মহালয়া(২০১৯)

(এই লেখা যতটা না ‘মহালয়া’ মুভিটির রিভিউ, তার চেয়ে বেশি ইতিহাসকথন। ব্যস্ততা থাকলে কিংবা ইতিহাসের প্রতি অনুরাগ না থাকলে এই লেখা অনুগ্রহ করে এড়িয়ে যান, সবিনয়ে বলছি। তবুও যদি অল্প কথায় পড়তে ইচ্ছে করে, তবে শেষের ‘মহালয়া। বাঙালির রক্তের মধ্যে যদি………’ অংশটি থেকে পড়তে পারেন।)

কুন্দনলাল সায়গল, কিশোরকুমার যাঁকে গুরু মানতেন, তাঁকে দিয়ে প্রথম বাংলা গান গাওয়ানোর কৃতিত্ব পঙ্কজকুমার মল্লিকের। পরিচালক নীতিন বসু ও সঙ্গীত পরিচালক পঙ্কজ মল্লিকের ‘জীবন মরণ’ ছবিতে সায়গলের গলায় একটি রবীন্দ্রসংগীত ছিল—‘তোমার বীণায় গান ছিল……’। সঠিকভাবে গাওয়া হয়েছে কি না, তা জানার জন্যে এই গানটি রেকর্ডে রবীন্দ্রনাথকে শুনিয়েছিলেন পঙ্কজ মল্লিক। একবার শুনেই গানের দ্বিতীয় অন্তরাটি আরও কয়েকবার শুনতে চাইলেন কবি। এই অংশের প্রথম লাইনে আছে ‘গান তবু তো গেল ভেসে, ফুল ফুরালো দিনের শেষে,’। শুনে কবি শুধালেন, ‘‘ফুল ফুরালো দিনের শেষে, এ কেমন করে সম্ভব?’’ হতবাক পঙ্কজ মল্লিক তক্ষুনি গানের বই খুলে কবিকে দেখালেন, সেখানে ‘ফুল ফুরালো দিনের শেষে’ই ছাপা আছে। পরের লাইনে ‘ফাগুনবেলার মধুর খেলায় কোন্‌খানে হায় ভুল ছিল গো॥’ এবার যা হল, তা পড়া যাক পঙ্কজ মল্লিকের বয়ানে: “কবি তখন যেন একটু দূরের দিকে দৃষ্টি মেলে দিয়ে উদাস বিষণ্ণ সুরে বললেন— কী করে এটা হল জানি না, কিন্তু ওটা তো ‘সুর ফুরালো দিনের শেষে’ হওয়াই উচিত ছিল।” তখন ছবি ও রেকর্ডিং-এর কাজ শেষ হয়ে গেছে, কোনও কিছু পাল্টানোর আর কোনও উপায় নেই। অগত্যা, রবীন্দ্রনাথ তাঁর অনুমোদন দিয়ে দিলেন। “তবু ওই শব্দটি নিয়ে তাঁর বিষণ্ণতা রয়েই গেল।” ‘জীবন মরণ’ ছবিতে ‘গান তবু তো গেল ভেসে, ফুল ফুরালো দিনের শেষে’ গাইলেন সায়গল। আগ্রহীরা গানটা ইউটিউবে শুনে নিতে পারেন, গীতবিতান-স্বরবিতানেও তা-ই আছে। একথা তো সত্যি, ‘গান তবু তো গেল ভেসে’-এর পরে ‘সুর ফুরালো দিনের শেষে’-ই যথাযথ। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এ নিয়ে প্রশ্ন তুললেও, কেন তা অপরিবর্তিত থেকে গেল, তা নিয়ে পঙ্কজ মল্লিক তাঁর ‘আমার যুগ আমার গান’ বইয়ে লিখছেন, “আমার মনে একটা প্রশ্ন আজও থেকে গেছে। গীতবিতানে এখনো পর্যন্ত ওই ‘ফুল ফুরালো’ কথাটি অপরিবর্তিতই থেকে গেছে। কবি কি তাহলে বিস্ময় প্রকাশ করার পরও এর পরিবর্তন করেননি? পরে এই গানটি আমি স্বকণ্ঠেও রেকর্ড করেছি এবং গীতবিতানে যেমন ছাপা আছে, তেমনই গেয়েছি। কবির সেদিনকার বিস্ময় ও বেদনার তাৎপর্য আমি আজও সম্যকভাবে বুঝে উঠতে পারিনি।”

আরও আগের কথা। ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে বঙ্গবাসী কলেজে ঢুকেছেন পঙ্কজ। পাশাপাশি গানের চর্চাও চলছে। দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের গানের ইস্কুলে। এক রবিবারের দুপুরে দুর্গাবাবুর বাড়িতে গিয়ে একলা বসে ছিলেন তক্তপোশে। গুরুমশাই বাড়ি নেই। চোখে পড়ল বিছানায় রাখা রবীন্দ্রনাথের কবিতা সঙ্কলন ‘চয়নিকা’। পাতা উল্টোতে গিয়ে চোখ আটকে গেল ‘চির আমি’ কবিতায়—’যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে……’ শব্দের অপূর্ব সে মিছিলে যেন হারিয়ে গেলেন তিনি। বেশ খানিকক্ষণ অসাড় শরীর নিয়ে স্তব্ধ হয়ে থাকার পর গুনগুন করে কবিতাটিতে সুর বসাতে লাগলেন। হঠাৎ করে আবিষ্কার করলেন, বেশ লাগছে! উত্তেজনায় ছিটকে বেরিয়ে পড়লেন দুর্গাবাবুর মদন বড়াল লেনের বাড়ি ছেড়ে। পাশেই গণেশ পার্ক। নিঝুম দুপুর। গাছের ছায়ায় বেঞ্চিতে বসে বাকি অংশেরও সুর দিয়ে ফেলেলেন। এরপর আর তর সইছে না। যন্ত্রে ফেলে সুরের শরীর তাঁকে দেখতেই হবে। এবং এখনই। একটু দূরেই ছিল ফকির দে লেনে সখের নাট্যদল ‘আনন্দ পরিষদ’-এর ঘর। সেটির কর্তা লক্ষ্মীনারায়ণ মিত্র। পঙ্কজের লক্ষ্মীদা। লক্ষ্মীদার অর্গান আছে। ছুটলেন সেখানে। গুটিকয় লোক বসে। তাঁদের পাশ কাটিয়ে সোজা বসে গেলেন অর্গানে। রিড-এ হাত বুলিয়ে সুর গড়তেগড়তে কেমন যেন দাউদাউ দাবানল লেগে গেল অন্তরাত্মায়! হঠাৎ পিছন থেকে কার গলা! চমকে তাকিয়ে দেখেন, লক্ষ্মীদা।

“সুরটা মোটামুটি ঠিকই হচ্ছিল, দু-একটা জায়গা বাদ দিয়ে।”

পঙ্কজ শুনে অবাক। মানে কী? এ সুর তো তাঁরই দেওয়া, তার ভুল-ঠিক লক্ষ্মীদা বুঝবেন কী করে? এর ঠিক পরে লক্ষ্মীদার কথাতেই বুঝলেন, তিনি যে সুরের কথা বলছেন সেটি রবীন্দ্রনাথের দেওয়া। সেটির সঙ্গে প্রায় হুবহু মিলে গেছে এই সুর! এই অত্যাশ্চর্য সমাপতন পঙ্কজের নাভিমূল থেকে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিল সেদিন! ভাবা যায়!

কলেজে পড়ার সময় আর একটি রবীন্দ্রকবিতা পেলেন: ‘শেষ খেয়া’—‘দিনের শেষে ঘুমের দেশে ঘোমটা-পরা ওই ছায়া……’ সুর বসিয়ে ফেললেন তাতেও। যেখানেসেখানে সেই গান গেয়েও বেড়াতে লাগলেন। একবারের জন্যও ভাবেননি এজন্য অন্তত কবির অনুমতি নেয়া লাগে। গোল বাধল তাতেই। জোড়াসাঁকো থেকে রবিপুত্রের কড়া চিঠি এলো। দিনক্ষণ জানিয়ে লিখেছেন, রবীন্দ্রনাথ পঙ্কজের সাথে স্বয়ং দেখা করতে চান। একদিকে উত্তেজনা, তাঁর ঈশ্বরদর্শন হবে বলে! অন্যদিকে শঙ্কা! না জানি কী হয়! মনকে বোঝালেন, “প্রহার করলেও আমি তা আমার অঙ্গের ভূষণ করে নিয়ে ফিরে আসব। তবে আসার আগে কেবল তাঁর কমলচরণে দুটি চোখের অশ্রুতে সিক্ত করে সব অপরাধ স্বীকার করে নেব।” (বড়ো মানুষের প্রতি এতটা অনুরক্তি যাঁর বিশ্বাসে ও মননে, তিনিই তো ভাবিকালে বড়ো মানুষ হবেন, এমনই হয়ে আসছে। গ্রেট হতে চাইলে গ্রেটনেসের প্রতি এমন অন্ধ ও বিনীত মনোভাব থাকা চাই।)

জোড়াসাঁকো। কবির ঘর।

রথীন্দ্রনাথ গম্ভীর মুখে বসে। ঘরের এক পাশে একটা নিচু সুদৃশ্য তক্তপোশ। তার ওপরেই বসে কবি। লিখছেন। মাঝেমধ্যে কী যেন আওড়াচ্ছেন! তাঁর সামনে রাখা বই, কাগজপত্র। কালি, কলম, নানান রঙের পেন্সিল। অন্য পাশে বিশাল হ্যামিল্টন-অর্গান। রথীন্দ্রনাথ চোখের ইশারায় অর্গানটি দেখিয়ে দিয়ে গান গাইতে বললেন। ভয়ে পঙ্কজের শরীর তখন ঘামে ভিজে উঠছে। কাঁপাকাঁপা হাত অর্গানে রেখে শুকনো গলায় গান ধরলেন, “……ও পারেতে সোনার কূলে আঁধারমূলে কোন্ মায়া/গেয়ে গেল কাজ-ভাঙানো গান।……দিনের শেষে……” গান শেষ হলে দেখলেন, ঘরের প্রায় সকলেই পা টিপেটিপে বেরিয়ে যাচ্ছেন। রবীন্দ্রনাথ শুধু স্থাণু পাথর হয়ে বসে আছেন। চোখ অর্ধনিমীলিত। আত্মসমাহিত! পঙ্কজ আর দাঁড়লেন না। কোনওক্রমে রথীন্দ্রনাথের অনুমতি নিয়ে দ্রুতপায়ে বেরিয়ে এলেন ঠাকুরবাড়ি ছেড়ে। ১৯৩৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘মুক্তি’ চলচ্চিত্রের জন্য রবীন্দ্রনাথের অনুমতিক্রমে পঙ্কজকুমার মল্লিক এই গানটি গেয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক সুরারোপিত নয় বলে বিশ্বভারতী সংগীত সমিতি এটিকে ‘রবীন্দ্রসংগীত’ আখ্যা দেয়নি এবং রবীন্দ্রনাথের গীতি-সংকলন গীতবিতান-এও এই গানটি অন্তর্ভুক্ত হয়নি। পরবর্তীকালে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও কিশোরকুমার এই গানটি রেকর্ড করেন। হেমন্তের কণ্ঠে ‘অনিন্দিতা (১৯৭২)’ মুভিতে আমরা অনেকেই গানটা শুনেছি।

দলেদলে শিল্পীরা বাংলা ছাড়ছেন। নিউ থিয়েটার্স লিমিটেড-এর বি এন সরকার বললেন, “সবাই তো চলে যাচ্ছে। আপনিও যান। এত টাকা দেবার ক্ষমতা যে আমার নেই! সুযোগ হারাবেন কেন?” পঙ্কজের উত্তর, “আপনি আমার অসময়ে পাশে থেকেছেন, আজ এই দুঃসময়ে আপনাকে ছেড়ে চলে যাব!” সরকার সাহেবের এরপর আর কী করার থাকে, চোখের জলে ভেসে যাওয়াটুকু ছাড়া! বারবার ডাক আসতে লাগল বম্বে থেকে। তিনি কিছুতেই যাবেন না। একবার তো রাজকাপুর নিজে এসে বললেন, “চাচা, আপনার টেবিলে আমি ব্ল্যাঙ্কচেক রেখে যাচ্ছি, যা মনে আসবে, ভরে নেবেন। আমার ছবিতে কিন্তু আপনাকে চাই।” তাও তিনি যাননি।

নিউ থিয়েটার্সে থাকাকালীন অসংখ্য হিন্দি, উর্দু, তামিল ছবিতেও সুর দিয়েছেন পঙ্কজ। রাষ্ট্রীয় পুরস্কার চালু হওয়ার পর ‘যাত্রিক’, ‘মহাপ্রস্থানের পথে’ এবং ‘রাইকমল’ ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক বিবেচিত হন, ১৯৭২ সালে প্রথম সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে দাদাসাহেব ফালকে সম্মান পান। ভারতের জাতীয় সঙ্গীত ‘জন গণ মন’ তিনিই প্রথম গেয়ে রেকর্ড করেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে বলেছিলেন, জীবদ্দশায় যেসব গানে তিনি সুর করে যেতে পারবেন না, সেগুলিতে সুরযোজনার দায়িত্ব যেন পঙ্কজকুমার মল্লিক নেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কবিগুরুর এই আশীর্বাদকে তিনি সকল পুরস্কার ও সম্মানের ঊর্ধ্বে মনে করতেন। আর ছিল রেডিও। আকাশবাণী।

রেডিওতে ৫০ বছরের কার্যকালে পঙ্কজ মল্লিক অগণ্য অবদান রেখে গেছেন, সেগুলির মধ্যে দুইটি অনন্যসাধারণ: প্রতি রবিবার সকালের ‘সঙ্গীতশিক্ষার আসর’ এবং মহালয়ার ভোরের বিখ্যাত অনুষ্ঠান ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। পঙ্কজ মল্লিকই প্রথম ব্যক্তি যিনি রবীন্দ্রনাথের গানকে সমাজের সবস্তরে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন এবং ‘সঙ্গীতশিক্ষার আসর’ ছিল তার প্রধান মাধ্যম। ১৯৩১ সাল থেকে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ প্রচারিত হতে আরম্ভ করে, আজও তা প্রথমদিনের মতোই অপরিহার্য। বাণীকুমারের সৃষ্ট এই বীথিটি বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের স্তোত্রপাঠে সজ্জিত ও পঙ্কজ মল্লিকের সুরে অলঙ্কৃত। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের সম্পূর্ণ গ্রন্থনাটি তাঁরই সুরে বাঁধা, এমন-কী, গোড়ার দিকের অনেক বছর সব ক’টি গানও তিনিই গাইতেন! সেই ভালোবাসার গর্ভগৃহেই যে একদিন চূড়ান্ত অপমানিত হতে হবে, কোনওকালে তিনি তা ভাবেননি। অথচ তাই-ই হল। তাও জীবনের একেবারে উপান্তে।

উপর্যুপরি দু-দুটো ঘটনা ঘটল।

দীর্ঘকাল ধরে চলেআসা তাঁর স্বপ্নের ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ হঠাৎ একবার বন্ধ করে নতুন আকার দিয়ে সম্প্রচার করা হল। এমনটা যে হবে, ঘুণাক্ষরে আগে থেকে জানতেন না তিনি। ১৯৭৬ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর, মহালয়ার দিন৷ ভোরবেলা আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে বেজে উঠেছিল সেই চিরাচরিত ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ নয়, ‘দুর্গে দুর্গতিহারিণীম্’৷ বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ সেই এক মহালয়াতেই বাতিল হয়েছিল। এসেছিল ওই নতুন অনুষ্ঠান৷ যার প্রধান ভাষ্যপাঠক ছিলেন উত্তমকুমার। কিন্তু কী ছিল সেই ‘দুর্গে দুর্গতিহারিণীম্’? স্ক্রিপ্ট লিখেছিলেন ড. গোবিন্দ গোপাল মুখোপাধ্যায়, মাধুরী মুখোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। পরিমার্জনায় পণ্ডিত ড. ধ্যানেশনারায়ণ চক্রবর্তী। গান লিখেছিলেন পণ্ডিত ভি বালসারা ও শ্যামল গুপ্ত। শৈলেন মুখোপাধ্যায় ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় গান গেয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলে, মান্না দে, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, আরতি মুখোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, উৎপলা সেন, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, নির্মলা মিশ্র, অসীমা মুখোপাধ্যায়, অনুপ ঘোষাল, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, শৈলেন মুখোপাধ্যায়, শিপ্রা বসু, বনশ্রী সেনগুপ্তা, হৈমন্তী শুক্লা, পিন্টু ভট্টাচার্য, অপর্ণা সেনগুপ্তা, সমরেশ রায়, অরুণ কৃষ্ণ ঘোষ, প্রভাস প্রসূন, শক্তি ঠাকুর। বাংলা ও সংস্কৃত ভাষ্যপাঠে ছিলেন উত্তমকুমার, বসন্ত চৌধুরী, পার্থ ঘোষ, ছন্দা সেন, মাধুরী মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। স্তোত্রপাঠ করেছিলেন গোবিন্দগোপালবাবু ও মাধুরী চট্টোপাধ্যায়।

সবচাইতে উজ্জ্বল তারকাপুঞ্জের হাট বসেছিল সে মহাকর্মযজ্ঞে! এরপর? শ্রোতার প্রবল দাবিতে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ আবার ফিরল। কিছু জিনিস থাকে, বদলানো যায় না, বদলালে অনর্থ সৃষ্টি হয়।

‘মহিষাসুরমর্দিনী’র নাম প্রথম থেকেই ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ ছিল না। ‘মহিষাসুরমর্দিনী’তে যাঁরা অংশ নিতেন তাঁরা অনেকেই মহড়ার জন্য আগেই চলে আসতেন বেতারে। মহড়ার অবসরে চলত চা-পান, রঙ্গরসিকতা। একবার হয়েছে কী, যথারীতি কেউ আড় হয়ে শুয়ে পড়েছেন, তো কেউ বা ঘুরছেন এদিক-সেদিক। বাণীকুমার বসে আছেন রেকর্ডিং-এ। ওই দিনের আগে ভাষ্য অংশ পাঠ করা হত স্বাভাবিক কথ্যভঙ্গিতে। সুরে নয়। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ তাঁর নিজস্ব ধারায় চণ্ডীপাঠ করছিলেন সুরেলা কণ্ঠে। হঠাৎই অলস রসিকতার ছলে বাংলা ভাষ্যটিও স্তোত্রের সুরের অনুকরণে বলতে শুরু করলেন। তাতে চারিদিকে বেশ একটা মৃদুহাসির ভাব জাগল। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ থামলেন।…….তখন বাণীকুমার দ্রুত রেকর্ডিং রুম থেকে বেরিয়ে এসে বললেন, “আরে আরে, থামলে কেন? বেশ তো হচ্ছিল! হোক! হোক না ওই ভাবেই……” বীরেন্দ্রকৃষ্ণ হেসে বললেন, “আরে না না, একটু মজা করছিলাম!” কিন্তু বাণীকুমার গভীর আগ্রহ নিয়ে বললেন, “মোটেই না! দারুণ হচ্ছিল! ওইভাবেই আবার করো তো।” বীরেন্দ্রকৃষ্ণ আবার শুরু করলেন, “দেবী প্রসন্ন হলেন…….”

সেদিনই বাংলার ইতিহাসে সংযুক্ত হল এক নতুন মাত্রা। অন্য ধারায় মহালয়ার পাঠ। দুর্গাপুজোর কার্টেন রেজার! এক হলদে রঙের রোদ্দুরে মায়া যেন! শরৎ এসে হাজির হয় পুজোর আকাশে। অনেকের বাড়িতে একসময় রেডিও এসেছিল মহালয়ার আগমনী হিসেবেই।

পরনে কোঁচানো ধুতি ও পাঞ্জাবি, গায়ের রং ফর্সা, ঝকঝকে কালো পাম্পশু, মুখে পান, চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা। মাথার সামনের দিকের অংশ কিছুটা ফাঁকা হলেও পেছনে ও কানের দু’পাশের চুলটি বড়ো সুন্দর। চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। গায়ে মিষ্টি আতরের গন্ধ। গাম্ভীর্যপূর্ণ চেহারা। সব কিছুর মধ্যেই এক শিল্পীসুলভ ভাব। মুখে তাঁর জর্দামেশানো পান। আতরও মাখতেন তিনি। জুঁইফুলের আতর ছিল তাঁর খুব প্রিয়। এহেন মানুষটি যে এত কঠিন হতে পারেন কে বলবে?

বলতে পারে অতীত।

১৯৩২-এ বাণীকুমারের প্রযোজনায় সম্প্রচারিত হল শারদ-আগমনী গীতিআলেখ্য ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। তখন এটি ঘিরে তীব্র আপত্তি ওঠে। ধর্মকে যারা চিরদিন বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে রাখতে চায়, সেই রক্ষণশীলদের পক্ষ থেকে। প্রতিবাদের মূল কারণ ছিল – এক অব্রাহ্মণ ব্যক্তির কন্ঠে কেন চণ্ডীপাঠ শোনা যাবে? রুখে দাঁড়ালেন বাণীকুমার। গ্রন্থনা ও চণ্ডীপাঠ বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রই করবেন, এই সিদ্ধান্তে অটল থাকলেন তিনি। আর মায়ের এই আরাধনায় মুসলমান শিল্পীরাও অংশগ্রহণ করবেন৷ সে-ও আটকাবে না কিছুতেই৷ মা শুধু হিন্দুর মা নন। এই লড়াকু মনোভাব লেখা ছিল যেন মজ্জায়৷ অন্য একটি আপত্তিও ছিল, মহালয়ার সকালে পিতৃতর্পণের আগেই কেন চণ্ডীপাঠ হবে? এ কারণে কয়েক বছর অনুষ্ঠানটি ষষ্ঠীর ভোরে সম্প্রচারিত হয়েছিল। কিন্তু শেষে বাণীকুমারের সিদ্ধান্ত মেনেই মহালয়ার ভোরেই প্রচারিত হয়ে আসছে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’।

‘মহিষাসুরমর্দিনী’ প্রথম প্রচারিত হয় ১৯৩২ সালে ষষ্ঠীর দিন। তবে তার আগের বছর, ১৯৩১ সালে, বাণীকুমার (আসল নাম বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য) ‘শ্রীশ্রী চণ্ডী’-র বিষয়বস্তু নিয়ে ‘বসন্তেশ্বরী’ নামক একটি কাব্য রচনা করেছিলেন। সে বছরই চৈত্রমাসে বাসন্তী পুজোর সময়ে ‘বসন্তেশ্বরী’ প্রচারিত হয়। তাতে সুর দিয়েছিলেন পণ্ডিত হরিশচন্দ্র বালী। তাতে ছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ও বাণীকুমারও। আর সঙ্গীত পরিচালনায় ছিলেন রাইচাঁদ বড়াল। এমনই এক সময় সকলে মিলে ঠিক করলেন দুর্গাপুজোর ষষ্ঠীর সকালে এমন একটা অনুষ্ঠান করলে কেমন হয়? সেই শুরু। ১৯৩২ সালে প্রথম প্রচারিত হয় ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। বাণীকুমার এই রচনায় সহায়তা পেয়েছিলেন পণ্ডিত অশোকনাথ শাস্ত্রীর। কয়েকটি গানে সুর দিয়েছিলেন পণ্ডিত হরিশচন্দ্র বালী ও রাইচাঁদ বড়াল। তবে বেশিরভাগ গানে সুর দিয়েছিলেন পঙ্কজকুমার মল্লিক।

শোনা যায়, অনুষ্ঠানের আগের দিন রাত্রে স্টুডিওতেই থাকতেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। অন্য শিল্পীদের রাত দু’টো নাগাদ স্টুডিওয় নিয়ে আসা হত। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ স্টুডিওতেই স্নান সেরে গরদের ধুতি ও চাদর পরতেন। অনুষ্ঠানের শুরুতে শাঁখ বেজে উঠত। শুরু হত লাইভ প্রোগ্রাম। প্রথমদিকে কয়েক বছর রাইচাঁদ বড়াল ও পঙ্কজকুমার মল্লিক যুগ্ম সঙ্গীত পরিচালনায় ছিলেন। তবে পরবর্তীকালে এই অনুষ্ঠানে এসেছিল বেশ কিছু পরিবর্তন। বদলেছিল শিল্পীর তালিকাও। শুধু বদলায়নি গ্রন্থনা ও শ্লোক-আবৃত্তির সেই শিল্পী। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকেই টেলিভিশন বিভিন্ন বাড়িতে স্থান পেতে শুরু করে, রেডিওর জৌলুশ এখন অনেকটাই স্তিমিত। তবে এর একমাত্র ব্যতিক্রম মহালয়ার ভোরে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। টেলিভিশনের চেয়ে আকাশবাণীর এই অনুষ্ঠানটি এখনও লোকের কাছে অনেক বেশি প্রিয়। অনুষ্ঠানের শুরুটি এরকম: মহিষাসুরমর্দিনী। রচনা ও প্রবর্তনা – বাণীকুমার। সঙ্গীত-সর্জন – পঙ্কজকুমার মল্লিক। গ্রন্থনা ও স্তোত্রপাঠ – বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র।

“আজ দেবীপক্ষের প্রাক-প্রত্যুষে জ্যোতির্ম্ময়ী জগন্মাতা মহাশক্তির শুভ আগমন-বার্ত্তা আকাশ-বাতাসে বিঘোষিত। মহাদেবীর পুণ্য স্তবনমন্ত্রে মানবলোকে জাগরিত হোক ভূমানন্দের অপূর্ব্ব প্রেরণা। আজ শারদ গগনে-গগনে দেবী ঊষা ঘোষণা করছেন মহাশক্তির শুভ আবির্ভাব-ক্ষণ।”

এরপর তিনবার শঙ্খধ্বনির পর শুরু হয় অনুষ্ঠান। সুপ্রীতি ঘোষের পরিশীলিত কন্ঠে গাওয়া সেই গান – “বাজল তোমার আলোর বেণু”।

সাধারণ মানুষের কাছে পঙ্কজকুমার ও বীরেন্দ্রকৃষ্ণ এই ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত হিসেবে যতটা পরিচিত, সেই তুলনায় হয়তো একটু আড়ালেই থেকে গেছেন বাণীকুমার। অথচ মূল অনুষ্ঠানটির পরিকল্পনা ও রচনা বাণীকুমারেরই। উপরোক্ত গানটির রচয়িতাও বাণীকুমার। অনুষ্ঠানটি সফল ও আকর্ষণীয় করে তুলতে বাণীকুমারের সঙ্গে পঙ্কজকুমার মল্লিক ও বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের নাম অবশ্যই স্মরণীয়, তাঁদের বাদ দিয়ে বাঙালির প্রাণের এ অনুষ্ঠানের অস্তিত্বই কল্পনা করা যায় না। বাণীকুমার নিজের লেখাতেই জানিয়েছেন, “এ কথা বলা বাহুল্য যে আমাদের কয়জনের আন্তরিক সাধন দ্বারা এই মহিমাময় চণ্ডী-গাথা সকল শ্রেণীর জনবর্গের প্রার্থনীয় হয়েছে।… ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ কলিকাতা বেতারের তথা বাংলার একটা কীর্তিস্থাপন করেছে।” ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ গীতি-আলেখ্যটি পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। এ প্রসঙ্গে একটি নিবন্ধে বাণীকুমার নিজেই লিখেছেন: ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ আমার প্রথম যৌবনের রচনা। কিন্তু মূল রূপটির বিশেষ পরিবর্তন না ঘটলেও এই গ্রন্থের বর্তমান রূপ বহুতর তথ্য ভাবগর্ভ বিষয় এবং বেদ-পুরাণাদি-বিধৃত শ্লোকাবলী সংযোজনায় সমলংকৃত। প্রকৃতপক্ষে এই গ্রন্থ মার্কন্ডেয় সপ্তশতী চন্ডীর সংক্ষিপ্তসার বললেও অত্যুক্তি হয় না, তদুপরি এর মধ্যে আছে মহাশক্তি-সম্বন্ধে বৈদিক ও তান্ত্রিক তত্ত্বের ব্যঞ্জনা, এবং এর অন্তরে নিহিত রয়েছে শাশ্বত বাংলার মর্মকথা।

মাত্র একবারই ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র প্রচার বন্ধ রাখা হয়েছিল। যে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ চল্লিশ বছর ধরে আকাশবাণীতে প্রচারিত হয়ে আসছিল, যার প্রতিটি সম্প্রচারের দিন আকাশবাণীতে উপস্থিত থাকতেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ স্বয়ং, সেই অনুষ্ঠান না বাজিয়ে নতুন অনুষ্ঠান বাজানোর নির্দেশ এসেছিল দিল্লি থেকে। দেশে জরুরী অবস্থা থাকাকালীন ১৯৭৬-এর ২৩শে সেপ্টেম্বর মহালয়ার ভোরে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’কে সরিয়ে ‘দুর্গে দুর্গতিহারিণীম্’ নাম দিয়ে এক বিকল্প অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়। রূপদান করেছিলেন মহানায়ক উত্তমকুমার, অমর শিল্পী লতা মঙ্গেশকর প্রমুখ স্বনামধন্য ব্যক্তিবর্গ। কিন্তু ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ স্থানচ্যুত হওয়ায় জনরোষ ফেটে পড়ে। পত্রপত্রিকায় সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। প্রবল আপত্তি আসতে থাকে—অজস্র চিঠি, টেলিফোন। জনসাধারণের চাহিদাকে মর্যাদা দিতে সে বছর ষষ্ঠীর দিন সম্প্রচারিত হয় ‘মহিষাসুরমর্দিনী।’ আর ১৯৭৭ থেকে স্বমহিমায় মহালয়ার ভোরে ফিরে আসে ‘মহিষাসুরমর্দিনী।’ বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র বরাবরই ভোর হবার আগে রাত্রিবেলাতেই বেতারকেন্দ্রে চলে আসতেন এবং ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত উপস্থিত থেকে তারপরে যেতেন। টেপ রেকর্ডারে অনুষ্ঠান চললেও এ অভ্যাস তিনি চালিয়ে গেছেন। কিন্তু ১৯৭৬ সালের পর থেকে তিনি আর কখনও রাত্রিবেলা যেতেন না। ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ অনুষ্ঠানটি রচনা ও তরঙ্গায়িত করে বাণীকুমার যে অসাধারণ কাজটি করেছিলেন, তৎকালীন স্টেশন ডিরেক্টর দিলীপকুমার সেনগুপ্ত সে প্রসঙ্গে বলেছেন: “বাণীকুমার যদি আর কোনো কাজ নাও করতেন, তাহলেও শুধু ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র জন্যই মানুষ তাঁকে মনে রাখত। …… শাজাহান যেমন তাজমহল গড়েছিলেন, যা পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্যের একটা হয়ে আছে, আমাদের বাণীদা হাওয়ায় তাজমহল গড়ে গেলেন, যা মানুষের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।”

কী ঘটেছিল সে বছর? ১৯৭৬ সাল। আকাশবাণীর কর্তৃপক্ষ ঠিক করলেন চিরাচরিত ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ বীরেন্দ্রকৃষ্ণর বদলে উত্তমকুমারকে দিয়ে করাবেন। তাঁদের গোপন বৈঠকে বাদ পড়লেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। এই নতুন উদ্যোগ ঘুণাক্ষরেও টের পাননি বীরেন্দ্রকৃষ্ণ। কিছুই জানানো হয়নি পঙ্কজকুমার মল্লিককেও। নির্দিষ্ট দিনে রেডিওয় বাজল নতুন অনুষ্ঠান ‘দুর্গে দুর্গতিহারিণীম্’। এবং চূড়ান্তভাবে ফ্লপ! সমালোচনার ঝড় উঠল। বেতার অফিস ভাঙচুর হল। অফিসের সামনে লোকে গালিগালাজ করতে লাগল। অনেকের এমনও মনে হয়েছিল যে মহালয়ার পুণ্য প্রভাত কলুষিত হল! এবার বুঝি অমঙ্গল কিছু ঘটবে!

উত্তমকুমার কিন্তু এ দায়িত্ব নিতে চাননি। তিনি বীরেন্দ্রকৃষ্ণের কাছে গিয়ে তাঁর অস্বস্তি ও অযোগ্যতার কথাও বলেছিলেন। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ অবশ্য তাঁকে আশ্বস্ত করে উৎসাহই দিয়েছিলেন। বেতার কর্তৃপক্ষ একেবারে গোপনে তাঁকে কিছু না জানিয়ে এই নতুন অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করায় তিনি খুবই কষ্ট পেয়েছিলেন। বলেছিলেন, “ওরা একবার আমায় জানালোও না। আমি কি নতুন কিছুকে কোনও দিন বাধা দিয়েছি?” মহিষাসুরমর্দিনী না-বাজানো সম্পর্কে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের বক্তব্য ছিল, “আমি তো অমর নই, একদিন না একদিন অন্যদের তো এগিয়ে আসতেই হবে এ কাজে।” কিন্তু এ কথা মিথ্যে প্রমাণিত হয়েছে। প্রতি বছর মহালয়াতে বাঙালির ভোর হয় মহিষাসুরমর্দিনী দিয়েই। আর সেই অনুষ্ঠান বাঙালির চিরকালের ঠাকুরঘরই৷ ‘দুর্গে দুর্গতিহারিণীম্’-এর অশেষ দুর্গতি-র পরে দুর্গতির কারণ বলতে গিয়ে উত্তমকুমার যে নিজেই বলেছিলেন, “ঠাকুরঘরকে রিনোভেট করে ড্রয়িংরুম বানালে যা হয়, তাই-ই হয়েছে।”

বহু মানুষের চাহিদায় সে বছরই ষষ্ঠীর দিন আবার বীরেন্দ্রকৃষ্ণর ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ সম্প্রচার করা হয়। আশ্চর্যের কথা হল, এই সম্প্রচার হবে শুনে অভিমান, ক্ষোভ সব ভুলে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ পুনরায় কাজে নেমে পড়েছিলেন। সাথে ছিলেন পঙ্কজকুমার মল্লিক। পঙ্কজকুমার মল্লিকের জায়গায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায় কাজ করায় দু’জনের মধ্যে কি কোনও দ্বৈরথ সৃষ্টি হয়েছিল? পঙ্কজকুমার মল্লিকের পৌত্র শ্রী রাজীব গুপ্ত সাম্প্রতিক অতীতে সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে জানাচ্ছেন, “পঙ্কজকুমার ও হেমন্ত, দু’জনেই খুব নম্রভাষী মানুষ ছিলেন। আমার দাদু, অর্থাৎ পঙ্কজকুমার ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী, সারাজীবনে কারও সঙ্গে উঁচু গলায় কথা বলেছেন কি না, জানা নেই।” সেই সঙ্গে তিনি এটাও জানিয়েছিলেন, সে সময়ে গোটা বিষয়টি নিয়ে কেউ কিছুই জানাননি পঙ্কজকুমারকে, এবং এই বিষয়টিই তাঁর সবচেয়ে খারাপ লেগেছিল।

কিন্তু ক্ষত তো রয়ে গেল পাঁজরে! এই বিষয়ে পঙ্কজকুমার মল্লিকের পৌত্র শ্রী রাজীব গুপ্তর বক্তব্য: “অল ইন্ডিয়া রেডিওর পক্ষ থেকে জানানো উচিত ছিল। সে সময় অল ইন্ডিয়া রেডিওতে দাদুর দুটো অনুষ্ঠান হত। প্রথমটি ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ আর দ্বিতীয়টি ‘সঙ্গীতশিক্ষার আসর’। ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ বন্ধ করার পনেরো দিন আগে ‘সঙ্গীতশিক্ষার আসর’ অনুষ্ঠানটিও বন্ধ করে দেওয়া হয়। সঙ্গীতশিক্ষার আসর বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দাদু একটা ধাক্কা পেয়েছিলেন। সে সময় উনি যে গানটি শেখাতে শুরু করেছিলেন, সেটাও ওঁকে শেষ করতে দেওয়া হয়নি। তার পনেরো দিনের মধ্যেই ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র ঘটনাটা ঘটে। একদম শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দাদু জানতেন না, মহিষাসুরমর্দিনীর পরিবর্তে অন্য একটা অনুষ্ঠান হতে চলেছে। অথচ সবার সঙ্গেই দেখাসাক্ষাৎ, কথাবার্তা হত। পরপর দুটো ঘটনা ঘটে যাওয়ায় দাদুর একটা হার্ট অ্যাটাক হয়। কিন্তু হেমন্তবাবুর সঙ্গে পঙ্কজকুমার মল্লিকের সম্পর্ক এমন ছিল না যাতে দু’জনের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি হতে পারে। হেমন্তবাবু ওঁর সন্তানতুল্য ছিলেন। তাই দাদুর একটা ক্ষোভ থেকে থাকতে পারে, হেমন্তবাবু সব জেনেও ওঁকে কিছু জানাননি। কিন্তু ঝগড়া বা তর্কাতর্কি কিছুই হয়নি। হেমন্তবাবুও কখনওই দাদুর প্রতি অশ্রদ্ধা দেখাননি। আসলে এই বিষয়টা এতটাই জটিল যে এক কথায় উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়।”

জীবনের প্রান্তবেলায় সন্তান হারানোর মতো এ শোক ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিল গানসাধক প্রবীণ মানুষটিকে। এমন অবহেলা আর আঘাতই হয়তো বাঙালি সাধকের চিরকালের পাওনা! আমরা প্রতিভা সহ্য করতে পারি না। যাঁর মধ্যে প্রতিভা আছে, তাঁকে নির্যাতন করাই বাঙালির দায়িত্ব।

পণ্ডিত অশোকনাথ শাস্ত্রীর ঠাকুরঘরে বসে লেখা শুরু করেন বাণীকুমার৷ কিছুটা লেখেন, আর পড়ে শোনান বন্ধু অশোকনাথকে৷ অশোকনাথ শোনেন, আলোচনা করেন, তথ্য সহায়তায় এগিয়ে আসেন। বাণীকুমার লিখে চলেন৷ আর লিখেই বসে যান আরেক অক্লান্ত পথিকের সঙ্গে৷ রাজার রোয়াব যাঁর সঙ্গীতে, তিনি পঙ্কজকুমার মল্লিক৷ অহরহ বৈঠক চলছে৷ আর ঘরময় সুরের পরশ৷ এক লাইন এক লাইন করে কোরাস নির্মাণ, পর্দার আড়ালে হাজার রাগ৷ পিলু, খম্বাজ, আহির ভৈরব, মালকোষ…….পঙ্কজকুমার তখন সে আবহে এমনই আসক্ত যে রাতের রাগ মালকোষকে ব্যবহার করলেন ভোরের সে মুহূর্তে৷ কর্ণাটকী শৈলির রাগ অনায়াসেই মিশ খেল অন্য ঘরানায়৷ আর বাণীকুমার, বন্ধু পঙ্কজের কাছে নতুন আত্মজকে সমর্পণ করে আবার ঢুকে গেলেন ঘোর-মধ্যে৷ যে ঘোরে প্রতিনিয়ত ডুব দিয়ে বাণীকুমার তুলে আনছেন মুক্তো-হিরে-চুনি-পান্না। ভোর চারটেয় তরঙ্গে ভাসা শুরু ‘মহিষাসুরমর্দিনী’-র৷ আরম্ভে তিনবার শঙ্খধ্বনি, আর তারপরই বীরেন ভদ্রের অমর হয়েযাওয়া স্বর৷

বাণীকুমার এই শঙ্খটি বাড়ি থেকে বেতারকেন্দ্রে নিয়ে যেতেন। মৃত্যুঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায় তাতে ফুঁ দিতেন৷ শুরুর নির্দেশ ছিল ওটাই৷ পরে গৌর গোস্বামী বাঁশি দিয়ে বা কখনও শৈলেশ্বর মুখোপাধ্যায় ক্ল্যারিওনেটে তুলে দিতেন এই সুর। তখন তো লাইভ ব্রডকাস্টের যুগ৷ দীর্ঘ বিশ-বাইশ দিনের অবিরাম মহড়া চলত পঙ্কজ মল্লিকের নেতৃত্বে। সকলের উপস্থিতি চাই। এক দিকে সারেঙ্গি ধরতেন মুন্সি, চেলোয় ওঁরই ভাই আলি, হার্মোনিয়ামে খুশি মহম্মদ, বেহালায় তারকনাথ দে, ম্যান্ডোলিনে সুরেন পাল, গিটারে সুজিত নাথ, এস্রাজে দক্ষিণামোহন ঠাকুর, পিয়ানোয় রাইচাঁদ বড়াল। আহা, নক্ষত্রের কী সমাহার! আর এসবের অন্যপিঠে গায়কদের নিয়ে একা বাণীকুমার। প্রত্যেকের সংস্কৃত উচ্চারণ ঠিক চলছে কি না, তা দেখতেন। এমনকি বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রেরও৷ তিনি শুরুর দিকে সংস্কৃত বেশ কিছু কথা অনেকটা বাংলার মতো করে উচ্চারণ করে বলতেন, যা অধ্যবসায়ের জোরে শেষে এমন বসল ওঁর গলায় যে একটা ভিন্ন ধারাই তৈরি হয়ে গেল। বাণীকুমারের কথা ছিল, আগে মানে বুঝতে হবে প্রতিটি শব্দের, সে তুমি কোরাসই গাও না কেন, উপলব্ধি করতে হবে সেটির ভাব, তারপর মিলবে ছাড়। সোজা পঙ্কজবাবুর সান্নিধ্যে এক বিস্তর মহাযজ্ঞ।

মহালয়া। বাঙালির রক্তের মধ্যে যদি কোনও সুর মিশে গিয়ে থাকে, সে সুর মহালয়ার। অন্যসময় রেডিওর সঙ্গে কোনওরকম সম্পর্ক না থাকলেও বছরের একটি বিশেষ দিনে ভোরবেলা আজও বাঙালিবাড়ি থেকে ভেসে আসে মহিষাসুরমর্দিনীর চেনা সুর। পঙ্কজকুমার মল্লিক-বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র-বাণীকুমার……এই তিন স্রষ্টার ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ বাঙালির ঘরেঘরে মহালয়া, তথা পুজোর সঙ্গে সমার্থক হয়ে আছে যুগের পর যুগ ধরে। এই সুর, গান, স্তোত্রপাঠ না হলে বাঙালির ঘরে পুজো আসে না। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র তাঁর কণ্ঠের যাদুতে আমাদের প্রাণে জাগিয়ে তোলেন আগমনী মেজাজ, পুজোর ঘ্রাণ। একটা বেতার-অনুষ্ঠান কেমন করে বাঙালির ধর্মাচরণের, কৃষ্টির, আবেগের, বিশ্বাসের, অনুভূতির, উৎসবের, সর্বোপরি জীবনযাপনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেলো, তা সত্যিই পরম বিস্ময়ের ব্যাপার! মহালয়ার পুরো গল্পকে সৌমিক সেন ২০১৯ সালে সেলুলয়েডের ফিতেয় নিয়ে এসেছেন ‘মহালয়া’ নামে। ফিল্মমেকিং-এর দোহাইয়ে কিছু সংযোজন-বিয়োজন আছে বটে, তবে সিনেমা দেখে কাহিনির আবহটা ঠিকই পাওয়া যায়।

সিনেমায় কিছু ডায়লগ আমার ভাল লেগেছে। শেয়ার করছি:

এক। (কিশোরকুমার ও রেডিওর বড়কর্তার মধ্যকার কথোপকথন)

– আপনার জন্য ৪৫ মিনিটের একটা স্লট রাখা আছে।

– সত্তর হাজার।

– কী?

– নগদ দিলে ৬৫ দিলেও হবে। আপনি আমার সেক্রেটারির সাথে যোগাযোগ করবেন। ধন্যবাদ।

(কিশোরকুমার এরকমই ছিলেন। প্রাপ্য পয়সা পাবেন না বুঝতে পেরে অর্ধেক গান করেই স্টুডিয়ো থেকে বেরিয়ে গেছেন বহুবার! আই সাপোর্ট হিম! একজন আর্টিস্টকে তাঁর আর্টের ন্যায্য দাম দিতে হবে, যেকোনো আর্টকে রপ্ত করতে কী যে শ্রমসাধ্য সাধনার প্রয়োজন হয়, সে খোঁজ একমাত্র আর্টিস্টই জানেন। বাঘের দুধ খেতে চাইলে বাঘের হৃদয় লাগে, ছাগলের হৃদয় নিয়ে ছাগলের দুধই মেলে, বাঘের নয়। ভাল জিনিসের দামটাও ভাল হয়। যতো গুড়, ততো মিঠা।)

দুই। বেত্তমিজি ইজ নট নেসেসারিলি অ্যা ব্যাড থিং। জিনিয়াস লোক, একটু বেত্তমিজি করবে, ইটস কোয়াইট নর্মাল। (আহা, কতটা সত্য এই কথাটি! এ পৃথিবী কেবল জিনিয়াসদের বেয়াদবিই সহ্য করে। কেন? খুব সোজা। ওরা যে অপরিহার্য! একলক্ষ মেধাবী লোকের চাইতেও একজন জিনিয়াস পৃথিবীকে বেশি কিছু দিতে পারে।)

তিন।

– ঠিক আছে, স্যার, চেষ্টা করবো।

– চেষ্টা! হোয়াট অ্যা স্টুপিড ওয়ার্ড ইজ দিস মিস্টার ব্যানার্জি!

(চেষ্টা করবো—এটা বলার সময়ই কাজের প্রস্তুতি অর্ধেকে নেমে আসে!)

চার। রবীন্দ্রনাথ পঙ্কজবাবুর সুর পাল্টাতে না চাইলেও আধুনিক বাঙালি সেটা চাইছে। এটাই তো মডার্নিজম। (বাঙালির মাথায় ঘিলু নেই? এই ফালতু কথাটা কে বলে? ঘিলু না থাকলে কেউ এমন অকাজে ব্যস্ত হয়ে থাকে? ফালতু কাজের জন্য এমন অফুরন্ত অবসর আর কোন জাতির আছে?)

পাঁচ। বদনাম ব্র্যান্ড তৈরি করার একটা ইম্পরট্যান্ট হাতিয়ার। (যে অঞ্চলের মানুষ বাংলায় কথা বলে, সে অঞ্চলে নেগেটিভ মার্কেটিং খুবই কাজে দেয়। ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, এই লেখাটি যখন থেকে সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে লিখে দেয়াটা বাধ্যতামূলক করা হল, তখন থেকে সিগারেটের বিক্রি হুহু করে বেড়ে গিয়েছিল, সে গল্প তো আমরা সবাইই কমবেশি জানি।)

ছয়। প্রতিভার মধ্যে ধৈর্যের অভাবটা চিরকালীন, পঙ্কজবাবু। (খুব সত্যি! জিনিয়াসরা বেশ অধৈর্য প্রকৃতির হয়ে থাকেন। সাথে ঠোঁটকাটাও! অন্যরা কোনো কাজের পেছনে দিনের পর দিন লেগে থেকে যে আউটপুটটা দেয়, একজন প্রতিভাবান মানুষ মুহূর্তেই সেটির চাইতে বেটার আউটপুট দিতে পারে। প্রয়োজন কীসের অতো ধৈর্যের?)

সাত। কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন………এই যে গানটা আপনি গাইছিলেন, সেটা কার, জানেন? না, ব্রাহ্মণের তো নয়ই, কায়তেরও নয়……মোল্লার বাচ্চা, বাঘের বাচ্চা কাজী নজরুল ইসলাম। ওইরকম মানুষ আর গোটা দশেক জন্মালে দেশের অবস্থাটাই পাল্টে যেত। (হাসি পায় যখন কেউ নজরুলকে মুসলমান হিসেবে ট্যাগড করে ফেলেন। অমন একজন মানুষকে কোনো ধর্মের পরিচয়ে বাঁধা যায় না। একজন নজরুল মানুষের সম্পদ, কোনো সম্প্রদায়ের নয়। তাঁর সৃষ্ট শ্যামাসংগীতসহ অন্যান্য হিন্দু ধর্মীয় গান বাঙালির হৃদয়কে শান্তির সুবাতাস দিয়ে আসছে যুগের পর যুগ ধরে। আমার সবচেয়ে প্রিয় শ্যামাসংগীত ‘খড়ের প্রতিমা পুজিস রে তোরা, মাকে তো তোরা পুজিস নে’ তাঁরই লেখা। ইসলামি সংগীতে নজরুলের তুল্য আর কে আছেন? না, ভুল হল! ‘তুল্য’ তো অনেক পরের কথা, তাঁর কাছাকাছিই-বা কে আছেন? তাঁর জন্ম মুসলিম পরিবারে, এইটুকুই শুধু! তাঁর মনন, বিশ্বাস, লালন, জ্ঞান, বোধ সবই ছিল মানুষের ধর্ম-অনুপ্রাণিত। তাঁর চাইতে বেশি অসাম্প্রদায়িক লেখক আর কেউ ছিলেন বলে আমার জানা নেই।)

আট। স্যার, একটা কথা কী, জানেন, হুজুগে বাঙালি তো, বাঙালি যাকে একবার আইকন বলে ঠিক করে নেয়, তার আর রক্ষে নেই। (এ আইকন মানার ব্যাপারটা দুরারোগ্য রোগের মতন। বাঙালি যাকে একবার আইকন মেনে ফেলে, তার জীবন একেবারে বিপর্যস্ত করে ছেড়ে দেয়। অন্যরা টয়লেটে গেলে কোনো ‘দোষ’ নেই, আর ওদের আইকন টয়লেটে গেলে সবাই মিলে শেয়ালের ডাক দেবে: আশ্চর্য! উনার মতন মানুষও কেন হাগবে?)

নয়। (নিখুঁত উচ্চারণের দিকে নাট্যনির্দেশক বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের অতি মনোযোগ দেখে সুবিমল নামের এক উঠতি থিয়েটার অভিনেতা বিরক্তপ্রকাশ করলে সেটির সহনশীল প্রতিক্রিয়ায়) মেজাজ নষ্ট কোরো না, অনিল। সুবিমল বয়সে ছোট, নিজের মতামত দিয়েছে। (আহা, একজন বড়ো মানুষের একটা অপদার্থকে সহ্য করার কী ক্ষমতা! আমার যদি থাকতো!)

দশ।

– স্যার, আসলে উত্তমবাবুর সাথে প্রাইমারি কথা হয়ে গেছে, এখন ওনাদের যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব রিকোয়েস্ট করতে হবে।

– রিকোয়েস্ট? রিকোয়েস্ট তো রিফিউজ ভি হতে পারে, মিস্টার ব্যানার্জি। ইন্ডিয়ায় কবে কোন সেলিব্রিটি রিকোয়েস্ট রেখেছে?

– না, মানে, কার কী শিডিউল আছে……

– আরে বাঃ! গভর্নমেন্ট মশা তাড়ানোর জন্য ম্যালেরিয়া স্প্রে দেবে আর আপনি বলবেন, আপনার গার্ডেনে পিকনিকের শিডিউল আছে! বাঃ!

(গডফাদার মুভির ডায়লগ মনে পড়ে যাচ্ছে: I’m gonna make him an offer he can’t refuse.)

এগারো।

– কেউ যদি আপনাকে রিফিউজ করে, আপনি আমার নাম নেবেন, আমার! বলবেন যে, এর পরিণাম খুব খারাপ হয়ে যাবে!

– থ্রেট করবো, স্যার?

– থ্রেট………এ ক্রিমিনালের ভাষা কেন বলছেন, বাঙালি বাবু? ট্রুথ ইজ নট দি থ্রেট। আর ট্রুথ কনভে করা ইজ দি জব অব গড।

(ক্ষমতাবানরা থ্রেট দেন না, কেবল সত্যিটা জানান। ওদের কথামতো না চললে যে ক্ষতিটা ওরা করতে পারেন, তা কোনো অনুমান নয়, অতীত সাক্ষ্য দেয়, তা দিবালোকের মতোই সত্য।)

বারো। (উত্তমকুমার গেছেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের বাড়িতে। গেইটে উত্তমকুমারকে গৃহ পরিচারিকা চিনতে পারেনি বলে তাঁর পরিচয় সম্পর্কে নানান প্রশ্ন করতে থাকে। এই ব্যাপারটি নিয়ে উত্তমকুমারের ডায়লগ) বাংলায় ‘আপনি কে’ অনেকদিন শোনা হয় না। (উত্তমকুমার যে কত বড়ো সেলিব্রিটি ছিলেন, এ ছোট্ট কথায় তা অনেকটাই চোখের সামনে চলে আসে। আমার বিচারে, উত্তমকুমারের স্টারডোম যে কোন পর্যায়ের ছিল, তা বোঝাতে এই ডায়লগের চেয়ে শক্তিশালী কিছু আর হয় না।)

তেরো। (উত্তমকুমার বলছেন) বীরেনবাবু, ঠাকুরঘরে দেবতার সিংহাসনটা আপনি স্থাপন করেছেন। ভয় হয়, যদি সে ঠাকুরঘরে একটা কার্পেট পেতে সোফা ঢুকিয়ে সেটাকে ড্রয়িংরুম না বানিয়ে ফেলি! (প্রাচীন কিছু সত্তা থাকে, যেগুলিতে রং চড়ালেই বরং বিবর্ণ হয়ে যায়। মা বুড়ো হয়ে গেলেও কোনো তরুণীকে ধরে এনে মাকে রিপ্লেস করে ফেলা যায় না। কিছু জিনিস রেখে দিতে হয়—যেমনটি আছে, তেমনটি করেই।)

চৌদ্দ। মানুষের ভালোবাসা তো থাকবেই, বড়দা; তবে, পুজো এলো কি? (উত্তম নিজেই অনুষ্ঠানটি বদলে দেয়ার কাজটিতে সন্তুষ্ট ছিলেন না। তাঁর কণ্ঠ শুনে তাঁর নিজেরই মনে হয়নি পুজোর গন্ধটা ওখানে আছে। যে সুর, যে আবহ, যে মেজাজ বুকে গেঁথে আছে সেই বোধ হওয়ার পর থেকেই, অন্য কিছুকেই সে জায়গাটি দেয়া যায় না।)

পনেরো। আপনি ধরুন, স্যার, আপনার খোকনসোনা যদি ক্রিস্টমাসের দিন সকালবেলা দেখে যে স্যান্টার বদলে চার্লি চ্যাপলিন এসছে, তাহলে আপনার খোকনসোনা দুঃখ পাবে, এর জন্য চার্লি চ্যাপলিন কোনোভাবে দোষী নয়। (মানুষের মনের অবস্থা কত সহজেই বলা হয়ে গেলো এই ডায়লগের মধ্য দিয়ে! উত্তমকুমারের ধারাভাষ্যে নতুন যা সৃষ্টি করা হয়েছিল, সেটির সাথে বাংলার সবচাইতে প্রতিভাবান কিছু মানুষ যুক্ত ছিলেন, তবু লোকে তা নিলো না, তীব্র আপত্তিতে ছুঁড়ে ফেলে দিলো। ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ মানেই পুজোর শুরু, মানুষের মনের মধ্যে এটাই গেঁথে ছিল। সেখান থেকে সরে এসে অন্যকিছুকে কেউ গ্রহণ করবে না, তা সেটি যতো ভাল কিছুই হোক না কেন!)

ষোলো। (একজন আর্টিস্টের জীবনে) সংগীতের থেকে বড়ো ছায়া কিছু নেই। স্নেহ নেই, ভালোবাসা নেই, আশ্রয় নেই। (খুব খুব খুব সত্যি কথা! শেষ পর্যন্ত সৃষ্টিই স্রষ্টাকে আশ্রয় দেয়, বাঁচিয়ে রাখে। পরিবার, বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী, প্রিয়জন, কাছের সবাই কখনো আর্টিস্টকে ভুল বুঝে দূরে সরে গেলেও এক আর্টই বিশ্বস্ত বন্ধুর মতো পাশে থেকে যায়। জীবনে এমন সময় আসে, যখন বেঁচে থাকার সব আশা হারিয়েও কেবল নিজের সৃষ্টিকে আঁকড়ে ধরে মানুষ বাঁচতে চায়। নিজের সৃষ্টির চাইতে বড়ো ছায়া আর হয় না। প্রচণ্ড দুঃখের সময়ে দুঃখ ভুলতে………যে গাইতে জানে, সে গায়; সে ছবি আঁকতে জানে, সে ছবি আঁকে; যে লিখতে জানে, সে লেখে……যে কিছুই করতে জানে না, কেবলই কাঁদতে জানে, তার চাইতে অসহায় প্রাণী আর হয় না।)

তথ্যঋণ। লেখাটি প্রস্তুত করার সময় যেসকল উৎস থেকে সাহায্য নিয়েছি:

১. পঙ্কজ কুমার মল্লিকের আত্মকথা ‘আমার যুগ আমার গান’

২. শতবর্ষে বাণীকুমার: স্মরণে ও বরণে

৩. কলকাতা বেতার, সম্পাদনায় ভবেশ দাস, প্রভাতকুমার দাস

৪. আনন্দবাজার পত্রিকা’র অনলাইন সংস্করণ