি…একে তো ডাক্তার দেখাতে আসেন, তার উপর আসেন একগাদা কুটনামি করতে। তিনি বাবার কাছে শোকপ্রকাশ করতে শুরু করে দিলেন---আহারে, তোমার মেয়েটার জীবনটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে! মেয়েটা কী এক সমস্যায় পড়ে গেল! বয়স হয়ে যাচ্ছে, এখন কোন ছেলে তাকে বিয়ে করবে? তো কী সমস্যা? মেয়ের বিয়ে দাও না কেন? এত পড়াশোনার কী দরকার? মেয়ের কোনও সমস্যা? আমাকে খুলে বলো, আমি তো আর তোমার পর না।


এদিকে বাবাও অমনি শুরু করে দিলেন---আরে মামি, আজকালকার দিনের মেয়ে, এজন্যই এই অবস্থা! নামাজ-রোজা করে না। বেশি শিক্ষিত হয়ে গেছে, এজন্য সংসার করতে চায় না, নিজেই ভাব দেখিয়ে গোঁয়ার্তুমি করে পড়াশোনার দোহাই দেয় আর বিয়ে করে না। আমার সেদিন ভীষণ কষ্ট লেগেছিল। আমি যাদের এত ভালোবাসি, সব সময় যাদের যত্নে রাখি, সব সময় যাদের সব কিছু সহ্য করে যাই, নিজের জন্য কিছু ভাবি না কখনও, তাদের কাছে এসব আশা করিনি। বাবার ভাবটা এমন যে আমাকে বিয়ে দিলে আমার স্বামী আর ওঁর পরিবার আমার বাবা-মায়ের সব কিছুর দেখাশোনা করবেন! বাবার এই মামি যিনি কিনা সারাজীবনেও এই বাসায় কোনও দিন গ্রাম থেকে একটা সূতাও হাতে করে নিয়ে আসেন নাই, উল্টা ভাড়ার টাকাটা পর্যন্ত বাবার কাছে থেকে নিয়ে তারপর বাড়ি ফিরবেন, এরাই বোধহয় আমার বাবা-মায়ের প্রকৃত শুভাকাঙ্ক্ষী, এরাই বোধহয় সব সময় পাশে থাকবে, থাকে, আগেও যেমন থেকেছে! আমি কখনও কিছু বলি না কাউকে, চুপ করে সব দেখে যাই। আমি কি আর বুঝি না, এরা কেন বাবাকে হুজুর হুজুর করে! না করলে বছরে বছরে এত টাকার যাকাত কে দেবে তা হলে! আর এরাই যে এভাবে করে করে আমার বাবা-মার ভেতরে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে আমার মায়ের সংসারটা নষ্ট করেছে, এটাও আমি জানি।


এদের মতো মানুষরা সব সময় এসব সুযোগেই থাকে। আজ আমার বাবা কিংবা মা অসুস্থ হলে এদের কেউ ফিরেও তাকাবে না! আর আমার বাবা মনে করেন, আহারে, কী ভালো মানুষ এরা, আমার মনের সব কষ্ট বুঝে! আমার মা চালাকচতুর মহিলা হলে কবে এইসব বাজে লোকজনকে ঝাঁটা মেরে বিদায় করতেন! যারা টাকা খেয়ে পিরিত দেখায়, ওসব লোককে আমার ভালোভাবে জানা আছে। ওরা ধান্দায় থাকেই কীভাবে বাড়তি কিছু টাকা আদায় করা যায়। যত তেল, তত টাকা। আর আমার বাপের যাবতীয় হাদিস শোনার জন্যও তো কাউকে লাগবে। তিনি যে ঘরের মানুষকে সারাক্ষণ হাদিস শুনিয়েও কিছুই বদলাতে পারছেন না, এইসব দুঃখের কথা আর কে শুনবে! আর যে সমস্ত হুজুরের ওয়াজ শুনতে থাকেন সারাদিন, ওরাও তো সব একটা একটা বদ্ধপাগল। মাইক সামনে পেলেই এত ভুলভাল কথাবার্তা বলে বলে ধর্মকে বিকৃত করে করে চিৎকার করতে থাকে এমনভাবে যে, পৃথিবীর সবাই ঘোর পাপে আর অনাচারে লিপ্ত আর তিনিই একমাত্র সাধুপুরুষ। আর নারীরা এই পৃথিবীতে এসেছেই কেবল পুরুষের পা চাটতে, আর পুরুষের কথামতো উঠতে আর বসতে। আর এখনকার দিনে কোথাও কোনও ভালো নারী নাই। সব বেহায়ার দল। আর এই বেহায়া মেয়েগুলোকে আল্লাহ্‌ ঝাঁটা মেরে মেরে নিশ্চয়ই জাহান্নামে ছুড়ে ফেলবেন। এই বেহায়াগুলোর জন্যই হুজুরদের ঈমান সব নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।


আমার বাবা এমন বয়ান সারাদিন শুনতে থাকেন আর রক্ত গরম করে করে বাসায় হুংকার চালাতেই থাকেন। তিনি যে বাসার বাকি সদস্যদের উপর অত্যাচার করছেন, এটা তাঁর এ জীবনে কোনও দিনই মাথায় আসবে না। ভোর সাড়ে তিনটার থেকে উঠে ঠুসঠাস আওয়াজ করে সবার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটিয়ে নামাজে যান। ভোর ছয়টায় বাজারে চায়ের দোকানে আড্ডা দিয়ে বাসায় এসে আর এক দফা অত্যাচার শুরু করেন। হয় ওয়াজ শুনবেন, নয়তো ইচ্ছা করে করে বিকট আওয়াজে কোরানশরিফ পড়বেন। মাঝে মাঝে ওই আওয়াজটা এতই বিরক্ত লাগতে থাকে যে মনে হয়, নিজের মাথাটাই কেটে ফেলে দিই! বাবা এটা কিন্তু বুঝেশুনেই ইচ্ছা করে প্রতিদিন করেন। মাঝে মাঝে মনে হয়, কী এক উদ্ভট জায়গায় উদ্ভট কিছু মানুষের মাঝে এসে যে পড়লাম! এটা নিয়ে বাসার কেউ কিছু বলতে পারে না, বললেই বাবার হুংকার আবারও শুরু হয়ে যায়।


আমার আর কিছুই ভালো লাগে না! জীবনটা একেবারে ফালতু কিছু একটা কিছু মনে হয়। ইচ্ছে হয়, এর চেয়ে বরং বনেজঙ্গলে গিয়ে পড়ে থাকি, জীবনে আর কিছুরই দরকার নেই। সব কিছুই, মনে হচ্ছে, তলিয়ে যাচ্ছে। না পড়তে পারি, না লিখতে পারি। দরজা বন্ধ করে পড়তে বসলেই বাবা আমার রুমের চারপাশ দিয়ে হাঁটতে থাকবেন, আর নীতিবাক্য ছাড়তে থাকবেন---পৃথিবীসুদ্ধ মানুষ এখন এক আল্লাহ্‌কে ডাকছেন, অথচ আমার এখনও হুঁশ হলো না! আমি সারাদিন বইপত্র নিয়ে পড়ে থাকি কেন? বাবা এটা কখনও মাথায় রাখেন না যে তাঁর মেয়েটা তাঁর সামনেই নামাজ আদায় করেছে, এরপর সে একটু পড়তে বসেছে, তার সামনে পরীক্ষা। মেয়েটাকে একটু পর নাস্তা বানানোর জন্য রান্নাঘরে ছুটতে হবে। এইসব বাবার মাথায় কখনও আসেই না। আমার সত্যিই মনে হয়, আমি ভীষণ ভুল একটা জায়গায় এসে পড়ে গেছি। আমার এখানে জন্মানো কিছুতেই উচিত হয়নি, এবং যদি সুস্থ থাকতে চাই, যদি পাগল হতে না চাই, তবে দ্রুতই আমার এখান থেকে সরে যেতে হবে। আমি আর কিচ্ছু নিতে পারি না এসব। আমার মাথাটা ভনভন করতেই থাকে এসবের মধ্যে সব সময়ই। কী করে কীভাবে এই অসুস্থ পরিবেশে নিজের পড়ালেখাটা অন্তত চালিয়ে যাব, এটাই এখন আমার কাছে সবচেয়ে বড়ো পরীক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছে।


হয়তোবা, আমার ভেতরেই আসলে সমস্যা আছে। আমি কারও সাথে মানিয়ে চলতে পারি না। হ্যাঁ, আমিই খারাপ, মানিয়ে চলতে আমি আর চাইও না। আমি আমার মতো থাকি, আর ওরা ওদের মতো থাকুক। নিজেও ভালো থাকি। ওরাও ভালো থাকুক।