মধ্যবিত্ত

 
দরোজার ওপাশ হতে ঝাঁঝালো কণ্ঠটা শুনতে পেলাম।
'বললামই তো, আমাদের কিচ্ছু লাগবে না। চাল, ডাল, তেল, নুন...কিছুই লাগবে না! আপনারা কেন এসেছেন এখানে? চলে যান, চলে যান! আমরা ভিখারি নাকি? যান এখান থেকে।'
চাচা দরোজা খুললেন না। খোলার কথা ছিলও না। আগেই জানতাম।


আহা মধ্যবিত্ত! আহা মধ্যবিত্ত!
না খেয়ে মরতেও রাজি, তা-ও হাত পাতবে না।
চুলোয় হাঁড়ি চড়ে না, ঘরে চাল নেই, পকেটে পয়সা নেই,
তবু আত্মসম্মানটুকু সসম্মানে অক্ষত!
ছেলেমেয়ে, পঙ্গু স্ত্রী খেয়ে না খেয়ে আছে, কিংবা আধপেটা খেয়েছিল…ওই বেলায়।
তা-ও ওরা আমাদের দরোজার বাইরেই রেখে দেয়...
ওরা আমাদের দরোজার বাইরে রেখে দিতেই অভ্যস্ত!


ছেলেটা দোকানে যেতে পারছে না,
মেয়েটার টিউশনি বন্ধ।
ওরা কেউ বেতন পায়নি।
চাচা অসুস্থ, ঘরে বসে থাকেন, আর আত্মসম্মানবোধে তা দিতে থাকেন!
মানুষ হয়ে মানুষের দিকে সবাই তো আর তাকায় না,
...কাজ না পেলেও বেতন দেয়, এমন মানুষ কটাই-বা আছে?
চাচার ছেলেমেয়ে বেতন পায়নি, পেয়েছে শুধুই---ব্যর্থবাবার অথর্ব আত্মসম্মানবোধটুকু!
অথচ, সে-ঘরেরই কাজের বুয়াকে একমাসের অগ্রিম বেতন,
সাথে কিছু বাড়তি টাকা দিয়ে ছুটি দেওয়া হয়েছে!


ওরা ঘরে বন্দি, ওদের এখন ছুটি।
খিদের কোনও ছুটি হয় না, পেটের কোনও লকডাউন হয় না।
এ জগতে আত্মসম্মানবোধের কোনও সাময়িকবিরতি হয় না,---
যে শালার নেই তো নেই-ই,
আর যে শালার আছে তার চিতার আগুনও আত্মসম্মানের কাঠে জ্বলতে থাকে!
কোভিড-নাইনটিন কেন যে মধ্যবিত্তের এই সেলফরেসপেক্টটাকে খেয়ে নিতে পারল না এখনও অবধি,
তার উত্তর খুঁজতে হলে পৃথিবীর ইতিহাস খুঁজতে হবে, জীবনের ইতিবৃত্ত জানতে হবে।


ওদের, আগের মতো, অন্তত একবেলা হলেও পেটপুরে ভাত খেতে ইচ্ছে করছে।
একবাটি ডাল, অর্ধেক ডিমভাজি, একটু সবজি। ওইটুকু হলেও চলবে।
অথচ এই রাক্ষুসে খিদের ঘরে তিনটি হাজার টাকাও নেই!


বাড়িওয়ালা বাড়িভাড়া মাফ করে দিয়েছেন বলে চাচার মুখ থেকে তাঁকেও কথা শুনতে হয়েছে,...আরে ভাইসাহেব, আপনি চলবেন কী করে এইমাসে? ভাড়াটা নিন, আমার সমস্যা হবে না।
বাড়িওয়ালা চোখ মুছে, হাতজোড় করে হেসে বলেছিলেন,…ভাইসাহেব, টাকাটা নেবো তো, একটু পরেই নাহয় নিই?
...বলেই দ্রুত চলে গিয়েছিলেন, পেছনের এই কথাগুলিকে উপেক্ষা করেই---'আশ্চর্য! কেন নেবেন না? কেন নেবেন না, ভাইসাহেব?'
আমাদের এই চাচাটি বাড়িওয়ালার চলে-যাওয়ার দিকে নির্বাকদৃষ্টিতে ঠায় তাকিয়ে ছিলেন।...আহা জীবন! আহা জীবন!


সেদিন আমি চাচার কণ্ঠস্বরে আমার বাবার কণ্ঠটা শুনতে পেয়েছিলাম।
আমি জানি, এমন কণ্ঠস্বরে কথা বলতে গেলে কতটা কান্না গিলে খেয়ে ফেলতে হয় অসহায় চোখে।
আমি চাচার তরুণ ছেলের মধ্যে প্রাক্তন নিজেকে আবিষ্কার করেছিলাম,
আর মেয়েটির মধ্যে নিজের আদরের ছোটবোনটিকে।
এই মানুষগুলি ক্ষুধাকেও চিবিয়ে খেয়ে নেয় হাসিমুখে,
তবু কারও ত্রাণ খায় না, নিজের মান খায় না।
ওদের জন্মই হয়েছে মাথাটা উঁচু করে বাঁচার জন্য...আমৃত্যুই!


মনে হচ্ছিল, আমার বাবা আমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছেন ঘরের দরোজা থেকে....
ফিরে এলাম। ফেরার আগে, একপৃথিবী ঐশ্বর্যের সেই মহামণ্ডপে রেখে এলাম তুচ্ছ কিছু নৈবেদ্য!
বাবার পায়ের কাছে এক সন্তানের অতিসামান্য কিছু উপচার!


ঈশ্বরের সাথে ঝগড়াঝাঁটি করেও তো একটা জীবন দিব্যি কেটে যায়!
মনে হলো, এই পৃথিবীর এই নিভৃত কোণে, চিরকালের এই ঝগড়া…
নাহয় আরও একটু বাড়বে!
বাড়ুক না। পরোয়া কীসের! চাচাও ঝগড়া করতে জানেন, জানি আমিও---
আমি যে সেই মধ্যবিত্ত চাচারই সন্তান!