ভুলতে ব্যর্থ হবার পর

আমি কাউকে কখনও দোষ দিই না কেন, জানো?
কেননা আমার জানা আছে, সময় আমার সাথে নেই।
সময় আজ চলেছে অন্য স্রোত ধরে,
আমিই কেবল স্রোতের বিপরীতে হাঁটছি অবিরাম একলা একা।
হ্যাঁ, দিন আমার কাটে বিষণ্ণতাতেই,
রাতের আঁধার যখন গাঢ় হয়ে আসে,
তখন আমার নিঃশ্বাসের প্রতিটি শব্দ ভারী হতে থাকে।


আমি জানি, আমি কারও কাছেই নই গুরুত্বপূর্ণ কেউ,
কেবলই নিছক প্রয়োজন এক!
আমার বাসায় কাজের লোকের অভাব,
আমাকে দিয়ে ঘরের কাজ হয়ও ভালো,
এ কারণেই ওরা আমাকে আদরে রাখে,
কখনও কখনও হয়তোবা নেয় সহ্য করেও!
কী আর করার, প্রয়োজন যে!


যখন তোমার ঘরের মানুষটি ছিল না কাছে,
তখন তোমারও বেশ প্রয়োজন ছিল অমন কাউকে,
সামনে আমি তৈরিই ছিলাম, তাই প্রয়োজনে,
নিতান্তই খেলার ছলে আমাকে তোমার খেলনা বানালে,
আমিও হঠাৎ সিংহাসনটা পেয়েই ভাবলাম, সব পেয়েছি,
এক আমিই বুঝি তার সবই হলাম!


আমি এমনই বোকা, জানো?
ওহ্‌, জানতে বলেই তো টেনেছিলে, না?
বোকার মতো আমিও নিজেকে ভাসিয়ে নিয়েছি স্রোতের সাথে!
আচ্ছা, আমার ভালোবাসার বায়নাগুলো ছুড়ে কোথায় ফেলেছিলে সেদিন,
যেদিন তোমার ঘরের মানুষ ফিরে এল?
আমার কথার ঝুড়ি যত, ওরা বুকের কোন পাশে ঠিক লুকিয়েছিলে?


আমিও এখন নিয়েছি শিখে, জানো?
কেবল বোকার মতো ভালোবাসলেই হয় না,
নিয়ম করে নিজের চারপাশে প্রলেপটুকুও লাগাতে হয়,
এমনকি ভালোবাসার মানুষটিও যেন আমাকে আঘাত করতে না পারে,
তেমন করে প্রলেপ জড়াতেই হয় নিজের চারপাশে।


জানো, এখন আর রাত হলেই বারে বারে তোমার ফোনের অপেক্ষায় ঘড়ির কাঁটা গুনি না!
সে সময় কি আর আছে এখন?
আমার মতো বাজে বিরক্তিকর একটা মেয়েকে তুমি এতদিন সহ্য করে ছিলে,
অভিনয় করে হলেও ভালোবেসে গেছ,
ভালোবাসা দিয়েও গেছ…এ-ই তো কত!
এখন আমি আবার সেই পথের ভিখিরি, তাই থেকেছি এসে পথের বাঁকেই!


আমার জায়গাটা আসলে এখানেই,
ভালো তো আর সইবে না কপালে,
ভালো আমি রাখতে জানিও না।
আসলে তুমিই ঠিক বলেছিলে,
যদি এমন করি, তবে কেন আশা করি,
কারও সাথে সম্পর্কে জড়াতে পারব আদৌ!
ওরা পারবে, ওরা পারে সবাই, শুধু পারি না আমিই।
আমার ভেতরে মেকি কোনও কিছুই ছিল না কখনও,
নিখাদ ভালোবাসা ছিল শুধু, তাই আমি পারিনি বোঝাতে!
আসলে ভালোবাসা যে ভালোবাসাই শুধু, তা জানতে বড্ড দেরি হয়ে গেছে,
সব ভালোবাসাই ভালোবাসা,
ওদের মতো হতে পারলে থাকত আমার একাধিকও!


জেনো, যাদের থাকে একাধিক,
তাদেরই কেবল কাউকেই প্রয়োজন পড়ে না,
তাদের কাছে সব ভালোবাসাই তথাকথিত প্রেম,
ওটা করে করে ওরা তাই পারে ধরে রাখতে!
আর এদিকে আমি একটা নিয়েই বড়ো ভালো থাকি,
আমার যে ভালোবাসার জায়গা একটাই আছে,
আমি আর কোথায় যাব?
কোন আকাশে মুখ লুকোবো কান্না পেলে?
কোন বুকে গিয়ে শান্তিসুখের ঘর খুঁজব কূল হারালে?
আমার সেই আকাশটাই যে হারিয়ে গেছে,
আমার লুকোবার সেই ঘরটা আজ অন্য কারও,
হয়তো তা ছিলই না আমার কখনও!


আমাকে কষ্ট দাও,
আমাকে দগ্ধ করো, পুড়িয়ে মারো যত খুশি,
কে হারাবে?
আমি, না কি তুমি?
আচ্ছা, যাও তবে উঠোনের ওপারে,
আমিও দেখি, তোমার মেকি ভালোবাসার জোর কতটা দূরে নেয় তোমাকে!
আমার ভালোবাসার প্রতি এতটুকু আস্থা আমার আছে---
ফিরে তোমাকে আসতেই হবে!
তোমাকে আসতেই হবে আমার কাছে,
আমিই তোমার একটি মাত্র ঘর, এ তুমি সময় হলে বুঝবে ঠিকই!


হয়তো এখন সে সময়ই নয়!
তুমি কি আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছ?
আমাকে পিষে ফেলতে চাইছ তুমি?
দেখতে চাইছ, আমি মরে যাই কি না?
না কি আমার বোবাকান্নায় মনকে সান্ত্বনা দিচ্ছ?
তোমারও তো আসবে সময় আমার কাছে ফেরার!
নাহয় আমি ততদিন সয়েই যাব এই বোবাকান্না!
নাহয় ততদিন খোলা আকাশের নিচে বাতাসের সাথে ভেসে যাব ঠায়!
নাহয় এবেলা আমার ঘর ঘুটঘুটে আঁধারে ছেয়ে যাবে খুব!


হোক না যা হবার!
আমি তো পুরনো ভিখিরি,
কষ্টের আর আছে কি কিছু বাকি?
এ আর নতুন কী, বলো?
বরং তুমি একটু সুখ কুড়িয়ে নাও এবেলা,
একটা দিন যায় এমনও, যেদিন সব কিছু তুচ্ছ হয়ে আসে,
আমি নাহয় তোমার কাছে তুচ্ছতাচ্ছিল্যের উপলক্ষ্য কিছু,
আমি নাহয় তোমার অবহেলার একটিই মাত্র ঘর,
আমি না হয় তোমার সবচেয়ে কাছের পর!


আজ আমার নতুন করে জন্ম হলো,
আমার যে পুরনো ‘আমি’টা ছিল, সে পুড়ে গেছে, ঝরে গেছে।
তোমার আগমনে আমার সেই যে সকালবেলার ‘আমি’ ছিল এক,
আজ সেটির মৃত্যু ঘটেছে!
এই দুয়ার খুলে যখন তোমার হাওয়া লাগল গায়ে,
হিমেল সেই হাওয়ায় ভেসেছি, সাথে গায়ে তোমার গন্ধ মেখেছি,
শ্বাসও নিয়েছি তোমার শ্বাসের দামে,
সেদিন থেকেই আমার পুরনো ‘আমি’র মৃত্যু হতে শুরু হয়েছিল,
বুঝিনি তখনও, এই যে আমি আছি,
এই যে আমি ভালোবাসার প্রতি এত বীতশ্রদ্ধ,
এই যে আমি ভালোবাসাকে ছুড়ে ফেলে দিই দূর থেকে দূরে, সীমান্তের শেষপ্রান্তে,
সেই ‘আমি’টাই আজ ভালোবাসার জালে কঠিনভাবে আটকে যাবে?


মূর্খ বলো কে আর আছে আমার মতো?
নিজের যে এক পরাধীন জীবন আনলাম ডেকে নিজে নিজেই, আমি তা বুঝতেই পারিনি তখন!
মানুষ যখন স্বাধীন থাকে, হয়তো সে তখন বোঝেই না যে, সে পুঁটিমাছের প্রাণ কেবলই!
মিথ্যে বলছি?
বানিয়ে বললাম, মনে হলো তা-ই?
আচ্ছা, তুমিই বলো তো তবে?
ভালোবাসতাম আগে ধূসর রঙ, আজ ভালোবাসি টকটকে লাল,
আগে রাতে জলদি ঘুমোবার তাড়া ছিল, আজ অথচ,
রাতের শেষ তারাটিও ঘুমিয়ে পড়ে, আর ঘুম নেই আমার এই দু-চোখের তারায়!


আগে শুলেই চোখে রাজ্যের ঘুম এসেই যেত, আর আজ
বিছানায় গেলে এপাশ-ওপাশ করতেই কেটে যায় হাজারো মুহূর্তেরা!
আগে কবিতা ভালোবাসতাম, কিন্তু এখন নিজেই কবিতা লিখি,
কী যে লিখি ছাইপাঁশ, সে এক তুমিই জানো আমার থেকে বেশি,
তবু লিখতে যে তোমাকেই বসি!
আগে ভীষণ অ্যালার্জি ছিল নিজেকে আয়নায় দেখবার বেলায়,
অথচ তুমি এলে, আর সেই থেকে শুরু আয়না দেখাও!
আগে ভাবতাম, ভালোবাসা বলে হয় না কিছুই, ওসব সবই বাজে কথা,
অথচ আজ ভালোবাসার প্রতিটি অনুভূতি মিশে আছে যেন আমার রক্তের সাথেই!


তোমাকে আর কী দিয়ে বোঝাই, কতটা আমার মরণ হয়েছে?
এক জন মানুষের এত ভুলোমন, তার মনে থাকেই না কিছুই,
এই তো সেদিন, বাজারে চায়ের গুঁড়ো কিনতে গিয়ে
রাজ্যের সবই আনলাম কিনে, অথচ ওই এক চায়ের গুঁড়ো বাদে!
আরেক দিন তোমার সাথে অভিমানের খেলায়, দুধ পুড়িয়ে ফেললাম কিছু গ্যাসের চুলোয়!
বকুনি আর কথার শ্রাদ্ধ, সে তো আগেও গেছে আমার উপর,
তবুও আজ যেন কেবল তোমার কথাই মনে করে ঘুরঘুর,
আশেপাশে কে বকছে, গালিটা দিচ্ছে যে কে,
কিংবা কেউ কিছু মেরেই দিল কি না নিজের,
কিছুই যে আর মনে থাকে না!


কান শোনে সব কথাই, কিন্তু কোনও কথাই আর পৌঁছায় না মনে,
এতশত ভুল ভুলে যাই রোজ,
নিজেকেও যে নানানভাবে ভুলিই ভুলি,
এত যে ভোলার রোগে পেল, অথচ
কই, তোমাকে তো ভুলতে পারলাম না আজও?
তবে আর একি নয় মনের দোষই?
একে কি ভোলা-রোগ বলে?
সব কিছুই তো যাচ্ছি ভুলে,
তবে কেন তোমাকে ভুলতে গেলেই রাজ্যের যত ভূত এসে ভর করে মনে?