মারুন কষে চড়, আসার আগেই ঝড়!

আমরা ফেসবুক / মেসেঞ্জার / ভাইভার / হোয়াটস্অ্যাপ / ইমো এসব কেন ব্যবহার করি? মূলত যোগাযোগ করার জন্যই তো? আরও আছে। কিছু অনুভূতি শেয়ার করা, বিভিন্ন তথ্য আদানপ্রদান করা; ছবি গান ফান শেয়ারিং তো আছেই!

কেউ-কেউ লেখালেখি করে ফেসবুকে। বাকিরা কী করে? মোটা দাগে বলতে গেলে, যোগাযোগ রক্ষা করে (কিংবা ভাঙেও!); ব্যক্তিগত কিংবা ব্যবসায়িক।

ভাইভার / হোয়াটস্অ্যাপ / ইমো এগুলি ব্যবহার করতে হলে ব্যক্তিগত মোবাইল নাম্বারটাও দিতে হয়। মানে, চাইলেই যেকেউই এগুলির ব্যবহারকারীকে ফোন করতে পারবেন।

এসবে ভিডিও কলও দেয়া যায়। স্মার্ট লোকজন ভিডিওচ্যাটিং করে। প্রয়োজনে, অপ্রয়োজনে।

আপনার আমার যে ছোট ভাই/বোনটি এখনও অনার্সে ওঠেনি, মানে পৃথিবীর চোখে মোটামুটি নোবডি হিসেবে আছে এখনও পর্যন্ত, তারাও এসব ইউজ করতে পারে। করেই তো! মোটামুটি সবাইই করে। করবে না-ই বা কেন? অ্যাত্তো মজা! এসবের স্বাদ একবার পেয়ে গেলে আর ছাড়া যায় নাকি?

ওদের সাথে একটু গল্প করে দেখুন তো, ওদের বুদ্ধি বিচার বিবেচনা কতটুকু! ওরা জীবনের তেমন কিচ্ছু বোঝে না। ওদের কাছে বর্তমানটাই সবকিছু। জীবনে আনন্দের সংজ্ঞা ওদের কাছে খুবই স্থূল ও অপরিপক্ব। আমি এটা বাজি ধরে বলতে পারি।

ওরা নাহয় ছোট, কিন্তু আপনি আমি তো আর ছোট না। ওরা জানে না, অনার্সে ভাল একটা জায়গায় পড়াশোনা করতে না পারলে জীবনটার মোড় খুব বাজেভাবে ঘুরে যেতে পারে। জীবনটা যে কতটা কঠিন, এটা বোঝার বয়সই তো ওদের হয়নি এখনও! ওরা ভাবে, ঘোরাঘুরি চ্যাটিং মিটিং ডেটিং ………. এইতো জীবন!

খোঁজ নিয়ে দেখুন, ওদের সরল, বাস্তবতা থেকে দূরে-থাকা প্রবল অনুভূতিপ্রবণ মন কত ভুল দর্শন নিয়ে চলছে। একটা দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার আগেই খবর নিন। আচ্ছা, দুর্ঘটনা ঘটছে না, এরকমও কিন্তু না। ঘটছেই তো! খবর নিয়ে দেখুন। এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা দুর্ঘটনাকেই ঘটনা হিসেবে নেয়। কিন্তু সত্যি কথা হল, দুর্ঘটনা কোন ঘটনা নয়। দুর্ঘটনা দুর্ঘটনাই। ম্যাট্রিক-ইন্টারের ছেলেমেয়েরা নিজ থেকেই এটা সাধারণত বুঝতে পারে না যে, পৃথিবীতে আসলেই ওর দুই পয়সারও পাত্তা নেই। এ সময়ে ওদের মাথায় কিছু সঞ্চয় করতে না পারলে, একটা কেরানির চাকরি পাওয়াও ভয়াবহ কঠিন হয়ে দেখা দেবে একটা সময়ে গিয়ে। আমি যথাযথ সম্মান রেখেই বলছি, আমার রুমের সামনে যে সিপাই দাঁড়িয়ে থাকে, ও অনার্স-মাস্টার্স পাসকরা। আমাদের অন্যান্য দপ্তরের সিপাইদেরও শিক্ষাগত যোগ্যতা কোনও অংশেই কম নয়। কেরানিদের কথা বাদই দিলাম। আমাদের কেরানি নিয়োগ পরীক্ষায় বিভিন্ন পাবলিক ভার্সিটি থেকে গ্রাজুয়েশন কিংবা পোস্টগ্রাজুয়েশন করা অনেকেই ফাইট করেন। ওদের কারওরই হয়তো মামা-চাচার জোর নেই, বেসিকেও সমস্যা, তাই চাকরি পেতেও সমস্যা। চাকরির বাজার বড় কঠিন! এখানে কম্পিটিশন আর ভাগ্য, এই দুই হাত ধরাধরি করে চলে। দুটোকেই সমন্বয় করে একটা চাকরি জোটাতে হয়। অন্ধ স্নেহভালোবাসা থেকে নয়, যুক্তি দিয়ে যাচাই করে দেখুন, আপনার আদরের সন্তান আপনার কোনও রকমের সাহায্য ছাড়া সম্পূর্ণই নিজের মেধায় একটা কেরানির চাকরি পাওয়ার যোগ্যতাও কি রাখে? চাকরি ব্যবসা একটু কম করুন। ছেলেমেয়ে মানুষ না হলে কি ব্যাংক ব্যালেন্স ধুয়ে পানি খাবেন?

যখন থেকে নতুন সিস্টেম এল, পাবলিক পরীক্ষায় বাজে রেজাল্ট করা কঠিন হয়ে গেল, তখন থেকে স্টুডেন্টদের বেসিকের ১২টা না, ২৪টা বাজা শুরু করল। ওরা শুধু ভালভাবে পাস করে (ভালভাবে পাস করবেই তো! ভালভাবে পাস না করা কি এত সোজা?), ধুমধাম বেয়াদবের মতো কথা বলাকে স্মার্টনেস মনে করে, ছেলেমেয়ে অবাধে ও অবৈধভাবে মেলামেশা করে, ওদের অনেকেরই অ্যাপিয়ারেন্স দেখলে ধরে চড় লাগাতে ইচ্ছে করে। ওদের মাথায় কিচ্ছু নেই। খুব শ্যালো চিন্তাভাবনা করে ওরা বেড়ে উঠছে। ওদের কাছ থেকে দেশ দূরে থাক, ফ্যামিলি তেমন কী-ই বা আশা করতে পারে? ওরা ওল্ডফ্যাশনড হ্যাকনিড রবীন্দ্রনাথকে না চেনাটাকেই স্মার্টনেস মনে করে।

ওদের সাথে মন খুলে কথা বলুন, বোঝান, বুঝতে না চাইলে ধরে কষে চড় লাগান; সত্যি লাগান, দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই! ম্যাট্রিক-ইন্টারের একটা স্টুডেন্ট হয় পড়াশোনা করবে, অথবা চড় খাবে। এর মাঝামাঝি আর কিছুই নেই। ওরা দামি মোবাইল কিনে দেয়ার জন্য বায়না ধরে, কিনে দিতে না পারলে নানানভাবে ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করে। ওদের বাবার কাছে জীবনের অর্থ যে, দুপুরের লাঞ্চটা কম টাকায় করে সে বেঁচেযাওয়া টাকা দিয়ে স্যারদের বেতন দেয়া, সেটার খবর রাখার সময় তার কই? ওদের অনেকে ড্রিঙ্কটিঙ্কও করে, সিগারেট ফুঁকে; এমনকি রুম ডেটিংও করে। আপনার সামনে এলে দেখাবে, ভাজা মাছটা উল্টে খেতে জানে না। কিন্তু আসলে হাড়ে-হাড়ে বদমায়েশ। বিশ্বাস না হলে, খোঁজখবর নিয়ে দেখুন।

আচ্ছা, ওদের ফেসবুক / মেসেঞ্জার / ভাইভার / হোয়াটস্অ্যাপ / ইমো এসবে কী কাজ? অনার্সে ওঠেনি যে স্টুডেন্ট, ওর একমাত্র কাজই তো হওয়া উচিত পড়াশোনা করা। আমরা তো মোবাইল ফোন ব্যবহার না করে বড় হয়েছি। খুব গাধা টাইপের স্টুডেন্ট ছিলাম নাতো! দুনিয়ার ইনফরমেশনটেশন একটু কম জানতাম হয়তো! কী দরকার বাপু অতো জেনে? কী এমন লাভ হচ্ছে এই প্রজন্মের ডিজিটাল ছেলেমেয়েদের? যে কোথাও চান্স পায় না, সমাজের চোখে তার আদৌ দাম আছে কোনও? আমি বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষা দিতে পারিনি। অনীকিনী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরম কেনার জন্য বাবার কাছে টাকা চাইলে বাবা বলেছিলেন, “তোকে অনীকিনী ভার্সিটিতেও অ্যাডমিশন টেস্ট দিতে হবে?” আমি লজ্জায় কিছু বলতে পারিনি, মাথা নিচু করে চলে এসেছি। সেদিন থেকে অপমানে আর জেদে ঘুমটুম বাদ দিয়ে পড়াশোনা করেছিলাম। (আমি তখন কোন ভার্সিটি কী, কেমন এর কিছুই জানতাম না। তাই আমার এ কথাটাকে কেউ দয়া করে অন্যভাবে নেবেন না।) চুয়েটের ভর্তি পরীক্ষায় মেধাতালিকায় ২য় হওয়ার পরও বুয়েটে পড়তে না পারার লজ্জায় সে খবর আত্মীয়স্বজন তেমন কাউকে জানাইনি। এখন তো দেখি চুয়েটে ওয়েটিং লিস্টে এলেও ছেলেমেয়েরা সেলিব্রেট করে! আমার এসব দেখলেও লজ্জা হয়! এ লজ্জা কিন্তু ওর একার না, এ লজ্জা আমার, আপনার, সবারই। আমরা কেউই এ ব্যর্থতার দায় এড়াতে পারি না।

ফেসবুক / মেসেঞ্জার / ভাইভার / হোয়াটস্অ্যাপ / ইমো এগুলি যে কী পরিমাণ সময় নষ্ট করে, সেকথা খুব ভেঙে না বললেও চলে। একটা ম্যাট্রিক-ইন্টার লেভেলের স্টুডেন্ট কতটুকু বুদ্ধি মাথায় নিয়ে চলে? ওদেরকে এক্সপ্লইট কিংবা ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করা যে কতটা সহজ, সেটা যে হারামজাদারা এসব বাজে জঘন্য কাজগুলি করে, তারা জানে। ওরা কম বুদ্ধি থাকার কারণে ধরে নেয়, জীবনটা এখানেই! ওরা যখনতখন ছবি ভিডিও ব্যক্তিগত তথ্য যাকেতাকে দিয়ে দেয়, যে সেলফি আর ভিডিওগুলি পাঠায় সেগুলির অনেকগুলিতেই গায়ে কাপড় থাকে না, পরে খুব গোপনে ব্ল্যাকমেইলিংয়ের শিকার হয়। আপনি কোনওদিনও জানতে পারবেন না। ওরা লজ্জায় কিংবা ভয়ে এসব কথা কাউকে বলে না। আস্তে-আস্তে হতাশা, পড়াশোনার আর জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা ওদেরকে গ্রাস করে, এবং একটা সম্ভাবনাময় স্টুডেন্ট এভাবে করে হারিয়ে যায়।

আমি আপনি কি জানি, আমাদের ছোট ভাইবোন কিংবা সন্তানটি বাসা থেকে বের হয়ে আসলে কোথায় যায়? স্কুল, কলেজ, কোচিং, স্যারের বাসায় যাওয়ার নাম করে কোথায়-কোথায় সময় কাটায়। কোচিং কিংবা স্যারের বেতনের টাকা মেরে দিয়ে সেটা আমোদফুর্তিতে খরচ করছে নাতো? রাতে আদৌ ঘুমায়, নাকি ফোনে জেগে থাকে? আমি বলি কী, রাতের বেলায় ওর কাছে ফোনটা রাখারই বা কী দরকার? ওদের বয়েসি স্টুডেন্ট এতটা সময় সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে দেবে কেন? স্টুডেন্ট বয়সে এত সোশ্যাল হওয়ারই বা কী দরকার? একটু গোয়েন্দাগিরি করুন; দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই! এর দরকার আছে। ওর বন্ধুদের সাথে পরিচিত হোন। ভাল স্টুডেন্টদের সাথে মিশতে না পারলে ভাল স্টুডেন্ট হওয়া যাবে না, এটা মোটামুটি পরীক্ষিত সত্য। রাস্তার ছ্যাঁচড়া বখেযাওয়া লুইচ্চা লাফাঙ্গা টাইপের ছেলেমেয়েদের সাথে মেলামেশা করার নেশা কিংবা চার্ম কিন্তু অপ্রতিরোধ্য। আমি আপনি খেয়াল না রাখলে ওরা ওরকম সঙ্গে মিশবেই। আমার আপনার সময়ে আমরা তো কম্পিউটার আর মোবাইল ফোনই হাতে নিয়েছি অনার্সে ওঠার পর। আমাদের সাথে ওদেরকে মিলালে ভুল হবে। ওদের বাজে কাজে সময় নষ্ট করার উপকরণের অভাব নেই।

একটা সময়ে গিয়ে দেখবেন, আপনার দরিদ্র ড্রাইভার কিংবা পিয়নের সন্তানটা খুব ভাল একটা সরকারি প্রতিষ্ঠানে চান্স পেয়ে বসে আছে, আর আপনার নিজের সন্তান কোথাও চান্স না পেয়ে গর্দভ বেহায়ার মতো আপনার মুখের দিকে চেয়ে আছে। তখন নিজেকে পুরোপুরি ব্যর্থ একজন মানুষ মনে হবে। লজ্জায় মুখ দেখাতে ইচ্ছে করবে না। ওকে দেখলেই প্রচণ্ড রাগে গা জ্বালা করবে। এর দায় কিন্তু ওর একার নয়; আমার, আপনার, সবার।